সাজিয়েছি এক ফালি সুখ পর্ব-০৫

0
90

#সাজিয়েছি_এক_ফালি_সুখ
#লেখনীতে – #kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৫

ভাড়া করা ছেলে? কথাটা শুনেই চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো আবরারের, হাতে থাকা কলমটা সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ে মা’র’লো! কাচের দরজায় গিয়ে লেগেছে কলমটা, সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো দু – একজন এমপ্লোয়। সেক্রেটারি ইমরান বুঝলেন, রেগে গেছে আবরার!

‘ স্যার…!’

‘ আই অ্যাম ফাইন। আপনি এখন যেতে পারেন, আর এখন আমি কাউকে আমার অফিসে চাইনা। আই ওয়ান্ট টু স্টে অ্যালোন’

‘ ইয়েস স্যার!’

কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো সেক্রেটারি, ডেস্কের ওপর থাকা ফাইলগুলো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঝলো আবরার। মেয়েটার এতো জেদ? বিয়েটা যেভাবেই হোক করে ছাড়বে? নিজের ভালোমন্দ, ভবিষ্যৎ কিচ্ছু ভাববে না? জারার প্রতি আবরারের রাগটা যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো! এরপর কেটে গেছে প্রায় তিন সপ্তাহ, কিছু কারণে আবরারের নতুন জুয়েলারি লঞ্চ ইভেন্ট পিছিয়ে গেছে। এছাড়া বাকিসব স্বাভাবিক ভাবেই চলছে, জারাও নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তবে অদ্ভুত একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, কাজের মাঝে যখন ফুরসতে মেয়েটা বসে থাকে তখনই কয়েক মুহূর্তের জন্যে আবরারের কথা মনে পড়ে যায়। প্রায় একমাস ধরে আবরারের সঙ্গে দেখা – কথা কিছুই হয়নি, যেনো একটুখানি খারাপ লাগা কাজ করে জারার মনে। কিন্তু ঐযে, আবরার যে বলেছে জারা নি’ষ্ঠু’র। তাই সহজেই আবার এসব অনুভূতি ভুলে যাওয়ার ক্ষমতাও রাখে জারা! একদিন সন্ধ্যায় জারা নিজে রুমে বসে টিভি দেখছিলো তখনই দরজায় নক পড়লো, ওর ভাই রায়ান এসেছে। ওকে দেখামাত্রই জারা বলে উঠলো..

‘ আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কোনো সাহায্য করতে পারবো না’

‘ সাহায্য লাগবে না, আমি কিছু দিতে এসেছি ‘

রায়ানের হাতে ছোট্ট একটা বক্স, সেটা জারার দিকে এগিয়ে বললো…

‘ গত সপ্তাহে আমার আর্ট প্রতিযোগিতায় সাহায্য করেছিলে মনে আছে? প্রতিযোগিতায় আমি সেকেন্ড হয়েছি, থ্যাংক ইউ ‘

‘ রিয়েলি? কংগ্রাচুলেশন ‘

‘ থ্যাংক ইউ, গিফট নেবে না?’

‘ গিফট লাগবে না ‘

‘ এটা আব্বুর টাকায় কেনা, আম্মু জানেনা। তুমি না নিলে এটা দোকানে ফেরত নেবে না, আমার টাকাগুলো লস হয়ে যাবে ‘

‘ আমার সাহায্যের প্রতিদান স্বরূপ গিফট দেওয়া হচ্ছে? নট ব্যাড ‘

জারা গিফটা নিলো রায়ানের আর্টের প্রতি বেশ ঝোঁক, ছোটো থেকেই আর্ট শিখছে। একটা অর্গানাইজেশনের আয়োজন করা আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলো রায়ান, ওকে জারা কিছু বিষয়ে সাহায্য করেছিলো। ফ্যাশন ডিজাইনিং এর খাতিরে জারা বেশ ভালো স্কেচ করতে পারে, রায়ানও স্কেচই করেছে প্রতিযোগিতায়। ইদানিং জারা লক্ষ্য করছে ওর ভাইবোন দুটো ছোটখাটো অনেক বিষয়ে ওর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। ওরা বয়সে জারার থেকে অনেক ছোটো বলেই হয়তো দরকারের সময় যে বিষয়টা মা বাবাকে বলতে পারেনা সেটা ওকে বলে আর দরকারে সাহায্য চাইতে আসে। ধীরে ধীরে জারার কেমন ওদের প্রতি টান অনুভব হচ্ছে, যদিও হাসনা বেগমকে ও কখনোই মন থেকে মানবে না!
_________________________

