#সাতরঙা প্রজাপতি
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
||পর্ব:১৭||
শোভনের থেকে রেজিগনেশন লেটার পেয়ে অবাক হলো তনিমা। কেমন এক দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শোভনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,”এটা কী মি.শোভন?”
শোভন নির্লিপ্ত ভঙিতে উত্তর দিলো,”রেজিগনেশন লেটার।”
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তনিমার। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নিলো। থেমে থেমে প্রশ্ন করল, “হঠাৎ রেজিগনেশন লেটার? কোনো সমস্যা হয়েছে? এত ভালো চাকরি ছাড়বেন কেন?”
“কারণ তো লেটারে উল্লেখ করাই আছে।”
তনিমা ভ্রু কুঁচকে আবারো লেটারের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকালো। বললো,”এই সামান্য একটা কারণে আপনি চাকরি ছাড়ার মানুষ তো নন মি.শোভন। আসল সমস্যাটা জানতে চাই আমি।”
“এটা তো রুলসের মধ্যে পড়ে না ম্যাম। আমার ব্যক্তিগত কোনো কারণ জানার অধিকার আপনার নেই। দ্রুত এখানে সাইন করে দিলে ভালো হতো।আমার তাড়া আছে।”
“এখানে আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই শোভন। তারপরও রুলসের কথা আসছে কোত্থেকে?”
“অবশ্যই আসছে কারণ এটা অফিস আর এখানে আপনি আমার বস আমি আপনার ইমপ্লয়ী। সাইনটা করলে খুশি হতাম।”
“যদি না করি?”
“তাহলে আর কী আমাকে বাধ্য হয়ে উপর মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।”
বিপরীতে আর কিছুই বলতে পারলো না তনিমা। তার নিয়মের জালে হাত-পা যে এই মুহূর্তে আটকে গেছে। বাধ্য হয়েই সাইন করে দিয়ে বাদ বাকি কাজও সেরে ফেললো। আজ দুদিন পর অফিসে এসেছে শোভন। সেদিন রাতেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্যোতির কথাই সে রাখবে চাকরিটা ছেড়ে দিবে। বিভিন্ন নিউজ, চাকরির সার্কুলার দেখে নতুন একটা চাকরিও খোঁজে নিয়েছে। জ্যোতিকেও সময় দিয়েছে অনেক। মিটমাট করে নিয়েছে নিজেদের সম্পর্কটা।
তনিমা অনেক চেষ্টার পরেও যখন শোভনকে ভুলতে পারছিল না তখন সে তার খালাতো বোন নিতুর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্ত কথা খুলে বলে তাকে। নিতুই তাকে জ্যোতির সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেয়। তনিমার মাথায় হঠাৎ প্রশ্ন এলো,”আচ্ছা জ্যোতি কিছু বলে দেয়নি তো শোভনকে? বলে দেয়নি তো আমি গিয়েছিলাম তাদের বাড়ি? এ কারণেই কী শোভন চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে?”
ভয় পেয়ে গেলো তনিমা। পরক্ষণেই মনে হলো, জ্যোতি যদি শোভনকে সব বলেই দিতো তাহলে শোভন নিশ্চয়ই খারাপ আচরণ করতো তার সঙ্গে। এত স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলতো না। আবারো নিশ্চিন্ত হলো তনিমা। কিন্তু এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, শোভন চলে যাবে এখান থেকে? আগে যা একটু দেখতে পেতো এখন তো তাও পাবে না।
সাজেদ অফিসের নিচে শোভনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। গোমড়া মুখে শোভনের উদ্দেশ্যে বললো, “কোনো হেল্প লাগলে আমাকে কিন্তু অবশ্যই জানাবি। আর হ্যাঁ সবসময় যোগাযোগ রাখতে হবে। আমায় ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না।”
শোভন স্মিত হেসে জড়িয়ে ধরলো সাজেদকে।কয়েক সেকেন্ড পর ছেড়ে দিয়ে বললো,”অবশ্যই। তুই তো আমার বন্ধু নয় তুই হচ্ছিস আমার ভাই।তোর সঙ্গে কী আর যোগাযোগ বন্ধ করা সম্ভব?”
