#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২৬.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
পেন্ডুলাম ঘুরছে, চক্ষুস্থির। মনে হলো যেন পাখি হাত ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষন আগেই নিউজ আসলো এমপি শাহাদ ইমরোজ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছে। কত বড় সুযোগে মিস হয়ে গেলো। সুযোগটা কাজে লাগাতে না পারার আফসোসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে খালেদ পারভেজ এবং ফরিদ রেজা রশীদ। ফরিদ রশিদ গাল ভেঙচি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
– পারভেজ তুমি পুরাই অথর্ব। চোখে ধূলা দিয়ে পালালো হাঁটুর বয়সী ছেলেটা অথচ টের পেলেনা।
– আমাকে কম দোষ দিবেন স্যার। আপনার ঘর থেকে যে অহনার রিপোর্ট গায়েব হয়ে গেলো তার দোষ কে নিবে।
– আমার দিকে আঙ্গুল কম তোলো। ওই মেয়েটি কোথায় যার কাছে রাশেদের রিপোর্ট ছিলো।
– লোক পাঠাইছি আসতেছে।
___
একটা রাত পেরোলো,দিন পেরোলো নিজেকে এখনো সামলাতে পারলো না দিয়া। রুম থেকেই বের হয়নি সারাদিন। শেহজাকে বাড়ির অন্যরা সামলেছে। ছোট্ট শেহজা থেমে থেমে কিছুক্ষন পর পর বাবা! বাবা! বলে চিৎকার দিচ্ছে। বাবাকে কাছে পেতে চাইছে। ওই তো ঘন্টা খানেক আগের কথা। ফিডিং এর সময় খেতে খেতে কেঁপে উঠলো। খাওয়া ছেড়ে মায়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে দু বার বাবাকে ডাকলো। দিয়া মেয়েকে আদর করে আবার খাওয়ালো। শাহীনের মাঝে, লিমনের মাঝে বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এই ছোট্ট মেয়েটা। শেহজাকে কোলে নিয়ে দিয়ার অনুমতিতে শাহাদের স্টাডি রুমে এসেছে শাহীন কিছু ফাইল নিতে। সেখানে শাহাদের বড় একটা ছবি টানানো আছে নেভি ইউনিফর্মে। বাবাকে ছবিতে দেখে সজোরে খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– বাবা
নিজে নিজে হাতে তালি দিচ্ছে। শাহীন রুমের সব কটা বাতি জ্বালিয়ে দিলো। শেহজা আঙুল দিয়ে বুঝাচ্ছে, উ উ বা বা। মানে ওদিকে যাবে বাবার ছবির কাছে। বুদ্ধিদীপ্ত নেত্র, চৌ’কস,সাহসী শ ক্তি’শালী শাহাদ ইমরোজের এই চারফিট ছবিটাতে তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। শাহীন হ’তা’শা নিয়েই ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভাইজান আপনি জীবনে অনেক সঠিক কাজ করলেও ভাবীমা আর শেহজার প্রতি সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করলেন। আপনার অভাব অপূরণীয়।
___
রাগে শরীর রি’ রি’ করছে। নিজেকে অতিমাত্রায় চালাক ভাবা রমনীর দূ/র্দ/শা দেখে উপস্থিত সকলের মাথা ঘুরে গিয়েছে। মুখোমুখি সকলে উত্তর জানতে চায়। ফরিদ রশীদ রেগে টেবিলে সজোরে আঘাত করে র/ক্ত/চক্ষে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
– রিপোর্ট কোথায়??
কেঁ/পে উঠলো মনি। বুকের ভেতর ভয়েরা আজ শক্তপোক্ত একটা বি/পদের আভাস দিচ্ছে। এখানে অবস্থা স্বাভাবিক নয়। সে একা আর সবকটা হা’য়ে’না। আজ নিজেকে অসহায় বোধ করছে, তবে রিপোর্টটা কোথায়! মনির পাশে বসে আছে আরেকজন ফরেনসিক ডাক্তার। তাকে আনা হয়েছে রিপোর্টের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। তখন থেকেই চেক করে একই কথা বলে যাচ্ছে। পুনরায় বললো,
– কোনো ভাবেই এটা লে. কমান্ডার রাশেদের রিপোর্ট না। ডি এন এ ম্যাচ করছে না, একটা রিপোর্ট ও অথেনটিক না।
আলতাফ নার্ভাস হয়ে ঢোক গিলে বলে উঠলো,
– তার মানে কি?
ডাক্তার বললো,
– আমাকে আগে ক্লিয়ার করুন সঠিক মানুষের পোস্টমর্টেম হতে কেউ দেখেছে?
মনি দু পাশে মাথা নেড়ে বললো,
– না তা তো দেখিনি। কিন্তু শাহাদ ভাই তো রাশেদকে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়েছিলো।
ফরিদ রশীদ দাঁত চিবিয়ে বলে,
– কত বড় মা**** চো**। সবার চোখকে কিভাবে ফাঁকি দিলো। বোকা বানাইছে আমাদেরকে। ও পোস্টমর্টেম করায় নাই। ওরে আমি চিনি। ও এমন কাজ আগেও করছে, একজন অফিসারের ক্ষেত্রে ও করায় নাই।
সকলে হতভম্ব। মনি হাতের রিপোর্ট দেখিয়ে বলে,
– তাহলে এটা কার? এত যত্নে আগলে রেখেছিলো।
ফরেনসিক ডাক্তার হেসে বললেন,
– আপনাকে ডক্টরের সনদ যে দিয়েছে সে বে/য়া/ক্কে/ল নয়তো আমরা আপনাকে ডাক্তার মানছি আমরা বোকার দল। ম/র্গে অগণিত বে’ও’য়া’রি’শ লা/শ পড়ে আছে। কোনো একটার রিপোর্ট কালেক্ট করা এমপি শাহাদের জন্য আহামরি কোনো ফ্যাক্টই না। তবে আগলে রাখার ব্যাপারটা ধোঁয়াশা। আমার তো ভয় হচ্ছে আপনাকে নিয়ে। আপনার কৃতকর্ম আগে থেকে টের পায়নি তো!
