সাজিয়েছি এক ফালি সুখ পর্ব-০২ + বোনাস পর্ব

0
103

#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০২

রাতে বাড়ি ফিরে আজ ডিনার করেনি জারা, না চাইতেও রোজ সবার সঙ্গে বসে ডিনার করতে হয় কারণ এটা ওর বাবার আদেশ ছিলো। কিন্তু আজ সকালের ঘটনার পর অন্তত একসঙ্গে বসে খাওয়ার ইচ্ছেটাই আর নেই। আপাতত ব্যক্তিগত বিষয় বাদ দিয়ে কাজের ব্যাপারে ভাবছে জারা, আবরারের দেওয়া অফারটা কাজে লাগাতে হবে। ঠিক করেছে হাতে থাকা সময়ের জন্যে নতুন দুই – তিনটা ড্রেস ডিজাইন যেভাবেই হোক করতে হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ, ওর ঘরে কিছু ড্রাই ফ্রুটস ছিলো। সেগুলো খেতে খেতেই স্কেচ বুক আর পেন্সিল নিয়ে বসলো জারা। ঘন্টাখানেক পর হাসনা বেগম খাবার নিয়ে এলেন জারার রুমে, জারা ওনাকে দেখেও না দেখার ভান করলো। হাসনা বেগম বললেন…

‘ আজ সকালে তোমার বাবা না বললো তার জন্যে রাগ করো না জারা, আসলে ওনার বয়স হচ্ছে তো। কি ভেবে কি করছে নিজেই বুঝতে পারেনা মাঝে মাঝে। আমি ওনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবো। উইলের বিষয়টা…’

‘ নো থ্যাংকস, এটা আমার আর আমার বাবার মধ্যকার ব্যাপার আর এ বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমিই নেবো। আপনার বাবাকে কিছু বলতে হবেনা ‘

‘ দেখো জারা, আমি জানি তুমি তোমার বাবার এই সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছো আর সেটাই তো স্বাভাবিক তাইনা! উনি সব জেনেও এমন একটা সিদ্ধান্ত জোর করে তোমার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে আমি তোমার পক্ষে আছি, তুমি যা করবে তাতেই আমি খুশি ‘

‘ তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমার বিয়ে করা উচিৎ হবেনা?’

‘ এটা তো তোমার সিদ্ধান্ত ছিলো তাইনা? আমার মনে আছে তুমি মাধ্যমিক পরীক্ষার পরই বলেছিলে কখনো বিয়ে করবে না। আর বিয়েটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার, মেয়ে বলেই বিয়ে করতে হবে তার তো মানে নেই তাইনা?’

হাসনা বেগমের কথাগুলো শুনে জারা বেশ বুঝতে পারছে উনি কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন, উনি যে তার ছেলেমেয়ের লাভের জন্যে এখানে আজ জারার পক্ষে এসে কথা বলছেন তাও জারার অজানা নয়। হাসনা বেগম আরো কিছু কথা বললেন কিন্তু জারা তার উত্তরে কিছু না বলে শুধু শুনলো। এরপর হাসনা বেগম বেরিয়ে যাওয়ার পর জারা দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার ওপর শুয়ে পড়লো। সম্পত্তির সবটা যাতে নিজের ছেলেমেয়ে পায় এই উদ্দেশ্যে উনি জারাকে বিয়ে না করার জন্যে বুঝিয়ে গেলেন সেটা জারা বেশ বুঝেছে। এ সবে শুরু, দিনদিন উনি যে জারাকে বিয়ের ব্যাপারে আরো বেশি নিরুৎসারিত করার চেষ্টা করবেন এ ব্যাপারেও জারা নিশ্চিত। কিন্তু জারা যে ভীষন জেদী, একবার যখন ঠিক করে ফেলেছে সম্পত্তির ভাগ ছাড়বে না তখন কিছুতেই ছাড়বে না! ওদিকে আবরার এখনও নিজের অফিসে, সামনে যে নতুন নেকপিসটা লঞ্চ করবে সেটার কাজেই ব্যস্ত। ডিজাইন করা কমপ্লিট হয়ে গেছে, এবার শুধু এটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অপেক্ষা। আবরারের সেক্রেটারি ওর রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে…

‘ স্যার, রাত দশটার বেশি বাজে। আপনি বাড়ি যাবেন না?’

