সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-১৭+১৮

0
1

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_১৭

Maine jab dekha tha tujhko,
Raat bhi wo yaad hei mujhko!
Taare ginte ginte so gaya….

Dil mera dhadka tha kass ke,
kuch kaha tha tune hass ke!
Main usi pal tera ho gaya….

Aasmano pe jo khuda he,
Usse meri yahi Dua hai!
Chand yeh har roz mein Dekhu,
Tere sath mein….

হায়া’র চোখে চোখ রেখে গানটা গায় আশিয়ান। গানের প্রতিটি শব্দ যেনো আশিয়ানের ঠোঁট ছুঁয়ে বেরিয়ে এসে হায়া’র হৃদয়ে কাঁপন তুলছে। চারপাশ থমকে গেছে। কোলাহল, আলো, মানুষ—সব ফিকে। শুধু আশিয়ানের কণ্ঠটাই যেনো রয়ে গেছে বাস্তবের একমাত্র সুর হয়ে।

হায়া নিঃশ্বাস আটকে গেছে। ওই চোখ দুটো—যে চোখগুলোকে সে একসময় ঘৃণা করতে শিখেছিল, আজ সেগুলোতেই যেনো নিজের হারিয়ে যাওয়া সমস্ত স্বপ্ন খুঁজে পাচ্ছে। আশিয়ান তার চোখ দিয়ে কথা বলছে, মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি না-বলা কথা যেনো সুর হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে হাওয়ায়।

ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আশিয়ান। প্রতিটি পদক্ষেপে তার ভেতরের সমস্ত অহং ভেঙে চুরমার হচ্ছে, যেনো সে কোনো ক্ষমা চাওয়া শব্দহীন প্রার্থনার ভেতর দিয়ে হায়া’র কাছে ফিরছে। আর হায়া—সে স্থির, নিঃশ্বাসও যেনো নিতে ভুলে গেছে।

তার বুকের ভেতর কান্না জড়ানো এক রোমন্থন কাজ
করছে—যন্ত্রণায় গড়া ভালোবাসা, বেদনায় ভেজা প্রতীক্ষা।

আশিয়ানের গলায় সুর থাকলেও, চোখে ছিল দহন। তার দৃষ্টি যেনো কেবল একটা প্রশ্ন রাখছে হায়ার চোখে—“তুমি এখনো ভালোবাসো?”

আর হায়া’র চোখ… তার চোখে ছিল এক প্রকার আত্মসমর্পণ। ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, তবুও তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে জবাব ধ্বনিত হচ্ছে—“সবকিছু সত্ত্বেও, হ্যাঁ… আমি ভালোবাসি।”

সেই মুহূর্তে, গান থেমে গেলেও আবেগ থামেনি। সেখানে শুধু তারা দু’জন, আর মাঝখানে ভাঙা ভাঙা একটা হৃদয়, যা আবার জোড়া লাগতে চাইছে… শুধুমাত্র ভালোবাসার এক নিঃশব্দ স্পর্শে।

আশিয়ান একদম কাছে এসে দাঁড়ায়। এতটাই কাছে যে আশিয়ানের চঞ্চল উষ্ণ নিঃশ্বাস হায়া’র মুখে আছড়ে পরছে। আর সেই উষ্ণতা ভরা নিঃশ্বাসের সংস্পর্শে এসে হায়া’র অন্তঃকর্ণ কেঁপে কেঁপে উঠছে। আশিয়ানের ছোট ছোট চোখেজোড়া ছিল এক অদ্ভুত নিরবতা কিন্তু তাতে ভালোবাসার উষ্ণতার উপস্থিতি ঠিকই টের পেয়ে যায় হায়া।

আশিয়ান এক মুহূর্তের জন্য থেমে, তারপর তার হাতটা এগিয়ে আনে হায়া’র কাছে। হায়া বুঝে ওঠার আগেই, তার পুরুষালী উষ্ণ আঙুল দিয়ে হায়া’র ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা আইসক্রিমটায় আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয়। ছোঁয়াটায় যেনো কাঁটা দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে যায় হায়ার সারা গায়ে।

এর পরের মুহূর্তেই—সে হায়া’কে অবাক করে দিয়ে সেই আঙুলটা নিজের মুখে পুরে নেয়। চোখে তখনো চাহনি গাঁথা হায়ার চোখে।

গলায় গা ছমছমে হাস্কি টোনে বলে—
–দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম… কিন্তু আসল স্বাদটা নেওয়ার সৌভাগ্যই হয়ে উঠলো না।

কথাটার মানে বুঝতে হায়া’র বেশি সময় লাগে না। আশিয়ানের কথা শুনে হায়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। চোখে লজ্জা, মুখে উত্তাপ, নিঃশ্বাস এলোমেলো। ঠোঁট কামড়ে কোনোভাবে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে।

এক মুহূর্ত পর, কিছু না বলে সে আচমকা মুখ ফিরিয়ে নেয়। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে পিঠ ঘুরিয়ে নেয় আশিয়ানের দিক থেকে। তার গালে তখন লাল ছায়া—রক্তিম, লজ্জায় গলে যাওয়া চেহারা।

–হায়া…

আশিয়ানের কণ্ঠ তার পেছন থেকে নরম হয়ে ডাকে, কিন্তু হায়া ততক্ষণে এক মনে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। উদ্দেশ্য গাড়ি।

দ্রুত পায়ে সরে যাচ্ছে সে, কিন্তু পায়ের গতি আর হৃদয়ের গতি যেনো সমান তাল মিলিয়ে ছুটছে না। তার বুকের ভেতর তখনও আশিয়ানের স্পর্শের স্মৃতি, ঠোঁটে এখনও তার সেই চাহনির তাপ।

