সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0
3

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৫৮

সকাল বেলা সকালেই চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ শুনে জাহান ও মেহরিমার ঘুমটা ভেঙে যায়। জাহান একটু নড়েচড়ে মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলে, মেহরিমা তার প্রস্তুতিতে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে উঠে পড়ে। তার পরনে থাকা জাহানের শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করতে করতে বেড থেকে নামতে নিবে তখনই জাহান তার হাত টেনে ধরে আবারও শুয়ে দেয়। জাহানের এহেন কাজে মেহরিমা কিছুটা চমকে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে জাহানকে নিজের থেকে ঠেলতে ঠেলতে বলে–

—জাহান, ছাড়ুন আমাকে। ফ্রেশ হবো আমি।

জাহান মেহরিমাকে নিজের সাথে আরেকটু তার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুম ঘুম গলায় বলে–

—নো ছাড়াছাড়ি, আমি আরো ঘুমাবো। তুমিও ঘুমাও।

মেহরিমা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে বলে–

—আজব তো! আপনি ঘুমালে ঘুমান, আমাকে উঠতে দিন না। বাহির থেকে চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ আসছে। গিয়ে দেখি কি হলো আবার।

জাহান তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দেয়–

—এত দেখা লাগবে না। তুমি উঠে গেলে আমার আর ঘুম আসবে না বউ, প্লিজ একটু থাকো। আমি এখনও অনেক টায়ার্ড, আর আমি জানি তুমিও। সারারাত তো ঘুমাতেই পারলে না আমার জন্য একটুও। এখন ঘুমাও।

জাহানের কথা শুনে মেহরিমার গাল গরম হয়ে যায়। লজ্জায় হাস ফাঁস করতে থাকে মেয়েটা। বিয়ের আগে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি সে যে, জাহান এত ঠোঁটকাটা স্বভাবের হবে।

সময়ের সাথে সাথে মেহরিমা ছটফটানি বাড়তে থাকে। জাহান বুঝে আজ, বউ তার আর ঘুমাবে না। যেই বিছানায় বউ নেই সেই বিছানায় সে থেকে কি করবে ভেবে নিজেও উঠে পড়ে শোয়া থেকে। জাহান শোয়া থেকে উঠতেই মেহরিমাও উঠে হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যেতে চায়, কিন্তু বিধিবাম। তার বর সাহেব নিজেই তার খেদমতে হাজির। জাহান মেহরিমাকে সহ ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। এবার লজ্জায় মেহরিমার জান যায় যায় অবস্থা।

তাদের বিয়ের তিনমাস হয়ে গিয়েছে অলরেডি তাও সে জাহানের ছোট ছোট স্পর্শ, আদরে লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নুইয়ে পড়ে। জাহান তার বউয়ের এত লজ্জা দেখে আরো বেশি লজ্জা দিতে তৎপর হয়ে উঠে। সে যে বড্ড বেশি ভালোবাসে বউটার লাজে রাঙা মুখখানা দেখতে।

দু’জনে একসাথে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলে দেখতে প্রায় ড্রয়িংরুমের পরিবেশ রমরমা। তার বাবা, মা, জায়িন সকলের মুখে হাসি। আদিবার মুখটাও হাসি হাসি কিন্তু তার চেয়ে বেশি লজ্জালু ভাব। জাহান নিচে এসে তার বাবা ভাইয়ের কাছে চলে যায় জানতে কি হয়েছে। আর মেহরিমা এসে শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়ায়। জাহান জায়িনের মাথায় গাট্টা মেরে বলে–

—কি রে, বাদরের রাজা, সকাল সকাল এত চিৎকার চেচামেচি করছিস কেনো? লটারি জিতেছিস নাকি?

জায়িন জাহানকে দেখে বেশ ভাব নিয়ে বলে–

—হাহ্, লটারির চেয়ে বেশি কিছু।

—তাই বুঝি? তা শুনি কিসের জন্য আপনি বাড়ি মাথায় করে তুলেছেন?

জায়িন একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে–

—তালুকদার বাড়ির বাদরের রাজার ঘরে বাদর রাজপুত্র অথবা রাজকন্যা আসতে চলেছে।

তার কথা শুনে জাহান আর মেহরিমার চোখজোড়া বড়বড় হয়ে যায়। তারা বুঝতে পেরে গিয়েছে জায়িন কি বলছে। মেহরিমা বান্ধবীর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। জাহানও ভাইকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। তালুকদার বাড়িতে আজ আবার কয়েক যুগ পর নতুন প্রাণের আগমনের খবর এলো। সকলে খুশিতে আটখানা হয়ে রয়েছে। হানিয়া যায় মেয়েকে ফোন দিয়ে খুশির সংবাদটা জানাতে।

মির্জা বাড়িতে ফোন দিয়ে আদিবার প্রেগ্ন্যাসির খবর জানানো হলে তারাও তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়। যদিও আবরার ও স্পর্শ তখন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল, তাও তারা এমন একটা সংবাদ শুনে না গিয়ে পারে না। তারা লাগেজ নিয়ে একেবারে বের হয়ে যায়। তালুকদার বাড়ি থেকেই তারা গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হবে।

আধাঘন্টার মাঝেই হায়া-আশিয়ান ও স্পর্শ-আবরার তালুকদার বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। হায়া তো খুশিতে লাফাচ্ছে। তার ভাতিজী-ভাতিজা আসতে চলেছে। এত খুশি সে কই রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না। আসার পর থেকেই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কত আদর, কত আহ্লাদ তার। আশিয়ান দূর থেকে বউয়ের উচ্ছ্বসিত মুখখানা দেখে মনে মনেই বলে–

—ফুফু হওয়ার খুশিতে কতই না খুশি তার, যখন মা হবে তখন তো বোধহয় নিজেও পাগল হয়ে যাবে খুশিতে, আমাকেও পাগল বানাবে।

এসব কথা ভেবেই আনমনে হেঁসে উঠে আশিয়ান। ঠিক তখনই হায়া তার দিকে তাকায়। আশিয়ানকে তার দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? আশিয়ান মাথা নাড়িয়ে কিছু না বুঝায়। আশিয়ানের ক্লাস নেওয়ার সময় পাড় হয়ে যাচ্ছে দেখে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বাবা-মায়ের সাথেই বেরিয়ে পড়ে। হায়া আর মেহরিমা কেউই আজ ভার্সিটিতে যাবে না। নিজেদের মতো আনন্দ করে দিন কাটাবে তিন বান্ধবী এটাই তাদের প্ল্যান।

______________________________

এদিকে, আফিফকে হুট করে এমন ভাবে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে রাহা ঘাবড়ে যায়। কি রেখে কি করবে ভেবে পায় না। সে আফিফের পায়ে বসে তাকে ডাকতে থাকে–

—আফিফ! এই ডাক্তার সাহেব! কি হলো আপনার? উঠুন। অ্যাঁই আফিফ।

অনেকবার ডাকাডাকির পরও আফিফ চোখ মেলে তাকায় না। কি করবে ভেবে না পেয়ে হঠাৎই রাহার মন বলে, আফিফের চোখেমুখে একটু পানি ছিটিয়ে দেখলে কেমন হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। সে তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমের থেকে এক মগ পানি এনে তার মুখের ঢেলে দেয়। এতেই যেনো কাজ হয়। আফিফ লাফ মেরে উঠে বসে।

