সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭+৫৮

0
4

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৫৫

হায়া রাহাকে বাসায় দিয়ে যাওয়ার পর আফরা রাহাকে কতক্ষণ বকেটকে তারপর নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। আফরার হাতে খাওয়ার সময় রাহার মুনতাহার কথা মনে পড়ে যায়। রাহা যখন অসুস্থ হতো তখন মুনতাহাও শুরুতে একটু বকাঝকা করে, এমনই ভাবে আফরার যত্ন করত। রাহা আফরার মাঝে মুনতাহাকে অনুভব করতে পারছে।

আফরা মুনতাহাকে খাইয়ে দেওয়ার পর এঁটো হাত ধুতে উঠে পড়ে। রুম ত্যাগ করার আগে কড়া গলায় বলে যায়–

—দুই মিনিটের মাঝে ঘুমানো চাই, নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

রাহা ভদ্র মেয়ের মতো শুয়ে পড়ে কিন্তু ঘুম পায় না। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। অস্থির অস্থির লাগছে। তাই সে শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। মুনতাহা হাত ধুয়ে এসে দেখে রাহা না ঘুমিয়ে কেমন ছটফট করছে। সে রাহার কাছে এসে বলে–

—কি হয়েছে? ঘুমাচ্ছো না কেনো?

রাহা তার গলা পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। তারপর বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে–

—ঘুম আসছে না তো আম্মু।

আফরা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে রাহার দিকে। রাহাও তার নজর সরায় না আফরার মুখ থেকে। রাহার এমন ঠোঁট উল্টে কথা বলতে দেখে আফরার আদিবাকে মনে পড়ে যায়। আদিবাও কথায় কথায় এমন ঠোঁট উল্টে বিভিন্ন আবদার করত। আদিবার সেসব আবদারে আফরা উপরে উপরে রাগ দেখালেও, মেয়ের আবদার পূরণ না করা পর্যন্ত সে শান্তি পেতো না। সেই আদরের মেয়ে আজ পরের বাড়ির বউ। চাইলেই মেয়েটাকে যখন তখন বুকে টেনে নেওয়া যায় না, কান টেনে শাসন করা যায় না। মাসে একবার হুটহাট করে এসে সারপ্রাইজ দিয়ে পরেরদিনই আবার চলে যায়। সবটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আফরার বুক চিঁড়ে।

আফরা দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে বেডে উঠে রাহাকে শুয়ে দিয়ে তার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে–

—এখন ঘুম আসবে। চোখ বন্ধ করো তাড়াতাড়ি।

রাহা আফরার এই কাজে বেশ চমকে যায়। সেই সাথে আপ্লূতও হয়। সে রাহার পেট জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। একটা সময় ঘুমিয়েও পড়ে। আফরা রাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেও এক সময় ঘুমিয়ে যায়। বাসায় আপাতত সে আর রাহা ছাড়া কেউ নেই। আফিফ গিয়েছে হসপিটাল আর আদিয়াত অফিসে। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নেওয়ার পর বছর পাঁচেক আগে একটা ছোট একটা বিজনেস শুরু করেছে। এই পাঁচ বছরে বেশ সফলতাও অর্জন করেছে।

________________________

ভার্সিটি থেকে মেহরিমার আসতে আসতে বেশ লেট হয়ে যায়। একটায় ক্লাস শেষ হয়েছে তার। মূলত রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাৃ থাকার কারণে লেট হয়েছে। সকালে জাহান তাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দেয় আর ক্লাস শেষে তার জন্য প্রতিদিন বাসা থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

স্বর্গীয় সুখের আবরণে ঢেকে গেছে মেহরিমার দিনগুলো। জীবনের যে শূন্যতাগুলো এতদিন অব্যক্ত থেকে গেছে, সেগুলো যেন ধীরে ধীরে ভরে উঠছে নিঃশব্দ আশ্বস্তিতে।
বাবা-মায়ের মতো স্নেহময় শ্বশুর-শাশুড়ি, মন-প্রাণ জুড়ে থাকা এক প্রেমিক সহচর, আর বড় ভাইয়ের মতো ছায়াসঙ্গী দেবর সব মিলিয়ে মেহরিমার জীবন যেন এক নিখুঁত ছবির ফ্রেমে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে।
অনুভূতিগুলো এখন আর হাহাকারে থেমে থাকে না, বরং ধীর লয়ে তারা পূর্ণতার সুরে গেয়ে যায় তার একান্ত স্বপ্নের গান।

মেহরিমা কলিংবেলে বাজাতেই দরজা খুলে দেয় হানিয়া। সে এতক্ষণ ড্রয়িংরুমে বসে বড় পুত্রবধূর জন্য অপেক্ষা করছিল। মেহরিমার আসতে দেরি হচ্ছিল বলে সে চিন্তা করছিলো। দরজা খুলে দিয়ে মেহরিমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মেহরিমা সালাম দিয়ে বাসায় ঢুকতেই হানিয়া তাকে বসিয়ে কিচেনে চলে যায় শরবত আনতে। লেবুর শরবতের গ্লাসটি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজে তার পাশে বসে বলে–

—আস্তে ধীরে সবটুকু খাবি। আর এত দেরি হলো যে? টেনশন হচ্ছিল তো আমার সোনা….

হানিয়ার বেশ স্নেহ করে পুত্র বধূদের। এত ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্নটি করায় না চাইতেও মেহরিমার চোখে পানি এসে পড়ে। এই আড়াই মাসে এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে তাও মেহরিমা নিজেকে সামলাতে পারে না। একটু আদরেই সে কেঁদে দেয়। জীবনের এতগুলো দিন আপনজনের ভালোবাসাহীন বড় হয়ে উঠেছে সে, তাই অল্পস্বল্প আদর, ভালোবাসায় কেদে দেয়। গ্লাস থেকে একটু শরবত খেয়ে আস্তে ধীরে বলে–

—আসলে রাস্তায় এত জ্যাম ছিল কি বলবো, মাঝে তো ভেবেছিলাম গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা দেই। কিন্তু ড্রাইভার আঙ্কেল নামতে দিলো না।

—ওহ্হ। আচ্ছা সমস্যা নেই। গায়ের ঘামটা শুকিয়ে ফ্রেশ হও যাও, আমি খাবার রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

—আচ্ছা। তোমরা খেয়েছো আম্মু?

—হ্যাঁ।

মেহরিমা বাকি শরবত টুকু শেষ করে উপরে নিজেদের রুমে চলে আসে। ভার্সিটির ব্যাগ পড়ার টেবিলে রেখে হিজাব খুলে ফ্যানটা ছেড়ে সোফায় বসে রেস্ট নিতে থাকে। বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি নামলেও গতকাল থেকে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ফ্যানের শীতল হাওয়ায় ক্লান্ত মেহরিমার কখন যে চোখ লেগে যায় সে টেরও পায় না।

ঘুরে ঘোরে কারো আলতো হাতের স্পর্শে মেহরিমার ঘুমটা ভেঙে যায়। মনহরণ করা চিরপরিচিত সুবাসটি নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করতেই তাকে স্পর্শ করা ব্যক্তিটিকে চিনে ফেলে মেহরিমা। ব্যক্তিটি খুবই সাবধানী ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হাতটি দ্বারা মেহরিমাকে নিজের বাহুতে তুলে নিয়ে বেডের দিকে হাঁটা দেয়। মেহরিমা বিষয়টি বুঝতে পেরে আরেকটু বেশি করে নিজের মাথাটা এলিয়ে দেয় পুরুষটির বুকে। পুরুষটি বুঝতে পেরে যায় তার রমণীর ঘুম ছুটে গিয়েছে। বিরক্ত হয় সে নিজের উপরই।

বউটাকে একটু ভালো করে শুয়ে দিতে গিয়ে ঘুমটাই ভাঙিয়ে দিলো। তাও সে বেডে নিয়ে গিয়ে শুয়ে দেয়। তারপর সরে আসতে চায় তার ব্যক্তিগত রমণীটির থেকে, কিন্তু রমণীটি তা করতে দেয় না। মেহরিমা হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তার পুরুষটির গলা যাতে সে তাকে ছেড়ে উঠতে না পারে। জাহান তার পাশে বসে ঝুঁকে আসে মেহরিমার দিকে। সময় ব্যয় ব্যতীত আলতো করে ভালোবাসার স্পর্শ দেয় প্রিয় নারীর ললাটে। নিজের ললাটে জাহানের উষ্ণ স্পর্শের অস্তিত্ব পেয়ে খানিক লজ্জা পায় মেহরিমা। কিন্তু সেই লজ্জাকে ছাপিয়ে যায় ভালোলাগার অনুভূতি টাকে।

সে চোখ বন্ধ রেখেই জাহানকে প্রশ্ন করে–

—আজ এই অবেলায় যে? যার দেখা রাত দশটার আগে পাওয়া যায় না সে আজ ভরদুপুরে বাসায় কি কারণে?

