#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_৬৩+সমাপ্ত
সকালেবেলা সকালে ফোনের রিংটোনের আওয়াজে আশিয়ানের ঘুমটা। কিন্তু ফোনটা সে রিসিভ করে না। ভাবে বাজতে বাজতে একা একাই কেটে যাবে। প্রচন্ড বলে বিরক্তি নিয়ে সেইভাবে শুয়ে থাকে হায়াকে বুকে নিয়ে। মাথার দুইপাশের রগগুলো ব্যথায় দপদপ করছে তার। কেনো? গত দুটো দিন ধরে তার পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম হচ্ছে না।
সেদিনের জ্বরে হায়া অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঔষধও কাজ করছে না ঠিক মতো। চার ঘন্টা না হতেই গা কাঁপিয়ে পুনরায় জ্বর আসছে। সাথে তো বমি আছেই। দুই দিনেই হায়ার গোলগাল মুখশ্রীখানা আমসত্ত্বের ন্যায় চুপসে গিয়েছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। সকলে তার এমন অসুস্থতায় বেশ চিন্তিত। জাহান ধারনা করছে এটা কোন সাধারণ জ্বর নয়।
কল খানা বাজতে বাজতে কেটে গেলে আশিয়ান হায়াকে জড়িয়ে ধরে আবারও ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। তার নিজেও এতটা খারাপ লাগছে যে, ফোনটা নিয়ে যে সাইলেন্ট করবে সেইটুকু শক্তিও পাচ্ছে না। ফোনটা আবারও বাজতে শুরু করে। এবার আশিয়ান কলটা রিসিভ করার সিদ্ধান্ত নেয়। চোখ বন্ধ করেই হাতড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে কলটা রিসিভ করে।
কানে লাগালে শুনতে পায় ভার্সিটি থেকে কল করেছে। তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় আগামী পরশুর মধ্যে তাকে ভার্সিটিতে উপস্থিত হতে হবে। জরুরি একটা মিটিং ডাকা হয়েছে, সেখানে সব শিক্ষকদের উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় ঘটলে সেই শিক্ষকের চাকরি নিয়ে টানাটানি লেগে যেতে পারে।
এমন একটা নির্দেশনা আশিয়ানের উপর যেনো মরার উপর খরার ঘা। তার জেদি দাদাভাই এখনও রাজি হয়নি তাদের সাথে ফিরে যেতে। বউটা এমন অসুস্থ হয়ে বিছানাগত, এখন আবার এমন একটা কঠোর নির্দেশনা। আশিয়ান যেনো অকুল পাথারে পড়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই আশিয়ানের চোখে আবারও ঘুম নেমে আসে।
বেলা এগারোটার দিকে আশিয়ানের ঘুম ভাঙে, তাও আবার বুকের উপর প্রচন্ড তাপ অনুভব করে। ঘুমের ঘোরেই হায়ার কপালে হাত রাখলে বুঝতে পারে, তাপ টা হায়ার গায়ের। আশিয়ান আর শুয়ে থাকতে পারে না, চোখ মেলে তাকায় সে। হায়ার আবারও জ্বর এসেছে। ভোর বেলাতেই ঔষধ খাইয়েছিল। হায়ার জ্বরটা একটু কমতেই সেও ঘুমিয়েছিল। এখন আবার জ্বর এসেছে।
আশিয়ান আলতো হাতে হায়াকে বালিশে শুয়ে দিয়ে নিজে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর হায়াকে অনেক কষ্টে ফ্রেশ করিয়ে এনে নাস্তা করিয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়। হায়ার পাশে মেহরিমা কে রেখে সেও নাস্তা করে আবারও তার কাছে এসে বসে বসে মাথা জলপট্টি দিতে থাকে। হায়া একধ্যানে আশিয়ানকে দেখতে থাকে। লোকটা এই দুই দিন নিজের নাওয়াখাওয়া ভুলে তার খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। লোকটা একদিকে যেমন মানসিক অশান্তিতে ভুগছে, অন্যদিকে শারীরিক পরিশ্রমও হচ্ছে বেশ। চোখে-মুখে অসম্ভব ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
হায়ার মাথার পট্টিটা বাটিতে রাখা পানি ভিজিয়ে চিপে হালকা পানি রেখে পট্টিটা আবারও তার কপালে রাখে, তখনই আশিয়ান লক্ষ্য করে হায়া না ঘুমিয়ে তার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে। আশিয়ান তার হালকা ভেজা হাতটা দিয়ে হায়ার বাম গাল স্পর্শ করে। সে কি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ স্পর্শ, হায়া অনুভব করতে পারে। ভালোবাসার মানুষটির উপস্থিতি আমাদের যেমন স্বস্তি দেয়, তেমনি তাদের স্পর্শও আমাদের স্বর্গসুখ দেয়। ভালোলাগার আবেশে চোখ বন্ধ করে নিজের গালটা এলিয়ে দেয় আশিয়ানের হাতের উপর।
আশিয়ান তাঁকে ধীমী গলায় জিজ্ঞেস করে–
—খারাপ লাগছে জান?
