#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
সমারম্ভ.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
ছু-টছে,ছু-টছে বহুচেনা পথ পেরিয়ে, র*ক্তা/ক্ত হাত,পা।পেছনে কিছু জান্তব আক্রোশ ভরা মনুষ্য। এরা হুবহু মানব প্রাণীর রূপ ধরে থাকলেও এদের মধ্যে মানবিকতা নেই। নগ্ন পায়ে ছুটতে ছুটতে হোঁচট খেলো পাথুরে ভরা কণ্টকাকীর্ণ ভেজা রাস্তায়। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মুখ থুবড়ে পড়লো। পেছন থেকে ধেয়ে আসা বিপদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় সামনে তাকাতেই দেখে বাবা মা হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে। ঘুমের মাঝেই চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– আম্মিজান… বাবাজান… আনা ফি মুশকিলা..
হাঁপাতে থাকে। পাশ ফিরে দেখে সে নিজের কামরাতেই আছে, নিছক একটা দুঃস্বপ্ন। বাহিরে সত্যি বজ্রনাদ।ষড়ঋতুর মধ্যে এখন সবচেয়ে অপ্রিয় হচ্ছে বর্ষা। থেমে থেমে অশনিসংকেত,বজ্রধ্বনি। কেঁপে কেঁপে উঠছে বুকের মাঝে আগলে রাখা ছোট্ট ছানা। এই রুমটার আশপাশটা নির্জন। বাড়ির সবচেয়ে কর্ণারের রুম। এই বাড়িতে গেস্ট আসলে এই রুমে থাকে। ঘুম জর্জরিত চোখ দুটো খোলা থাকার কঠোর প্রতিজ্ঞা করেও ব্যর্থ। থাই গ্লাসের একটা লক নষ্ট। খুব জোরে শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। শিল গুলো আঘাত করছে গ্লাসে। মনে হচ্ছে ভেঙে তোড়পাড় করে, নিঃশেষ করেই ছাড়বে আজকের প্রকৃতিকে। নিজের রাজকার্য শেষ করে তবেই বিদায় নিবে এই অবিনাশী বর্ষনমুখর রাত্রি। কি জানি বর্ষা হয়তো এসেছে তার প্রিয় কিছু খুঁজে নিতে,যা হারিয়েছে বহুকাল আগে। হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে পেতেই সেই আর্তনাদ। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে গুটিশুটি হয়ে মায়ের বুকে। গলা শুকিয়ে গিয়েছে।পাশে ফিরে দেখলো বোতলে পানি নেই। এই বজ্রপাতের সময় মেয়েকে একা ছেড়ে যেতে মন মানলোনা। পানি না খেয়েই চুপটি মেরে শুয়ে আছে। মনে পড়ে গেলো পুরোনো স্মৃতি।
এইতো বছর ছয়েক আগের কথা, পরিবারের আপনজনদের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত কতটা আন্তরিক আর স্মৃতি জড়িত এটা অন্যরা বুঝবেনা। এই বরষার রাতে মা-বাবার বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা, টিনের চালে ধুপধাপ বৃষ্টি। বাড়ির পাশে আম গাছটা থেকে আম পড়েছে ধুপ করে। টিনের টুংটাং শব্দে বাবাকে জাগিয়ে বাবা-মেয়ে মিলে আম কুড়িয়ে আনা। ভিজে ঝপঝপ হয়ে বাড়ি ফেরা পরবর্তীতে মায়ের বকুনি। সেই সব হারিয়ে গিয়েছে। বুক থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। বৃষ্টি অনেকটা থেমেছে। মেয়ের শরীরে আলতো করে বালিশ চাপা দিয়ে উঠে দিয়া। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে দিয়া। ইরানী মায়ের চেহারার সবটুকু সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে দিয়ার চেহারাতে। বাবা বলতেন আমার মেয়ে ঘরের প্রদীপ।তাই সাধ করে মেয়ের নাম রেখেছিলো ফারহানা মেহতাব দিয়া। বাবার দিয়া এখন অন্য কারো ঘরের দিয়া জ্বালাতে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিচ্ছে। খাট থেকে আলতো পায়ে নেমে শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে নিলো। দরজার নব ঘুরিয়ে ডাইনিং টেবিলের জার থেকে পানি ঢেলে এক নিমেষে পান করলো। সামনে থাকা মাস্টার বেড রুমটাতে আলো জ্বলছে। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে একটা চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। পুনরায় নিজের শোবার ঘরে গিয়ে ছোট্ট ছানাটার পাশে শুয়ে পড়লো। এই বাড়িতে একমাত্র প্রান এই ছানাটা। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা চুমু দিয়ে নিজেই ঘুমের সাগরে তল হারালো।
.