আসলে অতিরিক্ত খুশি বা উত্তেজনার ফলে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যায়। এটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “ইমোশনাল সিনকোপি”। অতিরিক্ত আবেগি মানুষ কোন অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ পেলে তাদের স্নায়ুর উপর চাপ পড়ে। যার কারণে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যায়। আফিফের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। রাহার প্রেগ্ন্যাসির নিউজটা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি।

আফিফকে চোখ খুলে দেখে রাহার জানে প্রাণ ফিরে আসে যেনো। আফিফের জ্ঞান ফেরার পরপরই সে রাহাকে জড়িয়ে ধরে। রাহাও নিঃসংকোচে আফিফের বুকের সাথে মিশে থাকে। একটু পরপরই আফিফ রাহাকে বুক থেকে সরিয়ে তার পুরো মুখশ্রীতে আদর দিচ্ছে আর বলছে–

—ধন্যবাদ রাহা, আমার জীবনে আসার জন্য। আমায় এত সুন্দর একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় করানোর জন্য। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায়।

রাহা ভেবে পেলো না সে কখন আসল বরং আফিফ তাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়েছে বলেই তো আজ সে পরিপূর্ণ। এই কৃতজ্ঞতা তো রাহার আফিফকে জানানো উচিত। কিন্তু রাহা আপাতত কিছুই বলবে না। চুপচাপ স্বামীর আদর নিবে আর মাঝে মধ্যে খানিকটা দিবেও।

___________________________

—কি রে মেঘলা, সারাদিন হুইয়া বইয়া থাকলে চলবো? ঘরে এহনও কত কাজ পড়ে আছে।

ছোট চাচীর কর্কষ গলার কথা গুলো শুনে ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। সকালের নাস্তার পর ও গত রাতের খাবারের পর একগাদা থালাবাসন জমেছিল। এক ঘন্টা লাগিয়ে সেসব কিছু ধুয়েমুছে, কলপাড় পরিষ্কার করে মাত্র দুই মিনিট হলো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। এরই মাঝে আবারও ডাক পড়ে গেলো। ঋতুবতী হওয়ায় তার কোমড় ও পেট ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মুখ চোখ ব্যথায় কেমন ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেদিক কারো নজর নেই। যে যার স্বার্থ আদায়ে ব্যস্ত।

মেঘলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–

—চাচী আপনি যান। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।

তার ছোট চাচী যাওয়ার আগে বলে যায়–

—বেশি দেরি করিস না বাপু। আবার বাপের বাড়ির লোকজন এসে পড়ল বলে। তাদের জন্য তো একটু ভালো মন্দ রাঁধতে হয়, তাই না বল?

বরাবরের মতো শান্ত স্বভাবের মেঘলা তার কথায় সম্মতি দেয়। তার ছোট চাচী চলে যায়। যেতে যেতে বলতে থাকে–

—একটু কামে কইলেই যত বাহানা আর ঢং। এয়ি বয়সে কত কাম করছি তার নাই ঠিক। যত্তসব!

মেঘলা স্পষ্ট তার ছোট চাচী শান্তার কথাগুলো শুনতে পায়। সে ভালো করেই জানেন তার ছোট চাচী কত কাজের। তিন ভাইয়ের একটা মাত্র বোন হওয়ায় ছোট থেকে বেশ আদরেই বড় হয়েছে। বাবার বাড়ির অবস্থাও ভালো। বিয়ের আগে তেমন কিছুই করতে হয়নি তার। গরীব ঘরের সাইফুলকে ভালোবেসে বিয়ের করায় এখন যা একটু হাত লাগাতে হয় কাজে। তাও একদিন একটা রান্না করলে তিনদিন বিছানায় অবস্থান করে শান্তা।

খাটের উপর আধশোয়া হয়ে কিছুটা দূরে রাখা পড়ার টেবিলের উপর নজর পড়ে মেঘলার। বাবা-মাসহ তার একটা ছবি। ছবিটায় মেঘলার বয়স সাত বছর, যে বছরে সে তার বাবা-মাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। মেঘলা বিরবিরিয়ে বলে–

—আম্মু, আব্বু তোমরা কেমন আছো?

আসে না কোন উত্তর অপরপক্ষের থেকে। একরাশ অভিমান নিয়ে মেঘলা আবারও বলে উঠে–

—আমায় সাথে নিয়ে গেলে কি এমন হতো আম্মু, আব্বু? আমাকে এমন যন্ত্রণা সহ্য করার জন্যই কি রেখে গিয়েছিলে?

এবারও কোন উত্তর আসে না। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল মেঘলা। তিনভাই ও এক বোনের মাঝে তার বাবা ছিলো সবার বড়। মেঘলার দাদার বেশ কয়েকটা খামার আছে, তার বাবা সেই খামার পরিচালনা করার পাশাপাশি নিজেও আলাদা ব্যবসা গড়েছিলেন। অন্য ভাইয়েরা তেমন বুঝত না বলে মেঘলার বাবাই বলতে গেলে একাই তখন পরিবারের চালাত তাই তখন মেঘলারও বেশ ভালোই কদর ছিল। সকলের চোখের মনি ছিল। কিন্তু তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর দিনকে দিন সেই কদর কমতে কমতে, আজ সে এই বাড়ির অঘোষিত চাকরে রূপ নিয়েছে।

আজ থেকে দশ বছর আগে এক রোড এক্সিডেন্টে মেঘলার বাবা-মা মারা যায়। তারপরেই তার দায়িত্ব এসে পড়ে চাচাদের ঘাড়ে। মেঘলার মায়ের বাড়ির কেউ বর্তমানে জীবিত নেই। আর তাছাড়া তার মা-ও বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল যার কারণে মেঘলার কোন মামা-খালাও নেই।

—কিরে মেঘলা? আসোস না কেন তুই এহনও?

—আসছি চাচী।

চঞ্চল চিত্তে গায়ে ওড়না জড়াতে জড়াতে রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে।

____________________________

ঘরের দরজা লাগিয়ে মুখ বালিশে গুঁজে কাঁদছে মেঘলা। বুকের ভেতর এক আকাশ সমান কষ্ট। দিন দিন সেই কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তার আপন মানুষেরাই। হঠাৎই শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের শরীরে কাপড় দিয়ে ঘষতে থাকে উ”ন্মাদের মতো। আর বিরবির করে বলছে–

—মুছে ফেলবো আমি। সব খা”রাপ চিহ্ন মুছে ফেলবো।

কি বুঝতে পারছেন না তো কেন এমনটা করছে মেঘলা। তাহলে কয়েক ঘন্টা আগের কথা শুনতে হবে যে আপনাদের।