একবার পেছনে তাকায়—চোখাচোখি হয়।
আশিয়ান এখনও দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে সেই চেনা, শয়তানি-মেশানো মিষ্টি হাসি।

হায়া তার দৃষ্টি এড়িয়ে নিয়ে মুখ নিচু করে ফিসফিস করে বলে—
—পাগল… একদম অসহ্য রকমের পাগল।

কিন্তু তার কণ্ঠে রাগ ছিল না, ছিল কাঁপা কাঁপা প্রেম। হায়া পা চালিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। আশিয়ানও কিছু সময়ের ব্যবধানে গাড়িতে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। বেশ কিছুক্ষণ তারা দু’জনই নিরবতা পালন করে। এক পর্যায়ে নিরবতা ভঙ্গের দায়িত্ব হায়া নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বলে–

—কই যাচ্ছি আমরা? বাসায় ফিরবেন না?

—নাহ। আজ বাসায় যাবো না ভাবছি।

—তাহলে কোথায় যাবেন?

—ভাবছি আজ সারারাত এভাবে ঘুরবো। সকালের দিকে বাসায় ফিরবো। আইডিয়াটা কেমন?

—পুরাই বাকওয়াস। চুপচাপ গাড়ি বাসার দিকে ঘুরান। কেউ জানতে পারলে বকা দিবে দু’জনকেই।

—একদিন না হয় বকা খেলাম।

—আপনার এত শখ হলে আপনি খেয়েন কিন্তু আমায় বাসায় রেখে আসুন। পরে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেয়েন।

—তা তো হচ্ছে না ওয়াইফি। তুমি হচ্ছো আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার রুহ, দেহ দুটোরই অর্ধেকাংশ। তাই আমি যা পাবো, যা খাবো, যা করবো সবকিছুর ফলাফলের ভাগ তোমাকেও অর্ধেক নিতে হবে। এতে তোমার মত থাকুক আর না থাকুক।

—আমি আপনার সবকিছুর অর্ধেক ভাগ নিলেও আমার কষ্টের ভাগ আপনি এক বিন্দুও নিবেন না। কেনো জানেন? কারণ আমায় কষ্টগুলো দেনই আপনি।

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে হায়া কথাগুলো বলে। আশিয়ান হায়া’র কথায় খানিকটা কষ্ট পায় কিন্তু আপাতত দৃষ্টিতে হায়া’র কথাই সঠিক।

আশিয়ান বলে–

—দেখো….

আশিয়ান কথাটা শেষ করার আগেই তার গাড়িটা কাউকে ধাক্কা দেয়। অর্থাৎ কেউ একজন তার গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে। আশিয়ান জোরে ব্রেক কসে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

এমন ঘটনায় হায়া ও আশিয়ান দু’জনই ভয় পেয়ে যায়। তারা তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে দেখে ৯/১০ বছরের একটা বাচ্চা মাটিতে লুটিয়ে পরেছে। আশিয়ান আর হায়া বাচ্চাটির মাথার কাছে বলে পরে। আশিয়ান বাচ্চাটির মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার গালে আলতো করে চাপড় মেরে বলে–

—এই বাবু! চোখ খোলো? বেশি ব্যথা পেয়েছো?

হায়া আশিয়ানকে ধমকে বলে–

—আপনি যে চশমা লাগিয়েও দেখতে পান না আজ জানলাম। দেখছেন বাচ্চাটা ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে পরেছে তাকে আপনি জিজ্ঞেস করছেন বেশি ব্যথা পেয়েছে নাকি। রাতকানা কোথাকার। কোলে তুলুন বাচ্চাটাকে। হসপিটালে নিতে হবে ওকে।

আশিয়ান হায়া’র কথা মতো বাচ্চাটিকে কোলে তুলে গাড়ির দিকে হাঁটা দিলে তখনই কোথা থেকে যেনো ২/৩ জন লোক এসে তাদের সামনে উপস্থিত হয়।

একজন লোক বলে–

—এই আপনারা বাচ্চাটিকে এভাবে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বাচ্চাটা তো মনে হয় অজ্ঞান।

আশিয়ান বলে–

—আসলে ও হুট করে আমাদের গাড়ির সামনে এসে এক্সিডেন্ট করে ফেলেছে। তাই ওকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি।

আরেকজন লোক বলে–

—এক্সিডেন্ট করলো কিভাবে? দেখে চালাচ্ছিলেন না নাকি? এক মিনিট, এক মিনিট আপনারা বাই এনি চান্স বাচ্চা কিডন্যাপার না তো? তা না হলে এত রাতে এমন সুনশান জায়গায় বাচ্চাটা আসবে কোথা থেকে? বাচ্চাটির শরীরেও তো বেশ ক্ষত দেখা যাচ্ছে।

লোকটির পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠে–

—ঠিক বলেছিস শরীফ। ওরা হয়ত বাচ্চা চোর। বাচ্চাটাকে এখানে এনেছিলো কোন ক্ষতি করার। যেই আমাদের দেখলো তখনই এসব কাহিনি বলা শুরু করলো। না না এদের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।

লোকগুলোর কথা শুনে আশিয়ান আর হায়া বিচলিত হয়ে পরলো। হায়া অস্থির কণ্ঠে বলে–

— আপনারা আমাদের ভুল বুঝছেন। আমরা দু’জন হাসবেন্ড ওয়াইফ। আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরাঘুরি করছিলাম তখনই বাচ্চাটা হুট করে আমাদের গাড়ির সামনে এসে পরে। আমার হাসবেন্ড ইচ্ছে করে ওকে হিট করে নি। আমি বিশিষ্ট শিল্পপতি জাভিয়ান তালুকদারের মেয়ে জেসমিন তালুকদার হায়া। উনি আমার হাসবেন্ড। আপনারা আমাদের ভুল বুঝবেন না।

হায়া’র পরিচয় শুনে লোক তিনটা’র চোক্ষু চরগ গাছ। জাভিয়ানকে চিনে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। বিখ্যাত বিজনেসম্যান হিসেবে তার বেশ খ্যাতি রয়েছে। তারা চোখে চোখে নিজের মধ্যে কি কথা বললো তারাই জানে। তারপর তাদের মধ্যে শরীফ নামের লোকটি বলে–

—আমার তো আপনাদের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। তোমরা কি বলো?