জাহান মেহরিমার প্রশ্ন শুনে হেঁসে উঠে। কিন্তু তার হাসির কোন আওয়াজ হয় না, বরাবরের মতো শব্দহীন সেই হাসি। জাহান মেহরিমার বেবি হেয়ার গুলো আঙ্গুল দিয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে–

—বুক চিনচিন করছে হায়, মন তোমায় কাছে চায়।

জাহানের এমন হঠাৎ গুনগুনিয়ে ওঠায় মেহরিমা ভয়াবহ রকমে চমকে যায়। সে জাহানের গলা থেকে হাত সরিয়ে এনে হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহরিমাকে এমন থমকে যেতে দেখে জাহান আবারও হেঁসে দেয়। কোন কথাবার্তা ছাড়াই বেডে উঠে বউয়ের বুকের উপর শুয়ে পড়ে। ক্ষীণ গলায় বলে–

—মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে একটু বউ? ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

মেহরিমা আর কোন প্রশ্ন ব্যতীত জাহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। মাঝে মধ্যে আবার হালকা করে চুলগুলো টেনে দিচ্ছে, ভীষণ আরাম বোধ করছে জাহান। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকার পর মেহরিমা জিজ্ঞেস করে–

—ফ্রেশ হবেন না? লাঞ্চ করেছেন?

—দু’টোর উত্তরই না। পরে হবে সব, এখন একটু ঘুমাবো।

—না। আগে ফ্রেশ হবেন, তারপর খেয়েদেয়ে ঘুম। উঠুন তাড়াতাড়ি।

—প্লিজ নাাা বউ। টায়ার্ড লাগছে ভীষণ……

বাচ্চাদের মতো জেদ করে কথাগুলো বলে জাহান। মেহরিমা জাহানকে ঠেলে উঠাতে উঠাতে বলে–

—একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার হয়ে এমন জেদ মানায় আপনাকে? বাহির থেকে এসেছেন কত জীবাণু আছো শরীরে। উঠুন,ফ্রেশ হবেন। আপনি আগে যান,আপনি ফ্রেশ হয়ে বের হলে নি যাবো।

মেহরিমার ঠেলাঠেলিতে জাহান উঠে তো বসে ঠিকই কিন্তু তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলা করছে। সে ভদ্রলোকের মতো শোয়া থেকে দাঁড়ায়। মেহরিমাও শোয়া থেকে উঠে বসেছে ততক্ষণে তারপর কোন আগাম বার্তা ছাড়াই মেহরিমাকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে দিকে হাঁটা দেয়। মেহরিমা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে–

—কি হলো আবার? আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো?

—আমি তোমার কথা শুনলাম, এখন তুমি আমার কথা শুনো। চুপচাপ চলো।

মেহরিমা জানে জাহান কেমন জেদি, তাই আর কথা বাড়ায় না। লোকটার সঙ্গ যে সেও বেশ উপভোগ করে। এতদিনে তার ভাগ্যের সবটুকু সুখ তার দরজায় এসে উপস্থিত হয়েছে। মেহরিমা কি করে সেই সুখকে ফিরিয়ে দিবে, তাই তো সবটুকু সুখ সাদরে গ্রহণ করছে।

_______________________

রাহার ঘুম ভাঙে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে। সেই একটায় এসে ঘুমিয়েছে আর উঠল সাড়ে পাঁচটায় তাও শ্বাশুড়ি মায়ের ডাকে। কিন্তু এতক্ষণ ঘুমানোর পরও তার তন্দ্রা ভাবটা কাটছে না। সে ঘুমে ঢুলুঢুলু পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে আসে। আগে নামাজ না পড়লেও বিয়ের পর থেকে আফিফ ও তার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির প্রচেষ্টায় রাহা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে এখন।

ওয়াশরুমে ঢুকেই সে আফিফের বডি স্প্রে’র গন্ধ পায়। কিন্তু রুমে বা বেলকনিতে কোথাও তার জামাকাপড় দেখতে পায়নি সে। রাহা আসরের নামাজ পড়ে কতক্ষণ বেলকনিতে৷ আনমনে বসে বসে ভাবতে থাকে আফিফের কথা। ইদানীং এটাই তার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফিফকে নিয়ে সে বরাবরই বড্ড বেশি ভালোবাসে।

মাগরিবের আজান দিতেই নামাজ পড়ে নিচে চলে যায়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে একসাথে বসে হালকা চা-নাশতা করে উপরে রুমে চলে আসে। হঠাৎই তার গা গুলিয়ে বমি চলে আসে। দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বৃি করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ লাগিয়ে পেটের সব বের করে ক্লান্ত হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই ধপ করে শুয়ে পড়ে। একটু শুয়ে থাকার পর তার খানিকটা ভালো লাগলে শোয়া থেকে উঠে বই-পুস্তক নিয়ে বসে। বই-খাতা নিয়ে বসে তো ঠিকই কিন্তু পড়া হয় না তেমন কিছুই। ঘুম ঢুলতে থাকে। সে বুঝে উঠতে পারছে না ইদানীং তার এত ঘুম আর বমি বমি পায় কেনো।

এশারের পর কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। আফরা জোর করলে বলে আফিফ এলে তারা দু’জন একসাথে খেয়ে নিবে। আফরা আর কিছু বলে না। রাত বারোটার দিকে কারো ধাক্কাধাক্কিতে রাহার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তাকালে আফিফকে দেখতে পায় নিজের মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখে হালকা হাসি। রাহা আফিফকে দেখে একটু চমকে যায়। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেলে দু’জনের মাথার একে অপরের সাথে বা”’রি খায়। আফিফ “আঃ” করে মাথা ধরে খানিকটা পিছিয়ে গেলে রাহা নিজের ব্যথা ভুলে গিয়ে তার জন্য অস্থির হয়ে যায়। আফিফের ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলে–

—সরি সরি। আসলে আমি হুট করে আপনাকে দেখে একটু চমকে গিয়েছিলাম। বেশি ব্যথা পেয়েছেন? দেখি হাত সরান।

আফিফ হালকা হেঁসে বলে–

—তেমন ব্যথা পাইনি। তুমি এত অস্থির হয়ো না তো।

আজ অনেকগুলো দিন পর রাহা আফিফের মুখে হাসি দেখল। সদা হাস্যোজ্জ্বল আফিফ ইদানীং মুখটা গম্ভীর করে রাখত। তার মুখের সেই হাসিখানা রাহা অনেক মিস করছিল।

রাহা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে আফিফের দিকে। আফিফ কিউট করে বলে–

—রাহা, ছাঁদে যাবে?

রাহা তার দিকে তাকিয়ে থেকেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। তার সম্মতি পেয়ে আফিফ তার ডান হাত রাহার দিকে বাড়িয়ে দেয়। রাহা একবার আফিফের দিকে আরেকবার তার বাড়ন্ত হাতের দিকে তাকায়। আফিফ তাকে নিজের হাতের উপর হাত দিতে না দেখে, বলে উঠে–

—কি যাবে না? ভরসা নেই আমার উপর?

ভরসা? রাহা তো তার বাবার পর একমাত্র আফিফকেই চোখ বন্ধ করে ভরসা করে। রাহা আসলে একটু চমকে গিয়েছিলো আফিফকে হাত বাড়িয়ে দিতে।

রাহা যখন এই প্রশ্নটিরও উত্তর দেয় না তখন আফিফের মন খারাপ হয়ে যায়। সে মুখটা মলিন করে নিয়ে তার হাতটা সরিয়ে আনতে নিলে রাহা তার হাতের উপর নিজের হাত দেয়। আফিফ চমকে তার দিকে তাকালে রাহা বলে–

—পাপার পর আপনাকে আমি চোখ বন্ধ করে ভরসা করি আফিফ।

রাহার কথাটা শুনে আফিফের মুখে পুনরায় হাসি ফুটে ওঠে। সে রাহার হাত ধরে ছাদে নিয়ে যেতে থাকে।ছাঁদের সিঁড়ির মাঝামাঝিতে আসতেই আফিফ হাঁটা থামিয়ে দিয়ে রাহার পেছনে গিয়ে তার চোখ একটা কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়। রাহা চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে–

—আফিফ, চোখ বাঁধলেন কেনো? আমি হাঁটবো কিভাবে এখন?

আফিফ তার মুখটা রাহার কানের কাছে নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে–

—আমি আছি না, তোমার ডাক্তার সাহেব।

কথাটা বলেই আফিফ ঝট করে রাহাকে কোলে তুলে নেয়। তারপর রাহাকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজে কোথায় যেনো চলে যায়। রাহা আফিফের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তাকে ডেকে উঠে, কিন্তু আফিফ তাতেও সাড়া দেয় না। রাহা খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়ে চোখের বাঁধনটা খুলে ফেলে। আর সাথে সাথেই একঝাক আলো এসে তার চোখে লাগে। রাহা নিজের চোখটা আবার বন্ধ করে নিয়ে পুনরায় আস্তে আস্তে পিটপিট করে তাকায়।

যখন তার চোখ আলো টাকে সহ্য করে নেয় তখন সে আশেপাশের পরিবেশ দেখে ভয়াবহ রকমের চমকে যায়। কেনো? কারণ তাদের ছাদটা অনেক সুন্দর করে লাইটস ও বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। এছাড়া আরে একটি কারণে রাহা চমকে গিয়েছে আর তা হলো, আফিফ এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে রাহা সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। রাহা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালে আফিফ বলতে শুরু করে–

—আমি জানি না, ঠিক কিভাবে বললে আমার হৃদয়ের অনুভূতি গুলো বুঝবে। শুনেছি, এই লাল গোলাপ দিয়ে প্রেয়সীর সামনে হাঁটু গেড়ে “আমি তোমায় ভালোবাসি” বললে নাকি ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়। আসলে সারাজীবন সিঙ্গেল কমিটির একজন দায়িত্ববান সদস্য ছিলাম তো তাই এসব বিষয়ে আমি একদমই কাঁচা।

আমি জানি তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাইছি। তাও তুমি যাতে কখনো অভিযোগ করতে না পারো তাই স্পষ্ট করে বলছি, আই লাভ ইউ রাহা। আই লাভ ইউ সো মাচ। উইল ইউ বি মাই সোলমেট।

রাহা অবাক হয়ে ছলছল চোখে তার আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁট গুলো কাঁপছে। নাকের পাটা একটু একটু করে ফুলে উঠছে। যেকোন সময় কেঁদে দিতে পারে সে।

—কি হলো বলে রাহা? চুপ থেকো না আজ। তুমি হবে আমার প্রেয়সী? আমার রাতজাগার সঙ্গী? হবে তুমি?

