সায়রে গর্জন পর্ব-১৮+১৯

0
3

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১৮.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ঘুমন্ত কন্যার কপালে চুমু দিয়ে গায়ে কাঁথা পরিয়ে চলে এলো বিদেশী পিটুনিয়া,রডোড্রেন্ডন লাগানো বারান্দায়। রডোড্রেন্ডন নেপালের জাতীয় ফুল হিসেবে পরিচিত। বারান্দার সৌন্দর্য্য বর্ধন করেছে ঠিকই তবে কোথাও কিছু নেই মনে হচ্ছে। সহসা মনে হলো শাহাদের প্রিয় রজনীগন্ধ্যা গুলো নেই। শুকিয়ে গিয়েছে প্রখর রোদে। সন্ধ্যার আকাশে চেয়ে দিয়া নিজেকে শুধায়,

– কি হলো দিয়া?এভাবে মাফ করে দিলি রসকষহীন কাঠখোট্টা মানবকে?

উত্তর খুঁজে পায়না। মানুষটাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে সে তার দোষ-ত্রুটি সব সহজেই মাফ হয়ে গেলো। প্রচন্ড রাগ,ক্ষোভ থাকার সত্ত্বেও এই মানুষটা হাসিমুখে মাফ করে দেয়ার পেছনের কারণটা যদি হয় দিয়ার ভবিতব্য তবে তাই সই। একটা মুহুর্তে নষ্ট করতে চায়না এমপি সাহেবের সাথে। সারাটা দিন আজ চোখের পানি পড়েছে টুপ টুপ করে। যে সত্য দিয়া জেনেছে তা যদি সকলের সামনে চলে আসে হয়তো পাথরের মতো অনড়,সায়রে গর্জন তোলা নেভিয়ান, নিজের আপন মানুষদের ভালোবেসে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া কমান্ডার শাহাদ ইমরোজ ভেঙে পড়বে। দিয়া কখনোই মেনে নিতে পারবেনা ভঙ্গুর শাহাদকে। গতকাল রাত থেকে অভিনয় করে যাচ্ছে ভালো থাকার। তবে এটাই কি সেই শাস্তি। দরজায় খট খট আওয়াজ পেয়েই বারান্দা থেকে ছুটে আসলো।শেহজা না উঠে যায় এই আওয়াজে! দরজা খুলেই দেখতে পেলো এই বাড়ির সবচেয়ে অপছন্দনীয় দুজন মানুষ। একজন জানে অপরজন জানেনা। মনি আর শেফালী ভেতরে আসতে চাইলে দিয়া বলে উঠলো,

– আপু শেহজা ঘুমায় বাইরে চলুন।

দিয়া কিছুতেই চায়না,তাদের ব্যক্তিগত শোবার ঘরে পরনারীর আগমন ঘটুক। যে নারীর প্রধান আকর্ষণ দিয়ার আপন পুরুষ। আফিয়া খালাকে ডেকে ঘরের কাজগুলোকে নিরবে করার নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ড্রইং রুমের লাগোয়া বারান্দায় ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প শুরু করলো। দিয়ার মনোযোগ সেই কাগজে আটকে আছে। আশিককে কিছুক্ষণ আগে মেসেজ দিয়েছে। এখনো রিপ্লাই আসেনি। তৎক্ষনাৎ মনি বলে উঠলো,

– আচ্ছা শেফালী, শাহাদ ভাইয়ের এক্সের নাম যেন কি ছিলো?

শেফালী এমন একটা ভান করলো যেন জানেনা। পরক্ষনে বললো,

– হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে সামরা আপু। দুজনকে বড্ড মানাতো।

দিয়া শান্ত চোখে দেখতে থাকলো দুজনকে। এই প্রথম সামরার কথা শুনলো দিয়া। কেনো যেন কথা বাড়াতে মন চাইলোনা। মনি দিয়ার ভাবভঙ্গি দেখে প্রশ্ন করলো,

– ভাবীজান আপনাকে নিশ্চয়ই শাহাদ ভাই বলেছে সামরার কথা?

– এক্সের কথা প্রেজেন্টকে জানিয়ে কি লাভ? ভালো তো প্রেজেন্টের সাথে থাকতে হবে।

শেফালী চমকে উঠলো।এই প্রথম দিয়া মুখের উপর উত্তর দিলো। কয়েকটা লাগিয়ে দিতে মন চাইলো। দিয়া দুজনকে উপেক্ষা করে বললো,

– এক্সকিউজ মি একটু কাজ আছে।

আশিকের ফোন রিসিভ করতেই পুরোটা শুনে নিলো। গাল বেয়ে টুপ টুপ করে জল পড়ছে। ভেতরটা কান্নায় ফেটে পড়তে চাইছে। ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠছে। দিয়া পণ করেছে একেবারে স্বাভাবিক থাকবে৷ কাল বিকালে যখন জানতে পারলো, তখনো বিষয়টি ছিলো বেশ কিছুটা স্বাভাবিক কিন্তু আজকের টা!সেল ফোনটা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে গেলো। কিছুক্ষন পর এসে দেখলো শাহাদ শুয়ে আছে মেয়ের পাশে ঘর অন্ধকার করে। দিয়া কাছে আসতেই বলে উঠলো,

– আশিক নামের কেউ বার বার ফোন দিচ্ছে। কথা বলে নাও।

– দেখছি।

– আশিক কে?

– কেনো থাকতে পারে না? আবার সন্দেহ করবেন?

– শুনিনি তো কখনো এই নাম তাই জিজ্ঞেস করলাম।

– ছিলেন কয়দিন আমার সাথে যে শুনবেন।

শাহাদ বিস্মিত হচ্ছে দিয়ার তর্ক করার ভঙ্গি দেখে। দিয়া বারান্দায় গিয়ে কথা বলে ফিরলো। শাহাদের দিকে এক নজর দেখতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। মন চাইছে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলতে,

– আপনাকে কে দিয়েছে আমাদের ছেড়ে যাওয়ার অধিকার। আমার হয়ে থাকবেন কথা দিয়েছিলেন। কেনো এত অবহেলা করলেন।

শাহাদের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো।

– ফারাহ, লাইটটা অফ করে দাও। আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।

– মাইগ্রেনের মেডিসিন নিন। চলে যাবে।

শাহাদ এক পেশে হাসি দেয়। সত্যি বিছানা থেকে উঠে মেডিসিন নিলো। দিয়া অবাক হয়ে চাইলো। মেডিসিন নিলো কেনো! ওর তো মাইগ্রেন নেই!ওর মন রাখতে মেডিসিন নিলো! আজ চোটপাট করা শাহাদ এত শান্ত কেনো! পুনরায় শুয়ে পড়তেই দিয়া বললো,

– সামরা কি বেশি সুন্দর আমার চেয়ে?

শাহাদ দু চোখ তড়াক করে উঠলো। না ঘাবড়ে বলল,

– সুন্দর কি না জানিনা তবে ভদ্র মেয়ে ছিলো।

– জানালেন না যে কখনো?