শরীফ বাকি দু’জন কেও জিজ্ঞেস করে। তারাও নেতিবাচক উত্তর দেয়। আশিয়ান বলে–

—আপনারা যদি আমাদের কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। আপনারা চাইলে আমাদের সাথে হসপিটালে যেতে পারেন আমাদের গাড়িতে করে। এমনিতেই অনেকটা সময় চলে গিয়েছে।

আশিয়ানের কথার মাঝেই তার কোলে থাকা বাচ্চাটি নড়েচড়ে উঠে। সেকেন্ডের ব্যবধানে বাচ্চাটি চোখ খুলে তাকায়। একজন লোক বলে–

—ঐ তো বাচ্চাটির জ্ঞান ফিরেছে। এখন ওর থেকেই সবটা জানা যাবে।

আশিয়ান বাচ্চাটিকে নিচে দাঁড় করিয়ে দেয়। শরীফ লোকটি বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে–

—বাবু তোমার নাম কি? আর এখানে এত রাতে এলে কি করে? আর তোমায় এত মেরেছে কে? তুমি নিঃসংকোচে আমাদের সবটা বলো। আমরা তোমায় সাহায্য করবো।

লোকটির কথা শেষ হতে না হতেই বাচ্চাটি তাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। বাচ্চাটির এমন কান্না দেখে আশিয়ান-হায়াও ভরকে যায়। আরেকজন লোক এসে বলে–

—ভয় পেও না বাবা। বলো তোমার সাথে কারা কি করেছে? আমরা বলছি তো তোমায় সাহায্য করবো।

অনেক কষ্টে বাচ্চাটির কান্না থামে। তারপর বাচ্চাটি হিঁচকি তুলতে তুলতে বলে–

—আমার নাম রাফি। উনারাই (আশিয়ান আর হায়া’কে দেখিয়ে বলে) আমারে এমনে মারছে। আমি হেগো বাসায় কাম করতাম। একটু ভুল হইলেই আমারে মারতো। পরশু সাহেবের শার্টে ভুল বশত চা পইরা যাওয়ায় আমারে ইস্টোর রুমে আটকায় রাখছে এই দু’দিন। আর অনেক মারছেও। দেখেন আঙ্কেল মাইরা আমারে কি করছে। আজ সন্ধ্যায়ও অনেক মারার পর আমি অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম। তারপর হেরা আমারে কি করতে এহানে আনছে আমি জানি না চোখ খুললাম মাত্র।

বাচ্চাটির কথা শুনে আশিয়ান আর হায়া’র আক্কেল গুড়ুম। বলে কি এই বাচ্চা? তারা একে দেখলোই আজকে। হায়া বাচ্চাটির সামনে এসে রাগত স্বরে বলে–

—এই বাবু মিথ্যে বলছো কেন? আমরা তোমায় কবে কাজে রাখলাম আর এভাবে মারলাম। আমরা তোমায় চিনিই না। শুধু শুধু মিথ্যা বলছো।

শরীফ নামের লোকটি হায়া’কে ধমকে বলে–

—এই আফা, বাচ্চাটা রে ধমকান কেন এখন? বাচ্চা মানুষ যা সত্য তাই কইছে। মিয়াভাই (আরেকজন লোককে উদ্দেশ্য করে বলে) এরে আমাগো এলাকায় নিয়া চলেন। তারপর আমরা পুলিশ ডাকমু। যা ফয়সালা করার পুলিশই করবো। জাহিল গুলা কেমনে বাচ্চাটা রে মারছে। দেখেই আমার রক্ত গরম হইয়া যাইতাছে।

আশিয়ান লোকটির কথা শুনে কিছু একটা বুঝতে পারে হয়ত। সে হায়া’কে বাচ্চাটির সামনে থেকে সরিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে নিজের পেছনে লুকিয়ে নেয়। হায়া কিছু বলতে গেলে আশিয়ান চোখ গরম করে তাঁকে চুপ করিয়ে দেয়।

আশিয়ান লোক গুলোর উদ্দেশ্য শান্ত গলায় বলে–

—আচ্ছা ঠিক আছে, আপনারা ফোন দিবেন তো পুলিশকে। ভালো কথা। আপনারাদের দেওয়া লাগবে না, আমি নিজেই দিচ্ছি।

কথাটা বলে আশিয়ান নিজের প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে যেই না কল করতে যাবে তখনই একজন লোক আশিয়ানের ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনা দেখে হায়া চমকে গিয়ে আশিয়ানের পিঠের কাছে আরেকটু সেঁটে যায়। সেও কিছু একটা বুঝতে পেরেছে।

আশিয়ান লোকটিকে বলে–

—আমার ফোন নিলেন কেন এমন করে? ফোনটা দেন, আমি কল করছিলাম তো পুলিশকে।

হঠাৎই লোক তিনটা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে উচ্চস্বরে হেঁসে দেয়। বাচ্চাটিও ততক্ষণে তাদের কাছে চলে গিয়েছে। শরীফ লোকটি বলে–

—এরে তোরা বের হয়ে আয়। বড় পাখি পাইছি আজ। তাগো খাতিরযত্ন করবি না তোরা?

