#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২০+২১
কড়া রোদ চোখে পড়তেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো জারা, গত রাতে ঘুমটা ভালোভাবে হয়নি। চেয়ে দেখলো আবরার অফিসের জন্যে তৈরি হচ্ছে…
‘ কয়টা বাজে এখন?’
‘ দশটা ‘
‘ কীহ! সকাল দশটা বেজে গেছে? তুমি আমাকে ডাকোনি কেনো আর তুমিই বা এখনও বাড়িতে কি করছো? কাজে যাওনি?’
‘ আমি যাচ্ছি, আর তোমার উঠতে দেরি হওয়ায় কি এমন ক্ষতি হয়ে গেছে?’
‘ তবুও আবরার, আমাকে ডেকে দেওয়া উচিত ছিলো তোমার। নাহলে অ্যালার্ম সেট করে দিতে। আম্মু কি ভাববে বলোতো, এতো দেরি আমার কখনো হয় না উঠতে ‘
‘ কেউ কিছুই ভাববেনা, আর আমার আম্মুও কিছু বলেনি। সো রিল্যাক্স! গতকাল অনেক ঘুমিয়েছিলে, তোমার এই ঘুমটা আজ প্রয়োজন ছিলো। এখন কেমন লাগছে?’
‘ আই অ্যাম ওকে! আমি এতো ইমোশনাল নই, কিন্তু গতকাল জানিনা কেনো ঐভাবে..’
‘ সবসময় রাফ এন্ড টাফ থাকতে হবে তার মানে নেই জারা, মাঝে মাঝে ইমোশনাল হওয়া ভালো। যাই হোক, ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও। আর আজ কাজে যাওয়ার দরকার নেই, আজকের দিনটা বিশ্রাম করো’
‘ হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। আজকে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না যাওয়ার, পরে নিশাকে ফোন করে জানিয়ে দেবো। আমি বরং গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি ‘
জারা ফ্রেশ হতে যাওয়ার পর ওর ফোনে অপরিচিত নাম্বারে একটি ফোন আসে, দু বার বাজতে বাজতে কেটে যাওয়ার পর ওয়াশরুম থেকে জারা বলে…
‘ আবরার, একটু রিসিভ করে দেখো তো কে এতোবার ফোন করছে ‘
‘ দেখছি ‘
আবরার কল রিসিভ করে, অপর পাশের ব্যক্তিটির কথা শুনে ও বারান্দায় চলে যায় এবং সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেই কথা বলে, এরপর নাম্বারটা ডিলিটও করে দেয়। একটু পরে জারা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েই প্রশ্ন করে…
‘ কার ফোন ছিলো?’
‘ রং নাম্বার ‘
‘ রং নাম্বারে এতোবার কল করছিলো?’
‘ কাজ না থাকলে মানুষ যা করে আর কি! তুমি এসব বাদ দাও, ফ্রেশ হয়েছো এবার গিয়ে খেয়ে নাও। আমি কিন্তু আম্মুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করবো। ভালো লাগছে না বলে যদি না খেয়ে থাকো তাহলে তোমার খবর আছে ‘
শাসনের সুরে আবরার কথাগুলো বলতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো জারা..
‘ শাসন করছো?’
‘ হ্যাঁ করছি, ভালোবেসে মাথায় তুললেই হয়না। মাঝে মাঝে শাসন করাও জরুরি ‘
গত রাত থেকে মনটা ভীষন খারাপ ছিলো, কিন্তু এখন আবরারের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো জারার…
‘ আচ্ছা বাবা, আর শাসন করতে হবে না। আমি সময়মতো তিন বেলা খেয়ে তোমাকে আপডেট জানাবো, আমার জন্যে আম্মুকে জ্বালাতে হবেনা ‘
‘ ওকে! ‘
আবরার যেতেই যাচ্ছিলো তখন জারা হুট করেই ওর হাত টেনে ধরলো, ফিরে তাকালো আবরার…
‘ আজকে সম্ভব হলে দুপুরের পর বাসায় চলে এসো ‘
‘ কেনো? আমাকে দিয়ে দরকার আছে?’