‘ না, আমার কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। আজকে বাসায় যাবো না। আপনি চলে যান ‘

‘ আপনার কি আর কিছু প্রয়োজন আছে? তাহলে আমি দিয়ে যাই, খাওয়ার জন্যে কিছু দেবো?’

‘ নো থ্যাংকস, খুদা লাগলে আমিই খেয়ে নেবো। আপনি যান, গুড নাইট ‘

‘ গুড নাইট, স্যার!’

অফিসের সব লাইট বন্ধ করে দিয়ে সেক্রেটারি চলে যায়, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে আবরারের। এ মুহূর্তে বাড়ি যাওয়ার মতো শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই ওর মাঝে, মনে হচ্ছে এখনই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাবে। ডেস্কের ওপর থেকে সবকিছু গুছিয়ে রেখে আবরার কিছু খাবার খেতে খেতে বিশাল কাছের জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দূর আকাশে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের কিঞ্চিৎ ঝলকানি নজরে পড়ছে, রাতে হয়তো বৃষ্টি আসবে। খেতে খেতেই কি একটা ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে কনট্যাক্ট লিস্টে গিয়ে জারার নাম্বারটা বের করলো, একবার ভাবলো কল করবে আবার ভাবলো এতো রাতে কল করা উচিত হবেনা। মেসেজ করাই ভালো হবে, পরমুহূর্তেই সব বাদ দিয়ে ফোনটা আবারো পকেটে রেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো আবরার…

‘ মনে হয়, এবার আপনাকে কোনো একদিন কফি খাওয়ার জন্যে ইনভাইট করতে হবে। ফোন কল বা মেসেজিং এর থেকে সেটাই বেটার অপশন হবে’
________________________________

প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেছে, হাসনা বেগম রোজই জারাকে বুঝ দিচ্ছে বিয়েটা না করার জন্যে। এসবে অতিষ্ট হয়ে জারা কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলো। আজ ছুটির দিন, বান্ধবীর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে এসে জারা জানালো..

‘ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, বিয়ে করবো আমি ‘

‘ মানে! এতো সহজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি? তুই না জীবনে বিয়ে করবি না?’

‘ মাঝে মাঝে জীবনের তাগিদেই কিছু সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়, আমিও সেটাই করছি। তুই জানিস না মিসেস. হাসনা আমার বিরুদ্ধে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র করছেন। ওনার উদ্দেশ্য আমি কিছুতেই সফল হতে দেবো না ‘

‘ ওকে ফাইন, কিন্তু ছেলে পেলি কোথায়? কাকে বিয়ে করবি? নাকি আঙ্কেলকে বলেছিস ছেলে দেখতে?’

‘ এই একটা বিষয়ই এখন বাকি আছে, একটা ছেলে দরকার। বাবার পছন্দের ছেলে বিয়ে করবো না আমি, আমার এমন ছেলে দরকার যে আমার শর্ত মানতে রাজি হবে ‘

‘ তোর আবার কিসের শর্ত? তুই নিজেই তো এক শর্ত মানতে বিয়ে করবি সেখানে আবার তুইও ছেলেকে শর্ত দিয়ে বসবি?’