লোকটা নিজের কথা শেষ করতে না করতেই আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে হুড়মুড়িয়ে আরো ৭/৮ জন লোক বের হয়ে আসে।তাদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে দেশীয় অ*স্ত্র। আশিয়ান আর হায়া এবার স্পষ্ট বুঝতে পারে তারা ডাকাতদের কবলে পরেছে।

সবাই শরীফ নামের লোকটির পেছনে এসে দাঁড়ায়। একটা লোক শরীফের দিকে একটা রাম দা এগিয়ে দেয়। শরীফ সেটা নিজের হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে–

—আমরা থাকতে আপনাগো এত কষ্ট করতে দেই কি করে? আপনারা ফোন তো করবেন কিন্তু পুলিশ না নিজের পরিবার রে। আর কেন করবেন আশা করি বুঝতে পারতাছেন। এহন আমাগো লগে চলেন। আমাগো এলাকায় আইছেন একটু খাতিরযত্ন না নিয়ে ছাড়ি কেমনে। (হঠাৎই মুখটা ইস্পাত কঠিন করে বলে) কোন চালাকি করবেন না, তাইলে ঘাড় থেকে কল্লা আলাদা করতে বেশি সময় নিমু না কিন্তু আমি।

হায়া আগে কখনো এমন সিচুয়েশনে পরে নি তাই সে একটু বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছে। সে আশিয়ানকে পেছন থেকে খামচে ধরে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে। আশিয়ান তার এমন কাঁপুনি দেখে বুঝতে পারে তার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে। সে হায়া’কে পেছন থেকে সামনে এনে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একহাত দিয়ে। তারপর হায়া’র চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। শরীফকে উদ্দেশ্য করে বলে–

—আমরা কোন চালাকি করবো না। আপনারা যেই দাবী করবেন তাই আমরা পূরণ করবো। আপনি চাইলে আমার ফোন আর আমার গাড়ি রাখতে পারেন। দুটো মোট দাম বারো লাখ টাকা। কিন্তু প্লিজ আপনারা অস্ত্র গুলো সরান। এসব দেখে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পরছে।

পাশ থেকে আগের একটা লোক বলে–

—গাড়ি ফোন তো আমরা এমনিতেই নিমু। কিন্তু তার লগে ঐ ফুলটুসি রেও আমাগো দিতে হইবো যে মিয়াভাই।

লোকটার কথা শুনে বাকি সকলে বিশ্রী ভাবে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে দেয়। আশিয়ান লোকটির কথা শুনে পারে না হায়া’কে নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। মনে মনে সে একটা কথাই বলে–

—আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করো মাবুদ।

শব্দসংখ্যা~১৮৪৮
~চলবে?

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_১৮

কেমন যেনো একটা অস্বস্তুির জন্য করে জাভিয়ানের ঘুমটা ভেঙে যায়। হাসফাস লাগছে, বুকের ভেতর ধরফর করছে। সে আলতো করে হানিয়া’র মাথাটা নিজের বুকের উপর থেকে সরিয়ে বালিশে রাখে। তারপর নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে বেলকনিতে এসে পরে।

রাত ছিলো জাভিয়ানের নিকট এক অনিবার্য মোহের নাম। চাঁদের শীতল আলো যখন গগনে উদ্ভাসিত হয়ে চারপাশে অপার্থিব আলো ছড়িয়ে দিতো, তখন সে যেন এক গভীর আত্মতৃপ্তি খুঁজে পেতো সেই সৌন্দর্যে। কত শত রাত, কত অনাহুত মুহূর্ত—হানিয়াকে বক্ষে জড়িয়ে সে কাটিয়ে দিয়েছে নিদ্রাহীন নিঃশব্দতায়। হানিয়া যখন ক্লান্তিতে চোখ মুদে তার বুকে আশ্রয় নিত, তখন জাভিয়ান এক নিঃসঙ্গ চাঁদপ্রেমীর মতো নিজের ধ্রুবতারা–হানিয়াকে দেখে যেত নিরবধি, জানালার ফাঁক গলে আসা চাঁদের আভায়। চাঁদের আলোকচ্ছটায় তাঁর প্রিয় মুখে খেলে যাওয়া প্রতিচ্ছবি যেন তাঁকে নতুন করে জীবনের অর্থ বুঝিয়ে দিত। কখন রাত গলে ভোর হতো, সে বুঝতেই পারতো না।

আজও গগনে সমুজ্জ্বল পূর্ণিমা। পরিবেশের উপর এক অদ্ভুত কোমলতা, এক নিরাবেগ শীতলতা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আজ, এই অতিপরিচিত স্নিগ্ধতা যেন জাভিয়ানের হৃদয়কে স্পর্শই করতে পারছে না। হৃদয়ের অন্তঃস্থল জুড়ে এক অজানা দহন, এক গভীর অস্থিরতা বিরাজ করছে। কারণটি যেন অদৃশ্য, অথচ অনুভবে প্রগাঢ়।

তার অন্তর কাঁপছে—কোনো অজানা আশঙ্কায়। মনে হচ্ছে, তার রক্তমাংশে গড়া সন্তানের একজন কোনো অজানা বিপদে পতিত হয়েছে। অথচ বাস্তবতার পর্দা তো ভিন্ন কিছু বলে। ঘুমানোর পূর্বে সে নিজ চোখেই দেখেছে জাহান ও জায়িনকে—তারা হাসিমুখে তার সঙ্গেই উপরে উঠে নিজ নিজ কক্ষে গমন করেছে।

কিন্তু হায়া?না, আজ সারাদিন মেয়েটির মুখ পর্যন্ত দেখেনি সে। সকালের তাড়া থাকায় ঘর ছাড়ার সময় হায়া’র সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ হায়া তখনও নিদ্রারত ছিলো। সন্ধ্যায় ফিরেই শুনল, তার কন্যা নাকি দুপুর থেকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, এখনও জাগেনি। রাত্রির ভোজনকালে হানিয়া যখন গিয়ে ডাকতে যায়, তখন তাদের জামাতা আশিয়ান জানায়—তারা পরে খাবে, কারণ তার দু’জন নাকি ঘুমের রাজ্যে বিভোর।

তবে কি হায়ার অনুপস্থিতিই এই অন্তর্লীন অস্থিরতার উৎস?

