সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-১৫+১৬

0
1

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_১৫

একদিন ল্যাব থেকে বাসায় ফিরে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলে হায়া’র একটা স্ট্যাটাস দেখতে পায়। যেটা দেখে আশিয়ান হতভম্ব হয়ে যায়। হায়া তার ফেসবুকের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে এনগেজড দিয়েছে আর তার ও ফারাবির এনগেজমেন্টের ছবি আপলোড করেছে। ফারাবি’র হাতের উপর হায়া ছোট্ট হাতটা দেখে আশিয়ানের বুকে জ্বলন শুরু হয়। সে তার ফোনটা ছুড়ে ফেলে দূরে।

সে বিশ্বাসই করতে পারছে না হায়া আজ থেকে অন্য কারো বাগদত্তা। নিজেকে শান্ত করার জন্য সে ওয়াশরুমের গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে থাকে। এমনিতেই লন্ডনের আবহাওয়া ঠান্ডা, সেই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আবার ঠাণ্ডা পানিতে শাওয়ার নিয়ে দুইদিন জ্বরেও ভুগেছিলো আশিয়ান।

আশিয়ান শাওয়ার শেষ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আফিফকে কল লাগায়। সে জানে আফিফই তাকে নির্ভুল সব তথ্য দিতে পারবে। আফিফের থেকে সে জানতে পারে হায়া’র এখন বিয়ে বা এনগেজমেন্ট করার কোন ইচ্ছে ছিলো না। মূলত ফারাবি’র পাগলামির কারণে তার বাবা-মা জাভিয়ান ও হানিয়া’কে অনেক জোর করায় তারা এখন এনগেজমেন্ট করে রাখছে। কিন্তু বিয়েটা হায়া’র ইচ্ছে মতো সময়ে হবে। যেহেতু হায়া তখনও বিবাহ ভীতি থেকে বের হতে পারে নি তাই ফারাবি ও তার পরিবার তাই মেনে নিয়েছিলো।

আশিয়ান এটা শুনে স্বস্তি পায় যে হায়া এই বিয়েতে রাজি না। কিন্তু তার মনে এই ভয়টাও থেকে যায় যে, হায়া যদি ফারাবি’র প্রেমে পরে যায়? তাহলে তো সে বিয়ে না করেই বউ হারা হয়ে যাবে।

এরপর থেকে সে তার রিসার্চে বেশি মনোযোগ দিতে থাকে, যাতে রিসার্চটা তাড়াতাড়ি সফল করে সে দেশে ব্যাক করতে পারে। এর আগে সে লন্ডনের একটা কলেজে লেকচারা হিসেবে জব করলেও পরবর্তীতে সেই জবটাও ছেড়ে দিয়ে নিজের পুরো ধ্যাণ জ্ঞানে রাখে শুধু তার রিসার্চকে। হায়া’র সাথে নিয়মিত কথা বলা ও নিজের রিসার্চ নিয়ে গবেষণা করতে করতে কবে যে আরো দেড়টা বছর চলে যায় আশিয়ান টেরও পায় না। তার রিসার্চ খুব ভালোভাবে সফল হয় এবং সে সকলের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়। এবার পালা দেশে ফিরে তার না হওয়া বউকে বিয়ে করার।

আশিয়ান যেভাবে কাউকে না জানিয়েই চলে গিয়েছিলো দূর দেশে, সেভাবে সে না জানিয়ে পুনরায় ফিরে আসে। আশিয়ান আর হায়া’র বিয়ের ছয় মাস আগে সে দেশে ফিরে। হায়া কিন্তু তখনও আশিয়ানকে দেখে নি। আশিয়ান জানে সে যেই ভুলটা করেছে তার কোন ক্ষমা হয় না, কিন্তু সে আগের বিষয়টা নিয়ে মন থেকে অনুতপ্ত এবং এবার সে হায়া’কে মন থেকে নিজের বউ হিসেবে মেনে নিতে চায়।