‘ অবশ্যই, তোর মনে হয় সবকিছু আমার জন্যে এত সহজ হবে? বিয়ে আমি একটা চাপে পড়ে করছি, সত্যি সত্যি নয়। এটা তুইও জানিস ‘

‘ হ্যা কিন্তু, তুই কি করতে চাইছিস আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না জারা ‘

‘ তোকে বুঝতে হবেনা, তুই এক কাজ কর। আমাকে তোর চেনাজানা যত ছেলে আছে মানে আমাদের সমবয়সী আর কি, ওদের নাম্বার দিয়ে দে। আর তোর হাসবেন্ডের পক্ষের কেউ থাকলে তাদের নাম্বারও দিস। সবার সঙ্গে কথা বলে, দেখা করে তারপর আমি আমার মন মতো একটা ছেলে বাছাই করবো ‘

‘ ফাইন, আমার চেনাদের নাম্বার আমি তোকে টেক্সট করে দেবো। তবে জারা, যাই করিস চিন্তা ভাবনা করে করিস। ঝোঁকের বশে এমন কিছু করিস না যাতে ভবিষ্যতে সমস্যা হয় ‘

‘ চিন্তা করিস না, আমি সব ভেবেই কাজ করবো ‘

আবরার আজ বাসায়, ওর বড় আপু আয়েশা এসেছে সকালে। ওর সঙ্গেই বসে টুকটাক গল্প করছিলো তখন আবরারের বাবা নওয়াজ সাহেব এসে বসলেন, ছেলের সঙ্গে কিছুদিন ধরে উনি দরকারি কিছু কথা বলতে চাইছেন কিন্তু ছেলেকে তো বাড়িতেই পাননা। বসেই উনি আবরারকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন…

‘ তোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি একটু শুনি ‘

‘ সামনের মাসে একটা নতুন নেকপিস লঞ্চ করবো, আপাতত সেটার কাজই চলছে। এটায় যদি পজিটিভ রিভিউ পাই তাহলে… ‘

‘ আমি কাজের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করিনি, ব্যক্তিগত ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছি। বিয়েশাদী করার ইচ্ছে আছে নাকি নেই?’

‘ ওহ প্লিজ আব্বু, এখনই কিসের বিয়ে?’

‘ কিসের বিয়ে? আবরার, তোর এই বয়সে তোর মায়ের আর আমার বিয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেছিলো। আর তুই ছেলে এখনও বিয়েই করলি না?’

‘ যুগ বদলেছে আব্বু, এখন এতো জলদি কেউ বিয়ে করেনা। মেয়েরাও তো এতো জলদি বিয়ে করেনা, আর আমি তো… ‘

‘ তোর ওসব কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই, আমার পরিচিত সবার ছেলে মেয়ে বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেছে, নাতি নাতনী হয়ে গেলো সবার। এবার তোকেও বিয়ে করতে হবে। তেত্রিশ বছর হয়ে গেছে তোর ভুলে যাস না। কিন্তু আমি তো ঠিকঠাক মেয়েই খুজে পাচ্ছিনা’

আবরারের মা আজ সকালে কিছু দুধপুলি পিঠে বানিয়েছেন, সবাইকে এনে সেগুলো খেতে দিলেন। আবরার চামচ দিয়ে একটা পিঠা তুলে খেতে খেতে বললো…

‘ আব্বু, আমার জন্যে মেয়ে খুঁজতে তোমাকে এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি একজনকে পছন্দ করি ‘

আবরারের কথা শুনে ওর মা বাবা ও বোন অবাক চোখে তাকালো, নওয়াজ সাহেব তার স্ত্রীর চেয়ে বলে উঠলেন…

‘ তোমার ছেলের কান্ড দেখেছো? এদিকে আমি ওর সঙ্গে ম্যাচ করবে এমন মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিনা, কাউকেই নাকি ওর পছন্দ হয় না আর আজকে তোমার ছেলে বলছে ও কিনা একজনকে পছন্দ করে?’

‘ আবরার, তুই সত্যিই কাউকে পছন্দ করিস?’

‘ হ্যা আম্মু ‘

‘ মেয়েটা কে আবরার? আমাকেও কখনো বললি না তুই? ছবিও দেখালি না?’

‘ সরি আপু, আসলে আমি নিজেই শিওর ছিলাম না এতদিন। তবে এখন আমি শিওর তাই তোমাদের সবাইকে জানিয়ে রাখলাম, আমার জন্যে মেয়ে দেখতে হবে না ‘

‘ এভাবে হুট করে বললেই তো আলোচনা শেষ হয়ে যাবে না। মেয়ে পড়াশুনা করেছে কতদূর? মেয়ের পরিবার কেমন আর বাবা কি করে?’