হায়া চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দেয়–
—উহু।
তারপর তাদের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ তেমন কোন কথা হয় না। একটু পর হায়া নিজে থেকেই বলে–
—আমার জন্য আপনাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়, তাই না আশিয়ান?
তার গলা কাঁপছিল প্রশ্নটি করতে। নিজেকে কেমন অপরাধী লাগছে তার আশিয়ানকে এত কষ্ট দেওয়ায়। আশিয়ান তার প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, প্রশ্নটা তার পছন্দ হয়নি।
আশিয়ান গমগমে গলায় বলে–
—তা পড়তে হয় ঠিকই। কিন্তু…..
আশিয়ানের কথা শুনে হায়া চোখ মেলে তাকায়। বলে–
—কিন্তু???
—আমার জানের জন্য আমি সকল ধরণের ঝামেলায় জড়াতেই পারি, তুমি এসব বলার কে মেয়ে? আমার বউ, আমার ভালোবাসার নারী, আমার হায়ার জন্য আমি সব ঝামেলায় নিজেকে জড়াবো তাও আবার স্বাচ্ছন্দ্যের সহিত। এতে তুমি তাকে প্রশ্নের কাঠ গোড়ায় দাঁড় করাতে পারো না। এত সাহস আমি তোমাকে দেই নি।
আশিয়ানের কথাগুলো শুনে হায়ার চোখ ছলছল করে উঠে। লোকটা এত কেন ভালোবাসে তাকে? তার যে ভীষণ ভয় হয়। ভয় হয় এই কারণে, যদি আশিয়ানের এই ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে? কোন ঝড় এসে যদি তাদের আলাদা করে দেয়? তখন হায়া কিভাবে থাকবে? হায়া মরে যাবে, আশিয়ানকে ছাড়া একদম মরেই যাবে সে।
হায়ার চোখে পানি থেকে আশিয়ান বিচলিত হয়ে পড়ে। অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে–
—জান, বেশি খারাপ লাগছে? কোথায় খারাপ লাগছে বলো আমায়?
হায়া কাঁথার নিচ থেকে নিজের হাতটা বের করে বুকের বাম পাশে রেখে বলে–
—এখানটায়। আপনি একটু এখানে নিজের মাথাটা রাখবেন আশিয়ান?