জাভিয়ান জানে না। শুধু জানে, আজকের এই পূর্ণিমা তার চোখে কোনো রূপকল্প ছড়ায় না। আজকের চাঁদ তার চিরচেনা চাঁদ নয়। হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসা এক বিষণ্ণ স্রোত যেন তাকে বারবার করে বলছে—কিছু একটা ঠিক নেই।

আজকের রাত্রি, জাভিয়ানের প্রিয়তম রাত্রি—নির্জনতার মাঝে জড়িয়ে আছে এক দুর্বোধ্য শঙ্কার ছায়া।

হঠাৎই কেউ একজন এসে জাভিয়ানের কাঁধে হাত রাখে। জাভিয়ান চমকে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পায় নিজের প্রেয়সীকে। হানিয়া তার অস্থিরতা টের পেয়ে যায় জাভিয়ানের চোখ দেখেই। হানিয়া জাভিয়ানকে প্রশ্ন করে–

—কি হয়েছে আপনার? এমন অস্থির হয়ে আছেন কেনো? আর এমন ঘামছেনই বা কেনো?

জাভিয়ানের কপালের ঘামগুলো শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে দিতে প্রশ্ন করে হানিয়া। মুছানো শেষ হয়ে গেলে হানিয়া জাভিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে জাভিয়ান অন্যমনস্ক হয়ে আছে। হানিয়া আবারও প্রশ্ন করে–

—কি হলো বলুন? এমন অস্থিরতা, অন্যমনস্কতা কেন আপনার? খারাপ লাগছে কোথাও? এই আপনার বুকে ব্যথা করছে না তো আবার?

শেষের প্রশ্নটা করতে গিয়ে হানিয়া নিজেই অস্থির হয়ে উঠে। হায়া’র বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর সকলে যখন হায়া’র চরিত্রে আঙ্গুল তুলছিলো আর এসব দেখে হায়া ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলো তখন জাভিয়ান মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় আবারও হার্ট অ্যাটাক করে। বেশি বড় না কিন্তু তারপরেও হার্টের অবস্থা অনেক নাজুক হয়ে গিয়েছিলো। তখন থেকে হানিয়া জাভিয়ানকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকে।

জাভিয়ান হানিয়া’র এক হাত টেনে ধরে তার মাথাটা নিজের বুকের উপর রাখে। হানিয়া’র চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–

—জানি না কেমন জানি একটা চাপা অস্থিরতা কাজ করছে। মেয়েটাকে আজ সারাদিন দেখি নি তাই হয়ত এমনটা হচ্ছে। এছাড়া কিছুই না। তুমি অযথা টেনশন করে নিজের প্রেশার বাড়িয়ে ফেলো না।

হানিয়া জাভিয়ানের বুকে মাথা রেখেই বলে–

—মেয়ে কি এখন আর ছোট আছে? আপনি শুধু শুধু টেনশন করেন। চলেন রুমে চলেন, ঘুমাবেন গিয়ে। রাত জেগে আউলফাউল চিন্তা ভাবনা করে নিজের সাথে আমার বিপিও বাড়ানোর ধান্দা না? তা তো চলবে না।

কথা শেষ করে হানিয়া জাভিয়ানের হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে। জাভিয়ানকে শুইয়ে নিজে শুতে যাবে তখনই কেউ তাদের রুমের দরজায় ধুমধাম শব্দ করছে আর তাদের ডাকছে। গলা শুনে মনে হলো আবরার ডাকছে।

হানিয়া দরজা খুলে দেখে তার ভাই-ভাবী এসেছে। তাদের দু’জনেরই চোখেমুখে আতঙ্ক। হানিয়া জিজ্ঞেস তাদের করে–

—কি হয়েছে ভাইয়া, ভাবী? তোমরা এমন ভয় পেয়ে আছো কেনো?

স্পর্শ চোখ ভর্তি পানি নিয়ে বলে–

—হানিয়া, আশিয়ান আর হায়া’কে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

কথাটা বলে স্পর্শ হুহু করে কেঁদে দেয়। একটা মাত্র ছেলে তার, সেই ছেলের কিছু হয়ে গেলে স্পর্শ মরে যাবে। তারউপর ভাইয়ের মেয়েটাও তার বড্ড আদরের। সে তো জানে হায়া’র কিছু হলে তার ভাইও শেষ হয়ে যাবে।

হানিয়া মস্তিষ্ক সাথে সাথে কথাটা ক্যাচ করতে পারে না। কিডন্যাপ হয়েছে মানে? মেয়ে না তার ঘুমাচ্ছিলো? তাহলে বাহিরে গেলো কখন আর কিডন্যাপই বা হলো কখন?

তার চিন্তা ভাবনা মাঝেই জাভিয়ান হানিয়া’র কাছে এসে দাঁড়ায়। বোনকে কাঁদতে দেখে জাভিয়ান প্রশ্ন করে–

—পুতুল তোর কি হয়েছে? কাঁদছিস কেনো?