সাজেদও হাসলো।কিছুক্ষণ কথা বলে শোভন বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।জ্যোতি একা হাতে আলমারির সব জামাকাপড় ব্যাগ বন্দি করছে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে তার।কী এক যন্ত্রনার মধ্যে পড়েছে। কয়েকটা দিন সময় নিয়ে কী সুন্দর করে এই ফ্ল্যাটটা মনের মতো করে সাজিয়েছে এখন কিনা এখান থেকে চলে যেতে হবে? যদিও সিদ্ধান্তটা জ্যোতির নিজেরই ছিলো। জ্যোতির মাঝেমধ্যে নিজের মনের উপর চরম বিরক্ত লাগে, রাগ হয়। তার মনটা এমন কেন? এক জায়গায় সহজে স্থির থাকে না কেন? যখন বাপের বাড়ি শ্বশুর বাড়ি অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারতো তখন মন শুধু স্বামীর জন্য ছটফট করতো। আশেপাশের জুটি দেখলেই আফসোস হতো।
অথচ আজ জ্যোতির সেই আফসোসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। স্বামীর ভালোবাসার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে কিন্তু মনে আবারো এক আক্ষেপ জন্মালো। যদি সবাই একসঙ্গে থাকতে পারতাম? কিন্তু এ আর সম্ভব নয়। শোভনের অতীত জেনে এই কাজটি করার জন্য কখনোই সে শোভনকে জোর করবে না। সে সবসময় চায় শোভন খুশি থাকুক।
শোভন বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জ্যোতির ভ্রু কুটির আরো কুঁচকালো।শোভনের শিয়রে গিয়ে কপালে, গলায় হাত দিয়ে চেক করল।
শোভন সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল,”কী চেক করছো?”
“হাতমুখ না ধুয়েই হঠাৎ করে বাহির থেকে এসে শুয়ে পড়লেন যে তাই ভাবলাম হয়তো জ্বর এসেছে।”
“জ্বর তো এসেছেই।”
“কোথায়? সব তো ঠান্ডা।”
“সব জ্বর কী আর হাত দিয়ে অনুভব করা যায়?”
“তাহলে কীভাবে অনুভব করা যায়?”
শোভন মুচকি হেসে জ্যোতিকে একটানে নিজের অতি নিকটে নিয়ে এলো। স্ত্রীর উপর কিছুটা ঝুঁকে চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো। জ্যোতির দৃষ্টি শোভনের আঁখি জোড়ায় নিবদ্ধ হয়ে আছে। শোভন জ্যোতির বাম হাতটা তার বক্ষ গহ্বরে রাখলো। বললো,”ভালোবাসা দিয়ে,অনুভূতি দিয়ে।”
“এ আবার কোন জ্বর?”
“মনের জ্বর।”
জ্যোতির কপালে ভাঁজ পড়ল। জিজ্ঞেস করল,”মাথা কী গেছে আপনার? মনের আবার জ্বর হয় কীভাবে?”
“শরীরের যেভাবে হয় সেভাবেই।”
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো জ্যোতি। শোভনের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। ভেতরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছে। আঙুল গুলো দিয়ে জ্যোতির ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। গালে গাঢ় চুম্বন করল। দীর্ঘশ্বাস ফেললো জ্যোতি। শোভনের ঠোঁটে হাত রেখে তাকে আটকে দিলো। বললো,”কত কষ্ট করে ফ্ল্যাটটা গুছিয়ে ছিলাম এখন আবার সব অগোছালো হয়ে যাবে। নতুন করে সব সাজাতে হবে।”
জ্যোতির হাতটা নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিলো শোভন। উত্তরে বললো,”তুমিই তো চেয়েছিলে এখান থেকে চলে যেতে। এখন কী সিদ্ধান্ত বদলে নিতে চাইছো?”
“উহু মোটেও নয়।”
“তাহলে আর কী? কিছুই করার নেই। আবার না হয় দুজনে মিলে সব গুছিয়ে নিবো।”
“হুম। তাহলে কবে যাচ্ছি আমরা? আর কোথায়ই বা যাচ্ছি?”
“কালই ফিরে যাবো চেনা শহরে।”
কিছুটা অবাক হলো জ্যোতি। প্রশ্ন করল,”আপনি কী বাড়িতে ফিরে যাবেন? সবাই একসঙ্গে থাকবো?”