রাত নয়টার বেশি বাজে, কাজ শেষে বাড়ি ফিরবে জারা। কর্মচারীরা সবাই চলে গেছে একটু আগে। আরেকবার সবকিছু চেক করে নিয়ে সব লাইট বন্ধ করে বের হলো জারা, বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া খবরে অবশ্য বলেছে এই বৃষ্টি আরো দু – তিনদিন থাকবে, ঝড়ের সম্ভাবনাও আছে। জারা ভেবেছে এরকম ধুম বৃষ্টি যদি কাল সকালে থাকে তাহলে কর্মচারীদের দুপুরে আসতে বলবে, সকালে এমনিও কাস্টমার তেমন থাকে না। ছাতা নিয়ে বের হয়েই সামনে আবরারকে দেখলো জারা, কালো রংয়ের একটা ছাতা হাতে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জারা ভেবেছিলো সেদিনের পর হয়তো আবরারের সঙ্গে বিনা কাজে আর দেখা হবেনা কিন্তু এতোদিন পর এরকম ঝড়বৃষ্টির রাতে যে এভাবে আবরার নিজেই ওর সাথে দেখা করতে চলে আসবে ভাবেনি মেয়েটা। জারা এগিয়ে এলো…

‘ এতো বৃষ্টির মধ্যে আপনি এখানে?’

‘ আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে ‘

‘ কথা পরেও বলা যেতো ‘

‘ না, আজকেই বলবো ‘

‘ ভেতরে আসুন তাহলে, এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই ‘

‘ একটা ছেলেকে ডেকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন, ভয় হচ্ছে না?’

‘ মানুষ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেই আমি আবরার, আপনার জায়গায় যদি এখন অন্য কোনো ছেলে আসতো তার সঙ্গে এরকম এক দুর্যোগের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি এক মুহুর্তও কথা বলতাম না’

‘ তারমানে আমায় ভরসা করেন?’

‘ ভেতরে আসুন, ভিজে যাচ্ছেন ‘

বিগত কিছুদিন ধরেই নানাভাবে জারাকে ভোলার প্রয়াস চালিয়েছে আবরার, কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি উল্টে আবরারের জেদ হতে শুরু করেছে জারার বিষয়ে জানার জন্যে। মেয়েটা এমন কেনো? আর পেছনে কারণ কি? তার ওপর ভাড়া করা একটা ছেলেকে বিয়ে করবে জানার পর থেকেই আবরার নিজের মন শান্ত করতে পারেনি। ওইদিন রেস্টুরেন্ট থেকে আসার সময় ঠিক করে নিয়েছিলো জারা তার জন্যে উপযুক্ত নয়, কিন্তু মনের ওপর কি আর রাগ, অভিমান ও মুখের কথায় কোনো প্রভাব পড়ে? আবরার পারেনি মেয়েটাকে ঘৃ’ণা করতে, তাইতো আজ সবকিছু ভুলে দেখা করতে চলে এসেছে। জারা ওকে ভেতরের রেস্টরুমে নিয়ে আসে, এবং একটা তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে বলে…

‘ হাত মুখ ভালোভাবে মুছে নিন ‘

‘ থ্যাংক ইউ ! আপনার সব এমপ্লয় বাড়ি চলে গেছে?’

‘ হ্যাঁ, ওয়ার্কিং আওয়ার তো অনেক আগেই শেষ। আমার কিছু কাজ ছিলো বলে যেতে দেরি হয়ে গেছে। আপনি চা বা কফি কিছু খাবেন?’