‘ মেয়ের পরিবার সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা আব্বু, আমি শুধু মেয়েটার সম্পর্কে জানি আর আমার মনে হয় ওর সম্পর্কে জানাই আমার জন্যে যথেষ্ট ‘

‘ বিয়ের ব্যাপারে শুধু ছেলে বা মেয়ের সম্পর্কে জানলেই হয় না আবরার, বিয়েটা শুধু ছেলে আর মেয়ের হয় না। এটা দুটো পরিবারের একটা মেল বন্ধন। তুই মেয়ের বাড়ির ঠিকানা বল, আমি গিয়ে কথা বলবো ‘

‘ আহা, আগে ছেলে কি বলছে সেটা শুনে নাও। আগেই তুমি মেয়ের বাড়ি গিয়ে কি কথা বলবে? আবরার তো বলছে ও নিজেই মাত্র বুঝতে পেরেছে ও মেয়েটাকে পছন্দ করে ‘

‘ পছন্দ যখন করে তারমানে ওদের উভয় পক্ষ থেকেই মত আছে, তাহলে কথা বলতে সমস্যা কি?’

‘ মেয়েটা জানেনা আব্বু, আমি ওকে এখনও কিছু বলিনি তাছাড়া ও আমার চেনা পরিচিত বা বন্ধু নয় যে এতো সহজে বলে দেবো। একটু সময় দাও আমাকে ‘

‘ বেশ, তুই তাহলে তুই মেয়েটাকে আগে জানিয়ে তারপর আমাকে বলিস। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলবো ‘

‘ ঠিক আছে আব্বু ‘

দুই বছর আগে আবরার জারার ফ্যাশন হাউজের ইনভেস্টর হয়, জারার সঙ্গে স্বল্প কয়েকদফা সাক্ষাৎ হয়েছে ওর। তবে এই স্বল্প সাক্ষাতেই আবরারের জারাকে ভালো লাগে, ধীরে ধীরে এই ভালো লাগা আরো গভীর হয়। ধীরে ধীরে আবরার উপলব্ধি করে জারাকে ও অনেকটা বেশিই পছন্দ করে, এতদিন ও এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলো না তবে ইদানিং আবরার জারার প্রতি নিজের অনুভূতির বিষয়ে নিশ্চিত। বাড়িতেও আজ বিষয়টা সবাইকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো, এবার শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। যাকে ঘিরে সবকিছু, তাকে জানাতে হবে।
__________________________________

বিকেলে বড় বোনের সাত বছরের মেয়ে ফিহাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলো আবরার। ফিহা মারাত্মকভাবে মামার ভক্ত। নানুবাড়ি এলে যতটা সময় মামাকে কাছে পায় পিছুই ছাড়েনা। আবরারও অনেক আদর করে ওকে, একমাত্র ভাগ্নি বলে কথা।

‘ বাসায় যাওয়ার আগে কিছু খেতে চাও ফিহা?’

‘ হ্যা মামা, আমি চকলেট পেস্ট্রি খাবো ‘

‘ ঠিক আছে, তুমি তাহলে গাড়িতে বসো আমি নিয়ে আসছি ‘

‘ না মামা, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। প্লিজ!’

ভাগ্নি এমনভাবে আবদার জুড়ে বসলো যে আবরার আর না করতে পারলো না, পরে ওকে নিয়েই আবরার কফি শপে গেলো। ফিহাকে একটা মিল্কশেক দিয়ে বসিয়ে দিলো, আর কাউন্টারে এসে পেস্ট্রি কিনছিলো তখন একটা টেবিলে একটি ছেলের সঙ্গে বসা অবস্থায় জারাকে দেখতে পেলো। ছেলেটা একটু পর চলেও গেলো, আবরার বুঝলো হয়তো আরো আগেই ওরা এখানে এসেছিলো। ছেলেটা যেতেই আবরার এগিয়ে এলো, জারা ওকে দেখে কিছুটা অবাক হলো…

‘ মিস্টার. আবরার! আপনি এখানে?’