‘ তুমি কাল সারারাত জেগে ছিলে, দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে লম্বা ঘুম দেবে। দেখবে অনেকটা ফ্রেশ লাগবে ‘
কিছুটা অবাক হলো আবরার, গত রাতে বাসায় ফেরার পর জারা না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলো। ভেবেছিলো জারা ঘুমিয়ে গেছে, আবরার পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি তাই ওর পাশেই বসে ছিলো…
‘ তারমানে তুমি ঘুমানোর নাটক করছিলে? ভালোই অভিনয় জানো দেখছি, ড্রেস ডিজাইন না করে অ্যাকটিং করতে পারতে’
ফেলে চলে যাওয়া ” মা ” নামক যে মানুষটার জন্য এত বছর কষ্ট পেয়েছে তার জন্যে জারা নির্ঘুম রাত পার করে কষ্টটা বাড়িয়েছে বুঝে আবরার কিছুটা রেগে গেলো, ওর হাতটা ধরেই নিচু স্বরে জারা বললো….
‘ সরি! অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারিনি, তবে তুমি প্লিজ আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি ‘
কোনো উত্তর না দিয়ে মিনিট দুয়েক জারার দিকে চেয়ে রইলো আবরার, ক্ষণিকের জন্য রাগ হয়েছে বটে তবে এটাও অনুভব করলো যে জারার জায়গায় এখন হাজার চাইলেও নিজেকে ও বসাতে পারবে না। শত হলেও মহিলাটি জারার মা, আর মায়ের প্রতি যতোই ক্ষোভ থাকুক দিনশেষে সন্তানের মন তো কাঁদেই…
‘ ইটস ওকে, এখন এসব ভাবনা ছাড়ো। স্টে হ্যাপী ফর ইউরসেলফ ওকে?’
স্মিত হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো জারা, আবরার ও এবার বেরোলো। বেরোনোর পূর্বে জারার গালে ছোটো একটা চু’মু খেতে ভুল করেনি, অফিসে বেরোনোর পূর্বে এই কাজটা করা যেনো রীতিমতো আবরারের ডেইলি রুটিন হয়ে গেছে! জারা খাবার টেবিলের কাছে আসতেই ওর শ্বাশুড়ীকে দেখে..
‘ সরি আম্মু, আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে ‘
‘ তাতে কী হয়েছে? রোজ সকালেই তো ওঠো, একদিন দেরিতে দোষ নেই। এইযে খাবার বেড়ে দিয়েছি, খেয়ে নাও ‘
‘ হ্যা! উম্ম! আমি একটু আমার বাসায় যেতে চাইছিলাম। ভাবছি এবার গিয়ে কয়েকদিন থাকবো ‘
‘ বেশ তো, থেকে এসো। আমি পরে আবরারকেও পাঠিয়ে দেবো ‘
‘ থ্যাংক ইউ আম্মু ‘
শাশুড়ির সঙ্গে শুরু থেকেই জারার সম্পর্ক বেশ ভালো, এখনও শাশুরি বউমার মধ্যে কোনো সংঘাতের সৃষ্টি হয়নি। অবশ্য ছেলে যাকে নিয়ে ভালো থাকে তাকে সাদরে বরণ করে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ বুঝেই আবরারের মা জারাকে এতোটা আপন করে নিয়েছেন। অফিসে যাওয়ার পূর্বে আবরার একটা রেস্টুরেন্টে যায়, ভেতরে যেতেই কয়েকজনকে বসা দেখে। সকাল হওয়ায় কাস্টমার কম, তাদের মধ্যে মধ্য বয়স্ক একজনকে মহিলাকে দেখে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় আবরার। ভদ্র মহিলা উঠে দাঁড়াতেই, আবরার নিজের পরিচয় দিয়ে বলে…
‘ আমি আবরার, জারার হাসবেন্ড। সকালে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিলো ‘
‘ ওহ আচ্ছা, গতকালই জারা তোমার কথা বলছিল। ভেবেছিলাম দেখা করবো, অবশেষে দেখা হলো। বসো..’
