#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_২১
মেহরিমা বসে আছে হানিয়া আর স্পর্শের মাঝে। হানিয়া তাকে আগে থেকেই চিনলেও, স্পর্শের সঙ্গে এ আজই প্রথম দেখা। অথচ দেখলে কে বলবে—এ যেন বহুদিনের চেনা আত্মারা আজ কেবল নতুন পরিচয়ে ধরা দিয়েছে। কথায় কথায় এমন ভাব জমে উঠেছে যে, মনে হচ্ছে তারা তিনজন যেন দুধে মেশানো পাকা আম—স্বাদে-ঘ্রাণে একাকার, আলাদা করা দায়।
এই চেনা-অচেনার মিষ্টি মুহূর্তের বাইরে এক কোণে একা বসে আছে জাহান। সিঙ্গেল সোফার কোণায় সে যেন এক গোপন দর্শক, গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় তিন নারীর দিকে—তার মা, তার ফুফু, আর তার ভালোবাসার মানুষ, মেহরিমা।
তিন নারীর মুখর হাসিতে মুখর হয়ে উঠেছে ঘরটা। তাদের আলাপ চলেছে গৃহস্থালি থেকে শুরু করে জীবনের টুকরো গল্পে—একটা ঘর সাজানোর স্বপ্ন, পুরোনো দিনের কোনো রান্নার স্মৃতি, কিংবা এক কাপ চায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করা কোনো মনখারাপ।
তাদের এমন একচেটিয়া আলাপচারিতায় জাহানের মনে কোনো বিরক্তির বিন্দুমাত্র রেশ নেই। বরং বুকের ভেতর এক ধরনের নিঃশব্দ প্রশান্তি খেলা করছে। তার চোখের সামনে বসে আছে জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষগুলো—একসাথে, হাসিমুখে, কথার সাগরে ভেসে। এই দৃশ্য দেখে তার মনে হয়, যেন সংসারের প্রথম রঙ তুলির আঁচড় এঁকে যাওয়া শুরু হয়েছে আজ—ভালোবাসা, গ্রহণযোগ্যতা আর একধরনের নিখুঁত ছন্দে।
তার ভালোবাসার নারী মেহরিমা আজ তার মায়ের আর ফুফুর সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে, যেন সে তাদের পরিবারের এক পরিচিত ছায়া, বহুদিনের চেনা আত্মা। জাহানের বুকের গহীনে কোনো শব্দ নেই, শুধু গভীর সন্তুষ্টির ঢেউ। সে কোনো কথা বলে না, কেবল দেখেই যায়—কারণ কখনো কখনো দেখা আর অনুভব করাই সবচেয়ে গভীর ভাষা হয়ে ওঠে।
জাহান তার পরিবারের মানুষদের হৃদয়ের গভীরতা চেনে। জানে, ভালোবাসা আর গ্রহণযোগ্যতায় তারা যেন এক অবিনশ্বর বৃক্ষ—যার ছায়ায় দাঁড়ালে কোনো সম্পর্ককেই তারা প্রত্যাখ্যান করে না, যদি তাতে থাকে সত্য, শ্রদ্ধা আর নিঃস্বার্থতা। মেহরিমা আর তার সম্পর্কের কথা জানলে হয়তো প্রথমে কপট বিস্ময়ের ঢেউ উঠবে তাদের চোখে, তারপরই আসবে এক ধমক—এতদিন লুকিয়ে রাখার অপরাধে। কিন্তু আপত্তি? সে আশঙ্কা কোনোদিনই ছিল না জাহানের মনে। তার পরিবারের উপর রয়েছে এক নিঃশর্ত আস্থা—যার ভিত গড়া রক্তে, ভালোবাসায়, আদরে।
সে জানে, সেই দিন আসবেই—যেদিন আর কোনো লুকোচুরি থাকবে না, কোনো দ্বিধা থাকবে না, ভয় তো দূরের কথা, তার ছায়াটুকুও থাকবে না। সব অভিমান, সকল নীরবতা ভেদ করে সে এগিয়ে যাবে মেহরিমার দিকে—চোখে সাহসের দীপ্তি, কণ্ঠে প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা।
সে দাঁড় করাবে মেয়েটিকে সকলের সামনে—সেই শান্ত, নীরব, অথচ গভীর এক সৌন্দর্যে মোড়া নারী, যে তার হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি জানে।
তখন, কোনো আড়াল নয়, কোনো সংকোচ নয়—সে উচ্চারণ করবে তিনটি শব্দ, না তিনটি শপথ—
“আমি কবুল করি।”
প্রথমবার, তার চোখে চোখ রেখে। দ্বিতীয়বার, তার কাঁপতে থাকা হাত ধরেই। তৃতীয়বার, তার সমস্ত ভাঙা-গড়া অতীতকে আঁকড়ে ধরে, প্রতিজ্ঞা করে চিরদিনের জন্য আপন করে নেওয়ার।