__________________

কয়েকঘন্টা আগের কথা~

মেঘলার ছোট চাচীর মেঝো ভাই, তার বউ ও তাদের ছেলেসহ মেঘলাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। মেঘলা তাদের জন্য নিজের হাতে পাঁচ থেকে সাত পদের রান্না করে রেখেছে। যখন মেঘলা এক এক করে রান্নাঘর থেকে খাবারের রুমে রান্না গুলো আনছিল তখনই, শান্তার অসভ্য, বখাটে, নেশাখোর ভাতিজা তন্ময় মেঘলার পথ আঁটকে দাঁড়ায়। মেঘলা তাকে দেখে ভয় পেয়ে যায় বেশ। কারণ বছর জুয়েল আগে সে মেঘলাকে একটা বাজে প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু মেঘলা তাকে থাপ্পড় মেরে উচিত শিক্ষা দেয়। তারপর থেকে সে যখনই স্কুল বা কলেজে যেতো দলবল সহ মেঘলাকে উত্যক্ত করত। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মেঘলা তার ছোট চাচা অর্থাৎ শান্তার স্বামীকে এই কথা জানায়। তারপর থেকেই সে শান্তার দুই চোখের বিষ হয়ে যায়। মেলার ছোট চাচা তন্ময়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে শান্তার মেঝো ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।

মেঘলা তার পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে তন্ময় অসভ্যতামির সকল স্তর অতিক্রম করে মেঘলার কোমড় চেপে ধরে ও আরেকহাত দিয়ে মেঘলার মুখ চেপে ধরে তার কাধের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মেঘলার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। যখনই তার ধ্যান ফিরে তখনই সে অসভ্য তন্ময়কে নিজের থেকে দূরে সরানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। হাত দিয়ে কিছু করতে পারছে না কারণ হাতে তখন বড়সড় একটা তরকারির বাটি। তন্ময় যেই না তার অপবিত্র স্পর্শ দ্বারা মেঘলাকে ছুঁয়ে দিতে নিবে তখনই, কারো আসার পদধ্বনি শোনা যায়। তন্ময় তাড়াতাড়ি করে মেঘলার থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়। মেঘলা তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে চলে যায়। তারপর তরকারির বাটিটা টেবিলের উপর রেখেই শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে নিজের রুমে চলে এসে কাঁদতে।

_______________________

বর্তমান~

দরজায় খট খট করার শব্দে মেঘলার ধ্যান ফিরে। তার বৃদ্ধ দাদীর গলার আওয়াজ শোনা যায়। মেঘলা নিজের চোখের পানি মুছে দরজা খুলে দিলে দেখতে পায় তার দাদীর সাথে সাথে তার ছোট চাচীও এসেছে। সে একহাতে খাবারের প্লেট ও অন্যহাতে তার দাদীকে ধরো আছে। বৃদ্ধা একা চলাচল করতে পারে না তাই তাকে অন্যের সাহায্য নিয়েই চলাচল করতে হয়।

মেঘলা তার চাচীকে খাবারের প্লেট সহ আসতে দেখে, কেননা তার চাচী গত দুই বছর ধরে তার খাওয়া-পরা, বা যত্ন-আত্তি করে না। মেঘলা তাদের দু’জনকে ঘরে প্রবেশের জায়গা করে দেয়। মেঘলাকে আরো অবাক করে দিয়ে, আজ কয়েক বছর পর মেঘলার ছোট চাচী তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়। অনেক আদরও করে। সবকিছুই মেঘলার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

________________________

হঠাৎই এক বউ সাজে থাকা রমনী আশিয়ানের বুকে এসে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় আশিয়ান কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে পড়ে যেতে নিলে, পেছনে থাকা হায়া তাকে ধরে ফেলে। হায়া ঘাবড়ে গিয়ে বলে–

—আপনি ঠিক আছেন আশিয়ান?

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে সামনে তাকাতেই সে থমকে যায়। ভালোবাসা মানুষ, তার একান্ত শখের পুরুষের বক্ষে অন্য নারীকে দেখে হায়ার বুকে আগুন জ্বলে যায়।

শব্দ সংখ্যা~১৮১৭
~চলবে?

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৫৯(রোমান্টিক এলার্ট)

টিনের দরজায় অনবরত হাত দিয়ে বারি দেওয়ার আওয়াজে হায়া ও আশিয়ানের ঘুমটা পাতলা হয়। হয় একটু নড়েচড়ে আশিয়ানের বুকে পোক্ত ভাবে মুখ ডুবিয়ে রেখে আবারও ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু আশিয়ান আর ঘুমায় না। তার এক বদ অভ্যাস আছে। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না সহজে।

সে শোয়া অবস্থাতেই একহাত দিয়ে চোখ কচলে ঘুমটা পুরোপুরি ছাড়িয়ে নেয়। তারপর উঁচু গলায় বলে–

—কে?

দরজার অপর পাশ থেকে উত্তর আসে–

—আমি তোমার আম্মু।

আশিয়ান মায়ের কণ্ঠ সে সাথে সাথে চিনতে পেরে যায়। স্পর্শ আবারও বলে–

—উঠবে না? নয়টা বেজে গিয়েছে অলরেডি। হায়াকে কিছু খাওয়ানো দরকার।

কি? নয়টা বেজে গিয়েছে? আশিয়ান তাড়াতাড়ি করে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে স্ক্রিন অন করে সময় দেখে নেয়। হ্যাঁ, তার মা ঠিক বলেছে। নয়টা পাঁচ বাজতে চলেছে। এত লেট হয়ে গেলো আজ তাঁদের? আশিয়ান ফোনটা পূর্বের জায়গায় রেখে চাচীকে বলে–

—তুমি যাও আম্মু, আমরা আসছি।

—আচ্ছা আসো তাড়াতাড়ি।

স্পর্শ চলে যায়। আশিয়ান আস্তে ধীরে হায়াকে বুকে নিয়েই আধশোয়া হয়। তারপর ধীরেসুস্থে তাকে ডাকতে থাকে–

—হায়া, উঠবে না বউপাখি? নয়টা বাজতে চললো, কিছু খেয়ে আবার ঘুমাও।

হায়া ঘুমের ঘোরেই বিরবিরিয়ে কি জানি বলে আবার চুপ হয়ে যায়। আশিয়ান বুঝতে পারে এই মেয়েকে আজ এমন তুলুতুলু করে ডাকতে তাদের সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার একসাথেই সারতে হবে। এবার সে জোরেই ডাক দেয়–

—হায়া, উঠো। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। উঠে নাস্তা করে তারপর ঘুমিয়ে থেকো, উঠে বলছি। এই হায়া।

কানের সামনে আশিয়ানের অনবরত ডাকাডাকি উপেক্ষা করে হায়া আর ঘুমাতে পারে না। একটা সময় ঘুম ভেঙেই যায়। শোয়া থেকে উঠে বসতেই তার কেমন গা গোলাতে থাকে, কিন্তু সে এই শরীর খারাপ লাগাটাকে পাত্তা দেয় না। আশিয়ান নিজেই হায়ার চুলগুলো একটা ক্লিপ দিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়। হায়া রুমে থাকা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। সে বের হয়ে আসলে, আশিয়ানও যায় ফ্রেশ হতে। সে এসে একটা ওড়নাটা পরিপাটি করে হায়ার গায়ে এলিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে বাহিরে চলে আসে।

দরজা খুলতেই বৃষ্টি ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ তাদের নাকে এসে বারি খায়। নিমিষেই মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। হায়া আশিয়ানের হাত ছেড়েই আগে আগে হাঁটতে থাকে। কাল রাতে সে আর আশিয়ান এবং জাহান আর মেহরিমা গ্রামের বাড়িতে আসে। রাস্তায় হায়া বমি করতে করতে এত কাহিল হয়ে গিয়েছিল, তাই বাড়িতে পৌছিয়েই আশিয়ান তাকে দুটো খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।

