সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-২৫+২৬

0
1

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_২৫

গুনগুনিয়ে গান করতে করতে হেলেদুলে বাসায় আসে হায়া। আজকের এক্সামটা তার একটু বেশিই ভালো হয়েছে। যতটা টেনশন করছিলো তার কিছুই হয়নি। বরং অন্যান্য গুলোর চেয়ে আজকের টা বেশি ভালো হয়েছে। আজ লাস্ট পরীক্ষা ছিলো। ভাইবা কিছুদিন পর। হায়া ভাবছে আশিয়ানকে মানিয়ে একটু ও’বাড়ি যাবে।

মন ভালো থাকার আরেকটি কারণ হলো, আজ একজনের সাথে তার পূর্বের ঝামেলা মিটে গিয়েছে। কার সাথে? সেটা একটু পরই জানতে পারবেন।

দরজায় কলিংবেল দিতেই স্পর্শ এসে খুলে দেয় দরজা। চোখে মুখে এক ধরণের উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কা। হায়া’কে দেখেই তার গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে–

—আম্মাজান, কই ছিলি তুই এতক্ষণ? তোর ফোন অফ কেন? জানিস আমরা তোকে নিয়ে কত টেনশন করছিলাম। আশিয়ান তো তোকে খুজতে খুজতে পাগল হয়ে গিয়েছে। একটু আগে বাসায় আসলো ছেলেটা, তাড়াতাড়ি রুমে যা।

হড়বড়িয়ে এতগুলো কথা বলে তারপর থামে স্পর্শ। অন্যদিকে শ্বাশুড়ির থেকে এসব শুনে হায়া অবাক হয়ে যায়। বুকটা কেমন ধক করে উঠেছে তার। ফোন বের করে চেক করলে দেখে আসলেই তার ফোনটা বন্ধ। ইশশ রে! পরীক্ষার হল থেকে বের হওয়ার পর একটা কারণে তার ফোনটা পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে আর মনে ছিলোনা অন করতে।

হায়া পা চালাতে শুরু করে। উদ্দেশ্য তাদের রুম। সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তার মনে পড়ে পরীক্ষা শেষ করে বের হওয়ার সময়টার কথা।

_____________________

~এক্সামের পর~

এক্সামের দিনগুলোতে বাসা থেকে কেউ না কেউ তাকে আর মেহরিমাকে পরীক্ষার কেন্দ্রে দিয়ে আসত। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আশিয়ান আজ দিয়ে এসেছিলো আর বলেছিলো সেই নিতে আসবে। হায়া খুশি মনে মেহরিমার সাথে পরীক্ষা দিতে চলে যায়।

পরীক্ষা শেষ করে তার বের হতে একটু লেটই হয় অন্যদিনের চেয়ে।কারণ সে তার আরেক সহপাঠীর সাথে দাড়িয়ে কথা বলছিলো তাই। বাহিরে এসে দেখে না আছে মেহরিমা আর নাই আছে আশিয়ান। তার কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ে। সে ফোন বের করে প্রথমে ফোন লাগায় মেহরিমাকে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে না মেহরিমা। এমনটা খুবই রেয়ার তাদের ফ্রেন্ডশিপে। ইদানীং মেয়েটার ব্যবহারও তার কেমন অদ্ভুত লাগছে।

ফোনটা একটু ঘাটাঘাটি করলে তার নজের পড়ে মেহরিমার মেসেজ যেখানে সে লিখেছে—

—কিছু কেনাকাটা করা লাগবে, তাই আমি একাই চলে যাচ্ছি। টেনশন নিস না।

মেসেজটা দেখে হায়া’র রাগ হয়। তাকে সাথে করে নিয়ে গেলে কি হতো? মেহরিমা একা-একা রাস্তা পাড় হতে পারে না, ঘাবড়ে যায়। আজ একাই চলে গিয়েছে বলে তার একটু টেনশন হচ্ছে।

হায়া এবার ভাবে তার বরটাকে ফোন দিয়ে জানা যাক সে কেনো আসেনি। সে আশিয়ানের নম্বরটা ডায়াল করে কানে ধরে। রিং হচ্ছিল তখনই পেছন থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ তার নাম ধরে ডেকে উঠে–