জাহান জানে, মেহরিমার অতীত শূন্যতায় ভরা। অভিমান, অপমান, একাকিত্ব—সব মিলিয়ে এই মেয়েটা বহন করে বেড়িয়েছে নিজের ভিতর এক শীতল শোকের পাহাড়। কিন্তু জাহান ঠিক করেছে, সে সেই পাহাড়কে পিষে ফেলবে ভালোবাসার রোদের নিচে। সে তাকে ছায়া দেবে, আশ্বাস দেবে, ভরসা দেবে—আর দেবে এমন এক ভালোবাসা, যা অপ্রাপ্তির প্রতিটি ছায়াকে মুছে দেবে চিরতরে।
জন্ম নয়, জন্মান্তরের জন্য সে মেহরিমাকে নিজের করে নিতে চায়। শুধু ভালোবেসে নয়, এক আধ্যাত্মিক বন্ধনে বাঁধা পড়ে, একান্ত নিজের করে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তার গম্ভীর মুখাবয়বের সামান্য প্রশান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। মেহরিমা কথা বলার মাঝে মধ্যেই আঁড়চোখে তার প্রণয় পুরুষ টির দিকে তাকাচ্ছে। চোরা চোখে দেখে নিচ্ছে তার মনে বাস করা একমাত্র পুরুষ টিকে।
প্রতিবারের ন্যায় এবারও সে চোরা চোখে তাকিয়েছিলো জাহানের দিকে। তখনই জাহানকে একা একা হাসতে দেখে সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জাহানকে জিজ্ঞেস করে সে কেন হাসছে? জাহান মাথা নাড়িয়ে বুঝায় এমনিতেই হাসছে। মেহরিমা তার উত্তর পেয়ে আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্পর্শ আর হানিয়া’র সাথে কথা বলায়।
তাদের কথা বলার মাঝেই ডোরবেল বেজে উঠে। জাহান নিজে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দেখতে পায় তার বাবা, মামু আর কয়েকজন স্পেশাল গেস্ট এসেছে। জাহানের মুখের স্মিত হাসি বেশ চওড়া হয় গেস্টদের দেখে।
জাহান তাদের কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলে–
—ভালো আঙ্কেল, কেমন আছো তোমরা?
কথাটা বলতে বলতে সে জড়িয়ে ধরে তার পিতা সমতুল্য লোকটাকে। মাঝ বয়সী সেই লোকটিও তাকে সন্তান স্নেহে জড়িয়ে ধরে। জাহানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে–
—আলহামদুলিল্লাহ বেটা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
—আলহামদুলিল্লাহ ভালো।।
পাশ থেকে ভদ্রলোকটির স্ত্রী কপট অভিমান নিয়ে বলে উঠে–
—আমায় তো কেউ মনেই করে না। সবাই ভুলে গিয়েছে আমায়।
জাহান লোকটিকে ছেড়ে পাশে দাড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে–
—তোমায় কি করে ভুলতে পারি মিষ্টি আন্টি? তুমি তো আমার ফেভারিট।
মহিলাটিও তাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে–
—কেমন আছে আমার বাবাটা? দিন দিন তো মেয়েদের মন চুরি করার মতো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া (জাভিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে) ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন, নাহলে কবে জানি ছেলে আপনার চুরি হয়ে যায়।
জাহান মহিলাটির কথা শুনে লজ্জা পেয়ে যায় আট বাদ বাকি উপস্থিত সবাই হেঁসে দেয়। জাভিয়ান মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বলে–
—দরজার সামনে দাড়িয়েই সব কথা বলে ফেলবে নাকি? ছেলের বিয়েও খেতে চাও আবার আলোচনায়ও সামিল হচ্ছো না ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না। চলো ভেতরে চলো।
এরই মধ্যে হানিয়া বলতে বলতে উপস্থিত হয়–
—কে এসেছে রে জাহান?
জাহান হাসিমুখে জবাব দেয়–
—ভালো আঙ্কেল আর মিষ্টি আন্টি এসেছে আম্মু।
মুহূর্তেই সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাহানের ভালো আঙ্কেল ও মিষ্টি আন্টি ওরফে আদিয়াত ও আফরা’কে নিয়ে। হানিয়া তাদের কাছে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে–
—স্যার কেমন আছেন?