জায়িন-আদিবাও আসার কথা ছিল, কিন্তু আসেনি। আসার আগের দিন আদিবার হঠাৎই সে কি বমি আর মাথা ঘুরানো। টেস্ট করে জানা গিয়েছে, আদিবা জমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে। তার শরীরে ভিটামিন ও রক্তস্বল্পতা রয়েছে। এই সময় জার্নি করা রিক্স হবে। তাই আর তাকে আনে নি কেউ। আদিবার যদিও একটু মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু দু’টো বাচ্চার জননী হতে চলেছে এটা মনে করেই তার সকল মন খারাবি উবে গিয়েছে। সেখানে ঠায় নিয়েছে, তার অনাগত সন্তানদের জন্য চিন্তা।

হায়াদের বংশ পরম্পরায় জমজ বাচ্চা হওয়ার বহু কাহিনি রয়েছে। তার মায়ের থেকে এই পরম্পরা শুরু হয়েছে। তারপর তার ভাইয়েরা হলো। এখন আল্লাহ দিলে তার ভাইয়ের ঘরেও দুটো নেয়ামত আসতে চলেছে।

হায়া উঠানে এসে হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে। কিছুক্ষণ আগ অব্দি বৃষ্টি পরছিল, পাঁচ-সাত মিনিট আগে থেমেছে। চাল থেকে তখনও টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। হায়া মুগ্ধ হয়ে আশেপাশের পরিবেশ উপভোগ করতে করতে বলে–

—আশিয়ান, পরিবেশটা কি সুন্দর না? মাশা আল্লাহ।

আশিয়ান ততক্ষণে তার পেছনে এসে উপস্থিত হয়েছে। সেও নিঃশব্দে হেঁসে বলে–

—হুম, খুব সুন্দর। একদম আমার লাল টমেটো বউয়ের মতো।

লাল টমেটো বলায় হায়া মিছেমিছি রেগে যায়। ইদানীং কথায় কথায় রাগ উঠে তার। সে আশিয়ানের দিকে ফিরে কপট রাগী গলায় বলে–

—আমি টমেটো? এখন আমাকে টমেটো, মুলা, কচুঘেঁচু কত কিছু যে লাগবে। পুরোনো হয়ে গিয়েছি না। যত্তসব! মুডের চৌদ্দটা বাজিয়ে দিল।

নিজের মতে বকেঝকে সেখান থেকে চলে যায় খাবারের ঘরে। আশিয়ান বেআক্কলের মতে বউয়ের বকা গুলো শুনল। বেচারা এটা বুঝতে পারল না সে খারাপ কি বলেছে, কত সুন্দর পাকা টশটশা টমেটোর সাথে তুলনা দিল। বউটা তো দিনকে দিন সেই লাল টকটকে টমেটোর চেয়েও বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। দেখলেই আদর আদর পায় আশিয়ানের। এটা বলাও কি দোষের?

আশিয়ানের নিজের জন্য এক আকাশ সমান মায়া হলো। মায়া দয়া একপাশে রেখে সেও যায় যায় খাবারের ঘরে। তারা আসতেই স্পর্শ তাদেরকে নাস্তা বেড়ে দেয়। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি সাথে মুরগির মাংস, আলু ভর্তা, শুটকি মাছের ভর্তা, পেয়াজ-শুকনা মরিচের ভর্তা, ডিম ভাজা। আশিয়ানরা কেউই সকাল সকাল এত ভারী খাবার তেমন একটা না খেলেও আজ এত টাটকা টাটকা খাবার আর বৃষ্টিমুখর ঠান্ডা পরিবেশে এমন ধোঁয়া ওঠা গরম গরম খাবার সকলেই পেটপুরে খায়।

হায়া খাবার নিয়ে প্রায়ই গাইগুই করলেও আজ সে বেশ অনেকখানি খাবার খায়। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আবরার এসে জানায় মি.মির্জা ঘুম থেকে উঠেছেন। তাদের সকলের সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে হালকা কিছু খেয়ে আবার একটু ঘুমান সে। তাকে ডাক্তার টেস্টে থাকতে বলেছেন। জাহান-মেহরিমা, আশিয়ান-হায়া তখনই ছুটে যায় তার রুমে।

তারা যখন মি.মির্জা রুমের দুয়ারে এসে হাজির হয় তখন একটা চোখজুড়ানো দৃশ্যের সাক্ষী হয়। মিসেস মির্জা চোখ গরম করে মি.মির্জাকে স্যুপ খাওয়াচ্ছেন। অসুস্থতার কারণে মি.মির্জা মুখের রুচি একদমই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, তেমন কিছুই খেতে পারেন না।

বৃদ্ধা মিসেস মির্জা চোখ গরম দিয়ে সবটুকু স্যুপ শেষ করে স্বামীর মুখটা মুছিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালে, দরজার কাছে নাতি-নাতনীদের দেখতে পান। তাদেরকে কেউ জানায়নি আশিয়ানদের আসার কথা।তিনি অবাক হয়ে যায় তাদের দেখে। বিশেষ করে আশিয়ানকে দেখে। আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর প্রিয় নাতিকে দেখে সে কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছে।

সে ধীরস্থির পায়ে আশিয়ানের সামনে এসে নিজের কুঁচকে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতটা দিয়ে আশিয়ানের গাল স্পর্শ করে। লম্বায় আশিয়ান পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মতো। স্বাস্থ্যও মাশা আল্লাহ নজরকাড়া। চেহারায় সুপুরুষ ভাবটা সে তার বাপ-দাদার কাছ থেকে পেয়েছে। একমাত্র নাতি হওয়ায় সকলে আশিয়ানকে মাথায় রাখত না উকুনে ধরবে বলে, মাটিতে রাখত না পিঁপড়ায় কামড়াবে বলে, এমনই আদরযত্ন করে বড় করা হয়েছে আশিয়ানকে।

মিসেস মির্জার চোখ ছলছল করে উঠে। সে ক্ষীণ গলায় ডেকে উঠে–

—আশিয়ান! তুই সত্যি সত্যি এসেছিস দাদুভাই?

আশিয়ান তার গালে থাকা দাদীর হাতের উপর হাত রাখে। তারপর সেই হাতটা নিজের মুখের কাছে এনে সেটায় আলতো করে একটা চুম্বন করে বলে–

—হ্যাঁ, দাদী আমি এসেছি। তোমার আশিয়ান এসেছে।

মিসেস মির্জা নাতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। তার কত শখের, ভালোবাসার নাতি আশিয়ান আজ এতগুলো বছর পর আবার ফিরে এসেছে তাদের কাছে।

_______________________________

ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে বেডের দিকে তাকালে আফিফের কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ে। একটু আগেও সে এখানে রাহাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছে, অথচ এখন নেই। কই গেলো মেয়েটা?