আবরারের চোখেও পানি কিন্তু তা গড়িয়ে পরছে না। সে জাভিয়ানের প্রশ্নের জবাবে বলে–

—আশিয়ান আর হায়া’কে ডাকাতেরা অপহরণ করেছে। মুক্তিপণ হিসেবে এক কোটি টাকা দাবী করেছে। সময় দিয়েছে কাল বিকাল পর্যন্ত এর মধ্যে যদি আমরা টাকা না দেই বা পুলিশে খবর দেই তাহলে ওদের দু’জনের কাটা মাথা পাঠাবে বলে হুশিয়ারী দিয়েছে।

জাভিয়ান হতভম্ব হয়ে যায় আবরারের কথা শুনে। তার কলিজার টুকরা মেয়ে অপহরণ হয়েছে এটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে–

—ওরা না ঘুমাচ্ছিলো রুমে তাহলে ডাকাতের কবলে পরলো কি করে?

—সেটা তো জানি না। হয়ত বাহিরে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলো তখনই ডাকাতের কবলে পরেছে। রুমে চেক করে দেখলাম ওরা দু’জন নেই। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে আর বাড়ির গেইটে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সিউর হলাম ওরা বাহিরে গিয়েছিলো।

আবরার এবারও জাভিয়ানের প্রশ্নের উত্তর দেয়। হানিয়া ভাইয়ের কথাগুলো অবাক হয়ে শুনছিলো। সে জাভিয়ানের দিকে তাকালে দেখতে পায় জাভিয়ানের শরীর কাঁপছে। হুট করে জাভিয়ান পায়ের ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে নিলে হানিয়া তাড়াতাড়ি করে জাভিয়ানকে ধরে ফেলে। তাকে ধরে এনে বেডে বসিয়ে দেয়।

স্পর্শ চলে যায় জাহান-জায়িনকে খবরটা দিতে। জাভিয়ান তেজহীন গলায় সুধায়–

—আপনি এসব জানলেন কি করে? তারা কখন ফোন দিয়েছিলো? কোন নাম্বার থেকে দিয়েছিলো?

—একটু আগেই ফোন দিয়েছিলো আমায় কিডন্যাপার রা। আশিয়ানের ফোন থেকে কল দিয়েছিলো। ওদের সাথে কথা শেষ করেই তোমাদের এসে খবরটা জানালাম।

জাভিয়ান থম মেরে বসে থাকে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তখনই হুড়মুড়িয়ে তাদের রুমে প্রবেশ করে জাহান আর জায়িন। জামিন এসেই অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে–

—ভালো বাবাই, মামনি এসব কি বলছে? বনু আর আশিয়ান ভাই নাকি কিডন্যাপ হয়েছে?

—হ্যা বাবা। তোমার মামনি ঠিকই বলছে।

তারপর আবরার তাদের দু’জনকেও সবটা জানায়। সকলে বিচলিত হয়ে নানানরকমের মতামত দিলেও জাহান মাথা ঠাণ্ডা রাখে। সে বলে–

— আমরা কমিশনার আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে সবটা জানাবো। সে তার টিমের মাধ্যমে হায়াদের ট্রেস করবে। ওদের লাস্ট লোকেশন জানতে পারলেই আমরা ফোর্স নিয়ে সেখানে যাবো।

জাভিয়ান ছেলের কথায় দ্বিমত করে বলে–

—না এমনটা করো না। ওরা যা বলেছে দিয়ে দাও। পরে ওরা কিছু টের পেয়ে গেলে যদি আমার বাচ্চাগুলোর ক্ষতি করে দেয়। জাহান তুমি আর তোমার ভালো বাবাই সকাল হলেই ব্যাংকে গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। আমি আমার মেয়ের ক্ষেত্রে কোন রিস্ক নিতে চাই না।

জাহান বাবাকে বলে–

—আচ্ছা বেশ তোমার কথা অনুযায়ী কাজ করলাম। আজ আমাদের টাকা আছে বলে আমরা আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের উদ্ধার করে আনলাম সেই টাকার জোরে। কিন্তু তারপর? ঐসব লোকদের টাকা যখন ফুরিয়ে আসবে তখন তারা আবারও এই পেশায় নিজেদের নিয়োগ করে দিবে। তারপর আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতোই আরেক বাড়ির ছেলেমেয়ে বা সদস্যদের আটক করে এমন বড় অঙ্কের মুক্তিপণ চাইবে। তারা যদি আমাদের মতো স্বামর্থবান হয় তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আর যদি না হয়? তাহলে কি হবে? একটা পরিবার তার প্রিয় মানুষকে হারাবে। সেটা হতে পারে কারো সন্তান, কারো বাবা বা কারো একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এদেশের আইনের অবস্থা কতটা খারাপ সেটা তুমিও জানো আর আমিও জানি। তারা যে কস্মিনকালেও সেসব ডাকাতের দলকে ধরতে পারবে না কোন ক্লু বা নিজেদের দাপটে সে বুঝায় যায়। তো এবার যখন একটা সুযোগ হলো এসব বাজে লোকদের ধরার তাহলে কেন একটা চেষ্টা করে দেখবো না?