পানির এক একটি ফোঁটা তীরের মত বিঁধছে শরীরে। কানে বাজে সেই শপথ বাক্য, সেই মন্ত্র-‘ বল বীর, বল উন্নত মম শির’। শাওয়ারের দিকে তাকাতেই সরাসরি চোখে পানি লাগছে। এ যেন এক কঠিন সংগ্রাম পানিকে জয় করার। চোখ খোলা রাখা অসম্ভব চলন্ত শাওয়ারের পানে তাকিয়ে। এই অসম্ভবকে জয় করে তাকিয়ে আছে। শরীরের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। শীল পড়া ঠান্ডা বৃষ্টিতে পানিও কেমন বরফের মতো আচরণ করছে। পাত্র পরিবর্তনে যেমন রূপ বদলে ফেলে ঠিক তেমনি পরিবেশ পরিবর্তনে ও সাধারণ অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় নেমে আসে। শাওয়ার বন্ধ করে তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে আসে। বিন্দু বিন্দু জল এখনো তনু জুড়ে।
কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলো ডাইনিংয়ে আসা মানবীর দিকে। থাই গ্লাসের দরজা ভেদ করে বাইরের চিত্র দেখা গেলেও ভেতরে কি ঘটছে তা দেখা সম্ভব নয়। ব্যালকনিতে পানি জমেছে। সবটুকু জমিয়ে থাকা পানি মফ দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে পুনরায় রুমে এসে এসি ছেড়ে দিলো। আঠারোতে তাপমাত্রা দিয়ে ঘুমোনোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানোটা এখন চ্যালেঞ্জিং। জ্বরের পরিমাপটা কা-টা-য় কা-টা-য় একশত তিনে ঠেকেছে। কম্বল মুড়িয়ে উন্মুক্ত গায়ে নিজেকে সঁপে দিলো বিছানার আঁচলে।
.
সকালের মিষ্টি রোদ জানালা ভেদ করে দেয়াল ছুঁয়েছে। শেহজা কেঁদে উঠলো। মেয়েটার ডায়াপার বদলে, মেয়েকে ফিডিং করিয়ে উঠলো।মেয়ে উঠার আগেই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিলো। প্রথম দিকে শাশুড়ি সাহায্য করতো এসব কাজ করতে। বাড়ির সকলের মধ্যমনি ছিলো দিয়া। ছোট ননদ সব কাজে এখনো সাহায্য করে। শাশুড়ির কয়েকমাস আগে পায়ের অপারেশন হওয়াতে বেশিক্ষন হাটাহাটি করাটা ক্ষ-তি-ক-র । এক জায়গায় বসে থাকতে পারেনা। উনার রেস্টে থাকতে হয় অনেকটা সময়। ঘড়িতে সাতটা।আজ দেরি হয়ে গিয়েছে। ইশ! কাল রাতে দেরি করে শোয়াতেই আজ এমনটা হলো। নাস্তার টেবিলে সকলে বসে আছে। দিয়া শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে মেয়েকে কোলে নিয়ে বের হলো। গিয়েই ডাইনিং রুমে খাবার টেবিলে দেখলো সকলে বসে গিয়েছে রীতিমত। বড় ননদ শেফালি কটমট চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– মহারানী উঠেছে এতক্ষনে। এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমালে তো ঘরের কাজ আমাদের করতে হবে। মায়ের শরীরটা ভালো না চোখে দেখা যায়না। সক্কাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই রান্না করছে।
দিয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে আশপাশে চোখ বুলালো।কেউ যদি মেয়েটাকে নিত সে রান্নাঘরে যেতো। এমন সময় শাশুড়ী এসে বললো,
– বড় বৌমা, আমার নাতনীটাকে দাও। তুমি খাবার গুলো নিয়ে আসো। আমি এদের দেখছি।
শেফালী পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো,
– করো আহ্লাদ এই ন্যাকা মেয়েকে, একবার সংসারের অবস্থা খারাপ করেছে।পরের বার…
