#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৩.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বাতাসে মাটির সোদা গন্ধ। বাগানের বেলী,রজনীগন্ধা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। শেহজা অনেকটাই সুস্থ। দুদিনের মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে সুলতানা মঞ্জিলে। হাসিতে আনন্দে মুখরিত। অপেক্ষা বাড়ির ছেলে বাড়ি ফেরার। শেহজাকে ঘুম পাড়িয়ে সুলতানা কবিরের রুমে দিয়ে আসলো দিয়া। শিফাকে বললো,
– ছাদে চলো, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
– ভাবীজান এখন যাবেন? যে পরিমান বৃষ্টি আপনার ঠান্ডা লাগলে তো শেহজার ও লাগবে।
– শেহজার বাবা সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ, ওর বাবার সাথে ওর আত্মার টান। বাপ সুস্থ তো বেটি ও সুস্থ। তুমি প্লিজ চলো।
দিয়া গায়ে ওড়না জড়িয়ে শিফার হাত ধরে ছুটলো ছাদের দিকে। ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে দুজনের আলাপ শুনছিলো আড়াল থেকে রায়হান সাহেব এবং সুলতান। সুলতানা হেসে বলে,
– দেখলা বাবুর বাবা, কেমন ছটফটিয়ে উঠলো মেয়েটা। এতখানি মেয়ে স্বামী সন্তান কি বুঝে! অথচ সব সামলে যাচ্ছে। আমি ওর মাকে যদি একবার দেখার সুযোগ পেতাম তাহলে কুর্নিশ জানাতাম। পারিবারিক শিক্ষা অনেক বড় ব্যাপার বুঝলে।
রায়হান সাহেব হেসে বললেন,
– বুঝলে গিন্নী, বাবুর চোখ জহুরির চোখ, নিজের যোগ্য সহধর্মিণী নিজেই বেছে নিয়েছে, আমরা মাঝে মাঝে বয়স দিয়ে সব মাপি। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা,অভিজ্ঞতা বুঝিনা। গত তিন বছরে মেয়েটা অনেক কিছুই শিখেছে স্বামীর কাছ থেকে। আমি যতটুকু বুঝেছি ওর কোনো কিছু শেখার মারাত্মক একটা ইচ্ছাশক্তি আছে। ওর কাছ থেকে নওরীন ও শিখবে,লিমনের বউ ও শিখবে। মূলত এই বাড়ির বউগুলোর পথনির্দেশক দিয়াই হবে ভবিষ্যতে দেখে নিও। তবে আমি খুশি যে আমাদের শিফার সময়টা ভালো যাচ্ছে দিয়ার সাহচর্যে থেকে।
– আমিন। আল্লাহ এভাবে যেন সব ঠিকঠাক রাখে। এখন তো ইনশাআল্লাহ আমাদের বাবু ও ফিরে আসবে।
___
শাহীনের পারসোনাল সিক্রেট রুম। মূলত ইয়াজের বাসাকে ওরা নিজেদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করছে বেশ কিছু বছর।
– মনি কোথায়?
– আমাদের ডেরায়।
– ভাইজান যেন ঘুনাক্ষরে ও কিছু টের না পায়। তোর আর আমার দুজনেরই গর্দান যাবে।
– জ্বি চিফ। চিফ আরেকটা কথা?
– কি?
– খালেদ পারভেজ তো পালিয়েছে?
শাহীন একপেশে হাসি দিয়ে বলে,
– তোর কি সত্যি ক্ষমতা ছিলোনা ওকে ধরার?
কিছুটা ভ্রু কুচকে আসলেও শাহীনের তাচ্ছিল্য থেকে ধরে নিলো বিদ্রুপ করছে সে। ইচ্ছে করেই ও তো ছেড়ে দিয়েছে খালেদ পারভেজকে। দরজা দিয়ে পাভেল হাসতে হাসতে ঢুকলো। একটা চেয়ার টেনে বসলো। গ্লাসে পানি ঢেকে এক ঢোক খেয়ে বলে,
– ডানা টা না কা/টা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনারে। ছেড়ে দিয়ে কি ভুল করলাম?
– ওকে কেনো ছাড়ছি জানিস?
– কেনো?