—হায়া।

হায়া’র শরীর তরতরিয়ে কেঁপে উঠে। কানে চেপে রাখা ফোনটা হাতের কাঁপা-কাঁপিতে নিচেই পড়ে যায়। হায়া’র ভয় হচ্ছে পেছন ফিরে তাকাতে। সে পেছন না ফিরে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।

লোকটি নিজেই হায়া’র পেছন থেকে সামনে আসে। ঝুঁকে হায়া’র ফোনটা উঠিয়ে এগিয়ে দেয় হায়া’র দিকে। হায়া’র চোখে চোখ রাখলে দেখতে পায় সেখানে তার জন্য একরাশ ভীতি, অস্বস্তি, অস্থিরতা।

হায়া’র চোখের এই ভীতি দেখে ফারাবি’র বুকটা হুহু করে উঠে। হ্যাঁ, ব্যক্তিটি ফারাবি। ফারাবি ভাবে–

—আগে এই চোখে তার জন্য মুগ্ধ বা ভালোবাসার ছোয়া না থাকলেও এমন ভীতি তো ছিলো না। তাহলে আজ এমনটা কেন?

হায়া তখনও ফারাবি’র হাত থেকে নিজের ফোনটা নেয় নি। ফারাবি গলা খাঁকারি শান্ত গলায় বলে–

—ফোনটা নাও।

হায়া’র যেনো ধ্যাণ ভঙ্গ হয়। সে চোখ সরিয়ে ফারাবি’র হাতের দিকে তাকায়। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিজের হাতে তুলে নেয়। ফোনের পাওয়া অন বাটান টা প্রেস করলে দেখে ফোনটা মাটিতে পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হায়া ফোনটা অন করতে করতে ফারাবি’র সামনে থেকে চলে আসতে নিলে, ফারাবি তার এক হাত খপ করে ধরে ফেলে।

ফারাবি’র এমন হাত ধরায় হায়া’র চোখজোড়া অস্বাভাবিক রকমের বড়বড় হয়ে যায়। সেকেন্ডের ব্যবধানে হায়া আকুতি ভরা আর্জি শুনতে পায়–

—হায়া, প্লিজ যেয়ো না। কিছু কথা ছিলো। প্লিজ কথাগুলো শুনো আমার।

হায়া নিজের হাতটা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। ওড়নার আচল দিয়ে জায়গাটা মুছতে মুছতে বলে–

—আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি ভাইয়া। আপনি আবারও আমার গায়ে টাচ করেছেন। আপনার কি এইটুকু জানা নেই, একটা মেয়ের গায়ে তার পারমিশন না নিয়ে হাত দেওয়া কতটা অসভ্যতামির কাজ? আপনার মতো একজন নামি-দামি ডাক্তারের কাছে এমনটা কাম্য নয়।

ফারাবি হায়া’র কথা শুনে আহত হয়। স্মিত স্বরে বলে–

—সরি আর কখনো হবে না।

—না হলেই ভালো।

কথাটা বলে হায়া আবার হাটা দেয়। উদ্দেশ্য রিকশা নিয়ে বাসায় পৌছানো।

এরই মধ্যে ফারাবি দৌড়ে তার সামনে এসে তার পথ আটকায়। অনুনয় নিয়ে বলতে থাকে–

—হায়া, কয়েকটা কথা ছিলো তোমার সাথে। প্লিজ কথাগুলো শুনে যাও। আমি কথাগুলো না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না। প্লিজ এই অনুরোধটা রাখো।

হায়া ফারাবি’র এত অনুরোধ শুনে হায়া তার দিকে তাকায়। দেখতে পায় সুর্দশন লোকটি কিভাবে যত্ন করপ নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। চোখের নিচের কালো দাগগুলো তার নির্ঘুম রাতের স্বাক্ষী দিচ্ছে, উসকোখুসকো চুল, এলোমেলো শার্ট এসবই যেনো তার বেহাল অবস্থার কথা জানাচ্ছে হায়া’কে।

হায়া কঠোর গলায় মানা করতে চায় তাকে, কিন্তু গলায় দিয়ে বের হয় না নেতিবাচক কিছু। অজান্তেই বলে দেয়–

—বলেন, কি বলবেন?