—এসব কি হানিয়া, তুমি আমায় এভাবে স্যার ডেকে বয়স্কদের তালিকায় ফেলে দিতে পারো না। আই এম জাস্ট ফিফটি ফাইভ ইয়ারস ওল্ড। এটা কোন বয়স হলো?বলো তো বাচ্চারা।
আদিয়াত রসিকতা করে কথাগুলো বলে হানিয়া ও বাকি বাচ্চাদের। বাচ্চারা বলতে জাহান, আফিফ আর আদিবা। তারা তিনজনই আদিয়াতের কথায় হেঁসে বলে–
—নো। উই হ্যাভ নেভার সিন এন ওল্ড ম্যান এস হ্যান্ডসাম এস ইউ বিফোর।
আদিয়াত তাদের কথা শুনে বলে –
—দেখলে বাচ্চারাও জানে ফিফটি ফাইভ ইয়ারস কোন বয়সই না। ইউ নো হোয়াইট, এইজ ইজ জাস্ট এ নম্বর। মনের বয়সই বড় বয়স।
সকলে তার কথা শুনে হাহা করে হেঁসে দেয়। সকলে গিয়ে সোফায় বসে। আবরার আর জাভিয়ান ফ্রেশ হতে চলে যায়। জাহান, আদিয়াত আর আফিফ এক সোফায় বসে আর হানিয়া, স্পর্শ আর আফরা আরেক সোফায় বসে গল্প শুরু করে দেয়। আদিবা তার সমবয়সী মেহরিমার সাথে গিয়ে কথা বলা শুরু করে।
টুকটাক কথা বলে স্পর্শ আর হানিয়া আফরা’কে আদিবা ও মেহরিমার সাথে কথা বলতে বলে উঠে চলে যায় কিচেনের দিকে। হোক আদিয়াতরা তাদের আত্মার আত্নীয় তাই বলে কি আতিথেয়তায় কার্পন্য করবে? উহু, একদমই না।
এরই মধ্যে হায়া’কে ধরে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে আশিয়ান। আদিয়াতরা মূলত হায়া আর আশিয়ানের সাথেই দেখা করতে এসেছে। কালকে তাদের কিডন্যাপিংয়ের ঘটনার জন্য। হায়া তাদেরকে পেয়ে প্রচন্ড খুশি হয়। সে আশিয়ানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মহিলা পার্টির মধ্যে গিয়ে বসে পড়ে। আশিয়ান বেচারা বউয়ের অনুপস্থিতিতে জাহানদের কাছে চলে যায়।
আফরা মেহরিমার থুতনি ধরে উঁচু করে হায়া’কে বলে–
—এই শান্ত পরীটা কে রে হায়া? তখন থেকে দেখছি শুধু আমাদের কথা শুনছেই নিজে কিছু বলছে না।
হায়া বলে–
—আরে মিষ্টি আন্টি ও আমার বেস্টফ্রেন্ড মেহরিমা। আর ওকে দেখে যতটা শান্তশিষ্ট মনে হচ্ছে ও কিন্তু ততটা শান্ত নয়। আমার সাথে কথা বলা শুরু করলে মাথাটা খেয়ে নেয় একদম।
হায়া’র কথা শুনে মেহরিমা একটু লজ্জা পায়। সে রাগী চোখে হায়া’কে শাসায় এসব বলার জন্য। হায়া দুষ্টুমি করে জোরে জোরে বলে–
—অ্যাঁই তুই আমায় চোখ করে দিলেই কি আমি সত্যি কথা বলবো না ভেবেছিস? সেই আশায় গুড়া বালি। জান যায় যাক কিন্তু সত্যের পথে অটল থাকবো আমি।
পাশ দিয়ে আদিবা আবার বলে–
—আসছে রে আমার সত্যবাদী। তুই যে কতবড় সত্যবাদী সেটা আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না। মুখ খুলাস না হায়া, তাহলে হাঁটে কিন্তু হাড়ি একটাও আস্ত রাখবো না।
হায়া ঢং করে বলে–
—আমার সাথে এত বড় দুই নাম্বারি করবি তুই আদু? যাহ তোর সাথে কথা নাই।
এরই মধ্যে হানিয়া ও স্পর্শ সকলের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। মেহরিমা ভাবে এটা তাদের ফ্যামিলি টাইম আর তার না থাকাই উত্তম এসময়। তাই সে হায়া’র কানে কানে বলে–
—দোস্ত আমি আজ যাই হ্যা। আরেকদিন আসবো নে।
হায়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–
—কেন কি হলো তোর আবার? তোর টিউশনিতে না আজ অফ ডে? তাহলে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি কেন?
মেহরিমা আমতাআমতা করে বলে–
—না মানে….
—কি না মানে ইয়ে উয়ু করছিস? স্পষ্ট করে বল।
—আমার মনে হয় আমার এখন চলে যাওয়া উচিত।
—আর সেটা কেন মনে হলো আপনার একটু বলে ধন্য করেন আমায়?