‘ ইয়াহ, ভাগ্নির জন্যে পেস্ট্রি কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি… ওইটা আপনার বয়ফ্রেন্ড ছিলো?’

‘ না না, এমনিই দেখা করতে এসেছিলাম। ব্লাইন্ড ডেট ‘

‘ হঠাৎ ব্লাইন্ড ডেট কেনো? মনমতো কাউকে পাচ্ছেন না?’

জারা স্মিত হেসে বিড়বিড়য়ে বললো..

‘ মন মতো কাউকে দরকার নেই, আপাতত জরুরি ভিত্তিতে বিবাহের জন্যে ছেলে দরকার ‘

‘ কিছু বললেন?’

‘ কিছুনা, আসলে লাইফে অনেক বোর হচ্ছি তাই ভাবলাম বোরিং ভাব কাটানোর জন্যে কিছু করা দরকার তাই..’

‘ ওহ এই ব্যাপার! ফাইন, চলুন তাহলে আমরাও একটা ব্লাইন্ড ডেট করি?’

কথাটা বলেই বাঁকা হাসলো আবরার, চমকে উঠলো জারা। প্রথমে ভেবেছিলো লোকটা হয়তো মজা করছে কিন্তু না..লোকটার চোখমুখ দেখে মজা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে সিরিয়াস হয়েই বলছে

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]

#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#বোনাস_পর্ব

আবরারের চোখেমুখে সিরিয়াসনেস, দুজনেই মিনিট দুয়েক চুপ রইলো। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মৃদু হাসলো জারা…

‘ আপনি দেখছি ভালোই মজা করতে পারেন ‘

‘ আপনার কাছে এটা ফান লাগলো? আমি নাকি মজা করে কিছু বলতে পারিনা, এমনটাই শুনে অভ্যস্ত আর কি। যাই হোক, আপনার কাজ কতদূর এগোলো?’

‘ জ্বি আমি চেষ্টা করছি নতুন ডিজাইন করার, আসলে হুট করেই তো আর একটা ডিজাইন করে ফেলা যায় না। সময় দরকার ‘

‘ এতো প্রেশার নেওয়ার কিছু নেই, এখনও হাতে সময় আছে আর নাহলেও সমস্যা নেই। আপনার আগের যে কালেকশন আছে তাতেও কাজ হয়ে যাবে ‘

‘ জ্বি! উম্ম, আমি তাহলে আজ আসছি। শীঘ্রই দেখা হবে ‘

‘ সেদিন আপনি অফিসে এলেন, চা কফি কিছুই খাননি। আজকে যেহেতু আমাদের এখানে দেখা হয়েই গেছে, কফি না খেয়ে আজ যেতে পারবেন না ‘

‘ আমি একটু আগেই কফি খেয়েছি ‘

‘ আরেক কাপ খেলে ক্ষতি হবেনা, বসুন! ফিহা, এখানে এসো ‘

আবরারের সঙ্গে যেহেতু প্রোফেশনাল সম্পর্ক, তাই না করলে খাবার দেখাবে ভেবে জারা বসলো। ফিহা এসে বসলো আবরারের পাশে, দু কাপ কফি অর্ডার করে বসতেই ফিহা ওর মামাকে প্রশ্ন করলো…

‘ মামা, এই আন্টি কি তোমার বন্ধু?’

আবরার ফিহার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কি যেনো বললো, জারা শুনতে পেলো না। একটু পরে ফিহা হেসে বলে উঠলো…

‘ হাই আন্টি, আমার নাম ফিহা ‘

‘ আমি জারা। তুমি তো বেশ মিষ্টি দেখতে, বোধহয় তোমার আম্মুর মতো তাইনা? ‘

‘ না না আন্টি, আমি দেখতে একদম আব্বুর মতো। পুরো কপি টু কপি, তাইনা মামা?’