ফারাবি’র সিগারেটে পুড়ে যাওয়া ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে। হাসিমুখে বলে–

—কোথাও একটা বসে বলি? এই কাছেই একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে সেখানে যাই চলো।

হায়া কাঠকাঠ গলায় বলে–

—যা বলার এখানেই বলুন। বাসায় যাওয়া লাগবে আমার।

—প্লিজ চলো না। বেশিক্ষণ নিবো না। আর তাছাড়া এতক্ষণ এক্সাম দিয়ে নিশ্চয়ই তোমার ক্ষুধা পেয়েছে, আমিও দুপুরে কিছু খাই নি। হালকা পাতলা কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে। প্লিজ মানা করো না, প্লিজ।

হায়া মানা করতে পারে না। তার বিবেক তাকে দেয় না নাকচ করতে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় যাবে সে। তারপর আগে আগে হাঁটা শুরু করে। ফারাবি তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁকা হাসি দেয়।

তারা ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ে। হালকা স্ন্যাক্স অর্ডার করে বসে থাকে। হায়া ভাবে খাবার আসতে আসতে ফারাবি তার কথাগুলো বলে ফেললে খাবার খেয়েই সে চলে যেতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে ফারাবিকে বলে–

—আপনি যেনো কি বলবেন ফারাবি ভাইয়া?

ফারাবি এতক্ষণ একধ্যানে হায়াকে দেখছিলো। হায়া’র কথায় যেনো তার ধ্যাণ ভঙ্গ হয়। ফারাবি একবার এদিক সেদিক তাকায়। তারপর হুট করেই হায়া’র ডান হাতটা তার দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে করুণ গলায় বলা শুরু করে–

—বিশ্বাস করো হায়া, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। জাহান মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পরের বছরই তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম একটা কাজে, সেদিন থেকেই তোমায় ভালোবাসি। আমার এতগুলো বছরের ভালোবাসা এভাবে হারিয়ে দিও না প্লিজ। চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই, সেখানে কেউ থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি।

হায়া বিস্মিত চোখে ফারাবি’র কথাগুলো শুনে। কেমন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় করছে সে। হায়া রয়েসয়ে তাকে উত্তর দেয়।

সে ফারাবি’র হাতটার উপর নিজের বাম হাত রেখে শান্ত গলায় বলে–

—আমি আপনার অনুভূতিকে সম্মান করি ফারাবি ভাই। কিন্তু আপনি যেটা বলছেন সেটা কখনোই পসিবল নয়।। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আর আমি আমার হাসবেন্ডকে অনেক ভালো…..

কথা বলতে বলতে হায়া থেমে যায়। একটু শ্বাস নিয়ে বলে–

—আমি আমার হাসবেন্ডকে প্রচন্ড ভালোবাসি। নিজের চাইতেও বেশি। আপনি ভাবতে পারে এই দুই আড়াই মাসে কিভাবে এত ভালোবাসা যায়, আমার উত্তরটা হবে, সে আমার কিশোর কালের প্রথম অনুভূতির জোগান দাতা। তাকে আমি আরো অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি। তার একটা ভুলের কারণে তার জন্য আমার মনে থাকা অনুভূতি গুলো অভিমানের আড়ালে ঢেকে গেলেও এখন তার সংস্পর্শে এসে পুনরায় সেই অনুভূতিগুলো মাথা চড়া দিয়ে উঠছে। আমি অনুভব করতে পারি সে নিজেও আমায় ভালোবাসে। সেদিকে আর না যাই। সে সব আমাদের পারসোনাল কথা, কিন্তু সব কথার এক কথা আমি আপনার এই অন্যায় আবদার মেনে নিতে পারলাম না।