রাহা কাঁপা কাঁপা গলায় সম্মতি দিতে যাবে তার আগেই তার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে আফিফ ঝট করে এসে তাঁকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে ধরে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে রাহা।

শব্দসংখ্যা-২০০০
~চলবে?

[ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স ]

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৫৬

আফিফ রাহাকে নিজের বাহুতে আগলে নিয়ে নিচে বসে যায়। রাহার গালে আলতো হাতে চাপড় মারতে মারতে অস্থির গলায় বলতে থাকে–

—রাহা, এই সোনা পাখি, কি হলো তোমার? চোখ খুলো।

ততক্ষণে সেখানে আদিয়াত ও আফরাও উপস্থিত হয়। মূলত তারা দু’জন কেক আনার বাহানায় একটু লেট করে আসে যাতে তাদের ছেলে সবার প্রথম নিজের বউকে বার্থডে উইশ করতে পারে। কি বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে এখানে? তাহলে শুনতে হবে আজ দুপুর থেকে ঘটা কিছু ঘটনা।

হ্যাঁ, আজ রাহার বাইশতম জন্মদিন। দুপুরের দিকে রাহাত আফিফকে ফোন দিয়ে আগামীকাল তাদের বাসায় যেতে বলে। আফিফ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তখন রাহাত জানায় কাল রাহার জন্মদিন। তারা দু’জনই চান প্রতিবারের মতো এবারও মেয়েটার বার্থডে সেলিব্রিট করতে। আফিফ এটা শুনে চমকে যায় যে, কাল রাহা জন্মদিন। সে রাহাতকে কাল চৌধুরী নিবাসে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ফোনটা কেটে আফিফ ভাবতে থাকে বিয়ের পর প্রথম সে শ্বশুর বাড়ি যাবে, সেই উপলক্ষে শ্বশুর বাড়ির সকলের জন্য কিছু গিফটস না নিলে বিষয়টা খুবই খারাপ দেখায়। সে যেহেতু রাহাত, মুনতাহা ও রায়হানের পছন্দ কেমন সেই বিষয়ে কিছুই জানে না তাই ঠিক করে রাহাকে ভার্সিটি থেকে পিক করে প্রথমে তারা লাঞ্চ করবে। তারপর দুপুরের রোদটা একটু পরে গেলে বিকেলের দিকে কেনাকাটা করে সন্ধ্যায় একেবারে বাসায় ফিরবে।

এছাড়াও আরেকদিন রাহাকে তার চরিত্র সম্পর্কে কটুক্তি করে সে ভীষণ অপরাধবোধ করছিল। তারপর থেকে তাদের সম্পর্কে চোখে পড়ার মতো শীতলতা এসে যায়। ঐ বিষয়টার জন্যও রাহাকে কাছে ক্ষমা চাওয়ার একটা বাহানা খুঁজছিল আফিফ। আজ লাঞ্চে যাওয়ার বাহানায় এই কাজটাও করে নেওয়া যাবে। এসব ভেবেই সে আজ দুপুরে ভার্সিটিতে যায়। ভার্সিটিতে গিয়ে অনেকবার করে রাহার নাম্বারে কল দিলেও যখন রাহা ফোন ধরে না, তখন আফিফ রাহার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তার এক ক্লাসমেটের কাছে তার কথা জিজ্ঞেস করে। যাকে জিজ্ঞেস করে সে বলে দেয় রাহাকে লাস্ট কোথায় দেখেছিল। আফিফ তার বলে দেওয়া ডিরেকশন অনুযায়ী সেই মাঠের পাশের নিরব জায়গাটায় চলে যায়।

সেখানে গিয়ে সে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সত্যি কথাগুলো জেনে যায়। রাহা কান্না করে হায়া ও মেহরিমাকে বলা সবগুলো কথা শুনে সে আরো অপরাধবোধ করতে থাকে, সেই সাথে অনুশোচনা হয় এটা ভেবে সেদিন তাদের অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কাছে এসে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে আগে কেন খোলাখুলি ভাবে কথা বললো না। বিষয়টা তাদের অজান্তেই তারাই অনেক জটিল করে ফেলেছে। আফিফ তখনই ঠিক করে নেয় আজই সে তার মনের কথা রাহাকে জানিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যকার সকল ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নিবে। তাই সে রাহার সাথে দেখা না করেই চলে যায়। হসপিটালে তেমন কাজের চাপ না থাকায় আজকের দিনটা তো ছুটি নিয়েছিলোই সেই সাথে আরো এক্সট্রা কয়েকদিনের ছুটিও নিয়ে নেয়।

আফিফ নিজেই একা একা শপিংমলে গিয়ে ছাঁদ সাজানোর জন্য সব জিনিস নিয়ে বাসায় আসে বিকেলে, যখন রাহা আর আফরা ঘুমাচ্ছিলো। সে রুমে এসে খুবই আস্তেধীরেই ফ্রেশ হয় তাও আফরা উঠে যায়। তখন সে আফরাকে রাহার বার্থডের বিষয়টা বললে আফরা বলে সে রাহার জন্য নিজের হাতে কেক বানাবে। আদিয়াতও ততক্ষণে এসে পড়েছিল। সে বলে সে আফিফকে ছাঁদ সাজাতে সাহায্য করবে। ব্যস, তারা তিনজন রাহাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার মিশনে লেগে পড়ে।

রাহা সন্ধ্যার পর রুমে চলে আসলে আফরা তার জন্য কেক বানানোর কাজ শুরু করে দেয়। তার আফিফ ও আদিয়াত তো বিকেলের পরপর দিয়েই কাজে লেগে পড়েছিল। তাদের কাজটা আরে সহজ করে দেয় রাহা নিজেই। সে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ায় আফিফ, আফরা ও আদিয়াতের সবটা করতে বেশ সুবিধাই হয়।

এবার গল্পে ফেরা যাক।

আদিয়াত ও আফরা ছাঁদে এসে দেখে আফিফ নিচে বসে আছে রাহাকে কোলে নিয়ে, আর রাহা জ্ঞানহীন হয়ে রয়েছে। তারা দু’জন দ্রুত পা চালিয়ে তাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়। আফরা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে–

—আফিফ, রাহার কি হয়েছে? অজ্ঞান হয়ে গেলো কেনো?

আফিফ বলে–

—জানি না আম্মু। হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে গেলো। রাহা এই, উঠো না! (রাহাকে ডাকতে ডাকতে বলে)

বোকা ছেলে নিজে ডাক্তার হয়ে, কোনরূপ ট্রিটমেন্ট না করিয়ে ডেকে ডেকে বউয়ের হুঁশ ফেরাতে চাইছে। আসলে আমরা সকলেই প্রিয় মানুষটির অসুস্থতায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আফিফের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

আদিয়াত বলে উঠে–

—আফিফ, রাহা মামুনিকে ঘরে নিয়ে চলো। সেখানে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি আমরা। যদি তাতে কাজ না হয় তাহলে হসপিটালে নিয়ে যাবো নে।

আফিফ বাবার নির্দেশনা মতো কাজ করে। সে রাহাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে আসে। রুমে এসে সে রাহাকে বেডে শুয়ে দেয়। তারপর তার চোখেমুখে কয়েকবার করে পানি ছিটিয়ে দেয়। আফরা রাহার হাত-পা মালিশ করছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

আফিফ চঞ্চল পায়ে হেঁটে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে তার স্টেথোস্কোপ ও স্ফিগমোম্যানোমিটার নিয়ে এসে রাহার পাশে বসে পড়ে। প্রথমে স্ফিগমোম্যানোমিটার দিয়ে প্রেশার মাপে। তারপর স্টেথোস্কোপ দিয়ে হার্টবিট। সবশেষে রাহার পালস চেক করলে সে থমকে যায়। বার কয়েক ঢোক গিলতে থাকে।

এরই মাঝে পিটপিট করে চোখ খুলতে থাকে রাহা। আফরা তাকে চোখ খুলতে দেখে বলে–

—আফিফ রাহা চোখ খুলে তাকিয়েছে।

মায়ের কথায় আফিফের ঘোর ফিরে। সে রাহাকে বলে–

—এখন কেমন লাগছে তোমার? শরীর বেশি খারাপ লাগছে কি?

রাহা ক্ষীণ গলায় বলে–

—মাথা কেমন ঘুরাচ্ছে আর গা গোলাচ্ছে। এছাড়া আর কোন সমস্যা হচ্ছে না।

—আচ্ছা। উঠো, ডিনার করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আদিয়াত আফিফকে জিজ্ঞেস করে–

—আফিফ কি বুঝলে? রাহা মামনি হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে গেলো কেনো?