সে হায়া’র কাছাকাছি থাকার জন্য হায়া’র ভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে। প্রথমদিন আশিয়ানকে দেখে হায়া ভেতরে ভেতরে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পরলেও তার বাহিরটা ছিলো বরাবরের মতো শান্ত। সে আশিয়ানকে শুধু তার শিক্ষক ব্যতীত আর কিছু মনে করত না। আশিয়ান দেশে আসার পর একটা দিনও হায়া মির্জা বাড়িতে যায় নি।

একদিন আশিয়ান ক্লাস শেষ করে টিচার্সরুমের দিকে যাচ্ছিল তখনই তার নজরে পড়ে ফারাবি কোন একটা বিষয় নিয়ে হায়া’র সাথে ঝামেলা করছে। এক পর্যায়ে ফারাবি হায়ার হাত ধরে টানাটানি শুরু করলে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে দ্রুত সেখানে তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে–

—এখানে কি হচ্ছে?

আশিয়ানের এমন অপ্রত্যাশিত আগমনে হায়া-ফারাবি দুইজনই অবাক হয়ে যায়। ফারাবি কিছু বলার আগেই হায়া শক্ত গলায় বলে–

—কিছু না স্যার। আমাদের পারসোনাল ম্যাটার তাই আপনাকে জানাতে চাচ্ছিলাম না।

হায়া’র কথাটা শুনে আশিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। সে হায়া’কে প্রতিত্তোরে কিছু বলবে তার আগেই হায়া ফারাবি’র হাত টানতে টানতে তার সামনে থেকে চলে যায়। সেদিনই আশিয়ান ঠিক করে নেয় সে যেভাবেই হোক হায়া’কেই বিয়ে করবে।

তার কিছুদিন পরই শুনতে পায় হায়া আর ফারাবি’র বিয়ে। আশিয়ান এমন সংবাদ শুনে বিচলিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় আফিফের সাথে প্ল্যান করে কিভাবে ফারাবি’কে সরিয়ে আশিয়ান বর হবে। আফিফ তাকে এমন কাজে সাহায্য করতে চায় না। কিন্তু আশিয়ান যেনো তেনো ভাবে তাকে রাজি করিয়ে নেয়।

প্ল্যান অনুযায়ী বিয়ের দিন ফারাবি’র এসএসসি পড়ুয়া বোনকে তারা কিডন্যাপ করায়। আর ফারাবি ও তার পরিবারকে হুমকি দেয় তারা যাতে আজ বিয়েতে না যায়। ফারাবি’র পরিবার নিজেদের মেয়েকে বাঁচাতে বিয়ের দিন আসে না।

এদিকে দ্বিতীয় বার মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে দেখে জাভিয়ান না পেরে আশিয়ান দের কাছে হায়া’র বিয়ের প্রস্তাব রাখে। আশিয়ান এমন সুযোগ হাতে পেয়ে তা চটজলদি লুফে নেয়। হায়া এমন কথা শুনে বলেছিলো–

—আমি সারাজীবন কুমারী থাকবো কিন্তু তাও এই লোকের সাথে বিয়ে করবো না। তোমরা আমায় বারবার বিয়ে নিয়ে এমন চাপ দিতে পারো না।

কিন্তু সেদিন তার কথা কেউ শুনেনি। সবাই নানান ভাবে বুঝানোর পরও যখন হায়া রাজি হচ্ছিলো না তখন জাভিয়ানের হায়া’কে নিজের কসম দেয় বিয়েটা করার জন্য। জাভিয়ান যেমন মেয়ে অন্ত প্রাণ, হায়াও তেমন বাবা বলতে পাগল। সেদিন বাবার কসমের কারণেই হায়া বিয়েটা করেছিলো।

আশিয়ান তার ও হায়া’র বিয়ের দু’দিন পরই ফারাবি’র বোনকে ছেড়ে দিয়েছিলো। তার এসব অপকর্মে কথা আফিফ ব্যতীত আর কেউ জানে না।

_________________

বর্তমান~

আশিয়ান গাড়ি চালাতে চালাতে বিড়বিড়িয়ে বলে–

— ❝তোমায় পাবার তৃষ্ণায় যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়, তাও রাজি আমি,
পৃথিবী জ্বালিয়ে ছাই করে দিলেও, শেষ ছাইয়েও খুঁজে নেবো তোমায় আমি,
কারণ আমার সব শেষ, সব শুরু—তুমি, শুধুই তুমি।❞

