সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-১১+১২

0
1

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_১১

ভার্সিটি যাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাও মেয়ে রুম থেকে বের হচ্ছে না দেখে মুনতাহা বেগম মেয়ের রুমের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য মেয়েকে ডেকে তুলে ভার্সিটিতে পাঠানো। মুনহাতা পরপর কয়েকবার মেয়ের দরজায় কড়াঘাত করলেও তার মেয়ে দরজা খুলেন না। একপর্যায়ে জোরে জোরে দরজায় হাত দিয়ে বারি দিতে থাকেন আর মেয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকেন–

—রাহা! এই রাহা! দরজা খুলছিস না কেন মা? ভার্সিটিতে যাবি না আজ? দরজা খুল।

এমন আরো বহু কথা বলে মেয়েকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু রাহা তার ডাকে কোন সারা দেয় না। মুনতাহা বেগমের গলার আওয়াজে তার স্বামী রাহাত ও কলেজ পড়ুয়া ছেলে রায়হান নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে আসে। যদিও তারা দু’জন নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ঘরে থেকে বের হচ্ছিল, কিন্তু মিসেস চৌধুরীর এমন চিৎকার করা শুনে তারা রাহা’র রুমের সামনে আসেন।

রায়হান তার মা’কে জিজ্ঞেস করে–

—মা, কি হয়েছে? তুমি আপুর ঘরের দরজায় এত জোরে জোরে আওয়াজ করছো কেনো?

রাহাতও স্ত্রীকে একই প্রশ্ন করে। মুনতাহা তাদের আদ্র গলায় জবাব দেয়–

—কাল ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে সেই যে ঘরের দোর দিয়েছে, রাতের খাবার টাও খায় নি। সকালে ও ভার্সিটির সময় হয়ে যাচ্ছিল দেখে এসে ডাকা শুরু করি কিন্তু এত ডাকার পরও রাহা দরজা খুলছে না।

কথাটা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ঝরঝরিয়ে কেঁদে দেন। রাহাত প্রাণপ্রিয় সন্তানের এমন কথা শুনে অস্থির হয়ে যায়। মুনতাহাকে ধমক দিয়ে বলে–

—রাহা যে কাল থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ করছে সেই কথা আমায় কাল রাতে জানাতে পারলে না? মেয়েটা কাল রাতে খায় ও নি। এত কাণ্ডজ্ঞানহীন কি করে হতে পারে একজন মা আমি বুঝে পারি না। সরো দরজার সামনে থেকে।

রাহাত ভীষণ রুঢ়ভাবে কথা গুলো বলে মুনতাহাকে। মুনতাহা বেগম শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে পেছনে সরে যায়। রাহাত রাহা’র দরজার সামনে এসে বেশ কয়েকবার কড়াঘাত করে কিন্তু রাহা এবারও কোন জবাব দেয় না। সে এবার রায়হানকে উদ্দেশ্য করে বলে–

—দরজা ভাঙতে হবে মনে হচ্ছে। রায়হান তুমি আমার সাথে কাঁধ মেলাও।

রায়হান মা’কে আরেকটু দূরে দাড় করিয়ে দিয়ে বাবার সাথে কাঁধ মিলিয়ে রাহার রুমের দরজা ভাঙতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই দরজা ভেঙে তার রুমে প্রবেশ করে। তারা রুমে প্রবেশ করে দেখতে পায় রুমে অবস্থা ভীষণই করুণ। একটা জিনিসও আস্ত নেই রুমের।

সাথে এ-ও দেখতে পান তাদের মেয়ে ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। মুনতাহা দৌড়ে মেয়ের কাছে গিয়ে মাথার সমীপে বসে পরে। মেয়ের মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডাকতে থাকে–

—রাহা! ও রাহা! মা আমার! চোখ খুল মা। কি হয়েছে তোর?