আফিফ ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রাখে। তারপর বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আনমনেই বেলকনিতে চলে যায়। তার অবচেতন মন কেন জানি বারবার করে বলছিল, রাহা এখানেই আছে।

বেলকনিতে এসে দেখা যায়, তার ধারণাই সঠিক। রাহা দোলনায় বসে ফোনে তার মায়ের সাথে কথা বলছে। মুখে তার এক চিলতে মিষ্টি হাসি। আর তার বাম হাতটা পেটের উপর রাখা, যেনো তার ভালোবাসার চিহ্নটিকে অনুভব করার ক্ষুদ্র প্রয়াস। আফিফ দরজায় হেলায় দিয়ে দাঁড়িয়ে রাহাকে দেখতে থাকে। সে এতদিন কত প্রেগন্যান্ট মহিলাকে দেখেছে। প্রেগ্ন্যাসির জন্য নারী দেহে অনেক হরমোনের বিকাশ ঘটে। এসব বিকাশের ফলে অনেকেই দেখতে আগের থেকে সুন্দর হয়ে যায় তো, অনেকের শরীর সেই বিকাশের ধাক্কা সইতে না পেরে দূর্বল হয়ে পড়ে।

রাহার প্রেগন্যান্ট হওয়ার খবর জানার পর থেকে আফিফ তার থেকে চোখ সরানোই বড্ড বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে। রাহা আগের থেকেই নজরকাঁড়া সুন্দরী ছিল, এখন তো মাতৃত্বের হাওয়া লেগেছে তার গায়ে। তার সৌন্দর্যে যেনে আশেপাশের পরিবেশও ঝলমল করে উঠছে।

আফিফ বেশ কিছুক্ষণ রাহাকে এক ধ্যানে দেখে তারপর আস্তে আস্তে করে তার সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। রাহা হুট করে তাঁকে দেখে খানিক চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। আফিফকে ইশারা করে পাশে বসতে বলে। আফিফ বসে তো ঠিকই কিন্তু তার পাশে না বরং রাহার পায়ের কাছটায়। সেখানে বসে নিজের মাথা এনে রাখে রাহার কোলে, চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করতে চায়। বুকের ভেতর যে তার ভালোবাসার ঝড় উঠেছে।

রাহা কথা বলতে বলতেই নিজের বাম হাতটা পেট থেকে সরিয়ে এনে আফিফের চুলের ভাঁজে ডুবিয়ে দেয়। বিলি কাটতে কাটতে আলতো হাতে টানতে থাকে তার চুল। আফিফের ভীষণ আরাম বোধ হয়। সে রাহার কোলে মাথা রাখা অবস্থায় শুনতে পায়, রাহা তার মা’কে বলছে–

—না আম্মু, এখন যাবো না। তোমরা কয়দিন এসে থেকে যাও না।

—…………..

—আমি চলে গেলে শ্বাশুড়ি আম্মু একদম একা হয়ে যাবে। আদিবারও তো বেবি হবে, ও একটু অসুস্থ দেখে আসতে পারবে না। তার মধ্যে যদি আমিও তোমার কাছে চলে যাই বেচারি একা ফিল করবে না?

—…….

—আসব তো। আদিবা একটু সুস্থ হয়ে এই বাড়ি আসুক, আমি তখম তোমার কাছে যাবো নে। কিন্তু এখন তো একেবারেই সম্ভব নয়।

আরো নানান কথা বলতে থাকে রাহা তার মায়ের সাথে। আফিফ তার এসব কথা শুনে মনে পড়ে যায় চারদিন আগের কথা, যখন কিনা তারা প্রেগ্ন্যাসির বিষয়টা প্রথমবারের মতো সকলকে জানিয়েছিল। একদিকে, মেয়ে মা হতে চলেছে। অন্যদিকে পুত্রবধূও সন্তানসম্ভবা। আফরার তো খুশি ধরে না।

রাহার প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে তার বাবা-মাও ছুটে আসে মাহমুদ ভিলায় প্রথমবারের মতো। রাহার মায়ের থেকে তার বাবাই বেশি কেঁদেছে মেয়ের সন্তান হওয়ার কথা শুনে। বড্ড আদরের কিনা মেয়েটা। ফেরার সময় রাহার বাবা-মা মেয়েকে নিজেদের সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব জানায়। আদিয়াত ও আফরা বিষয়টা রাহার উপরই ছেড়ে দেয়। এই সময়ের তার যেখানে ইচ্ছে থাকুক। বলাবাহুল্য, শ্বশুর বাড়ি বা বাবার বাড়ি কোথাও তার আদর যত্নে এক বিন্দুও কম হবে না।

রাহা শ্বশুর বাড়িতেই থেকে যায়। এতদিন পর প্রকৃত অর্থে বরের ভালোবাসা পাচ্ছে, এখনই সেই ভালোবাসা থেকে দূরে যেতে চায় না। আরো কিছুদিন বর থেকে তার প্রাপ্য ভালোবাসা নিয়ে তারপর না-হয় যাওয়া যাবে বাবার বাড়ি।

রাহার বাবার বাসায় না যাওয়ার সিদ্ধান্তে আফিফ সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। সেও চায় না এত তাড়াতাড়ি বউটাকে নিজের কাছ ছাড়া করতে।

আফিফের ধ্যান ভাঙে রাহার কোমল গলার ডাকে। রাহা বলছে–

—এই শুনছেন? ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি আবার? ঘুমাতে হলে রুমে গিয়ে ঘুমান।

আফিফ রাহার কোল থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। মেয়েটা বিড়ালের মতো পিটপিট করে তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে তাকিয়ে রয়েছে। স্নিগ্ধ, কোমল মুখখানা আদর দিয়ে লাল করে ফেলতে মন চাচ্ছে আফিফের। মন কিছু চেয়েছে আর আফিফ তা করবে না তা খুব কম হয়েছে। বিয়ের দিন রাহা অশ্রুসিক্ত মুখখানা দেখে তার মন বলে উঠেছিল, এই মেয়ের পাশে তোর থাকা উচিত আফিফ। বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, ভালোবাসার মানুষ হিসেবে। সেদিন মনের কথা শুনেই তো বিয়েটা করল। ভাগ্যিস করেছিল, নাহলে এত ভালোবাসা, এত সুন্দর অনুভূতির সাথে পরিচয় হতো কি করে।

আফিফ রাহার গাল নিজের হাত দ্বারা স্পর্শ করে। গম্ভীর অথচ প্রেমময় গলায় বলে–

—আমার একটা সিক্রেট শুনবে?

—কি?

—আমি আমার মস্তিষ্কের চেয়ে মনের কথা বেশি শুনি। এই মনটা কয়েকমাস আগে কোন একদিনে, এক অশ্রুসিক্ত বধূয়া সাজে সজ্জিত রমনীকে দেখে বলেছিল, আফিফ এই মেয়েটাকে তোর ভীষণ প্রয়োজন। তাকেও হয়ত তোর প্রয়োজন পড়বে জীবনের কোন একসময়। ভাবাভাবি বাদ দিয়ে তাকে নিজের নামে করে নে।

সেদিন মনের কথা শুনেই, বন্ধুর কাজিনের বিয়েতে গিয়ে সেই কাজিনের না হওয়া বউকে নিজের বউ করে নিলাম। ভাগ্যিস নিয়েছিলাম, নাহলে আমায় এত নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার জন্য কাউকে কি আদৌও খুঁজে পেতাম আমি?