হায়ার দেখানো জায়গাটায় আশিয়ান নিজের মাথা রেখে তারউপর নিজের হালকা ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে। আশিয়ান শুতেই হায়া তাকে অক্টোপাসের মতো পেচিয়ে ধরে নিজের সাথে, নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে। আশিয়ানও তাকে জড়িয়ে ধরে। হায়া ভেজা গলায় বলে–
—আশিয়ান, আপনি কখনো পরিবর্তন হয়ে যেয়েন না প্লিজ। সবসময় এমনভাবে আমায় ভালোবেসেন। আপনি যদি কখনো আমায় কম ভালোবাসেন, বা ইগনোর করেন আমি সহ্য করতে পারব না একদমই।
আশিয়ান আস্তেধীরে হায়ার বুকের উপর থেকে মাথা তুলে তার গলায় মুখ গুঁজে দেয়। ছোট ছোট আদরে জায়গাটা সিক্ত করে দিতে দিতে বলে–
—নিজের জানের মায়া কি কেউ কখনো না করে থাকতে পারে বলো? ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে কিছুটা হলেও কমে যায়, কিন্তু মায়া? সে তো সময়ের সাথে সাথে আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তোমায় যে আমি জান সম্বোধন করি, সেটা তুমি কি ভেবেছো আর পাঁচটা টিনেজারদের মতো? জ্বি না, তোমার মধ্যে, এই জেসমিন তালুকদার হায়ার মাঝে আশিয়ান মির্জা জান লুকিয়ে আছে। হায়া আছে তো আশিয়ান মির্জা ভালো আছে, হায়া নেই আশিয়ান মির্জাও দুনিয়া ত্যাগ করার কারণ পেয়ে গিয়েছে।
আশিয়ানের কথা ও স্পর্শগুলো হায়াকে শান্ত করে। বুকের ভেতরের ঝড়টা কমে যায় নিমিষেই।
___________________________
সন্ধ্যায় সকলে মি.মির্জার রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। আশিয়ানই সকলকে ডেকেছে কিছু একটা বলবে বলে। হায়া এসে দাদুর পাশে বসেছে। একটু পর মেহরিমা গরম তেলের বাটি নিয়ে এসে মিসেস মির্জাকে দিয়ে জাহানের পাশে এসে দাঁড়ায়।
আশিয়ান সকলকে এক পলক দেখে নিয়ে বলতে শুরু করে–
—আমি তোমাদের একটা জরুরি কথা জানাতে এখানে ডেকেছি। কথাটা হলো, আজ সকালে ভার্সিটি থেকে আমায় ফোন দিয়েছিল। আমাকে পরশুর মধ্যে উপস্থিত থাকতে বলেছে। যদি উপস্থিত না হতে পারি তাহলে আমার চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তার কথা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে যায়। আবরার ছেলেকে বলে–
—মানে কি? তুমি না দশদিনের ছুটি নিয়েছিলে? তাহলে হঠাৎ করে এত জরুরি তলব?
—হুম, কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্টে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, এবং আমি না গেলে সমাধানও সম্ভব নয়। তাই এত জরুরি তলব। আর হায়াও কয়েকদিন ধরে বেশ অসুস্থ, বিষয়টা তোমাদের অজানা নয়। সাধারণ ওর এমন জ্বর কমই আসে। মাম্মামের (হানিয়া) থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি। ওর এই অসুস্থতা আমায় ভাবাচ্ছে, রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আমি ওর এই অসুস্থ মুখখানা দেখে অস্বস্তির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমি চাচ্ছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় গিয়ে ওর ট্রিটমেন্ট শুরু করাতে।
সবাই আশিয়ানের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায়। সে যে হায়ার প্রতি কতটা পসেসিভ সেটা তার কথার ভাঁজে জমে থাকা অস্থিরতাই বলে দিচ্ছে। মি.মির্জা প্রসন্ন হয় হায়ার প্রতি আশিয়ানের এত ভালোবাসা দেখে।
তারপর গম্ভীর গলায় বলে–
—হুম, সেটা করাই উত্তম হবে। তোমরা তাহলে ব্যাগপত্র গুছাতে শুরু করে দাও। কবে যাচ্ছো?