________________

রাহাতের হাতে ঘড়িটা পরিয়ে দিয়ে মুনতাহা একটু পেছনে সরো দাঁড়ায়। রাহাত শেষবারের মতো চুলে চিরুনি চালিয়ে নিয়ে মুনতাহা’র মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলে–

—মেয়েরটার তো বয়স কম হলো না, ইদানীং ওর বিয়ে নিয়ে ভাবছি।

মুনতাহা স্বামীর এহেন কথা শুনে একটু অবাকই হন বটে। কারণ কয়েকমাস আগেও তিনি এবিষয়ে রাহাতকে বললে রাহাত জানায় সে এখনি মেয়ের বিয়ে দিবেন না। মেয়েকে সে অনেক দূর পর্যন্ত পড়াতে চান। কিন্তু সেই রাহাত আজ এমনটা বলছে শুনে তার অবাক হওয়া। তাও সে হাসি মুখে বলে–

—বেশ তো। আমি কি ঘটক ডাকবো? নাকি আপনার কোন ছেলেকে আমাদের মেয়ের জন্য পছন্দ হয়েছে?

রাহাত পকেটে ফোন ঢুকাতে ঢুকাতে বলে–

—মেয়ের মনে যে একজন আছে সেটা কি জানো?

মুনতাহা অবাক হয়ে বলে–

—না তো। রাহা তো আমায় এমন কিছু জানায় নি।

—তা জানবে কেনো। মেয়ের কোন খবরই তো জানো না। কিছুদিন আগে যে অসুস্থ হয়ে পরলো সেটাও এই কারণেই হয়েছিলো।

ভীষণ বিতৃষ্ণা নিয়ে কথাগুলো বলে রাহাত। মুনতাহা বিচলিত হয়ে বলে–

—তাহলে তো জল অনেক দূর গড়িয়ে পরেছে। তাড়াতাড়ি ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আচ্ছা, আপনাকে কি রাহা বলেছে ও কোন ছেলেকে পছন্দ করে?

—হুম। এবং সে আমাদের চেনাজানার মধ্যেই। এখন আসছি। বাকি কথা রাতে এসে বলবো।

রাহাত মুনতাহার মনে সাসপে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। মুনতাহা তার পেছন ডাকতে নিয়েও ডাকে না। চিন্তায় পরে যায় সেই ছেলেটি কে যাকে তার মেয়ে মন দিয়ে বসে আছে?

____________________

এপ্রিলের খর রোদ যেন আগুন হয়ে ঝরে পড়ে আকাশ থেকে। গোটা প্রাণীকুলই হাঁসফাঁস করে এই অসহনীয় উত্তাপে। যতই বেলা বাড়ে, সূর্য ততই রুদ্ররূপ ধারণ করে—তার প্রখর তেজে যেন পুড়ে যায় ধরণী। বিকেলের দিকে সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে, তখন তাপমাত্রা কিছুটা কমে বটে, কিন্তু আরাম মেলে না একটুও।

সূর্য অস্ত গেলেও বাতাসে জমে থাকে একধরনের ভ্যাপসা ক্লান্তি, শরীর-মনের উপর যেন চেপে বসে এক অদৃশ্য ভার। বিত্তবানদের জন্য হয়তো এই গ্রীষ্ম কেবলই একটি ঋতু, যাকে তারা এয়ার কন্ডিশনের ঠাণ্ডা পরশে উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কাছে এই গ্রীষ্ম এক ধরণের দুঃসহ পরীক্ষার নাম—ঘামে ভেজা বিছানা, নিঃস্ব প্রাচীর আর ক্লান্ত শরীরের দীর্ঘশ্বাসেই যেন মিশে থাকে তাদের গ্রীষ্মের দিনলিপি।