আফিফ থমথমে গলায় বলে–

—খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করে না তাই প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিল। এখন কিছু খেলেই আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।

কথাটা বলতে বলতে আফিফ আলতো হাতে রাহাকে উঠিয়ে বসায়। তারপর তার পিঠের পেছনে একটা বালিশ দিয়ে তাঁকে আধশোয়া করে বসায়। আফরা বলে–

—তোদের নিচে যেতে হবে না কষ্ট করে। আমি খাবার দিয়ে যাচ্ছি তোদের দুইজনের জন্য। আর রাহাকে না হয় আমি খাইয়ে দিয়ে গেলাম।

—আমি খাইয়ে দিবো নে। তোমরা গিয়ে শুয়ে পড়ো।

আফরা জানে তার ছেলে কতটা দায়িত্ববান তাই আর কিছু বলে না। আদিয়াত ও আফরা রুম থেকে বের হয়ে আসার আগে রাহাকে তার বার্থডে উইশ করে। তারপর তারা দু’জন একটা গিফটও দেয় তাঁকে। রাহা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির থেকে এত আদর-ভালোবাসা পেয়ে আপ্লূত হয়ে যায়।

তারা দু’জন চলে যাওয়া পর আফিফ থমথমে মুখে রাহাকে খাইয়ে দিতে থাকে। রাহা এক ধ্যানে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগের আফিফ আর এই আফিফের মধ্যে বিস্তর ফারাক। কি সুন্দর করে তাকে ঘুম থেকে তুললো, ছাঁদে নিয়ে গেলো হাত ধরে। তারপর….তারপরের কথা স্মরণ করে রাহার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে যায়। আফিফ রাহাকে প্রপোজ করেছিলো।

—ডাক্তার সাহেব, আপনি আমাকে কি সত্যিই ভালোবাসেন?

রাহার প্রশ্নটা শুনে আফিফের চলন্ত হাতটা থেমে যায়। তাদের মধ্যে নিরবতা এসে ঠায় নেয়। রাহা হাপুস নয়নে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য, কিন্তু আফিফ তাঁকে হতাশ করে দিয়ে বলে–

—খাওয়ার সময় এত কথা বলতে নেই, চুপচাপ খাও।

শেষের কথাটা একটু ধমকের সুরেই বলে। রাহা ছলছল নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আফিফ রাহাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়। রাহা ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে, কিন্তু ঘুমায় নি। চোখবুঁজে শুয়ে আছে।

আফিফ খাওয়া শেষ করে ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর লাইট নিভিয়ে দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। নিস্তব্ধতা মুড়িয়ে রাখা তাদের রুমে শুধু সিলিংয়ে চলতে থাকা ফ্যানের আওয়াজ ও ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার টিকটিক আওয়াজ ব্যতীত আর কোন শব্দই শোনা যায় না। সময় গড়িয়ে যেতে থাকে আপন নিয়মে। সেই সাথে এক দুই ফোটা করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে আফিফের চোখের কোন বেয়ে। আফিফ অনুভব করে তার পাশে শুয়ে থাকা রমণীটিও তারই মতো নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছে।

আফিফ না হয় কাঁদছে অনাকাঙ্ক্ষিত কারো একজনের আগমনী বার্তায়, কিন্তু তার পাশে শুয়ে থাকা রমণীটি কাঁদছে কেনো? সে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায় নি বলে? নাকি তখনকার সেই প্রশ্নের উত্তর দেয় নি বলে? নাকি সেদিন তার চরিত্র নিয়ে কথা বলার জন্য? কোনটার জন্য রমণীটি এমনভাবে কাঁদছে? নিজের অজান্তেই সে এই মেয়েটিকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।

আফিফ আস্তে আস্তে তার দিকে ফিরে শোয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়াই রাহাকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। রাহা আফিফের এমন কাজে চমকে যায়। সে ভাবে হয়ত ঘুমের ঘোরে এমনটা করেছে। কিন্তু তার ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে, আফিফ বলে উঠে–

—আই লাভ ইউ সোনা পাখি, লাভ ইউ সো মাচ।

রাহার এতক্ষণের শব্দবিহীন কান্না এখন আর্তনাদে রূপ নেয়। বেশ শব্দ করে কাঁদতে থাকে সে। আফিফ তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রাহাও তাকে নিজের শরীরে সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে, যেন ছাড়লেই আফিফকে হারিয়ে ফেলবে। আফিফ অনেক কষ্ট করে তার কান্না থামায়। কত-শত ওয়াদা করে বউয়ের কাছে। তাকে ভালোবাসার, ভালো রাখার, তার চোখ থেকে কখনোই অশ্রু নামক মূল্যবান সম্পদ না ঝরানোর।
রাহাকে বুকে নিয়েই ঘুমায়। ঘুমানোর আগে ভেবে নেয় কাল সকাল হতেই তার কি কি করা লাগবে।

______________________

হায়া ঘুমের মধ্যেই টের পায় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, সেই সাথে শরীরটাও কেমন ভারী ভারী লাগছে। ভীষণ ছটফট করতে করতে একসময় ধপ করে চোখ খুলে ফেলে। চোখ খুলে দেখতে পায় তার গুনধর বর মশাই তার ঘুমের ফয়দা নিচ্ছে। হায়া মোচড়ামুচড়ি করায় আশিয়ান তার ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে হায়ার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।

হায়ার বড়বড় শ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল আরেকটু হলেই রুহটা বের হয়ে যেতো। হায়া ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালে দেখে অন্ধকার হয়নি এখনও। আজ আশিয়ান তাড়াতাড়িই চলে এসেছে। সে জানালার থেকে চোখ সরিয়ে এনে আশিয়ানের দিকে তাকালে দেখতে পায় তার অসভ্য মামা প্লাস ফুফাতো ভাই তারই বুকের উপর থুতনি ঠেকিয়ে টুকুর টুকুর করে তাকিয়ে আছে। শরীরে এখনও বাহিরের জামাকাপড়। হঠাৎই হায়া রেগেমেগে উঠে। সে আশিয়ানকে নিজের উপর থেকে সরাতে সরাতে বলে–

—সরুন তো। সবসময় চিপকাচিপকি না করলে ভালো লাগে না?

—না, লাগে না। বিয়েটা করেছি যাতে হালাল হয়ে এমন সারাক্ষণ চিপকে থাকতে পারি। এখন নো সরা-সরি অনলি চিপকাচিপকি। আজ না বলে এসে পড়েছো কেনে বাসায়? তাই এর শাস্তি পাবে এখন। এখন এমন চিপে অন্তত দুই ঘন্টা শুয়ে থাকব।

কথাটা বলে আশিয়ান তার শক্তি লাগিয়ে হায়ার সাথে আরেকটু লেগে যায়। হায়া খেঁকিয়ে বলে–

—আজব তো ভাই!

আশিয়ান হায়ার মুখে ভাই কথাটা সহ্যই করতে পারে না। কেমন কেমন লাগে তার। সে ধমকে বলে–

—চুপ বেয়াদব, জামাইকে ভাই ডাকে কে? জামাই ডাকো।

হায়া তার ধমকে একটু ঘাবড়ে যায় ঠিকই কিন্তু দমে না। সে মুখ ভেঙচিয়ে বলে–

—এহ্হ যত্তসব ঢং। ভুলে যাবেন না এককালে আমরা মামাতো-ফুফাতো ভাইবোন ছিলাম। সেই সম্পর্কের জেরে মাঝেমধ্যে ভাই ডাকতেই পারি।

—না পারো না।

—পারি।

—পারো না।

—বললাম তো পারি।

—পারো।

—না, পারি না।

আশিয়ান হায়াকে তার নিজের কথায় ফাঁ”সিয়ে দেয়। হায়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে জিভ কাটে। তারপর আশিয়ানের দিকে তাকালে দেখতে পায় সে নিজের সবগুলো ঝকঝকে ফকফকে দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে।

হায়া আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিবে তখনই তাদের দরজায় কেউ একজন নক করে। আশিয়ান গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে–

—কে?

একটি নারী কণ্ঠ বলে–

—আশিয়ান বাবা, আপনাগো দুইজনরে নিচে যাইতে কইছে আফা।

—আচ্ছা, যান আপনি খালা আমরা আসছি।

হেল্পিং হ্যান্ড মহিলাটি চলে যায়। আশিয়ান হায়ার উপর থেকে সরে আসে। তারপর নিজের জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।

~চলবে?

