সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-২৭+২৮

0
1

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_২৭

সময় বড়োই স্বার্থপর। সে কারও কান্নায় থামে না, কারও সুখে মুগ্ধ হয় না। নিজের ছন্দে, নিজের নিয়মে সে এগিয়ে চলে—পেছনে ফেলে যায় হাজারো ভাঙা স্বপ্ন, অপূর্ণ অপেক্ষা।

সেদিনের পর কেটে গেছে পাঁচটি দীর্ঘ দিন। হায়া বারবার নানা ভাবে আশিয়ানের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, নিজের সেই অনাঘটিত বোকামির জন্য অনুশোচনায় ভেঙে পড়েছে। সে কথায়, আচরণে, দৃষ্টিতে — প্রতিটি ভঙ্গিতেই বোঝাতে চেয়েছে তার অনুতপ্ত মন। অথচ আশিয়ান যেন এবার একেবারে পাথর হয়ে গেছে। বোঝে, তবুও না বোঝার ভান করে। দেখে, তবুও না দেখার অভিনয় রচে।
তার জেদের মাটিটা ছিল বরাবরই দুর্ভেদ্য আর এইবারও সে তার কঠিন অবস্থান থেকে একচুলও সরেনি।

হায়ার অনুনয় যেন বাতাসে ভেসে গিয়েছে, আশিয়ানের মন ছুঁয়ে যেতে পারেনি।

এই ক’দিন আশিয়ান যেন ইচ্ছে করেই হায়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলেছে। রাতে ফিরছে অনেক দেরিতে, যেন বাসার চৌকাঠ পেরোনোই অনিচ্ছায় ভরা। আর সকালে? সূর্য ওঠার পরপরই গা ঢাকা দেয় কোনো অজানা ব্যস্ততায়।

হায়া, যার এখন ফাইনাল এক্সাম শেষ, সারা দিনই ঘরে থাকে—নিঃসঙ্গ, অপেক্ষার ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত। প্রতিটি ঘণ্টা যেন তার কাছে ধীরে ধীরে জমাট বাধা দীর্ঘশ্বাস হয়ে উঠছে। আশিয়ান আছে, তবুও নেই এই দুর্বিষহ অনুভূতিটা হায়ার বুকের ভেতর বিষের মতো জমে উঠছে।

সময় এখন রাত নয়টা পঁইতাল্লিশ।
আশিয়ান তার ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোমতে টেনে বাসায় আসে। রুমে ঢুকে অফিস ব্যাগটা স্টাডি টেবিলের ওপর রেখে দেয়। তারপর এক দমকা নিশ্বাস ফেলে নিজের বিধ্বস্ত দেহটা সোফায় এলিয়ে দেয়। নিথর, নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। মাথার ভেতর ব্যথায় দপদপ করছে, যেন প্রতিটা চিন্তা তার মস্তিষ্কে হাতুড়ির মতো আঘাত করছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, আর সেই নিস্তব্ধতার ভেতর আশিয়ানের ক্লান্তি আরও ঘন হয়ে জমে থাকে।

সোফায় বসার মিনিট দুয়েক পরই কেমন ঠাণ্ডা ভেজাভেজা অনুভব করে। চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই সোফায় হাত রাখলে বুঝতে পারে সোফাটা ভেজা। একটুখানি জায়গা না বরং পুরো সোফাটাই ভেজা। এমন কাণ্ডে আশিয়ানের কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ে। ভুল বশত পানি পরলে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ভেজা থাকবে পুরোটা তো ভেজা থাকার কথা না। তাহলে কি কেউ ইচ্ছে করে করেছে এমনটা?

তার চেয়েও বড় কথা আজ সে ঘুমাবে কোথায়? এই কয়েকদিন সে হায়া’র সাথে রাগ করে এই সোফাতেই নিজের বসতি স্থাপন করেছিল, কিন্তু আজ সেই জায়গা টারও এই অবস্থা।

আশিয়ান যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত তখনই তার ঘরণী গুটিগুটি পায়ে হেটে আসে তার সামনে। হাতে তার এক গ্লাস পানি। হায়া গ্লাসটা আশিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে–

—পানি টা খান। ভালো লাগবে।

আশিয়ানের ধ্যাণ ভাঙে হায়া’র কথায়। সে হায়া’র দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকে। আগে অফিস থেকে ফিরলে মেয়েটাকে কম করে হলেও ১৫/২০ মিনিট নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখত। এমনটা করায় তার মনে হতো, তার সারাদিনের সকল ক্লান্তি কর্পূরের ন্যায় উড়ে যেত। কিন্তু লাস্ট কয়েকটা দিন তা করা হয়নি। ইভেন রাতেও হায়া’র তুলতুলে শরীরটা নিজের বুকের উপর নিয়ে ঘুমানো হয়নি।

—কি হলো নিন পানিটা।

আশিয়ান হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নেয়। পানি খেতে শুরু করে তখনই হায়া হাত বাড়িয়ে আশিয়ানের শার্টের বাটান গুলো খুলে দিতে থাকে এক-এক করে। আশিয়ান একবার তার হাত সরিয়ে দিলেও হায়া জোর করেই কাজটা করে।