—দেখ দোস্ত রাগ করিস না। এটা তোদের ফ্যামিলি টাইম আর আমার এখন না থাকাই উচিত বলে আমি মনে করছি।
হায়া মেহরিমার কথা শুনে শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে–
—আচ্ছা চলে যা তুই।
—দোস্ত রাগ করিস না, আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা কর।
হায়া আর একবারও মেহরিমার দিকে তাকায় না আর না তার কোন কথা শুনে।
অন্যদিকে জাহান অনেকক্ষণ ধরেই তার বোন আর প্রেয়সীর ফিসফিসানি দেখছে। সে খেয়াল করেছে মেহরিমা কিছু একটা বলার পর হায়া কেমন গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। না মেহরিমার দিকে তাকাচ্ছে আর না-ই বা তার কথার কোন জবাব দিচ্ছে। এর মানে হায়া কোন কারণে রেগে আছে মেহরিমার উপর। কিন্তু কি বিষয়ে রেগে গেলো হঠাৎই?
মেহরিমা হায়া’কে কয়েকবার বলার পরও হায়া তেমন একটা রেসপন্স করে না। সে একটা হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হানিয়া’র উদ্দেশ্য বলে–
—আন্টি আজ তাহলে আমি আসি।
হানিয়া তড়িঘড়ি করে বলে–
—কেন রে মা? এই তো আসলি, এখনি চলে যাবি? আজকের ডিনার টা আমাদের সাথে করে যা।
মেহরিমা কিছু বলার আগেই হায়া গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলে–
—আমাদের আপন ভাবলে তো এত তাড়াতাড়ি যেতে চাইতো? ও ভাবছে আমাদের ফ্যামিলি টাইমে সে বাহিরের মানুষ হয়ে পরিবেশটাকে অস্বস্তিকর বানিয়ে ফেলছে। যেতে দাও আম্মু ওকে।
সকলে হায়া’র কথা শুনে মেহরিমার দিকে তাকায়। আর মেহরিমা কেমন চোরের মতো মুখ করে রেখেছে। জাহান বুঝতে পারে কেন তার বোন রেগে গিয়েছে। মেহরিমার এমন ধারণা শুনে জাহানও রেগে যায়। সে একটা ফোন করার বাহানায় সেখান থেকে চলে যায় রাগী মুখ করে। মেহরিমা আঁড়চোখে তার যাওয়া দেখে। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার জাহানের রাগ দেখে।
হানিয়া মেহরিমার কাছে এসে তাকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে–
—আমাদের তোর আপন মনে হয় না? আমরা কিন্তু তোকে আর হায়া’কে একই চোখে দেখি। কিন্তু তোর আজকের কথায় কষ্ট পেলাম ভীষণ ।
মেহরিমা তড়িঘড়ি করে ছলছল চোখে বলে–
—আন্টি তুমি প্লিজ কষ্ট পেয়ো না। আমি তো জানি তোমরা আমায় কতটা আপন ভাবো আমিও তোমাদের নিজের কাছের মানুষ ভাবি।
—তাহলে আজকের ডিনার টা আমাদের সাথে করে গিয়ে প্রমান কর তুই আমাদের আপন ভাবিস। কি থাকবি তো?
মেহরিমা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। হানিয়া তার কপালে একটা স্নেহের পরশ দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।
মেহরিমা হায়া’র পাশে বসে তার কানের কাছে ঝুঁকে এসে বলে–
—দোস্ত তোর ভাই তো রেগে গিয়েছে। এখন তাকে শান্ত করাবো কি করে?
—সেটা তোর টেনশেন। ছাগলের মতো চিন্তা ভাবনা করার সময় মনে ছিলো না তোমার ‘উনি’ রেগে যেতে পারে? এখন আমায় বলে কোন লাভ নেই।
মেহরিমা অসহায়ের মতো হায়া’র দিকে তাকিয়ে থাকে।
______________________
মেহরিমা মাগরিবের নামাজ পড়ে মাত্রই রুম থেকে বের হয়েছিলো। উদ্দেশ্য কিচেনে হানিয়া ও স্পর্শ কাছে যাওয়া। তখনই কলিংবেল বেজে উঠে। স্পর্শ তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দরজা খুলতে যাবে তখন মেহরিমা তাঁকে আটকে দেয়। নম্র গলায় বলে–
—আন্টি আমি দেখছি। আপনি একটু বসুন। তখন থেকে শুধু দেখছি ছুটাছুটিই করছেন।
স্পর্শকে ডাইনিং টেবিলে বসাতে বসাতে কথাটা বলে মেহরিমা। তারপর এক গ্লাস পানি স্পর্শর দিলে এগিয়ে দিয়ে সে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে কিছু অপরিচিত মানুষদের দেখতে পায়। তাদের মধ্যে একজন মানুষকে দেখে সে একটু ভয় ও অস্বস্তিতে পড়ে যায়।
শব্দসংখ্যা~১৭৫৪
~চলবে?