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৫৭

আশিয়ান ফ্রেশ হয়ে বের তারা দু’জন নিচে নেমে আসে। ড্রয়িংরুমে প্রতিদিনকার ন্যায় আজও শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে সন্ধ্যার নাস্তার পর্ব সাড়ে হায়া। যদিও অন্যান্য দিনের থেকে একটু ব্যতিক্রম রয়েছে। আজ আশিয়ান বিকালেই চলে এসেছে। হায়া খেয়াল করে আবরার কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে আছে। কখনো একধ্যানে চায়ের কাপ টার দিকে তাকিয়ে আছে তো, কখনো বড় বড় করে শ্বাস ফেলছে। তার এই শ্বাসের সাথে কত হতাশা ও ক্লান্তি মন থেকে বের করে দিতে চাইছে সে, সেটা হায়ার বুঝতে বাকি থাকে না।

হায়া না পারতে জিজ্ঞেসই করে ফেলে–

—বাবাই, কি হয়েছে তোমার? আজ তোমাকে এমন লাগছে কেনো? টেনসড লাগছে তোমায়।

হায়ার হঠাৎ প্রশ্নে আবরার খানিকটা হকচকিয়ে যায়। আশিয়ানও বাবার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে। স্পর্শের বুঝতে বাকি থাকে না আবরার কি নিয়ে চিন্তায় বিভোর। আবরার হায়ার প্রশ্নের কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে হায়া আবারও একই প্রশ্ন করে উঠে। হায়ার বারবার জিজ্ঞেস করায় আবরার বলেই দেয়–

—আশিয়ানের দাদাভাই অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে কাল তাকে।

আবরারের কথাটা শুনে হায়া ও আশিয়ান দু’জনই বেশ চমকে যায়। বিশেষ করে আশিয়ান। তার দাদাভাই অসুস্থ বিষয়টা আজই সে জানতে পারল। হায়া অস্থির গলায় সুধায়–

—কি হয়েছে নানাভাইয়ের বাবাই? পরশুও তো কথা বললাম, তখন তো মনে হলো না হসপিটালে ভর্তি করানোর মতো এত অসুস্থ।

—কাল ফজরের সময় অজু করতে গিয়ে ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে বাম পায়ে চোট পেয়েছে। তোমার নানুমনি ওয়াশরুম থেকে জোড়ালো আওয়াজ পেয়ে গিয়ে দেখেন বাবার এই অবস্থা। জানোই তো, একজন কেয়ার টেকারের তত্ত্বাবধানে তারা থাকেন। সেই লোকটিও কাল ছুটিতে নিজের বাড়িতে গিয়েছিল। তোমার নানুমনি পাশের বাড়ির রহিম চাচাদের সহায়তায় তোমার নানাভাইকে হসপিটালে নিয়ে যায়। পা’টা ভেঙে না গেলেও অনেকটা সেই পর্যায়েই চলে গিয়েছে। সেই সাথে নাকি হার্টের ব্যথাও বেড়েছে। আমাদের গ্রামে সবচেয়ে উন্নত হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় আমার নির্দেশে কিন্তু সেখানকার চিকিৎসা শহরের মতো এতটা উন্নত হয়নি। ডাক্তাররা বলেছেন, ঢাকায় এনে অন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করাতে, নাহলে থার্ড টাইম হার্ট অ্যাটাক হতে পারে যেকোন সময়।

শেষের কথাটা বলতে বলতে আবরারের গলা ধরে আসে। একসময় তার বাবা তাকে আর তার বোনকে সীমাহীন কষ্টের সাগরে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে বাবা হয়ে বুঝতে পারছে, বাবা শব্দটা অর্থ কি। খারাপ হোক, ভালো হোক, সুস্থ হোক, অসুস্থ হোক বাবা বেঁচে আছেন এটাই সন্তানদের জন্য অনেক বড় কিছু। বাবারা তো সেই বটগাছের মতো, যে নিজে সূর্যের প্রখর তাপে শুকিয়ে যেতে প্রস্তুত কিন্তু তার ছায়াতলে থাকা অন্যদের বিন্দু মাত্র কষ্ট দিতে রাজি না।

আশিয়ান বেশ চিন্তিত হয়ে যায় তার দাদাভাইয়ের শরীরের কন্ডিশন শুনে। সে উৎকণ্ঠিত গলায় বলে–

—তাহলে বাবা দাদাভাইকে ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছো না কেনো? এভাবে হেলায় রেখে দিলে পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে যাবে যে।

আবরার এবার বেশ রেগে গিয়েই বলে–

—তুমি জানো না কেন ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করছি না?

বাবার হঠাৎ রাগ দেখে আশিয়ান চমকে যায়। কিন্তু সেই সাথে এটাও মনে পড়ে যায় কেন তার বাবা তার দাদাকে ঢাকায় আনছে না। মূলত মি.মির্জার একটা জেদের কারণেই তাকে ঢাকায় আনা যাচ্ছে না। হায়াকে বিয়ের আসরে রেখে আশিয়ানের লন্ডনে চলে যাওয়ায় মি.মির্জা ভীষণ কষ্ট পায়। বিয়ে করবে না সেটা আশিয়ান নিজেই বলতে পারত তাকে, সে না হয় তার ছেলেকে বুঝাত বিষয়টা। কিন্তু এভাবে একটা মেয়েকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা কতটা ঘৃণ্য একটা কাজ সেটা আশিয়ান তখন অনুভব করতে পারে নি। আশিয়ান চলে যাওয়ায় সবাই যখন হায়াকে নানান লথা শোনাচ্ছিল, তখন হায়া বেশ ভেঙে পড়ে।

চঞ্চল, উড়ন্ত পাখিটা প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়ে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন প্রিয় নাতনীর এমন অবস্থার জন্য মি. মির্জা নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করে। এদিকে মেয়ের এমন অবস্থা দেখে জাভিয়ানও হার্ট অ্যাটাক করে বসে। করতে চাইল সকলের ভালো, ভালো তো কিছুই হলো না বরংচ মেয়ের স্বামী ও সন্তানের জীবন নিয়ে টানাটানি লেগে গেলো। এসব সহ্য করতে না পেরে মি.মির্জাও হার্ট অ্যাটাক করে বসেন। কি দুর্বিষহ ছিল সেই দিনগুলো! হায়া নিজের শোক ভুলে গিয়ে পরিবারের দিকে নজর দেয়। একজনের দেওয়া কষ্টে জন্য সে তার অন্য ভালোবাসার মানুষগুলোকে অপরাধী বানিয়ে ফেলছে। বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরে হায়া আশিয়ানের কথা ভুলে যেতে চায়। কিন্তু প্রথম অনুভূতির জোগানদাতাকে কি এতই সহজ?

হায়া তার পরিবারের জন্য আস্তে আস্তে আগের মতো হয়ে যায়। হায়াকে স্বাভাবিক হতে দেখে সকলের মন থেকে দুঃশ্চিতার বোঝা কিছুটা কমে,কিন্তু পুরোপুরি যায় না। জাভিয়ানের শরীর হার্ট অ্যাটাকের ধাক্কা সয়ে গেলেও, বৃদ্ধ মির্জা সাহেব প্রায় এক বছরের মতো অসুস্থ ছিলেন। এরপর কিছুটা সুস্থ হতেই সে এক অদ্ভুত জেদ ধরে। সে জানায়, নিজের জীবনের বাকিটা সময় তিনি তার পৈতৃক ভিটায় কাটাতে চায়। সকলে এক বাক্যে মানা করে দেয় তাকে। মানা করবেই না কেনো? গ্রামের বাড়িতে তাদের তেমন কোন আত্মীয়ই তখন থাকে না। তারা হয় বেশিরভাগ ঢাকায় চলে এসেছে, নাহয় অন্য জেলায় সিফট করে ফেলেছে। সকলের অনেক বুঝানোর পরও মি.মির্জা রাজি হয় না। সে গ্রামেই থাকবেন। আসলে সে তখনও হায়ার অপমানের কারণ হিসেবে নিজেকেই দায়ী মানতে। সে যদি প্রস্তাবটা না রাখত তাহলে সকলে হয়ত এত তোড়জোড় করত না হায়া ও আশিয়ানের বিয়ের। এই কারণে নিজেকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি এই বয়সে এসে সন্তান ও নাতি-নাতনীদের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেন। স্ত্রীকে অবশ্য ঢাকাই থাকতে বলেছিলেন, কিন্তু মিসেস মির্জা থাকেন নি।

মি.মির্জার জেদের সাথে না পেরে সকলে রাজি হয়ে যায়। তাদের সাথে গ্রামের বাড়িতে থাকার জন্য আবরার ২৪/৭ জন্য একজন কেয়ার টেকারের ব্যবস্থা করেন। তাদের পাশের বাড়িতে মি.মির্জার দূরসম্পর্কের এক ভাই থাকেন পরিবার সহ, তাকেও দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে এসেছেন।

আবরার এই কয়েক বছরে কম চেষ্টা করেনি মি. এন্ড মিসেস মির্জাকে ঢাকায় নিয়ে আসার কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন। এক পর্যায়ে সব চেষ্টা থামিয়ে দেন তারা। কিন্তু আজ বাবার অসুস্থতায় আবরার বিচলিত হয়ে পড়েছে, স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা অসুস্থ হলে সন্তানরা বিচলিত হয়ে পড়ে।

ড্রয়িংরুমে পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে রয়েছে। কেউ কিছু বলছে না, শুধু তাদের নিরবতাই অনেক কিছু বলে যাচ্ছে চুপিচুপি। হায়া ও স্পর্শ বরাবরের মতো স্বামীদের মতামত জানার জন্য চুপ করে অপেক্ষা করছে। আবরার কিছুটা ক্ষিপ্ত ও ব্যথিত নয়নে আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আশিয়ান, সে অপরাধীর ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর আবরার বুকে কষ্ট নিয়েই উঠে দাঁড়ায় বসা থেকে, উদ্দেশ্য রুমে যাওয়া। হঠাৎই নিস্তব্ধতার দেওয়াল ভঙ্গ করে আশিয়ান বলে উঠে–

