সায়রে গর্জন পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
3

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩০.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

শহরের এক কোণায় বাসা ভাড়া করে থাকে মা-মেয়ে। সাবিনার শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রাম। মেয়ের ডাক্তারি পড়ার সুবাধে এই শহরে থাকা। স্বামী মারা যাওয়ার পর ঢাকা-চট্রগ্রাম আসা যাওয়ার মধ্যে থাকে।তাহি সহজে যেতে চায়না। চাচারা উপরে উপরে আদর করলে ও ফুফুরা কটু নজরে দেখে,অপয়া বলে। এই জিনিসটা তাহি নিতে পারেনা। তাহি কি ইচ্ছে করে রাশেদকে শেষ করেছে। রাশেদ না থাকাতে বরং তাহির পৃথিবী থমকে গিয়েছে। কেউ কারো কষ্ট বুঝেনা, উলটো কষ্ট দেয়। সাবিনা টিফিন ক্যারিয়ারে মেয়ের খাবার রেডি করতে করতে নিজের এবং মেয়ের ভাগ্যকে দুষছে। স্বামী হারা হলো, মেয়ের ভাগ্যেও এমন লিখা ছিলো কেনো? কাল রাত থেকে মেয়েটা কেঁদে যাচ্ছে। দুদিন আগে রাশেদের কবরের সামনে পাথর হয়ে পড়ে ছিলো। শাহীন,লিমন গিয়ে সামলেছে। শাহাদ মাথার উপর ছাদ ছিলো। হয়তো নিজের ছেলেও এতটা করতোনা যতটা বোনের ছেলে করেছে। খালা ডাকার পরিবর্তে ডেকেছে মামনি। ছেলেটা ও আজ অসুস্থ।

– আম্মু আমি বের হচ্ছি ফিরতে রাত হবে।

– খাবার নিয়ে যা।

গায়ে এপ্রোন জড়িয়ে গলায় স্টেথোস্কোপ প্যাচায়। বিনা বাক্য ব্যয়ে খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তাহি। রিকশা ডেকে রিকশায় উঠতেই লাফিয়ে পাশে একজন উঠে পড়ে। তাহি ঘাবড়ে গিয়ে পাশ ফিরে দেখে লিমন। শাহীনের বিয়ের পর থেকে একটা শব্দ ও কথা বলেনি তাহির সাথে। দুদিন আগে ও কথা বলেনি শুধু শাহীনের সাথে সামলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। তাহি ক্রোধান্বিত হয়ে বললো,

– এ্যাই ছেলে নামো রিকশা থেকে।

লিমন কেমন যেন মলিন চোখে তাকালো তাহির দিকে। পুনরায় চোখ সামনে নিবদ্ধ করে বললো,

– বড় ভাইজান বলেছে উনি না ফেরা অবধি আমি যেন উনার বোনের খেয়াল রাখি।

– মিথ্যুক, কোথায় বলেছে? দেখাও আমাকে?

– ছোট ভাইয়াকে বলেছে।

তাহি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে শাহীনকে ফোন দেয়। ওপাশ থেকে শাহীন কি যেন বললো এরপর তাহি আর কথা বাড়ায়নি। লিমন চুপচাপ বসে আছে রিকশায়। বাসা থেকে হসপিটাল পর্যন্ত যেতে মিনিমাম ত্রিশ মিনিট লাগবে। এতক্ষন কি করবে ভেবেই নিজের কেমন লাগছে। তাহি নিরব থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো। কেমন যেন চোখ লাল। সারারাত মাছি মে*রেছে নাকি! চেহারার এই অবস্থা কেনো? আচমকা লিমন বলে উঠলো,

– ডাক্তার সাহেবা, এই কয়েকদিনে আমাকে একবারো মিস করেন নি?

কথা বলা শেষ করেই তাহির চোখের দিকে তাকালো। তাহি কেমন ঘাবড়ে গেলো। ভ্রু কুচকে বললো,

– আমার ভাবনায়,চিন্তায় একজন মানুষেরই বিচরন তোমাকে কেনো মিস করবো?

– সেটাই, আমাকে কেনো করবেন।

– তুমি আমার বাসার সামনে কখন এসেছো?

– ফযরের নামায আপনাদের মসজিদে পড়েছি।

– এত সকালে?

– আরো পরে হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেত। আরো ব্যাপার আছে সেগুলো না জানাই ভালো।

তাহি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে ফিরে রইলো। লিমনের ফোন বেজে উঠলো। স্টুডেন্ট এর মা ফোন দিয়েছে। প্রতিটি কথার উত্তরে হুম, হা, জ্বি আপু দিলো। চলন্ত রিকশার গতিতে মনোযোগ। ছেলেটা অমনোযোগী হয়ে উঠাতে তাহি লক্ষ্য করলো তার দিকে। দূরন্ত, বিরক্ত করা ছেলেটা হঠাৎ কেমন চুপসে গেলো। তাহি কৌতুহল দমিয়ে না রেখে বললো,

– চুপ করে আছো যে, তুমি তো চুপ থাকার বান্দা না। কয়েকদিন দেখি আমাকে জ্বালাচ্ছো না।

লিমন ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,

– জ্বালালে বুঝি খুশি হতেন!

এমন কথায় ভ্যাবাচেকা খেলো তাহি। বিরক্ত নিয়ে বললো,

– বাজে বকবে না।

লিমন ধীর গলায় বললো,

– একটু আগে স্টুডেন্ট এর মা ফোন দিয়েছিলো। এই মাসের বেতন টা গত সপ্তাহে দেয়ার কথা ছিলো। দিলোনা। আজ থেকে যেতে নিষেধ করে দিলো। বেতন নাকি ওর বাবা ঢাকার বাইরে থেকে আসলে দিবে। আমি আপনাদের মতো এত মেধাবী নই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। মাস শেষে গুণে গুণে একটা এমাউন্ট সেমিস্টার ফি দিতে হয়, বড় ভাইজান থেকে এখন আর নি না। সেই টাকা জোগাড় কর‍তে টিউশন করাই। ভাইজানকে নিষেধ করেছি। বাসার সব খরচ,ভাড়া সব ভাইজান দেয়।ভাইজান নিজেই অসুস্থ। আমি যে এক সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছি তা তো ভাইজান জানেনা। জানলে আমাকে মে*রেই ফেলবে। আমার কোনো ফালতু খরচ নেই। সেমিস্টার ফি যোগাতেই টিউশনি করাই।

– ড্রপ দিয়েছো কেনো?

– ফেইল করেছিলাম, খারাপ সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম এক বছর আগে। আম্মুর জন্য ব্যাক করতে পেরেছি। বড় ভাইজান জানেনা এই কথা।

– তাহলে তো অনেক টাকা সেমিস্টার ফি আসে।

– হুম আটাশ হাজার করে। ট্রাই সেমিস্টার। দুইটা ইন্সটলমেন্ট।

– অনেক টাকা। টিউশনিতে জোগাড় হয় এই টাকা?

– টিউশনি আর পার্ট টাইম জব করে চল্লিশ করতাম। ওখান থেকে কিছু সেভিংস করে অন্য জায়গায় খরচ করতাম।

– কোথায়?

লিমন অন্যমনস্ক হয়ে বলে,

– নানা ভাইয়ার একটি এতিমখানা আছে, ওটা আম্মুর নামে। আমি ওটা চালাই আর নিজের খরচ…

এতটুকু বলে লিমন থামলো। পুনরায় বললো,

– আপনার হসপিটাল চলে এসেছে।

– এখন কোথায় যাবে?

– শোরুমে…

– ওখানে কি?

– সেলসম্যান আমি। আমার সুন্দর চেহারা দেখে টাকা দিবে?

পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিলো। তাহি নিষেধ করাতেও শুনেনি। তাহি বিরক্ত হয়ে বললো,

– এই না বললে, টাকা নেই?

– টাকা নেই বলিনি, টিউশনি চলে গিয়েছে বলেছি। নিজের হাত খরচের টা ভাইজান আসা অবধি রিকশা ভাড়া দেয়ার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছি। আরেকটা খুঁজে নিব টিউশন। আর আপনার রিকশা ভাড়া দেয়া আমার জন্য ফরজ। গেলাম ভালো থাকবেন।

লিমন সোজা সামনের দিকে হেঁটে নিজের পথে পা বাড়ালো। তাহি মনে হলো পুরোটাই এটেনশন পেতে এমনটা করেছে। সবসময়ই দেখেছে চাকচিক্যের মধ্যে। এত কষ্ট করার মত ছেলে লিমন নয়। ঢুকে গেলো হাসপাতালের ভেতর।

___

শাহীনকে দেখে লায়লা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। সাথে আছে আরো একজন মেহমান। রাশেদ মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে শাহাদ ব্যতীত কারো ধূলাও পড়েনি। রোদসীও আজ এসেছে। হাম্মাদ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। টেবিলে নাস্তা রেখে আঁচলে চোখ মুছলেন লায়লা। শাহীন সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

– আন্টি একটা খুব দরকারে এসেছি। বুঝতে পারছিনা কিভাবে বলবো বা আপনারা ঠিক কিভাবে আমাকে সাহায্য করবেন?

– বলো বাবা।

– আপনি তো রাশেদ ভাইয়ের জন্মদাত্রী মা নন। একথা কি ভাই জানতো?

রোদসী চমকে উঠলো। প্রশ্ন করলো,

– আম্মু ভাইয়া আমার আপন ভাই না?

লায়লা আঁচলে চোখ মুছে মাথা নাড়ালো বামে ডানে। কম্পিত গলায় বললো,

– কিন্তু ও আমার ছেলে। আমার বাবা।

কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রোদসী মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ভাই জানতো?

– জেনেছে পরে। ওর মাকে ও খুঁজেছে অনেক। পায়নি। বাবা তো আগেই দুনিয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন।

হাম্মাদ প্রশ্ন করে,

– কে ছিলেন রাশেদের বাবা?