‘ ইয়াহ রাইট, মেয়ের চেহারা একটুও মায়ের মত হয়নি বলে আমার আপু অনেকদিন ডিপ্রেসড ছিলো। কি ভুত ওর মাথায় চেপেছিল কে জানে, এখন আস্তে আস্তে ঠিক হয়েছে ‘

‘ ওহ আচ্ছা!’

একটু পর ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেলো, আবরার যে পেস্ট্রি কিনেছিলো সেটা বের করে ফিহাকে খেতে দিলো। এর মাঝে চললো দুজনের হালকা খুনসুটি। উল্টোপাশের চেয়ারে বসে মামা – ভাগ্নির খুনসুটি দেখে আনমনে হাসলো জারা। কর্মসূত্রে কয়েকবার আবরারকে দেখেছে জারা, সাধারণত কর্ম ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ব্যক্তির মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। জারা নিজের চোখে আজ সেই পার্থক্য দেখছে, আবরারকে দেখে শুরুতে শান্ত বা গোমড়া স্বভাবের মনে হলেও আজ সেই ভুল ধারণা ভেঙেছে জারার। আবরার স্বভাবে বেশ চঞ্চল! কফি খেতে খেতে আবরার হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো…

‘ বিয়ে করছেন কবে?’

‘ এখনও ঠিক করিনি ‘

‘ বয়ফ্রেন্ড, আছে?’

‘ থাকলে নিশ্চয়ই ডেট করতে আসতাম না?’

‘ তাও ঠিক! কিন্তু আপনাকে বিয়ের জন্যে বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে না? ওয়াও!’

‘ বাড়ির চাপের ওপর তো আর বিয়ের মতো ব্যক্তিগত বিষয় নির্ভর করা উচিত নয় তাইনা? আমি মনে করি যখন আমি মনে করবো বিয়ের উপযুক্ত সময় হয়েছে তখনই বিয়েটা করা উচিত হবে ‘

‘ নাইস থট! আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু ইদানিং আমার বাবা আমার বিয়ের জন্যে জোরাজুরি করছে, ডোন্ট নো হুয়াই!’

‘ ছেলে মেয়ের বিয়ের বয়স হলে যেকোনো মা বাবাই এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে না আপনার বিয়ে বয়স পার হয়ে গেছে ‘

‘ আমাকে দেখে কি মনে হয় আপনার? অ্যাম আই হ্যান্ডসাম?’

‘ আপনি কি আমার মুখ থেকে আপনার প্রশংসা শুনতে চাইছেন?’

‘ করলে ভালোই লাগবে ‘

স্মিত হাসলো জারা, আর আবরার ওকে দেখতে ব্যস্ত। ওরা ওখানে প্রায় আধ ঘন্টা মতো সময় কাটায়, পুরোটা সময় জারা ফিহার সঙ্গেই বেশি কথা বলেছে। আবরার অবশ্য ইচ্ছে করেই কথা বলেনি, সে প্রিয় রমনীর নিরব দর্শনে ব্যস্ত ছিলো! সন্ধ্যায় ফিহাকে নিয়ে বাসায় ফিরেই সোফায় গা এলিয়ে বসলো আবরার, মেয়েকে ঘরে হাত মুখ ধুইয়ে রেখে এসে ভাইয়ের পাশে বসলো আয়েশা…

‘ বসে রইলি কেনো? ফ্রেশ হবি না?

‘ আপু, আজ তোর মেয়ের সঙ্গে তার মামীর দেখা করিয়ে নিয়ে এলাম’

‘ কি বলছিস? সত্যিই? কিভাবে দেখা হলো?’

‘ হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো। জানিস আপু, ওর সঙ্গে বসে আজকে প্রথমবার কাজের বাইরে কিছু কথা বললাম। যা বুঝলাম মেয়েটা একটু চাপা স্বভাবের, পুরোটা সময় শুধু ফিহার সঙ্গেই কথা বলে গেলো ‘

‘ তাতে বুঝি তোর রাগ হয়েছে?’