ফারাবি আহত দৃষ্টি নিয়ে হায়া’র কথাগুলো শুনে। বুকের বাম পাশটায় এত ব্যথা কেন হচ্ছে তার সে বুঝতে পারছে না। হায়া নিজের হাতটা ফারাবি’র হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ততক্ষণে খাবারও চলে আসে। হায়া ফারাবি’র দিকে খাবারের একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও খেতে থাকে। নিজের মতো হালকা করে খেয়ে উঠে যাওয়ার আগে বলে–

—আপনার কাছে অনুরোধ রইবো, এমন কিছু করবেন না যার জেরে আমার আপনাকে সম্মান করতে কুণ্ঠিত হতে হয়। আপনি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু আর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সবসময় শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন। আসছি, আল্লাহ হাফেজ।

হায়া কথাগুলো বলে বিল পে করে চলে যায়। ফারাবি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে–

—তোমাকে আমার হতে হবে হায়া, এর জন্য আমার যা করার লাগে আমি করবো।

কথাটা বলে ফারাবি একটা শয়তানি হাসি দেয়।

__________________

~বর্তমান~

হায়া গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিজের রুমে আসে। পরিবেশ কেমন থম মেরে রয়েছে। হায়া রুমে এসে আশিয়ানকে পায় না। সে গলা উঁচিয়ে তাকে ডাক দিয়ে বলে–

—এই শুনছেন? কই গেলেন আপনি? আমি এসে পরেছি।

আশিয়ান তখন বেলকনিতে ছিলো। হায়া হিজাব খুলতে থাকে, এরই মধ্যে আশিয়ান আসে রুমে। সে হেঁটে হেঁটে হায়া’র পিছনে এসে উপস্থিত হয়। তার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আয়নার মাধ্যমে হায়া’র দিকে তাকিয়ে থাকে আশিয়ান।

হায়া আয়না দ্বারা আশিয়ানের দিকে তাকালে দেখতে পায় আশিয়ানের মুখ অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। এমন তো হওয়ার কথা না। হায়া তো কয়েকটা বকা খাবে ভাবছিলো। হায়া হিজাবের পিনগুলো খুলে আশিয়ানের দিকে ফিরে।

আশিয়ান এক হাত বাড়িয়ে হায়া’র কপালের কাছে হালকা ঘাম মুছে দেয় হাত দ্বারা। তারপর হায়া’র চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলে–

—কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

হায়া আশিয়ানের এমন ঠাণ্ডা ব্যবহার দেখে ভয় পেয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায় কিছুদিন আগে ফারাবিকে দেখে আশিয়ানের রেগে যাওয়ার বিষয়টা। হায়া ভাবে–

—এখন তো এমনিতেই অনেক রেগে আছে। তারউপর যদি শুনে ফারাবি ভাইয়ার সাথে ক্যাফেতে গিয়েছি তাহলে আমারে কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে, লবণও লাগবে না। এখন অন্য কিছু বলে কাটিয়ে দেই পড়ে না হয় শান্ত হলে সত্যি টা বলা যাবে।

হায়া’র এসব ভাবনা চিন্তার মাঝে আশিয়ান তাকে আবারও প্রশ্ন করে। হায়া নজর লুকিয়ে আমতাআমতা করে বলে–

—একটা ফ্রেন্ডের সাথে একটু কফি খেতে গিয়েছিলাম।

—ফ্রেন্ডটার নাম কি?

—আপনি তাকে চিনবেন না। সে আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড।

—বলেই দেখো চিনতে পারি কিনা।

—বললাম তো চিনবেন না।

—আচ্ছা আমিই বলছি তোমার ফ্রেন্ড টার নাম। তার নাম ডা.ফারাবি শাখাওয়াত। এম আই রাইট?

আশিয়ানের মুখে এমন একটা কথা শুনে হায়া বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে যায়। সেই সাথে অনেক ভয়ও পেয়ে যায়। আশিয়ান তার সামনে থেকে সরে বেডের কাছে এসে নিজের ফোনটা তুলে নিয়ে আবারও হায়া’র সামনে যায়। তারপর ফোনের লক খুলে ফোনটা হায়া’র দিকে ধরে।

আশিয়ান হায়া’কে বলে–

— দেখো তো চিনতে পারো নাকি এদের?