চেয়ার টেনে বসলো আবরার, জারার মা সকালে ফোন করেছিলেন জারার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার উদ্দেশে কিন্তু আবরার জানিয়েছিল ও আসবে। মেয়েকে না দেখে জারার মা প্রশ্ন করেন…
‘ তুমি একা এলে? আমি তো ভেবেছিলাম জারাও…’
‘ আমি জারাকে জানাইনি আপনি ফোন করেছিলেন, আর গতকাল শুনেছি আপনি ওকে সবটা জানিয়ে দিয়েছেন তাই আমার মনে হয় না এখন ওর আর আপনার সঙ্গে দেখা করার কোনো কারণ আছে ‘
আবরারের কথায় জারার মা বুঝে গেছেন মেয়ের সঙ্গে ওনার আর দেখা করা হবেনা। নরম স্বরে তিনি বলেন…
‘ আমার মেয়েটার কাছে অনেক বড় দোষী আমি, জারার কাছে ক্ষমা চাইতে চাইছিলাম আজ। দু একদিনের মধ্যেই আমি ফিরে যাচ্ছি, তাই ভাবলাম…’
‘ আন্টি, জারার আপনার ওপর কোনো অভিমান নেই। ও আপনাকে কতটা ভালোবাসে সে সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই, আমি জানি। তবে সত্যিটা জানার পর জারা মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে। ও যাতে কষ্ট পায় তার থেকে আমি ওকে হাজার মাইল দূরে রাখার চেষ্টা করবো, সেই মানুষটা যদি ওর মা হয় তাও!’
‘ ওকে খুব ভালোবাসো মনে হচ্ছে!’
‘ অনেক সাধনার পর ওকে নিজের করে পেয়েছি, কতটা ভালোবাসি সেটা হয়তো আপনাকে পরিমাপ করে বলা সম্ভব হবেনা ‘
‘ যাক, শুনে ভালো লাগলো যে জারা এমন একজনকে পছন্দ করেছে যে ওর কথা এতোটা ভাবে। হয়তো আমাদের আর কখনও দেখা হবেনা, মা হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করিনি আমি তবে আজ মা হিসেবে একটা জিনিস চাইবো। আমার মেয়েটাকে সবসময় ভালো রেখো, ওর সঙ্গে থেকো ‘
জারার মায়ের সঙ্গে আবরারের আরো কিছু কথা হয়, আবরারকে উনি জারাকে সামলে রাখতে বলেন। মিনিট দশেক আলাপের পর দুজনে একে অপরকে বিদায় জানান, আবরার অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়। আবরার জারার মাকে জানিয়ে দিয়েছে জারার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে, মেয়ের বর্তমান জীবনের কথা ভেবে জারার মা ও এই বিষয়ে রাজি হয়েছেন। প্রথমবার মেয়েকে ছেড়ে যাওয়ার সময় কষ্ট না হলেও এবার কেনো যেনো কষ্ট হবে ওনার, হয়তো মেয়ের প্রতি মাতৃত্বের টান কিছুটা রয়ে গেছিলো!
_____________________________________
তেঁতুলের আচার খেতে খেতে বান্ধবীর সঙ্গে জম্পেশ আড্ডায় মজেছে জারা, কাজে আজ মন বসছিলো না তাই এলিনার সঙ্গে দেখা করতে ওর শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছে। এলিনার শ্বাশুড়ি মানুষ হিসেবে অনেক ভালো, জারা এলে ওকে নিজের হাতে কিছু না কিছু বানিয়ে খাওয়ান। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দুপুরের খাবার শেষে বিছানায় বসে টিভি দেখছিলো ও আড্ডা দিচ্ছিলো দুজনে, এরই মাঝে এলিনা প্রশ্ন করে…
‘ কিরে, তোদের দুজনের মধ্যে তো এখন খুব প্রেম চলছে তাইনা? আমাকে ফোন করার সময়ও পাস না এখন ‘
‘ কিযে বলিস না, আমাদের ওরকম প্রেম করার সময় কই? হাতে যখন সময় পাওয়া যায় তখন…’
‘ যাক, তারমানে সত্যিই তোদের দুজনের মধ্যে প্রেম চলছে। স্বীকার করেছিস নিজের মুখেই ‘
এলিনার কথায় কিছুটা লজ্জা পেলো জারা..
‘ কিসের প্রেম হ্যা? আমরা কলেজ স্টুডেন্ট নাকি যে প্রেম করবো? এটা বলতে পারিস যে আমরা দুজনে সংসার করছি ‘
‘ দেখ, বিয়ের আগে যারা প্রেম করে না তারা বিয়ের পর সংসার প্রেম দুটোই করে। তোরাও তাই করছিস, এটা অস্বীকার করার কি আছে?’