– ভাইজানের জন্য। ভাইজান চেয়েছিলো নিজ হাতে ওকে শাস্ত দিবে। ওর পাপের পরিমান ফরিদের থেকেও অনেক বেশি।
হঠাৎ করে ইয়াজ বলে উঠলো,
– চিফ, ফরিদের উপর পুলিশের থার্ড ডিগ্রি চলতেছে। ওর কেস কে নিয়েছে জানেন?
পাভেল সিগারেট বের করে আয়েশী ভঙ্গিতে লাইটার জ্বালিয়ে বললো,
– অফিসার মাশরুফ ফারুক।
শাহীন বাঁকা হেসে বলে,
– ওরে আর কি বা শাস্তি দিবে। এমনিতেই ম/রার সময় হয়ে আসছে। কি খেলটাই না দেখালো মেহনাজ পাঠান।
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তিনজনের মুখ দিয়ে। অন্যমনস্ক হয়ে শাহীন পুনরায় বললো,
– রাশেদ ভাইয়ের মত মানুষটাকে আমরা কিছুতেই ভুলতে পারিনা উনিতো মা। একদম ঠিক হয়েছে ওর সাথে।
টেবিলের উপর ফোনটা ভাইব্রেশনের জন্য কেঁপে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমে উপেক্ষা করলো। কে*টে গেলো। পুনরায় কল বেজে উঠলো। পাভেল ও বললো ধরতে। শাহীন ফোন রিসিভ করতেই ও পাশ সালাম ভেসে এলো। উত্তর দিতেই অপর পাশ থেকে মোটা গম্ভীর স্বর ভেসে এলো। শাহীনের অক্ষি বৃহদাকৃতি ধারণ করেছে। শাহীন সালাম দিলো বড় করে। ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে এলো,
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। শাহীন কেমন আছো?
– জ্বি ভাইয়া ভালো। আপনি ভালো আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ। শাহাদের কি অবস্থা?
– ভাইজান আগের চেয়ে বেটার। থেরাপি চলছে।
– কবে আসতে পারে দেশে?
– মিনিমাম এক মাস লাগবে।
– সিঙ্গাপুর ন্যাশনালে আছে তাই তো?
– জ্বি ভাইয়া।
– ঠিক আছে, আমি যাবো। বাই দ্যা ওয়ে, কাজ ফেলে রেখোনা। খালেদকে ধরো। নরেশ মিত্রকে প্রথমে ছাড় দিয়েছিলাম বলে মাথা চড়া দিয়ে উঠেছিলো মনে আছে তোমার।
– জ্বি ভাইয়া।
– খালেদকে ধরে নিজের কবজায় আটকাও। শাহাদকে রেস্ট দাও। এসে যেন স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভালো থাকে। সবাইকে নিয়ে বাসায় আসো তুমি।
– ভাইজান আসলে একদিন আসবো ইনশাআল্লাহ।
– অপেক্ষায় রইলাম। আচ্ছা শুনো রাশেদের সব কিছু আমার কাছে সহিহ সালামতে তানভীর পৌঁছে দিয়েছে। হাম্মাদের সাথে দেখা হয়েছিলো সে জানালো শাহাদের অনুপস্থিতিতে এখানে আছে বেশ কিছুদিন। একটু চোখ কান খোলা রাখবে।
– জ্বি ভাইয়া।
– আল্লাহ হাফেজ।
– আল্লাহ হাফেজ।
ফোনটা রেখে দম ফেললো। পাভেল কপালে ভাজ ফেলে বলে,
– বসের পুরা গ্যাংটাকেই আমার ভয় লাগে জানিস। একটা আতঙ্কে থাকি। সব খবর এদের নখদর্পনে।
– আমি তার চেয়ে বেশি থাকি। মিশনে গেলে চিফ মেজর খন্দকার এখানে আসলে আমাদের এক্স.কমান্ডার আর এখন তো নাফিস ভাইয়া।
ইয়াজ বলে উঠলো,
– তবে যাই বলেন চিফ, উনারা একেকজন জেম। দেশের সম্পদ। উনারা আছেন বলে আমরা সেফ। ভয় হয় এতকিছুর পর ও অপরাধ বেড়েই যাচ্ছে। যখন দেশে উনাদের মতো কেউ থাকবেনা তখন কি হবে?