এবার শ্বশুর রায়হান মাহমুদ ধমকে উঠলেন মেয়েকে,
-চুপ থাকো শেফালী। খাবার টেবিলে আমি এসব পছন্দ করিনা। একদিন এমন দেরি হতেই পারে। শোরগোল করবেনা। সকাল সকাল এমন কটু পরিবেশ অপছন্দনীয়।
শেফালি কিছু একটা বলতে যাবে তখনই ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলো দীর্ঘকায়, পেটানো দেহ, চুলগুলো একদম গুছিয়ে সেট করা, মুখে ক্লিন সেভ, পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, কলারে সুতোর কাজ, সাথে সাদা পায়জামা পরিহিত রায়হান সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পাঞ্জাবির হাতা কব্জি বরাবর গুটানো। হাতে একটা ফ্রেডরিক কনস্টেন্ট ব্রান্ডের ওয়াচ। চোখে মেটালিক থিন ফ্রেমের চশমা। পারফিউমটাও শ্যানেলের। পারফিউমের স্মুথ স্মেল পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে। চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে রায়হান সাহেবকে সালাম দিলো।
– আসসালামু আলাইকুম আব্বু।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
বাকি দুবোন ভাইকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে বসা থেকে। ইশারায় বসতে বলায় দুজন বসলো। রায়হান সাহেবের চার সন্তান। মেয়ে দুটো বড় ভাইয়ের সামনে চায়না নিজেদের ঝগড়ার বোল খুলুক।বড় ভাইজানের চোখের চাহনীই যথেষ্ট এদেরকে টাইট করার জন্য। সুলতানা কবির নাতনীকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। বাবাকে দেখে শেহজা কেমন যেন করে উঠলো। দাদীর কোল থেকে নেমে যেতে চাইলো। প্লেটে নাস্তা তুলতে তুলতে আঁড়চোখে মেয়েকে দেখলো। বাবার কোলে আসতে চাইছে মেয়ে। চোখের ভাষায় বলতে চাইছে,’আমাকে কোলে নাও বাবা’।দু হাত বাড়িয়ে দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার কোলে। মেয়েকে কোলে নিয়ে চুপচাপ নিজের প্রাতঃকালীন নাস্তা সেরে নিচ্ছে। মেয়ে মুখে নিজের ভাষায় কত কি বলে যাচ্ছে যার কোনো অর্থ নেই। নয় মাসের একটা বাচ্চা উউ, আআ ছাড়া আর কি বা বলবে। রুটির একটু খানি অংশ ছিড়ে মধুতে ভিজিয়ে মেয়ের মুখে দিলো। দিয়া রান্নাঘর থেকে দেখতে পাচ্ছে বাবা মেয়ের এই সুন্দর মুহুর্ত। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। ওর বাবাও তো এভাবে সকালে চায়ে চুবিয়ে মেয়েকে রুটি খাইয়ে দিত। তবে এখানে মিসিং ব্যাপার হচ্ছে দিয়ার পাশাপাশি ওর মা আমিরাকে ও খাইয়ে দিতেন দিয়ার বাবা।বাবার এই ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মা সুদূর সৌদি থেকে বাবার হাত ধরে সব ছেড়ে চলে এসেছেন। নিজের নানাবাড়ি কখনো দেখেনি দিয়া।মাকে বলতে শুনেছে সকলের আদরের ছিলো আমিরা। বাবা,ভাইয়ের ভালোবাসা ফেলে এসেছে এইদেশে।ভাবনাছেদ হলো সুলতানা কবিরের কথায়। উনি ছেলেকে বলছেন,
– বাবু, ছোট আসবে আগামী মাসে। আমাদের কাল রাতে জানালো। আমি আর তোমার বাবা চাইছি ও আসলে এবার বিয়ে করিয়ে দিব। তাহলে আমরা কি মেয়ে দেখা শুরু করবো?
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। এমন সময় শেফালী বলে উঠলো,
– ভাইজান আবিরের বাবার কোনো সন্ধান পেয়েছেন?