রাহাত ও রায়হানও কয়েকবার রাহা’কে ডাকে কিন্তু রাহা যে অজ্ঞান। রাহাত মুনতাহাকে বলে–

—ওকে আমার কাছে দাও। আমি বেডে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিচ্ছি।

মুনতাহা স্বামীর কথা মতো মেয়েকে তার দিকে বাড়িয়ে দিলে রাহাত তাঁকে কোলে তুলে বেডে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। তারপর রাহার হাত-পা চেক করে দেখে ঠাণ্ডা হয়ে বরফ হয়ে গিয়েছে। সে রায়হানকে বলে–

—তোমার ডাক্তার আঙ্কেলকে ফোন করে তালে আমাদের বাসায় আসতে বলো যত তাড়াতাড়ি সম।আর তুমি (মুনতাহাকে উদ্দেশ্য করে বলে) তেল গরম করে নিয়ে আসো। হাত-পা প্রচন্ড ঠাণ্ডা হয়ে পরেছে রাহার।

রায়হান আর মুনতাহা নিজেদের কাজে লেগে পরে। মুনতাহা সরিষার তেল গরম করে নিয়ে এসে মেয়ের হাত-পায়ের তালুতে মালিশ করে দিতে থাকে আর রায়হান তাদের ফ্যামিলি ডা.কে ফোন করে তাদের বাসায় আসতে বলে দেয়।

ডাক্তার আসার পূর্বেই রাহার জ্ঞান ফিরে আসে কিন্তু দূর্বলতার কারণে কিছু বলতে পারছে না। ডা. তার চেক-আপ করে জানান–

—বিপি প্রচন্ড লো। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মনে করে না দেখা যাচ্ছে। আর যা বুঝতে পারছি শারীরিক অসুস্থতার থেকে ও মানসিক ভাবে কোন কাজে ভীষণ ডিস্টার্ব। প্রোপার কেয়ার না করলে যেকোন সময় বড় কিছু ঘটে যেতে পারে। আমি ঔষধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি সেগুলো রেগুলার খাওয়ান আর ওর মানসিক অবসাদ দূর করার চেষ্টা করুন।

কথাগুলো মুনতহানা ও রাহাতের উদ্দেশ্য বলে ডাক্তার। তারপর কিছু ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিয়ে চলে যান। রাহাত রায়হানকে ঔষধ গুলল পাঠিয়ে দিয়ে মুনতাহাকে রাহার জন্য খাবার আনতে পাঠিয়ে দেন।

মুনতাহা বেগম রাহার জন্য খাবার নিয়ে এসে রুমে ঢুকতে ঢুকতে শুনেন,, রাহাত বলছে–

—তুমি আজ পর্যন্ত যা চেয়েছো পাপা তাই তোমাকে এনে দিয়েছে। এবারও তাই হবে। তুমি খাওয়াদাওয়া করে নিজেকে ফিট করে তুলো, সামনে যে গ্র্যান্ড অনুষ্ঠান আছে।

রাহা তার একটা হাত দিয়ে বাবার ডান হাত ধরে উঁচু করে সেটায় চুম্বন করে অসুস্থ গলায় বলে–

—আই লাভ ইউ পাপা। ইউ আর দ্যা বেস্ট পাপা ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।

রাহাতও মেয়ের কপালে স্নেহের পরশ দিয়ে বলে–

—পাপা অলসো লাভ ইউ মাই প্রিন্সেস।

মুনতাহা তাদের কথার কিছুই বুঝে না আর না সেই বিষয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায়। সে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে–

—হ্যাঁ, সব ভালোবাসা তো পাপার জন্যই। মাম্মা তো বানের জলে ভেসে এসেছে না। থাক আমার কাউকে ভালোবাসা লাগবে না। যখন মাম্মা আকাশের স্টার হয়ে যাবো তখন ভালোবাসার জন্য আমায় খুঁজো।

রাহাত হাসি মুখে মুনতাহার সবটা কথা শুনলেও শেষের কথাটা তার কেন জানি ভালো লাগে না। নিমিষেই তার হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর্যতার আড়ালে ঢেকে পরে। মুনতাহা খাবারের প্লেট নিয়ে এসে তাদের সম্মুখে দাঁড়ালে রাহাত তার জায়গা ছেড়ে উঠো গিয়ে সেখানে মুনতাহাকে বসার জন্য জায়গা করে দেয়। মুনতাহা মেয়েকে আস্তে করে বসিয়ে দিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে থাকে। রাহাত তাদের থেকে বিদায় নিয়ে নিজের অফিসে চলে যায়।

________________

আশিয়ান ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে টাই বাঁধতে বাঁধতে আয়নার মাধ্যমে হায়া’কে দেখছে যাকে কিনা তারই ফুফিরূপী শ্বাশুড়ি খাইয়ে দিচ্ছে।

