#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_০৫
সময় এখন রাত সাড়ে তিনটা। বিলাশ বহুল একটি কক্ষের মধ্যে শুয়ে আছে একজোড়া মাঝবয়সী দম্পতি। রাত পেরিয়ে নতুন সকাল আসছে কিন্তু তাদের চোখে ঘুমের “ঘ” ও নেই। থাকবেই বা কিভাবে আজ যে তাদের চোখের মনিকে অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা সারাজীবনের জন্য।
জাভিয়ান বুকে শুয়ে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অনুভব করতে পারছে বুকে উপর মাথা রাখা তার ভালোবাসার নারীটি চোখের পানিতে তার বুকের কাছের ফতুয়া ভিজিয়ে ফেলেছে। জাভিয়ানের চোখ দিয়েও অবিরত অশ্রু গড়িয়ে পরছে। তার আরেকটা জানকে যে সে আজ কষ্ট দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে মেয়েটাকে নিজের কসম দিয়ে বিয়েটা না দেওয়াই ভালো ছিলো। যাওয়ার সময় কেমন অভিমানী টইটম্বুর চোখজোড়া নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। অল্প বিস্তর অভিযোগও তো করলো।
জাভিয়ান একহাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে নেয়। তারপর মাথাটা হালকা উচু করে হানিয়ার চুলের উপর ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। হানিয়া জাভিয়ানের স্পর্শে আরো সেঁটে যায় তার বুকের সাথে। জাভিয়ান নিজের বালিশে মাথা রেখে পুনরায় হানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–
—আর কেঁদো না হানি। শরীর খারাপ করবে তোমার। একটু ঘুমাও জান।
হানিয়া জাভিয়ানের বুকে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে দেয়। জাভিয়ান দুই হাত দিয়ে তাকে জাপ্টে ধরে। হানিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে–
—আমি সকাল হলেই আমার মেয়ের কাছে যাবো। আপনি দেখেন নি, আমার হায়া যাওয়ার সময় কেমন অভিমানী চোখ করে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে জাভিয়ান। আমরাও আজ ওকে কষ্ট দিলাম। নিজেকে আজ ব্যর্থ মনে হচ্ছে।
জাভিয়ান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। হানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে সময় নিয়ে। যখন দেখে হানিয়ার কান্না থেমে গিয়েছে তখন সে মুখ খুলে। জাভিয়ান বলে–
—আমরা কালই যাবো আমার প্রিন্সেসের কাছে। অভিমান করে থাকলে কান ধরে বসে থাকবো তার সামনে,,যতক্ষণ না অভিমান ভাঙছে ততক্ষণ পর্যন্ত বসে থাকবো। দেখবে ওর অভিমান ঠিক পরে যাবে। তুমি আর কান্না করো না। আমরা কালই যাবো।
হানিয়া বলে–
—জাভিয়ান আশিয়ান কি আমাদের মেয়ের জন্য সঠিক জীবনসঙ্গী হবে? আবারও যদি কষ্ট দেয় আমাদের মেয়েকে?
উত্তরে জাভিয়ান বলে–
—আমার মন কেন জানি বলছে, আশিয়ানই আমাদের হায়া’র জন্য বেস্ট চয়েস হবে। যদি তাও কষ্ট দেয় তাহলে এবার আমি আর ওকে ছেড়ে কথা বলবো না। আমার মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার পরিণাম যে কতটা ভয়াবহ সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিবো। এবার আমি আর কোন সম্পর্কের তোয়াক্কা করবো না।
শেষের কথাগুলো জাভিয়ান দাঁতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে। হানিয়া জাভিয়ানের কথা শুনে কিছুটা আশ্বাস্ত হয়।
সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে শরীর এমনিতেই ক্লান্ত ছিলো,, এতক্ষণ ঘুৃম আসছিলো না মেয়ের কথা ভেবে। মনটা বড্ড ছটফট করছিলো। এখন স্বামীর থেকে আশ্বাস পেয়ে মনের সব ছটফটানি বিলীন হয়ে যায়। সময়ের ব্যবধানে চোখে নিদ্রাপরী এসে নিজের আসন গ্রহন করে। আস্তে আস্তে হানিয়া ঢলে পরে নিদ্রা পরীর কোলে।
জাভিয়ান হানিয়ার গভীর ভাবে ফেলা নিঃশ্বাসে বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে পরেছে। জাভিয়ান আরো কিছুক্ষণ হানিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর হানিয়াকে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে। বিড়াল পায়ে হেঁটে ওয়াশরুম চলে যায়। অজু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ শেষ করে সময় নিয়ে দোয়া করে তার সন্তান ও পরিবারের জন্য। মেয়ের দাম্পত্য জীবন যেনো সুখের হয় এজন্যই বেশিক্ষণ দোয়া করল। তারপর রুম ছেড়ে বাহিরে আসে। নিঃশব্দে চলে যায় মেয়ের রুমের দিকে। ফজর আজান দেওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকে।
__________________
—মন খারাপ?