‘ কফি ‘

জারা আবরারকে এক কাপ কফি করে এনে দেয়..

‘ যা বলার ফোনেই বলতে পারতেন, এতো বৃষ্টির মধ্যে আসার প্রয়োজন ছিলো না ‘

‘ সামনাসামনি বলা উচিত মনে হলো, তাই এসেছি ‘

‘ জ্বি, বলুন যা বলতে এসেছেন ‘

‘ সত্যি বলতে সেদিন আপনার কথাগুলো শোনার পর আপনার ওপর আমার অনেক রাগ হয়েছিলো। সারারাত আমি ভেবেছি একটা মেয়ের চিন্তা এমন কিভাবে হতে পারে, ইন ফ্যাক্ট আমি ঠিক করেই নিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে আর কখনও দেখা করবো না। কিন্তু, আমি পারলাম না। আই মিসড ইউ অ্যা লট!’

শেষের কথাটা বলার সময় আবরার জারার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, নেভি ব্লু রংয়ের চিকন ফ্রেমের চশমা পড়া পুরুষটির সেই অমায়িক চাহনি দেখে জারার পুরো শরীরে যেনো কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখ সরিয়ে নিলো জারা..

‘ যাই হোক, আপনি যে ছেলেকে ভাড়া করেছেন তাকে বলে দেবেন তার আর প্রয়োজন নেই। তাকে কোনো ড্রামা করতে হবেনা ‘

‘ এই কথা আপনি কিভাবে জানলেন?’

‘ আমি কিভাবে জানলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আপনি ঐ ছেলেকে বিয়ে করবেননা ‘

‘ আবরার, বিয়েটা কেনো করবো সেটা আপনাকে আমি বিস্তারিত বলেছি। এরপরও কেনো এসব কথা উঠছে? তাছাড়া এটা আমার ব্যক্তিগত…’

‘ আপনি যেসব শর্ত দিয়েছেন বিয়ের জন্যে, তাতে আমি রাজি। আপনাকে আর টাকা খরচ করে ছেলে ভাড়া করতে হবেনা ‘

‘ মানে?’

‘আমি আপনাকে বিয়ে করবো, আপনার যা শর্ত আছে সেসব মানতেও রাজি আছি। আপনার সঙ্গে ছয় মাস কেনো, একদিন থাকার সুযোগও যদি পাই সেটা আমি হাতছাড়া হতে দেবো না ‘

‘ না আবরার, আপনি আমাকে বিয়ে করতে পারেন না। আমি একটা প্রয়োজনে বিয়ে করছি, আমি কারো পরিবারকে কষ্ট দিতে চাইনা। যে ছেলেটাকে আমি ভাড়া করেছি তার পরিবারে তেমন কেউ নেই। তাই ওখানে কোনো সমস্যা হবেনা কিন্তু আপনি একজন নামি মানুষ, আপনাকে একটা স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে হবে ‘

‘ সেসব চিন্তা আমার। আমার পরিবার, পাবলিক স্ট্যাটাসের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আপনার দরকার বিয়েটা করা আর আমি চাই যেটুকু সময় আপনি নির্ধারণ করেছেন সেই সময়টুকু আপনার পাশে থাকতে, আপনার স্বামী হিসেবে!’

‘ আবরার, আমার মনে হয় আপনি আবেগী হয়ে এখন এসব কথা বলছেন। ভবিষ্যতে আফসোস করবেন, আমাকে দোষারোপ করবেন ‘

‘ আপনি আবেগী হয়ে ঝোঁকের মাথায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জারা, কিন্তু কি কি সমস্যা হতে পারে সেটা ভাবেননি।একটা অচেনা ছেলেকে আপনি টাকা দিয়ে ভাড়া করেছেন, ছেলেটার টাকার প্রয়োজন বলেই আপনার শর্তে রাজি হয়েছে। ভবিষ্যতে ছেলেটা যে আপনাকে টাকার জন্যে ব্ল্যা’ক’মে’ই’ল করবে না তার কি গ্যারান্টি দেবেন? আপনার কাজে ছেলেটা কোনো ঝামেলাও সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু আমার তেমন কোনো মোটিভ নেই, না আমি আপনাকে কোনো কাজে আটকাবো না কখনও দোষারোপ করবো। জীবনটা আপনার, সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি কিছুদিনের জন্যে একজন জীবনসঙ্গী চেয়েছেন তাইনা? আমি আপনার সেই জীবনসঙ্গী হতে চাই!’