#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_২২
মেহরিমা আর আদিবা স্পর্শ-হানিয়ার হাতে হাতে খাবারের বাটি গুলো এনে ডাইনিং টেবিলে রাখছে৷ তারা দু’জন মানা করলেও মেহরিমা ও আদিবা একপ্রকার জোর করেই কাজটা করছে। রান্নাবান্না সামলে এইটুকু কাজ যদি এগিয়ে দিলেও তাদের একটু কাজ কমবে।
স্পর্শের হেল্পিং হ্যান্ড মহিলা এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গতকালই নিজের গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। তাই আজ হঠাৎ করে এত মেহমান এসে পড়ায় তাদের খাবারদাবারের সব দায়িত্ব মির্জা ও তালুকদার কর্তীদের উপর এসে বর্তেছে। তাদের রান্নার কাজে মাহমুদ বাড়ির কর্তীও হাত লাগিয়েছে। তিনজন একদম বোনের মতো গলাগলি করে রান্না করেছে। মুনতাহা বেগম সাহায্য করতে চাইলেও হঠাৎই তার মাথা ব্যথা শুরু হওয়ায় সে আর তাদের হাতে হাত লাগাতে পারেনি।
খাবারের সবগুলো বাটি রাখা শেষ হলে হানিয়া আদিবার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে–
—আম্মাজান যাও তো ভাইয়াদের ডেকে নিয়ে আসো তো। বাদর তিনটা সেই যে রুমে দোর দিয়েছে, বের হওয়ার নামই নেই। মেহরিমাকেও সাথে নিয়ে যাও। ও তো বাড়িটা ঘুরে দেখার সুযোগই পেলো না।
আদিবা হানিয়ার ফুলোফুলো গাল গুলো হালকা টেনে বলে–
—ওকে কিউটি। আমরা ঝড়ের গতিতে যাচ্ছি কিন্তু ফিরবো পিঁপড়ার গতিতে। ঠিক আছে?
হানিয়া আদিবার কথায় হেসে সম্মতি দিয়ে বলে–
—ঠিক আছে।
আদিবা মেহরিমার কাছে এসে তার হাতটা খপ করে ধরে বলে–
—এই পুরান রেডিও চল। তোকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি।
কথাটা শেষ করতে দেরি মেহরিমাকে টানতে দেরি হয় না আদিবার। সে বড়বড় পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে যেতে থাকে। আদিবার ছোটবেলা থেকেই মির্জা বাড়িতে আসা যাওয়া রয়েছে। তাই সে সহজেই জানে কোনটা কার রুম এবং কোনদিক দিয়ে যেতে হবে।
মেহরিমাকে আদর আহ্লাদ, হানিয়ার হাতে হাতে কাজ করে দেওয়া সবকিছুই দূর থেকে প্রত্যক্ষ করছিলে একজোড়া অনুসন্ধানী চোখ।
__________________________
পরপর কয়েকবার নক করতেই দরজা খুলে দেয় একজন পুরুষ। আদিবা পুরুষটির দিকে চোখ উঁচিয়ে তাকালে দেখতে পায় এ আর কেউ নয় তারই ইনা, মিনা, টিনার হবু পাপা।
জায়িন তার পিচ্চি প্রিয়তমাকে দেখে বেশ খুখিই হয় কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করে না। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে–
—কি চাই এখানে?
আদিবা ভাবে একটু জ্বালানো যাক তার সখের পুরুষ টিকে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরেছে পর একবারও দেখা বা কথা হয়নি তাদের একই বাড়িতে অবস্থান করেও। সে যাও চোখে চোখে দুই একবার গার্ডেনে যাওয়ার ইশারা করলেও জায়িন তেমন একটা পাত্তা দেয় নি। সেটারই শোধ তুলবে এখন।
আদিবা মেহরিমাকে পেছনে রেখে জায়িনের একদম কাছে এসে পড়ে। চোখে একপ্রকার নেশা নিয়ে নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে–
—তোমায় লাগবে জায়িন।
আদিবার যখন একটু বেশি প্রেম প্রেম পায় তখনই সে জায়িনকে নাম ধরে ডাকে। জায়িন প্রিয়তমার এমন আবেদনময়ী ভঙ্গিতে গলে যায়। সেও ঘোরে ডুবে গিয়ে নিজের অজান্তেই আদিবার কপালের উপর আসা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে বলে–
—কেনো?
—কেনো আবার? নিচে আন্টি খেতে ডাকছে সবাইকে তাই তোমাকেও সেখানে লাগবে।
কথা তো নয় যেনো ফাটা বাশ দিয়ে মাথায় বারি মারা। আদিবার এমন কাঠকাঠ গলায় বলা কথাগুলো মুহূর্তেই জায়িনকে অনুভূতির রঙিন দুনিয়া থেকে টেনে বের করে এনে বাস্তবতার মুখোমুখি করে।
সে আদিবার কথাটা সাথে সাথেই ধরতে পারে না। তাই বলে–
—এ্যাঁ??