জাহান কোন জবাব দেয় না। মনটা তার এতই খারাপ যে প্রিয় রমণীটির সাথেও কথা বলতে মন চাইছে না। কিন্তু তাও ফোন বসে আছে,কেন দিয়েছে সে নিজেও জানে না। মেহরিমা বুঝে নেয় তার প্রিয় পুরুষটির মন ভীষণ খারাপ। খারাপ হওয়ার কারণও তার জানা। লোকটার কলিজার টুকরা বোনটা যে আজ পরের ঘরে চলে গিয়েছে। তারও যে বোনের মতো বান্ধবীর জন্য মনটা খারাপ। কেমন ভাবে হায়া’র বিয়েটা হলো ভেবেই মেহরিমার মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়।
মেহরিমা আর কোন কথা বলে না আর না-ই বা কোন প্রশ্ন করে। চুপ করে একে অপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকে। এতেও যেন আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর মেহরিমা বলে–
—ফোনটা কাটি এখন? ঘুমানো প্রয়োজন আপনার। রাত তো শেষ হওয়ার পথে।
স্বল্পভাষী জাহান গম্ভীর গলায় সুধায়–
—তোমার ঘুম পেলে ঘুমাও কিন্তু ফোন কেটো না। তোমার নিঃশ্বাসের আওয়াজেও আমি আলাদা শান্তি পাই।
জাহানের কথা শুনে ফোনের অপর পাশে থাকা মেহরিমা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মেহরিমা বুঝে উঠতে পারে না তার মতো এতিম মেয়েকে লোকটা এত কেন ভালোবাসে? তার কি আছে? কিছুই তো নেই। না আছে ধনদৌলত আর না আছে তেমন আহামরি রূপ। শ্যাম রাঙা মেহরিমার মধ্যে এই সুদর্শন ডাক্তার কি এমন পেয়েছে যার কারণে এমন পাগলের মতো ভালোবাসে?
প্রশ্নটা গত এক বছরে বেশ কয়েকবারই করেছে। কিন্তু বিনিময়ে জাহান নিজের ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ফুটিয়ে কথাটা কাটিয়ে চলে গিয়েছে। আজও প্রশ্নটা করার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। মেহরিমা দোনামোনা করতে করতে জিজ্ঞেসই করে বসে–
—একটা প্রশ্ন করতে পারি?
—আমি তোমায় কেন এতো ভালোবাসি,, এটাই জানতে চাও তো?
মেহরিমা খানিকটা অবাক হয় জাহানের কথা শুনে। লোকটা কিভাবে বুঝলো? মেহরিমা জাহানের কথায় সম্মতি দিয়ে বলে–
—হুম। আজ কি উত্তর পাবো?