জাহানের সবগুলো কথাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু তাও জাভিয়ানের পিতৃ সত্ত্বা মানছে না। জাহান আবারও বলে–

—পত্রিকা, টিভি নিউজে অহরহ এমন ডাকাতদের খবর আমরা শুনছি দেখছি। কিছুদিন আগে রাজশাহীগামী একটা বাসে ডাকাত দ্বারা রাতভর ধ*র্ষ*ণ হয়েছে যাত্রীগামী দু’জন মহিলা। কিছুদিম আগে ফেসবুকে দেখলাম, একজন নারীকে তার বাসায় এসে ডাকাতি করে তার কাল্লা বিহীন মাথা রেখে গিয়েছে ডাকাতরা। তুমি বুঝতে পারছো ক্রাইম করা ওদের কাছে কতটা সহজ হয়ে পরেছে। কেন এমন হচ্ছে জানো? আমাদের নিস্তবদ্ধতা, অন্যায় দেখেও পিঠ বাচিয়ে চলে যাওয়ার কারণে ক্রিমিনালদের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে।

সকলে চুপ করে জাহানের কথাগুলো শুনে। জাহান বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে–

—বাবা তুমি চিন্তা করো না। আমরা আছি না? ঐখানে হায়া’র কাছে আশিয়ান ভাই আছে না? আমরা ইনশা আল্লাহ কিছু হতে দিবো না তোমার প্রিন্সেসের। তুমি পারমিশন দাও আমাদের আমরা দেখছি কিভাবে তোমার প্রিন্সেসকে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনা যায়।

এত সব যুক্তিসঙ্গত কথার পর জাভিয়ান আর কোন অন্যায় আবদার করতে পারে না। সে জাহানকে বলে–

—নিজের খেয়াল রেখো আর বোনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমাদের।

জাহান শব্দ বিহীন একটা হাসি দেয়। তারপর জায়িন আর আবরারের সাথে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে আসে।

_______________

দিনের আলো এখনো ফুটেনি। চারদিক ডুবে আছে গভীর তিমিরে। হায়া আশিয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। এখানে উপস্থিত থাকা লোকদের তাকে হিংস্র হায়েনা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে শরীফের ওমন বক্তব্য শোনার পর থেকে সে আরো ভয়ে সেঁটে আছে আশিয়ানের বুকের সাথে। আশিয়ানের একটা মিথ্যে কথার দরুণ সে এখনো পবিত্র রয়েছে। নাহলে এই হায়েনা’রা কখন তাঁকে ছিড়েখুঁড়ে নিজেদের ভোগের বস্তুতে পরিণত করতো সেটা হায়া কল্পনাও করতে চায় না।

কিছুক্ষণ আগে শরীফ যখন হায়া’র সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে তখন হায়া ভয়ে, উৎকণ্ঠায় আরো ঘাবড়ে যায়। হায়া’র একটা বাজে অভ্যাস হলো সে যখন অনেক ভয় পেয়ে যায় তখন বমি-টমি করে দূর্বল হয়ে পড়ে। এটার জন্য হানিয়া’র কাছে একসময় অনেক বকা খেলেও আজ এই কাজের জন্য সে কলুষিত হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছে।

অন্যান্য বারের মতো হায়া অতিরিক্ত ভয়ে বমি করে দিয়েছিলো। সেই সাথে অনেকটা দূর্বল হয়ে অনেকটা অজ্ঞানের মতো হয়ে গিয়েছিলো। তখন আশিয়ান তার এমন পরিস্থিতি দেখে চট করে ডাকাতদের বলে–

—দেখুম আমার স্ত্রী এমনিতেই অসুস্থ। দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। আপনারা আমাদের পরিবারের থেকে যত টাকা দাবী করবেন তারা দিয়ে দিবে, এটা আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি। কিন্তু আপনারা আমার স্ত্রীর সাথে কিছু করবেন না। একটা সন্তানটা বাবা-মায়ের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আপনারা জানেন আশাকরি। আপনাকে দেখে বুযর্গ লাগছে (ডাকাত দলের লিডারকে উদ্দেশ্য করে বলে আশিয়ান, যদিও সে তখন জানত না এই লোকটিই লিডার নাকি) আপনি আপনার বিচক্ষণতা দিয়ে বলুন একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর গায়ে হাত দেওয়া কি ঠিক?

আশিয়ান ইচ্ছে করে আবেগী কথা বলা শুরু করে তাদের কাছে। কারণ আশিয়ান একা থাকলে ফাইট করার চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন তার সাথে হায়া আছে, তাও আবার হায়া’র পায়ে চোট লাগা। দৌড়াতেও পারবে না তেমন করে হায়া। এছাড়া ডাকাতদের সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। ১০/১২ জন লোক তারা, তাদের প্রত্যেকের হাতে দেশীয় অস্ত্র রয়েছে। তাই আশিয়ান আর রিস্ক নেয় না ফাইট করার।

ডাকাত সর্দার তার দলের লোকদের বলে হায়া’র গায়ে যেনো তারা কেউ হাত না দেয়।

আশিয়ান হায়া’র দিকে তাকিয়ে দেখে হায়া’র শরীর অল্পবিস্তর কাঁপছে। সে হায়া’র শরীরটা নিজের বুকের সাথে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে। তাদের দু’জনকে ডাকাতেরা তাদের সঙ্গে করে নিজেদের ডেরায় নিয়ে এসেছে। জঙ্গলের মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে ডেরা করেছে ডাকাতেরা। তাদের দু’জনকে বর্তমানে খড় দিয়ে তৈরি একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আশিয়ান আর হায়া’কে পাহারা দিচ্ছে তিনজন লোক। একজন রুমের ভেতরে আর বাকি দু’জন বাহিরে টহল দিচ্ছে।

একটু পরই ফজরের আজান দেয়। আজান শেষ হওয়ার একটু পরই হায়া ক্ষীণ স্বরে আশিয়ানকে বলে–

—আশিয়ান ভাই।

—বলো পুতুলবউ। খারাপ লাগছে বেশি?