রাহা আফিফের চোখে চোখ রেখে তার কথাগুলো শুনছে। তার স্মৃতির পাতায়ও সেদিনটা আবারও ভেসে উঠেছে। জাহান তাকে প্রত্যাখ্যান করে বিয়ের আসর ছেড়ে মেহরিমার কাছে চলে যাওয়ায় সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। অনেকটা ভেঙেও পড়েছিল। তারপর হঠাৎই আফিফের প্রস্তাবে অন্যদের মতো সে নিজেও অনেক অবাক হয়ে গিয়েছিল।

আফিফ সেই একই সুরে আবারও বলে–

—জানো, এই মুহুর্তেও আমার মন আমায় একটা কাজের নির্দেশনা দিচ্ছে।

—আর সেই কাজটা কি?

—সদ্য প্রেমে পড়া মনটা বলছে, ছিঃ আফিফ আজ সারাদিন বাসা থেকেও একবারের জন্যও বউটাকে আদর দিলি না। তোর বউয়ের চুপসে থাকা মুখখানা দেখে তোর কি একটু দয়ামায়া হচ্ছে না। তোর তো উচিত বাসায় থাকতে, উঠতে-বসতে বউকে আদর করা। এখনই আদর করার মিশনে নেমে পড়।

আর তোমায় তে আগেই বললাম, আমি আমার মনের কথা সব থেকে বেশি শুনি। তাই এই কথাটাও আমাকে অবশ্যই শুনতে হবে।

কথাটা শেষ করেই আফিফ নিচ থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর খুবই সাবধানে রাহাকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে হাঁটা লাগায়। রাহা প্রথমে লজ্জা পেয়ে ছটফট করলেও পরবর্তীতে আফিফের চোখে তাকে পাওয়ার জন্য আকুলতা দেখে রাহার সকল ছটফটানি দূর হয়ে যায়।

রুমে এসে রাহাকে আস্তে করে বেডে শুয়ে দেয়। দরজাটা ভিড়ানো ছিল দেখে ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে বউয়ের অতি নিকটে চলে আসে। রাহাও হাত বাড়িয়ে দেয় ভালবাসার পুরুষটির দিকে।

তাদের প্রথম কাছে আসাটা ছিল রাহার হুঁশহীন অবস্থায়। কিন্তু আজ তাদের কাছাকাছি আসার ক্ষণে আফিফ ও রাহা দু’জনই সম্পূর্ণ চেতনায় রয়েছে, এবং পূর্ণ ভালোবাসার সহিত একে অপরের কাছে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে।

দীর্ঘ সময়ের ওষ্ঠ ভালোবাসা শেষ করে আফিফ রাহার গলার থেকে ওড়না সরিয়ে দিয়ে সেখানে মুখ গুঁজে দেয়। খুচরো খুচরো ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে থাকে রাহার কাঁধ, গলার উন্মুক্ত অংশগুলো। রাহা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে থাকে তার প্রিয়তমের স্পর্শ গুলো।

তেমন একটা গভীর স্পর্শ না করেও রাহাকে স্বর্গসুখে ভাসিয়ে দিতে থাকে আফিফ। গলার থেকে মুখ উঠিয়ে এনে আফিফ এবার নিচে রাহার পেটের দিকে তাকায়। এই টুকুন একটা পেটে আরেকটা জান আছে। তার আর রাহার ভালোবাসার অংশ। আফিফ রাহার পেটের কাছে মুখ এনে জামার উপর দিয়েই উষ্ণ স্পর্শে ভরিয়ে দিতে। একটু শান্ত হয়ে কোমল গলায় বলে–

—আম্মু, এই প্রিন্সেস, তোমার আম্মুকে কিন্তু একটুও কষ্ট দিবে না সোনা, ঠিক আছে? তোমার আম্মু তো নিজেও ছোট, সেই ছোট আম্মুকে কষ্ট দিলে বাবা কিন্তু রাগ করব। তুমি না বাবার প্রিন্সেস, বাবার কথা শুনবে ঠিক আছে। তাহলে বাবা বড় হলে আমার মতো একটা সুন্দর ছেলের সাথে বিয়ে দিবো তোমার।

আফিফের লাস্টের কথাগুলো শুনে রাহা উচ্চস্বরে হেঁসে দেয়।

শব্দসংখ্যা~২০৪২
~চলবে?

ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স ]

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৬০

দুই হাত ভর্তি বাচ্চাদের জামাকাপড় নিয়ে বাসায় আসে রাহাত। মনটা আজকাল একটু বেশিই ফুরফুরে। আগে সবসময় মুখটা কেমন যেনো গম্ভীর করে রাখত। কারো সাথে প্রয়োজন ব্যতীত তেমন একটা কথা বলত না। হাসতও খুবই কম। সেই রাহাত নিজের ভোল পাল্টে ফেলেছে। কারণে-অকারণে হাসে মাঝে মধ্যেই, হুটহাট দুয়েক কথা বলে চমকে দেয় ইদানীং তার সঙ্গিনীকে। মুনতাহা বেশ অবাক হয় বটে স্বামীর এমন আচরণে, কিন্তু আগের মতো তেমন একটা উৎসাহ দেখা যায় না তার মধ্যে।

রাহাত আজ বিকেলের দিকেই বাসায় এসে পরেছে। নানা হবে শুনে তার খুশির অন্ত নেই। তার ছোট্ট রাহা যে কিনা দুইদিন আগেও তার হাত ধরে রাস্তা পাড় হতো, সে অফিসে যাওয়ার সময় তার কোলে চড়ে বায়না করত অফিসে যাওয়ার, সেই রাহা মা হতে চলেছে। রাহাত এতটা খুশি তখন হয়েছিল, যখন রাহা তার ঘরে আলো করে এসেছিল। আজ এতগুলো বছর পর আবার হলো।

রাহাত শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে গুনগুন করতে করতে রুমে ঢুকে। নিচে হেল্পিং হ্যান্ড মহিলার থেকে শুনে এসেছে মুনতাহা নাকি রুমেই আছে, কিন্তু সে রুমে এসে মুনতাহাকে পায় না। সে অনেক এক্সাইটেড হয়ে আছে মুনতাহাকে তার আনা বেবিদের কাপড়গুলো দেখানোর জন্য। কিন্তু রুমে এসে সে মুনতাহাকে কোথাও পায় না।

রুম খালি দেখে রাহাতের কপালে কয়েকটা ভাজ পড়ে। সে শপিংব্যাগ গুলো সোফার উপর রেখে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে পায় মুনতাহাকে। সে ছোট ছোট নকশিকাঁথা সেলাই করছে দিনের আলোতে বসে।

মুনতাহা একধ্যানে কাজ করছিল বলে সে রাহাতের উপস্থিতি টের পায় নি। রাহাত নিজের উপস্থিতি জানানোর জন্য তাঁকে ডেকে উঠে–

—মুন, এসব কি করছো?