তড়াক করে উঠলো মনির চোখ,
– মানে কি?
খালেদ পারভেজ উঠে সরাসরি মনির চুলের মুঠি ধরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
– বে*** তুই একটা বেডা পটাতে পারোস নাই এত বছর, আসছোস এতগুলা গুলো বেডার লগে ডিল করতে। একটা রিপোর্ট ঠিকঠাক আনতে পারলিনা! ও আচ্ছা, আনবি কেমনে তোর মরদ তো তোর চোখেই ধূলা দিছে। শা*লী তুই যে বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছোস শাহাদ ওই বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার।
মনির আ/র্ত/না/দে ছুটে আসলো সকলে। চুল ছাড়িয়ে নিলো খালেদ থেকে। ফরিদ তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে উঠলো,
– ভুল বললে পারভেজ ওই বিদ্যালয়ের হেড মাস্টার তুমি। শাহাদ তুমি যে বিষয়ে পড়ছো ওটার হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট বুঝলা। ও আমার বাসায় বসে আমার সাথে গেম খেলে গেলো অথচ আমি ঘুনাক্ষরে ও টের পেলাম না। তুমি ওরে বুড়া আঙ্গুল দেখাও!! ও তোমার সেই আঙ্গুল কে*টে প্যাকেট করে রেপিং এ মুড়িয়ে গিফট পাঠাবে এমন পাবলিক।
খালেদ পারভেজ আঁকুতি নিয়ে বললো,
– স্যার, এখন উপায়! সবাই ফেঁসে যাবো তো! অহনা যে গ্যাং রে/প/ড এটা তো রিপোর্টে আছে। আমার,আপনার নাম ও আছে।
আলতাফ জোরে কেঁশে মনোযোগ আকর্ষণ করে বললো,
– দেখি আমি কি করতে পারি।
ফরিদ রশীদ গালি ছুঁড়লো ওর দিকে,
– বাই****দ তুই একটা ভাই, আর শাহাদ ও একটা ভাই। বইনের রে/পি/স্ট গুলার সাথে বসে আড্ডা মারাস। বা*** ফালাবি তুই।
– গা*লি দিবেন না।উপকার করছি আপনাদের। ও কখনো আমার আপন বোন ছিলো না। আমার বাপের দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে ছিলো।আমার কি?
– ভাই তো ডাকতো!
– ওই যে মনিকা ম্যাডাম ও এমপি শাহাদকে ভাই ডাকে। কিন্তু মনে মনে ঠিকই বিছানায় চায়।
খালেদ পারভেজ এক দলা থুতু ফেললো নিচে। কিছু গালি আঁওড়ে উঠে দাঁড়ায়। মনির দিকে ক্রু/দ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে ধপাধপ পায়ে বেরিয়ে পড়লো।
___
পানের পিক ফেললো থুক দিয়ে। লাল রঙা ঠোঁট আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে পঞ্চাশোর্ধ মেহেরজান আম্মাকে। সামনে বসে আছে মা*রের ঘোরে কাতর হওয়া সিজার, রকি এবং সাথে আছে তিনজন গোয়েন্দা সদস্যসহ পাভেল এবং লেফটেন্যান্ট তানভীর।
তানভীরের চোখে মুখে অ/ন/লের মত ক্রো/ধ। যাওয়ার আগেই কাজটা তানভীরকে বুঝিয়ে দিয়েছে শাহাদ। সিজারকে যতগুলো প্রশ্ন করেছে একটির ও উত্তর দিতে পারেনি। বিনিময়ে মা*র খেয়েছে অগণিত। অহনা মেহনাজ, ক্যাপ্টেন আলতাফের ছোটবোন অন্যদিকে তার আরো একটি পরিচয় আছে যা গোপন ছিলো এতগুলো বছর। মেহেরজান আম্মার ভি আই পি কাস্টমার খালেদ পারভেজ। এই পল্লীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে গুলো তার জন্য সাজিয়ে রাখা হচ্ছে বিগত তিন বছর ধরে। অহনা নিয়ে শোনা কথা আছে অনেক। তিনবছর আগে গেট টুগেদার করা হয় শিপে তিনবাহিনীর পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে। সাধারণত এই সুযোগটা সবাই পায়না। অফিসার নিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে এসেছিলো। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলো লে. কমান্ডার শাহাদ ইমরোজের ইউনিট। ইউনিট সদস্য কিংবা অফিসারদের পারিবারিক মেল বন্ধন অনুষ্ঠানে শাহাদ কখনো পরিবার নিয়ে আসেনা। ব্যক্তিগতভাবে তার পছন্দ নয়। যদি নিয়ে আসতেই হয় তবে রায়হান সাহেব এসে ঘুরে যান। সেদিন ও তেমনটাই হয়েছে, নিজের পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে আসেনি।সকলের অনুরোধ ও অগ্রাহ্য করেছে। শাহাদের ইউনিটের কোনো সদস্য পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে আসেনি। পার্টি হচ্ছে, নাচ গান হচ্ছে সাথে আছে স্পেশাল পানীয়। সব মিলিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশ। রাশেদ এবং শাহাদ সন্ধ্যার নাস্তা করছিলো তখন ক্যাপ্টেন আলতাফ এসে তার ছোট বোন অহনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো সকলের। প্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ে। দেখতে শুণতে বেশ ভালো, ছটফটে। কিছুক্ষনের মাঝে তারা চলে যায়। তানভীর এগিয়ে এসে বললো,
– স্যার আলতাফ কেমন যেন গায়ে পড়া।
শাহাদ আঁড়চোখে তাকিয়ে বলে,
– নো কমেন্ট। আই ডোন্ট লাইক ইট।
– স্যরি স্যার।
শিপের ছাদে রাতের খাবার শেষ করে তানভীর এবং রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। রাহাত তানভীরকে বলে উঠলো,
– স্যার না বললে এখানে আসতাম না। আমার ভালো লাগছে না রে।
তানভীর মৃদু হেসে বলে,
– ইট ইজ অলসো ইউর টেস্ট ব্রো। স্যার কিন্তু তোকে মার্কিং করবে।
রাহাত হতাশ হয়ে বলে উঠলো,
– এমন কেনো আমাদের লাইফ। আমার ভালোই লাগছেনা। মন চায় পালিয়ে যাই।
– তুমি চাইলেই পালাতে পারো লেফটেন্যান্ট রাহাত। পালানোর রাস্তা আপাতত দুটো। পানিতে ঝাঁ/প দিবে নতুবা আমি তোমাকে ডিরেক্ট উপরে পাঠাবো। কোনটা চাও?