টাই বাঁধা শেষ করে চুলে চিরুনি ব্রাশ করতে করতে হায়া’র খাওয়া হয়ে যায়। হানিয়া তাড়াতাড়ি করে হায়া’কে ঔষধগুলো খাইয়ে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে থেকে বের হয়ে যায়। বাহিরে যাওয়ার আগে মেয়ে আর তার জামাইকে পারসোনাল স্পেস দিয়ে যায়। সে আড়চোখে খেয়াল করছিলো আশিয়ান তার কাজগুলো আস্তে ধীরে করছিলো।

শ্বাশুড়ি চলে যাওয়ায় আশিয়ান কিছুটা খুশি হয় বটে। সে সম্পূর্ণ রেডি হয়ে হায়া’র সামনে এসে দাড়ায়। বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা তুলে পকেট ভরে হায়া’র দুই গাল চেপে ধরে টুপ করে তার ললাটে চুম্বন করে। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে–

—ভালো মেয়ের থাকবে।সময় করে খাওয়াদাওয়া করবে আর ঔষধ খাবে। আর কতগুলো পড়া দিয়ে যাচ্ছি, অবসর সময়ে সেগুলো শেষ করেন রাখবে। আমি এসে ধরবো। মনে থাকবে?

হায়া বুঝি এত বাধ্য? সে চটপট করে বলে–

—না। আমি অসুস্থ না, তাহলে পড়বো কেন? নো পড়াশোনা, অনলি রেস্ট।

আশিয়ান চোখ গরম করে বলে–

—টেনে দেবো এক থাপ্পড় যদি কথা না শুনো। যা বলেছি তাই করবে।

হায়া ভেঙচি কেটে বলে–

—এহহহহহহ, আমার বাবা এখন আমার কাছে আছে। আপনি আমায় থাপ্পড় মারলে আমিও বাবার সাথে চলো যাবো। তখন আপনি হাত পা ছড়িয়ে কান্না করেন।

—কথাটা ফানি ছিলো কিন্তু আমার হাসি পেলো না। দাঁড়াও আমি বাবাইকে বলে যাবো, তারপর সেই তোমাকে ঘাড় ধরে পড়াবে। কাল ঝাড়ি খেয়েও লজ্জা হয়নি।

আশিয়ান হায়া’র মুখের উপর কিছুটা ঝুকে ছিলো। হায়া তার কথা শুনে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে নিজের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে–

—যান তো অসভ্য লোক। শুধু ঝগড়া করার পায়তারা।

আশিয়ান হাত ঘড়িয়ে তাকালে দেখে তার ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আশিয়ান হায়া’কে জ্বালানোর জন্য একটা শক্তপোক্ত চিমটি কেটে তার ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়ে পগারপার। হায়ার পায়ে ব্যথা থাকায় সে সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে আশিয়ানের পিছু নিতে পারে না৷ তাই সেখানেই বসে চেঁচিয়ে বলে–

—সামনে পাই একবার। খামচে যদি আপনার চেহারা আফগানিস্তানের রিলিফ ম্যাপ না বানিয়ে দিয়েছি তাহলে আমার নামও জেসমিন তালুকদার হায়া না।

~চলবে?

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_১২

লাঞ্চ ব্রেকের আগে লাস্ট পেসেন্টটা দেখা শেষ করে জাহান। পেসেন্টটাকে বিদায় দিয়ে জাহান চোখের চশমা’টা খুলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে থাকে। হঠাৎই মস্তিষ্কের নিউরন গুলো বিদ্রোহ করে বলে উঠে–

—তোর মায়াবতী’র কথা ভুলে গেলি জাহান? অসুস্থ মেয়েটার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য তুই ছাড়া আর কেউ নেই যে।

জাহান তড়াক করে চোখ খুলে টেবিলের এক কোণে পরে থাকা ফোনটা তুলে মেহরিমাকে কল দেয়। একটা রিং হওয়ার সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হয়ে অপর পাশ থেকে কোকিল কণ্ঠী সুরে শোনা যায়–

—আসসালামু আলাইকুম।

সালাম অর্থ শান্তি সেটার আজ প্রমাণ পেয়ে গেলো জাহান হাতেনাতে। সকাল দশটা থেকে পেসেন্ট দেখতে দেখতে সে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পরেছিলো। সেই সাথে একটা চাপা অস্থিরতাও কেমন জাপ্টে ধরেছিলো তাকে। মেহরিমাকে নিয়ে চিন্তা ও এক অজানা শঙ্কায় বিচলিত হয়ে আছে তার মন-মস্তিস্ক দু’টোই। কিন্তু এইমাত্র মেহরিমার সুরেলা গলার স্বর যেন তার অস্থিরতা গায়েব করে দিয়েছে। কেমন শান্তি শান্তি লাগে মেয়েটার সংস্পর্শে থাকলে।

—হ্যালো, শুনছেন?