—”তোমায় ভালোবেসে এক অদ্ভুত প্রশান্তি পাই,
শব্দহীন এক সুর বাজে হৃদয়ের গহীনে।
কেন পাই, সেই রহস্য তো আকাশে বসে থাকা ঐ মালিক জানে।”
জাহানের থেকে উত্তর পেয়ে মেহরিমার মনে হয় হওয়ায় ভাসতে থাকে। চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিনা অনুমতিতে গড়িয়ে পরে। মনে মনে অসংখ্য বার শুকরিয়া জানায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে তার মতো একটা এতিমকে সীমাহীন ভালোবাসে এমন একটা মানুষকে দেওয়ার জন্য।
বাকি রাতটা জাহান আর মেহরিমা এভাবেই কানে ফোন ধরে বসে থাকে। তাদের মধ্যে নেই কোন ক্লান্তি,, নেই কোন বিরক্তি। আছে শুধু ভালোবাসা নামক অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতির আনাগোনা।
________________
—জায়িন ভাই আমার ঘুৃম পাচ্ছে,, আমি ফোন রাখলাম।
কথাটা বলে আদিবা ফোন কাটতে যাবে তখনই জায়িন ধমকে উঠে–
—এই অসভ্য মাইয়া ফোন কাটলে এখনি তোর বাসায় যাইয়া উঠায় নিয়া আসমু।
জায়িনের কথা শুনে আদিবার আর সাহস হয় না ফোন কাটার। মাথার তার কয়েকটা ছেড়া এই লোকের। দেখা গেলো সত্যি সত্যিই বাসায় এসে একটা গন্ডগোল পাকিয়ে ফেললো।
আদিবা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে–
—জায়িন ভাই ঘুম আসছে তো ভীষণ। আজকের মতো রাখি না। কাল আপনার সামনে বসে বাকি কথাগুলো শুনবো নে।
আদিবার বার বার ‘ভাই’ সম্বোধন করাটা জায়িনের পছন্দ হয় না। আবারও একটা ধমক দিয়ে বলে–
—এই আদিবাসী! ভাই কারে বলিস? একটা চটকনা দিয়া দাঁত ফেলায় দিমু তোর। দুইদিন পর তোর বাচ্চার বাপ হবো আমি আর এখন আমারে ভাই ডাকিস? এক নাম্বারের বিটকেল তুই। আমার বাচ্চাগুলো জানি আমারে বাবা না ডেকে মামা ডাকে এজন্য তুই এই ফন্দি আঁটছিস না? আমি তো তোর কুবুদ্ধি ধরে ফেলছিরে ময়না মা।
লম্বা একটা ভাষণ শেষ করে জায়িন ফুস করে শ্বাস ফেলে। অপর পাশে থাকা আদিবা হতভম্ব হয়ে তার কথা শুনতে থাকে। কেমন শয়তান লোককে সে তার মাসুম মন দিয়েছে এতদিনে বুঝতে পারে। কষ্টে তার পিঙ্ক কালারের বিষ খেতে মন চাইছে।
আদিবা নরমাল ভাবে বলে–
—আপনার যতসব বাজে কথা। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো।
—কি?
—হায়া’র জন্য মন খারাপ করছে না আপনার?
আদিবার মুখে হায়া’র নাম শুনে পুনরায় জায়িনের মনটা খারাপ হয়ে যায়। বোনটার জন্য তার মন যে কি ভয়াবহ রকমের খারাপ সেটা যদি এই বেয়াদব প্রেয়সী বুঝতো তাহলে আর এই প্রশ্নটা করতো না। মেয়েটা কেন তাঁকে বুঝে না? কেন তার প্রতিই তার এত অবুঝপানা? অভিমান হয় জায়িনের। সেই অভিমান থেকেই বলে বসে–
—নাহ আমার মন খারাপ করবে কেন? হায়া কোন ক্ষেতের মুলা যে তার জন্য আমার মন খারাপ করবে। আমি অনেক খুশি। তুই ফোন রাখ আমি মোবাইলে পাগলু গান ছেড়ে লুঙ্গি ডান্স দিবো। রাখ তুই ফোন। তোরে আর ডিস্টার্ব করবো না।
নিজের মতো কতগুলো কথা বলে জায়িন খট করে ফোনটা কেটে দেয়। আদিবাকে কিছু বলার সুযোগও দেয় না। আদিবা হা করে ফোনটা কানে ধরে বসে থাকে।
~চলবে?
ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স 🤍🖤]