চমকে উঠলো রাহাত এবং তানভীর। মনে মনে স্রষ্টাকে স্মরণ করছে। রাহাত ধরা গলায় বললো,
– স্যরি স্যার। আর বলবোনা এমন কথা।
– কমপ্লিট টুয়েন্টি পুশ আপ এন্ড লেফটেন্যান্ট তানভীর এজ ওয়েল।
– আই আই স্যার।
শাহাদ চলে যেতেই তানভীর চোখ পাকিয়ে ধমকে বললো,
– স্যার পাঠানোর আগে আমি তোকে ভোগে পাঠাবো। সারাদিনের খাটনি এখন এই শরীরে পুশ আপ! তোর জন্য হয়েছে। এবার পালানোর ভূত মাথা থেকে নামা। শা** হা*রা****।
– আমি কি জানতাম…
– চুপ থাক। আবার দেখলে এই মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিবে।
..
ঘড়িতে রাত দুটো। রাহাত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কিচেনের দিকে গেলো। এক গ্লাস পানি পান করে নিলো। পাশের রুম থেকে হাসাহাসির শব্দ আসছে। হয়তো পরিবারের সকল সদস্য একসাথ হয়ে হাসাহাসি করছে। আকাশে কেমন বজ্রপাতের ঘনগর্জন। শিপের ছাদে চলে এলো পুনরায়। বিশটা পুশ আপ দিয়ে শরীরে ব্যাথা করছে। ট্রেইনিং পিরিয়ডে তো আরো বেশি দিতে হত। ছাদে উঠেই দেখতে পেলো সমুদ্র তোলপাড় করা গর্জন। কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত। ফোনটাও ফেলে এসেছে। ঝুম বৃষ্টি নামলো। ছাদের কর্ণারে একটি নারী অবয়ব। ভয় পেয়ে গেলো। ছাদের উপর অশরীরী আত্না তাও আবার এমন ঝড়ের রাতে। কেনো এলো! পাশ থেকে পানিতে সমুদ্রের বিধ্বংসী গর্জন। রাহাত মনে মনে আওড়ালো,
– লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জোয়ালিমিন।
ধীর কন্ঠে চিৎকার ভেসে আসছে বাঁচাও। সে চিৎকার আবার অন্য কারো নয়,স্বয়ং রাহাতের। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা। এমন ভুতুড়ে পরিবেশের মুখোমুখি আগে কখনো হয়নি। শিপের রেলিং আকড়ে ধরে পানিতে চোখ যেতেই দেখে পানি কালো কিছু একটা ধাপাধাপি করছে। আত্না উড়ে যাবার মতো অবস্থা। ওই অশরীরী কিছু একটাও নড়ছে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে জ্ঞান হারানোর অবস্থা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তানভীর। ঝাপটে ধরলো তানভীরকে। বৃষ্টিতে দুজন ভিজে একাকার। সমুদ্রের ঝড় তো বলে কয়ে আসবেনা এটা স্বাভাবিক। রাহাত আঙ্গুল দিয়ে প্রথমে পানিতে ঝাপাঝাপি করা জিনিসটা দেখালো, পরে ওই অশরীরি টা।তানভীর নিজেও শুকনো ঢোক গিললো। নেভি জীবনে সে এমন জিনিস দেখেনি। এরমধ্যে অতি মাত্রায় সর্বোচ্চ ডেসিবলে বজ্রনাদ হলো যা কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতক। অকস্মাৎ দেখলো ওই কালো জিনিসটা শিপের লেডার বেয়ে উপরে উঠছে। তানভীর ভয় লুকিয়ে রাহাতকে বললো,
– সামনে চল দেখি কি ওটা?
রাহাত কিছুতেই যাবেনা। এক প্রকার টেনে রাহাতকে নিয়ে যাচ্ছে তানভীর। নিজেও ভীত। সামনে আসতেই রক্তে- মাংসে মানুষের অবয়ব নিলো। সুইমিং গগলস টা খুলে এগিয়ে আসতেই রাহাত – তানভীরের জানে পানি এলো। রাহাত তো মুখ ফসকে বলেই দিলো,
– স্যার আমাকে রাতে ফা/লা/ই দিবেন বলছিলেন? কিন্তু আপনাকে কে ফালায় দিলো পানির মধ্যে? বাঁচার জন্য লড়াই করছিলেন এতক্ষন! আমি তো বুঝতেও পারিনাই। নাহলে আমি আর তানভীর যেতাম…
তানভীর মুখ চেপে ধরলো রাহাতের। এই ছেলেটা ইউনিটে এসেছে গত সপ্তাহে। এর মধ্যেই শাহাদের মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহাদ ঠান্ডা গলায় বললো,
– বের হয়েছো কেনো কেবিন থেকে?