দুপুরের আহার্য সম্পাদন করার পর হায়া’র মাথা ব্যথা থাকায় সে হালকা ডোজের একটা ঘুমের ঔষধ নেয় যার কারণে সেই যে দুপুরে ঘুমিয়েছে, সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরও হায়া’র ঘুম ভাঙে নি।

আশিয়ান বাসায় এসে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়। সে নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে হালকা নাস্তা করে উপরে চলে আসে। হায়া জেগে থাকলে এতক্ষণে তাদের ঠুকনাঠুকনি শুরু হয়ে যেতো। হায়া যেহেতু ঘুমন্ত তাই আশিয়ানও নিজের জন্য ঘুমটা ফরজ করে নেয়। সে আস্তে আস্তে বেডে উঠে হায়া’র বুকের উপর শুয়ে তার কোমড় দুই হাতে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়।

আশিয়ানের কাঁধে এক পাহাড় সমান কাজ। ভার্সিটিতে টেস্ট এক্সাম চলছে সেগুলোর খাতা কাটা লাগবে। তার উপর বাবার কোম্পানিতে একটা নতুন প্রজেক্টে সেও হাত লাগাচ্ছে এবার সেটারও বহু কাজ বাকি। কিন্তু সে সব কাজ ফেলে বউয়ের বুকে মুখ গুঁজে একটা শান্তির ঘুম দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শরীর ক্লান্ত থাকায় অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে আশিয়ান ঘুমিয়েও পড়ে। ঘুমন্ত হায়া নিজের অজান্তেই স্বামীকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে আগলে নেয়।

~চলবে?

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_১৬

হায়া’র ঘুম ভাঙে রাত সাড়ে বারোটায়। অস্বস্তি ও গরমের জন্য ঘুমটা ভেঙেছে মূলত তার। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালে নিজের উপর একটা ভর অনুভব করে হায়া। চোখ ঘুরিয়ে নিজের বুকের দিকে তাকালে সেখানে তার অপ্রিয় বরকে দেখতে পেয়ে চোখজোড়া বড়বড় হয়ে যায়। সে বুঝে উঠতে পারে না এই লোক তার বুকের উপর ঘুমিয়ে আছে কেন?

সে আলতো করে ধাক্কাতে ধাক্কাতে আশিয়ানকে ডাকতে থাকে–

—অ্যাঁই শুনছেন, অ্যাঁই আশিয়ান ভাই উঠেন আমার উপর থেকে। বালিশে গিয়ে শুয়ে পরুন। ধুরু আটার বাস্তা!

অনবরত ধাক্কাধাক্কি ও ডাকাডাকিতে আশিয়ানের স্বাদের ঘুমটা ভেঙে যায়। সে ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বলে–

—কি হয়েছে বউ? ডাকছো কেনো এই মাঝরাতে?

আশিয়ানের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ শুনে হায়া’র কিছু একটা হয়ে যায়। কেমন ঘোর লাগানো কণ্ঠ আশিয়ানের। হায়া একটা ফাকা ঢোক গিলে বলে–

—নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পরুন। আমি তো আপনার ভাড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেলাম রে ভাই।

আশিয়ানের ঘুমটা পুরোপুরি ছেড়ে যায় হায়া’র কথা শুনে। সে আস্তে ধীরে হায়া’র বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তার দিকে তাকায়। বেলকনির দরজা খোলা থাকায় সেখান দিয়ে আসা আলোয় সে বেশ ভালো মতোই হায়া’কে দেখতে পারে। অনেক সময় ঘুমানোর কারণে হায়া’র মুখটা ফুলে টমেটো হয়ো রয়েছে। হালকা তৈলাক্ত মুখ টা আশিয়ানকে প্রচন্ড আকৃষ্ট করছে। মন চাইছে এই মেয়েটাকে নিয়ে ডুব দিতে ভালোবাসার দুনিয়ায়। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার হায়া’কে।

নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে আশিয়ান হুট করে হায়া’র দুই গাল চেপে ধরে তার কপালে মধ্যখানে নিজের ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ এঁকে দেয়। কোন তাড়াহুড়ো ছাড়াই বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সে কাজটা করে। আকস্মিক এমন আক্রমণে হায়া কিছুটা ভরকে যায়। সে নিজের চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে আশিয়ানের বক্ষে তলে পরে থাকে।