আশিয়ানের পানি খাওয়া শেষ হলে তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে দেয় হায়া। তারপর তার পেছনে গিয়ে আশিয়ানের মাথার চুলগুলো আলতো হাতে টেনে দিতে শুরু করে। আশিয়ান গমগমে গলায় বলে–

—লাগবে না। ছাড়ো ফ্রেশ হতে যাবো।

হায়া তার দ্বিগুণ গম্ভীর গলায় বলে–

—লাগবে কি লাগবে না সেটা আমি বুঝে নিবো। আপনি চুপ করে থাকুন, নাহলে চুল ছিঁড়ে শাক রান্না করে আপনাকেই খাওয়াব।

হায়া’র এমন কথায় আশিয়ান থতমত খেয়ে যায়। বলে কি এই মেয়ে। চুল ছিঁড়ে শাক রান্না করা যায়?? হায়া বেশ কিছুক্ষণ আশিয়ানের মাথা টিপে দেয়। আশিয়ানেরও ভালো লাগছিল বলে আর মানা করে না। হায়া মাথা টিপা শেষ করে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে যায়। সেখান থেকে আশিয়ানের বাসায় পরিধান করা জামা কাপড় বের করে তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে–

—ফ্রেশ হয়ে আসুন। খাবার কি এখানে আনবো নাকি নিচে যেয়ে খাবেন?

—নিচে যেয়েই খাবো। সবার খাওয়া হয়েছে?

—হুম।

“তুমি খেয়েছো?” কথাটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না আশিয়ান। ফ্রেশ হতে চলে যায়। হায়া তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দেয়। বিড়বিড়িয়ে বলে–

—শালার জামাই, আজ তোর হাতেই আমি খাবো আর তোর বুকেই আমি ঘুমাবো। আমার সাথে নাটক করার ঝাল যদি বের করতে না পেরেছি তাহলে আমার নাম জেসমিন তালুকদার হায়া না। আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া।

কথাটা বলে হায়া নিজের কাঁধের চুল গুলো একটু ভাব নিয়ে উড়িয়ে দিয়ে গুণগুণ করতে করতে নিচে চলে যায় খাবার গরম করতে।

আশিয়ান নিচে এসে দেখে হায়া কিচেন থেকে খাবারের বাটি গুলো আনছে। হায়া আশিয়ানকে দেখে বলে–

—আপনি শুরু করুন আমি আসছি।

কথাটা বলে আবারও কিচেনে চলে যায়। আশিয়ান খাবার প্লেটে তুলে নেয় ঠিকই কিন্তু শুরু করে না খাওয়া। এরই মাঝে কিচেন থেকে বিকট আওয়াজে হায়া’র চিৎকার শোনা যায়।

আশিয়ান দৌড়ে কিচেনে গিয়ে দেখে কিছু কাঁচের থালাবাসন নিচে পড়ে আছে আর হায়া নিজের রক্তাক্ত হাত ধরে বসে আছে। আশিয়ানের বুকটা জোরে ধক করে উঠে। সে দৌড়ে হায়া’র কাছে এসে বসে পড়ে, উত্তেজিত হয়ে বলে–

—এসব কি করে হলো হায়া? হাত কাটলে কিভাবে জান? আল্লাহ কতো রক্ত ঝরছে!!!

হায়া এক ধ্যাণে আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আশিয়ানের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ব্যথাটা হায়া না সে নিজে পেয়েছে। এরই মাঝে আবরার-স্পর্শ আর তাদের হেল্পিং হ্যান্ড মহিলাও চলে আসে। তারাও হায়া’কে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে যায়। স্পর্শ তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করে–

—আম্মু, এত হাত কাটলি কিভাবে? আল্লাহ! আশিয়ান ওকে কিচেন থেকে বাহিরে নিয়ে যা।

আশিয়ান ঝট করে হায়া’কে কোলে তুলে নেয়। সাবধানে কাচ গুলো ডিঙিয়ে তাকে বাহিরে এনে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে দেয়। উদ্বিগ্ন হয়ে হায়া’র অন্য হাত-পা দেখতে থাকে। আর কোথাও কেটেছে কিনা।

আবরার আশিয়ানকে বলে–

—এত রাতে তো কোন ডাক্তার পাবো না, তুমি ওকে আশেপাশের কোন ক্লিনিকেই নিয়ে যাও। কোন রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই, যদি হাতের ভেতরে কোন কাচ ঢুকে থাকে তাহলে পরবর্তীতে ইনফেকশন হওয়ার চান্স থাকবে।

আশিয়ান বাবার কথামতো হায়া’কে পুনরায় কোলে তুলতে নেয় কিন্তু হায়া তাকে থামিয়ে দেয়। শান্ত গলায় বলে–

—কোন কাচ ফুটে নি আমার হাতে। নরমাল ড্রেসিং করিয়ে দিলেই হবে, যেটা উনিও পারবে। শুধু শুধু এত রাতে দৌড় ঝাপ করা লাগবে না।