—আমি যাবো। আমি গিয়ে দাদাভাই ও দাদুমনিকে ফিরিয়ে আনব। যেই ভুলটা করেছি তার জন্য অনেক আগেই ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু আর নয়। বাবা, তুমি আর আম্মু কালই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাও। আমি ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে হায়াকেসহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, গ্রামে যাবো। আমার বিশ্বাস, আমি গিয়ে বললে দাদাভাই আর রাগ করে থাকতে পারবে না সেখানে।

আশিয়ানের কথা শুনে উপস্থিত বাকি তিনজন কথা বলতে ভুলে যায়। হায়া আর স্পর্শের চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা দেয়। আবরার কতক্ষণ হা করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের কোণেও কেমন চিকচিক করছে। বুঝাই যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো শুনতে পেয়ে তার চোখ আপনাআপনিই অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সে নিজের অশ্রু লুকাতে তটস্থ পায়ে হেঁটে জায়গা ত্যাগ করে।

স্পর্শ এগিয়ে এসে ছেলের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর সেও রুমের উদ্দেশ্য রওনা হয়। কাল সকাল সকাল রওনা হতে হবে গ্রামের উদ্দেশ্য, তাই তো এখনই সব গুছাগাছ করতে হবে।

_________________________

আজ রাহার ঘুম ভাঙে একটা কোমল গলার আওয়াজে। গলার মালিক খুব সাবধানে আস্তে ধীরে তাঁকে ডাকছে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর রাহা ঘুমটা ভেঙে যায় ঠিকই কিন্তু সে চোখ মেলে তাকায় না। লোকটাকে একটু শায়েস্তা করার স্বাদ জেগেছে মনে। রাহার এমন একটা ভান করে যেনো সে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। হালকা একটু নড়াচড়া করে আবারও ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। রাহা মনে মনে ভাবে, আজ দেখবে আফিফের ধৈর্য শক্তি কত।

এদিকে আফিফ রাহাকে ডেকে ডেকে অস্থির। অন্যদিন হলে এত ডাকাডাকি মোটেই করত না, বরং বউকে বুকে নিয়ে সেও ঘুমিয়ে থাকত। কিন্তু আজ যে একটা জিনিস জানার জন্য তার এত অস্থিরতা। কাল সারারাত কেমন ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছে। এমনটা তার সাথে তখনই হয় যখন সে কোন বিষয় নিয়ে অনেক এক্সাইটেড, অথবা কোন বিষয় নিয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। আফিফের বর্তমানে এমন কোন বিষয় নেই যেটা নিয়ে দুঃশ্চিন্তিত হয়ে রাত জেগে থাকবে। তাহলে বাকি থাকে এক্সাইটমেন্টের বিষয়টা। কাঙ্ক্ষিত সংবাদটা শোনার জন্য সে সেই ফজরের সময় নামাজ পড়তে গিয়েই পরিচিত এক ফার্মাসিস্টের দোকান খুলিয়ে কিট নিয়ে এসেছে।

হ্যাঁ, সে ধারণা করছে তাদের ঘর আলো করে একটা নতুন প্রাণ আসতে চলেছে। কাল যখন রাহার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর যখন সে তার ব্লাডপ্রেশার, পালস রেট, হার্টবিট চেক করে তখনই আফিফের কিছুটা সন্দেহ হয়। কিন্তু সে সিউর হয়ে সবাইকে জানাতে চেয়েছে।

আফিফ তার ছোট ছোট চোখ গুলো আরেকটু ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে রাহার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরই সে বুঝতে পারে রাহার ঘুম ভেঙে গিয়ে আর সে তার সাথে দুষ্টুমি করছে। রাহার চোখের পাতা হালকা হালকা করে নড়ছে। আফিফ রাহার এই ঘুমের নাটক ভাঙানোর জন্য রাহার নাক টিপে ধরে। রাহা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় সে ঝট করে চোখ মেলে বড় বড় করে তাকায়। সে চোখ মেলে তাকাতেই আফিফ তার টিপে ধরা নাক ছেড়ে দেয়। তারপর মিটমিট লরে হাসতে থাকে।

রাহা ধরা তো পরে ঠিকই কিন্তু সে নিজের দুষ্টুমি স্বীকার করতে নারাজ। সে রাগী রাগী ভাব নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। তারপর মেকি ধমকের সুরে বলে–

—একজন ঘুমন্ত মানুষের নাক টিপে ধরা কোন ধরণের ফাজলামি ডাক্তার সাহেব? আপনি না ডাক্তার, একজন ডাক্তার হয়ে আপনি সাধারণ একজন মানুষকে পটোলের ক্ষেতে পাঠাতে চাচ্ছিলেন?

আফিফ রাহার এমন ধমকে কথা বলায় একটুও রাগ করে না, বরং সে হাত বাড়িয়ে রাহার কপালে ও চোখের আশেপাশে পড়ে থাকা কিছু চুল কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলে–

—আপনি সজাগ থাকা সত্ত্বেও ঘুমের ভান করে ছিলেন কেন, মিসেস ডাক্তার সাহেব? এটা কোম ধরণের ফাজলামি?

রাহা ধরা খেয়ে যায়। কিন্তু সে এত তাড়াতাড়ি হেরে যাওয়ার পাবলিক না। তাই সে নিজের পক্ষে সাফাই দিয়ে বলে–

—কি বলছেন আপনি এসব? আমি ঘুমের ভান করে থাকব কেনো? আমি সত্যি সত্যিই ঘুমচ্ছিলাম। ইশশশ, রে আপনি আমার এত সুন্দর ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে দিলেন।

—বারোটা বাজালাম কিভাবে? মাত্র তো সাড়ে সাতটা বাজে।

বোকাবোকা গলায় কথাটা বলে আফিফ। রাহা বিরক্ত হয়ে যায় তার কথা শুনে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তখনই তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলে সে আবারও ধপ করে বেডে বসে যায়। আফিফ অস্থির হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে–

—এই রাহা, কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? এভাবে বসলে কেনো?

রাহা তার মাথা চেপে ধরে বলে–

—তেমন কিছু না। কেন যেনো মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।

আফিফ রাহার সাথে দুষ্টুমিতে মেতে প্রেগ্ন্যাসি টেস্টের কথা ভুলেই গিয়েছিল। সে রাহার বাহু টেনে ধরে নিজে কাছে নিয়ে আসে। তারপর একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে রাহাকে নিজের বুকের উপর শোয়ায়। রাহাও কোন প্রতিবাদ না করে চুপটি করে মিশে থাকে প্রিয় পুরুষের বক্ষে।

কিছুক্ষণ পর আফিফ বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে তিনটা প্রেগ্ন্যাসি টেস্টের কিট বের করে রাহার সামনে ধরে। রাহা কিটের প্যাকেটের উপরে লেখা দেখেই বুঝে যায় এটা কি। সে হতবাক চাহনি নিয়ে আফিফের দিকে তাকায়। আফিফ তার অবাকতা বুঝতে পেরে কোমল গলায় বলে–

—কাল আমি প্রপোজ করার পর অজ্ঞান হয়ে গেলে না, তখন রুমে এনে কিছু চেক-আপ করাই। তখনই আমি কিছু উপসর্গ দেখতে পাই। পুরোপুরি সিউর না হয়ে আমি কাউকে জানাতে চাই নি। তাই তো আজ, ফজরের সময়ই নামাজ পড়তে গিয়ে মোড়ের ওখানের দোকান খুলিয়ে কিটগুলো নিয়ে এসেছি। অপেক্ষায় ছিলাম তোমার ঘুম ভাঙার।

আফিফ কোমল গলায় কথাগুলো বলে।রাহা চুপ করে তার কথাগুলো শুনে। সে মনে মনে হিসাব মিলাতে ব্যস্থ। তাদের একান্ত কাছাকাছি আসার পরের মাস থেকেই তার পিরিয়ড মিস হয়েছে। আজ দুই নাম্বার মাস চলছে। ইদানীং ক্লান্তি, খাবারের প্রতি অনীহা, মাথা ঘুরানো, বমি বমি ভাব সবই তার নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে। রাহা এতদিম আফিফের চিন্তায় এতই বিভোর ছিল যে, এসব শারীরিক পরিবর্তনে সে বিন্দুমাত্র খেয়াল করেনি। কিন্তু আজ আফিফের কথা শুনে তারও মনে হচ্ছে খুশির খবর আসতে চলেছে।

রাহার ধ্যান ভঙ্গ হয় আফিফের গলার আওয়াজে। সে বলে–

—যাও সোনাপাখি, আমাকে আর অপেক্ষা করিও না।

রাহা আফিফের কাছ থেকে কিট গুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। আফিফ বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে খুশির সংবাদটি শোনার জন্য।
________________________

আফিফকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করায়নি রাহা। মিনিট পনেরো পরেই সে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে। হাতের মুঠো কিট গুলো। আফিফ অস্থির হয়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দরজার সামনে পায়চারী করছিল। রাহা বের হয়ে আসতেই সে তার পায়চারী থামিয়ে দিয়ে তার কাছে এগিয়ে যায়।

আফিফ এগিয়ে আসতেই রাহা তার হাতের মুঠোয় থাকা জিনিসটা এগিয়ে দেয়। বাম হাতটা তার পেটে তখন। আফিফ পরপর তিনটা কিটেই নজর বুলায়। তিনটা লাল দাগ ইঙ্গিত করছে তারা খুব শীঘ্রই বাবা-মা হতে চলেছে।

আফিফ যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় কিটটা দেখে। সে চোখ বড় বড় করে একবার প্রেগ্ন্যাসির কিট টার দিকে আরেকবার রাহার দিকে তাকাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপছে তার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু গলায় যেন শব্দ আটকে গেছে।

হঠাৎই তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো, শরীর টালমাটাল হলো খানিকটা। তাকে এমন দিলতে দেখে রাহা অস্পষ্ট গলায় বলে—

—আফিফ!!