– আমি অতীত ঘাটাই কম। এছাড়া এই বাড়িতে কতগুলো ভাঙা রেকর্ডার আছে,আমি না বললেও তোমার কানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাজিয়ে দিবে।

শাহাদের তাচ্ছিল্যভরা হাসি এই অন্ধকারে ও দিয়া অনুভব করলো। কথাটা পুরোপুরি শোনার আগ্রহ জন্মালো দিয়ার। মন চাইলো শাহাদকে ঘিরে ওর জীবনের আদ্যোপান্ত সব জানতে হবে,সব। দিয়া প্রশ্ন ছুড়লো,

– আপনাদের বিচ্ছেদ কেনো হলো?

– ফারাহ আমার আজ কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। পরে বলি।

– কবে যাবেন সিঙ্গাপুর?

– কেনো! সিঙ্গাপুর কেনো যাব!

– আর কত লুকাবেন?

শাহাদ তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। দিয়ার কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারছেনা।তখন থেকে বাতাসে প্রশ্ন ছুঁড়ছে । কিসব আবোলতাবোল বলছে। শাহাদ এগিয়ে এসে দিয়ার গাল দুটো আজলায় তুলে বললো,

– কি হয়েছে ফারাহ,এমন কেনো করছো?

কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– আপনি সিঙ্গাপুর কবে যাচ্ছেন বলেন?

আচমকা শাহাদের কিছু একটা মনে পড়াতে লাফ দিয়ে বেড থেকে নেমে কাভার্ডের কাছে চলে যায়। কাপড়ের উপরে থাকা ফাইলের দিকে চোখ যায়। শান্ত চোখে দিয়ার দিকে তাকায়। কিছুটা ধমকে বলে,

– হাত দিতে গেলে কেনো?

– এই তাহলে আসল কারণ ছিলো আমাকে দূরত্বে রাখার? মাঝখানে অবিশ্বাসের কারণ দেখিয়ে আমার দুটি বছর নষ্ট করলেন।

– ফারাহ এসব নিয়ে পরে কথা হবে।আমার ভালো লাগছেনা। যেভাবে হাঁউ মাঁউ করছো মেয়ে উঠে যাবে। কাঁদতে হলে বাইরে গিয়ে কাঁদো নতুবা বারান্দায় ।

– আরো বেশি করে খারাপ ব্যবহার করুন,যত খুশি করুন। কালকে কেনো এত ভালোবাসলেন?

– ভুল করেছি।

শাহাদ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক আজ কিছুতেই সঙ্গ দিচ্ছেনা। দিয়াকে ওই অবস্থায় ফেলে গলায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। রেখে গেলো ক্রন্দনরত মেয়েটাকে। আঁড়ালে থাকা সত্যগুলো সামনে আসছে কেনো?সামরাকে নিয়ে অবান্তর কথা কে জানালো? আর আজ তো সবচেয়ে বড় গোপনীয়তা সামনে চলে এলো। হে মহান রব,আমাকে ধৈর্য্য দিন। অনেক কাজ বাকি, অন্তত আর কিছুটা দিন আমার ঝুলিতে যোগ হোক। রাশেদকে পুরো ডিপার্টমেন্ট রেপিস্ট হিসেবে চেনে।এই অপবাদ মুছে দিতে হবে। তাহির একটা গতি করে রেখে যেতে হবে, ফারাহর ভবিষ্যত সাজিয়ে যেতে হবে। বাকি কাজ শাহীনকে বুঝিয়ে দিতে হবে। পুনরায় মাথায় প্রদাহ হচ্ছে। নিষাদের বিয়ের পর থেকে শরীরের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।চেক আপ করাতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সা*প বেরিয়ে এলো।

____

– এই মেয়ে বড্ড বাড়ছে। ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

– কি করবে মনি আপা?

– ওর স্বামী নিয়ে অহংকার অনেক বেশি, ভাবছি এবার নাহয় সব কিছু ছাড়িয়ে প্ল্যানটা শাহাদ ভাইকে ঘিরে করবো।

– মানে?

– দেখে যা।

ডিনারের টেবিলে আজ সবাই আছে। অনুপস্থিত শুধু শাহাদ আর মনি। শাহাদ গোসল সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মনি শেফালীর কামরায় থাকছে। শিফা দু বার মনিকে ডাকার পর ও আসছেনা। দিয়া শাহাদকে ডাকার জন্য রুমের ভেতর যেতেই দেখে ভেতর থেকে রুমের দরজা লক। দিয়ার মাথায় খেলে গেলো অদ্ভুত চিন্তা। ছুটে গিয়ে শেফালীর রুমে মনিকে পেলো না। কথা না বাড়িয়ে সুলতানা কবিরকে বললো,

– আম্মু আপনার ছেলের রুমের চাবি দিন।

সুলতানা কবির বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো,

– কেনো মা কি হয়েছে?

রায়হান সাহেব ও হতবাক। সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললো,

– চাবিটা দাও। কিছু কি হয়েছে আম্মু?

– আব্বু আমার চাবি লাগবে।

আঁচল থেকে সুলতানা কবির শাহাদের রুমের চাবি দিলো। দিয়া ছুটে আসলো।পুরো পরিবার ওর পেছনে। রুমের দরজা খুলতেই দেখতে পেলো শরীর জুড়ে নাইটি পরা মনি। দিয়ার শ্বাস আটকে গেলো। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেলো। সুলতানা কবির দু কদম পিছিয়ে যেতেই শিফা ধরে ফেললো। রায়হান সাহেব স্তব্দ। শাহীন অন্যদিকে মুখ ঘুরালো বাবাকে আঁকড়ে ধরে। রায়হান সাহেব জোরেই বলে উঠলেন,

– আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিওঁ ওয়া আতুবু ইলাইহি; লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।

দিয়া জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। শেহজা ওর বেবি বেডে। দরজা খোলার শব্দে উঠে চুপচাপ তাকিয়ে আছে বাবার দিকে এবং বাবার পাশে মহিলার দিকে। নামার চেষ্টা করছে। দিয়া এক ছুটে মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো।যেন এমন লজ্জার চিত্র না দেখে মেয়ে। শাহাদের শরীরে ট্রাউজার। শাহাদ এখনো ঘুমে। এত কিছু হয়ে গেলো অথচ মানুষটার কোনো হেলদোল নেই। দিয়া চমকে গিয়ে শিফাকে বললো শেহজাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে। সকলের সামনে মনির চুলের মুঠি ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়ে কষে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দেয়ালের দিকে ছুড়ে মা*রে। মাথায় গালে প্রচন্ড ব্যাথায় মনি ককিয়ে উঠে। হুংকার ছেড়ে শেফালীকে বললো,

– শেফালী মনিকে নিয়ে এক্ষুনি আমার রুম থেকে বের হও। মনি আজকের পর তোকে কখনো আমার স্বামীর আশেপাশে দেখি আমার হাতের প্রথম খু*নটা তোকে করবো অপবিত্র না*রী।

আঁৎকে উঠেছে সকলে। শেফালী নিজেও চমকে উঠেছে। চিৎকার দিয়ে বলে,

– নিজের স্বামীর চরিত্র ঠিক নেই, আসছে আরেকজনকে দোষ দিতে। মুখ সামলে কথা বলবি আমার সাথে।