আশিয়ান রাগী গলায় ধমক দিয়ে বলে–

—তুমি বেশি বুঝো আমাদের থেকে? চুপচাপ আমার সাথে যাবে, বেশি কথা বললে মাথার উপরে তুলে একটা আছাড় মারব।

হায়া’র চোখ বড়বড় হয়ে যায় আশিয়ানের কথা শুনে। তার একটু নাটকের জন্য এখন হসপিটালে যেতে হবে? হায় আল্লাহ! অবশ্য সে নিজেও ভাবেনি এতটা হাত কেটে যাবে। সে জাস্ট প্লেট গুলো পায়ে ফেলতে চেয়েছিলো কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত পায়ে তো পরলই না উল্টো হাত কেটে বসে আছে।

হায়া তাও সাহস নিয়ে বললো–

—বাসার সামনের ফার্মেসির লোকটাকে ডেকে আনলেই হয়। সে না হয় এসে দেখে যাক। সে যদি বলে হসপিটালে যেতে হবে তারপর না হয় গেলাম।

—একটা কথাও না। চুপচাপ চলো আমার সাথে।

কথাটা বলে যেই না হায়া’কে কোলে তুলবে তখন স্পর্শ বলে–

—আশু, হায়া ঠিক বলছে। আগে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অন্তত রক্ত পড়াটা বন্ধ করা দরকার। দেখছিস কতটা রক্ত বের হয়েছে অলরেডি।

আশিয়ান হায়া’র দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে তার পরনের স্কাই ব্লু চুরিদারটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গিয়েছে অনেকটা। আশিয়ানের বুকে আবারও চিপ খায়।

আশিয়ান আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে–

—বাবা, তুমি একটু ফার্মাসিস্ট কে কল করো না। আমার কাছে তার নাম্বার নেই।

আবরার আশিয়ানের কথা শুনে নিজের রুমের দিকে হাটা দেয়। ফার্মাসিস্ট তাদের পুরানো চেনা লোক হওয়ায় রাত দশটায়ও তাদের বাসায় আসে। সে হায়া’র হাত ভালো করে খুঁচিয়েখাচিয়ে ক্লিন করে ড্রেসিং করে দেয় আর এ-ও বলে–

—ক্ষত জায়গাটা গভীর হলেও কোন কাচ ফুটে থাকেনি। আমি ড্রেসিং করিয়ে দিয়েছি। দিনে একবার ড্রেসিং করতে হবে রেগুলার কয়েকদিন তাহলে ক্ষত তাড়াতাড়ি শুঁকিয়ে যাবে। এছাড়া চিন্তার কোন কারণ নেই।

আশিয়ান অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে–

—আপনি সিউর তো? ভালো করে চেক করেছেন তো? দেখুন আমরা ওকে নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাই না।

আবরারের সমবয়সী লোকটা আশিয়ানের এমন অস্থিরতা দেখে মনে মনে হেঁসে উঠে। আবরার আশিয়ানকে বলে–

—উনি ভালো করে চেক করেই তো দেখল আমাদের সামনে। প্রয়োজন হলো নিশ্চয়ই বলত। তুমি একটু চুপ করো তো। আর ফারুক ভাই (ফার্মাসিস্ট) রাতে হয়ত ব্যথা হতে পারে। এর জন্য কোন ঔষধ দিবেন?

—হ্যাঁ। একটা নরমাল পেইন কিলার আর প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলে জ্বর আসার সম্ভাবনা কম থাকবে।

—আচ্ছা।

লোকটি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চলে যায়। স্পর্শ আশিয়ানকে বলে–

—তোমরা দু’জন উপরে যাও। আমি তোমাদের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। আশিয়ান ওকে সাহায্য করো। আর দু’জন খেয়ে নিও।

—হায়া খায় নি আম্মু?

খানিকটা অবাকতা নিয়ে প্রশ্ন করে আশিয়ান। স্পর্শ বলে–

—নাহ্, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

কথাটা শুনে আশিয়ানের রাগও হয় আবার একটা ভালো লাগাও কাজ করে। কিন্তু সে তার রাগ টাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। সে হায়া’র দিকে এমন একটা লুক দেয় যে আবরার-স্পর্শ না থাকলে আশিয়ান তাঁকে কাচাই গিলে ফেলত। হায়া তার চাহনি দেখে পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে নেয়।

তারপর তারা দু’জন রুমে চলে আসে। রুমে এসে আশিয়ান হায়া’কে বেডে বসিয়ে দিয়ে সে কাবার্ডের কাছে চলে যায়। সেখান থেকে হায়া’র একটা ড্রেস বের করে রুমের লাইট অফ করে হায়া’র কাছে ফিরে আসে। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার হায়া খানিকটা ভয় পেয়ে যায়।

তার ভয়টা আরো বেড়ে যায় যখন আশিয়ান তার জামার চেইনে হাত লাগায়। হায়া হড়বড়িয়ে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে যায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে–

—কি করছেন আপনি? জামায় হাত দিচ্ছেন কেন?