“না। নতুন বাড়ি দেখেছি। ভাড়া বাড়িতে উঠবো। যেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকবো। আমাদের ছোট্ট একটা পরিবার হবে।”
জ্যোতির অধরে হাসি ফোটে উঠল।
________
ব্যাগ পত্র সব গুছানো শেষ। শোভন লোক ডেকে সব জিনিসপত্র মিনি ট্রাক গাড়িতে উঠালো। আগেই তাদের ঠিকানা বলে দিয়েছে শোভন। জিনিসপত্র সব উঠানোর পরপরই গাড়ি ছেড়ে দিলো। কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে দিলো ইভা। জ্যোতিকে দেখে অধরে হাসি ফোটে উঠল। বললো,”ভেতরে আসুন ভাবী।”
জ্যোতি আর ভিতরে গেলো না। বললো,”ভেতরে আর যাবো না ভাবী। আসলে আজ আমরা চলে যাচ্ছি এখান থেকে তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। এখানে আমার পরিচিত বলতে তো আপনিই ছিলেন। যার সঙ্গে দিনে অন্তত দুটো কথা হলেও বলতে পারতাম। একাকীত্ব কিছুটা হলেও ঘুচতো।”
ইভার মুখখানা মলিন হয়ে গেলো। মলিন মুখে বললো,”আপনাকে খুব মিস করবো ভাবী। নাম্বারটা কী দেওয়া যাবে?”
“অবশ্যই কেন নয়।” জ্যোতি নিজের নাম্বার ইভাকে দিলো। তারপর বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। শোভন স্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,”এত দেরি হলো কেন?”
“ওই যে পাশের ফ্ল্যাটের একজন ভাবী থাকেন না? উনার সঙ্গেই আর কী দেখা করতে গিয়েছিলাম তাই একটু দেরি হলো।
“ওহ। আচ্ছা চলো তাহলে।”
“হুম চলুন।”
সিএনজিতে উঠে বসলো দুজনে। আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছেও গেলো স্টেশনে। তারপর ট্রেনে উঠে নতুন এক গন্তব্যে পাড়ি জমালো।
_______
জেলার ভেতরেই সাত তলা বিল্ডিং। চার তলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে শোভন। এখান থেকে খাঁন বাড়ি যেতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে আবার জ্যোতির ভাইয়ের বাড়িতে যেতে লাগবে এক দেড় ঘণ্টা। শোভনের ভাড়া করা লোকেরা ঠিকঠাক স্থানে আসবাবপত্র গুলো গুছিয়ে রেখে বিল নিয়ে চলে গেলো।
এই ফ্ল্যাটটায়ও ঘর সংখ্যা দুটো।তবে আগের ফ্ল্যাটের মতো দুই ঘরে দুটো বারান্দা নেই। একটা ঘরে বিশাল বড়ো বারান্দা তো আরেক ঘরে জানালা। তবে এখন আর জ্যোতির মনে একটুও কষ্ট নেই। নেই কোনো হতাশা। যখন তখন ইচ্ছে করলেই সে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবে। ভাই-ভাবীর সঙ্গে গল্প করতে পারবে। ইচ্ছে করলেই শাশুড়ির কাছে চলে যেতে পারবে।
বিকেলে গিয়ে বাজার করে এনেছে শোভন। আগের মতো করেই এই সংসারটাও নতুন করে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে জ্যোতি।
রাতে খাবার টেবিলে বসে হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন এলো জ্যোতির। এবার আর নিজের মধ্যে কোনো ধোঁয়াশা রাখলো না। সরাসরি স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,”এই যে কাল নতুন অফিসে জয়েন করবেন এখানকার বস কী ছেলে নাকি মেয়ে?”