মি.মির্জা কথা শুনে সকলেই বুঝে যায় সেও নিজের পূর্বের জেদে অটল। আশিয়ান ঠান্ডা গলায় বলে–
—তোমরা যাচ্ছো না বলে বলো, আমরা যাচ্ছি কবে। আমি একবার বলেই দিয়েছি তোমাদের না দিয়ে আমি গ্রাম ছাড়ব না।
—আশিয়ান জেদ ধরো না। আমরা শুধু শুধু শহরে গিয়ে কি করব? তার চেয়ে এখানেই বেশ ভালো আছি। শহরে কেমন বন্দি বন্দি লাগে। আর গ্রামে, এখানে ঘর থেকে বের হলেই কত চেনাপরিচিত মুখের দেখা মিলে। তোমরা এবারের মতো চলে যাও, পরে ছুটি নিয়ে আবার বেশিদিনের জন্য এসো না হয়।
আশিয়ান তার কথা সাফসাফ মানা করে বলে–
—একবার যখন বলেছি, তোমাদের না নিয়ে যাবো না। মানে আমি যাবো না। লাগলে চাকরি ছেড়ে দিব। আর হায়াকে জাহানদের সাথে পাঠিয়ে দিব। আমিও দেখি তুমি কতদিন জেদ ধরে বসে থাকতে পারো। তুমি যদি জেদী দাদাভাই হও, আমিও তোমার নাতী।
এখন বলো, তুমি যাবে কিনা আমাদের সাথে? নাহলে আমি কল করে ভার্সিটিতে জানিয়ে দিচ্ছি, আমি পরশু উপস্থিত থাকতে পারব না আর চাকরিটাও কন্টিনিউ করব না। সব সিদ্ধান্ত এখন তোমার হাতে দাদাভাই।
আশিয়ানের কথা শুনে আবরার এতক্ষণে মুখ খুলে। সে আশিয়ানের কাছে এগিয়ে এসে বলে–
—তোমার এত শখের টিচিং প্রোফেশন, সেটা তুমি ছেড়ে দিবে?
আশিয়ান তার বাবার দিকে তাকিয়ে মলিন হেঁসে বলে–
—এই চাকরিটা আমার শখের হতে পারে, কিন্তু পরিবারটা আমার ভালোবাসার। আমি তো জানি, তুমি দাদাভাই আর দাদুমনিকে কতটা মিস করো। খাবারের টেবিলে বসে বারবার চোখ ঘুরিয়ে তাদের বসার জায়গাটা দেখো। তোমার বাবা-মা জীবিত থেকেও আমার জন্য আজ দূরে। এই অপরাধবোধের গ্লানি আমি আর টানতে পারছি না। হয় তারা আমাদের সাথে যাবে, না হয় আমি সারাজীবনের জন্য এখানে শিফট করে নিবো।
আশিয়ানের কথার উপর আবরার আর কিছু বলতে পারে না। আশিয়ান হায়াকে ধরে দাঁড় করায়। তারপর রুম ছেড়ে যাওয়ার আগে বলে–
—যে সিদ্ধান্ত নিনে বিকালের আগেই বলে দিও। আমায় আবার ভার্সিটিতে জানাতে হবে।
কথাটা বলে হায়াকে ধরে আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করে। তারা দু’জন যখন রুমের চৌকাঠ পাড় হবে তখনই মি.মির্জা দৃঢ় গলায় বলে–
—দাঁড়াও আশিয়ান।
মি.মির্জার কণ্ঠস্বর শুনে সকলে তার দিকে তাকায়। আর আশিয়ান নিজের বিজয়ের হাসি হাসে। মি.মির্জা সকলকে আদেশের সুরে বলেন–
—সবাই নিজেদের ব্যাগ গোছাতে থাকো। কাল সকালে ইনশা আল্লাহ রওনা হবো। আজ পাড়াপ্রতিবেশি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে তাই যাওয়া হবে না।
তার কথা শুনে উপস্থিত সকলের মুখ আনন্দে চকচক করে উঠে।
_____________________
রুমের বাহির থেকে কয়েকজন মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে আশিয়ানের কপালে ভাজ পড়ে। ফোনের পাওয়াঅন বাটান প্রেস করে সময় দেখে নেয়। দশটা বাজতে চলেছে। গ্রামে এই সময়টাকে মাঝরাতই ধরা হয়। এতরাতে আবার কে আসল তাদের বাড়িতে ভেবেই পূর্বের ভাজ গুলো আরেকটু গাড়ো হলো।
হায়াকে বুকের থেকে আস্তে করে সরিয়ে বালিশে শোয়াতে গেলে, হায়ার ঘুম ভেঙে যায়। হায়া ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বলে–
—ক্ষুধা পেয়েছে আশিয়ান।
এই কথা শুনে আশিয়ান হায়াকে শুয়ে দিয়ে বসে। তারপর হায়াকে বসায়। চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে দিয়ে ফ্রেশ করিয়ে এনে ঘরে আগের থেকে এনে রাখা খাবারগুলো খাইয়ে দিতে থাকে। হায়া কোন মতে পাঁচ ছয় লোকমা খেয়ে আর খায় না। আশিয়ানও জোর করে না খেতে। খাওয়া শেষ হলে হায়া আশিয়ানকে জিজ্ঞেস করে–
—বাহির থেকে এত মানুষের কথা বলার আওয়াজ আসছে কেনো? সবাই কি ঘুমায় নি?