তানভীর জবাব দিলো,
– স্যার আমি ওকে না পেয়ে উপরে এসে দেখি এখানে ভয় পাচ্ছে। স্যরি স্যার।
রাহাত তানভীরের হাত মুখ থেকে সরিয়ে শাহাদকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে। শাহাদ ও সেদিকে চোখ দেয়। কিছুটা বিস্মিত হলো এই ভেবে কি জিনিস এমন অবয়ব নিয়ে স্থির হয়ে আছে।
কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
– কি এটা?
তানভীর জবাব দিলো,
– স্যার জানিনা এতক্ষন ধরে একই ভাবে একই জায়গায় আছে। মনে হচ্ছে অশরীরি কিছু।
চোখ পাকিয়ে তাকালো শাহাদ। দমে গেলো তানভীর। সুইমিং কস্টিউমে শাহাদকে গ্রিক বীরদের মতো লাগছে। এগিয়ে গেলো সেই অশরীরীর দিকে। পেছন পেছন আসছে বাকি দুজন। আচমকা প্রচন্ড শব্দে বাঁজ পড়লো মনে হলো যেন মাথায় পড়েছে। রাহাত আর্তনাদ করে উঠলো। শাহাদ পেছন ফিরে মুখ খিঁচিয়ে বললো,
– কাওয়ার্ড।
একটুখানি হয়ে গেলো বেচারা রাহাতের মুখটা। সামনের আসতেই স্পষ্ট হলো সেই অশরীরী জিনিসটা একজন নারী। শাহাদ আলতো স্বরে ডেকে উঠলো,
– এক্সকিউজ মি!
মেয়েটা ঘাড় ঘুরাতেই চমকে উঠলো তিনজন। তানভীর বলেই উঠলো,
– ম্যাডাম অহনা আপনি?
অহনা বৃষ্টিতে ছুপছুপ। নারী দেহের গঠন স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্যণীয়। শাহাদ মুখ ঘুরিয়ে পানির দিকে চোখ দিয়ে বলে উঠলো,
– মিস অহনা, এটা আপনার বাড়ি নয় যে মাঝ রাতে বৃষ্টিবিলাশ করবেন! তানভীর, কল ক্যাপ্টেন আলতাফ।ডেকের ভেতর চাদর আছে উনাকে এনে দাও।
– আই আই ক্যাপ্টেন।
এতক্ষনে অহনা মুখ খুললো,
– আপনাকে দেখেই উঠে এলাম কমান্ডার। এতক্ষন আপনার সুইমিং দেখছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি আসাতে ভেজার লোভ সামলাতে পারলাম না।
শাহাদের চোখ চমকিত,বিস্মিত। কি অবলীলায় বলে দিলো কথা গুলো। রাহাতের মুখটা দেখার মতো। ততক্ষনে আলতাফ ছুটে এসেছে, তানভীরের পেছন পেছন। বোনের গায়ে চাদর জড়িয়ে দিলো। অহনা শাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ইউনিফর্ম হোক আর সুইমিং কস্টিউম হোক ইউ আর লুকিং অলওয়েজ হট এন্ড পারসোনেবল।
চোখ ঘুরিয়ে নাক কুঁচকে পানিতে চোখ নিবদ্ধ করে বাঁজখাই গলায় আলতাফকে বললো,
– ক্যাপ্টেন আলতাফ…
– স্যরি স্যার। আই’ল হ্যান্ডেল।
বোনকে টে/নে হিঁ/চ/ড়ে নিয়ে গেলো। বৃষ্টি এখনো থামেনি। তানভীরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আমরা পরশু ফিরছি জানো তো!
– ইয়েস স্যার।
– ইনফরমেশন পাঠাও হেড কোয়ার্টার আগামীকালকের মধ্যে যেন ফোর্স পাঠায়। সন্দেহ জনক সাবমেরিন আছে থার্টি ডিগ্রি নর্থে। ইফ নিডেড দেন আই’ল জয়েন দেম ওকে!
– আই আই স্যার।
সামনে থেকে চলে গেলো তানভীর ও রাহাত। রাহাত ঘোর কাটিয়ে বললো,
– স্যার কি ঘুমায় না! পানির নিচে সাবমেরিন খুঁজতে এত রাতে সুইমিং এ নামছে? উনি কি স্বাভাবিক মানুষ!
– আস্তে বল। উত্তর পাইছিস কেনো কিং অফ দ্য ওয়েভ বলে?
– ভাই সত্যি স্যার যোগ্য এই নামের জন্য। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা এই ঝড়ে। অথচ পানিতে নেমে উত্তাল সমুদ্রে ডাউটেড সাবমেরিন খুঁজে বের করেছে।
– ভাই মাফ চাই আর এমন করিস না। স্যারকে রাগাস না।
এই ছিলো সেদিনের ঘটনা। সেই সাবমেরিন উদ্ধার করা হয়। এবং ধ্বংস করা হয় বে অভ বেঙ্গলে। কিং অফ দ্য ওয়েভের এক একটি কাজ ছিলো প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু সেই মানুষটা বন্ধুর অসমাপ্ত কেইসের ব্যাপারে এখনো বিফল। তানভীর পুরো ঘটনা মাথায় নিয়ে কেস সমাধানে নেমেছে। পূর্ণ মনোযোগ দিলো মেহেরজানের দিকে। ক্রুর হাসি দিয়ে তানভীর বলে উঠলো,
– তো আম্মাজি, আপনি যেমন টা দেখান আপনি কিন্তু তেমনটা মোটেও নন।
মেহেরজান ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,
– কি কইতাছো, কিলিয়ার কইরা কও।
– এই যে খালেদ পারভেজকে কাস্টমার বানান, ফরিদের বাসায় ললনা পাঠান অথচ এরা তো আপনার জাত শত্রু। কারণটা কি আম্মাজি এত ভালো সম্পর্কের!