আবরারের প্রতিটা কথায় যুক্তি আছে, তা অস্বীকার করার ক্ষমতা জারার নেই। একটা পুরুষ একটা নারীকে নিয়ে কতটা সিরিয়াস হলে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটা ভেবে অবাক হচ্ছে জারা

‘ দেখুন, আমার বিষয়টা নিয়ে ভাবতে একটু সময় লাগবে ‘

‘ টেক ইওর টাইম, কিন্তু ওই ছেলেটাকে আবার নিজের বাড়িতে নিয়ে চলে যাবেন না। আপনার কাছে হাজার গুণ বেটার অপশন আছে এখন। আপনাকে কেউ একজন পছন্দ করে, নিজের করে চায় সেটা ভুলে যাবেন না ‘

জারা উত্তরে কিছু বলতে পারলো না, কিছুটা দোটানায় পড়ে গেলো। এই মুহূর্তে কোন অপশন বেছে নেওয়া উচিত হবে?

বৃষ্টি কিছুটা কমতেই আবরার বাড়ি চলে আসে, এতদিন মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছে কিন্তু আজ জারাকে সব বলতে পেরে অনেকটা হালকা লাগছে। ওদিকে, জারাও বাড়ি ফিরেছে কিছু সময় আগে। কোনো কিছুতে আজ মন দিতে পারছে না, আবরারের বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সারারাত বিষয়টা নিয়ে ভাবলো জারা, আর সবকিছু ভেবে ঠান্ডা মাথায় অন্তিম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো!
________________________________

অফিসে এসেছে আবরার, আজ মেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। বসের খোশ মেজাজ লক্ষ্য করেই সেক্রেটারি ইমরান প্রশ্ন করলো…

‘ আজ সকালে কি ভালো কিছু হয়েছে স্যার? বেশ খোশ মেজাজে আছেন মনে হচ্ছে ‘

‘ আজ হয়নি, তবে হয়েছে! ওনার থেকে একটা পজিটিভ উত্তর আশা করছি ‘

‘ কার কথা বলছেন, স্যার?’

‘ ধারণা করুন, কে হতে পারে ‘

সেক্রেটারি ইমরান তো ভাবার সময়টুকু পেলো না, তার আগেই আবরার যার উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো সে এসে দরজায় কড়া নাড়লো। জারাকে দেখে আবরার মৃদু হাসলো, তাতেই সেক্রেটারি বুঝে গেছে তার বস কার কথা বলছিলো। সে নিরবে বেরিয়ে গেলো, জারা এসে বসলো চেয়ার টেনে ‘

‘ আমি আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম, কিন্তু আপনি যে সকাল সকালই আসবেন ভাবিনি’

‘ আমার জন্যে যতো দ্রুত সব হবে ততোই উত্তম ‘

‘ ওকে, তো আপনার সিদ্ধান্ত কি?’

‘ আমি বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি, আপনি ঠিকই বলেছেন। একটা অচেনা অজানা ছেলে ভবিষ্যতে কি করবে জানা নেই, কিন্তু আপনার দিক থেকে তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আপনার যদি সত্যিই আমার শর্ত নিয়ে কোনো আপত্তি না থাকে তবে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি ‘

জারার সিদ্ধান্তে আবরার বেশ খুশি হলো। ভবিষ্যতে কি হবে সে চিন্তা আপাতত সাইডে রাখলো আবরার, পছন্দের মানুষটা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। এক প্রেমিক পুরুষের কাছে এর চেয়ে বেশি আনন্দের কিছু হয়তো হতেই পারে না!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]