আশিয়ান গম্ভীর গলায় বলে–

— চেঞ্জ করবে না তুমি? এক হাত তো কেটে বসে আছো। আরেক হাত দিয়ে একা একা চেঞ্জ করতে পারবে? এদিকে আসে, আমি হেল্প করছি তোমায়।

আশিয়ানের কথা শুনে হায়া লজ্জা ও অস্বস্তি দুটোই অনুভব করে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে–

—আমি পারবো, আপনি আমার কাছে দেন। আর বাহিরে দিকে একটু ওয়েট করেন।

কথাটা বোধহয় আশিয়ানের পছন্দ হয় না। সে হায়া’র হাসবেন্ড হয়ে তার অসুস্থতায় সাহায্য করতে পারবে না? এতদিন না হয় আশিয়ান তাকে সময় দিচ্ছিল, তাদের সম্পর্কটাকে সময় দিচ্ছিল তাই বলে সবসময় এমন দূরে দূরে থাকবে এমনটা তো হবে না। আশিয়ান হায়া’কে নিজের জীবনে চায়। এতটা চায় যে সে হায়া’কে ছাড়া নিজেকে অচল মনে করে। আর হায়া? সে সব অনুভব করেও কেমন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে চলে।

আশিয়ান রেগে হায়া’র কাছে চলে আসে। বেলকনিতে জ্বলতে থাকা লাইটের আলোতে ঘরটা আবছা আলোয় ছেয়ে আছে। সে হায়া’র বাম হাত টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে, এতটাই কাছে যে হায়া আশিয়ানের প্রতিটা নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছে।

আশিয়ান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে–

—লুক, তোমায় ও আমাদের সম্পর্কটাকে আমি যথেষ্ট সময় দিয়েছি। আর না। আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গিয়েছে। একটা কথা শুনে রাখো, তুমি আমার। শুধু মাত্র আমার। ইহকাল পরকাল সব কালের জন্য আমার। তুমি আমায় ভালোবাসা না তো? ওকে, চলবে আমার। আমি চালিয়ে নিবো। কিন্তু আমার থেকে দূরে থাকার চিন্তা মাথার হাজার কিলোমিটারেও আনবে না। তুমি জানো আমি আমার জিনিসের প্রতি কতটা পজিসিভ। এখন চুপচাপ আমায় আমার কাজ করতে দাও। নাহলে আজ রাতটা তোমার জন্য বেদনাদায়ক একটা রাত হতে চলেছে।

হায়া আশিয়ানের এমন কথা শুনে গাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশিয়ান হায়া’র গলার থেকে ওড়না নিয়ে নিজের চোখ বেঁধে নেয়। তারপর সেভাবেই তার ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে দেয়। ড্রেসে চেঞ্জ করার পরই শুনতে পায় স্পর্শের গলা। আশিয়ান দরজা খুলে দেখে সে খাবার নিয়ে এসেছে। আশিয়ান খাবারের ট্রে’টা নিয়ে পুনরায় হায়া’র কাছে আসে। নিজের সাথে সাথে হায়া কেও খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়া শেষ করে হায়া’কে প্রয়োজনীয় মেডিসিন দিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়ে সে নিচে চলে যায়। এঁটো প্লেটগুলো ধুয়ে রুমে এসে ভার্সিটির কাজ করতে থাকে।

মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকায় ঘণ্টায় দুয়েক কাজ করেই শুতে চলে যায়। বেডে এসে হায়া’র থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় করে শুয়ে পড়ে। একটু পরই অনুভব করতে পারে একজোড়া তুলতুলে হাত তার বাহু আঁকড়ে ধরেছে। নিজের অজান্তেই আশিয়ানের মুখে হাসি ফুটে ওঠে।

আশিয়ান ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে হায়া ঘুমের ঘোরে তার কাছে এসেছে। আশিয়ান এদফায় তাকে ফিরিয়ে দেয় না। সে আলতো হাতে হায়া’কে নিজের বাহুতে এনে শোয়ায়। তারপর হায়া’র আহত হাতটা নিজের কোমড়ের উপর রেখে হায়া’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

আহ! এখন একটু শান্তি পেলো বোধহয় তার আত্মা। এতদিন রাতে শুধু ছটফট করে কাটিয়েছে। বিয়ের পর বউ’কে জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসে বুঝি? আশিয়ান হায়া’র চুলের ভাজে মুখ ডুবিয়ে কতগুলো চুমু খায়। হায়া’র মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বিড়বিড়িয়ে বলে–

— হায়া, আমার শান্তি, আমার একান্ত ব্যক্তিগত নারী। আমার ভালোবাসা। এই আশিয়ান মির্জা তোমায় সীমাহীন ভালোবাসে।

কথাটা বলে আবারও ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় আশিয়ান।তারপর সে অবস্থাতেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে।

এদিকে চোখ বন্ধরত হায়া’র মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। সে খুবই আলতো করে আশিয়ানের বুকে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় যাতে আশিয়ান বুঝতে না পারে। মনে মনে বলে–