দিয়া পুনরায় গর্জে উঠে বলে,

– আমার চোখের সামনে থেকে এদের সরান আম্মু, ভাইয়া। আমি সত্যি খু*ন করে ফেলবো এখন।

শাহীন বজ্রকন্ঠে ধমকে বললো,

– বের হ রুম থেকে ব*দ*মাশ গুলা। মনি তোকে তো আমি দেখছি পরে।

দিয়া শাহাদের মাথা কোলে নিয়ে দুবার ডাকলো। শাহীনকে চিৎকার দিয়ে বললো,

– ভাইয়া পানি দেন।

হতভম্ব সকলে দৌঁড়ে গেলো। দিয়া শাহাদের মুখে পানি ছিটাতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষন পর শাহাদ আস্তে আস্তে চোখ খুললো। চোখে ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে সব।অনেকের গলার আওয়াজ পাচ্ছে। দিয়া শাড়ির আঁচলে শাহাদের ভেজা মুখ মুছে দিলো।সুলতানা কবির ঘাঁবড়ে গিয়ে কাঁদছেন। পুরোপুরি হুঁশে আসতেই বুঝতে পারলো বাসার প্রতিটি মানুষ তার সামনে। মাথা দিয়ার কোলে আবিষ্কার করলো, পরনের পোশাক না দেখে কিছুটা বিব্রত হলো। উঠতে চাইলে শাহীন এবং দিয়ার সাহায্যে হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে বসলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,

– বুঝতে পারছিনা কি হয়েছে,খুলে বলোতো।সবাই এই রুমে কেনো?

আকস্মিকভাবে শেফালী পুনরায় রুমে ঢুকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

– নাটক করছেন আপনি, মনে ছিলো না মনি আপার সাথে এক বিছানায় শোয়ার আগে। ছিঃ ভাইজান বলতে লজ্জ্বা লাগছে।

খাট থেকে নেমে দিয়া সকলের সামনে সজোরে হাত টান টান করে অনবরত কয়েকটি থা/প্প/ড় দিলো। তর্জনি আঙ্গুল তুলে শাসালো,

– খবরদার আর একটা কথা মুখ থেকে বের করলে জিভ টেনে ছিঁ*ড়ে ফে/লবো। আমার সাথে হওয়া সব অন্যায় মুখ বুঁজে মেনে নিয়েছি তার মানে এই না যে তোমাদের দুই শয়তানের চাল বুঝতে আমার সময় লাগবে। এতটা নিচে কিভাবে নামলে শেফালী! এনিওয়ে আমি চাইছিনা এখন আমার স্বামীর সামনে এসব কথা উঠুক।বের হও।

শাহাদ কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো,

– কি হয়েছে ফারাহ। শাহীন খুলে বলোতো।

সকলের মাথা নত। শেফালী গজগজ করতে করতে বলে উঠলো,

– আপনার কুকীর্তির ছবি হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি দেখে নিন।

শাহাদ তড়িঘড়ি করে ফোন হাতরাচ্ছে। দিয়া খাটের একপাশে ফোন লক্ষ্য করতেই ধরার জন্য হাত বাড়ানোর আগেই শাহাদ ফোন নিয়ে আনলক করলো হোয়াটসঅ্যাপ। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিভৎস সব ছবি। ছবি গুলো স্ক্রল করে বার বার দেখছে। এই তো এই বেডরুম,এই বেড। বেডে শুয়ে থাকা মানুষটা শাহাদ,আর পাশে অর্ধ নগ্ন মনি।জড়িয়ে ধরে আছে উন্মুক্ত গায়ের শাহাদকে। প্রচন্ড চাপ অনুভূত হচ্ছে মস্তিষ্কে। ফোনের সাথে দেয়াল ঘড়ির সময় মিলিয়ে দেখলো না ঠিক আছে ঘড়িতে দশটা বেয়াল্লিশ। মাঝে সময় মাত্র দু ঘন্টা।এত কিছু কি করে সম্ভব হলো। ফোনটা একপাশে রেখে মনে করার চেষ্টা করছে,কিছুতেই মনে করতে না পেরে দিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

– ফারাহ মেডিসিন নিয়ে শোয়ার পর তুমি তো বেরিয়ে গেলে,মাঝে এমন কি হলো যে চরিত্রে দাগ লেগে গেলো। এখন কি উপায়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করবো বুঝতে পারছিনা। সবচেয়ে বড় কথা,মনির সাথে উলটা পালটা কিছু করিনি তো?

শেফালীর দিকে চোখ যেতেই দিয়া ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলো। দিয়ার এমন আচরণ সকলকে বিস্মিত করছে। শাহাদের কাছে এসে বলে,

– আপনি কেনো চাপ নিচ্ছেন। সব কিছু ঠিক আছে।

– অবুঝ পেয়েছো আমাকে? কি করেছি আমি?

দিয়া সকলের সামনে পাগলের মতো চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বললো,

– আমাকে একটু স্বস্তি দিন। আমি এত যন্ত্রণা নিতে পারছিনা। মনি আপনার সাথে সেদিন যা করতে চেয়েছিলো আজ ও তাই করতে এসেছে।

শাহীন, রায়হান সাহেব এবং সুলতানা কবিরের দু হাত ধরে বেরিয়ে গেলো।ওদের একা ছেড়ে দিতে বললো। পুরো ঘটনা খোলাসা করতে রুমে নিয়ে এলো বাবা মাকে। রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলেন,

– কি চলছে এসব?

– আব্বু মনি ভাইজানকে পছন্দ করে। ইদানিং মরিয়া হয়ে উঠেছে ভাবীমাকে তাড়াতে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে ভাইজানের সাথে এমন কিছু করেছিলো সেদিন অন্ধকারে যার পরে ভাইজান অস্থির হয়ে পড়েছিলো।আপনারাই তো দেখলেন। আর আজ ভাইজানকে বদনাম করতে গিয়ে নিজেই অপমানিত হলো।আব্বু বিশ্বাস করেন ভাইজান সেন্সে ছিলোনা।

সুলতানা কবির থম ধরে বললো,

– মনি একটি মেয়ে শাহীন। আমি কিভাবে নিজের ছেলেকে বাঁচাতে একটি মেয়েকে ফাঁসাবো। চোখকে কি করে অবিশ্বাস করবো?

শাহীন ফ্লোরে বসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো,চোখ গড়িয়ে পড়ছে অবারিত অশ্রু। ভাইজান মানুষটা প্রচন্ড আত্নসম্মানপ্রবন।আজকের ঘটনার পর কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারবেনা। ডাক্তার বার বার বলেছে স্ট্রেস যেন কম নেয়।ভাবীমা কি করে সামলাচ্ছে তাকে। যে ভাইজান এতক্ষন হুঁশে ছিলোনা সে কি করে কোনো নারীর সম্ভ্রম নিয়ে খেলবে!

– কাঁদছো কেনো আব্বা?

– আম্মু, ভাইজান ভালো নেই। একদম ভালো নেই। আম্মু আমার মাথার উপর থেকে আমি বোধ হয় আশ্রয় হারিয়ে ফে/লবো। ভাইজানের মাইল্ড ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিলো দু বছর আগে।ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলো ঠিকই,তবে ভাইজানের মনে হতো তার সময় বেশি নেই। গত বছর ডিসেম্বর মারামারির মাঝে মাথায় যে আঘাত লেগেছিলো ব্রেইন হেমারেজ হয়। এরপর থেকে শরীর খারাপের দিকে যেতে থাকে।অথচ কাউকে একটু ও বুঝতে দিলোনা। নিরবে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।আপনিই বলুন, যে ভাইজান গত দু ঘন্টা যাবৎ বেহুঁশ ছিলো সে কি করে মনির ক্ষতি করবে!