ঘাবড়ে গেলো মেহেরজান। আমতা আমতা করে বললো,
– কাম থাকলে কইতে পারো। সাধ্যির মইধ্যে আপ্যায়নের ব্যবস্থা আছে। নতুন কচি মাল আছে। আর এই ছেমড়ারে কেন আনছো?
– স্রষ্টা ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না আম্মাজি। সাবধান। মানুষের মেয়েদের সম্মান নিয়ে সওদাবাজি করছেন অথচ…
হা হা করে হেসে উঠলো মেহেরজান হাসতে হাসতে পান চিবানো রক্ত লাল গালে বললো,
– আমার যা হারানোর হারাইয়া গেছে, এহোন আমি বিচার চাই। কোনো শূ******* চ্চারে বাঁচতে দিবোনা। শুনলাম তোমাগো সর্দার দেশ ছাড়ছে…
– আজ উঠি। জানাবেন কোনো সূত্র পেলে।
– আইচ্চা। তয় নাস্তা খাইয়া যাও। আমার বাবুর্চি কিন্তু পাচ ওয়াক্ত নামায কালাম করে। ভালা মানুষ আল্লাহ ওয়ালা বান্দা। নাপাক কিছু নাই।
পাভেল হাসি দিয়ে বলে,
– ভালা মানুষ আপনিও ছিলেন আম্মাজি। রাগ টা সংযত করলে হয়তো নাড়িছেঁড়া ধন হারাতেন না।
চরম বিস্ময় নিয়ে মেহেরজান তাকালো পাভেলের দিকে। যেন কোনো অজানা সত্য যেনে গিয়েছে যা গোপনে ছিলো এতটা বছর। কথা বাড়ায় নি। উঠে দাঁড়ায় সকলে। পাভেল পুনরায় বলে,
– আমাদের আবার দেখা হবে আম্মাজি। তবে আগামী বার ভালো কোনো সময়ে,ভালো কিছু নিয়ে। আর অনুরোধ এসব বন্ধ করেন আপনার জন্য এসব আসে নি।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
২৭.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
দু চোখ শ্রাবনের ধারার মত অশ্রু সজল। হামজা পূর্বেই মেসেজে জানিয়েছে তারা সুস্থভাবে সিঙ্গাপুর পৌঁছেছে। শাহাদের সাথে এখন অবদি কারো যোগাযোগ হয়নি। ফ্রি হয়ে ফোন দিবে জানিয়েছে। আজ দুদিন। পুরো বাড়ি জুড়ে যেন শূন্যতা। নিজেদের ব্যক্তিগত রুমটাকে দিয়ার এখন উত্তপ্ত মরুভূমি মনে হয়। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মুঠো ফোন রিংগিং। কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিলো। সামনে বসে আছে সুলতানা কবির, নওরীন,শিফা এবং রায়হান সাহেব। তারা যদিও জানেন ছেলের শয়নকক্ষে আশা অশোভনীয়। তবুও আজ কেউ নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারেন নি। শাহীনের কাছে টুকটাক খবর পাচ্ছে। তবে কিছুটা অবাক হয়ে শাহীনের কথা অবিশ্বাস করলো রায়হান সাহেব! এমনটা আগে কখনো হয়নি। সবার আগে রায়হান সাহেবের ফোনেই কল আসে শাহাদের। অথচ আজ দুদিন খোঁজ নেই। কিছুটা চিন্তিত থাকলে এখন স্বস্তি বোধ হচ্ছে। বাসায় কাউকে জানায় নি ফোন দিয়ে তাতে কারো রাগ নেই, দিয়াকে ফোন দিয়েছে শুনে সকলে রুমে উপস্থিত। একবার দেখবে বাড়ির প্রাণটাকে। ভিডিও কল করেছে, নিজেকে সামলে আঁচলে চোখ মুছে মাথায় ঘোমটা তুললো। ফোন রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে হামজার মুখ ভেসে এলো। সকলে চমকে উঠলো। শাহাদের ফোন নিয়ে হামজা কেনো দিয়াকে ভিডিও কল দিবে!
– ম্যাডাম আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুমুস সালাম
হামজা ভিডিওতে ব্যাক ক্যামেরা দেখিয়ে বাস্তব চিত্র তুলে ধরলো। দিয়ার আঁচলে মুখ চেপে ধরলো। কান্নারা আর বাঁধ মানলো না। ফোন ধরিয়ে দিলো সুলতানা কবিরের হাতে। হাতে ফোন নিয়ে সুলতানা কবির আঁৎকে উঠলেন। বাকিরা এগিয়ে এসে দেখে নিরব। হামজা ও পাশ থেকে বলে,
– আমি একটু ও সময় পাই নি খালাম্মা। গত দুটোদিন আমি হাসপাতালে। প্লেন থেকে নামার পরই স্যার সেন্সলেস হয়ে যায়। এয়ারপোর্টের এমার্জেন্সি এম্বুলেন্স হাসপাতালে পৌঁছে দেয় আমাদের। আমার ফোনের চার্জ শেষ। তাই বাধ্য হলাম স্যারের ফোন দিয়ে আপনাদের কল দিতে। প্লেনেই আমাকে স্যারের ফোন হাতে দিয়ে বলেছিলো আপনাদের জানাতে যদি কিছু হয়। আংকেলকে ফোন দিতে বার বার বারণ করেছে। কিন্তু আংকেল তো সামনে। আংকেল ক্ষমা করবেন। স্যার চায়নি আপনি কষ্ট পান। হয়তো স্যারের অসুস্থতার কথা শুনে আপনি অসুস্থ হয়ে যাবেন…
রায়হান সাহেবের চোখে পানি। ছেলে নিজের এমন করূন পরিস্থিতিতেও বুড়ো বাপের ভালোর কথা ভাবছে। তার এই সম্বলকে কেনো এমন জীবন দিলো মহান রব!