আকস্মিক ডাকায় মুনতাহা চমকে যায় আর একটা দু”র্ঘটনা ঘটে যায়। মুনতাহার হাতে সূঁচ ঢুকে যায়। মুনতাহা ব্যথায় “আহ” করে উঠে। রাহাত তার আর্তনাদ শুনে হন্তদন্ত হয়ে এসে মুনতাহার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। চিন্তিত ভঙ্গিতে মুনতাহার হাতটা টেনে নিয়ে বলে–

—কি যে করো না তুমি? সাবধানে কাজ করবে না একটু। কতটা রক্ত বের হচ্ছে। চলো এক্ষুনি রুমে চলো।

বকতে বকতেই রুমে নিয়ে আসে সে মুনতাহাকে। মুনতাহাকে বেডে বসিয়ে নিজে তাড়াতাড়ি ফার্স্টএড বক্স নিয়ে এসে মুনতাহার ব্যথা জায়গাটায় স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে থাকে। মুনতাহা আর একটা টু শব্দ করে না। এমন দৃশ্য তার কাছে নতুন কিছুই না তাদের ২৫-২৬ বছরের সংসারে। রাহাত তার কেয়ার করে না এমন না, স্ত্রী হিসেবে, তার সন্তানদের মা হিসেবে যথেষ্ট কেয়ার করে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষ হিসেবে না। সেই জায়গাটা তার কখনো ছিল না, আজও হয়ে উঠেনি, মনে হয় না ভবিষ্যতেও হয়ে উঠবে।

মুনতাহার আঙ্গুলে ছোট একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে রাহাত তার দিকে তাকালে, দেখতে পায় মুনতাহা তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাহাত তাকে প্রশ্ন করে উঠে–

—কি দেখছো এভাবে?

রাহাতের প্রশ্নে মুনতাহার ধ্যান ভঙ্গ হয়। সে রাহাতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করে–

—আজ এত তাড়াতাড়ি আসলেন যে? শরীর খারাপ করেছে?

—না, তেমন কিছুই না। অফিসে তেমন একটা কাজ ছিল না বলে একটু শপিংমলে গিয়েছিলাম শপিং করতে।

—ওহহ্, আচ্ছা। ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি নাস্তা বানাচ্ছি বিকেলের।

মুনতাহা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গলাগুলো বলে রাহাতকে রেখে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কাবার্ডের কাছে চলে যায় রাহাতের বাসা পরা জামাকাপড় নেওয়ার জন্য। রাহাত তার এত নির্লিপ্ততা দেখে অবাক হয়, সেই সাথে কষ্টও পায়। ইদানীং সে খেয়াল করেছে মুনতাহা তার সাথে তেমন একটা কথা বলে না, আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না বা আহ্লাদ দেখায় না। মনের দুরত্ব তাদের আগে থেকেই ছিল, এখন সেটা চোখেও ধরা মতো দুরত্বে পরিণত হয়েছে।

রাহাত মলিন গলায় বলে–

—কি শপিং করেছি দেখতে চাইবে না মুন?

মুনতাহা জামাকাপড় বের করে তার দিকে আসতে আসতে বলে–

—আপনার দেখাতে ইচ্ছে হলে দেখান।

—তোমার ইচ্ছে নেই দেখার?

—তেমন না বিষয়টা, আসলে…..

—বুঝতে পেরেছি, আর কিছু বলা লাগবে না।

রাহাত কথাটা বলে মুনতাহার হাত থেকে একপ্রকার থাবা দিয়ে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। মুনতাহা কয়েক পল ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর একটা হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলো নিচে চলে যায়।

_____________________

—কিরে মেঘলা তুই রান্ধন ঘরে কি করতাছোস? তোরে কইছি না যেই কয়টা দিন তুই এই বাড়িতে আছোস, তোরে রান্ধন ঘরে আসা লাগব না। চুলার ধোঁয়ায় মুখ আরো কালা হইয়া গেলে, বিয়ার দিন তোরে সুন্দর লাগব না।

মেঘলার পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলে মেঘলার ছোট চাচী শান্তা। হ্যাঁ, মেঘলার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেটাও কার সাথে জানতে চান? পাত্র হলো, শান্তার সেই অসভ্য ভাইপো তন্ময়। সেদিন তন্ময়ের বাবা-মা আসল না, ঐদিন তারা এসেছিল মেঘলার জন্য তন্ময়ের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে। তন্ময় নাকি শহরে একটা ভালো চাকরি পেয়েছে, মেঘলাকে তার মনে ধরেছে। ছেলেটা তার বাবা-মাকে মেঘলাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। শান্তা তো এমন প্রস্তাব শুনে প্রথমে একটু নাখোশই হয়। তারপর ভাবে আর কতকাল অন্যের মেয়েকে নিজেরা পালবে, বিয়ের সম্বন্ধ নিজ থেকে যখন এসেছে তখন দিয়ে দেওয়া ভালো হবে। মেঘলার ছোট চাচা এনামুল প্রথমে রাজি হয় না, ভাইজির প্রতি তার যথেষ্ট টান রয়েছে। সে অমত করে বলে–

—মেঘলার আঠারো বছর না হওয়া পর্যন্ত সে মেঘলাকে বিয়ে দিবে না।

কিন্তু মেঘলার ছোট চাচী কেমনে কেমনে তাকে মানিয়ে ফেলে বিয়ে করার জন্য। সবাই সেদিনই মেঘলার ও তন্ময়ের বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেলে। অথচ কেউ একবার মেঘলাকে জিজ্ঞেসটুকু অব্দি করে না, সে এই বিয়েতে রাজি কিনা? তার কোন পছন্দের মানুষ আছে কিনা?

মেঘলা এসব জানতে পারে পরের দিন। সে এই বিষয়ে তার বৃদ্ধা দাদীর কাছে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। মেঘলার চাচী সেটা শুনে ফেলে, তারপর তাকে আলাদা একটা খালি কক্ষে নিয়ে গিয়ে অনেক কথা শোনায়। সে মেঘলাকে বলে–

—তুই এত অকৃতজ্ঞ কেন রে মেঘলা? এতদিন ধরে আমাদের খাচ্ছিস, আমাদের পরছিস এখন আমাদের কথারই অমান্য করতে চাচ্ছিস? তোর সাত পুরুষের ভাগ্য আমার ভাইপোয়ের সম্বন্ধ তোর জন্য আসছে, নাহলে তোদের যোগ্যতা আছে আমার পরিবারের সাথে আত্নীয়তার সম্পর্ক করার? শুন মেঘলা, ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে এই বাড়ি থেকে বিদেয় হবি, নাহলে তোর জন্য বেশি একটা ভালো হবে না। তোর যদি সামান্য কৃতজ্ঞতা বোধ থাকে তাহলে বিয়ে টায় আর ব্যাগড়া দিবি না।

বি”ষমিশ্রিত কথার বান দিয়ে খুব বাজেভাবে আ”ঘা”ত করে। এত সব কথা শোনার পর মেঘলার আর কিছু বলার থাকে না। সে মৃত ব্যক্তির ন্যায় সকলের সকল কাজে সম্মতি দিতে থাকে।

শান্তা আহ্লাদ করে মেঘলার হাত টেনে ধরে বসা থেকে ওঠায়। তারপর নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মেঘলার কপালে বেয়ে চুইয়ে পড়া ঘাম মুছে দিতে দিতে বলে–

—যা ঘরে গিয়ে একটু রেস্ট নে। জান্নাত তোকে নিয়ে বিউটি পার্লারে যাবে দুপুরের খাবার খেয়ে। সেখান থেকে ফেসিয়াল করে দুই বোনে ঘুরেফিরে বাসায় আসিস।