রায়হান সাহেব নিজের ইজি চেয়ারে বসে শান্ত গলায় বললো,

– অপারেশন করানো যাবেনা?

– চান্স ২০/৮০। এই চান্স কিন্তু সুস্থ হওয়া না হওয়ার নয়।

– তবে!

– ২০% সুস্থ হওয়ার,বাকি ৮০% মৃত্যুর। অপারেশনের পর জ্ঞান না ফিরলে শেষ সব।

এই একটা কারণ গত একটা বছর লুকিয়ে এসেছে। চুপ চাপ নিজের কাজ করছে।ভাবীমাকে দূরে ঠেলে রেখেছে। অপারেশন করবে না জানিয়েছে। অসমাপ্ত কাজ গুলো সমাপ্ত করে তারপর সময় হাতে থাকলে অপারেশন করবে। এই চিন্তায় যেদিন ভাবীমার মাইগ্রেনে পেইন শুনেছে সেদিন থেকে আপনাকে,আমাকে দিয়ে প্রেশারাইজ করছে ডাক্তার দেখাতে বলার জন্য। মনের ভেতর ভয় ঢুকে গিয়েছে।বিকেলে আমাকে বলেছে,

– আমার অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তি তোমার হাতে রেখে গেলাম। আমার অনুপস্থিতিতে পূর্ণ করো।

___

– ফারাহ অন্যায়ের পরিমাণ কি এতই অত্যধিক ছিলো যে শাস্তি হিসেবে তোমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটল। আমি সকলের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াবো কোন মুখে? আজ রাতটা যদি শেষ রাত হতো।

– এর চেয়ে বড় অপবাদ আমাকে দিয়েছিলেন,কই আমি তো এমন করিনি।

– রজনীগন্ধা মূর্ছা গেলে কি কম সুবাস দেয়! তখনো নিজের সর্বোচ্চ সুবাস ছড়িয়ে সকলের ভালোবাসা আদায় করে নেয় ।তুমি হলে আমার সেই রজনীগন্ধা। আর আমি কাঁটা, না সুবাস আছে,না রূপ-রঙ আছে, গায়ে লেগে কেউ আঘাত পেলে উঁপড়ে ফেলে।

শাহাদ থেমে দিয়ার দিকে তাকিয়ে পর পর বললো,

– রাশেদ কিভাবে মা’ রা গিয়েছিলো জানো,তাহির অবিশ্বাস নিতে না পেরে সুইসাইড এটেম্পট করেছিলো। ওর প্রাণহীন দেহের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম, এতটা ভালোবাসলি কেনো! যে ভালোবাসায় প্রাণের মূল্য নেই। আজ আমার মনে হলো আমিও একই পথের যাত্রী। আমি মনিকে মেয়ের মতো মানুষ করেছি ফারাহ। ও কাজটা কিভাবে করলো! আমি ওর সাথে একবার দেখা করতে চাই।

দিয়া রনাঙ্গিনী হয়ে রুখে দাঁড়ায়,

– খবরদার আজকের পর স্বদিচ্ছায় ওর মুখ দেখবেন না।অন্যথায়, আমি নিজে ম*রে,আপনার মেয়েকে মে*রে ফে*লবো।

দিয়া অকস্মাৎ রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। শাহাদ নিচে তাকিয়ে দেখে টি শার্ট নিচে গড়াচ্ছে। আরেকটা নতুন বের করে দিয়ার পেছনে ছুটে গেলো৷ ততক্ষনে সুলতানা কবির,রায়হান সাহেব ও এলেন মনির রুমের সামনে। দিয়া রুমে সরাসরি ঢুকে হন্তদন্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। কাঙ্ক্ষিত জিনিস দুটো পেয়ে সকলের সামনে আছাড় দিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে সুউচ্চ শব্দে হুমকি দিলো,

– ফোন দুটো প্রমান ছিলো আমার স্বামীর ক্যারিয়ার,রেপুটেশন সব ধ্বংসের। আমি দুটোই ধ্বংস করলাম। সকলের সামনে মুক্ত মনে অভিশাপ দিলাম, মনি আজ যেভাবে আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলে নিজের সম্মানের তোয়াক্কা না করে, এমন দিন আসবে ভবিষ্যতে তোমাকে রা*স্তা কুকুর বেড়াল ও দেখলে থুতু দিবে। শেফালী বোন হয়ে ভাইয়ের এত বড় ক্ষতি করতে চাইলে যে এতটুকু বুক কাঁপেনি! সেই বোন আজ থেকে মৃত আমার স্বামীর কাছে। অন্তত তোমাদের সংস্পর্শে আমি আমার স্বামী সন্তানকে রাখবোনা। আমি এই বাড়ি ছেড়ে দিব।

রায়হান সাহেব দিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

– কোথাও যেতে হবে না। রুমে যাও। শাহাদ খেয়ে নাও। জীবনটা তো খুব ছোট আমাদের। আজ আছি কাল নেই। যতটুকু সময় আছি,ততটুকুতে নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করা উচিত। যদিও আমাদের পরিবারের মতো বিরল ঘটনা কোথাও ঘটেছে কিনা সন্দেহ আছে। শাহাদ আমার প্রাণ। মনি এ বাড়িতে কেনো আমার পরিবারের ত্রিশ সীমানায় যেন তোকে না দেখি। আর শেফালী তুমি তো অসুস্থ। তোমার ব্যবস্থা আমি করছি। আমি রিটায়ার্ড হয়েছি ঠিকই কিন্তু বেঠিক সন্তান মানুষ করতে ভুল করবোনা এবার। তুমি আমার পরিবারের ভিত্তিকে বদনাম করতে সাহায্য করেছো। পাখনা বেড়ে উঠেছে তাই না। কিভাবে কা/টতে হয় জানা আছে আমার।

নিশব্দে পা ফেলে শাহাদ বেরিয়ে এলো কামরা থেকে। দিয়া পেছনে ছুটলো। আজ মনে হলো দিয়ার মনের জোর অনেক বেশি,সেই তুলনায় শাহাদের নেই বললেই চলে।এতটুকুতে নড়ে গেলো? শাহাদ সুইমিং পুলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে দিয়াকে বললো,

– ভয়াবহ রকমের অন্তর্দ্বন্দে ভুগছিলাম। একবারের জন্য নিজেকে পারভার্ট মনে হয়েছিলো।ভাবলাম পুরুষ সত্ত্বা জেগে উঠেছিলো কি! নিজের অজান্তে এমন কিছু করে ফেলেছি। তবে ভাবতে পারিনি এভাবে আমার পাশে থাকবে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে টা ম*রেই গিয়েছিলো ফারাহ।

দিয়া মুচকি হাসে। হেসে বলে,

– সিঙ্গাপুর কবে যাবেন?