আশিয়ান কাঁধ নাচিয়ে বলে–
—জানি না তো,আমি যে সেই সন্ধ্যায় তোমার সাথে ঘরে ঢুকেছি, তোমাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে আমি নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আম্মু খাবারটা দিয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙার পরও তোমারে সাথেই শুয়ে ছিলাম।
—ওহ্হ। তাহলে চলুন তো দেখে আসি বাহিরে কি হচ্ছে।
—যাবে? মাথা ঘুরাচ্ছে না তো? নাহলে তুমি থাকো, আমি গিয়ে দেখে আসি।
—না ঘুরাচ্ছে না মাথা। আমিও যাবো চলেন।
কথাটা বলে হায়া খাট থেকে নেমে আগেই হাঁটা ধরে। আশিয়ান তার পরনের টি-শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে তার সাথে পা মেলায়। ঘরের দরজা খুলে বাহিরে এসে কয়েক কদম আগাতেই হঠাৎই অচেনা একজন হুমড়ি খেয়ে আশিয়ানের উপরে এসে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় আশিয়ান থতমত খেয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।
হায়া তার দূর্বল হাতে আশিয়ানকে ধরে ফেলে। ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বলে–
—ঠিক আছেন?
আশিয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে বলে–
—হ্যাঁ।
এতক্ষণে সেই আগন্তুকও নিজেকে সামলে নিয়েছে। মেয়েটি ভালো করে দাঁড়াতেই তার মুখটা আশিয়ান-হায়ার কাছে স্পষ্ট হয়।
—মেঘলা?
—মেঘলা?
দুইজন একসাথেই বলে উঠে। হ্যা মেয়েটি মেঘলা। সে বিয়ের থেকে পালিয়ে এসেছে। শাড়ি সামলাতে না পারার কারণে বিয়ে থেকে যখন পালাচ্ছিল তখন এদিক ওদিক কয়েল জায়গা থেকে শাড়ি খুলে গিয়েছে। এখন হাটতে গিয়ে পায়ের সাথে পেঁচিয়ে পরে যায় আশিয়ানের উপর।
মেঘলা তার ভাঙা গলায় বলে–
—দুঃখিত ভাইয়া। আমি ইচ্ছে করে পরি নি।
আশিয়ান বলে–
—ইটস ওকে। কিন্তু তুমি এখানে কি করছো এত রাতে? আজ না তোমার বিয়ে?
আশিয়ানের করা প্রশ্নটা শুনে মেঘলার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মেঘলাকে কাঁদতে দেখে হায়া ও আশিয়ান একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। এরই মাঝে আবরার এসে বলে–
—ও মায়ের সাথে দেখা করতে চাইছে। আমরা ওকে বাবা-মার রুমে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা যাবে?