লায়লা চোখ মুছে বলে,

– রাশেদের বয়স দু বছর। আমার স্বামী রাশেদের বাবা ফোরকান আবেদীনের ম্যানেজার ছিলেন। ওদের বাড়ি পুরান ঢাকা। কি সুন্দর সংসার ছিলো স্যারের আর ম্যাডামের। স্যারের সাথে ম্যাডামের বিয়ে হয় অনেক ঝুট ঝামেলা করে। ম্যাডামের নাম ছিলো মেহনাজ পাঠান। উনাদের বংশের মেয়েদের অন্য বংশে বিয়ে দেন না। স্যারের আব্বা অনেক অনুনয় বিনয় করে ম্যাডামকে স্যারের জন্য নিয়ে আসেন। ফোরকান স্যার বলে দিছিলেন উনি ম্যাডাম ছাড়া বিয়ে করবেন না। বন্ধুর বিয়েতে ম্যাডামকে পছন্দ হয়েছিলো। ফোরকান স্যাররা ছিলেন তিন ভাই। দুই ভাই এখনো আছেন।

– বাকি দুইভাই কোথায় আন্টি?
শাহীনের প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলো লায়লা।

– আমি জানিনা বাবা।

– আচ্ছা আপনার কাছে কি করে এলো রাশেদ ভাই।

– রাশেদের দ্বিতীয় জন্মদিন সেদিন। ম্যাডাম আমাদের ও দাওয়াত দিছিলো। ঘরোয়া আয়োজন। ফোরকান স্যার পছন্দ করেন না ধুমধাম। রাত তখন সাড়ে এগারোটা। ম্যাডামের ফোনে খবর আসলো স্যারের গাড়ি এক্সিডেন্ট হইছে। আমরা ছুটে হাসপাতালে গেলাম। কিন্তু স্যার ততক্ষনে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। ম্যাডাম পাগলের মত হয়ে গেলো। স্যারের বাবা এক বছর আগে বিদায় নিয়েছে। ম্যাডামের পরিবার স্যারকে কম পছন্দ করতেন। ম্যাডামের রূপের বর্ননা আমি দিয়ে শেষ করতে পারবোনা। সেই রূপই ম্যাডামের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। স্যারের মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। আমি প্রায় থাকতাম ম্যাডামের কাছে। একা বাড়ি ভয় পাইতেন। সেদিন রাতে রাশেদ বাথরুম যাবে। ম্যাডামের শরীর ভালোনা। আমি নিয়ে গেলাম। ওর ক্ষুধা লাগছে বলাতে খিচুড়ি খাইয়ে রুমে আনতেই দেখি ম্যাডাম আমার সামনে দৌঁড়ে এসে বলে, লায়লা রাশেদকে নিয়ে পালাও। আমার কিছু হলে তুমি ওকে দেখে রেখো। আমি তখনো বুঝি নাই কি হতে যাচ্ছে। ম্যাডামকে অনেক বুঝালাম কিন্তু ম্যাডাম আসলোনা আমার সাথে। গেটের কাছে অনেক গুলো গাড়ির আওয়াজ। কতগুলো পায়ের শব্দ। গোলাগুলি। রাশেদ ভয় পাচ্ছিলো। ম্যাডাম আমার পায়ে ধরে ফেললেন রাশেদকে নিয়ে যেতে। আমিও হতবিহ্বল হয়ে ছুটলাম পেছনের দরজার দিকে। এরপর দেখি ম্যাডাম সিড়ি দিয়ে মুখোমুখি হয়েছে তাদের। আমার যতদূর ধারণা সেদিন ম্যাডামের সাথে খুব খারাপ কিছুই হয়েছিলো।

– আপনি কাউকে চেনেন নি? ম্যাডাম কি বেঁচে ছিলেন?

– আমার মনে হয় ম্যাডাম আছেন। কারণ রোদসীর বাবার কাছে প্রতি মাসে একটা এমাউন্ট কেউ রাশেদের নামে পাঠাতো। রাশেদ যেদিন মারা যায় ওই এমাউন্ট আসা বন্ধ হয়ে যায়। সাথে একটা করে চিঠি থাকতো। চিঠিতে সরাসরি ধমক থাকতো যেন এই টাকা নেন। নাহলে হুমকি আসতো কখনো রোদসীর ক্ষতি করবে অথবা কখনো আমার। একটা সময় আমরাও অভ্যস্ত হয়ে যাই।

– রাশেদ ভাই জানলেন কিভাবে?

– রোদসীর বাবা মারা যাওয়ার পর আমি ওই এমাউন্ট রাশেদকে দিতাম। ও অবাক হয়ে একদিন প্রশ্ন করলো, আম্মু আমাদের সংসার চালাতে হিমশিম খাই অথচ এত টাকা আমাকে কিভাবে দাও তুমি? এভাবেই জেনে গেছে। ও মারা যাওয়ার বছর খানেক আগে জেনেছে আমি ওর আসল মা না। এর পর শুরু করে খোঁজ, একদিন ফোনে বলেছিলো ওর মা সম্পর্কে জানার পর থেকেই ছেলেটা গোমড়ে গেছে। বাঁচতে দিলোনা ওরা আমার ছেলেটাকে।

– আন্টি আর কিছু কি জানেন আপনি?

– না বাবা।

– আচ্ছা আজ উঠি।

– কিছু তো খেলেনা, মেহমান নিয়ে আসলে।

– আরেকদিন আন্টি। কাজ আছে।

দুজনই বেরিয়ে পড়ে। শাহীন দুয়ে দুয়ে চার মিলাচ্ছে। হাম্মাদ গাড়িতে উঠে শাহীনকে বলে,

– শাহীন আমি যা ভাবছি আপনি ও কি তাই ভাবছেন।

শাহীন মাথা ঝাকিয়ে বলে,

– মেহনাজ পাঠান ওরফে মেহেরজান আম্মা। সেদিন কি হয়েছিলো? আরেকটা ব্যাপার হাম্মাদ খেয়াল করেছেন, আমরা ওই বাড়ির দেয়ালে কিছু পারিবারিক ছবি দেখেছিলাম ওখানে একজনকে আমার বেশ পরিচিত লেগেছে। কিন্তু মনে করতে পারছিনা। ছবিটা আমি ভাইজানকে সেন্ড করেছিলাম। সুস্থ হলে হয়তো দেখবে।

হাম্মাদ গাড়ি চালাতে চালাতে শাহীনের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো,

– ইনশাআল্লাহ শাহাদ সুস্থ হবে। আল্লাহ মালিক।

___

ল্যাপটপে কানেক্ট করেছে ভিডিও কল। এই কয়েকদিনে অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। সকলকে সালাম দিয়েই একটা হাসি দিলো। পরনে সেই হাসপাতালের পোশাক। সুলতানা কবির ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আম্মু আপনি শুকিয়ে গিয়েছেন আগে থেকে। খাওয়া দাওয়া করেন না ঠিক মতো।

ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আমার বাবু নেই, খাবার টেবিলে বসে বাবুর চেয়ারটার দিকে তাকালে আমার বুকটা খাঁ খাঁ করে মানিক।

– ঠিক মত খাবেন,আমি এসে যেন দেখি আমার আম্মু আগের মত ফিট এন্ড ফাইন। ওকে?

নাক টেনে আঁচলে চোখ মুছে হেসে মাথা নাড়ায়। শাহাদ এবার বাবাকে বলে,

– আব্বু ডাক্তারের রিপোর্ট তো ভালো না আপনার। এত চিন্তা করছেন কেনো। আপনার ভরসায় সবাইকে রেখে আসলাম আপনি যদি নড়বড়ে হোন কিভাবে চলবে?

রায়হান সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,

– তোমার ডাক্তারের কাছে আর যাবোনা। ব্যাটা ফাজিল তোমাকে এসব পাঠায় কেনো? আমার মা*র খাবে এরপর ব্যাটা।

শাহাদ হো হো করে হেসে উঠলো। ওর হাসির আওয়াজে শেফালী, শিফা ছুটে এলো। বাবা মায়ের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে পড়লো। দিয়া একপাশে আছে। শাহাদের সামনে আসেনি। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে সেই হাসি। সুলতানা কবির দোয়া পড়ে স্ক্রিনে ফু দিচ্ছে জোরেই বললো,

– আমার বাবুর দিকে কারো নজর যেন না লাগে।

শাহাদ হাসি থামিয়ে বলে,

– হ্যাঁ আপনার আটত্রিশ বছরের বাবু। বাবুর বাবুটা কই? আচ্ছা থাক ওকে সামনে আনার দরকার নেই।

অকস্মাৎ পেছন থেকে শেফালী বলে উঠলো,

– ভাইজান…

শাহাদ বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

– ভালো আছো?

শেফালী কাত করে মাথা নাড়ায়।

– আপনার শরীর কেমন?

চোখের পলক ঝাপটিয়ে বলে,

– আলহামদুলিল্লাহ। আমার মামা কোথায়?

– ঘুমায়।

– আচ্ছা।

ভাই কথা বলতে চাইছেনা বুঝে শেফালী চুপ হয়ে গেলো। তখনই শাহাদ বলে উঠলো,

– বিজনেস করবে নাকি কলেজে পড়াবে?