‘ অস্বীকার কখন করলাম!’
‘ জানিস, এখন যদি আবরার তোর জায়গায় থাকতো। হাসতে হাসতে বলতো হ্যা, আমরা বউ জামাই হিসেবে প্রেম করছি ‘
‘ উফফ! এই লোকটা না কি যে করে…এলিনা থাম তুই এবার!
কিছুদিন আগে জারার আরও কিছু বন্ধুরা হাসবেন্ড সহ এসেছিলো, ছোটখাটো একটা রিউনিয়ন হয়েছে। সেখানে সবার সামনে আবরার কিছু ঠোঁ’ট’কা’টা কথা বলেছিলো, তার প্রসঙ্গ তুলেই এলিনা মজা করলো। এরই মাঝে হুট করে এলিনা জারার হাতটা ওর ছয় মাসের উচু পেটটার ওপর ধরে প্রশ্ন করলো…
‘ কিছু ফিল হচ্ছে?’
জারা থেমে থেমে কিছুটা কাঁপুনি অনুভব করতেই উচ্ছ্বাসিত হয়ে প্রশ্ন করলো…
‘ বেবী কিক করছে এখনি?’
‘ এটা তো কিছুইনা, ডাক্তার বলেছে সাত – আটমাস হলে আরো নড়াচড়া করবে। আমার শ্বাশুড়ি তো আমাকে রীতিমতো ভয় দেখাচ্ছে যে শেষ দুই মাস নাকি এত নড়াচড়া করে যে আমি ঘুমাতেই পারবো না ‘
জারা এলিনার পেটের উপর কান পেতে শুনলো বেবীর হার্টবিট শোনার চেষ্টা করলো..
‘ ওয়াও! পেটের ভেতর একজন নড়ছে, তখন তোর অদ্ভুত একটা ফিলিং হয় না? আমার তো হাতে ছুঁয়েই শরীর শিউরে উঠলো’
‘ হ্যা রে, এখন তো নড়াচড়া টের না পেলে চিন্তা হয়। যেদিন নিজে মা হবি সেদিন বুঝবি এই অনুভূতিটা কত সুন্দর। আমি তো বলি তুইও বাচ্চা নিয়ে নে এবার’
বাচ্চার কথা শুনেই মুখের হাসি উবে গেলো জারার, না চাইতেও হঠাৎ মনে পড়লো নিজের মায়ের কথা। বেহায়া মনটা না চাইতেও অনেক সময় পুরোনো কথা মনে করিয়ে দেয়, জারার মলিন মুখটা দেখেই এলিনা ওর কাধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো…
‘ মুখটা অমন হয়ে গেলো কেনো?’
‘ কিছুনা ‘
এলিনা বুঝলো কি হয়েছে…
‘ জারা, আগেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে চাস কেনো? কত রেসপন্সিবল একটা মানুষ তুই, সব কত সুন্দর হ্যান্ডেল করে নিস আর নিজের বাচ্চাকে সামলাতে পারবি না? পরে দেখবি তুই বেস্ট একজন মা হবি ‘
বান্ধবীর কথার উত্তর দিলো না জারা তবে বিষয়টা কেনো যেনো ওর মস্তিষ্কে গেঁথে গেলো। রাতে… জারা আজ অনেকদিন পর ওদের সেই বিয়ের চুক্তির কাগজটা বের করে দেখছে, কিছুদিন যেনো এর কথা ভুলেই গেছিলো। আজ হঠাৎ কি মনে করে বের করেছে, আবরারের আজ ফিরতে দেরী হয়েছে। ও এখন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছে, একটু পর আবরার বের হতেই জারা হুড়মুড় করে কাগজটা ড্রয়ারে রেখে দেয় তবে আবরারের চোখে পড়েছে…
‘ কি রাখলে ওভাবে?’
‘ এমনি, একটা কাগজ ‘
মাথা মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আবরার…
‘ কাগজ নাকি লাভ লেটার দিয়েছে কেউ?’