খাওয়ার ফাঁকে স্ত্রীর দিকে তাকালো শোভন। মুচকি হেসে উত্তর দিলো,”চল্লিশ বছরের পুরুষ।”
মনে মনে শান্তি পেলো জ্যোতি। খাওয়া শেষে টেবিল থেকে উঠতে উঠতে শোভন বললো,”ছেলে নাকি মেয়ে তাতে কী আসে যায় বলো? আমি যদি ঠিক থাকি তাহলে কী আর কেউ আমাদের মাঝখানে প্রবেশ করতে পারবে? নিশ্চিন্তে থাকো। আর যাই হোক আমি আমার বাবার পথে হাঁটবো না।”
“হুম জানি। আপনার প্রতি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে কিন্তু তারপরেও স্ত্রী হিসেবে সব খবরাখবর রাখা তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”
“হুম এবার দ্রুত ঘরে এসো। আমার আবার কাল সকাল সকাল অফিস যেতে হবে।”
“আপনি গিয়ে ঘুমান। আমি কাজ শেষ করে আসছি।”
শোভন আর গেলো না। জ্যোতির পেছন পেছন রান্নাঘরে প্রবেশ করল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত কণ্ঠে বললো,”তোমায় ছাড়া ঘুমাই কী করে বলো তো? পরে আবার বলবে আমি তোমায় ভালোবাসি না।”
ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো জ্যোতি। পেছনে না ফিরেই প্রতিত্ত্যুরে বললো,”হ্যাঁ সেই জন্য আপনি কথায় কথায় মুহূর্তে মুহূর্তে আমায় বুঝাচ্ছেন আপনি আমায় ভালোবাসেন।”
“যা মনে করো।”
হাতের কাজ শেষ করে শোভনের সঙ্গে ঘরে গেলো জ্যোতি। রাতটা পার হলো। রোজকার মতো ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা তৈরি করল জ্যোতি।শোভন আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি থেকে বের হয়েছে।অফিসের প্রথম দিন বলে কথা। তবে আগের তুলনায় বেতনের অংকটা একটু কম। তবে চাকরিতে পুরাতন হয়ে গেলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে হয়তো প্রমোশনের মাধ্যমে আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রথমদিন অফিসে প্রবেশ করতেই সহকর্মীরা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই শোভনকে গ্ৰহণ করে নিলো। ঊর্ধ্বতনের কাছ থেকে সব কাজ বুঝে নিয়ে কাজ করতে লাগলো শোভন। প্রথমদিন অফিস টাইমটা বেশ ভালোই কাটলো তার।
________
বেশ কয়েকদিন পার হলো এখানে। এবার আর শোভনের নিকট জ্যোতিকে বায়না করতে হয়নি। শোভন নিজ দায়িত্বে পুরো বারান্দা ফুল গাছে ভরিয়ে দিয়েছে। বিকেলে আনোয়ারা বেগমের নাম্বার থেকে কল এলো। শোভন কল রিসিভ করে সালাম দিলো। আনোয়ারা বেগম সালামের জবাব নিয়ে কিছুটা সময় নিলেন। ধীরে সুস্থে বললেন,”ওখান থেকে যেহেতু চলেই এসেছো, আবারো ভাড়া বাড়িতে কেন উঠতে হবে? এখানে তোমার একটা বাড়ি আছে সেখানে চলে এলে কী হয়না? সবাই আমরা একসঙ্গে থাকব।”
“সবকিছু জেনেও আপনি আমায় এ কথা বলছেন?”
“মানুষ ভুল করে, একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। তোমার বাবাকে কী ক্ষমা করা যায় না? উনি উনার কর্মকাণ্ডে লজ্জিত।”
“কারো প্রতি এখন আর আমার রাগ ক্ষোভ নেই। উনি আমার মন থেকে অনেক বছর আগেই উঠে গেছেন। আমি মেনে নিয়েছি আমার বাবা নেই। তাই এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না।”
“আরেকবার ভাবলে হতো না?”
“আপনার ছেলের সঙ্গে এমন হলেও কী এ কথাই বলতেন?”
কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই ভেতরে সুপ্ত ব্যথা অনুভব করলেন আনোয়ারা বেগম। বললেন,”তুমি কী আমার ছেলে নও? আমি কী কখনো তোমাদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখেছি? শাফিনের আগে তুমিই আমার ছেলে। আমার বড়ো ছেলে। তোমার গুরুত্বটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি। আচ্ছা এখনো কী আমায় মায়ের জায়গাটা দিতে পারোনি?”