দরদর করে ঝরতে লাগলো চোখের পানি। দুহাতেও আটকাতে পারছেনা। দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

– কিছু করবোনা। বাসায় থাকবো। আবিরের বেস্ট মাম্মা হবো।

– যাই করো বুঝে শুনে করো ভাইজান যতদিন বেঁচে আছি পাশে পাবে। আর ধন্যবাদ পাওনা রইলো তোমার। ভুলতো অনেক বড় করেছো। তবে তার মাঝে ও ঠিক কাজটা করেছো নিজেকে নষ্ট করোনি অবৈধ কিছু করে। খালেদ পারভেজ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে। শাহীনের কাছে আছে। শয়তানি বুদ্ধিতে চালাক হয়ে গিয়েছিলে। সেই বুদ্ধি কাজে লাগালে তুমি আজ আমার শিফা ফুলের মতো আমার মাথার তাজ হয়ে থাকতে।

– স্যরি ভাইজান।

– শরীরের প্রতি যত্ন নাও। ছেলেকে সময় দাও।

ভাইজানের অগোচরে কিছুই ছিলোনা। খালেদ পারভেজকে বিয়ে করেছিলো এই খবর ভাইজান জানে। সেদিন ভয়ে বলেনি কারণ এর এক সপ্তাহ আগেই খালেদ বিয়ের কথা অস্বীকার করে হুমকি দিয়েছিলো। নিজের কাজে বিয়ের কাবিন নামা ও ছিলোনা। নোমানকে হারিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিলো।

– শিফা…

শিফা ভাইজানের সম্বোধনে হাসি দিয়ে বলে,

– আই মিস ইউ ভাইজান। কখন আসবেন? আমার বাসাতে ভালো লাগে না আপনাকে ছাড়া। ছোট ভাইয়াও বাইরে থাকে।

– রেজাল্ট যেন ভালো হয়। পড়াশোনা করো ঠিক আছে। এরপর বিয়ে দিয়ে দিব।

সকলে চমকে উঠলো। একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে শাহাদের দিকে তাকাচ্ছে। শাহাদ সকলের ঘোর ভেঙ্গে বললো,

– মজা করেছি। মজা বুঝোনা তোমরা।

শিফার মনে হলো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এর মাঝে আফিয়া এক কাজ করে বসলো। শেহজা ঘুম থেকে উঠে কাঁদছিলো। ওকে এনে সোজা সুলতানা কবিরের কোলে বসিয়ে দিলো। মেয়েটা ল্যাপটপের স্ক্রিনে বাবাকে দেখে চুপ হয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে স্ক্রিন ধরছে। শাহাদ এতক্ষন স্বাভাবিক থাকলেও এবার নড়েচড়ে বসলো। স্ক্রিনে আঁচড় কা*টছে, কিন্তু কথা বলছে না। একবারো আজকে বাবা ডাকছেনা। সুলতানা কবির বললো,

– দাদুমনি দেখো বাবা,এই যে। কথা বলো।

ঠোঁট উলটে রেখেছে কিন্তু কথা বলছে। শাহাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছে মেয়ের অভিমান। এই মেয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে চিৎকার ও করছেনা। শাহাদ নিজের বুকে হাত দিয়ে কাঁপা গলায় মেয়েকে ডাকলো,

– আম্মাজান, বাবার সাথে কথা বলবেন না?

ছলছল চোখে কেঁদে দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিলো। বুঝালো কোলে নাও। জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে, বা বা। আর কেউ সামলাতে পারছেনা শেহজাকে। সুলতানা কবির দাঁড়িয়ে পড়লো কোলে নিয়ে, শিফা কোলে নিতে চাইলো কারো কোলে যাচ্ছেনা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে বাবা বলে। দিয়া এসে কোলে নিলো। আজ মাকেও মানছেনা। একপাশে চলে গেলো সুলতানা কবির। এই মেয়েটাকে এখন আনাই উচিৎ হয়নাই। দিয়াকে শিফা আর শেফালী ধরে স্ক্রিনের সামনের বসিয়ে দিলো। শাহাদ দেখতে পেলো সহধর্মিণীকে। গুছালো দিয়া আর নেই। চোখ ভেতরে ঢুকে গিয়েছে, গাল ফোলা। আবার দুহাত বাড়িয়ে চিৎকার দিচ্ছে। শাহাদ এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে ডিসকানেক্ট করে দিলো লাইন। শাহীন শেহজাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মেসেজ আসলো দিয়ার ফোনে,

Farah, Dua korte bolbe sobaike amar jonno. Jananor sahosh pacchilam na, aj e operation. Jodi na firi dukkho rekho na mone. Khoma kore dio. Ar jodi firi sob pushiye debo.

~ Shahad Imroz

দিয়া চোখের পানি মুছে বললো,

– আম্মু আপনার ছেলের আজ অপারেশন। দোয়া করতে বলেছে সবাইকে।

উঠে চলে গেলো রুমে দিয়া।

শাহাদ লাইন বিচ্যুত করে দুহাতে মুখ ঢাকে। মেয়ের জন্য বুক পুড়ছে। সব ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়েটা তার সব। যেদিন শেহজার জন্ম হয় সেদিন একটা সমাবেশে ছিলো। দিয়ার কষ্ট সচক্ষে কখনো দেখতে চায়নি। সবাইকে হাসপাতালে থাকতে বলে নিজে সমাবেশে চলে এসেছিলো। গাড়িতেই শুনলো মেয়ে হয়েছে। ছুটে গিয়েছিলো হাসপাতালে। মেয়েকে কোলে নিয়ে আলাদা কেবিনে ঢুকে প্রায় আধঘন্টা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সদ্য জন্ম নেয়া শেহজা বাবার দিকে তাকিয়ে পিট পিট চোখে শুধু হেসেছে। একদম বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলেছিলো মেয়েটাকে। যে কটা দিন হাসপাতালে ছিলো দিয়া, মেয়েকে নিয়ে পাশের কেবিনে থাকতো শাহাদ। মাকে দিয়ার কেবিনে রেখেছে। খাবারের সময় মেয়েকে নিয়ে যেত, এরপর আবার দিয়ে যেত। মেয়ের জন্য এভাবে কাঁদবে ভাবতে পারছেনা। চোখ মুছে হামজাকে ফোন দিলো। অপারেশনের আগে স্রষ্টাকে স্মরণ করা উচিত।নিজের জন্য কখনো কিছু চায়নি, খুব করে আজ চাইবে যেন সুস্থভাবে ফিরে যেতে পারে বাংলাদেশ।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩১.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাইরে বৃষ্টি। মাঝ রাস্তায় ফেঁসেছে দুজন। লিমন কল দিয়ে বলেছিলো আসবে, বারণ করে দিয়েছে এক জুনিয়র সাথে আছে জানিয়েছে। তার সাথেই যাবে। লিমন ও আর জোর করেনি। আজ নিজের ও কাজের অনেক চাপ। তাহি ইনফিনিটির শোরুমে এসেছে এক কলিগের জন্মদিনের উপহার কিনতে। সেই কলিগকে আবার সাথে আসা জুনিয়র, প্রমা পছন্দ করে। ভেতরে এত ভিড় দেখে মাথা ঘুরে উঠলো। স্বাভাবিক ভেতরে একটা চাপা গরম। এর মধ্যে প্রমা সবাইকে বিরক্ত করে তুলেছে। ওয়াচ দেখেছে অনেক গুলো কিন্তু কেনে নি, প্যান্ট দেখেছে,টি শার্ট দেখেছে। ঘুরে ঘুরে দেখলো কিছুই পছন্দ হলোনা। শেষমেষ প্রমাকে ধমকে বললো,

– তুই তোর ক্রাশের পছন্দ বুঝিস না। কিছু কি বাদ রেখেছিস দেখা?

– হ্যাঁ শার্ট আর পারফিউম।

– যা ওইদিকে, শার্ট দেখ আমি পারফিউম দেখছি। সাইজ জানিস তো?

– জানি আপু।

– ওকে যা।

তাহির ধমক খেয়ে প্রমা শার্ট দেখতে গেলো। একে একে প্রায় আটটা শার্ট খুলে ফেললো। তাও আবার ইনফিনিটির মতো শো রুমের। সেলসম্যানকে বলে বসে,

– ভাইয়া এই শার্টটা পরে দেখুন তো কেমন হবে?

– ম্যাডাম আমরা পরতে পারবোনা। নিয়ম নেই।

– কেনো কেনো নাহলে বুঝবো কিভাবে?

– যার জন্য নিবেন তাকে নিয়ে আসুন।উনি ট্রায়াল দিক।

– সারপ্রাইজ দিব

– তাহলে আপনাকে একটা সাইজ অনুমান করে নিতে হবে।

– আন্দাজে নিব নাকি?

– আমাদের এই ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। অন্য অপশন দেখুন।

– আপনি কিন্তু বেয়াদবি করছেন।

সেলসম্যান হতচকিত হয়ে গেলো। সে কখন বেয়াদবি করলো। প্রমা চিৎকার দিয়ে ম্যানেজারকে ডাকলো, এ পাশ থেকে তাহি ছুটে আসলো। আরো কয়েকজন এসে ভিড় করে ফেললো। প্রমাকে ম্যানেজার বুঝানোর চেষ্টা করছে। ওর জোরালো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে,

– আপনাদের সেলসম্যান গুলো এত বেয়াদপ কেনো? এভাবে কথা বলে ক্লায়েন্টের সাথে। আমি শার্ট নেব বলেই তো পছন্দ করেছি। ও মুখের উপর কিভাবে বলে অন্য অপশন দেখুন।

তাহি ভিড় ঠেলে সামনে আসলো।

– কি সমস্যা হয়েছে, চেঁচাচ্ছিস কেনো?

– দেখো না আপু, এই বেয়াদপ ছেলেটা আমাকে বলে অন্য অপশন দেখুন।

তাহি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে লিমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাহিকে দেখে এই ছেলে চমকে যাওয়ার কথা,কিন্তু চমকায় নি। উল্টা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রমা তখনো চেঁচাচ্ছে,

– ছোট লোক, কিভাবে ক্লায়েন্ট ট্রিট করতে হয় জানেনা। আসছে সেলসম্যান হতে। রাস্তার ফুটপাতে যাওয়া উচিত।

– একদম চুপ…

সবার সামনে প্রমাকে তাহি ধমক দিলো। লিমনের চোখ ছলছলে। ছেলেটা এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লিমনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,

– কি হয়েছে এখানে?

লিমন ইশারা দিয়ে ভাঁজ খোলা সব শার্ট দেখালো। তাহি বুঝতে পেরে চোখ গরম করে প্রমার দিকে তাকালো। ইচ্ছে করছে সবার সামনে অপমান করতে। নিজেকে দমাতে গিয়েও আজ তাহি পারলোনা লিমনের চোখের দিকে তাকিয়ে। প্রমা তাহির চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেলো। তাহি রেগে বললো,

– তুই কি চাস আমি তোকে সকলের সামনে কষে দুটো চড় দি?

– আমি কি করেছি আপু?

– চল তুই?

– আপু..