—আপনার জন্য বিশাল একটা সারপ্রাইজ আছে জামাই জান। জাস্ট আর কয়েকটা দিন ওয়েট করেন কষ্ট করে।

চলবে।

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_২৮

ফোনটা রিং হতে হতে কেটে গেলো আবারও। এই নিয়ে চতুর্থ বার জাহান মেহরিমাকে কল দিয়েছিলো কিন্তু মেহরিমা কলটা রিসিভ করে না। তাদের সম্পর্কের এতগুলো দিনে এমনটা কখনোই হয়নি। কিন্তু ইদানীং একমাস ধরে হচ্ছে। কেন হচ্ছে জাহান নিজেও জানে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাহান আবারও কল লাগায় মেহরিমার ফোনে। পূর্বের ন্যায় বাজতে বাজতে কেটে যাবে তখনই ফোনটা রিসিভ হয়। আনন্দ উচ্ছ্বাসে জাহানের বুকটা কেঁপে উঠে। কিন্তু তার এই আনন্দ স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। ফোনটা রিসিভ করেই মেহরিমা কোন সালাম বিনিময় ব্যতীতই কর্কশ গলায় বলে–

—সমস্যা কি আপনার বলেন তো? দেখছেন যে আমি রিসিভ করছি না ফোনটা তার মানে আমি নিশ্চয়ই ফোনের কাছে নেই বা আমার এখন কথা বলতে মন চাইছে না তাই করছি না। তাও কেন বারবার ফোন করে আমায় বিরক্ত করছেন? মুড ভালো থাকলে তো আমি সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করি, তাই না?

জাহান কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায় মেহরিমার এহেন আচরণে। আজকের পূর্বে মেহরিমা কখনোই এমন রূঢ় আচরণ করেনি তার সাথে। মেহরিমা একজন নরম, কোমল, লজ্জাবতী মেয়ে জাহানের জানা মতে। হায়া’র কাছে কিছুটা প্রাণবন্ত ও চঞ্চল হলেও তার কাছে একদম কোমল ফুল মেহরিমা। সেই মেহরিমা আজ এমন রূঢ় ও কর্কশ গলায় কথা বলছে তার সাথে? বিষয়টা জাহানের বিশ্বাস হতে চায় না।

জাহানের হতভম্বতা ভঙ্গ হয় মেহরিমার প্রশ্নের তোপে। মেহরিমা পূর্বের ন্যায় বলে–

—কি হলো কথা বলবেন নাকি রেখে দিবো?

আজ যেনো জাহানের শুধু অবাক হওয়ারই দিন। মেহরিমা কেন এমন আচরণ করছে? জাহান আস্তে করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলা শুরু করে–

—কেমন আছো?

—ভালো।

—আমায় জিজ্ঞেস করবে না কেমন আছি?

—আপনি ডাক্তার মানুষ নিশ্চয়ই খারাপ থাকবেন না।

—শারীরিক সুস্থতাই কি সব? মানসিক-আত্মীক সুস্থতা বলতেও কিছু আছে।

—ওহ্হ।

ভীষণ বিরক্তির সহিত বলে মেহরিমা। জাহান বুঝতে পারে তার বিরক্ত হওয়া। তাই সে বলে–

—তুমি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছো। আমি তাহলে রাখছি।

—আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।

কথাটা বলে দুম করে ফোনটা কেটে দেয় মেহরিমা। জাহান আস্তে ধীরে ফোনটা কান থেকে নামায়। মেহরিমার এমন ব্যবহার জাহানকে যে কতটা কষ্ট দিয়েছে যদি মেহরিমা তা জানত তাহলে হয়ত এমনটা কোনদিন করার সাহস করত না।

জাহান টেবিলের উপর হাত রেখে তার উপর মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে। বুকটা তার জ্বলছে, মাথা কেমন ব্লাঙ্কা হয়ে গিয়েছে। নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য ছোট একটা বিরতি না নিলেই নয় তার। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড়িয়ে বলে–

—কাউকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসতে নেই। যদি হয়েও যায় তাহলে নিজেকে প্রতিনিয়ত গুমরে মরার জন্য তৈরি করে নিতে হয়।

_______________________________

হায়া ও মেহরিমা ভাইবা দিয়ে বের হয় একসাথে। হায়া’র অনবরত তার মুখ চালালেও মেহরিমা চুপ করে আছে। কথা বলতে বলতে হায়া মেহরিমার চুপ থাকাটা খেয়াল করে। সে মেহরিমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে–

—কিরে? চুপ করে আছিস কেন? মুড অফ? বড় দা’ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে?