মেহরিমার কণ্ঠে জাহানের ধ্যাণ ভঙ্গ হয়ে। সে পুনরায় চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে–

—কিছুক্ষণ চুপ করে থাকো তো। তোমায় অনুভব করি।

মেহরিমা বরাবরই বাধ্যগত মেয়ে। প্রিয়তমের আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা তার এ জীবনে হবে কিনা সন্দেহ। সে জাহানের কথামতো চুপ করে থাকে যতক্ষণ না জাহান নিজে থেকে কথা বলে।

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাওয়ার পর জাহান নিজেই প্রশ্ন করে–

—কি করছো?

মেহরিমা শান্ত গলায় বলে–

—পড়ছিলাম।

—রেস্ট নিতে কয়েকটা দিন। মাথা ব্যথা আছে?

গতকাল হায়াদের রিকশা উল্টে পরে গেলে প্রথমে মেহরিমা পরে তার উপর হায়া পরে। রিকশা থেকে পরে গিয়ে মেহরিমার মাথা রাস্তার ফুটপাতের উঁচু জায়গায় লেগে কপালের এক সাইডে কেটে যায়। পায়েও কিছুটা চোট পায়। হায়া যে কম ব্যথা পেয়েছে তা কিন্তু না। কয়েকজন বিক্ষোভকারী দৌড়ে যাওয়ার সময় হায়া’র পায়ে পাড়া দিয়ে যায়। এমনিতে বেকায়দা ছিলো পা’টা তার উপর পাড়া খেয়ে তার পায়েও বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছে।

জাহানের প্রশ্নের জবাবে মেহরিমা বলে–

—পরশু একটা টেস্ট আছে ভার্সিটিতে। ওটার পড়াই পড়ছিলাম। আর মাথা ব্যথা নেই এখন আলহামদুলিল্লাহ।

মেহরিমার সুস্থতার কথা শুনে জাহান লম্বা করে একটা শ্বাস ছাড়ে। টুকটাক কথা শেষ করে একে অপর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় হালকা ফ্রেশ হতে। লাঞ্চের পর ওয়ার্ড ভিজিটিংয়ে যেতে হবে তার।

_______________

গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে গুনগুনিয়ে কেঁদে চলেছে আদিবা। জায়িন তার গতকাল রাতের কথা সত্য করে দিয়েছে। সত্যি সত্যি আদিবার ভার্সিটিতে এসে তাঁকে থাপ্পড় মেরেছে। জায়িন কাল কথাটা আদিবাকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছিলো। কিন্তু সে আদিবার ভার্সিটিতে আসলে দেখতে পায় আদিবা তার ক্লাসমেটদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করছে।

গ্রুপস্টাডি করছে ভালো কথা, এতে জায়িনের কোন সমস্যা ছিলো না কিন্তু আদিবার থাপ্পড় খাওয়ার কারণটা হলো, তার ঘাড়ে হাত দিয়ে এক ছেলে বসে ছিলো। আদিবাও তার সাথে হাসতে হাসতে ছেলেটির গায়ে ঢলে পরছিলো। এই দৃশ্য দেখে কোন প্রেমিক পুরুষের মাথা ঠিক থাকে? জায়িন তাদের সামনে না গিয়ে ফোন করে আদিবাকে নিজের গাড়ির সামনে ডাকে। আদিবা নাচতে নাচতে এসে জায়িনের সামনে উপস্থিত হতে দেরি কিন্তু তার তুলতুলে গাল টায় থাপ্পড় পরতে দেরি হয় না।

গাড়িতে ঢুকিয়ে আরেক দফা ঝেড়ে তারপর শান্ত হয়েছে জায়িন। তারপর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে শহরের একটু বাহিরের সাইডে একটা লেকের কাছে। আদিবা সেই যে গাড়ি স্টার্ট করার পর থেকে কান্না শুরু করেছে, এখনো কেঁদেই চলেছে।