– কিসের আপু? এতগুলো শার্ট কেউ শোরুমে এসে নামায়। জীবনে শো রুম থেকে শপিং করিস নি। নিউ মার্কেটে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো তোকে। এতক্ষন ধরে দেখছি শুধু ঘুরছিস। এই বেচারা তোকে অন্য অপশন দেখতে বলেছে,আমি হলে তো বলতাম অন্য শপিং মলে যান আপনার জায়গা বসুন্ধরায় না। চল তোর গিফট কেনার দরকার নেই আমার সাথে। নিজে নিজে কিনিস। আমি আমার টা কিনে নিয়েছি।

– আপু আর করবো না প্লিজ…

ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বললো,

– স্যরি ভাই।

– ইটস ওকে ম্যাডাম। ওর ও দোষ আছে। এভাবে বল উচিত হয়নি ক্লায়েন্টকে।

তাহি আর কতটুকু সেভ করবে লিমনকে। যা শোনার এখন ওরা বেরিয়ে গেলেই শুনবে। সকালে ছেলেটার কথা বিশ্বাস হয়নি। এখন ছেলেটাকে দেখেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে। লিমনের দিকে তাকিয়ে বিনা শব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে ইশারায় স্যরি বললো। এখান দিয়ে অনবরত ম্যানেজার ঝাড়ি দিচ্ছে। তাহি স্যরি বলায় এই মন খারাপের মাঝেও লিমনের ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। চোখের পলক ব্লিংক করে ঠোঁট কামড়ে হালকা মাথা নাড়িয়ে বুঝায় ইটস ওকে। এই দৃশ্যটা সুন্দর। তাহি নিজেও হেসে দিলো।

___

বাড়ির পাশের টং দোকানে বসেছে শাহীন,পাভেল,তুহিন আর হাম্মাদ। এখানেই একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে যোগাযোগের সুবিধার জন্য। মেসেজের আওয়াজে ফোন বের করলো শাহীন। মেসেজ পড়ে মুখটা ঝুলে গেলো। দু অধর আলগা হয়ে আছে। মনে হলো যেন অসম্ভব, অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত কিছু দেখে ফেলেছে। হাম্মাদ একটু ধাক্কা দিয়ে প্রশ্ন করলো,

– কি হয়েছে?

ফোন বাড়িয়ে দিতেই হাম্মাদ ফোনটা নিলো। হাম্মাদ নিজেও চোখ বড় বড় করে ফেললো। মুখে উচ্চারণ করলো,

– ইয়া আল্লাহ রহম করো।

শাহীন উঠে দাঁড়ায়। হাঁটা শুরু করলো। তুহিন চায়ের বিল মিটিয়ে দিলো। ওকে অনুসরণ করে বাকিরাও এলো। এক জায়গায় দাঁড়ালো যেখানে মানুষের আনাগোনা কম। পাভেল প্রশ্ন করলো,

– মুখটা এমন বাংলা পাঁচের মত করলি কেনো?

– তুই জানিস রাশেদ ভাইয়ের চাচা কে?

– কে?

– ফরিদ রেজা।

– আল্লাহ আল্লাহ।

তুহিন ও একইস্বরে বলে উঠলো,

– ইয়া আল্লাহ।

পাভেল পুনরায় প্রশ্ন করলো,

– আপন চাচা।

– ছোট চাচা।

– তোকে কে জানিয়েছে?

– ভাইজানকে ছবি পাঠিয়েছিলাম। মাত্র ভাইজান মেসেজ দিলো।

– তার মানে বস সব জানে?

– সেটাই তো মনে হচ্ছে। আমরা যা মাত্র জেনেছি ভাইজান তা অনেক আগেই জেনেছে। আমাকে শুধু লাস্ট মেসেজ এটা দিলো যেন দুয়া করি ভাইজানের জন্য। আর সব প্রমান রেডি রাখি। উনি এসে বাকিটা বুঝবে।

___

এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ঘড়ি চেক করছে। এইতো আর ত্রিশ মিনিট। এরপর আকাশে উড়বে। ঝলমলে আকাশ। শাহাদের অপারেশনের আগেই পৌঁছে যাবে মনি। এরপর সেখান থেকে সব প্ল্যানড। সরিয়ে ফেলবে শাহাদকে। কিছুতেই আর কাউকে সেই সুযোগ দিবেনা শাহাদকে পাবার। ইয়ার ফোনে গান শুনছে। মন আজ ফুরফুরে। খালেদ পারভেজ ও ফরিদ রেজাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মনি চলে যাচ্ছে সেই খবর কেউ রাখেনি। রাখবে কি করে আজ যে খালেদ পারভেজ এর জনসভা আছে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সরাসরি জনসভায় চলে যাবে। আর ফরিদ রেজার প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং। এই দিনের অপেক্ষায় ছিলো মনি। খালেদ পারভেজ নিজ হাতে রিপোর্ট হারিয়েছে এতে মনির কি দোষ। গত রাতে লোক পাঠিয়েছিলো আজ সন্ধ্যায় দেখা করতে মনি সরাসরি নাকোচ করে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে এসবের মাঝে সে আর নেই। যার জন্য এত কিছু করলো সেই মানুষটাই যদি না থাকে এসব করে তো লাভ নেই।

– আসসালামু আলাইকুম

সালাম শুনে পাশ ফিরে দেখে সুদর্শন একজন বসে আছে। সালামের জবাব নিয়ে বললো,

– আমি কি আপনাকে চিনি?

– না আমরা কেউ কাউকে চিনিনা। মনে হলো একই ফ্লাইটে যাবো তাই কথা বললাম। আপনি মাইন্ড করলে বলবোনা।

– ইটস ওকে। আমি ডক্টর মনিকা।

– ওয়াও নাইস টু মিট ইউ। আমি ইয়াজ, জার্নালিস্ট।

অল্প কিছুক্ষনে আলাপ জমে উঠলো।

– আপনার পারফিউমের নাম কি ডক্টর? নাইস ফ্র্যাগরেন্স।

– গুড গার্ল।

– আই নো ইউ আর আ গুড গার্ল

– নো ইটস পারফিউম নেইম।

– ওয়াও ইটস সো সুইট। আই হ্যাভ আ পারফিউম। ইট ওয়াজ গিফটেড বাই মাই মম। ডু ইউ ওয়ান্টু টেস্ট?

– ইয়াহ, শ্যুর। প্লিজ…

ইয়াজ পারফিউম টা বের করে মনিকার হাতে দিলো। মনিকা নাকের কাছে স্মেইল নিতেই মাথা ঘুরে উঠলো। সেখানেই সেন্স লেস হয়ে গেলো।ইয়াজ একটা মাস্ক বের করে পরে নিলো।এতক্ষন এমনিতেই চোখে সানগ্লাস ছিলো। সাথে সাথে এয়ারপোর্টে পুলিশ ডাক দিলো। পুলিশ আসলে বললো,

– একটু হেল্প করবেন আমার ওয়াইফ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমাদের ফ্লাইট ছিলো। কিন্তু মিস হয়ে যাবে মনে হয়?

– আপনি কি করতে চাচ্ছেন?

– একটু ব্যাগ গুলো গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা গেলে খুব ভালো হত। আগে আমার ওয়াইফের সুস্থতা এরপর আবার যাব। আমরা হানিমুন ট্রিপে সিঙ্গাপুর যাচ্ছিলাম।

পুলিশের সাহায্যে ইয়াজ মনিকাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। গাড়ি ছুটালো গন্তব্যে। গাড়িতে অট্টহাসি দিয়ে ফোন লাগালো খালেদ পারভেজকে,

– বস ডান। এখন মালটাকে কি করবো?

– আমার ডেরায় রেখে আয়। উৎসব করবো। কত বড় সাহস আমাকে না জানিয়ে পালায়। অনেকদিন উৎসব হয়না। খবর দে সবাইকে।

– ওকে বস।

___

তাহির বারান্দায় কে যেন দূর থেকে টর্চ মা*রছে। একটা কেস স্টাডি করছিলো তাহি। বিরক্ত হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সামনে তাকিয়ে দেখে বা*দরটা দাঁড়িয়ে আছে। তাহি বিরক্ত হয়ে ইশারায় বললো, কি হয়েছে?
লিমন হাত দিয়ে তাহিকে নামতে বললো। তাহি নামবে না দেখানোতে লিমন পুনরায় হাত জোর করে অনুনয় করলো। এবার তাহি হাত দিয়ে দেখালো,আসছি। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বড় ঘোমটা দিলো। সাবিনা জিজ্ঞেস করলে বললো একটু দোকানে যাচ্ছে আইসক্রিম আনতে। সাবিনা বোনের সাথে শাহাদের ব্যাপারে কথা বলছিলো,তাই আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি আসার আদেশ করলো। তাহি চারতলা থেকে নেমে গেট দিয়ে বেরিয়ে আশে পাশে তাকিয়ে সোজা হাঁটতে থাকলো। কিছুটা দূর যাওয়ার পর পাশে পাশে লিমন ও হাঁটছে। লিমনের দিকে তাকিয়ে তাহি হেসে দিলো। মুখে মাস্ক থাকায় অন্য কেউ না বুঝলেও লিমন থমকে দাঁড়িয়ে বললো,

– ডাক্তার সাহেবা হাসলেন কেনো? আমাকে কি জোকার লাগছে?