“ভুল বুঝবেন না। আমার মা হিসেবে এখন শুধু আপনাকেই আমি মানি। সে জায়গা আপনি নিজেই দখল করে নিয়েছেন। ও বাড়িতেও আপনার জন্যই আমি পা রাখি। তাই দয়া করে আপনি অন্তত পুরোনো কথা মনে করাবেন না। তবে এখন তো আমরা খুব কাছাকাছিই আছি আপনার যখন ইচ্ছে চলে আসবেন। তবে হ্যাঁ সঙ্গে শুধু রেশমীকেই নিয়ে আসতে পারবেন।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আনোয়ারা বেগম। বিপরীতে এ ব্যাপারে আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। কথা শেষ করে কল কেটে দিলেন।শোভনের নিজের বাবা মা যেখানে তার মধ্যে নিজেদের জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে পারেনি যেখানে অধিকার বিস্তার করতে পারেনি। পারেনি তার ভরসার স্থান দখল করতে সেখানে সৎ মা হয়েও আনোয়ারা বেগম তা পেরেছেন। সফলও হয়েছেন। সৎ মা নামটি করেছেন স্বার্থক। সৎ শব্দটার অর্থই তো শুভ, ভালো। অর্থাৎ ভালো মা। তিনি পেরেছেন একজন ভালো মা হতে।
দুই কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এলো জ্যোতি। শোভন প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাহিরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় ইট দিয়ে বাঁধাই করা মোটা রেলিংয়ে চায়ের কাপ রেখে দাঁড়ালো জ্যোতি। আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেলে বললো,”হয়তো আজ বৃষ্টি নামবে।”
শোভন সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো জ্যোতির দিকে। তার কথায় তাল মিলিয়ে বললো,”হুম। ভিজবে?”
“না। আপনার যদি আবারো জ্বর আসে?”
“আসলে আসুক। তুমি আছো তো আমার জন্য।”
লাজুক হাসলো জ্যোতি। বললো,”দিনদিন আপনি অবুঝ হয়ে যাচ্ছেন।”
স্ত্রীর অতি নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো শোভন। চোখে চোখ রেখে হাস্যজ্জ্বল মুখে উত্তরে বললো,”সামান্য ভালোবাসা পেলেই পুরুষ মানুষ অবুঝ হয়ে যায় সেখানে আমি তো আমার স্ত্রীর এক সমুদ্র পরিমাণ ভালোবাসায় ডুবে গিয়েছি সেক্ষেত্রে একটুখানি অবুঝ তো হতেই হতো।”
“আমি না হয় এক সমুদ্র পরিমাণ আপনাকে ভালোবাসি কিন্তু আপনি আমায় কতটুকু ভালোবাসেন, বললেন না তো?”
হাসনাহেনা গাছটায় একটা প্রজাপতি এসে বসেছে। শোভনের দৃষ্টিগোচর হতেই সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে। আবারো স্ত্রীর চোখে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। বললো,”নির্জনতায় প্রতিটি প্রজাপতি ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ধরা দেয় মানব মনে। তুমি হচ্ছো আমার জীবনের সেই প্রজাপতি যে আমার দুঃখ গুলো ভুলিয়ে সুখ ছড়াতে এসেছে। আমার জীবনে ভালোবাসার সাত রঙ ছড়াতে এসেছে। আমি তোমায় ভালোবাসি। যেই ভালোবাসা হয়তো দুনিয়ার এই ছোট্ট জীবনে প্রকাশ করা যাবে না কিন্তু তাও আমি তোমায় ভালোবাসি ওই সাতরঙা প্রজাপতির মতো। আমি তোমায় চিরকাল এভাবেই ভালোবেসে যাবো। কখনো ছেড়ে যাবে না তো আমায়?”
জ্যোতি হাসলো। যে হাসিতে এ জীবনের প্রাপ্তি লুকিয়ে আছে। ভালোবাসা এতটা সুন্দর হয়? হয়তো হয়। প্রিয় মানুষ অতি নিকটে থাকলে, ভরসার একটি হাত পেলে শুধু ভালোবাসা কেন? কুৎসিত চেহারার মানুষটিকেও পৃথিবীর সুন্দরতম মানুষ মনে হয়। যে যতো ভালোবাসতে পারে সে ততোই সুন্দর।
বারান্দার দোলনায় বসলো দুজনে। স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো জ্যোতি। বললো,”ছাড়ার জন্য তো আপনার হাতটা আমি ধরিনি। মৃত্যু ব্যতীত কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
শোভনের চোখ চিকচিক করে উঠল। তার এত বছরের একাকীত্ব ঘুচলো তবে।দেখা মিললো সুখের। কারো নিকট সে হয়ে উঠল জীবনের প্রধান চরিত্র।
(~সমাপ্ত~)