—এ্যাঁ নয় হ্যাঁ। তোমাদের তিন বাদরকে নিচে যেতে বলেছে আন্টি। তাড়াতাড়ি আসো।
অনেকটা ধমকের সুরে কথাগুলো বলে আদিবা মেহরিমার হাত ধরে আবারও হাটা দেয়। মেহরিমা আদিবার সাথে যেতে যেতে একবার একবার পেছনে ঘুরে প্রিয়তমের অভিমানী মুখখানা দেখে নেয়, যে কিনা মাত্রই উপস্থিত হয়েছিলো দরজার সামনে।
_______________________
ছাদ থেকে নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মেহরিমা, আদিবা ও হায়া। হায়া’কে ধরে আস্তে আস্তে পা চালাচ্ছে মেহরিমা। উদ্দেশ্য তাকে রুমে পৌছে দিবে তারপর আজকের মতো বিদায় নিবে সে। কিন্তু মাঝপথেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখে তার হৃৎস্পন্দন কয়েক মিনিটের জন্য থেমে যায় বোধহয় তার।
ফ্লোরে পড়ে আছে রাহা, তারউপর জাহান। বিষয়টা বড্ড অনাকাঙ্ক্ষিত ও দৃষ্টিকটু। বুঝাই যাচ্ছে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়েছে, কারণ জাহান আজ পর্যন্ত তার প্রেমিকার হাত ব্যতীত তার ললাটেও ভালোবাসার স্পর্শ পর্যন্ত দেয় নি। জাহানের বক্তব্য-“এইটুকুন স্পর্শ আমার পোষাবে না। তোমায় আমি স্পর্শ করলে পুরোপুরি নিজের করে নেওয়ার উদ্দেশ্য করবো। এইটুকুন স্পর্শ আমার হৃদপীড়া আরো বাড়িয়ে দিবে।”
সেই জাহান কি করে একজন মেয়েকে এমন খোলামেলা জায়গায় এমন অবস্থায় থাকতে পারে? কিন্তু নারী হৃদয় তো এসব লজিক জেনেও মন খারাপ করা বা অভিমান করা যেনো তাদের অন্যতম কাজ। অজান্তেই মেহরিমার শান্ত, কোমল নয়নযুগল ভিজে উঠতে শুরু করে। তার চোখের তারায় শুধু জাহান ও রাহা’র আলিঙ্গনরত দৃশ্যটিই জ্বলজ্বল করছে।
মেহরিমা’র ধ্যাণ ভঙ্গ হয় হায়া’র উত্তেজিত ও আতঙ্কিত গলার আওয়াজে। হায়া বলে উঠে–
—একি ভাইয়া?! তোমরা পড়লে কিভাবে?
জাহান হায়া’র কণ্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে তার দিকে তাকালে দেখতে পায় তিন রমনীকে। তাদের মধ্যে তার ব্যক্তিগত রমণীর নয়নে যে বেদনার অশ্রু জমেছে সেটাও তার চক্ষুগোচর হয়। সে তড়িঘড়ি করে রাহা’র উপর থেকে সরে আসে। বেশ অপ্রস্তুত ও বিব্রত দেখাচ্ছে তাঁকে।
জাহান উঠে গেলে রাহা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। জাহানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাহার হাত ধরে তাকে নিচ থেকে উঠায়। হায়া আস্তে আস্তে তাদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে–
—কি হয়েছে ভাইয়া? তোমরা পরে গিয়েছিলে কিভাবে?
জাহান দৃঢ় কণ্ঠে বলে–
—আমি আমার রুম থেকে বের হয়ে নিচে যাচ্ছিলাম তখনই রাহা’র চিৎকার শুনি। এখানে এসে দেখি ও নিচে পরে রয়েছে আর পায়ের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে এসে ওকে উঠাতে গেলে ফ্লোরে থাকা পানিতে আমিও পা পিছলে ওর উপর পরে যাই।
—ফ্লোরে পানি ছিলো?
বিস্ময় নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে হায়া নিচে তাকায়। দেখে তার ভাই সত্যিই বলছে। সাদা টাইলসের ফ্লোর হওয়ায় পানিটা ততটা বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু কথা হলো ছাদে যাওয়ার এই পথে পানি আসলো কি করে?
হায়া ফ্লোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে পুনরায় ভাইয়ের দিকে তাকালে দেখতে পায়, তার ভাই এক দৃষ্টিতে তার বান্ধবীকে দেখছে। অথচ তার বান্ধবী রূপী হবু ভাবী তার ভাইয়ের দিকে ভুলেও নিজের দৃষ্টি স্থাপন করছে না। হায়া’র বুঝতে বাকি থাকে না কেন এমনটা করছে মেহরিমা। সেও তো মাঝে মধ্যে তার পুরুষ টির সাথে এমন অভিমান করে।
হায়া গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের ধ্যাণ নিজের দিকে ফেরায়। তারপর বলে–
—এখানে পানি আসাটা বড়ই অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর। যাইহোক, রাহা তুমি কি বেশি ব্যথা পেয়েছো পায়ে?