– যাবোনা।

ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়া তাকাতেই শাহাদ মুচকি হেসে বলে,

– একা যাবোনা, সঙ্গে রাজকন্যা আর রানীকে নিয়ে যাব। কাছে এসো আদর করি।

আজ মনে হলো এমন একজন জীবনসঙ্গী থাকলে সবচেয়ে কঠিন মুহুর্ত হেসে পার করা যায়। রাশেদের জীবনের ভুল পয়েন্ট ছিলো তাহি থেকে দূরে থাকা। এই প্রথম বারের মত মনে হলো নেভি ছেড়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। নতুবা আজ অন্য রকম জীবন গাঁথা রচিত হতো,যা থাকতো কলুষতাময়। সুস্থ থাকার জন্য,ভালো থাকার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ ফারাহ নামক মেডিসিন প্রয়োজন। কিছুদিন সমস্ত চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রেখে স্ত্রী সন্তানকে সময় দিবে। বাঁচার স্পৃহা জেগে উঠেছে। দিয়া শাহাদের কাছে ঘেষতেই এক হাতে আগলে নিয়ে মাথায় উষ্ণ অধর ছুঁইয়ে বলে,

– তুমি জানোই না জান তুমি আমার মিষ্টি ভোরের চক্ষু তৃষ্ণা, তুমি আমার প্রেম জাগানো এক সমুদ্র তপস্যা।

দিয়া মাথা উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,

– আর সামরা

শাহাদ হেসে বলে,

– কেউ না

– ওরা যে বললো?

– মিথ্যে বলেছে

– আপনি ও বলেছিলেন।

– বলেছিলাম কি সম্পর্ক আছে?

– নাহ

– তবে?

– বললো যে আপনার এক্স।

– বিভ্রান্ত করতে মিথ্যা বলেছে।

দুজনই নিরব। অকস্মাৎ শাহাদ বলে উঠলো,

– ফারাহ, তোমাকে দ্বিতীয়বার দেখেছি লাবনী বিচে। সঙ্গে ছিলো দাদাসাহেব আর দাদীজান। ডিউটি শেষে রাশেদের সাথে বিচে বসেছিলাম। আমার আশেপাশে এত অফিসারদের দেখে নাক মুখ কুঁচকে জোরেই বলেছিলে দাদাজানকে, ” কোথাকার কোন লাট সাহেব এসেছে দাদাসাহেব দেখেছেন, এই লোকের জন্য এতজন বডিগার্ড লাগে। এভাবে আমাদের সুন্দর সময়টা নষ্ট করছে।অর্ধেক সৈকত তো এরাই দখল করেছে।”
তোমার কথা শুনে তোমার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তুমি সেই মেয়ে যার সুরভিতে আমি মুগ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিলাম।সেই রজনীগন্ধার সুভাস। যাকে প্রথম দেখেছিলাম ‘সান ডান্সার’ রেস্টুরেন্টে পরী রূপে পাঁচ বছর আগে।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
১৯.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

চারদিকে শোঁ শোঁ ধূলা উড়ানো বাতাস। বন্ধুদের সাথে বাইক নিয়ে রেস লাগিয়েছে। আশে পাশের সব কিছু তোয়াক্কা করে ছুটে চলেছে। দু পাশে সবুজ আর মাঝে মেইন রাস্তা। দশটা বাইক। স্পিড ১১৫-১২০। লিমন বাইক স্টান্ট করবে এর আগেই ওর সামনের বাইকটা একটা কারের সাথে খুব জোরে ধা/ক্কা লেগেছে। গাড়ি থেকে ড্রাইভার বেরিয়ে সামনের ছেলেটাকে বকা ঝকা করছে। তর্কে কেউ হার মানতে রাজি না। গাড়ির ক্ষতি হয়েছে অনেক সেই সাথে বাইকের সামনের অংশে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ বেশি। একসাথে সব কজন বাইকার নেমে এলো। ড্রাইভারকে মা*রতে উদ্ধত হলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরেক জন লোক। লিমন এগিয়ে এসে বললো,

– আপনারা তর্ক না করে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিন চলে যাব। আর এটা জানেন না বাইকার রা রাস্তায় চললে একটু রয়ে সয়ে গাড়ি চালাতে হয়।

পেছন থেকে আরো একজন বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে লিমন যেই না ধমকে কথা বলবে চেহারার দিকে তাকিয়ে মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। লোকটা সামনে আসতেই তোঁতলে বললো,

– পাভেল…ভাই।

– বাইকারদের দেখলে রয়ে সয়ে চলতে হবে তাই না!

– ভাই স্যরি

– পেছনে তোর উপর মহল বসে আছে। ভাঙচুরের কাজটা করলি এটা সরকারি গাড়ি লোগো দেখিস নাই! শা*লা! যদি নাইমা তোরে দেখে একটা আঁ ছাড় দিবে সবার সামনে। ভাগ এখান থেকে সব কটা।

বাইকার ছেলে গুলো গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি সরকারি গাড়ি। লিমন এই গাড়ি কখনো দেখেনি তাই চিনতে পারেনি। একটা বাইকার ছেলে চেঁতে বলে,

– কে রে উপর মহল,ডাক দে খোমা ডা দেইখ্যা নি। এক্কেবারে ভাইরাল কইরা দিমু।

পাভেলের ফোনে কল আসতেই, পাভেল দাঁত খিচে বলে,

– লিমন এটাকে সামলায় ভাগ এখান থেকে বস বের হলে একটাকেও আস্ত রাখবেনা। ফোন দিচ্ছে বার বার। গাড়িতে ল্যাপটপে কাজ করছে তাই আমাকে পাঠিয়েছে, এজন্য তোর রক্ষা হয়েছে।

– আপনারা আগে চলে যান ভাই, বইলেন প্রবলেম সলভ।

ড্রাইভার একপাশ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। লিমনের বন্ধুরা বার বার প্রশ্ন করে কে ছিলো গাড়িতে।
পকেট কাঁপিয়ে ওয়্যারলেস যন্ত্রটা বেজে উঠলো। পরিচিত নাম্বার দেখে শির দাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে শীতল স্বেদজল। গলা কাঁপছে।

– আসসালামু আলাইকুম বড় ভাইজান।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম, রাস্তা দখল না করে
লা/ফা/ঙ্গা গুলোকে নিয়ে দু মিনিটের মধ্যে রাস্তা ফাঁকা করো। সন্ধ্যায় বাসায় আসবে।

টুট টুট করে ফোন কেঁটে গেলো। শীতল ধমকই বলে দিচ্ছে আজই শেষ। সত্যি যদি আঁছাড় দেয়! লিমনের এক বন্ধু এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,

– কে ছিলো রে?

– বড় ভাইজান। আমি আর এজন্মে বাইক রেস করবোনা। আজকে নির্ঘাত আঁছাড় দিবে।

– বললেই হলো!

রাসেল পাশ থেকে বলে,

– বেকুপের দল, এমপি শাহাদ ইমরোজ আঁছাড় না শুধু ঘুষিতে থোঁবড়া বদলায় দিবে। বাসায় চল। আমি যে লিমনের বন্ধু জানে। আব্বুকে যদি ফোন দিয়ে কিছু বলে আমার জায়গা ফুটপাতেও হবে না।

বাকিরা হতাশা নিয়ে বাইক ঘুরিয়ে গন্তব্যের জন্য রওয়ানা দিলো।

___

চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে বিকৃত,ঘৃণ্য ছবি,ভিডিও। এই ছবি,ভিডিওর মেমোরি কার্ড উদ্ধার করা গেলেও এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছেনা আরো কোথাও ব্যাকাপ আছে কিনা। নওরীন প্রজেক্টের কাজ করতে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলো টিমের সাথে। সেখান থেকে জানতে পারে শেফালীর বর্তমান প্রেমিকের খবর। শাহাদের কাছে নিউজ দিতেই হামজা এসে মেমোরি কার্ড দিয়ে গেলো। শাহাদ মিটিংয়ে আছে।এই কার্ড কারো কাছে নিরাপদ নয়,শাহীনের কাছে পাঠালো। রুমে এখন শাহীনের সাথে পাভেল এবং হামজা। ওরা যেতেই নওরীন ফোন দিলো।

– জানো শাহীন,আমি ভাবতেই পারছিনা শেফালী আপা এই কাজ করছে এতদিন ধরে।

– আমার তো ওকে মে*রে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ও এতদিন ভাইজানের পেছনে লেগেছে,আমার পেছনে লেগেছে কিছুই বলিনি কিন্তু আমাদের মান সম্মান বিকিয়ে নিজের ক্ষতি করে কি লাভ হলো!