জায়িন গাড়ি থামিয়ে সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বসে থাকে চোখ বন্ধ করে। তার মতে সে ভুল কিছু করেনি। ছেলে ফ্রেন্ড থাকতে পারে, তাদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করা যেতেই পারে তাই বলে গায়ে হাত দিয়ে বসে থাকবে? এটা সে কিছুতেই মানতে পারবে না। জাহানের চেয়ে জায়িন শর্ট টেম্পারড। তার হাত একটু বেশিই চলে মুখে থেকে। সেই হিসেবে জাহান তার কথা দিয়ে হাতের কাজ করে ফেলে।

জায়িন চোখ খুলে ঘাড় কাত করে আদিবার দিকে তাকায়। টকটকে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে তার বেশ মায়া লাগে। আর কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই সে ঝট করে আদিবার একটা হাত টেনে ধরে নিজের কোলের উপর নিয়ে আসে আদিবাকে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হয় যে আদিবা সব বুঝে উঠার আগেই জায়িন কাজটা করে ফেলে।

কিন্তু যখন আদিবা বিষয়টা বুঝতে পারে তখন গরম তেলের মধ্যে পানি পরলে যেমন চিটচিটিয়ে উঠে তেলটা তেমন করে উঠে। জায়িনের বুকে কিল,, থাপ্পড় দিয়ে নিজেকে তার থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। জায়িন এক হাত দিয়ে আদিবার মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে পুনরায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। আদিবা নিজের মনের ক্ষোভ মিটিয়ে একটু পর নিজেই শান্ত হয়ে যায়। জায়িনের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে হুট করে জোরে একটা কামড় দিয়ে বসে।

জায়িন ব্যথা পেলেও দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। কামড়টা দেওয়ার মাধ্যমে আদিবা নিজের সবটুকু ক্ষোভ মিটিয়ে নেয়। তারপর নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরে জায়িনকে। আদুরে বিড়ালের মতো লেপ্টে থাকে জায়িনের বুকে।

জায়িন তার এমন শান্ত ভাব দেখে বলতে শুরু করে–

—আজ আমি তোকে যেভাবে দেখেছি সেভাবে তুই আমায় দেখতে পারবি? আমার শরীরে কোন মেয়ে হাত দিয়ে বসে থাকলে সহ্য করতে পারবি সেই দৃশ্য? তাহলে কাল থেকে তুই তোর মতো যা ইচ্ছে করবি আর আমি আমার মতো।

জায়িনের কথা শুনে আদিবা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জায়িনকে। জায়িন তার মাথা উঁচু করে আদিবার চোখে চোখ রেখে বলে–

—ভার্সিটিতে মেয়ে ফ্রেন্ড আমারও ছিলো, কিন্তু আমার মনে পরে না আমি এমন গায়ে হাত দিয়ে কারো সাথে কথা বলেছি। ফ্রেন্ড মানেই যে সে তোকে টাচ করতে পারবে এমনটা ভেবে থাকলে তুই ভুল। তোকে তোর বাপ-ভাইয়ের পর আমি ব্যতীত অন্যকেউ টাচ করলে সে তো ক্যালানি খাবেই তার কিছুটা তুইও খাবি। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন এটলিস্ট এই পারমিশন পাচ্ছিস না তুই। কিন্তু আমি মরে….

আদিবা নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে জায়িনের ঠোঁট। তারপর নিজেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে–

—এমনটা আর হবে না। আমি ভুলেও কোন ছেলের সংস্পর্শে আসবো না।

—আমারও না?

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে জায়িন। প্রশ্ন করে নিতান্তই আদিবার সাথে মজা নেওয়ার জন্য। আদিবা বাচ্চাদের মতো নিজের চোখ দুই হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলে–

—না তুমি আর বাকি রা কি এক নাকি।

—আমি আর বাকিরা এক না কেন? আমি কে তোর?

প্রশ্নটা শুনে আদিবা থমকে যায়। মনে মনে ভাবে–

—এই বজ্জাত লোক কি জানে না সে কে হয় আমার, তাও এমন প্রশ্ন করে আমায় বিব্রতবোধ করাচ্ছে।

জায়িন উত্তরের আশায় আদিবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আদিবা গাইগুই করতে করতে বলে–

—আমার ইনা, মিনা, টিনার পাপা।

—আর?