হামজা পুনরায় বললো,
– প্লেনের মধ্যেই ছটফট করেছে। বার বার বলছিলো, হামজা আমার কিছু হয়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে বেশি টাকা খরচ করবেনা। শরীরের অবস্থা ভালোনা। যত তাড়াতাড়ি পারবে বাংলাদেশ নিয়ে সমাহিত করবে। এত তিন চারদিনের জানাজা প্রয়োজন নেই। পরিবারের মানুষদের একবার আমাকে দেখাবে। আমার মেয়েটা যেন আমাকে ছুঁয়ে দেখে এই দায়িত্ব তোমার। খালাম্মা আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। আমার কান্না পায়। স্যারকে আমি শাসন করতে দেখেছি,আদর করতে দেখেছি। এখন আমার স্যার ওই সাদা বিছানায় হাসপাতালের পোশাক পরনে। যতবার দেখছি আমার ভেতরটা কেপে উঠছে। আফসোস হচ্ছে একা কেনো আসলাম। পাভেল ভাই,শাহীন স্যারকে আমার লাগতো। বার বার মনে হচ্ছে মানুষটা সুস্থ হয়ে আবার শাসন করুক। আমাকে এখানে কেউ দেখিয়ে দেয়ার মতো নেই। আমার ভয় হয় যদি আমার দ্বারা কোনো ভুল হয়! এত বড় একজন নেতা এমপি হয়েও কাউকে না জানিয়ে একা চলে এসেছে। শক্ত করে বারণ করেছে কেউ যেন হাসপাতালের খবর না জানতে পারে। আমার জন্য দোয়া করবেন আপনারা সবাই যেন সাহস পাই।
কাঁদছে হামজাও। দিয়া উঠে গিয়ে মুখ ধুয়ে এসে সুলতানা কবিরের দিকে তাকালো। হেসে বললো,
– আম্মু আমাকে দিন আমি দেখছি। আব্বু আপনি আম্মুকে নিয়ে যান। এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবে।
রায়হান সাহেব স্তব্ধ হয়ে আছে। সত্তর বছর বয়সের মানুষটা আর নিতে পারছেনা কোনো স্ট্রেস। সুলতানা কবির ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বলে,
– আমি আরেকটু বসি বৌমা।
দিয়া শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আচ্ছা। কিন্তু কাঁদবেন না। আমি কথা বলি কেমন।
বাধ্য সন্তানের মতো মাথা নাড়লো সুলতানা কবির। দিয়া বলে উঠলো,
– হামজা ভাই, ডাক্তার কি বলেছে?
– টেস্ট করেছে। অলরেডি ট্রিটমেন্ট শুরু অবজারভেশনে আছে। রিপোর্ট দেখে অপারেশন করবে। ডেট দেয়নি। চান্স ৬০/৪০। সাকসেসফুল হলে থেরাপির মধ্যে কেয়ারে থাকতে হবে কিছুদিন বা মাস।
– ঠিক আছে।
একটু থেমে দিয়া শিফার দিকে তাকালো। পুনরায় হামজাকে বললো,
– ভাইয়া আপনি কি কেবিনের ভেতর যেতে পারবেন?
– জ্বি ম্যাডাম।
– আচ্ছা কষ্ট করে যেয়ে, আপনার স্যারের দিকে সাউন্ড অফ করে ক্যামেরা টা ধরুন।
হামজা তাই করলো। এর মাঝে আফিয়া খালাকে ডাক দিলো। শেহজা আফিয়া খালার কোলে। রুমে আসতেই শিফাকে বললো,
– শিফা ফোন টা ধরো,আমি শেহজাকে ওর বাবাকে দেখাই।
কাঁদছে শিফাও। কেঁদে কেঁদে বলছে,
– ও ভাবীজান দেখাইয়েন না। আমাদের মেয়েটা ছোট্ট। কাঁদবে।
– আরেহ পাগল নাকি তুমি, না দেখালে ওর আফসোস থাকবে। ভালো মন্দ কিছু হলে আমাকে দূষবে।
শেহজাকে কোলে নিয়ে শাহাদকে দেখালো। হালকা ঘিয়া রঙা হাসপাতালের পোশাকে শাহাদ শুয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। শেহজা বুঝতে প্রথমে বুঝতে পারেনি কে। দিয়া বললো,
– শেহজা দেখো মা এটা কে?