– আবির কোথায়?

– পাঠিয়ে দিবে নোমানের কাছে। নোমানের নেক্সট মান্থে ফ্লাইট নিউজিল্যান্ড। ও স্যাটেল হলে কয়েকমাস পর এসে নিয়ে যাবে। এমনিতেই আবিরের খেয়াল আম্মু আর ভাবীমা রাখে।

– বাচ্চাটাকে অনেক আদর লাগে। কষ্ট হবে না তোমাদের।

– আমি থাকবোনা। ভাইজানের অবস্থা নিয়ে সন্দিহান সবাই।ভাইজান চেয়েছিলো নিজের কাছে রেখে দিতে কিন্তু বলা তো যায়না,যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে ভাবীমা তো শেহজা, আবির দুজনকে সামলাতে পারবেনা।

বুকটা কেঁপে উঠলো কথাটা বলতেই।নওরীন ও পাশ থেকে নিশ্চুপ। শাহীনের কম্পিত গলায় বুঝা যাচ্ছে কতটা আবেগী হয়ে পড়েছে। নওরীন সময় নিয়ে বললো,

– ভাইজানকে যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে বলো। আমি নিজেকে ওই জায়গায় ভাবতেই ভীত আর ভাবীমায়ের কি অবস্থা?

– জানিনা তবে ভাবীমা অসম্ভব মনোবল সম্পন্ন নারী। ভাঙতে দেখছিনা। হয়তো আপনজনের বিয়োগ দেখেই তিনি অভ্যস্ত।

– দেখা করবে? মন ভালো লাগছেনা।

– আজকে না আগামীকাল করবো।পুরো দিন তোমার নামে। আজকে ভাইজান সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সবাইকে বাসায় থাকতে বলেছে।

– ঠিক আছে। দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

ফোন রেখে শাহীন পুনরায় নিজের কাজ করতে থাকলো। বন্ধু রফিকের অফিস জমজম টাওয়ারের তৃতীয় তলায়। প্রায় এখানে এসে নিজের কাজ গুলো সেরে নেয়।

___

বাড়ির লিভিং রুমে সবাই একত্রিত হয়েছে। ঘড়িতে ছ’টা পঞ্চাশ। রায়হান সাহেব ও সুলতানা কবিরের ডজন খানেক প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে শাহীন৷ শিফা আজ বাসায় নেই। তাহির সাথে বেড়াতে পাঠিয়েছে। শেহজাকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ। লিভিং রুমে উপস্থিত আছে রায়হান সাহেব,সুলতানা কবির,দিয়া,শেফালী এবং শাহীন। ঘড়ির কাঁটা সাত’টা। নিচে গাড়ির আওয়াজ। দরজা খুলে দিয়েছে শাহীন। বড় বড় পা ফে*লে ক্ষীপ্র গতিতে আসছে। চোখ থেকে সান গ্লাসটা খুলে শার্টের সামনের অংশে প্রথম বাটনে আটকালো। অফিশিয়াল প্রোগ্রাম থাকাতে আজ ব্লেইজার পরিহিত ছিলো। বাড়ির দিকে এগুতে এগুতে গায়ের ব্লেইজার খুলে দিলো রহমত চাচার হাতে। সাদা শার্টের হাতার বোতাম খুলে হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত উঠালো। দু কদম এগিয়ে রহমত চাচাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে ঠাস করে সকলের সামনে বাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো। সানগ্লাস টা টেবিলে রেখে ব্লেইজার ছুঁড়ে মা*রলো সোফায়। প্যান্টের মাঝে ইন করে গুঁজে থাকা শার্টের ইন খুলে এক টানে প্যান্টের বেল্ট খুলে ফেললো। পরিবারের সকলে দাঁড়িয়ে পড়লো। শেফালীকে হেঁচকা টান মেরে সোফা থেকে উঠিয়ে বেধড়ক বেল্ট দিয়ে প্রহার শুরু করলো। প্রতিটা বাড়ি পিঠে, কোমড়ে, ঘাড়ে পড়ছে। শেফালীর চিৎকারে কাঁপছে বাড়ির প্রতিটি ইট। শাহাদের বিধ্বংসী রূপ দেখে পরিবারের প্রত্যেকে ভীতসন্ত্রস্ত। শাহাদ গর্জন তুলে বললো,

– তোকে আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম,সময় দিয়েছিলাম,আচরন সংযত করতে বলেছিলাম। কিন্তু তুই কি করলি সব কিছুকে তুঙ্গে তুলে চরিত্র বিকিয়ে আসলি। তুই আমার হাতেই ম*রবি। কেউ শাহাদ ইমরোজের বোনকে বে*শ্যা বলবে সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনবে। কিছুতেই মেনে নিতে পারবোনা। তোর তো বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কোন সাহসে গিয়েছিলি খালেদ পারভেজের শয্যাসঙ্গী হতে। আমাকে ফাঁসাতে ওই জা/নো’য়া র তোকে কত লাখ টাকা দিয়েছে!

সুলতানা কবির মেয়ের উপর প্রহার দেখে যতটা ঘাবড়েছিলো ছেলের কথা শুনে বাকরুদ্ধ। রায়হান সাহেবের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সোফার হাতল ধরে বসে তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলেন,

– আমি ব্যর্থ বাবা।

শেফালী শাহাদের পা জড়িয়ে হাঁউ মাঁউ করছে,

– ভাইজান আর করবোনা এবারের মত মাফ করে দেন।

জড়িয়ে ধরা পা দিয়ে একটা লা*থি দিয়ে দু হাত দূরে ফে/লে দিলো। শেফালীর চিৎকারে বাড়ি যেন ম*রা বাড়ি হয়ে উঠলো। শাহাদ ফ্লোরে বসে শেফালীর দু চোয়াল শক্ত করে ধরে বললো,

– কান্না বন্ধ কর,নতুবা এখনই এখানে গেঁ/ড়ে দিব। একটা আওয়াজ যেন মুখ দিয়ে না বের হয়। বন্ধ কর ব*দ/মাশ। আরেকজনের চরিত্রে দোষ লাগাস। তোর মত সেলিব্রিটি প*তিতার কাছে তো আমার ঘরে বাকি চার নারী নিরাপদ নয়। আমার নারীর গায়ে তুই বে*শ্যার তকমা লাগাস, আমার আরো দুইটা কলিজার টুকরা আছে এই বাড়িতে,শিফা-শেহজা ওদের আশপাশে তোর মত সার্টিফাইড প্রস্টিটিউটের কোনো জায়গা নেই। এই শাহীন, ঘর বন্ধি কর ওরে।দুই বেলার বেশি খাবার দিবি না। ওর রুমের চাবি আমার কাছে থাকবে। আফিয়া খালা আসলে সে যেন খাবার দেয়। খবরদার এই বাড়ির কেউ যদি এই অপবিত্রার মুখদর্শনে যায় তবে সেই ব্যক্তির সাথে শাহাদের আর যোগাযোগ থাকবেনা। আমার বোন হয়ে আমার চরিত্রে দাগ লাগাস। তুই তো মা,বোন,স্ত্রী নামের কলঙ্ক। এই কলঙ্ক নিয়ে মরেও শান্তি পাবি! কি জবাব দিবি আল্লাহকে!!