রাহা’কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটি করে। রাহা মুখ কিঞ্চিৎ কুঁচকিয়ে বলে–
—হ্যাঁ, ভালোই ব্যথা অনুভব হচ্ছে। দাড়াতে কষ্ট হচ্ছে।
—ওহহ। তাহলে তুমি আন্টির রুমে গিয়ে রেস্ট নাও, আমি ব্যথার ঔষধ পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার জন্য।
—আচ্ছা, ধন্যবাদ তোমাকে।
তারপর জাহানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে রাহা বলে–
—জাহান ভাইয়া, আমাকে একটু রুমে দিয়ে আসবেন প্লিজ? আসলে একা একা হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
জাহান কিছু বলার আগেই হায়া বলে–
—রাহা, তোমায় যদি আদিবা রুমে দিয়ে আসে তাহলে কি কোন সমস্যা আছে? আসলে ভাইয়ার সাথে আমার একটা কাজ ছিলো তো তাই বললাম আরকি।
রাহা হলো তার বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান। তার মনমতো কিছু না হলে সে চট করে রেগে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। সে চেয়েছিলো, জাহান তার হাত ধরে তাকে রুম পর্যন্ত যাতে দিয়ে আসে। কিন্তু হায়া তো জাহানকে আটকে দিলো। আর কেনোই বা দিলো সেটাও সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে।
ভেতরে ভেতরে রাহা’র রাগেদের বিস্ফোরণ ঘটলেও উপরে সে একদম শান্ত ও মিষ্টিভাষী। সে নিজের মুখের হাসি বজায় রেখে বলে–
—না সমস্যা হবে কেনো? কোন সমস্যা নেই।
হায়া রাহা’র চোখে বিরাজমান রাগেদের দেখা খুব সহজেই পায়। তাও সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বরং আদিবাকে ইশারায় বলে তাঁকে রুমে নিয়ে যেতে। আদিবাও বিনা বাক্যে হায়া’র কথা পালন করে। সে রাহা’কে নিয়ে চলে যায়।
এতক্ষণে মেহরিমা মুখ খুলে। সে ক্ষীণ স্বরে বলে–
—চল তোকে রুমে নিয়ে যাই, তারপর আমাকেও হোস্টেলে ফিরতে হবে। আমার জন্য তো আর সারারাত হোস্টেলের দরজা খুলে বসে থাকবে না দারোয়ান।
নিজের মনের ক্ষোভ চেপে না রাখতে পেরে কিছুটা প্রকাশই করে দেয় মেহরিমা। দৃষ্টি তার নিচের দিকে। সেও বেশ ভালো করেই টের পেয়েছে জাহান যে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
হায়া মেহরিমার ক্ষোভ কিছুটা হলেও টের পায়। সে তার অগোচরেই হেসে উঠে নিঃশব্দে। তারপর বলে–
—চল। কিন্তু একটা কথা বলে দিচ্ছি একা একা যাবি না কিন্তু। তোকে দিয়ে আসা হবে।
—কে দিয়ে আসবে? কার এত সময় আমার জন্য? আর আমি কি আজই প্রথম একা যাবো? আমি তো একাই, দুনিয়াতে আসছি পর থেকে একা। একাই চলাফেরা করি। কখনো কারো প্রয়োজন পড়েনি আজও পড়বে না।
—বেশি কথা বলিস। আমি যা বলছি তা করবি নাহলে তোর খবর করে ছাড়বো। এখন চল।
হায়া মেহরিমাকে ধমকে কথাগুলো বলে তারপর নিজের রুমের দিকে হাঁটা দেয়। এদিকে তারা যে পেছনে এক ক্ষেপাটে পাগল রেখে যায় তা তাদের অজানাই থেকে যায়।
________________________
—আন্টি এবার আমি আসি প্লিজ? এর বেশি দেরি করলে হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমায় আজকে ঢুকতেই দিবে না।
অসহায়ের মতো মুখ করে কথা গুলো বলে মেহরিমা। হানিয়া তার এমন মুখভঙ্গি দেখে হেঁসে দেয়। তারপর মেহরিমার কাছে এসে তার থুতনি ধরে কপালে আদর দিয়ে বলে–
—আচ্ছা বেশ যা আজ তাহলে। কিন্তু প্রমিজ করতে হবে, এখন থেকে মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে দেখা করতে আসবি? আর একা যেতে পারবি না। তোকে আমাদের গাড়ি পৌছে দিয়ে আসবে।
—আচ্ছা আসবো দেখা করতে। কিন্তু গাড়ি লাগবে না আন্টি। আমি রিকশা করে চলে যেতে পারবো।
হানিয়া চোখ রাঙিয়ে বলে–
—যা বলেছি তাই হবে। কোন কথা শুনব না।
মেহরিমা মুখ গোমড়া করে বলে–
—আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা শুধু আমায় চোখ গরম দাও। তুমিও, তোমার মেয়েও আর তোমার ছে……
মাঝপথেই ব্রেক কষে মেহরিমা। কথায় কথায় কি বলে বসেছিলো সে নিজেও জানে না। হানিয়া লাস্টের কথাটা বুঝতে পারে না।তাই সে জিজ্ঞেস করে–
—লাস্টে কি বললি? আমার কে?