তখনই সিস্টার ঢুকছে। হামজা কিছু একটা বুঝালো। সিস্টার সামনে গিয়ে শাহাদের মাস্কটা একবার সরালো। যেই না সরালো শেহজা বাবার মুখ দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– বা বা…
ডাকছে তো ডাকছেই মেয়ের থামার নাম নেই। কিন্তু বাবা তো মেয়ের জবাব দিচ্ছে না। এবার মেয়েটা মায়ের দিকে তাকিয়ে অভিমান করেছে। বাচ্চার এই অভিমান স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে বাবা কথা না বলাতে রাগ হয়েছে। ঠোঁট উলটে কাঁদছে আর বলছে বা..বা। বাবা না, না, না। দিয়া মেয়েকে বুকে চেপে ধরলো। হামজা বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। সাউন্ড দিতেই দিয়া বললো,
– ভাইয়া আপনি খাওয়া দাওয়া করেন। আপনার স্যারের খেয়াল রাখবেন। এখন রেখে দিন।
– জ্বি ম্যাডাম।
ফোন কে*টে গেলো। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। থামার আর নাম নেই। বাকিরা চেয়ে দেখছে।
নীল গগনে চন্দ্রিমা স্বপ্ন এঁকেছে। বারান্দা দিয়ে স্পষ্ট। মেয়েকে কোলে তুলে কাঁধের সাথে মাথা লাগিয়ে আলতো করে চাপ দিচ্ছে পিঠে। গেয়ে উঠলো,
‘ ঘুম হারা চোখে,
ফিরে দেখি একবার
ইচ্ছে করে
তোমার
হাতে হাতটা মেলাবার।
খুব মন খারাপের রাতে
দূরের বাঁকা চাঁদটার সাথে
আমার হাতটা যেন থাকে
তোমার ছোট্ট হাতের পাশে।
তোমার ঘুম ভাঙানোর রাতে
যখন বড্ড একা লাগে
আমার হাতটা যেন থাকে
তোমার ছোট্ট হাতের পাশে।
ঘুমিয়ে পড়লো মায়ের কোলেই। কান্নার দাগ স্পষ্ট মুখে। চলে গেলো সকলে রুম ছেড়ে। সহ্য করতে পারলোনা সুলতানা কবির ছেলের বউয়ের এই রূপ।মেয়েটা কি পাথর হয়ে গেল!
___
চারকোণা একটি টেবিল। দেখতে খেলার মাঠের মত। এই কামরা জুড়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস এই টেবিলটি। গত চারমাস টেবিলটির কাছে আসা হয়নি ভাইজানের। শাহীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নওরীন সহ তিনতলার এই কামরায় ঢুকেছে শাহীন। নওরীনের কাছে আজকের পুরো ঘটনাই শুনেছে। সেতো ভাইজানকে আরো আগেই দেখেছে। বাসার মানুষগুলো মেনে নিতে পারবেনা ভেবে নিশ্চুপ ছিলো। ভাইয়ের জীবনের সব গল্প করতে করতে গল্পের মাঝে এই টেবিলের কথা আসে। নওরীনের অফিসের বসকে এই টেবিলের সামনে ছবিতে দেখেছে। শাহীন টেবিলটি ছুঁয়ে বললো,
– জানো নিরা, ভাইজান খেলতে খুব পছন্দ করতেন। ওনার কাছে এই পুল বল গুলো ছিলো এক একটা গুটি। যখনই সমস্যায় পড়তেন তখনই খেলতে আসতেন। বিলিয়ার্ড নিয়ে ভাইজানের প্রচন্ড আকর্ষণীয় ছিলো। খেলতে গেলে চাপ পড়ে ব্রেইনে তাই খেলেনি কয়েকমাস। অসুস্থ হওয়ার পর থেকেও অনেক খেলেছে। কত বারণ করেছি ফোনে।
– আমার মনে প্রশ্ন জাগে মেজর। ভাইজান কি আদৌ কারো কথা শুনেছে? সকলের প্রতি মনোযোগ রেখেছে অথচ নিজের প্রতি ছিলো অযত্নশীল। কেউই কি বুঝতে পারোনি তোমরা?
দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাহীন। এই রুমের প্রতিটি কোণায় শাহাদের চিহ্ন। রুমটা খাঁ খাঁ করছে তাকে ছাড়া। শখ করে কিনেছিলো এই পুল টেবিল। ছয়টা পকেট বিশিষ্ট বিলিয়ার্ড টেবিলের কিউই বল গুলোর মাঝে খুঁজে পেত নিঃসঙ্গ জীবনের বেশির ভাগ সময়। শাহীন বললো,
– জানো নিরা রাশেদ ভাই কি বলতো? বলতো, “তোর পাগলামী লিমিটলেস শাহাদ” সত্যি তার পাগলামি লিমিটলেস।
আচমকা নিজেকে অস্থির করে পুনরায় বলে উঠলো,
– নিরা, কি করছি আমি? আমি রাশেদ ভাইকে স্মৃতিতে স্মরণ করছি কিন্তু আমার ভাইজানকে কেনো? আমি দুজনকেই স্মৃতিতে রাখছি। চলো এখান থেকে। এখানে থাকলেই ভাবনা গুলো ভাইজানকে মনে করাবে। আমার ভাইজান সুস্থ হবে।
শাহীনের অস্থিতিশীল অবস্থা নিরাকে ভাবিয়ে তুলছে। বেরিয়ে গেলো তালা ঝুলিয়ে কামরা থেকে।
___
সুলতানা মঞ্জিলের লিভিং রুমে আজ চাপা উত্তেজনা। এক সুদর্শন মধ্য বয়স্ক পুরুষ অপেক্ষা করছে মেজর শাহীনের জন্য। দেখতে অনেকটা দিয়ার মতো। কিছুটা মিলে চেহারায়। রায়হান সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। সাথে পাভেল ও এসেছে সেই পুরুষের সঙ্গে। রায়হান সাহেবকে দেখে হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেক করার জন্য। সালাম দিলেন,
– আসসালামু আলাইকুম রেহান ভাইজান।
কিছুটা হতচকিত হয়ে সালাম নিলেন। বসলেন শান্ত হয়ে। নিজ থেকেই সেই মানব বললো,
– কেমন আছেন ভাইজান?
কি সুন্দর অবলীলায় বাংলা বলছে তবে টান আছে আরব দেশের।
– জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপনি।
– হামিও ভালো আছি। হামার নাম হাম্মাদ। আপনার ছেলের বউ এর মামু হই।
পাভেল মাথা ঝাঁকালো। এরমধ্যে শাহীন ঢুকলো বাসায়। হাম্মাদকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে। দুজনের গলায় গলায় ভাব দেখে লিভিং রুমে সবাই চমকিত। শাহীন সোফায় বসে বললো,
– মি. হাম্মাদ আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
রায়হান সাহেব শাহীনকে কাছে টেনে ধীর স্বরে প্রশ্ন করলো,
– বৌমার মামা বুঝলাম, ইরানী তাও বুঝলাম। বাংলা পারে কিভাবে?