‘ না! আজ ওকে প্রথমবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, সো আই অ্যাম হ্যাপি’

ভাইয়ের চোখমুখে এক অন্যরকম আনন্দের আভাস দেখতে পেলো আয়েশা, বুঝলো ভাই তার সত্যিই কারো প্রেমে পড়েছে। মৃদু হেসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো…

‘ এবার তাহলে আর মনে মনে লুকিয়ে না রেখে বলে দিস, আবার না পরে দেরি হয়ে যায় ‘

‘ আশা করি হবেনা, সামনে আমাদের ইভেন্টটা শেষ হোক তারপর আমি ওর সঙ্গে কথা বলবো ‘
________________________________

দুপুরবেলা লাঞ্চ শেষে সবে এসে বসেছে আবরার, সেক্রেটারি ইমরান তখন ওর সঙ্গে কিছু জরুরী বিষয় আলোচনা করছিলো। তখনই অফিস কক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ব্যক্তির আগমন ঘটলো। সে আর কেউ নয়, আবরারের প্রতিদ্বন্দ্বী ডিজাইনার রায়হান!

‘ হ্যালো আবরার, অনেকদিন পর দেখা হচ্ছে আমাদের রাইট?’

‘ মিস্টার. রায়হান, আজ আপনি হঠাৎ এখানে কি মনে করে?’

‘ মার্কেটের ডিজাইনারদের মধ্যে আমরা দুজনের ভ্যালু বর্তমানে টপে, দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানরত হিসেবে কি টপে থাকা বেস্ট ডিজাইনারের সঙ্গে দেখা করতে আসা যায়না?’

আবরার ইশারায় ওর সেক্রেটারিকে যেতে বলে, বেরিয়ে যায় ওর সেক্রেটারি। আবরার এবার ঘুরে বসলো রায়হানের দিকে, বোঝার চেষ্টা করলো আজ হঠাৎ তার এখানে আসার উদ্দেশ্য কি হতে পারে!

‘ সো মিস্টার. রায়হান, বলুন আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? কোনো বিষয়ে হেল্প লাগলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, আই উইল হেল্প ইউ ‘

‘ অন্যকে হেল্প করার কথা না ভেবে আপাতত নিজেকে হেল্প করার কথা ভাবলেই যথেষ্ট হবে ‘

বাঁকা হাসলো আবরার, কলমটা কৌশলে আঙ্গুলের মাঝে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বললো..

‘ আমার সঙ্গে আপনি পারবেন না, সেটা আমার থেকেও ভালোভাবে আপনি জানেন। তাই তো এখানে এসে নিজে কতটা ডে’ঞ্জা’র জোনে আছেন সেটা আন্দাজ করতে এসেছেন, অ্যাম আই রাইট মিস্টার. রায়হান?’

‘ এতো বছরেও অ্যাটিটিউড একটুও চেঞ্জ হয়নি আপনার, তবে এবার হবে ‘

‘ আপনার ওভার কনফিডেন্স আমার বেশ পছন্দ হয়েছে, তবে তাতে কোনো কাজ হবেনা। বাই দ্যা ওয়ে, এতদূর যখন এসেছেন কফি খেয়ে যান!’

‘ নো থ্যাংক ইউ! আপনাকে শুধু এইটুকু জানাতে এসেছি যে এবারের বেস্ট ডিজাইনারের অ্যাওয়ার্ডটা রায়হান মজুমদারই পাবে!’