আশিয়ান নিজের মনকে শান্ত করে হায়া’র কপাল থেকে ওষ্ঠ সরিয়ে আনে। তারপর ডান গাল থেকে হাত সরিয়ে সেখান টায় মুখ ডুবিয়ে ঠেসে চুমু দেয়। অপর গালটাতেও সেম কাজটা করে হায়া’র থেকে সরে এসে উঠে বসে। পা দুটো বেড থেকে বের করে ঝুলিয়ে বসে বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে।

তারপর বসা থেকে উঠে শরীরটা ডানে বামে কয়েকবার ঘুরিয়ে একটু চাঙ্গা করে নেয়। হায়াও ততক্ষণে উঠে বসেছে। সে কোন কথা না বলে চলে যায় ফ্রেশ হতে। আসলে সে কথা বলার জন্য এনার্জি পাচ্ছে না। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে তার। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এসে মুখটা মুছে সে ছুট লাগায় নিচের যাওয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু বাধ সাধে তার অনাদরের বর।

আশিয়ান হায়া’র হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে–

— আজকের মতো এই রোমান্টিক রাতে লাফাচ্ছো কেনো? আমার গলা জড়িয়ে বসে থাকলেই তো পারো। না কি সাহস নেই, সামনে আসলেই গলে পড়ো?”

রাতটা যেন হঠাৎ করেই অন্যরকম হয়ে উঠেছে। কালো মেঘে আকাশ ঢাকা, মাঝে মাঝেই গর্জে উঠছে। ঠাণ্ডা হাওয়া জানালার পর্দা নাচিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে, ঠিক যেমন অনাহূত ভালোবাসা নাড়িয়ে দেয় অবচেতন অনুভবগুলোকে।

সারাদিনের ক্লান্ত করিয়ে তোলা রোদের তেজও যেন হার মেনে নিয়েছে এই রহস্যময় রাতের কোমল স্পর্শে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এক অনির্বচনীয় শীতলতা, আর সেই শীতলতার ভেতরেও যেন জমে আছে অদ্ভুত এক উষ্ণতা—ভালোবাসার, না বলা কথার, চোখে চোখ রাখার।

এই মুহূর্তটার সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েই আশিয়ান বলেছিল কথাটি। তার কণ্ঠে ছিল একরাশ কোমলতা, চোখে এক গভীর মুগ্ধতা—যেন প্রকৃতির মতো করেই সেও আজ বলতে চায় কিছু… চুপিচুপি, মনের সবচেয়ে নরম কোণ থেকে।

হায়া নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে–

—আপনার রোমান্টিক রাতের ক্ষ্যাতায় আগুন। ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। ছাড়ুন বলছি।

লাস্টের কথাটা একটু ধমকের সুরেই বলে হায়া। আশিয়ান তার কথা শুনে ছেড়ে দিয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। হায়া রুম থেকে বাহির হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে হাটা থামিয়ে দিয়ে কিছু একটা ভেবে পেছন ঘুরে তাকায়। আশিয়ানকে উদ্দেশ্য করে হায়া জিজ্ঞেস করে–

—অ্যাঁই আপনি খেয়েছেন?

আশিয়ান ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে–

—খাবো কীভাবে? আমার পুতুলবউ’টা না খেয়ে ঘুমাচ্ছে আমি কি খেতে পারি?