– তা কখন বললাম তবে একটা ক্লাস নাইন টেনের বাচ্চা লাগছে। আম্মু পছন্দ করে একটা Ven-10 টিশার্ট আর এডিডাস থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট কিনে দিয়েছে সেটা বড় আপুকে দেখাতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এসেছো মনে হচ্ছে।

লিমন চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

– আপনি এমন কেনো ডাক্তার সাহেবা,সারাক্ষন আমাকে এভাবে বলেন। আমি আপনার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট।

– একদম বাবু তুমি আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট। চলো আপু আইসক্রিম কিনে দিই।

মুখ বাঁকিয়ে লিমন বললো,

– ঠিক আছে।

লিমন লাফাতে লাফাতে গাছের ডাল ছিড়লো। সেটা নাচাতে নাচাতে বললো,

– ডাক্তার সাহেবা আপুউউউউউউউউউ, আইসক্রিম খাবোনা ফুচকা খাবো

লিমনের মুখ থেকে এই ডাক শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় তাহি। কিভাবে অসভ্যের মতো টান দিলো। ফুচকার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লিমন বললো,

– মামা ঝটপট দু প্লেট ফুচকা। একপ্লেটে ঝাল টক অন্যটাতে মিষ্টি টক। ঝালটাতে অবশ্যই নাগা মরিচ দিবেন যাতে ম্যাডামের চোখে আমার জন্য পানি আসে।

এতক্ষন তাহি এঞ্জয় করলেও এখন তাহি থমকে গেলো। ফুচকাওয়ালা রফিক মামা। দশ বছর ধরে এই পাড়ায় ফুচকা বিক্রি করে। জনপ্রিয় ফুচকা তার। লিমনের কথায় রফিক মামাও হকচকিয়ে গেলো। এভাবে কথা বলার ধরন রফিক মামার পরিচিত। এর আগেও শুনেছে এই কথা। লিমনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাহির দিকে তাকালো। তাহি সিচুয়েশন নিজের আয়ত্ত্বে এনে বললো,

– মামা তাড়াতাড়ি দাও বাসায় যাব।

দুজনই বসলো তাহি হঠাৎ চুপসে যাওয়াতে লিমন তাহিকে বললো,

– আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

– নাহ ঠিক আছি।

– আপনি না চাইলে আমরা চলে যাবো উঠুন।

– আমি ঠিক আছি, তুমি এখানে কেনো এসেছো?

– আমি সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে এদিক সেদিক যাই। আজকে মন খারাপ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ভালো লাগছিলোনা তাই আপনার কাছে এসেছি।

– ওহ।

– আচ্ছা একটা কথা বলি?

– বলো?

– রাগ করবেন নাতো?

– রাগ করার মতো হলে করবো?

– তাহলে থাক।

– আচ্ছা বলো?

– রাশেদ ভাইকে অবিশ্বাস না করলে ও তো পারতেন?

তাহি অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো।

– আচ্ছা বলতে হবেনা। রাশেদ ভাইয়ের জায়গায় আমিও হতে পারি ভবিষ্যতে। যদি আমার ওয়াইফ আমাকে অবিশ্বাস করে,তখন আমি ও কি ম*রে যাবো? আপনারা মেয়েরা অনেক স্বার্থপর জানেন। আপনাদের একটু সাপোর্টের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকি। সবাই তো খারাপ না…

– চুপ করবে…

ধমকে উঠলো তাহি। লিমন স্যরি বলে চুপ হয়ে গেলো।

রফিক মামা ফুচকা দিতেই তাহিকে ফুচকা বাড়িয়ে দিলো। তাহি চুপচাপ ফুচকা খেয়ে যাচ্ছে। লিমন টক ঢেলে একটা ফুচকা মুখে দিতেই চোখ মুখ খিচে ফেললো। রফিক মামা বুঝিয়ে দেয়ার সত্বেও গুলিয়ে ফেলেছে কোনটা কার ফুচকা। নাগা মরিচের টক দেয়া, ফুচকা দুটোর বেশি খেতে পারলোনা। তাহির ততক্ষনে সব কটা শেষ। তাহি পানি চেয়ে নিলো। নিজে এক ঢোক খেয়ে লিমনকে বললো,

– দেরি হচ্ছে চলো উঠি।

লিমনকে চুপচাপ দেখে ওর দিকে তাকাতেই দেখে ছেলেটার নাক,মুখ,চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ফুচকার প্লেটটা রেখে জাস্ট মুখ খুলে বললো,

– আমাকে একটু পানি দেন।

তাহি পানির বোতল টা বাড়িয়ে দিলো। লিমনের প্লেটের ফুচকার টক চামচ দিয়ে একটু মুখে দিয়ে যা বুঝার বুঝে গেলো। পুরো বোতল পানি শেষ করে আরেক বোতল শেষ করলো। এবার রফিক মামা একটা শসা এগিয়ে বললো,

– মামা এটা খান ঝাল কমে যাবে।

লিমন চোখ মুখ খিচে শসা চাবাচ্ছে। মুখটা আরেকবার ধুয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাহির বাসার সামনে যেয়ে বললো,

– আপনি চলে যান,আমি চলে যেতে পারবো।

– কিভাবে যাবে?

– সাইকেলে?

তাহির চোয়াল ঝুলে গেলো। মুখ ফসকে বলেই ফেললো,

– লিমন সিরিয়াসলি সাইকেল চালাও তুমি আই মিন তোমার বয়সীরা এখন বাইক নিয়ে বের হয়। সাইকেল তো বাধ্য বাচ্চারা চালায়।

– বাইক ভাইজান কিনে দিয়েছিলো। একবার এক্সিডেন্ট করেছি আরেকবার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয়ে ধরা খেয়েছি। তাই বাইক ব্যানড আমার জন্য। জবে ঢুকলে দিবে বলেছে।

তাহি হো হো করে হেসে বলে,

– দেখেছো তুমি কতটা পুচকু। আর তুমি নাকি আমার সাথে…

লিমন তাহির হাসি দেখেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর স্বরে বললো,

– আমি নাকি আপনার সাথে কি??

তাহি হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললো,

– বাসায় যাও রাত হয়েছে।

লিমন কথা না বাড়িয়ে বললো,

– সকালে আমি আসবো। আল্লাহ হাফেজ।

সাইকেলে চড়ে পেছনে ও তাকালো না। সোজা চলে গেলো। আচমকা লিমনের মাঝে এমন পরিবর্তন যেন তাহিকে ভাবাচ্ছে। এই তো লাফাচ্ছিলো বাচ্চাদের মত আবার কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো। সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে, রফিক মামার ফুচকা দোকানের সামনে বলা প্রতিটি কথা, রাশেদ ও এভাবে বলতো। যেন ঝালের কারণে রাশেদের জন্য চোখে পানি এসে যায়। কোথাও একটা প্রাণোচ্ছল ভাবের মিল আছে লিমনের সাথে রাশেদের। তাহি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা যেন হাসছে। শরীরের ঠান্ডা বাতাস লাগলো। মনে হলো কেউ খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ফিসফিস গুঞ্জন,

– আমি বড্ড একা তাহি, তাহি বিহীন রাশেদ শূন্য।

সামনে বড় একটা প্রাইভেট কার। তাহির হুঁশ নেই। মনে হচ্ছে যেন বিভোরে হাঁটছে। ড্রাইভার হাত দিয়ে ইশারা করছে। নড়ার কোনো লক্ষ্মণই নেই তাহির মাঝে। আচমকা দুটো হাতের বেষ্টনী এসে নিজের মাঝে তাহিকে আবদ্ধ করে রাস্তার একপাশে নিয়ে আসে। হুঁশ আসে তাহির। ড্রাইভার পেছন দিক থেকে গালাগাল করছে। তাহি মানুষটার বুকে নিজেকে আবিষ্কার করলো। চোখ মেলে দেখে লিমন। এখনো ওর বুকের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে। তাহি আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। জোরে ধমকে বললো,

– বেয়াদপ কোন সাহসে আমাকে ছুঁয়েছো। শুধু ছোঁয়ার বাহানা তাই না। নারীর শরীর পেলেই খুশি!

লিমন হকচকিয়ে যায়। সে তো বাঁচাতে এলো। শরীরের কথা কিভাবে আসলো।এতো বাজে কথা তাহি বলতে পারলো! ক্ষেপে গিয়ে বললো,

– কি আবোল তাবোল বকছেন। রাস্তার মাঝে কেউ এভাবে হাঁটে! আপনি পাগল! এখনই তো জান যেতো।

– গেলে আমার যেতো তাতে তোমার কি?

– আশ্চর্য চেঁচাচ্ছেন কেনো? বাসায় যান মাথা ঠিক নেই আপনার।

লিমন এগিয়ে এসে হাত ধরে বাসায় দিয়ে আসতে চাইলো। স্পষ্ট বুঝতে পারছে তাহি স্টেবল নেই। হয়তো রাশেদের স্মৃতি মাথা চড়া দিয়েছে। তাহির হাত ধরলে হাত ঝামটা মে*রে ফেলে দিয়ে এক চ*ড় দেয় লিমনের গালে। ভাগ্য ভালো রাতের বেলা। আশপাশটা শান্ত। কেউ নেই তেমন। লিমন তাহির দিকে চেয়ে রইলো। চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহি গজগজ পায়ে বাসার গেটের দিকে ঢুকে গেলো। যতক্ষন তাহির ছায়া ছিলো ততক্ষন লিমন ছিলো। এরপর নিজের গন্তব্যে রওয়ানা হলো। তাহির প্রতিটি কথায় আজ কষ্ট পেয়েছে। মেয়েটাকে কি জোর করেছে কেউ! এত খারাপ আচরণ করার মত কি হলো! লিমন নিজেকে নিজে দোষারোপ করতে করতে বাড়ির পথে পথ ধরলো। আর কখনো আসবেনা এই পাষাণ মানবীর সামনে। মন ভেঙ্গে দিয়েছে আজ।

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩২.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

জায়নামাজ থেকে উঠে হামজার দিকে তাকালো। সিস্টার মেরি সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গত কয়েকদিন সেবা করতে করতে মায়ায় পড়ে গিয়েছে। ছেলের মতোই যত্ন করেছে শাহাদকে।শাহাদ হামজার দিকে তাকিয়ে বলল,

– বাইরে গিয়ে একটু রেস্ট নিবে। খাওয়া দাওয়া করবে। যা কিছু হোক ভেঙে পড়বে না। পৃথিবীতে শূন্য স্থান বলতে কিছু থাকেনা। ভালো থাকো।

হামজা ছলছলে চোখে বলে উঠলো,

– স্যার আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।

– ইনশাআল্লাহ।

শাহাদ হামজাকে জড়িয়ে ধরলো। হামজা আর থাকতে না পেরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিলো জোরে। শাহাদকে আঁকড়ে ধরে বললো,

– স্যার আমি আপনাকে ছাড়া দেশে যাবোনা। আপনি না থাকলে কি হবে আমাদের। অপারেশন লাগবে না আপনি চলেন আমার সাথে। হুদাই ভোগাস কথাবার্তা বলে সবাই,কিচ্ছু হবেনা আপনার।