খাবার শেষ,মেয়েকে খাইয়ে মুখটা মুছিয়ে দিলো টিস্যু দিয়ে। উঠে যাবে তখনই শিফা এগিয়ে এসে শেহজাকে কোলে তুলে নিলো। দুহাত ধুয়ে শেফালীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– থানায় ডায়েরি করা আছে।খোঁজ পেলে জানানো হবে। যে সম্পর্ক নেই, সেই সম্পর্ক কি পুনরায় শুরু করতে চাইছো?
– না না ভাইজান আমি তাই বলিনি। আবির দেখতে চাইছিলো ওর বাবাকে তাই।
– ছেলেকে সামলাও। অহেতুক আবদার এই বাড়ির কারো পছন্দ নয়।
শেফালীর খুব আঁতে লেগেছে এই কথা। বড় ভাই দেখে কথা বাড়ায়নি। কিন্তু ওই যে কথায় বলে কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। মুখের উপর কান্না ভাব নিয়ে বলে দিলো,
– আমার অসহায় ছেলেটাকে কিভাবে মা*রবো ভাইজান। ও তো শুধু বাবার কথা জানতে চেয়েছিলো।
রক্ত চক্ষু নিক্ষেপ করলো বোনের দিকে। রায়হান সাহেব বুঝতে পেরে মেয়েকে রাগান্বিত হয়ে বললেন,
– শেফালী তুমি দিন দিন মাত্রা ছাড়াচ্ছো, বড়দের মুখে মুখে তর্ক করো। তোমাকে মা*রতে কে বলেছে! বলেছে ছেলেকে সামলাও। মা হয়েছো অথচ এতটুকু বুঝোনা কি করে ছেলে সামলাতে হয়!
শেফালী মেজাজ খারাপ হয়ে গেলেও মাথা নত করে বললো,
– দুঃখিত আব্বু, আমাকে ক্ষমা করবেন।এভাবে বলতে চাইনি আমি।
রায়হান সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– শাহাদ..
থমকে বাবার দিকে ফিরলো স্বল্পভাষী মানুষটা। রায়হান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি কি অসুস্থ! চোখ দুটো কেমন লাল লাগছে?
– আব্বু,আমি ঠিক আছি,রাতে ঘুম কম হয়েছে।
স্বল্প কথায় উত্তর দিয়ে দরজার সামনে যেতেই পি এস পাভেল এসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাগ, ফাইল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।এরপর আস্তে ধীরে সবাই চলে গেলে দিয়া আসলো টেবিলে। নিজের প্লেটে অল্প পরিমাণ খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করলো দিয়া। এরমধ্যে শিফা শেহজাকে নিয়ে শুলো ওর রুমে। শেহজা ঘুমিয়ে পড়েছে। দিয়া দ্রুত খেয়েই শেহজাকে নিয়ে গেলো। মেয়েকে খাইয়ে পুনরায় ঘরের কাজ করা শুরু।
.
অফিসের জন্য রেডি হয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাসা থেকে নওরিনের অফিস দশমিনিটের পথ। তাই ভাবলো হেঁটেই যাবে। পরনে গোলাপি রঙের কোটা শাড়ি। মাথায় হিজাব থাকার সত্ত্বেও ঘোমটা তুলেছে। সকালের রবির কিরণ নিয়ে কত কবি মুগ্ধ হয়ে কত কি লিখলো। অথচ এর অত্যাচার নিয়ে কেনো লিখলোনা! এখন যে রোদে সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে তার কি হবে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা চল্লিশ। অফিস নয়টা থেকে। এদিকে রিকশা চলাচল করে না। ভি আই পি জায়গা। ব্যাগ কাঁপিয়ে কর্কশ ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে পুরুষালি স্বর ভেসে এলো,
– কেমন আছো নিরা?
– মেজাজটা চটে আছে। বিচ্ছিরি একটা রোদ আমার মাথা ব্যাথা তুলে দিচ্ছে। সারাদিন অফিস গিয়ে একটু স্বস্তি পাবোনা
– চশমা পরেছো!
নওরিনের জিহবায় কামড়। গত পরশু ডাক্তার দেখিয়েছিলো। ডাক্তার চশমা দিয়েছে নিয়মিত ব্যবহারের জন্য কিন্তু এই মেয়ে চশমা ব্যবহার করতে ভুলে যায়। কাতর গলায় বললো,
– স্যরি অভ্যাস নেই তো ভুলে গিয়েছি। আর এমন হবেনা।
অপর পাশ থেকে একটা দৃঢ় নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা গেলো। পরমুহূর্তে বললো,
– সাবধানে যাও এমন ভুল করোনা। অফিস গিয়ে একটা মেডিসিন নিবে।
– ঠিক আছে। এনিওয়ে টিকিট কেটেছো?