কথা বলতে বলতে ও শাহাদ অনবরত বেল্ট দিয়ে মারছে। ফরসা শরীরটাতে রক্ত,কালশিটে পড়ে যাচ্ছে। বেল্ট ছিড়ে গিয়েছে শাহাদের। দিয়া দেখতে পেলো শাহাদ হাঁপিয়ে উঠেছে। শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। সামনের উন্মুক্ত বোতামে দেখা যাচ্ছে বুক,গলা বেয়ে তর তর করে ঘাম ঝরছে। শাহাদের শরীরের জন্য এত চাপ মারাত্মক ক্ষতিকর। শাহীন দুবার ধরতে এসে মা*র খেয়েছে। দিয়া বুঝতে পেরেছে শাহীনের মত ধরে লাভ হবে না।লোকটা ক্ষ্যাপা সিংহের মত ব্যবহার করছে। সরাসরি সামনে দিয়ে এসে দিয়া ঝাপটে ধরে।দিয়াকে হাত দিয়ে সরাতে গেলেই দিয়ার গায়েও বাড়ি লাগে। কেঁপে উঠে দিয়া। হুঁশ পেয়ে শাহাদ এক হাতে বুকে আগলে নেয় দিয়াকে। মেয়েটা ঢোক গিলে চোখ মুখ খিচে সহ্য করে নেয় সবটুকু ব্যাথা। একটা আঘাতে দিয়ার শরীর, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। শেফালী হজম করছে কি করে! হাতের বেল্টা ফেলে দিয়ে শাহাদ এক পাশে দিয়াকে, অন্যপাশে শাহীনকে বুকে আগলে নেয়। শাহীনের দু চোখে আজ অশ্রু। দিয়ার চোখের পানিতে শাহাদের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। শাহাদ পাথরের মত অনড়। শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছে। চুপচাপ গুটি মেরে ফ্লোরে শুয়ে আছে। রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখে মাথা নিচু করে বসে আছে। নিরবে চোখের পানি ফেলছে। সুলতানা কবিরের দুহাতে মুখ ঢাকা। সহধর্মিণী স্ত্রী এবং ভাইকে শক্ত করে চেপে ধরলো বুকের সাথে। ওষ্ঠ চেপে নিজেকে সংযত করতে চাইলো,ব্যর্থ হলো।নিশব্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে নেত্রে বেয়ে। ধরনীর সমস্ত মন খারাপ আজ রায়হান সাহেবের বাড়িতে।শাহাদ হালকা কম্পিত গলায় দুজনকে বললো,

– স্যরি তোমাদের মা*রতে চাইনি।

প্রথমে ভাইয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

– বেশি লেগেছে?

শাহীন মাথা তুলে দু পাশে মাথা নেড়ে বুঝায় লাগেনি। দিয়া এখনো মুখ লুকিয়ে শাহাদের বুকে। দিয়ার কপালে চুমু দিয়ে বলে,

– ভেতরে যাও, আমি আসছি।

দিয়া আরেকবার শেফালীর দিকে তাকালো। শেফালীকে ধরতে গেলেই তেঁতে উঠলো। সুলতানা কবির দিয়াকে আগলে ধরে রুমে পাঠালো।কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন মআ রূপী নারী। দিয়া নিজের রুমে চলে আসলো সময় অপচয় না করে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে শাহাদের এই রূপ দেখে। এই মানুষটা কতটা যন্ত্রণা সহ্য করেছিলো সেদিন,যেদিন তার চরিত্রে দাগ লাগলো। বোনের একেকটা কাজ পরিবারের মান সম্মান ধূলোয় মিশিয়েছে।

শাহাদ পুনরায় হুংকার ছেড়ে বললো,

– আজ থেকে সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এসি,টেলিভিশন, ইন্টারনেট সংযোগ সহ যা যা আছে সব বন্ধ। থাকা,দুবেলা খাবার আর পানি পাবে। বাইরে যাওয়া বন্ধ। মেমোরি কার্ড তো আছে আমার কাছে। নিজের বোনের রঙ্গলীলা দেখেছি। বাইরের মানুষ ফোন দিয়ে যখন বলে আপনার বোনের পারফরম্যান্স দূর্দান্ত। শুনতে যে কি ভালো লেগেছে, মন চেয়েছে সেই মুহুর্তে মাটি ফাঁক হয়ে যাক আমি ঢুকে পড়ি। বিয়ে দিয়েছিলাম না, স্বামী রেখে বাইরে ছুঁক ছুঁক করতে গিয়েছিলিস কেনো! টাকা লাগলে বলতি, ও স্যরি তোর তো টাকা লাগবেনা, লাগবে বিলাসীতা আর কুঠি বাড়ি।হয়েছে কয়েকটা প/তি/তার সর্দারনি।আরেকটারে বানাচ্ছে এসিস্ট্যান্ট। তোর এসিস্ট্যান্ট এর নাম মনি তাই না।ওটাকে শেখাচ্ছিস How to do well performance? এমপির বউ হবি দিয়ার মত,তাই না! এসবই শুনলাম আজ। তাই খালেদ পারভেজকে আমার সম্পর্কে সব তথ্য পাচার করেছিস। বিজনেস করবি তাই না! করাচ্ছি তোর বিজনেস আমি। বিজনেসের জন্য তোর কোন না*গরকে বিশ লাখ দিয়েছিস!

শেফালী ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। এত খবর কি করে জানে। পুনরায় হুংকার ছাড়লো শাহাদ,

– উত্তর দে বে*য়াদ*প।

কম্পিত গলায় জানালো,

– খা লেদ পারভেজ কে…

শাহাদ আরো জোরে লাথি মা*রলো বোনের কোমড়ে। ব্যাথায় চিৎকার দিয়ে উঠলো।

শাহাদ দাঁত কটমট করে বললো,

– একদম পি*ষে ফেলবো। শেষ সুযোগ দিলাম ভালো হয়ে যা। শাহীন…

– জ্বি ভাইজান।

– বুঝতে পারছিস তো কি করতে হবে!