জান্নাত শান্তার মেয়ে। মেঘলা আর সে সমবয়সী। জান্নাত মেঘলার চেয়ে দুই মাসের বড়। মেঘলারা মফস্বল শহরে থাকে। আগে গ্রামে নিজেদের পৈত্রিক বাড়িরতে থাকলেও ব্যবসার কাজে তার চাচাদের প্রায়ই শহরে আসতে হতো বলে, মেঘলার বাবা-মা মারা যাওয়ার বছর দুয়েক পরেই তারা মফস্বল শহরে এসে একটা বাড়ি করে।

মেঘলা মলিন গলায় বলে–

—এসব ফেসিয়াল টেসিয়ালের কোন দরকার নেই চাচী।

—কে বলেছে দরকার নেই? অবশ্যই আছে, কোন কথা বলবি না। যা গিয়ে রেস্ট নে।

শান্তা মেঘলাকে তার ঘরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মেঘলা তার ঘরে না গিয়ে তাদের বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে। পুকুরের ঘোলা পানির দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকার সময় টুপ করে একফোঁটা পানি বের হয় মেঘলার চোখ থেকে।

_________________________

আশিয়ান তার দাদীকে আগলে ধরে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। চোখে অপরাধবোধ ও অনুশোচনা নিয়ে দাদার দিকে তাকালে দেখতে পায় মি.মির্জা প্রিয় নাতনীকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছেন। হায়াও গুনগুনিয়ে কাঁদছে। বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর হায়া মি.মির্জা পাশ থেকে উঠে গিয়ে আশিয়ানকে বসার জায়গা করে দেয়।

আশিয়ান তার পাশে বসে মি.মির্জা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। আশিয়ান তার পাশে বসার সাথে সাথে মি.মির্জা নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। বিষয়টা উপস্থিত সকলে খেয়াল করে। আশিয়ান ধরে আসা গলায় বলে–

—কেমন আছো দাদাভাই?

—আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?

—তোমায় এই অবস্থায় দেখে কি করে ভালো থাকতে পারি বলো। একটুও ভালো নেই আমি, আমরা।

—আমার জন্য তুমি খারাপ থাকবে কেনো? তোমার কিছু হই নাকি আমি, যে আমার শরীর খারাপ দেখে তুমিও ভালো থাকবে না?

—অবশ্যই হও। তুমি আমার দাদাভাই, আমার শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনার সাথী। মায়ের মার, বাবার বকা থেকে রক্ষা করা সেই ভালোবাসার মানুষটি। দাদাভাই, ও দাদাভাই! তুমি আমার উপর আর রাগ করে থেকে নিজেকে কষ্ট দিও না দাদাভাই।

মি.মির্জা নিজের হাতটি আশিয়ানের হাতের থেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু পারে না, আশিয়ান তার হাত ছাড়ে না। মি.মির্জা নিজের হাত ছাড়ানোর প্রয়াস ত্যাগ করে গম্ভীর থমথমে গলায় বলে–

—আমার তোমার উপর কোন রাগ নেই। আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম যে, তোমার নিজেরও আলাদা পছন্দ থাকতে পারে। কিন্তু তুমি এই কথাটা আমায় সরাসরি বলতেই পারতে, বিয়ের আসরে না এসে আমার নাতনীটাকে ওমন ভাবে অপমান না করলেও পারতে। তার তো কোন দোষ ছিল না। আমাদের সকলের জন্য তুমি আমার নাতনীটাকে এমনভাবে কষ্ট দিলে, এটা ভেবেই আমার তো মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।

মি.মির্জা চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে নিঃশব্দে। আশিয়ানের চোখেও অশ্রু। তার একটা হটকারি সিদ্ধান্ত তার পুরো পরিবারকে ভুগিয়েছে, অপমানিত-অসম্মানিত করেছে।

আশিয়ান একটা ঢোক গিলে নিয়ে বলে–

—ছোট ছিলাম তো ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু সেটা সুধরেও নিয়েছি। তখন না বুঝতে পারলেও এখন বুঝতে পারছি তুমি সবসময়ের মতো এইবারও আমার জন্য বেস্ট মানুষকে ঠিক করেছিলে। (একহাত দিয়ে মি.মির্জা হাত ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে হায়াকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে তার হাত ধরে কথাটা বলে আশিয়ান) আমি জানি, সেই কষ্টের সময়, সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু ভবিষ্যতে তোমাদের অভিযোগের কোন সুযোগও দিব না।

লাস্ট বারের মতো মাফ করে দাও না দাদাভাই। আমাদের সাথে চলো না ঢাকায়। আমার উপর রাগ করে নিজেকে আর শাস্তি দিও না। তোমরা দু’জন এখনও আমাদের মাথার উপর বটগাছের মতো ছায়া দাও। কিন্তু আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আমার পুরো পরিবার সেই বটগাছের ছায়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মি.মির্জা প্রাণভরে প্রিয় নাতি-নাতনীকে দেখেন। বিয়ের পর সব মেয়ের মতোই হায়ার সৌন্দর্যও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। আশিয়ান ও হায়াকে পাশাপাশি অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে। তার জীবনের শেষ ইচ্ছে ছিল আশিয়ান-হায়াকে এমনভাবে পাশাপাশি দেখা। আজ সেটাও পূরণ হলো। এখন বোধহয় সে শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে পারবেন।

মি.মির্জা বিরবিরিয়ে বলেন–

—মাশা আল্লাহ।

কতক্ষণ একধ্যানে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলেন–

—আশিয়ান, আমার আদরের দাদুভাই। আমাদের বংশের পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম সন্তান হওয়ায় তুমি সর্বদা অন্যদের থেকে তুমি একটু বেশিই প্রিয় ছিলে। ছিলে কি এখনও আছো, এবং আজীবন থাকবে। আমি তোমার কাজে একটু কষ্ট পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু পরবর্তীতে যখন বুঝতে পারি, জীবনটা তোমার, সংসার করবে তুমি, সেখানে তোমার জীবনসঙ্গী পছন্দ করে দেওয়ার আমরা কেউ নই। তারপর থেকে আর কোন কষ্ট বা রাগ নেই তোমার উপর। আর যেখানে কোন রাগ নেই সেখানে শাস্তি দেওয়ার কথা আসছে কেনো?

আমি আমার জীবনের শেষ কয়েকটা দিন এই বাড়িতে, আমার জন্মস্থানে থাকতে চাই। আর অসুস্থতার কথা বলছো? আমার বয়স দেখেছো? এই বয়সে বেশিরভাগ মানুষ কবরে থাকে, সেখানে আমি আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি।

কথাগুলো হাসি হাসি মুখেই বলে মি.মির্জা। আশিয়ানসহ সকলেই বুঝে যায় মি.মির্জা নিজের জেদে অটল। আশিয়ানও এবার জেদী গলায় বলে–

—তুমি জেদ করছো তো দাদাভাই, ঠিক আছে। তুমি যদি জেদী হও, আমিও তোমার নাতি। তোমাদের না নিয়ে আমি এই গ্রাম ছাড়ছি না। গেলে তোমাদের নিয়েই যাবো, না হয় সারাজীবনের জন্য এখানেই থাকব। এই আমি বলে দিলাম।

কথাটা বলে আশিয়ান রুম থেকে বের হয়ে যায়। মি.মির্জা তার প্রস্থানের পথে চেয়ে মৃদু হেঁসে ওঠে।

~চলবে?