—হুম। গা গুলচ্ছে, মাথার ভেতর কেমন ভো ভো করছে। ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে বোধহয়।

—আচ্ছা আমি কথা বলে দেখি তারা পারমিশন দেয় কিনা।

আশিয়ান আর হায়া’কে ফিসফাস করে কথা বলতে দেখে একজন ডাকাত বলে উঠে–

—ঐ মিয়া রা, কি কথা কন জামাই বউ মিল্লা? আমাগোও একটু কন, আমরাও এমন ফুলটুসির মুখের বাণী হুইন্না নিজেগোর কান ধন্য করি।

লোকটি বিশ্রী ভাবে হায়া’র দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বলে। আশিয়ান একজন পুরুষ হয়ে আরেকজন পুরুষের চাহনি ঠিকই বুঝতে পেরে যায়। তার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলেও পরিস্থিতির কারণে তাকে দাঁতে দাঁত চেপে নিরবতা অবলম্বন করতে হয়।

সে বিনয়ী ভাবে লোকটাকে বলে–

—আসলে আমার ওয়াইফের একটু ওয়াশরুমে যাওয়া লাগতো। আপনারা প্লিজ ওকে নিয়ে একটু ওয়াশরুমে যেতে দেন আমায়।

আগের লোকটি বলে–

—না না কোন ওয়াশরুম টশরুমে যাওন যাইতো নাহ্ চুপচাপ বাইয়া থাকেন।

—প্লিজ একটা শেষ অনুরোধ করছি।

লোকগুলো যখন তাও মানছিলো না তখন আশিয়ান তাদের লোভ দেখানোর কথা চিন্তা করে। আশিয়ানের হাতে একটা প্লাটিনামের ব্রেসলেট ছিলো সেটা সে নিজের হাত থেকে খুলে লোক দুটোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে–

—এটা প্লাটিনামের তৈরি। লন্ডন থেকে আনানো হয়েছে। ডায়মন্ড দেওয়া আছে এটায়। স্বর্ণের থেকেও দামী এটা। এটা আপনারা রাখেন তার বদলে আমার একটা অনুরোধ রাখেন।

লোক গুলোর চোখ লোভে চকচক করে উঠে। তারা ব্রেসলেটটা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে বলে–

—আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আপনার স্ত্রী একা যাইতে হইবো,আপনি যাইতে পারবেন না।

—কিন্তু ও তো অসুস্থ। সাহায্য ছাড়া দাড়াতেও পারছে না। আপনারা প্লিজ ওর সাথে আমাকেও যেতে দেন।

—দেহেন যা করা যায় তাই কইছি না মানলে বইসা থাকেন।

আশিয়ান চিন্তায় পরে যায়। হায়া আশিয়ানকে বলে–

—আমি যেতে পারবো। আপনি আমায় দাড়াতে সাহায্য করুন।

—তুমি সিউর?

—হুম।

আশিয়ান হায়া’কে দাড় করায়। হায়া’র পা টলছে। পরে যাবে যাবে ভাব। হায়া লোক গুলোর উদ্দেশ্য বলে–

—চলুন।

একটা লোক হায়া’র সাথে রুম থেকে বের হয়ে যায়, আরেকজন আশিয়ানের সাথে রুমেই থেকে যায়। আশিয়ান রুমটার দরজার সামনে দাড়িয়ে দেখতে পায় হায়া ও লোকটি খানিকটা দূরে একটা আধপাকা ওয়াশরুমে দিকে যাচ্ছে। হাতমুখ আর গোসলের জন্য বাহিরে আলাদা করে ছাউনি ও বাউন্ডারি দিয়ে কলপাড় করা হয়েছে।

লোকটি হায়া’কে ওয়াশরুমের ঢুকিয়ে দিয়ে একটু দূরে বাহিরে দাড়িয়ে থাকে। হায়া নিজের কাজ শেষ করে বাহিরে এসে কলপাড়ে চলে যায় মুখহাত ধুতে। কল চেপে মুখ ধোয়ার সময় তার জামার একটা পাশে ভারী-ভারী অনুভব করে হায়া। সেই দিকটায় হাত রেখে হায়া চমকে যায়। তার সবগুলো জামায় একটা করে হলেও পকেট দেওয়া থাকে।

হায়া’র বর্তমানে পরিধেয় জামাটায়ও একটা পকেট রয়েছে। হায়া কল চাপা বন্ধ করে পকেট টার চেইন খুললে দেখতে পায় তার ফোন টিকে। এটা কথা সে একদম ভুলেই গিয়েছিলো। ফোনটা সাইলেন্ট করা বিধায় বাসা থেকে অনেকবার ফোন দেওয়ার পরও ফোনের রিংটোন শোনা যায় নি।

হায়া তাড়াতাড়ি করে ফোনের লক খুলে তার বাবার নাম্বারে কল লাগায়। জাভিয়ান তখন নামাজ পড়ার জন্য বাহিরে যাচ্ছিলো, ফোন বেজে উঠায় সে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে তার মেয়ে কল করেছে।

সে বিচলিত হয়ে কমটা রিসিভ করে কানে লাগালে শুনতে পায়–

—পাপা, তুমি কোথায় পাপা? জানো আমাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে। পাপা তুমি তাড়াতাড়ি করে আমার কাছে এসে আমায় সেভ করে নিয়ে যাও। জানো লোকগুলো আমায় নিয়ে কত বাজে বাজে কথা বলছে।

প্রাণপ্রিয় মেয়ের এমন ক্রন্দন সুর শুনে জাভিয়ানের বুক কেঁপে উঠে। সে প্রতিত্তোরে কিছু বলবে তার আগেই তার কানে আসে একটা রুক্ষ পুরুষালী কণ্ঠস্বর। লোকটা বলছে–

—এই মাইয়া, কি করতেছেন আপনি এতক্ষণ ধরে? আর কার লগেই বা কথা কইতাছেন?

শব্দসংখ্যা~২৩২২

চলবে?