কথাগুলো বলেই চলে গেলো রায়হান, তার এই আকস্মিক আগমন আবরারকে হুট করে বেশ ভাবাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে পরপর আবরারের ডিজাইন করা জুয়েলারি বেশি বিক্রি হচ্ছে, তার জন্যে জুয়েলারি ডিজাইনার অর্গানাইশন থেকে অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে আবরার। তার আগে এই পজিশনে ছিলো রায়হান, কিন্তু পরপর দু বছর ধরে নিজের থেকে জুনিয়র একজনের থেকে পিছিয়ে আছে বলে রায়হান এবার প্রথম অবস্থানে আসার জন্যে পুরো চেষ্টায় আছে আর আজ খোলাখুলি সেটা জানিয়েও গেলো। রায়হান যে কিছু প্ল্যান করছে সে বিষয়ে আবরার নিশ্চিত। ও ওর সেক্রেটারিকে ডেকে এই বিষয়টা নিয়ে একটু খোঁজ খবর নিতে বললো…ওদিকে, জারার ফ্যাশন হাউজে এমনিতেই সহকারী কম। তার ওপর ওর সেক্রেটারি ও একজন কর্মচারী বাদে সব ছুটিতে আছে। জারাকে আজ একাই সব সামলাতে হচ্ছে। দুটো বিয়ের লেহেঙ্গার অর্ডার ছিলো, সেগুলো ক্লায়েন্ট রিসিভ করে পেমেন্ট করে গেছে। আরো টুকটাক কিছু কাজ ছিলো, সেগুলো শেষ করে বাসায় আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে ওর। কিন্তু বাড়ি ফিরে ঘন্টাখানেকও শান্তি পেলো না, ওর বাবা ওর রুমে এসে এসে দুটো ছেলের ছবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন…

‘ এই ছেলে দুটোর মধ্যে যেকোনো একজনকে পছন্দ করো, এরপর আমি ছেলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলবো’

বিরক্ত হয়ে বাবার দিকে তাকালো জারা..

‘ বাবা, এসব কি?’

‘ আমার উইলের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? আর তুমিও বলেছো নিজের ভাগ ছাড়বে না। তার জন্যে তো বিয়ে করতে হবে!’

‘এখন কি তুমি আমাকে জোর করে নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছো?’

‘ তোমার পছন্দের কেউ কি আছে?’

বাবার ওপর জেদ করে জেদের বশে জারা বলে বসে…

‘ হ্যা আছে, আর আমি আমার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো!’

মেয়ের কথা শুনে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন আনোয়ার সাহেব, জারা এতো জোর গলায় বলে ফেলেছে যে সত্য মিথ্যা ঠাওর করতে পারলেন না উনি।

‘ তুমি কাউকে পছন্দ করো?’

‘ হ্যা করি!’

‘ কই, কখনো তো শুনিনি। আর তুমি না বলেছো কখনো বিয়ে করবে না, আবার পছন্দের ছেলে আছে?’

বাবা যে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করবে তা জারা বেশ বুঝেছে, জারা নিজেকে মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুত করে নিলো…

‘ বিয়ে করবো না বলেছিলাম, তাই বলে যে কাউকে পছন্দও করবো না সেটা তো একবারও বলিনি ‘

‘ তাও ঠিক! কিন্তু তোমার কথা কেনো যেনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ছেলেটা কে? কি করে?’

‘ সময় হলে সব জানতে পারবে, আমি নিজেই জানাবো। তুমি প্লিজ আমাকে আর ছেলে দেখাতে এসো না!’

মেয়ের কথা শুনে আপাতত আর কিছু বললেন না আনোয়ার সাহেব, মেয়ে সত্য বললো না মিথ্যা সেটা এক সময় বেরিয়েই আসবে। এদিকে হুট করে এমন একটা কথা বলে এবার মনে মনে পস্তাতে শুরু করলো জারা, বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পরই দরজা আটকে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে নিজেই নিজেকে বললো…

‘ এটা তো আরেক ঝামেলা হয়ে গেলো, বাবাকে বলে তো দিলাম কিন্তু এখনও তো ছেলে জোগাড় করতে পারলাম না। এরপর বাবা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কি জবাব দেবো!’

আজ এলিনার পরিচিত দুটো ছেলের সঙ্গে দেখা করে এসেছে জারা বা ওই ছেলে কারোরই একে অপরকে পছন্দ হয়নি! বাকিদের সঙ্গে দেখা করে কি ফল আসবে সেটারও নিশ্চয়তা নেই, এসব ভাবতে ভাবতে মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলো জারার! জারা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারছে যে বিয়ের জন্যে নিজে নিজেই ছেলে খোঁজা সত্যিই অনেক কঠিন কাজ!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]