সাদা মন পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
9

সাদা_মন
পর্বঃ৩ (শেষ পর্ব)
রিহান_

আমি পড়ে গেলাম মহাবিপদে। ভাইয়ের নতুন বৈবাহিক জীবনে নিত্য অশান্তি হচ্ছিলো আমার কারণে। আম্মা ভীষণ বিরক্ত ছিলেন ভাবীর উপরে। বিনাদোষেই বেচারী দোষের বোঝা বয়ে যাচ্ছিলো।

এদিকে কাজবাজ বন্ধ করেও তো আর থাকা যায় না। নতুন ব্যবসা আমার! কাজেও মনোযোগ দিতে হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে। আমি মাকে জানিয়ে দিলাম লিসাকে বিয়ে করব না। তবে অন্য কাউকেও এখনই বিয়ে করব না। আম্মা সন্দেহ করলেন আমি চালাকি করছি! মায়ের মন তো! অনেক কিছুই বোঝে। মামাতো বোনের সাথে আমার বিয়েটা একরকম ঠিক করে ফেলতে চাইলেন। আমি ডিরেক্ট জানিয়ে দিলাম, ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে এভাবে আমার সাথে বাড়াবাড়ি করলে বিয়ে তো দূরে থাক; জীবনে আর ঘরেই ফিরবো না!

আম্মা কিছুটা ভয় পেলেন। আমি একটা জিনিস নোটিস করলাম, ‘আম্মা ভাবির সাথে এখনো খা’রাপ ব্যবহার করেন; কারণে-অকারণে!’

বুঝলাম আমার প্রেমে পড়ার অপরাধে হয়তো সারাজীবনই খা’রাপ ব্যবহার করবেন এবং দোষীও করে যাবেন ভাবীকে। আমি অন্যত্র বিয়ে করলেও ভাবিই খারাপ থাকবে ; ভাবির বোনকে বিয়ে করলেও ভাবিই দোষী হবে। ব্যাপারগুলো আমার অসহ্য লাগলো।

মাসখানেক পরে আমি ঢাকায় এয়ারপোর্টে বসে আম্মাকে কিছু ছবি পাঠালাম। এয়ারপোর্টের বিভিন্ন পয়েন্টে কিছু ভিডিও পাঠালাম। শেষ পর্যন্ত ভিডিওকলে যুক্ত হলাম আম্মার সাথে। আমার লোকেশন দেখে আম্মা বিস্ময়ে আতঙ্কের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কই? বাপ তুই কই?’

আমি জবাব দিলাম, ‘এয়ারপোর্টে! ‘
আম্মা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘এয়ারপোর্টে তোর কি?’
‘দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি! থাকবো না আর এদেশে। শেষবারের মতো দেখে রাখো আমাকে। আর কোনদিন এই চেহারা তোমাকে দেখাবো না! ‘

আম্মা ভীষণ কেঁদে-কে’টে জবাব দিলেন, ‘বাপ তুই যা চাস ; আমি তাই দিমু! তুই যাইস না বিদেশে! তুই গেলে আমি কারে নিয়া বাঁচমু?’

আমি বললাম, ‘তোমার বাপের বাড়ি-শশুর বাড়ির লোক তোমাকে দেখে রাখবে! আমাকে দিয়ে তোমার কি প্রয়োজন?’

‘বাপ, আমি কারো কথা শুনমু না। তুই রাগ হয়া দ্যাশ ছাড়তাছোস! তুই ফিইরা আয় বাপ। আমি লিসারেই বউ কইরা আনমু!’

‘তোমারে বিশ্বাস করি না!’
‘বাপ রিহান, খোদার কসম কইরা কইতাছি ; লিসারেই বউ বানায়া আনমু!’

আমি বিশ্বাস করলাম আম্মার ওয়াদাকে। আসলে আমি ছিলাম এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ অংশে। যশোর থেকে বিমানে ঢাকা গিয়েছি। আম্মাকে বোকা বানানোর জন্য। আম্মা বুঝতেই পারে নি অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্ট আর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের পার্থক্য। এটা বোঝা খুব সহজ নয়।
——
মাসখানেক পরে বিয়ে হলো আমার আর লিসার। আম্মার সম্মতিতেই বিয়ে। আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউই আসেনি বিয়েতে। দুজন অল্প বয়সী কাজিন এসেছে, বাকীরা আমার বন্ধু-বান্ধব। আমি বিরাট পা’পের কাজ করছি বিধবা বিয়ে করে। এমনই মনে হলো যেন সবার কাছে।