শাহাদ হামজার পাগলামী দেখে হাসছে। সিস্টার এসে হামজাকে বললো, শাহাদের সাথে অপারেশন থিয়েটার পর্যন্ত যেতে। শাহাদকে নিয়ে ডাক্তাররাও বেরিয়ে পড়লো। হঠাৎ শাহাদ থমকে গেলো। হামজার দিকে ফিরে বললো,

– আমার ব্যাগে একটা ডায়েরী আছে, ওটা ম্যাডামের হাতে দিও যদি না ফিরি।

এরপর চলে গেলো ভেতরে। হামজা দুহাতে মুখ ঢেকে ওটির বাইরে বসে গেলো। এই অপারেশন কখন শেষ হবে সেই অপেক্ষা। সবাইকে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছে। কারো সাথে কথা বলার অবস্থাতে নেই।
___

হামজার মেসেজ পেয়ে স্তব্দ দিয়া। দাঁড়িয়ে আছে আকাশের পানে চেয়ে। মনে পড়ে গেলো শাহাদের সেই কথা,

– ফারাহ আকাশটাকে দেখো।তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে। হয়তো অন্য কোনো সন্ধ্যারাতে এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি শাহাদকে খুঁজবে দূর আকাশে।তখন আমাদের দূরত্ব হবে হাজার বছরের।যদি উত্তম কাজ করি তবে দেখা হবে জান্নাতে।

কেমন যেন অস্থির লাগছে নিজেকে। তাহি ছুটে এসেছে কিছুক্ষন আগে, লিমন ও এসেছে। ঘড়িতে রাত নয়টা। সিঙ্গাপুর সময় এগারোটা। প্রায় দু’ঘন্টার পার্থক্য। শাহাদের অপারেশন চলছে। তাহি হঠাৎ করে কাঁধে হাত রাখলো। দিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাহিকে দেখে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আপু, আপনার ভাই আকাশ খুব পছন্দ করতো। আকাশের বিশালতা নাকি তাকে খুব টানতো। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন আকাশের বুকটা কত বড়? এখানে সবার জায়গা আছে, তারাদের,পাখিদের, প্লেনের,মেঘেদের। আচ্ছা আপনার ভাই যদি আকাশে থাকে তবে কি আমার জায়গা হবে সেখানে! দেখেন অল্প কয়েকটা তারা আছে আকাশে। আজ কি আকাশের মন খারাপ?

তাহি দুহাতে আগলে ধরেছে দিয়াকে। মেয়েটা কি বলছে না বলছে মাথা ঠিক নেই। ঘন্টা দুয়েক আগে নিজে ও একই কাজ করেছে। পাগলের মতো রাস্তায় আচরণ করেছে। মাথায় সারাক্ষন রাশেদ ঘুরে। দিয়া ফুঁফিয়ে কাঁদছে। কোনো দিকে আজ খেয়াল নেই। শেহজাকে আজ বাড়ির কোনো মেয়ে ধরছেনা। সব গুলো নেতিয়ে গিয়েছে। শেফালীকে দেখে আসলো শাহাদের দেয়া সব ছোট খাটো গিফট আগলে বসে আছে। শিফা রুমের দরজা দিয়ে কাঁদছে। সুলতানা কবির জায়নামাযে। নওরীন কিছুটা স্বাভাবিক থেকে খাবার রেডি করছে। লিমনকে দেখলো শেহজাকে বুকে নিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় শুয়ে আছে। শাহীন বাইরে। রায়হান সাহেব নির্বাক। আজ রাতটা কি করে পার হবে?

___

সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে। তাহি দিয়াকে জড়িয়ে বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছে। নওরীন টেবিলেই কাত হয়ে ঘুম। বাকিরা যে যেই অবস্থায় ছিলো সেই অবস্থায় আছে। কলিংবেলের শব্দে সকলে উঠে গিয়েছে। ছুটে আসলো প্রতিটি মানুষ ড্রইং রুমে। কে এসেছে! আফিয়া খালা দরজা খুললো। শাহীন ধীর পায়ে ঢুকলো। নওরীন বেসিনে এসে মুখে পানির ঝাপটা দিলো। ওড়নায় মুখ মুছে শাহীনের পাশে দাঁড়ালো। সুলতানা কবির তাসবী ঝপছে, লিমন নড়েচড়ে বসলো। উপর থেকে পাভেল ছুটে এসেছে। সকলের চোখ শাহীনের দিকে। শাহীনের চোখ মেঝেতে। রায়হান সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রাখতেই শাহীন শব্দ করে কেঁদে দিলো। দিয়া ধপ করে নিচে বসে পড়লো। তাহির শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। লিমন কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,

– ছোট ভাইয়া, বড় ভাইজান…

পাভেল অনবরত হামজাকে কল দিচ্ছে। শাহীন কথা বলছেনা। হামজা ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে পাভেল গালি ছুঁড়লো,

– হা***মী ফোন ধরোস না ক্যান? বস কই? কেমন আছে?

ডাইনিং এর চেয়ার টেনে পাভেল বসে পড়লো। কান থেকে ফোন নামিয়ে সবার মুখের দিকে তাকালো। সবাই যেন মুখিয়ে আছে নিউজ শোনার জন্য। পাভেল বুকে হাত দিয়ে বললো,

– স্টেবল না অবস্থা, আই সি ইউ তে।অপারেশনের পর পরই খিঁচুনি উঠে গিয়েছে। সন্দেহ করছে হেমোরেজিক স্ট্রোক হতে পারে…

তাহি চিৎকার দিয়ে বলে,

– পাভেল ভাই হেমোরেজিক স্ট্রোক বুঝেন আপনি? কেনো গেলো আমার ভাইজান একা। আরো কয়টা দিন বাঁচতো। কেনো আটকালেন না। স্ট্রোক যদি হয় অবজারভেশনে রেখেও লাভ নেই বাঁচবেনা তো আমার ভাইজান। ভাইজানের হাইপ্রেশার। আমার বাপ ও নাই, স্বামী ও নাই, ভাই ও নাই হয়ে যাবে। আমি কি নিয়ে থাকবো!

রায়হান সাহেব শক্ত পোক্ত ভাবে বললেন,

– তাহি আমরা কি মনকে শক্ত করবো? প্রস্তুতি নেব?

– খালুজান…

তাহির বিষন্ন ডাক পুরো কামরা জুড়ে ঘোর সৃষ্টি করে দিয়েছে। লিমন আচমকা বলে উঠলো,

– ডাক্তার সাহেবা এদিকে আসুন তো?

সকলে লিমনের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। লিমন শেহজাকে ভালো করে কোলে নিয়ে বললো,

– শেহজা কেমন যেন নেতিয়ে গিয়েছে দেখুন তো, ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

তাহি ছুটে গিয়ে দেখলো মেয়েটার গায়ে সত্যি জ্বর। অকস্মাৎ সকলের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু যেন শেহজা হয়ে উঠলো।

– শিফা থার্মোমিটার নিয়ে আয়।

লিমনের কথায় ছুটে গেলো শিফা। তাহি জ্বর মেপে দেখে ১০৪ এর বেশি। মেয়েটার হুশ নেই যেন। জ্বরের ঘোরে দু একবার পিট পিট করে চোখ খুলছে। শেফালী জল পট্টি দিতে ব্যস্ত। তাহি গাড়ি বের করতে বললো। কেমন যেন সব থমকে গেলো সুলতানা মঞ্জিলে। দিয়া মেঝের এক কোণে আগের মত বসে আছে। নিষ্প্রাণ দেহ। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– যা মা, তুই ও চলে যা। তোর বাবা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তুই থাকবি কি করে!আমি তোকে জন্মদিলেও তুই তোর বাবার প্রাণ। বাবাকে ছাড়া এমনিও বাঁচবিনা।

প্রকৃতি ঠিক কতটা অদ্ভুত। এই অবুঝ বাচ্চার শরীর,মন বাবার অনুপস্থিতিকে এতটা প্রভাবিত করেছে যে জ্বরের কম্পন লাগিয়ে দিয়েছে। ঠিক কতটা গভীর সম্পর্ক এদের মাঝে। তাহি, পাভেল,লিমন,শাহীন ছুটলো শেহজাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। দিয়া অনুভূতিশূন্য। বিড়বিড় করে বললো,

– দুনিয়াতে একা এসেছি! একাই থাকবো! একাই যাব! আমার কেউ নেই।

শিফা আর শেফালী দু পাশ থেকে ভাবীকে জড়িয়ে ধরেছে। নওরীন দেখছে সুন্দর পরিবারটার দূর্দশা। মেনে নিতে পারছেনা। পুরো পরিবারের ভীত নড়ে যাবে, শাহাদ-শেহজার কিছু হলে। এরা যেন পরিবারের প্রাণ।

___

ঘড়িতে সকাল ছয়টা। হঠাৎ ব্রেক কষলো পাভেল। সবাই সামনে ঝুঁকে গেলো। নেমে দেখলো কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। আশ্চর্য এই সময়ে নষ্ট হতে হলো। পাভেল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– শাহীন বের হ শেহজাকে নিয়ে। এই গাড়ির ও আজ নষ্ট হতে হলো।

শাহীন, তাহি আর লিমন বেরিয়ে আসলো। অকস্মাৎ শেহজা বমি করে দিলো তাহির গায়ে। মেয়েটার উত্তাপ যেন তাহির শরীর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাহি ওড়না দিয়ে মুখ মুছে দিলো। এবার লিমন এসে কোলে নিলো। একটা সি এনজি ডেকে উঠে পড়লো তিনজন। পাভেল গাড়ি নিয়ে সারাতে গেলো।