মেহরিমা বিরক্তি নিয়ে বলে–

—চুপ করে আছি তার মানে এই নয় যে, তোর ভাইয়ের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। সবসময় কথা বলতে ভালো লাগে না তাই চুপ করে আছি।

হায়া একটু স্তম্ভিত হয়ে যায় মেহরিমার এমন ঠাশ ঠাশ উত্তর শুনে। তার কাছেও মেহরিমার এমন ব্যবহার একদমই নতুন। হায়া নরম গলায় বলে–

—কি নিয়ে মন খারাপ বল না দোস্ত? আমি কি কোন ভাবে তোকে কষ্ট দিয়েছি? তাহলে সরি রে। তাও তুই এমন মুড অফ করে রাখিস না। আমার ভালো লাগে না তোর এমন চুপচাপ।

মেহরিমা তাদের ভার্সিটির মাঠের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসতে বসতে বলে–

—আমি তো চুপচাপই থাকি। এ আর নতুন কি?

—হ্যাঁ, কিন্তু এমনটা তো কখনো করিস নি।

—কেমনটা করছি?

হায়া বুঝতে পারছে মেহরিমা কোন বিষয় নিয়ে ডিস্টার্ব। তাই এখন কথা না বাড়ানোই ভালো হবে বলে সে মনে করছে। মেহরিমা কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে–

—আচ্ছা বাদ দে। আমার কথা শুন। আজ বিকালে তোকে আমার সাথে একটু বাহিরে যেতে হবে কিছু কেনাকাটা করবো তাই।

—হঠাৎ কেনাকাটা কিসের জন্য?

—আরে কাল আশিয়ানের জন্মদিন। তাই আমি ভেবেছি তাকে রাত বারোটায় বার্থডে উইশ করবো। আর নিজের মনের কথাও বলতে চাই তাকে৷ এজন্য সামান্য কিছু শপিং করা লাগবে।

—আচ্ছা।

আর টুকটাক কথা বলে মেহরিমা আর হায়া বাসায় চলে যায়।

বিকালে মেহরিমা হায়া’কে ফোন দিয়ে বলে তার মাথা ব্যথা থাকায় সে যেতে পারবে না। হায়া তার মাথা ব্যথা শুনে তার সাথে দেখা করতে যেতে চাইলে মেহরিমা বলে সে ঔষধ খেয়ে ঘুমাবো, তাই এখন যাতে হায়া না আসে। হায়াও তার কথা মেনে নেয়। সে আদিবা’র সাথে শপিংয়ে চলে যায়।

শপিংয়ে গিয়ে হায়া আশিয়ানের জন্য একটা ব্র্যান্ডেড ঘড়ি আর পারফিউম কিনে। তার ঘর সাজানোর জন্য কিছু সামগ্রী ও একটা ভ্যানিলা কেক অর্ডার দিয়ে সে আর আদিবা তাদের ভার্সিটির কাছের পার্কে যায় ফুচকা খেতে।

তারা দু’জন ফুচকা অর্ডার করে পাশে রাখা বেঞ্চে বসে পড়ে। হায়া আদিবাকে বলে–

—শুন, তুই কাল আমাদের বাড়ি আসবি। রাতটা সেখানেই থাকবি। আফিফ ভাইয়াকে আমি বলে রেখেছি উনাকে ডিনারের পর কোন একটা বাহানায় বাহিরে নিয়ে যাবেন আর বারোটার আগ পর্যন্ত নিজের সাথে রাখবেন। এই ফাকে আমি আর তুই আমাদের ঘরটা সাজিয়ে ফেলবো। বুঝেছিস?

—হ আমার মা। এখন অফ যা, ফুচকা এসেছে ফুচকা খেতে দে।

কথাটা বলেই আদিবা গপাগপ কয়েকটা ফুচকা নিজের মুখে ভরে দেয়। হায়া তার খাওয়া দেখে হেসে দেয়। তারপর নিজেও খেতে শুরু করে। খেতে খেতে আদিবার নজর যায় তাদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটাকে দেখতে তার কাছে মেহরিমার মতোই লাগে। আদিবা কনুই দিয়ে হায়া’কে গুঁতো দিয়ে বলে–

—দেখতো ঐটা মেহরিমা না? নাকি আমিই অন্য কারোর সাথে গুলিয়ে ফেলছি।

আদিবার কথা অনুযায়ী হায়া সেদিকে তাকালে দেখতে পায় আসলেই মেয়েটা মেহরিমা। কিন্তু ওর না মাথা ব্যথা আর ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে? তাহলে এখানে কি করছে? সবচেয়ে বেশি অবাক করার বিষয় হলো মেহরিমার সাথে একজন পুরুষও আছে। হায়া ও আদিবা তার মুখ দেখতে পায় না। শুধু পেছনের দিকটাই দেখে।

হায়া-আদিবা ফুচকার বিল দিয়ে মেহরিমার কাছে যেতে যেতে মেহরিমা লোকটির সাথে গাড়িতে বসে চলে যায়। হায়া মেহরিমাকে একজন পুরুষের সাথে গাড়িতে যেতে দেখে বেশ চিন্তিত হয়।

____________________________

—আসসালামু আলাইকুম বাবা। কেমন আছো?

—ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো আব্বু?

—আলহামদুলিলাহ ভালো। আম্মু কেমন আছে?