শব্দটা যেন রাহার গলার ভেতরেই জমে গেল। সে ছুটে গিয়ে ধরতে চাইল, কিন্তু ততক্ষণে আফিফ ধপ করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে।

শব্দ সংখ্যা~২০০০
~চলবে?

[ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স ]

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৫৮

সকাল বেলা সকালেই চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ শুনে জাহান ও মেহরিমার ঘুমটা ভেঙে যায়। জাহান একটু নড়েচড়ে মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলে, মেহরিমা তার প্রস্তুতিতে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে উঠে পড়ে। তার পরনে থাকা জাহানের শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করতে করতে বেড থেকে নামতে নিবে তখনই জাহান তার হাত টেনে ধরে আবারও শুয়ে দেয়। জাহানের এহেন কাজে মেহরিমা কিছুটা চমকে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে জাহানকে নিজের থেকে ঠেলতে ঠেলতে বলে–

—জাহান, ছাড়ুন আমাকে। ফ্রেশ হবো আমি।

জাহান মেহরিমাকে নিজের সাথে আরেকটু তার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলে–

—নো ছাড়াছাড়ি, আমি আরো ঘুমাবো। তুমিও ঘুমাও।

মেহরিমা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে বলে–

—আজব তো! আপনি ঘুমালে ঘুমান, আমাকে উঠতে দিন না। বাহির থেকে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ আসছে। গিয়ে দেখি কি হলো আবার।

জাহান তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দেয়–

—এত দেখা লাগবে না। তুমি উঠে গেলে আমার আর ঘুম আসবে না বউ, প্লিজ একটু থাকো। আমি এখনও অনেক টায়ার্ড, আর আমি জানি তুমিও। সারারাত তো ঘুমাতেই পারলে না আমার জন্য একটুও। এখন ঘুমাও।

জাহানের কথা শুনে মেহরিমার গাল গরম হয়ে যায়। লজ্জায় হাস ফাঁস করতে থাকে মেয়েটা। বিয়ের আগে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি সে যে, জাহান এত ঠোঁটকাটা স্বভাবের হবে।

সময়ের সাথে সাথে মেহরিমা ছটফটানি বাড়তে থাকে। জাহান বুঝে আজ, বউ তার আর ঘুমাবে না। যেই বিছানায় বউ নেই সেই বিছানায় সে থেকে কি করবে ভেবে নিজেও উঠে পড়ে শোয়া থেকে। জাহান শোয়া থেকে উঠতেই মেহরিমাও উঠে হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যেতে চায়, কিন্তু বিধিবাম। তার বর সাহেব নিজেই তার খেদমতে হাজির। জাহান মেহরিমাকে সহ ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। এবার লজ্জায় মেহরিমার জান যায় যায় অবস্থা।

তাদের বিয়ের তিনমাস হয়ে গিয়েছে অলরেডি তাও সে জাহানের ছোট ছোট স্পর্শ, আদরে লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নুইয়ে পড়ে। জাহান তার বউয়ের এত লজ্জা দেখে আরো বেশি লজ্জা দিতে তৎপর হয়ে উঠে। সে যে বড্ড বেশি ভালোবাসে বউটার লাজে রাঙা মুখখানা দেখতে।

দু’জনে একসাথে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলে দেখতে প্রায় ড্রয়িংরুমের পরিবেশ রমরমা। তার বাবা, মা, জায়িন সকলের মুখে হাসি। আদিবার মুখটাও হাসি হাসি কিন্তু তার চেয়ে বেশি লজ্জালু ভাব। জাহান নিচে এসে তার বাবা ভাইয়ের কাছে চলে যায় জানতে কি হয়েছে। আর মেহরিমা এসে শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়ায়। জাহান জায়িনের মাথায় গাট্টা মেরে বলে–

—কি রে, বাদরের রাজা, সকাল সকাল এত চিৎকার চেচামেচি করছিস কেনো? লটারি জিতেছিস নাকি?

জায়িন জাহানকে দেখে বেশ ভাব নিয়ে বলে–

—হাহ্, লটারির চেয়ে বেশি কিছু।

—তাই বুঝি? তা শুনি কিসের জন্য আপনি বাড়ি মাথায় করে তুলেছেন?

জায়িন একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে–

—তালুকদার বাড়ির বাদরের রাজার ঘরে বাদর রাজপুত্র অথবা রাজকন্যা আসতে চলেছে।

তার কথা শুনে জাহান আর মেহরিমার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে যায়। তারা বুঝতে পেরে গিয়েছে জায়িন কি বলছে। মেহরিমা বান্ধবীর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। জাহানও ভাইকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। তালুকদার বাড়িতে আজ আবার কয়েক যুগ পর নতুন প্রাণের আগমনের খবর এলো। সকলে খুশিতে আটখানা হয়ে রয়েছে। হানিয়া যায় মেয়েকে ফোন দিয়ে খুশির সংবাদটা জানাতে।

মির্জা বাড়িতে ফোন দিয়ে আদিবার প্রেগ্ন্যাসির খবর জানানো হলে তারাও তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। যদিও আবরার ও স্পর্শ তখন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল, তাও তারা এমন একটা সংবাদ শুনে না গিয়ে পারে না। তারা লাগেজ নিয়ে একেবারে বের হয়ে যায়। তালুকদার বাড়ি থেকেই তারা গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হবে।

আধাঘন্টার মাঝেই হায়া-আশিয়ান ও স্পর্শ-আবরার তালুকদার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। হায়া তো খুশিতে লাফাচ্ছে। তার ভাতিজী-ভাতিজা আসতে চলেছে। এত খুশি সে কই রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না। আসার পর থেকেই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কত আদর, কত আহ্লাদ তার। আশিয়ান দূর থেকে বউয়ের উচ্ছ্বসিত মুখখানা দেখে মনে মনেই বলে–

—ফুফু হওয়ার খুশিতে কতই না খুশি তার, যখন মা হবে তখন তো বোধহয় নিজেও পাগল হয়ে যাবে খুশিতে, আমাকেও পাগল বানাবে।

এসব কথা ভেবেই আনমনে হেঁসে উঠে আশিয়ান। ঠিক তখনই হায়া তার দিকে তাকায়। আশিয়ানকে তার দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? আশিয়ান মাথা নাড়িয়ে কিছু না বুঝায়। আশিয়ানের ক্লাস নেওয়ার সময় পাড় হয়ে যাচ্ছে দেখে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বাবা-মায়ের সাথেই বেরিয়ে পড়ে। হায়া আর মেহরিমা কেউই আজ ভার্সিটিতে যাবে না। নিজেদের মতো আনন্দ করে দিন কাটাবে তিন বান্ধবী এটাই তাদের প্ল্যান।

______________________________

এদিকে, আফিফকে হুট করে এমন ভাবে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে রাহা ঘাবড়ে যায়। কি রেখে কি করবে ভেবে পায় না। সে আফিফের পায়ে বসে তাকে ডাকতে থাকে–

—আফিফ! এই ডাক্তার সাহেব! কি হলো আপনার? উঠুন। অ্যাঁই আফিফ।

অনেকবার ডাকাডাকির পরও আফিফ চোখ মেলে তাকায় না। কি করবে ভেবে না পেয়ে হঠাৎই রাহার মন বলে, আফিফের চোখেমুখে একটু পানি ছিটিয়ে দেখলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। সে তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমের থেকে এক মগ পানি এনে তার মুখের ঢেলে দেয়। এতেই যেনো কাজ হয়। আফিফ লাফ মেরে উঠে বসে।

আসলে অতিরিক্ত খুশি বা উত্তেজনার ফলে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যায়। এটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “ইমোশনাল সিনকোপি”। অতিরিক্ত আবেগি মানুষ কোন অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ পেলে তাদের স্নায়ুর উপর চাপ পড়ে। যার কারণে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যায়। আফিফের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। রাহার প্রেগ্ন্যাসির নিউজটা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি।

আফিফকে চোখ খুলে দেখে রাহার জানে প্রাণ ফিরে আসে যেনো। আফিফের জ্ঞান ফেরার পরপরই সে রাহাকে জড়িয়ে ধরে। রাহাও নিঃসংকোচে আফিফের বুকের সাথে মিশে থাকে। একটু পরপরই আফিফ রাহাকে বুক থেকে সরিয়ে তার পুরো মুখশ্রীতে আদর দিচ্ছে আর বলছে–

—ধন্যবাদ রাহা, আমার জীবনে আসার জন্য। আমায় এত সুন্দর একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় করানোর জন্য। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায়।

রাহা ভেবে পেলো না সে কখন আসল বরং আফিফ তাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়েছে বলেই তো আজ সে পরিপূর্ণ। এই কৃতজ্ঞতা তো রাহার আফিফকে জানানো উচিত। কিন্তু রাহা আপাতত কিছুই বলবে না। চুপচাপ স্বামীর আদর নিবে আর মাঝে মধ্যে খানিকটা দিবেও।

___________________________

—কি রে মেঘলা, সারাদিন হুইয়া বইয়া থাকলে চলবো? ঘরে এহনও কত কাজ পড়ে আছে।

ছোট চাচীর কর্কষ গলার কথা গুলো শুনে ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। সকালের নাস্তার পর ও গত রাতের খাবারের পর একগাদা থালাবাসন জমেছিল। এক ঘন্টা লাগিয়ে সেসব কিছু ধুয়েমুছে, কলপাড় পরিষ্কার করে মাত্র দুই মিনিট হলো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এরই মাঝে আবারও ডাক পড়ে গেলো। ঋতুবতী হওয়ায় তার কোমড় ও পেট ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মুখ চোখ ব্যথায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেদিক কারো নজর নেই। যে যার স্বার্থ আদায়ে ব্যস্ত।

মেঘলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–

—চাচী আপনি যান। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।

তার ছোট চাচী যাওয়ার আগে বলে যায়–

—বেশি দেরি করিস না বাপু। আবার বাপের বাড়ির লোকজন এসে পড়ল বলে। তাদের জন্য তো একটু ভালো মন্দ রাঁধতে হয়, তাই না বল?