হায়া ও আশিয়ান সম্মতি দেয় যাওয়ার জন্য। তারা সকলেই মি. এন্ড মিসেস মির্জা রুমে এসে উপস্থিত হয়
তারা দু’জনও বাহির থেকে আসা কথা বলার আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল।মেঘলা মিসেস মির্জাকে কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয় হাউমাউ করে।
তার এমন কান্না দেখে সকলে আরো অবাক হয়ে যায়। মিসেস মির্জা কয়েক বার জিজ্ঞেস করার পরও যখন মেঘলা কিছু বলে না, শুধু কাঁদতেই থাকে। তখন আবরার বলে–
—দেখো মামনি, তুমি যদি কিছু না বলে এমনভাবেই কাঁদতে থাকো তাহলে আমাদের তোমাকে সাহায্য করার জন্য ও বিষয়টা জানার জন্য তোমার ফ্যামিলির কাছে যেতে হবে। অন্তত তোমার পরিবারের কারো নাম্বারটা দাও।
আবরারের মুখে এই কথা শুনে আঁতকে উঠে মেঘলা। সে তাড়াহুড়ো করে বলে–
—না না, আঙ্কেল। আপনি প্লিজ বাড়িতে কল দিবেন। বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করলে তারা আমায় এখান থেকে নিয়ে গিয়ে ঐ লম্পটের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।
মেঘলার ভয়ার্থ মুখে বলা কথাগুলো শুনে সবাই আরো একবার স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর মেঘলা তাঁদেরকে সবটা বিষয় খুলে বলে। তার চাচীর নিরব অত্যাচার, জোর করে বিয়েতে রাজি করানো, তন্ময়ের মতো লম্পটের পরিচয় সবটা বলে। সবকিছু শুনে উপস্থিত সবাই যেনো কথা বলতেই ভুলে যায়। স্পর্শ এগিয়ে এসে তাকে মাতৃস্নেহে আগলে নেয়। মেঘলা তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। আজ অনেকগুলো বছর পর মায়ের মতো কারো স্পর্শ পেলো।
হঠাৎই মেঘলার তার দাদীর লেখা চিঠি টার কথা মনে পড়ে। সে তার ছোট কাপড়ের ব্যাগটা থেকে চিঠিটা বের করে দেয় মিসেস মির্জার দিকে বাড়িয়ে দেয়। মিসেস মির্জার চোখে সমস্যা আছে, তাই চিঠিটা উনি পড়তে পারেন না। সে চিঠিটা আবরারেট কাছে দিয়ে পড়তে বলে। আবরার চিঠিটা পড়ে শোনায় তাকে। চিঠি টায় মিসেস মির্জার বোন তার উদ্দেশ্য বলেছেন-
“আমার মা-বাপ মরা নাতনিটাকে দেখিস বোন। ওকে আর এই গ্রামে আসতে দিস না। ওকে ওর চাচী একবার পেলে তার বখাটে ভাইপোর সাথে আবার বিয়ে দিয়ে দিবে। আমার নাতনিটা এত বছরের জীবনে একপ্রকার আপন বিহীন বড় হয়েছে। তোরা ওকে একটু ভালোবাসিস। বড় বোন হিসেবে আমার শেষ অনুরোধ তোর কাছে। ভালো থাকিস তোরা।”
তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মেঘলাকে তারা কাল তাদের সাথে ঢাকায় নিয়ে যাবে। পরেরদিন সকাল সকাল সকলে রওনা হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্য। দুটো গাড়িতে তারা রওনা হয়। প্রথম গাড়িটাতে জাহান ড্রাইভিং সিটে বসে আর তার পাশে বসে মেহরিমা। পেছনের সিটে আশিয়ান, তার পাশে হায়া ও হায়ার পাশে মেঘলা বসে। পেছনের গাড়িতে সিনিয়র সিটিজেনরা থাকে।
মেঘলা শেষবারের মতো গ্রামটাকে মন ভরে দেখে নেয়। সে জানে না ভাগ্য এবার তাকে নিয়ে কোন নতুন খেলায় মাতবে। তাও মনের কোথাও একটা ভরসা পাচ্ছে, মনে হচ্ছে এবার হয়ত ভাগ্য তার প্রতি সদয় হবে।
~সমাপ্ত..……
[অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই গল্পটা শেষ করে দিলাম। আমি প্রচন্ড রাইটিং ব্লকে পড়েছি। একটু ব্রেক নিচ্ছি লেখালেখি থেকে। কারণ কিচ্ছু লিখতে পারছি না। এমন একটা এন্ডিং আমি ভেবে রাখিনি কখনোই। আজকের মতো সমাপ্ত করে দিলাম। কিন্তু বোনাস পর্ব আসবে বেশ কয়েকটা। কিন্তু বোনাস পর্বগুলো আমি সময় নিয়ে লিখব।
ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স 🥹 লাভ ইউ অল🥺🫶]