—সেও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।

পিতা-পুত্র স্বাভাবিক কুশলাদি বিনিময় করে। আরো কিছুক্ষণ পরিবারের কথা বার্তা বলে জাভিয়ান এবার আসল কথায় আসে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলা শুরু করে–

—বাবা মা যে সন্তানের কখনো খারাপ চায় না এটা নিশ্চয়ই তুমি জানো এবং মানো। আমি কি সঠিক বলছি জাহান?

—জ্বি বাবা। কিন্তু হঠাৎ একথা বললে যে?

বাবার কথা শুনে জাহানের কপালে ভাজ পড়ে। হঠাৎ এধরণের কথায় সে কিছুটা ভরকে গিয়েছে।

—কারণ হলো আমি ও তোমার আম্মু তোমাদের দুই ভাইয়ের জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবং আশা করি তোমরা সিদ্ধান্তটা শুনে আমাদের সাথে একমত হবে।

—অবশ্যই একমত হবো,কিন্তু সিদ্ধান্তটা কি বাবা?

—আমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর পাত্রী আমাদের অলরেডি পছন্দ করা হয়ে গিয়েছে।

বাবার থেকে এমন কথা শুনে জাহানের বুকটা জোরে ধক করে উঠে। কি বলছে তার বাবা এসব? তাদের বিয়ে দিবে ঠিক আছে তাই বলে তাদের না জানিয়ে পাত্রীও ঠিক করে ফেলেছে? তাদের দুই ভাইয়ের মনেই যে তাদের প্রেয়সীদের বাস এটা কি তারা জানে না? না, জানেই না তো। সে বা জায়িন কেউ তো জানায়নি তাদের ভালোবাসার মানুষগুলোর কথা তাদের পরিবারকে। ভেবেছিলো এই ক্যাম্প শেষ করেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাবা-মাকে প্রেয়সীর কথা জানাবে, কিন্তু তার আগেই যে এমন একটা খবর শুনতে হবে সে কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি।

—হ্যালো, জাহান শুনতে পারছো আমায়?

জাভিয়ানের কথায় জাহানের ধ্যাণ ভঙ হয়। সে বলে–

—জ্বি বাবা শুনতে পারছি।

—এ বিষয়ে তোমার মতামত কি? যতই আমরা নিজেরা পাত্রী পছন্দ করি, কিন্তু সংসার তো করবে তোমরা। তাই তোমাদের মতামত ব্যতীত আমরা কোন কথা আপতত আগাচ্ছি না।

জাভিয়ানের কথা শুনে জাহান ভাবে এটা, এটাই সুবর্ণ সুযোগ নিজের ভালোবাসার মনের কথা জানিয়ে দেওয়ার। সে বলে–

—বাবা তোমরা হয়ত জানো হয়ত বা জানো না, আমার ও জায়িন দু’জনই দু’জন রমনীকে মন দিয়ে বসে আছি। কথাটা তোমাদের জানাবো জানাবো করেও সঠিক সময় ও সুযোগের অভাবে জানানো হচ্ছিল না। কিন্তু আজ না জানিয়ে পারলাম না।

জাহানের কথা শুনে জাভিয়ান উচ্চস্বরে হেঁসে দেয়। সে জাহানের কাছ থেকে এই কথাটাই শুনতে চাইছিলো। তার ছেলেদের রিলেশনের কথা কিছুটা হলেও সে জানে। জায়িনেরটা তো সবার কাছে অপেন সিক্রেট, জাহানেরটাও তারা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো যে, তাদের এই গম্ভীর ও শান্ত স্বভাবের ছেলে টাও হয়ত কোন রমণীর ভালোবাসার নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা সে সিউর হয়েছে কিছুদিন আগে।

অন্যদিকে বাবার এমন হাসি শুনে জাহান কিছুটা লজ্জায় পায়। জাভিয়ান নিজের হাসি থামিয়ে বলে–

—তো এই কথাটা বলতে এতদিন লাগে? ভরসা ছিলো না আমাদের উপর? আমরা কি তোমাদের দুই ভাইয়ের ভালোবাসায় ভিলেন হতাম নাকি বোকা ছেলে?

লাস্টের কথাগুলো জাভিয়ান আফসোসের সুরে বলে। জাহান এমন কথা শুনে অনুতপ্ত হয়। আসলেই তাদের উচিত ছিলো বিষয়টা আরো আগে বাবা-মাকে জানিয়ে দেওয়ার। জাভিয়ান-হানিয়া ছেলে-মেয়েদের সাথে সবসময় বন্ধুর মতো মিশেছে। সবসময় ভরসা, স্নেহ, ভালোবাসার মানুষ হয়ে তাদের তিন ভাইয়ের পাশে থেকে তাদের বাবা-মা। সেই বাবা-মাকেই নিজেদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানাতে তারা বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছে।

জাহান মন খারাপ করে বলে–

—উই আর সরি বাবা। আসলে কিছু সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম।

—ইটস ওকে আব্বু। তা আমরা কিন্তু জানি আমাদের রাজকুমারদের মন কে চুরি করেছে।

কৌতুক পূর্ণ গলায় কথাটা বলে জাভিয়ান। জাহান অবাক হয়ে যায় জাভিয়ানের কথা শুনে। সে জিজ্ঞেস করে–

—কিভাবে জানলে বাবা? ওয়েট ওয়েট, পুতুল বলেছে নিশ্চয়ই?