– আব্বু, হাম্মাদ ইরানের প্রফেশনাল হিট ম্যান। ও যে কয়টা খু/ন করছে তা গুণেও শেষ করা যাবেনা। ওর নখদর্পনে বেশিরভাগ ভাষাই।
– আল্লাহ, এই খুনী আমার বাড়িতে কি করে?
– আস্তে, ভাইজানের নির্দেশ। ভাইজান ইনভাইটেশন পাঠিয়েছে দেশে আসার জন্য।
রায়হান সাহেব শাহাদের কথা শুনে দমে গেলেন।ছেলে চেয়েছে মানে কারণ আছে হয়তো। পুনরায় হাম্মাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আপনার বাসার সবাই ভালো আছে?
শাহীন ভ্যাবাচেকা খেয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ঘরোয়া আলাপ করছে আন্টিদের মতো। এটা কেমন প্রশ্ন বাসার সবাই ভালো আছে! রায়হান সাহেব ও বিচলিত,ভাবছে কি গল্প করবে এর সাথে! হাম্মাদ হেসে দিলো। মাথা নেড়ে বললো,
– হাঁ ভালো আছি। শাহাদের সাথে তো হামার ওনেক কথা হতো। আমরা ভালো বন্ধু। আল্লাহ উইল সেভ হিম। ওর সিকনেস শুনে ওনেক দুঃখ পাইছিই।
এই মানুষটার আচরনে একটু ও ধরার উপায় নেই মানুষ মা*রায় এত এক্সপার্ট। হাম্মাদ থেমে বলে উঠলেন,
– হামি কি দিয়াকে দেখতে পারি?
শাহীন ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
– নিরা,ভাবীমা কে ডেকে আনো?
নওরীন চলে গেলো দিয়ার খোঁজে। কিছুক্ষন পর ফিরে এলো দিয়া এবং শেহজাকে নিয়ে। হাম্মাদকে দেখে ছলছলে চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– ছোট মামুজান!
হাম্মাদ এসে ভাগ্নিকে জড়িয়ে ধরলো। এত বছর পর ভাগ্নীকে দেখে আবেগে বলে ফেললো,
– উম্মি, কাইফা হালুক ( আম্মাজান, কেমন আছ?)
– তাইয়্যিব মামুজান। ( ভালো আছি)
– মিন আইনা জিতা? লিইমা জিতা মামুজান? ( মামুজান হঠাৎ আপনি এখানে কেন এসেছেন?)
– ফি ইয়ামালি। ( আমার একটা কাজে)
– মা আলিয়ামাল ফি বাংলাদেশ ? ( বাংলাদেশে কি কাজ)
কথা ঘুরিয়ে হাম্মাদ বললো,
– আনা সায়্যিদান বিরুইয়াতিক বায়্যিদ সানাওয়াত ইয়াদিদাতিন,উম্মি। (মা, তোমাকে এত বছর পর দেখে খুব খুশি লাগছে)
– শোকরান মামুজান।
– মা শা আল্লাহ মা শা আল্লাহ ইয়ালুহা মিন ফাতাত জামিলা? হাল হাদ্দিহ আবিনাতুক? ( মা শা আল্লাহ আদুরে একটা বাচ্চা। তোমার মেয়ে?)
– নিয়ামাল আ বিন্তি। ( আমার মেয়ে)
শেহজাকে কোলে নিয়ে সবার দিকে তাকাতেই দেখলো আশ্চর্যের উচ্চ শিখরে গিয়ে সবাই তাকিয়ে আছে। হাম্মাদ হেসে এবার দিয়েকে বললো,
– উম্মি, হামি বাংলা পারি। তুমি বাংলা বলো।
দিয়া মাথা নাঁড়ায়। শেহজা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে অপরিচিত মানুষটাকে। কিছুক্ষন বসে কথাবার্তা বলে হাম্মাদ চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। দাঁড়িয়ে বললো,
– দেখা হবে আবার, চিন্তা করবেন না মি. শাহাদের জন্য। হামার লোক আছে সেখানে তার প্রোটেকশন এর জন্য।
দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– উম্মি, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। মন খারাপ হলে মামুজানকে ফোন দিও।
মাথা নাঁড়ায়। হাম্মাদ জড়িয়ে ধরে ভাগ্নীকে। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো কানের কাছে কিছু একটা বলে। ছোট মামুজানের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলো। দশ বছর বয়সে একবার দেশে এসেছিলো আম্মিজানকে দেখতে। বড় মামু,নানাজান কেউ মেনে নেয়নি আম্মিজানের বিয়ে। তবে ছোট মামু ছিলো আম্মিজানের নেওটা। দিয়া ছিলো আদরের। ছোট মামুর দেশে আসার সংবাদ বরাবর গোপন রাখতো বাবাজান। লুকিয়ে দেখা করতো ওরা মামুজানের সাথে। আজ ছোট মামু কেনো এসেছে? যাওয়ার সময় কেনো বললো, যেকোনো সময় ডাকবে। আস্তাবলে নিয়ে যাবে। তবে কি কোহিনূর মামুজানের কাছে! দিয়ার সেই সাদা ঘোড়া যা হামিদ মজুমদার সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন গোপন আস্তাবলে। শরীর শিউরে উঠলো। খেলার ছলে তলোয়ার চালানো শেখা মায়ের কাছ থেকে। আর ঘোড়া ছিলো বিনোদনের মাধ্যম। তবে আজ তা কি উপকারে আসবে!!
চলবে…