‘ আমাকে কে লাভ লেটার দিতে যাবে, আমার তোমার মতো ওরকম স্পেশাল ক্লায়েন্ট নেই যে সুযোগ বুঝে আমার সঙ্গে কফি খাওয়ার জন্যে আসে ‘
জারার কথা শুনে আরো এক দফা হাসলো আবরার…
‘ আহহা! স্টিল জেলাস? আমার বউটা এতো জেলাসি কোথায় যে লুকিয়ে রাখে ‘
‘ আই অ্যাম নট জেলাস, তোমাকে একটা উদাহরণ দিলাম ‘
তোয়ালে রেখে জারাকে নিজের কাছে টেনে কোমড় জড়িয়ে ধরলো আবরার, গালে হাত বুলিয়ে বললো…
‘ বাহানা করতে হবে না ‘
‘ বাহানা করতে যাবো কেনো?’
‘ মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে, তাই নিশ্চিন্ত থাকো। ও আর এখন ওর স্বামীকে রেখে আমার সঙ্গে কফি খেতে আসবে না ‘
আবরারের চুলগুলো ভালোভাবে মোছা হয়নি, টপটপিয়ে পানি পড়ছে। জারা পাশ থেকে তোয়ালে তুলে ওর মাথা মুছে দিতে দিতে বললো…
‘ না এলেই ভালো ‘
‘ মুখটা এমন করে থাকবে না তো, আই ডোন্ট লাইক দিজ’
‘ ডু ইউ লাইক মি?’
ভ্রু কুঁচকে তাকালো আবরার…
‘ এতোদিন পর তোমার মনে এই প্রশ্নের জাগরণ হওয়ার কারণ?’
‘ সত্যি করে একটা কথা বলবে?’
‘ কি?’
‘ আমার মন রাখার জন্য উত্তর দেবেনা, যা সত্যি যেটা তুমি মন থেকে ভাবো সেটাই বলবে। আমি জানতে চাই ‘
‘ তুমি তো আমাকে ভয় দেখাচ্ছো, কি জানতে চাও?’
‘ আমাকে পার্সোনালি তোমার কেমন লাগে?’
বেশ সিরিয়াসভাবেই প্রশ্নটা করলো জারা, উত্তর না দিয়ে উপায় নেই বুঝে আবরার কিছুটা ভেবে বললো…
‘ মাঝে মাঝে তোমার কিছু কর্মকাণ্ড, ভাবনা ও আচরণে বিরক্ত হই বটে তবে ঠান্ডা মাথায় বসে যখন নিজেকে তোমার জায়গায় রেখে ভাবার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা করি তখন বুঝি তুমি কেনো অমন করছো। এছাড়া তোমার আর কোনো বিষয়ে আমার অভিযোগ নেই, ইউ আর পারফেক্ট ফর মি’
জারা মনোযোগ দিয়ে মিনিট দুয়েক কিছু একটা ভেবে বললো…
‘ আমি নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করবো’
এবার আরো অবাক হলো আবরার, জারার থুতনি ধরে মুখটা উচু করে ধরে তাকালো। তীক্ষ্ণ নজরে প্রশ্ন করলো…
‘ তোমার হঠাৎ কি হলো, নিজেকে বদলাতে যাবে কেনো? তুমি পাল্টে গেলে আমি কিন্তু তোমাকে আর ভালোবাসবো না’
‘ ভালোবাসবে না মানে কি? আমি মানুষটা বদলে যাবো নাকি?’
‘ তুমি নিজেকে বদলাতে চাইছো, একটা মানুষকে তার ব্যক্তিত্ব রিপ্রেজেন্ট করে। আমি কিন্তু তোমাকে দেখে প্রেমে পড়িনি জারা, আই লাইক ইওর পার্সোনালিটি ‘
‘ কিন্তু…’
‘ নিজেকে চেঞ্জ করার কথা ভেবো না, আমরা দুজন যেমন আছি তেমনি থাকবো। বিপরীত ব্যক্তিত্বের দুজন মানুষ একে অপরকে সহ্য করবে, বুঝবে এটাই তো মজা তাইনা? দুজনে এক রকম হয়ে গেলে আর সংসার করার মজা রইলো কোথায়?’