হায়া স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ফারাবি’র হাতে হাত রেখে যখন হায়া কথাগুলো বলছিলো তখন কেউ ছবিটা তুলেছে। হায়া হতভম্ব হয়ে যায় এমনটা দেখে। কে এই ছবিটা তুললো আর আশিয়ানকে দিলো?

হায়া’র ষষ্ঠইন্দ্র বলছে, আশিয়ানের এমন ঠান্ডা শান্ত ব্যবহার কোন বড় ঝড় আসার পূর্বাভাস মাত্র।

শব্দসংখ্যা~১৬০০
~চলবে?

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_২৬

রাত্রির অবসান ঘটিয়ে নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। পূর্বাকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে হালকা সোনালি আভা। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে এই ভোরকে। বাতাসে এক ধরনের নির্মলতা, যেন সে ক্লান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে চায়। চারপাশে পাখিদের সুরেলা ডাকে পরিবেশ যেন এক অপরূপ স্নিগ্ধতায় মোড়ানো। অথচ এই নিসর্গময় সকালে কারো কারো মনোভারসা বিষাদের কালো ছায়া কাটিয়ে উঠতে পারছে না। হৃদয়ের ভারে ক্লান্ত কায়া আজও মলিন।

হায়া রাতভর বসে ছিল বারান্দার কাঠের কাউচে। চোখে ঘুম নেই, মনে অস্থিরতা। কাউচটা বারান্দায় এমনভাবে রাখা, যেখান থেকে বাড়ির মূল ফটক পরিষ্কার দেখা যায়। সে অপেক্ষায় ছিলো যদি হঠাৎ তার মানুষটা ফিরে আসে, যদি হঠাৎ তার অপেক্ষার অবসান ঘটে। কিন্তু রাত পেরিয়ে সকাল এলেও সেই প্রিয় মুখের দেখা মেলেনি।

আকাশে আলো বাড়ে, আর হায়া’র চোখে জমে অন্ধকার। চোখের কোণ থেকে নীরব অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ে মুখের পাশে। শরীর আর মানতে চায় না দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা ক্লান্তি। সে ধীরে ধীরে গা এলিয়ে দেয় কাউচের গায়ে। হৃদয়ে এক ধরণের হাহাকার, এক অপ্রকাশ্য দীর্ঘশ্বাস। চোখ আপনা থেকেই বুঁজে আসে, ক্লান্ত মন অবশেষে ঘুমে ডুবে যেতে চায়।

আর ঠিক সেই সময়, মস্তিষ্কের গহীনে হায়া’র মনে পড়ে কাল রাতের কিছু কথা—কিছু এমন স্মৃতি, যা বিষাদকে আরও ঘনীভূত করে তোলে, যা চোখের ঘুম কেড়ে নেয়, অথচ মনে গেঁথে থাকে অনন্তকালের জন্য।

________________________

গতকাল রাত~

হায়া আমতাআমতা করছে। কি জবাব দিবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। একে তো ফারাবি’র সাথে দেখা করতে গিয়েছে, দুয়ে এমন হাত ধরাধরি করে কথা বলেছে। যদিও সেটা বুঝানোর উদ্দেশ্য ছিলো কিন্তু আশিয়ান তো সেটা মানবে না। তিনে, মিথ্যা বলেছে। মানে বাঁশ খাওয়ার সব ব্যবস্থা নিজ হাতে করে রেখেছে।

এদিকে আশিয়ানের ধৈর্য ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছে। সে আবারও শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে–

—কার পারমিশন নিয়ে ফারাবি’র সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে? আর মিথ্যে বললে কেন?

—আমি মিথ্যে বলতে চায় নি, ভেবেছিলাম ধীরে সুস্থে আপনার রাগ কমলে তারপর,….

—তারপর গুছিয়ে আরেকটা মিথ্যে বলে দিবে তাই না? এটাই তো প্ল্যান ছিলো?