বিয়ের কয়েক দিন পরে আম্মা পুরোপুরি বদলে গেলেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কু’বুদ্ধিতে। আম্মা আলাদা খেতে শুরু করলেন। ভাবির হাতের কিছু খেতেন না। আবার আমার শহরের বাসায়ও আসেন নি। লিসাকে নিয়ে আমি শহরেই থাকতাম। অসুস্থ হলে আম্মা তার ভাই-বোনদের বাড়ি থেকে খাবার চেয়ে আনতেন। মানুষ বউদেরকেই দোষী করতো। আম্মার অসুস্থতার কথা শুনলে আমি রাতে বাড়ি চলে যেতাম। আমরা দুই ভাই মিলে রান্না করে দিতাম। আম্মা সেগুলো ছুঁতেনও না। সবই ভাড়াটে বুদ্ধি। আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীদের।

আমি বিধবা বিয়ে করে কোন গন্ধ পাইনি। আমার আত্মীয়-স্বজন গন্ধ পায় বিধবার গায়ে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত না! এক বিধবা বিয়ে করার কারণে আমার গায়েও গন্ধ পায়। সব দূরে সরে গেছে আমার কাছ থেকে। এত এত ভালো মানুষ সমাজে! খোঁজ দিয়ে দেখা যায় অনেকেই রাতের আঁধারে পরনারীর কাছে যায়। আর বিধবা বিয়ে করে আমি চিরদোষী হলাম।
………..
সময়ের সাবলীল ধারায় পেরিয়ে গেছে তিনটি বছর। আমি এখন এক পুত্রের জনক। ব্যবসা-বাণিজ্যেও বেশ সফল। আফসোস একটাই আমার আম্মা অসুস্থ। বছর দেড়েক আগে এক বৃষ্টি স্নাত সন্ধ্যায় আম্মা স্লিপ কে’টে পড়ে যান গ্রামের বাড়িতে। আম্মার ডান পায়ের উরু ভেঙে যায়। আমি শহরে এনে চিকিৎসা করাই। তখন একটানা প্রায় ৬ মাস ছিলেন আমার বাসায়। একরকম বিছানাশয্যা। তখন আমার স্ত্রী লিসা আম্মার খাবার থেকে শুরু করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াসহ যাবতীয় কাজ তদারকি করেছে। সেই ছয় মাসে আম্মার ভাই-বোন,ভাবি সবাই একবার করে আসেন আমার বাসায়। অসুস্থ আম্মাকে দেখতে। সবাই আমার বউয়ের সামনে আম্মাকে খোঁচা মেরে কথা বলতেন, ‘পুতের বউর লগে হিংসা করছিলি না! এই কারণে আইজকা এই অবস্থা! তুই নিজে খা’রাপ। আল্লায় তোর বিচার করছে!’

আম্মা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন তাদের পানে। তাদের বুদ্ধিতেই আম্মা আলাদা খেয়েছেন। বৃষ্টির ভেতরে কাজ করতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছেন। অথচ তারাই এসে আম্মাকে দোষী করতো! আমার বউ,ভাবী দুজনই মনে মনে খুশি হতো আম্মাকে খোঁচা দিতে দেখে। কিন্তু আমি বউকে এবং ভাবিকে ডেকে আনলাম আম্মার সামনে। তারপর আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি যে বউদেরকে মেনে নেও নাই ; এইটা তো এইসব আত্মীয়-স্বজনের কুবুদ্ধির কারণেই! তাই না?’

আম্মা বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি আমার বউকে এবং ভাবিকে বললাম, ‘এইসব আত্মীয়-স্বজনই আগেরবার অশান্তি লাগিয়েছে আম্মাকে বুদ্ধি দিয়ে। এখন অশান্তি লাগাতে এসেছে তোমাদেরকে বুদ্ধি দিয়ে! এদের আসলে মনটাই কলুষিত। একটা সাদা মনের বড় অভাব!’

আম্মা তার পুত্রবধূরা সবই বুঝতে পারল।

আম্মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছেন কিন্তু আগের মত নয়। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন কোনোভাবে। আমার আর ভাইয়ার দুজনের সাথেই থাকেন। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কারো সাথেই আগের মত মেশেন না। নিজের বুদ্ধিতে চলেন। আম্মাও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে ওদের আসলেই সাদা মনের অভাব। সবসময় অন্যের অশান্তি কামনা করে।

আমরা ভালোই আছি এখন। ঐসব কলুষিত মনের লোকগুলোকে পেছনে ফেলে। এই লোকগুলো যে শুধু আমাদের ফ্যামিলিতে আছে এমনটা নয়; এমন কলুষিত মানসিকতার লোক সবার ফ্যামিলিতে আছে এবং সব জায়গায় অশান্তি করে। ওদেরকে এড়িয়ে চলে সাদা মনের লোকদেরকে গ্রহণ করবেন।

সমাপ্ত।