এবার হাসলো জারা, পুরুষটা কতো সহজেই সব সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে জারা ভাবে এই পুরুষটি না থাকলে আজ জীবনটা কেমন হতো? আর অন্য কোনো পুরুষ এলেও বা এভাবে কি ওকে বুঝতো? এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ জারার হুশ হলো আবরার এখনও ওর কোমড় জড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…
‘ এভাবে আমাকে ধরে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
আবরার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে জারাকে আরো কাছে টেনে বললো..
‘ আমার বউ আমার ইচ্ছা, যতক্ষণ ইচ্ছে ধরে রাখবো ‘
‘ আচ্ছা যতো ইচ্ছে ধরে রেখো, কোলে বসিয়ে রেখো সারাদিন সমস্যা নেই। অন্তত টি শার্টটা তো পড়ে নাও। আমি এনে দিচ্ছি, কোনটা পড়বে বলো’
জারা যেতে চাইলো কিন্তু আবরার তো ছাড়লোই না উল্টে জারাকে এবার আরো কাছে টেনে যেনো নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো, জারার কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুঝে বললো। আবরারের ভারী নিঃশ্বাস জারার মুখে আছড়ে পড়ছে, লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর স্বরে আবরার বললো…
‘ ড্রয়ারের ওই কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিও ‘
এবার চোখ খুলে তাকালো জারা, আবরার এখনও চোখ বুজেই আছে কিন্তু মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে চুক্তির কাগজটা আবরার একটু ওকে পড়তে আগে দেখেছে। একটু আগেও যে পুরুষটা মজা করছিলো তার মুখটা হঠাৎই কেমন থমথমে হয়ে গেছে। আবরার আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জারাকে, এবার জারার নাকে নাক ঘষে বললো…
‘ কাগজটা দেখলে আমার বুক পোড়ে জারা। মনে হয়, ওটার বাহানা দিয়ে তুমি আমার থেকে দূরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আমি চাইনা তুমি আমার থেকে কখনো দূরে যাও, তুমি সবসময় আমার কাছে থাকবে বুঝেছো? ‘
ফিসফিসিয়ে বলা আবরারের কথাগুলো জারার পুরো শরীর কেমন ঠান্ডা করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ যদি জারা ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কিছু বলে তবে আবরার হয় ওকে কিছু করে ফেলবে, নইলে নিজেকে!
‘ তুমি আজ ওটা কেনো দেখছিলে? সাম হাউ, তুমি কি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছো?’
আবরার হুট করেই অস্থির স্বরে প্রশ্নটা করে বসলো, এইটুকু বিষয়েই এতোটা অশান্ত হয়ে গেছে তাহলে সত্যিই যদি চলে যায় তাহলে এই পুরুষটির কি হবে? জারা এবার জড়িয়ে ধরলো আবরারকে…
‘ কেউ কোথাও যাচ্ছে না ‘
জারার কথার কোনো উত্তর দিলো না আবরার, জারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এতোটাই শক্ত করে জড়িয়েছে নিজের সঙ্গে যেনো নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে পারলে শান্তি পেতো, জারার দম বন্ধ হয়ে আসছে তবুও… ছাড়ানোর চেষ্টা করেনি উল্টে পুরুষটির হৃদপিণ্ডের টুমটাম অনুভব করছে। এতোটা অস্থির হয়ে গেছে সে? ঘাড়ের ওপর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে মেয়েটা, মিনিট দুয়েক পর আবরার ছেড়ে দিলো ওকে। টি শার্ট খোঁজার উদ্দেশ্যে হয়তো কাবার্ডের কাছে যেতে যাচ্ছিলো তখনই হুট করে জারা ওকে আটকে দাড়ালো, পায়ের আঙ্গুলে ভর করে নিজেকে সম্মুখে দাড়ানো পুরুষটির দু গাল আলতো করে ধরে ছুঁয়ে দিলো ওষ্ঠোজোড়া। একটু আগে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে সরে এসেছিলো আবরার, কিন্তু জারা নিজেই যে ওকে সীমানা লঙ্ঘনের অনুমতি দিয়ে দিলো…
_______________________________________
দুদিন পর বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে জারা, ঠিক করেছে এখানে কয়েকদিন থাকবে। বাবার সঙ্গে এতগুলো বছরে সে সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি সেগুলো কিছুটা পূরণ করবে। হুট করেই মেয়ের আগমনে আনোয়ার সাহেব খানিকটা অবাক হয়েছেন বটে…
‘ আরে জারা, এতদিন পর বাসার কথা মনে পড়লো?’