– জ্বি ভাইজান।

শেফালীকে ওর রুমে ধরে রেখে আসলো শাহীন। লিভিং রুমে ফিরে আসতেই শাহাদ বললো,

– নওরিনকে ফোন দিয়ে বল, আগামীকাল আমাদের সাথে লাঞ্চ করতে। ওর যেহেতু অভিভাবক নেই সেক্ষেত্রে মেয়ে পক্ষের অভিভাবক আমি হব। আগে সবার সাথে পরিচয় করানো উচিত।

কৃতজ্ঞতায় শাহীনের মুখে হাসি ফুটলো। সুলতানা কবির শাহাদের কাছে আসতেই মাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

– আম্মু গো, মাফ করে দিবেন। আমি চাইনি আপনার সন্তানকে আ/ঘাত করতে। শেফালী এতটাই…

সুলতানা কবির ছেলের মুখে হাত দিয়ে বললো,

– বাবু তুই মাকে মাফ করে দেয়। আমি ওকে সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে পারিনি। নাহলে তুই পুতুলের মতো আগলে রাখা বোনের গায়ে হাত তুলতি না আমি জানি। যে শেফালীর পায়ে ছোট বেলার গোলাপের কাঁ/টা ফুটেছিলো বলে পুরো গোলাপ গাছ উপঁড়ে ফে*লেছিস,সেই ভাই আজ আধমরা করলি।ওমন ভাইয়ের মূল্য বুঝলোনা মেয়েটা।বেশ করেছিস। বুকটা জ্বলছে ওর জন্য। তবে ও শাস্তিযোগ্য। বুঝতে দেয় কত বড় অপরাধ করেছে।

___

তাহি আর শিফা ঘুরে ঘুরে অনেক শপিং করেছে আজ। শপিং শেষে রেস্টুরেন্টে বসতেই পাশের টেবিলে দেখতে পেলো আবির এবং লিমনকে। শিফা ছুটে এলো। লিমন এমন সারপ্রাইজ পেয়ে খুশি হয়ে গেলো।এ যেন মেঘ না চাইতে জল। তাহি বাধ্য হয়ে ওদের পাশে বসলো। লিমন তাহিকে দেখে এক রাশ হাসি দিয়ে বড় করে সুউচ্চ শব্দে সালাম দিলো। আবির,লিমন বাটারস্কচ খাচ্ছে। শাহীন ঘন্টা খানেক আগে ফোন দিয়ে বলেছিলো আবিরকে নিয়ে আসতে। বাসায় মিটিং হবে শাহাদের নির্দেশ ছোটরা যেনো না থাকে। তাহি চুপচাপ ওর অর্ডার দেয়া কোল্ড কফি খাচ্ছে। শিফাকে উদ্দেশ্য করে তাহিকে শুনিয়ে লিমন বললো,

– কেমন লাগে দেখতো শিফা, এখন আমার বাটারস্কচ খেতে মন চাইছেনা। কোল্ড কফি খেতে ইচ্ছে করছে।

– তো খাও৷

– এত গুলো তো খাবোনা। কত্ত বড় কাপে দেয় দেখছিস।

শিফা নিজের টা বাড়িয়ে দিলো লিমনের দিকে।বললো,

– অর্ধেক ঢেলে নিয়ে খাও৷ বেশি খেও না।

– আরেহ না না আমি তো একজন।তোর টাতে বেশি। ডাক্তার তাহি অর্ধেক খেয়েছে। তোরা দুজন মিলে তোর টা খা। আমি উনার টা নিচ্ছি।

কথা শেষ করেই লিমন অনুমতির অপেক্ষা না করে তাহির কাপটা নিয়ে ঠুস করে চুমুক দিয়ে দিলো৷ তাহি চমকে গিয়ে চক্ষু বহিরাগত হওয়ার অবস্থা। শিফা নাক কুচকে বলে,

– এই, আপু মুখে দিয়েছে ওটা খাচ্ছো কেন? এভাবে খায় কেউ,কারোটা কেড়ে নিয়ে?

– তোরটা খাইনা, তোরটা পারলে উনার ও পারবো। দুজনই আমার আপনজন।

– ও হ্যাঁ সেই হিসেবে আপু তো তোমার বড় বোন।আচ্ছা খাও।

লিমন নাক মুখ কুঁচকে বলে,

– বড় বোন কিরে!

তাহি তখন হেসে খোঁচা দিয়ে বলে উঠলো,

– খাও ছোট ভাইয়া পুরোটাই খাও। তুমি চাইলে আরেকটা অর্ডার দিতে পারি। বড় আপুকে তো সবসময় পাবে না। এখনই খাও না হয়৷

লিমন গজ গজ করতে করতে এক নিশ্বাসে পুরোটা খেয়ে আবিরের হাত ধরে উঠে বললো,

– এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে, এই দিনেরে নিয়ে যাবো সেই দিনের কাছে।মনে রাইখেন।

– কিহ!

লিমন তাহির কানের একদম সন্নিকটে এসে ফিসফিস করে বললো,

– হ্যাঁ, সেদিন আপনি নিজের পাতলা গোলাপি অধরের দুমুক দেয়া এক কাপ মিষ্টি চা আমাকে অতি যত্নে আদরে মুড়িয়ে খাওয়াবেন। প্রমিজ। নাহলে আমার নাম ও লিমন নয়।

তাহি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলে গেলো এই ছেলে।ভারী বে*য়াদব, ব/জ্জাত।

___

হাতের অয়েন্টমেন্টটা নিয়ে দিয়ার পাশে দাঁড়ালো। মা*রার সময়টাতে বেল্ট লেগেছিলো দিয়ার কোমড়ে আর ঘাঁড়ে। ঘাঁড়ের চুল সরিয়ে অয়েন্টমেন্ট লাগাতেই কেঁপে উঠলো দিয়া। ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে জ’লছে
আ/ঘাতপ্রাপ্ত স্থান। আঁচল সরিয়ে কোমড়ে লাগিয়ে দিলো। বড্ড ভয় পেয়েছে এই মেয়েটা। শাহাদ দিয়ার কোমড় পেঁচিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।ঘাড়ে ক্ষতস্থানে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। হাঁটু গেড়ে বসে একই কাজ কোমড়েও করলো। বারান্দার গ্রিল চেপে ধরলো দিয়া। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। পূর্ব অবস্থানে এসে দিয়াকে পেঁচিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,

– স্যরি সোনা। আমি ঠিক ছিলাম না।

– সমস্যা নেই ইচ্ছে করে তো আ/ঘাত করেন নি।

– ফারাহ আকাশটাকে দেখো।তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে। হয়তো অন্য কোনো সন্ধ্যারাতে এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি শাহাদকে খুঁজবে দূর আকাশে।তখন আমাদের দূরত্ব হবে হাজার বছরের।যদি উত্তম কাজ করি তবে দেখা হবে জান্নাতে।

বুকটা ধুকধুক করে কাঁপছে। শাহাদের কথার স্পষ্ট ইঙ্গিত। দিয়া মুহুর্ত অপচয় না করে শাহাদের বুকে আঁছড়ে পড়ে আর্তনাদ করে উঠে,

– আর বলবেন না এমন কথা,আমি থাকবো কি করে এই গম্ভীরমুখো,কাটখোট্টা, রসকষহীন,ক্ষীপ্ত মেজাজী মানুষটার বক্ষ ছাড়া। আমি পারবোনা শেহজার বাবা।কিছুতেই না।

শক্ত করে বুকে চেপে ধরে অর্ধাঙ্গিনীকে। গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু৷ কখনো কি ভেবেছিলো যাকে বিয়ে করার জন্য পাগলামী করে কত সংখ্যক মেয়ের সাথে বিয়ে ভেঙেছে আজ তার সাথেই হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইশারায় থাকা হবে না। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।

চলবে…