হায়া নাবোধক মাথা নাড়িয়ে বলে–

—না না, এমনটা না। আমি বলতাম আপনাকে।

—বলতে তাহলে মিথ্যে বললে কেন?

হুংকার দিয়ে কথাটা বলে উঠে আশিয়ান নিজের হাতে থাকা ফোনটা দূরে কোথাও ছুড়ে ফেলে। ফোনটা কয়েক ভাগ হয়ে অবহেলায় মাটিতে পড়ে থাকে। আশিয়ানের ধৈর্যের বাধ ভেঙে গিয়েছে। তার একটাই কথা কেন দেখা করতে যাবে প্রাক্তনের সাথে? তাও আবার এসে মিথ্যা বললো হায়া।

আশিয়ান হায়া’র বাহুদ্বয় শক্ত হাতে চেপে ধরে ইস্পাত কঠিন কণ্ঠে বলে–

—তুই কার পারমিশন নিয়ে গিয়েছিলি? আমি তোর হাসবেন্ড, আমার পারমিশন না নিয়ে তুই কেন তোর প্রাক্তনের সাথে দেখা করতে গেলি? বল।

হায়া’র আত্মা সহ কেঁপে উঠে আশিয়ানের এমন হুংকার শুনে। সে প্রচন্ড ভয়ে কাঁপতে থাকে। আশিয়ানের এমন রাগ সেই ছোট্ট বেলায় তার কলমটা ফেলে দেওয়ার পর দেখেছিলো আর আজ আবার দেখলো।

হায়া কিছুটা সাহস নিয়ে বলে–

—হাসবেন্ড হয়েছেন তাই বলে আপনাকে সব কথা বলে করতে হবে? আমি আমার পরিচিত কারো সাথে দেখা করতে পারি না?

—পারবি না কেন? অবশ্যই পারবি। কিন্তু এই একজন ব্যক্তি ব্যতীত।

—কেন তার সাথে দেখা করলে কি হয়েছে?

—তুই জানিস না কি হয়েছে? বুঝিস না ওর চোখ তোকে কি বলতে চায়?

—তার আমার জন্য ফিলিংস থাকলেও আমার তো তার জন্য কোন ফিলিংস নেই, তাহলে দেখা করতে সমস্যা কই?

—ওর জন্য নেই তো কার জন্য আছে?

এই প্রশ্নের জবাবে হায়া নিরবতা অবলম্বন করে। মন বলছে বলে দে সত্যি টা। কিন্তু মস্তিষ্ক মুখকে আটকে রেখেছে। মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে এবারও মস্তিষ্ক জিতে যায়।

আশিয়ান গম্ভীর গলায় বলে–

—ভালোবাসো আমায়?

—(নিশ্চুপ)

—আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করেছি তোমায়। ভালেবাসো কিনা আমায়? হ্যা অথবা না তে জবাব দিবে।

—দেখুন, আপনি কিসের মধ্যে কি আনছেন? আমার ভুল হয়েছে না বলে যাওয়াটা, এর জন্য আমি সরি।

—আমার প্রশ্নের জবাব দাও। ডু ইউ লাভ মি? জাস্ট এন্সার উইথ ইয়েস ওর নো।

—(নিশ্চুপ)

—এন্সার মি ড্যাম ইট।

পূর্বের ন্যায় হুংকার দিয়ে বলপ কথাটা আশিয়ান। হায়া ফট করে বলে দেয়–

—না বাসি না। না আপনাকে আর নাই বা ফারাবি ভাইয়াকে, কাউকে ভালোবাসি না। আপনারা দু’জনই আমায় নির্মমভাবে কাঁদিয়েছেন।

চিৎকার করে কথা গুলো বলে হায়া। কথা শেষ করে সে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। আশিয়ানও তার থেকে দূরে সরে আসে।

আশিয়ান ঘরের মাঝেই এলোমেলো পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে। তারপর হুট করেই একটা ফ্লাওয়ার ভাস উঠিয়ে ছুড়ে মারে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার দিকে। বিকট শব্দ হয়ে যায় আয়না টা। আশিয়ান নিজের রাগ কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না। সে কিছুতেই মানতে পারছে না হায়া তাকে ভালোবাসে না।

বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মাঝে কেটে যায়। আশিয়ানই প্রথমে কথা বলা শুরু করে। সে বলে–

—বেশ ভালো। আমায় ভালোবাসো না তারমানে আমার থাকা না থাকায় তোমার কিছু যায় আসে না। তাই না?