‘ ব্যস্ত ছিলাম বাবা ‘
‘ তা তুমি একা কেনো? আবরার কোথায়?’
‘ তোমার কাছে তো দেখছি মেয়ের থেকে মেয়ের জামাই বেশি প্রিয়, আসতে না আসতেই ওর কথা জিজ্ঞাসা করছো?’
‘ কারণ আমার মেয়ের থেকে মেয়ের জামাই আমাকে ভালো বোঝে, ছেলেটা আমার থেকে বয়সে এত ছোট তবুও মনে হয় যেনো আমার বন্ধু ‘
‘ এতদিনের জন্যে সরি বাবা, এখন থেকে তোমার মেয়েও তোমাকে বোঝার চেষ্টা করবে’
‘ মানে?’
‘ কিছুনা! আমি এবার কয়েকদিন থাকবো এখানে বুঝলে, বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে সেভাবে আমার থাকাই হলো না ‘
মেয়ের কথার মানে বুঝলেন না আনোয়ার সাহেব তবে আজকে অন্যান্য দিনের তুলনায় মেয়ের আচরণ অনেকটা নমনীয় লাগছে তার, জারা যে এতো নরম স্বরে তার সঙ্গে তেমন কথা বলেনা! ফ্রেশ হয়ে এসে আজ রান্নাঘরে ঢুকেছে জারা, ঠিক করেছে যে কদিন এখানে থাকবে রান্না ওই করবে। বাবার পছন্দের খাবারগুলো বানিয়ে বাবাকে খাওয়াবে। জারাকে রান্নাঘরে দেখেই হাসনা বেগম বলে উঠলেন…
‘ এখানে কি কাজ?’
‘ আমি রান্না করবো আজকে, আপনাকে করতে হবে না’
‘ ঠিক আছে করো। তা, বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই আজ বাসার কথা মনে পড়লো কেনো?’
রান্নার জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিস ফ্রিজ থেকে বের করতে করতে বাঁকা হেসে জারা উত্তর দিলো…
‘ আমি আমার বাসায় আসবো তাতেও আপনার সমস্যা হচ্ছে নাকি এখন?’
‘ আরে নাহ, তুমি এই বাড়ির বড় মেয়ে এই সত্যিটা তো আর পাল্টে যাবেনা। অবশ্যই এখানে আসার অধিকার তোমার আছে, তবে বিয়ের এতদিন পর হুট করে এলে তো তাই জিজ্ঞাসা করা’
‘ আপনার মত সারাদিন যদি বাড়িতে বসে থাকতাম তাহলে প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহেই আসতে পারতাম, কিন্তু কি করবো বলুন কাজের ব্যস্ততা আছে। অবশ্য ওসব আপনি বুঝবেন না ‘
জারার কথা শুনে দাঁত কিটমিটিয়ে হাসলেন হাসনা বেগম, অবশ্য জারার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই এরকম কিছু হয় সেটা উনি জানেন। আজ অব্দি জারা ছেড়ে কথা বলেনি। হুট করেই উনি প্রশ্ন করে বসলেন..
‘ আচ্ছা, আবরারের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছো নাকি?’
‘ হঠাৎ এটা কেনো মনে হলো’
‘ তোমার যা কথার ধা’র, আমরা বাড়ির মানুষ সহ্য করি বলি পরের ছেলে ওসব কথা সহ্য করবে না’
‘ দিবা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারেন, তবে সত্যিই যদি আমি আবরারের সঙ্গে ঝগড়া করে এ বাড়িতে আসি সেটা নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি ছাড়া এই বাড়িতে নিশ্চয়ই দিব্যি আছেন’
হাসনা বেগম এবার থামলেন, বুঝলেন জারা শ্বশুরবাড়ি থেকে ঝামেলা করে আসেনি। ওনার ধারনা ছিলো জারা ওর শ্বশুরবাড়িতে টিকতে পারবে না, কিন্তু জারার কথা শুনে বুঝলেন ওনার ধারনা ভুল!
চলবে…