—হুহ।(একটা মুখ ভেঙচি দেয় হায়া,তারপর বলে) ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার নিয়ে আসছি।

কথাটা বলে এক মিনিটও দাড়ায় না। চলে যায় নিচোড়া নিজেদের জন্য খাবার আনতে। অন্যদিকে হায়া’র কথা শুনে আশিয়ানের মুখে হাসি ফুটে।

হায়া খাবার নিয়ে আসলে আশিয়ান আর সে খাবার খেয়ে নেয়। এঁটো প্লেটগুলো ধুতে হওয়াকে সাহায্য করে আশিয়ান। সব গুছিয়ে রুমে আসলে হায়া খেয়াল করে তার চোখে ঘুমের “ঘ’ ও নেই। সে একবার বইখাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে তো আরেকবার বেলকনিতে যায়। ঘরের মধ্যে হাটা চলা করে।

আশিয়ান ল্যাপটপে কাজ করতে করতে সবটা বিষয়ই আঁড়চোখে প্রত্যক্ষ করে। শেষে না পেরে বলেই দেয়–

—এমন হাটাহাটি করছো কেন রুমের মধ্যে? আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে। আর ঘুমাচ্ছো না কেনো?

হায়া কোমড়ে দুই হাত রেখে বলে–

—সেই দুপুরে ঘুমিয়ে রাত বারোটায় উঠলাম। ঘুমের কারখানা খুলে বসেছি আমি? এতক্ষণ ঘুমানোর পর কোন মানুষের ঘুম আসে?

আশিয়ান ভাবে –

—ঠিকই তো। আমি সন্ধ্যায় ঘুমানোর পরও যদি আমার ঘুম না পায়, এই অলসের ডিব্বা তো সেই দুপুরে ঘুমিয়েছে।

আশিয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে বলে–

—তাহলে পড়ালেখা করো। সামনের মাসে তোমার এক্সাম, আমি কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস চাই। নাহলে আমার কলিগদের সামনে আমার নাক কাটা যাবে।

—সেটা আপনি না বললেও আমি আনার চেষ্টা করবো। আর নাকের কথা বললেন, যেই না একটা বোঁচা নাক সেটা আবার কাঁটার কি টেনশন।

হায়া মুখ ত্যাড়াব্যাকা করে কেমনে যে কথাটা বলে। আশিয়ানকে হেনস্তা করার একটা সুযোগও সে মিস করতে চায় না। আশিয়ান তার কথা শুনে নিজের নাকে হাত বুলিয়ে বলে–

—আমার নাক ঠিকই আছে। বরং তোমার নাকউঁচু বাপের মতো তোমারও নাকটা একটু বেশিই উঁচু, যার কারণে বাকিদের নাককে বোঁচা মনে হয়।

হায়া তেড়েমেড়ে আশিয়ানের সামনে এসে আঙুল নাচিয়ে বলে–

—এই এই। খবরদার আমার পাপাকে নিয়ে কিছু বলেছেন তো আপনার বোঁচা নাকে ঘুষি দিয়ে আরো বোচা করে দিবো।

আশিয়ান নিজের কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটা রেখে ঝট করে টান দিয়ে হায়া’কে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নেয়। এমন কাজে হায়া একটু থতমত খেয়ে যায়। সে মোচড়ামুচড়ি করে চেষ্টা করে নিজেকে আশিয়ানের থেকে সরাতে।

আশিয়ান হায়া’র কোমড়ের দুই পাশে হাত রেখে নিজের মুখটা হায়া’র ঘাড়ে রেখে ফিসফিসিয়ে বলে–

—ঘুরতে যাবে?

আশিয়ানের এমন ফিসফিসিয়ে কথা বলায় হায়া’র কেমন একটা ঘোর লেগে যায়। আশিয়ান তার কোমড়ে হালকা চাপ দিয়ে বলে–

—কি হলো যাবে? নাকি আমি একাই চলে যাবো?

হায়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে–

—যা..বো।

হায়া’র এমন থেমে থেমে বলা কথা শুনে আশিয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে। সে হায়া’কে নিজের সাথে আরেকটু চেপে ধরে বলে–

—তাহলে সুন্দর করে বলো তো বউ “আশিয়ান আমি আপনার সাথে ঘুরতে যেতে চাই”।

হায়া আশিয়ানের নাম মুখে নিবে? একথাও হায়া জীবনে বলবে? হায়া যাও একটু ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলো আশিয়ানের কথা শুনে তার ঘোরটোর সব টাটা বায় বায় হয়ে গিয়েছে। সে আশিয়ানকে বলে–

—ছাড়ুন আমায়। আমার পাপা আমায় সিনিয়র সিটিজেনদের সম্মান করতে শিখিয়েছে?