– হুম নেক্সট মান্থের সাতাশ তারিখ আসছি ইনশাআল্লাহ। এরপর আপনাকে আমার ঘরে তুলে নিব।
নওরিন হালকা হাসলো। কথা শেষ করে ফোন রেখে দিলো। কথা শুরু হয়েছিলো বছর তিনেক আগে। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় নওরিন লক্ষ্য করলো পেছন থেকে একজন তাকে ডাকছে। ভর দুপুর। আশে পাশে লোকজন নেই বললেই চলে। একটু ভয় ও কাজ করলো।এরপর ও আল্লাহর নাম নিয়ে এগিয়ে গেলো। মানুষটা পানি আছে কিনা জানতে চাইলো। নওরিন ব্যাগ থেকে পানির বোতল টা বের করে দিলো। নওরিন ভেবেছে লোকটা হয়তো পানিটুকু নিজের জন্য চেয়েছে। না সম্পূর্ণ ভুল ছিলো। সে পানি টুকু তার গাড়ির ইঞ্জিনে ঢেলে দিলো। নওরিন বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই বলে উঠলো,
– আ’ম স্যরি।আশেপাশে কোনো দোকান নেই যে এক বোতল পানি নিব। তাই আপনার সাহায্য লাগলো। গাড়ির ইঞ্জিন অনেক গরম হয়ে গিয়েছে। আমাকে দ্রুত একটা মিটিং এ যেতে হবে।
নওরিন সৎবিৎ পেয়ে ঢোক গিললো। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর। গাড়ি ঠিক হয়ে এলো। নওরিনকে বোতল এগিয়ে বললো,
– অনেক ধন্যবাদ।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আসলেই কোনো দোকান নেই এই জায়গায়। অনুরোধের সুরে বললো,
– আপনি কি আমার সাথে একটু সামনে যাবেন?
নওরিনের মস্তিষ্ক সাড়া দিয়ে উঠলো। বসতে দিলে শুইতে চায় বাঙালি। যেই না পানির বোতল দিলো এখন তার সাথে যেতে হবে। কি সুন্দর আবদার! নওরিন বিনা বাক্য বেয়ে সামনে হাঁটা শুরু করলো। শাহীন পেছন থেকে নওরিনকে বললো,
– মিস এক্স, ওয়াই, জেড। প্লিজ দাঁড়ান।
নওরিন ঘুরে বললো,
– হোয়াট ডু ইউ মিন বাই মিস এক্স,ওয়াই,জেড? আমার নাম নওরিন।
নাম বলে নওরিন চমকে গেলো। বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। উপকারই বা করার কি দরকার ছিলো এখন যদি লোকটা ছেলেধরা হয়! ভর দপুরে তুলে নিয়ে যায়!
– মিস নওরিন। গাড়ি ওখানের থাক। আপনি আমার সাথে একটু আসুন। আমি হেঁটেই আপনার সাথে যাবো। আপনাকে আগে এক বোতল পানি কিনে দি। আমার খুব খারাপ লাগছে এভাবে আপনার খাবার পানিটা কাজে লাগালাম।
নওরিন বিস্মিত হয়ে দেখলো। এই পানির বোতল কিনে দিতে গাড়ি করে নিতে চাইলো!! আর সে কত কি লোকটাকে ভাবতে শুরু করলো। নওরিন বলে উঠলো,
– লাগবে না, বাসায় তো যাচ্ছি।
– না তবুও আমি ঋনী হয়ে থাকতে চাইনা।
নওরিন বুঝলো নাছোড়বান্দা লোক। শেষ মেষ বললো,
– আপনি গাড়ি নিয়ে মেইন রাস্তায় যান আমি দেখা করছি ওখানে।
– আপনি ও চলুন। আমার চরিত্র আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনাকে ট্রেপে ফেলবোনা। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে গাড়িতে উঠুন।
কি জানি সেদিন কি হয়েছিলো। সে যে গাড়িতে উঠলো, আজো একই গাড়িতে চলছে দুজন। জীবনটা কি অদ্ভুত, রহস্যে ঘেরা।
চলবে…