—আমার বাবার হবু মেয়ের জামাই।

—তোর কি সেটা বল।

—আমার ভালোবাসা, আমার ভালো থাকা, আমার সব তুমি।

কথাটা বলে আদিবা জায়িনের বুকে মুখ লুকিয়ে নেয়। প্রচন্ড লজ্জা পাচ্ছে সে কথাটা শেষ করার পর। জায়িন একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে আদিবাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।

জায়িন আর আদিবার রিলেশনটা তাদের ফ্যামিলির মধ্যে একটা অপেন সিক্রেটের মতো। সবাই জানে কিন্তু ভাবটা এমন করে কেউ জানে না। দু’জনেরই পরিবার অপেক্ষা করছে কবে এরা দু’জন মুখ ফুটে তাদের সম্পর্কের কথা বলবে। যেদিন বলবে সেদিনই বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলবে বলে জাভিয়ান আর আদিয়াতের মধ্যে কথা হয়ে রয়েছে।
________________

দুইদিন পর আজ কলেজে এসেছে হায়া। পায়ে যথেষ্ট ব্যথা থাকার পরও টেস্ট থাকায় আসতে হয়েছে। আশিয়ান তাঁকে সাহায্য করে গাড়ি থেকে নামতে। ভার্সিটি থেকে একটু দূরেই তাদের গাড়ি থামানো হয়েছে। আশিয়ান আর হায়া ভার্সিটির কাছাকাছি এসে দেখে মেহরিমা দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে।

মেহরিমা তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। তারপর আশিয়ানের থেকে হায়া’র হাতটা নিজের হাতে নিয়ে দুই বান্ধবী চলে যায় ভার্সিটির ভেতরে। আশিয়ান-হায়া আপাতত চাইছে না তাদের বিয়েটা ভার্সিটিতে জানাতে। মেহরিমা ছাড়া হায়া’র আর কোন ফ্রেন্ড তার আর আশিয়ানের বিয়ে সম্পর্কে জানে না। আশিয়ানের ক্ষেত্রেও সেম কাজটা হয়েছে।

তিন ঘন্টা পর হায়া আর মেহরিমা বের হয়ে ক্লাসরুম থেকে। মেহরিমা আর হায়া দুইজনের ক্ষুধা পাওয়ায় মেহরিমা হায়া’কে ভার্সিটির মাঠে একটা বেঞ্চে বসিয়ে ক্যান্টিনে চলে যায় নিজেদের জন্য খাবার আনতে।

আশিয়ান নিজের ক্লাস শেষ করে করিডর দিয়ে হাঁটতে থাকে। উদ্দেশ্য টিচার্সরুম। হঠাৎই তার চোখ যায় ভার্সিটির মাঠে। একটা মেয়েকে আরেকটা ছেলে জড়িয়ে ধরে আছে আর মেয়েটা ছেলেটাকে নিজের থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। চার তলার উপর থেকে মাঠের মধ্যখানে থাকা হায়া’কে তেমন একটা ভালো করে চিনতে পারে না আশিয়ান। কিন্তু হায়া’র ড্রেসের কালার দেখে তার একটু খটকা লাগে। তাই সে আর কিছু না ভেবে ঘটনাস্থলে যায়।

সেখানে এসে তো আশিয়ানের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে যায়। মেয়েটি সত্যিই হায়া। কিন্তু ছেলেটা কে সেটা চিনতে পারছে না। আশিয়ান বড়বড় কদমে হেটে তাদের কাছে এসে ছেলেটিকে টান দিয়ে হায়া’র থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ছেলেটিকে টান দেওয়ায় হায়াও নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে নিলে আশিয়ান তাঁকে ধরে ফেলে।

আশিয়ান হায়া’কে একহাত দিয়ে আগলে ধরে বলে–

—ঠিক আছো?

প্রশ্নটা হায়া’কে করলেও আশিয়ান উত্তরটা স্পষ্ট দেখতে পায়। হায়া ঠিক নেই। সে কাঁপছে থরথরিয়ে। আশিয়ান তাকে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে সামনের ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটার মুখ দেখার পর আশিয়ানের হুশ উড়ে যায়। মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে–

—তুমিইইইইই?

~চলবে?