—তোমার ভাইয়ের ছেলে মানে আশিয়ান স্যার আরকি। সেও ক্লাসে পড়া না পারলে এমন করে চোখ গরম করে আমার তো টায়টায় ফিস হয়ে যায়।
ক্যাবলার মতো হাসি দিয়ে কথাটা বলে মেহরিমা। বেচারি না পারতে আশিয়ানের কথা বলে দেয়। কথাটা অবশ্য মিথ্যে না সত্যিই।
মেহরিমার কথা শুনে হানিয়া হেঁসে দেয়। টুকটাক কথা বলে মেহরিমা বিদায় নিবে তখনই সেখানে এসে হাজির হয় জাহান। সে তড়িঘড়ি করে কোথাও একটা যাচ্ছে। যাওয়ার আগে হানিয়াকে বলে –
—আম্মু, হসপিটালে একটা ইমার্জেন্সি কেস এসেছে। আমায় ডেকেছে যাওয়ার জন্য। আমি যাচ্ছি হসপিটালে। আল্লাহ হাফেজ তুমি টেনশেন করো না কিন্তু।
কথাটা বলে জাহান দরজার দিকে হাটা দিবে তখনই তাঁকে পেছন ডাকে হানিয়া। জাহান মায়ের ডাকে পেছন ঘুরে দাঁড়ালে হানিয়া বলে–
—তোমার হসপিটাল তো মেহরিমার হোস্টেলের রাস্তায় পড়ে। তাহলে তুমি মেহরিমাকে একটু ওর হোস্টেলে ছেড়ে দিও?
জাহান একবার মেহরিমাকে দেখে বলে–
—আচ্ছা। আসতে বলো ওকে, আমি গাড়ি বের করছি।
এরই মধ্যে মেহরিমা মিনমিনিয়ে বলে–
—আন্টি ভাইয়াকে আমার জন্য কষ্ট করতে হবে না। আমি যেতে পারবো।
জাহান এবার রেগে যায়। একদিকে প্রেয়সীর অভিমান যার জন্য তার মন মেজাজ কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে,তার দায়িত্ব তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আসলেই তাকে হসপিটাল থেকে ডাকা হয়েছে ইমার্জেন্সি। কিন্তু সে যদি হসপিটালে যাওয়ার আগে প্রেয়সীর মুখে হাসি না দেখতে পায় তাহলে হয়ত তার বিক্ষিপ্ততা দূর হবে না। তার মধ্যে এখন আবার এমন ঘাড়ত্যাড়া কথা।
সে গমগমে সুরে বলে–
—আমার দেরি হচ্ছে আম্মু? সে কি আসবে নাকি আমি চলে যাবো?
—না যাবে। তুই গাড়ি বের কর যা।
জাহান মায়ের কথায় চলে যায় গাড়ি বের করতে। এদিকে হানিয়া মেহরিমাকে বুঝিয়ে জাহানের সাথে যেতে রাজি করে। মেহরিমা হানিয়া ও বাকিদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়। বাহিরে এসে দেখে জাহান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।
মেহরিমা গুটিগুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেলে জাহান কথা বলতে বলতেই ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের ডোর খুলে দেয়। দৃষ্টি তার অন্যদিকে। মেহরিমা একবার জাহানের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। জাহান ডোর লাগিয়ে কথা শেষ করে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। মিনিটের ব্যবধানে গাড়ি চলতে শুরু করে।
এদিকে তাদের গাড়ি বাড়ির ফটক থেকে বের হয়ে মেইন রাস্তায় উঠলে দূর থেকে তাদের উপর নজর রাখা ব্যক্তিটি ফোন লাগায় কাউকে। ফোনের অপরপাশে থাকে ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়ে বলে–
— মির্জা বাড়ি থেকে মাত্রই একটা সাদা রঙের গাড়ি বের হয়েছে। সেটাকে ফলো করো আর সেটায় অবস্থান করা মেয়েটার সম্পর্কে সব খোঁজ নাও। এ টু জেড সবটা।
কথা শেষ করে খট করে ফোন কেটে দেয়। ব্যক্তিটির চোখ এখনও রাস্তার দিকে। তার চোখে একপ্রকার ক্রোধে ছাপ রয়েছে।
শব্দসংখ্যা-১৮০০
~চলবে?