—সিনিয়র সিটিজেন? সেটা আবার কে?

—কেন আপনি।

হায়া কথা শুনে আশিয়ানের মাথা ঘুরে যায়। হ্যা সে মানছে সে হায়া’র থেকে একটু বেশিই বড় তাই বলে তাকে সিনিয়র সিটিজেন বলে আখ্যায়িত করবে?

আশিয়ান কপট রাগ নিয়ে বলে–

—এই মেয়ে সিনিয়র সিটিজেন কাকে বলছো? জানো আমার বয়স কতো?

—জানবো না কেন? গুণে গুণে আমার থেকে নয় বছরের বড় আপনি। আমার একুশ হলে, আপনার ত্রিশ চলছে। দেখেছেন বয়সের ভাড়ে নিজের বয়সটায় ভুলে গিয়েছেন।

হায়া আশিয়ানকে রাগানোর জন্যই কথাটা বলে। এবং কিছুটা সফলও হয় বটে। আশিয়ান হায়া’কে নিজের কোলের উপর থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাবার্ড থেকে একটা শার্ট নিয়ে সেটা পরতে পরতে বলে–

—আমায় বুড়ো বলা না? নিবোই না তোমাকে আমার সাথে। এত রাতে তুমি একা থাকো। আমার রুমের পেছনের বটগাছ বসবাস করা পেত্নীদের সাথে আড্ডা দাও। আমি চললাম।

আশিয়ানের রুমের পেছনে আসলেই একটা বটগাছ আছে। সেটা অন্যের প্রোপার্টির ভেতর হওয়ায় কাটা হয়নি। ছোট বেলায় এই বাসায় আসলে আশিয়ান তাঁকে ভয় দেখানোর জন্য বলতো ঐ বটগাছে নাকি পেত্নী আছে। প্রতিদিন গভীর রাতে তার রুমের বেলকনির সামনে দিয়ে নাকি ঘুরাঘুরি করে। এসব শুনে হায়া অনেক ভয় পেয়ে যেতো। এখনো সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

হায়া তড়াক করে নিজের জায়গা ছেড়ে দৌড়ে আশিয়ানের পেছনে গিয়ে তার শার্টের এক কোণা চেপে ধরে বলে–

—ও আশিয়ান ভাই, নিয়ে যাও না আমাকেও সাথে করে। এমন করছো কেনো? এত শয়তান হলে হয় বলো?

—না হলেও আমি হবো। প্রথমত, তুমি আমার কথা শুনো নি। দ্বিতীয়ত, আমায় সিনিয়র সিটিজেন বলে অপমান করেছো। এসব কারণে আমি তোমায় নিবো না। একাই যাবে ঘুরতে এই রাতের বেলা।

কথাটা বলে আশিয়ান হায়া’র হাত ছাড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটা দেয়। রুম থেকে বের হবে ঠিক তখনই আশিয়ান শুনতে পায় কিছু অদ্ভুত কথা। হায়া বলছে–

—ঐ মাফুতো বর, নিয়ে যান না আমায়ও আপনার সঙ্গে করে ঘুরতে।

আশিয়ান পেছন ঘুরে বলে–

—মাফুতো বর? এটা আবার কেমন ডাক?

হায়া তার কাছে আসে গুটিগুটি পায়ে। তারপর আশিয়ানের শার্টের একটা বোতাম ধরে সেটা খুঁটতে খুঁটতে বলে–

—আপনি তো আমার দুই দিক দিয়েই কাজিন না? মায়ের দিক দিয়ে মামাতো ভাই আর পাপার দিক দিয়ে ফুফাতো ভাই। এখন আপনাকে যদি শুধু মামাতো বর বা শুধু ফুফাতো বর ডাকি তাহলে ইনজাস্টিস হয় না?সবগুলো সম্পর্ককে জাস্টিস দিতে এই ডাকটা আবিষ্কার করলাম। সুন্দর হয়েছে না নামটা?