বরাবরের মতো শান্ত স্বভাবের মেঘলা তার কথায় সম্মতি দেয়। তার ছোট চাচী চলে যায়। যেতে যেতে বলতে থাকে–

—একটু কামে কইলেই যত বাহানা আর ঢং। এয়ি বয়সে কত কাম করছি তার নাই ঠিক। যত্তসব!

মেঘলা স্পষ্ট তার ছোট চাচী শান্তার কথাগুলো শুনতে পায়। সে ভালো করেই জানেন তার ছোট চাচী কত কাজের। তিন ভাইয়ের একটা মাত্র বোন হওয়ায় ছোট থেকে বেশ আদরেই বড় হয়েছে। বাবার বাড়ির অবস্থাও ভালো। বিয়ের আগে তেমন কিছুই করতে হয়নি তার। গরীব ঘরের সাইফুলকে ভালোবেসে বিয়ের করায় এখন যা একটু হাত লাগাতে হয় কাজে। তাও একদিন একটা রান্না করলে তিনদিন বিছানায় অবস্থান করে শান্তা।

খাটের উপর আধশোয়া হয়ে কিছুটা দূরে রাখা পড়ার টেবিলের উপর নজর পড়ে মেঘলার। বাবা-মাসহ তার একটা ছবি। ছবিটায় মেঘলার বয়স সাত বছর, যে বছরে সে তার বাবা-মাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। মেঘলা বিরবিরিয়ে বলে–

—আম্মু, আব্বু তোমরা কেমন আছো?

আসে না কোন উত্তর অপরপক্ষের থেকে। একরাশ অভিমান নিয়ে মেঘলা আবারও বলে উঠে–

—আমায় সাথে নিয়ে গেলে কি এমন হতো আম্মু, আব্বু? আমাকে এমন যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যই কি রেখে গিয়েছিলে?

এবারও কোন উত্তর আসে না। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল মেঘলা। তিনভাই ও এক বোনের মাঝে তার বাবা ছিলো সবার বড়। মেঘলার দাদার বেশ কয়েকটা খামার আছে, তার বাবা সেই খামার পরিচালনা করার পাশাপাশি নিজেও আলাদা ব্যবসা গড়েছিলেন। অন্য ভাইয়েরা তেমন বুঝত না বলে মেঘলার বাবাই বলতে গেলে একাই তখন পরিবারের চালাত তাই তখন মেঘলারও বেশ ভালোই কদর ছিল। সকলের চোখের মনি ছিল। কিন্তু তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর দিনকে দিন সেই কদর কমতে কমতে, আজ সে এই বাড়ির অঘোষিত চাকরে রূপ নিয়েছে।

আজ থেকে দশ বছর আগে এক রোড এক্সিডেন্টে মেঘলার বাবা-মা মারা যায়। তারপরেই তার দায়িত্ব এসে পড়ে চাচাদের ঘাড়ে। মেঘলার মায়ের বাড়ির কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। আর তাছাড়া তার মা-ও বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল যার কারণে মেঘলার কোন মামা-খালাও নেই।

—কিরে মেঘলা? আসোস না কেন তুই এহনও?

—আসছি চাচী।

চঞ্চল চিত্তে গায়ে ওড়না জড়াতে জড়াতে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে।

____________________________

ঘরের দরজা লাগিয়ে মুখ বালিশে গুঁজে কাঁদছে মেঘলা। বুকের ভেতর এক আকাশ সমান কষ্ট। দিন দিন সেই কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তার আপন মানুষেরাই। হঠাৎই শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের শরীরে কাপড় দিয়ে ঘষতে থাকে উ”ন্মাদের মতো। আর বিরবির করে বলছে–

—মুছে ফেলবো আমি। সব খা”রাপ চিহ্ন মুছে ফেলবো।

কি বুঝতে পারছেন না তো কেন এমনটা করছে মেঘলা। তাহলে কয়েক ঘন্টা আগের কথা শুনতে হবে যে আপনাদের।

__________________

কয়েকঘন্টা আগের কথা~

মেঘলার ছোট চাচীর মেঝো ভাই, তার বউ ও তাদের ছেলেসহ মেঘলাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। মেঘলা তাদের জন্য নিজের হাতে পাঁচ থেকে সাত পদের রান্না করে রেখেছে। যখন মেঘলা এক এক করে রান্নাঘর থেকে খাবারের রুমে রান্না গুলো আনছিল তখনই, শান্তার অসভ্য, বখাটে, নেশাখোর ভাতিজা তন্ময় মেঘলার পথ আঁটকে দাঁড়ায়। মেঘলা তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায় বেশ। কারণ বছর জুয়েল আগে সে মেঘলাকে একটা বাজে প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু মেঘলা তাকে থাপ্পড় মেরে উচিত শিক্ষা দেয়। তারপর থেকে সে যখনই স্কুল বা কলেজে যেতো দলবল সহ মেঘলাকে উত্যক্ত করত। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মেঘলা তার ছোট চাচা অর্থাৎ শান্তার স্বামীকে এই কথা জানায়। তারপর থেকেই সে শান্তার দুই চোখের বিষ হয়ে যায়। মেলার ছোট চাচা তন্ময়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে শান্তার মেঝো ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।

মেঘলা তার পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে তন্ময় অসভ্যতামির সকল স্তর অতিক্রম করে মেঘলার কোমড় চেপে ধরে ও আরেকহাত দিয়ে মেঘলার মুখ চেপে ধরে তার কাধের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মেঘলার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। যখনই তার ধ্যান ফিরে তখনই সে অসভ্য তন্ময়কে নিজের থেকে দূরে সরানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। হাত দিয়ে কিছু করতে পারছে না কারণ হাতে তখন বড়সড় একটা তরকারির বাটি। তন্ময় যেই না তার অপবিত্র স্পর্শ দ্বারা মেঘলাকে ছুঁয়ে দিতে নিবে তখনই, কারো আসার পদধ্বনি শোনা যায়। তন্ময় তাড়াতাড়ি করে মেঘলার থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়। মেঘলা তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে চলে যায়। তারপর তরকারির বাটিটা টেবিলের উপর রেখেই শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে নিজের রুমে চলে এসে কাঁদতে।

_______________________

বর্তমান~

দরজায় খট খট করার শব্দে মেঘলার ধ্যান ফিরে। তার বৃদ্ধ দাদীর গলার আওয়াজ শোনা যায়। মেঘলা নিজের চোখের পানি মুছে দরজা খুলে দিলে দেখতে পায় তার দাদীর সাথে সাথে তার ছোট চাচীও এসেছে। সে একহাতে খাবারের প্লেট ও অন্যহাতে তার দাদীকে ধরো আছে। বৃদ্ধা একা চলাচল করতে পারে না তাই তাকে অন্যের সাহায্য নিয়েই চলাচল করতে হয়।

মেঘলা তার চাচীকে খাবারের প্লেট সহ আসতে দেখে, কেননা তার চাচী গত দুই বছর ধরে তার খাওয়া-পরা, বা যত্ন-আত্তি করে না। মেঘলা তাদের দু’জনকে ঘরে প্রবেশের জায়গা করে দেয়। মেঘলাকে আরো অবাক করে দিয়ে, আজ কয়েক বছর পর মেঘলার ছোট চাচী তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। অনেক আদরও করে। সবকিছুই মেঘলার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

________________________

হঠাৎই এক বউ সাজে থাকা রমনী আশিয়ানের বুকে এসে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় আশিয়ান কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে পড়ে যেতে নিলে, পেছনে থাকা হায়া তাকে ধরে ফেলে। হায়া ঘাবড়ে গিয়ে বলে–

—আপনি ঠিক আছেন আশিয়ান?

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে সামনে তাকাতেই সে থমকে যায়। ভালোবাসা মানুষ, তার একান্ত শখের পুরুষের বক্ষে অন্য নারীকে দেখে হায়ার বুকে আগুন জ্বলে যায়।

শব্দ সংখ্যা~১৮১৭
~চলবে?