হাসপাতালের সামনে এসেই ছুটলো তাহি। শেহজাকে নিয়ে গেলো এমার্জেন্সীতে। বাইরে বসে রইলো লিমন। প্রতিটা প্রহর কা*টছে আতঙ্কে। ঝলমলে আকাশটা হঠাৎ করে কেমন অমোঘ মেঘে ঢেকে গেলো। প্রকৃতি যেন ঘোর বিপদের ঘোষণা দিচ্ছে। হাম্মাদ ছুটে এলো হাসপাতালে। পাভেল জানিয়েছে। শাহীনের মাথায় হাত। ওর যেন কোনো ভাবে মস্তিষ্ক কাজ করছেনা। হাম্মাদকে পেয়ে একটু শক্ত হলো মন। নিজ থেকে গিয়ে হাসপাতালের ফরমালিটিস পূরণ করছে। শেহজাকে এডমিট করিয়েছে। ট্রিটমেন্ট চলছে ভেতরে। মেয়েটার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তাররা জ্বর কমাতে ব্যস্ত।

__

– শাহাদের মেয়ে হাসপাতালে, যদি পারিস ওটাকে শেষ করে দেয়। এমপি বেঁচে ফিরলেও ম*রে যাবে মেয়েকে হারিয়ে।

এমন ক্রুর, অশুভ, মারাত্নক কথা শুনে কেঁপে উঠলো ঘাতকের অন্তরাত্নাও। এতটা পাষবিক হিংস্রতা সম্পূর্ণ হুকুম কেউ দিতে পারে বলে জানতোনা এই ঘাতক। কি অন্যায় এই নিষ্পাপ বাচ্চার! শুধুই কি শাহাদের মেয়ে বলে তাকে পৃথিবী ছাড়তে হবে নাকি এই অসুন্দর নিষ্ঠুর পৃথিবী তার যোগ্য নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার ঘোলা চোখের পরীর মত বাচ্চাটাকে শাহাদের কোলে দেখেছে ঘাতক। তবে হুকুম শিরধার্য। মালিকের আদেশ পালন করা কর্তব্য।

মেয়েটা ঘুমাচ্ছে চুপচাপ নিশ্চিন্তে। কি মায়াবী চেহারা। কিভাবে এতটা নিষ্ঠুর হয় মানুষ। তাহি পাশে বসে আছে। ডাক্তারকে দেখে বললো,

– আপনি কি নতুন ডক্টর?

উপর নিচ মাথা নাড়ালো। সাথে আরেকজন নার্স আছে। বাচ্চাকে দেখে ডাক্তার, নার্স সহ বেরিয়ে এলো। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। শেহজার জ্বর একটু কমে এসেছে। দিয়া এসেছে ঘন্টা খানেক আগে। শাহাদের এখনো কোনো খবর নেই। দিয়া আর তাহি শেহজার পাশে বসে আছে। স্যালাইন চলছে। মেয়েটা কাল রাত থেকে না খাওয়া। স্যালাইন শেষ হলেই খাইয়ে দিতে বলেছে ডাক্তার। তাহি একটা জরুরি কল এটেন্ড করতে বাইরে গিয়েছে। হাম্মাদ,লিমন কেবিনে ডুকলো। কিছুক্ষন বসে দিয়াকে খাবার দিয়ে বেরিয়ে এলো। চারদিকে কড়া নিরাপত্তা দিচ্ছে হাম্মাদের লোকজন। শেহজার ট্রিটমেন্ট করছে একজন ডক্টর। বাকিরা এসে দেখে যায়, স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে।

ছোট বাচ্চার রুমে এত ডাক্তারের আনাগোনা একজনের পছন্দ হচ্ছেনা। এখন যে ডাক্তার ঢুকেছে তাকে স্বাভাবিক মনে হয়নি । দিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন। পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে শেহজার মুখের উপর চাপ দিলো। প্রমানহীন মৃত্যু দিতে চেয়েছিলো মেয়েটাকে। ছটফট করে উঠলো ছোট্ট প্রাণটা। এর মাঝে দিয়া উঠে যায়, চিৎকার দেয়ার আগেই এক হাতে দিয়ার গলা টিপে ধরে, অন্য হাতে শেহজার মুখের উপর বালিশ। ঠিক তখনই লোকটার গলার উপর কেউ ধারালো, প্রখর চকচকের স্টিলের ধাতু সজোরে চালনা করে। আচমকা এমন আক্রমণে দুহাত ছেড়ে পেছন ফিরে দেখে রক্তিম চোখের এক মানব তার মৃত্যুদূত হিসেবে সামনে দাঁড়িয়ে। দিয়া কম্পিত গলায় বললো,

– মামুজান…

-শুষ… শেহজাকে ধরো।

দিয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরলো। মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। লোকটা ছটফট করতে করতে সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করলো। হাম্মাদ ভাগ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,

– উম্মি, এখন থেকে অনেক কিছুই দেখবে, অনেক কিছুই শুনবে। কিন্তু চোখকে বলবে দেখিনি,কানকে বলবে শুনিনি। ক্লিয়ার। তোমাদের হেফাজতে রাখার মহান দায়িত্ব হামাকে শাহাদ দিয়ে গিয়েছে।

দিয়া ভয়ে দু পাশে মাথা নাড়লো। হাম্মাদ কাকে যেন ফোন করলো। দুজন ডাক্তারের এপ্রোন পরে ভেতরে এলো। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝালো, একে নিয়ে যাও। ওরা ছদ্মবেশী ডাক্তার নিয়ে বেরিয়ে গেলো। হাম্মাদ সেই ছদ্মবেশধারী লোকের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখছিলো। লক দেয়া। কিভাবে যেন একটা ডিভাইস লাগিয়ে লক খুলে ফেললো। ঠিক তখনই ফোন আসলো। স্ক্রিনে বস লিখা ভেসে উঠেছে। হাম্মাদ রিসিভ করতেই পরিচিত কণ্ঠ শুনে এক পেশী কুটিল হাসি দিলো। লিমন, তাহিকে ডেকে দিয়ার কাছে রেখে বেরিয়ে এলো।

শাহীনের কাছে বসে বললো,

– ভেতর থেকে একটা ডাস্ট ক্লিন করে আসলাম শাহীন।

শাহীনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। হাম্মাদের ইঙ্গিত সঠিক বুঝতে পেরেছে। কিছুক্ষন আগেই হাম্মাদ বলেছিলো সন্দেহের কথা। হাম্মাদ পুনরায় বলে উঠলো,

– মিশনে চলে যান, আমি এখানে আছি।

– কার কাজ ছিলো আজকের আক্রমণ?

হাম্মাদ শাহীনের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,

– ফরিদের।

শাহীন উঠে দাঁড়ায়। হাম্মাদের দিকে ফিরে বলে,

– বড্ড ভুল করে ফেলেছে। রিপোর্টের জন্য মরিয়া হওয়া, সিঙ্গাপুরে ভাইজানের হাসপাতালে ওর গুপ্তচর পাঠানো,আর আজ তো লিমিট ক্রস করেছে আমাদের শেহজার দিকে চোখ দিয়ে। ও যখন ম*রণ নেশায় নেমেছে তাহলে আমরা কেনো শান্ত থাকবো হাম্মাদ?

হাম্মাদ মৃদু হেসে বললো,

– মেজর, নাও ইটস ইউর টার্ন।

– আল্লাহ হাফেজ। টেক কেয়ার অফ মাই ফ্যামিলি।

শাহীন বেরিয়ে গেলো। আজ কোনো কষ্টই কষ্ট লাগছেনা। কিছুক্ষন আগে হামজা মেসেজ করে জানিয়েছে মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটাল থেকে শাহাদকে অন্য হসপিটালে ট্রান্সফার করেছে গোপনে। শরীরের কন্ডিশন ভালোনা। হাম্মাদের লোকজন ডাক্তারের পরামর্শে সরিয়ে নিয়েছে।

__

অন্ধকার ঘর। হাত,পা,মুখ বাঁধা। চোখ খুলে দেখলো একটা ভাগাড়ের মতো জায়গা। বিশ্রী গন্ধ। আশপাশটা নিরব। কোথায় এনে রাখলো। মাথা এখনো ধরে আছে৷ এয়ারপোর্ট থেকে এই বিচ্ছিরি কামরায় কি করে এলো? ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে গেলো। হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। বার বার মনে পড়ছে প্লেন মিস হয়ে গেলো। আর কি তবে শাহাদকে পাবে না? দরজার খচ করা শব্দে সেদিকে চেয়ে দেখলো এয়ারপোর্টের সেই পরিচিত পুরুষ। অনল দৃষ্টি ছুঁড়লো মনি। হো হো করে হেসে মনিকে ঘাড়ে তুলে বেরিয়ে এলো ইয়াজ। গাড়ির ভেতর ছুড়ে মা*রলো। নিজের করুন পরিণতি চোখের সামনে দৃশ্যমান। কেঁদে উঠলো হাউ মাউ করে। বাঁধা মুখ দিয়ে উ আ আওয়াজ বের হচ্ছে। গাড়ি ছুটছে খালেদ পারভেজের বাংলো বাড়ির দিকে।

___

কেস উঠেছে কোর্টে। সব প্রমান পৌঁছানো শেষ। তদন্ত চলছে। সাক্ষীদের মধ্যে সকলে অনুপঅস্থিত৷ রায় ঘোষনা করবে আগামীকাল । এর আগেই অদ্ভুত চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসলো। এই রিপোর্ট পোস্ট ম্যান এসে দিয়ে গেলো হাম্মাদের হাতে। রিপোর্ট হাতে হাম্মাদ স্তব্ধ। রিপোর্টের এনভেলাপের পাশে চিরকুট। খুলে পড়তে শুরু করলো,

আজ পঁচিশ তারিখ। রিপোর্টের মূল কপি কোর্টে পেশ করা হয়েছে। সন্দেহ অনুসারে কাজ চালিয়ে প্রকৃত রিপোর্ট রেডি হয়েছে। প্রথম সন্দেহ করা হয়েছিলো, রাশেদ এত ঠুংকো কারণে ম*রে যাবে? নেভি ওকে এই শিক্ষা দেয়নি। রাশেদকে আ*ত্নহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে রাশেদকে ভয়ংকরভাবে ম্যানিপুলেট করা হয়, বলা হয়েছিলো প/তি/তার সন্তান। মানসিকভাবে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিলো। সেই ফোনকলের রেকর্ড কোর্টে জমা দেয়া হয়েছে। সমাজের অপমান,স্ত্রীর অবিশ্বাস, মায়ের আসল পরিচয় সব জানার পর রাশেদের মনোবল গুড়িয়ে যায়। বাধ্য হয় আ/ত্ন/হ/ন/নের পথ বেছে নেয়।
আ/ত্ন/হ/ত্যা কখনোই কোনো সমাধান হতে পারেনা,এ কথা ভুলে বসেছিলো। মানুষ ভূলের উর্ধ্বে নয়। ছোট ছোট ভুল গুলোই মহাপ্রলয় বাঁধিয়ে দেয়।রাশেদের মৃত্যুর পেছনে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ফরিদ রেজা যিনি সম্পর্কে রাশেদের ছোট চাচা। এক্স কমান্ডার শাহাদ আমাদের সাথে একমত। তিন বাহিনীর প্রতিটি সদস্য আজ মিলিত হয়েছে রাশেদকে নিরপরাধ, নির্দোষ প্রমানের জন্য।

সকলের পক্ষ থেকে,
~ এডমিরাল মানিক মোজাম্মেল।

একই চিরকুট আরো দুজনের নামে এসেছে। তাহি এবং মেহেরজান আম্মা। সুদিনের দেখা কি মিলবে তবে?