—নো মাই সান। সে তার ভাইদের সব সিক্রেটের নিজের পেটেই তালা দিয়ে রেখেছে।

—তাহলে কিভাবে জানলে?

—সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো আমি জানতে পেরেছি, আমার ছোট রাজকুমারের মনে আমাদের আদিবা মামনি আর আমার বড় রাজকুমারের মনে রয়েছে…….

—কার সাথে কথা বলছেন হায়া’র বাবা?

হানিয়া’র প্রশ্নে জাভিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। তারপর বলে–

—জাহানের সাথে। কথা বলবে?

হানিয়া চঞ্চল পায়ে তার কাছে এসে ফোনটা হাতে নিতে নিতে বলে–

—তা আর বলতে। দাও দাও।

জাভিয়ান ফোনটা হানিয়ার কাছে দিয়ে দেয়। হানিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলের সাথে কথা বলতে। এই প্রথম ছেলেটা তাদের ছেড়ে এতদিন বাড়ির বাহিরে অবস্থান করছে। মায়ের মন তাই সবসময় ছটফট করে সন্তানের জন্য।

বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর জাভিয়ান ফোনটা নিজের কাছে নিয়ে লাউডস্পিকারে দিয়ে বলতে শুরু করে–

—তো যা বলছিলাম। তুমি কি বিয়েতে রাজি? দেখো আমাদের তো বয়স হচ্ছে বাবা। তোমাদের সন্তান দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাবো।

—হায়া’র বাবা।

—বাবা।

দুই দিক দিয়ে দু’জন ধমকে উঠে জাভিয়ানকে। জাভিয়ান তাদের ধমক শুনে হেঁসে দেয়। হাত বাড়িয়ে প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে নিজের বুকে টেনে নেয়। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–

—আহা রাগছো কেনো, কথার কথা বললাম তো।

—কথার কথাও বলবে না বাবা। তোমার কি এমন বয়স হয়েছে যে, এখনই এসব ভাবছো? জানে আজ ক্যাম্পে একজন বৃদ্ধ লোক এসেছিল। তার বয়স মিনিমাম ৮০/৮৫ হবে। তাও কি সুন্দর হেঁসে খেলে হাঁটছে। আর তুমি এই বয়সেই এসব বলছো? দ্যাট’স নট ফেয়ার বাবা।

—আচ্ছা সরি সরি। আর বলবো না। এবার আসল কথা বলো, তুমি কি বিয়েতে রাজি?

জাহান একটু ভেবে দেখে, সে যথেষ্ট সময় নিয়েছে আর মেহরিমাকেও দিয়েছে। এছাড়া মেহরিমাকে সে বলেছিলো তার সেকেন্ড ইয়ার কমপ্লিট হলে বাসায় তাদের কথা জানাবে। মেহরিমাও তখন নিরব সম্মতি দিয়েছিলো। তাই এখন আর মানা করার কোন প্রশ্নই আসে না। সে নির্দ্বিধায় বলে দেয়–

—তোমাদের কোন সমস্যা না থাকলে আমি রাজি আছি।

—আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কবে আসছো? আমি আর তোমার আম্মু চাচ্ছিলাম, এই মাসের শেষের দিকে তোমাদের বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করতে। সেই হিসেবে আর বেশিদিন বাকি নেই তুমি তো জানোই। ৫ দিনের মতো আছে। তা তুমি কি বলো এই ব্যাপারে?

—আমার আসতে আরো ৩/৪ দিন লাগবে। এই সপ্তাহেই আসতাম কিন্তু একজন কলিগ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আমাকে তার পরিবর্তে থাকতে হয়েছে। একজন ডাক্তার আসার কথা, সে না আসলে সময় বাড়তে পারে।

—ওহ্হ। তাহলে ডেট তো তাহলে পেছাতে হবে।

—ডেট পেছানো লাগবে না। তোমরা বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকো,আমি একদম বিয়ের দিন আগে এসে পৌছানোর চেষ্টা করবো।

—তুমি সিউর তো? তাড়াহুড়োর কোন দরকার নেই। তুমি আসলে পরেই না হয়…..

—সমস্যা হবে না বাবা। আই উইল ম্যানেজ।

—আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাদের মর্জি। এখন রাখছি তাহলে।

—আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।

—আল্লাহ হাফেজ।

জাহান ফোনটা কেটে “ইয়াহুউউউ” বলে একটা চিৎকার দেয়। তার চিৎকারের আওয়াজে তার কলিগরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। জাহান তাদের তাকানো দেখে বুঝতে পারে হেঁসে খুশিতে কেমন বাচ্চাদের মতো পাগলামি করে ফেলেছে। পরবর্তী সকলের কাছে সরিও চায়।

চলবে।