হায়া অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। কি বলবে সে? মনে এক কথা রেখে মুখে আরেকটা বলে দিয়ে এখন সে চরম ভাবে পস্তাচ্ছে।

—আমায় যদি ভালো না বাসো তাহলে কিসের জোরে আমি তোমার উপর অধিকার ফলাবো। শুধু মাত্র কবুলের জোর অধিকার ফলানো আমার নীতির বিরুদ্ধ কাজ। এটা আমি মরে গেলেও করতে পারবো না। তাই আজ থেকে তুমি তোমার মতো থাকবে আর আমি আমার মতো। যতদিন না আমরা একে অপরকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসতে পারবো ততদিন কেউ কারো জীবনে কোন অধিকার ফলাবো না। না তুমি আর নাই আমি।

আশিয়ান নিজের কথা শেষ করে প্রথমে রুম থেকে তারপর বাসা থেকে বের হয়ে যায়। হায়া তার পেছন ডাকলেও শুনে না। আশিয়ান চলে যেতেই হায়া ধপ করে নিচে বসে পড়ে। কি থেকে কি হয়ে গেলো সে এখনো বুঝতে পারছে না।

______________________

বর্তমান~

হায়া’র চোখটা মাত্রই লেগে এসেছিলো তখনই সে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনে। সে চোখ মেলে দেখতে চায় আশিয়ান এসেছে কিনা কিন্তু তার অনেক দূর্বল লাগছে। উঠার শক্তিটা পর্যন্ত পাচ্ছে না।

আশিয়ান গাড়ি পার্ক করে এসে কলিংবেলে বাজালে তাদের হেল্পিং হ্যান্ড মহিলা দরজা খুলে দেয়। সময় এখন সাড়ে ছয়টা। এত সকালে আবরার-স্পর্শ কেউই উঠে না। তারা ফজরের নামাজ পড়ে আবার একটু ঘুমায়।

দরজা খুলে দিলে আশিয়ান গটগট করে রুমে চলে আসে। রুমে এসে হায়া’কে না দেখতে পেয়ে তার কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ে। সে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে চেক করে। সেখানে না পেয়ে বেলকনিতে আসলে হায়া’কে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়।

হায়া’কে পেয়ে আশিয়ান বড় করে একটা হাফ ছাড়ে। সে বিড়াল পায়ে হেঁটে হায়া’র কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। হায়া’র চোখের কোণে শুকিয়ে থাকা পানির দাগগুলো আশিয়ানের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে দেয়। আশিয়ান হায়া’র কপালের উপর পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তারপর হায়া’র কপালে ভালোবাসার পরশ দিতে নেয়। কিন্তু কি মনে করে যেনে আর দেয় না।

সে আলতো হাতে হায়াকে কোলে তুলে রুমে চলে আসে। তারপর তাঁকে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজে জামা কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। এদিকে আশিয়ান চলে যেতেই হায়া চোখ মেলে তাকায়। আশিয়ান যখন তার মুখটা হায়া’র কাছে এনেছিলো তখন সে সিগারেটের গন্ধ পেয়েছিলো। হায়া ভীষণ ব্যথিত হয় এটা জানতে পেরে যে আশিয়ান সিগারেট খেয়েছে। হায়া ছোট থেকে দেখে এসেছে না তার পাপা আর ভাইয়েরা নাই বা তার শ্বশুর কেউ সিগারেট বা নেশা পানি করে না। আশিয়ানও করত না। কিন্তু আজ?।

হায়া জানে না তাদের সম্পর্কটা কবে আবার আগের মতো মিষ্টি মধুর হবে। কিন্তু যা করার তা সবটাই যে হায়া’কে করতে হবে এটা সে খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে

~চলবে?