__

চোখের সামনে নিজের কৃতকর্ম ভেসে উঠেছে। লাইভ সম্প্রচার হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। পঞ্চান্ন বছর বয়সী হোম মিনিষ্টার ফরিদ রেজা মেয়েদের নিয়ে ক্লাবে মাতামাতি করছে। ফরিদের সব ভিডিও চিত্র ফাঁস। কোন মেয়ের সাথে কখন, কোন সময় মেলামেশা করেছে ক্লিপ আকারে দেখানো হচ্ছে দেশের মানুষকে। হাত পা বাঁধা চেয়ারে, প্রজেক্টরে চলছে স্বীয় কাজ। চিৎকার দিয়ে উঠলো,

– কোন শূ******চ্চা রে আমার এসব ছাড়ছিস সামনে আয়। টুকরো করে গাঙ্গের জলে ভাসাবো। এই বাই*****দ।

হা হা হো হো হি হি অট্টহাসিতে হল রুম প্রতিধ্বনিত। ধপ করে রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর পা তুলে পা দুলাচ্ছে মেজর শাহীন। ঠোঁটের কোণে ধোঁয়া উঠা সিগারেট। কুন্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে সেই ধোঁয়া। এই ছেলেটাকে সাধারণ ভাবে নিয়েছিলো ফরিদ। এটাও ভাইয়ের মত গোখরা। সুযোগ বুঝে ছোবল মা*রলো।

– আফসোস ফরিদ। তুমি আমাকে বড্ড সহজ ভাবে নিয়েছিলে…

গমগমে আওয়াজটা ফরিদের কানে লাগছে। আজ শাহীনকে যমদূত লাগছে। চেয়ার উলটা করে বসেছে তুহিন। দু পাটির সব দাঁত দেখিয়ে দু হাত নাড়িয়ে টেবিলে ধুম ধাম বাজিয়ে বিট দিয়ে নাচছে আর গাইছে,

জাব আয়ি তেরি ইয়াদ মুড মে জাতি নাহি
সাজনা আব তো নিন্দ ভি মুঝকো আতি নাহি
হো মাজনু মেরি ইয়ার
ইয়ে লায়লা হ্যেয় তাইয়ার
হো জালদি সে লেকে আজা
ইক ডায়মন্ড কি রিং
তেরি লিয়ে দিল কা টেলিফোন
হ্যে বাজতা রিং রিং রারা রিং
হো মেরি দিল কা টেলিফোন।

পাশের চেয়ারে তাকিয়ে দেখে আধম*রা অবস্থায় আলতাফ বাঁধা। পুনরায় তুহিন হাত পা নাচিয়ে একই গান গেয়ে যাচ্ছে। ঠক ঠক হিলের আওয়াজ।পান খেয়ে লাল করা ঠোঁট চোখা করে পানের পিক ফেলে পাশে বসলো মেহেরজান আম্মা। তার মুখেও হাসি। একটা টেপ রেকর্ডার বাজাতে বাজাতে ঢুকছে লেফটেন্যান্ট তানভীর। সেই একই গান রিং রিং রারা রিং, দিল কা টেলিফোন। বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঢুকছে শাহাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা দুঃসাহসী এসিস্ট্যান্ট ক্রাইম জার্নালিস্ট ইয়াজ। এরা প্রত্যেকে একই গানের সাথে বিট দিয়ে নাচছে। আলতাফের মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে। কিন্তু ফরিদ রেজা অক্ষত। চেঁচিয়ে উঠলো,

– ইয়াজ তুই কত্ত বড় বেঈমান। মেহেরজান এখানে কি তোমার? আর তোমরা এমন নাচছো কেনো?

ইয়াজ তাচ্ছিল্য নিয়ে হেসে বললো,

– এই চুপ কর শা*লা। কিসের বেঈমান। আমি শুরু থেকেই বসের বাধ্য সেক্রেটারি। আমি বেঈমান হলে তুই বা/ট/পা/র।

মেহেরজান আম্মা ভাবলেশহীন ভাবে একটা বোতল থেকে হুইস্কি ঢেলে খাচ্ছে। যেন এতেই পারদর্শী এই দুঃসাহসী নারী। তানভীর একটা ফুলের ট্রেতে করে কয়েকটা ফোন সাজিয়ে নিয়ে এলো। পুনরায় প্রত্যেকে গেয়ে উঠলো,
রিং রিং রারা রিং, দিল কা টেলিফোন। শাহীন হাত উঁচিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলো তখনই সব গুলো ফোন বেজে উঠলো। তুহিন রিসিভ করলো। প্রতিটি ফোনে কেউ না কেউ ফোন করেছে, পি এম, প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে দলের নেতাকর্মীরা। সকলের মুখে একটাই কথা দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সরাসরি রিমান্ডে নেয়া হবে। যেখানে আছে সেখান থেকে যেন সারান্ডার করে। ফরিদকে কেউ কোনো কথাই বলতে দিলোনা। এই সবগুলো ফোন ফরিদের পি এসদের। দেশের মানুষের কাছে ফরিদ পলাতক। একসাথে অনেক গুলো তকমা লাগিয়েছে নিজের নামের সাথে- রেপিস্ট ফরিদ, মাদক পাচারকারী, খুনী, কমান্ডার রাশেদ মামলার মূল আসামী সহ আরো অনেক মামলা দায়ের করা হয়েছে। শরীর কাঁপছে ফরিদের। চিৎকার দিয়ে মেহেরজান আম্মাকে বললো,

– তুই করেছিস এসব তাই না, তোকে আমি ছেড়ে দিয়ে বড্ড ভুল করেছি। ভেবেছিলাম তুই স্বেচ্ছায় ধরা দিবি। ভালোবেসেছিলাম তোকে আর তুই প্র/তা/রণা করলি?

এক দলা থুথু নিক্ষেপ করলো ফরিদের গালে মেহেরজান। গর্জে উঠলো,

– তুই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিস? আমার স্বামীকে মে*রে আমাকে সমাজের কাছে পতিতা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছিস? আমার সম্মানের বিনিময়ে সন্তানকে বাঁচিয়েছিলাম আমি। আমার সন্তানকে আ/ত্ম/হ/ত্যা/র জন্য বাধ্য করে ছেড়ে দিয়েছিস? দিলিনা বাঁচতে আমার মানিককে, তুই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিস? আমি তোকে ছেড়ে দিলাম যাহ। এই নে তোর মেডিকেল রিপোর্ট। তুই একটা এইচ আইভি প্যাশেন্ট। আমার এত বছরের প্রচেষ্টা সফল। কেন পালিয়ে যাইনি কুঠি থেকে জানিস, খোঁজ করছিলাম এইডস আক্রান্ত পতিতার, পেয়েও গেলাম। খুব ভালোবেসে রাতের বেলা যে তোহরাকে কাছে টানতি মেয়েটা আমার তুরুপের তাস ছিলো ফরিদ। আমি সফল। ম*র তুই। আমার ছেলেকে তুই বদনাম করেছিস, আমাকে করেছিস? এখন তোর কি হবে? বদনাম ও তোকে দেখলে লজ্জ্বা পাবে।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। ফরিদের মনে হলো কেউ গায়ে উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দিয়েছে। টিভিতে এই খবর ও প্রচার হচ্ছে ফরিদ এইডস আক্রান্ত রোগী। আলতাফ এখানে, খালেদ পারভেজ কোথায়! এদিকে তানভীর গানের রেকর্ডিং আরো জোরে ছেড়ে দিয়েছে। তাল মিলিয়ে বাদ্য বাজিয়ে এভাবে নেচে যাচ্ছে।

___

শেহজাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নটা। এদিকে সারাদেশ বিক্ষুব্ধ। রাস্তাঘাটে জ্যাম,র‍্যালি। কোনোরকমে জ্যাম ঠেলে হাম্মাদ,পাভেল দিয়াকে বাসায় নিয়ে এসেছে। তাহি শেহজার রিপোর্ট নিয়ে লিমনের সাথে এসেছে। সুলতানা কবির নাতনীর শুকিয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে দোয়া পড়ছে। তখনই ফোন এলো হামজার। তড়িঘড়ি করে পাভেল রিসিভ করলো,

– আসসালামু আলাইকুম পাভেল ভাই।

– ওয়ালাইকুমুস সালাম, বস কেমন আছে?

– ফোনটা আংকেল,আন্টি আর ম্যাডামের দিকে ঘুরান তো?

পাভেল রায়হানের সাহেবের হাতে ফোন দিলো। রায়হান সাহেব ফোন ধরতেই দেখতে পেলো শাহাদের হাসি হাসি মুখ। মনে হলো এই জীবনে পাওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় উপহার সন্তানের এই হাসি। মাথায় ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো। আস্তে করে বললো,

– আব্বুউউউ…

– হ্যাঁ বাবু বল

পুনরায় দম টেনে থেমে থেমে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললো,

– আমার মা..মেয়ে..আর ফারাহ্কে বলে দিবেন আমি..আআসছি.. ইন শা আল্লাহ।

চলবে…