মিটমিটিয়ে হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করে হায়া। এদিকে হায়া’র এমন উদ্ভট ডাক আর লজিক শুনে আশিয়ানের মাথা দু’টো চক্কর দিয়ে উঠে।

________________

—মেহু?

—জ্বি?

মেহরিমার এই ছোট একটা উত্তরেও জাহানের দম বন্ধ হয়ে আসে ভালো লাগায়। তার খুব করে ইচ্ছে হয়, মেহরিমাকে তার বুকের নিয়ে সে সারারাত গল্প করবে। ইচ্ছে হলে, আলতো করে ছুইয়ে দিবে ভালোবাসার পরশে, কখনো বা ঠোঁট কাটা কিছু কথা বলে লাজে রাঙিয়ে দিবে মেয়েটাকে।

—কি করছো?

—পড়ে উঠলাম। আপনি?

—তোমার কথা ভাবছি।

ছোট্ট করে মনের কথা জানিয়ে দিলো জাহান তার প্রেয়সীকে। জাহানের কথা শুনে মেহরিমার গাল লাজে লাল হয়ে যায়। লোকটার সাথে যখনই কথা বলে তখনই কোন না কোন কারণে মেহরিমা এমন লাল টুকটুকে রূপ ধারণ করবেই। অথচ জাহান কিন্তু তেমন কিছুই বলে না।

—মেহরিমা শুনছো?

—জ্বি বলুন।

—চলো না আমরা বিয়ে করে ফেলি। তোমায় নিজের চোখের আড়ালে রাখা আমার জন্য কতটা কষ্টের তুমি বুঝতো পারো না।

জাহানের কথা শুনে মেহরিমা আরো লজ্জা পেয়ে যায়। সে মিনমিনিয়ে বলে–

—আঙ্কেল-আন্টি কি আমায় মেনে নিবেন?

—তোমায় বউ করে নিয়ে আসি, দেখবে তোমায় আমি আদর করার সুযোগই পাচ্ছি না। তুমি সারাদিন আম্মুর সাথে লেপ্টে থাকবে তার আদর পাওয়ার জন্য।

জাহানের কথা শুনে নিঃশব্দে তৃপ্তির হাসি দেয় মেহরিমা। তার যথেষ্ট ভালো ধারণা হয়ে গিয়েছে জাহানের পরিবারের সম্পর্কে। যেখানে সেই ফ্যামিলির দুইজন সদস্য তার মতো এসে অচেনা, অজানা এতিম মেয়েকে এতটা ভালোবাসতে পারে, বাকিরাও এমনই ভালে মনের হবে হয়ত।

—কি হলো? বললে না কিছু?

—কি বলবো?

—বিয়ে করবে আমায়? চলো না কাল করে ফেলি? আমার একটুও মন টিকছে না তোমায় ছাড়া। নেগেটিভ সব ভাবনা এসে ভীড় করছে আমার মাথায়।

—এক্সাম টা শেষ হোক। আমারও মেন্টাল প্রিপারেশনের প্রয়োজন। আর নেগেটিভ ভাবনা? সেটা কি নিয়ে আসছে?

—তোমায় নিয়ে। তুমি প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না। আমি তোমায় অনেকটা বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি, এতটা ভালোবেসে ফেলেছি যে একজনমে আমার আর অন্য কারো জন্য ভালোবাসার অবশিষ্ট নেই।

ধরা গলায় কথা গুলো বলে জাহান। মেহরিমা তার কথার প্রতিত্তোরে নিরবতা অবলম্বন করে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জাহান নিরবতা ভঙ্গ করে বলে–

—সামনের সপ্তাহ থেকে আমায় একটা ট্রেনিংয়ের জন্য যেতে হবে চট্টগ্রাম। সকল নিউ হার্ট সার্জেনদের জন্য আমার হসপিটালের অথোরিটি ব্যবস্থা করেছে। এক মাস সেখানে থাকতে হবে।

—আচ্ছা। সাবধানে থাকবেন। নিজের যত্ন নিবেন।

—হুম।

এমনই আরো টুকটাক কথা চালিয়ে যায় এই জুটি।

~চলবে?