– রসাতলে যাবে। আপাতত অনেক ভেবেছি। যা খালেদ পারভেজকে ধরে আটকা। নতুবা এই ভদ্রলোক ঠান্ডা মাথায় খালেদ পারভেজকে বহাল তবিয়তে নিজের পিঞ্জরায় ঢুকাবে আর ভাইজান এসে আমাদের পিন্ডি চটকাবে কেনো উনার হাতে কাজ তুলে দিয়েছি। ভাইজান বরাবরই উনাকে নিট এন্ড ক্লিন রাখেন। তাই জন্য রাজনীতি থেকেও উনাকে দূরে রেখেছে। বন্ধুত্ব তো এমন হওয়া উচিত।
এ কথা বলতে বলতে শাহীন পাভেলের কাঁধে মুচকি হেসে হাত রাখলো।পাভেল মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়। জানায় আজ সুরাইয়াকে দেখতে যাবে। কাল ওদের ফ্লাইট।
___
সারা স্কুল ড্রেসে কাদা মাখানো। মাঠের মাঝখানে হাটুগেড়ে ভিড় জমিয়েছে অন্য শিক্ষার্থীরা। মাইশা বুঝাচ্ছে, উঠ শিফা আর কাঁদিস না লোকে কি বলবে। কে শোনে কার কথা। শিফার একটাই কথা, সে আগে ওই উর্মিলার চুল ছিঁড়বে এরপর বাসায় যাবে। এর মাঝে ব্যাগ থেকে আস্তে করে ডায়রিটা বের করে নিলো সদ্য। ডায়েরী নিয়ে ছুটলো ক্যান্টিনে। জামিল মামার ফোন থেকে শিফার বাসায় ফোন দিতে হবে। ডায়েরীতে বাসার নাম্বার আছে। প্রথমেই পেল ভাইজান, এরপর ছোট ভাইয়া। পরে পাভেল ভাই। সদ্য উনাকে জানে শাহাদ দেশে নেই আর শাহীন হয়তো কাজে ব্যস্ত থাকবে। পাভেলকে প্রায় সময় দেখেছে শিফাকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে। ফোন দিলো পাভেলের ফোনে। সব খুলে বললো। এরপর আবার ছুটে এলো শিফার কাছে। ওয়াশ রুমেই এই অকান্ডটি ঘটিয়েছে দুই বালিকা। শিফা ছুটির পর চুল আঁচড়াতে ওয়াশরুমে যায়। উর্মিলা ওর অন্য বান্ধবীকে শুনিয়ে শিফাকে খোঁচা দিয়ে বললো,
– আজ কাল দেখি সেজে গুজে স্কুলে আসে আবার বাইরে যায়। টিচারদের এই রূপ দিয়ে দমায় রাখে। ভালো রেজাল্টের খুশিতে বান্ধবীদের খাওয়ায়। বাপের টাকায় এমন ভালো রেজাল্ট সবাই করতে পারে। আসল খেল এস এস সি তে দেখবো।
শিফা ক্ষেপে গিয়ে বললো,
– তোর মতো তো রাস্তায় রাস্তায় বুক পেট দেখায় হাঁটি না। শরীরে একটা ক্রস বেল্ট পরেছে এমন ভাবে মনে হচ্ছে পরা আর না পরা একই কথা। আমার রূপের তো বাহার ঝড়ে পড়ছে তাই টিচাররা খুশী হয়ে নাম্বার দেয়। তুই তো সব খোলা রাখলেও কেউ ঘুরে তাকায় না।
এই শুরু হলো থা/প্প/ড় আর মা/রা/মা/রি। শিফার হাত ছিলে গিয়েছে, পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। উর্মিলার মাথা কে*টে গিয়েছে। এখন দুজন মাঠের দু পাশে বসে আছে। ভাগ্য ভালো ছুটি হয়ে গিয়েছে৷ নতুবস লংকা কান্ড হত। মাঠে এসে ধপ করে কাদার মধ্যে বসে আছে। বান্ধবীদের ও কাছে ঘেষতে দিচ্ছেনা শিফা। এমন সময় বাইক নিয়ে সোজা পাভেল ঢুকে পড়লো স্কুল গ্রাউন্ডে। শিফাকে এমন অবস্থায় দেখে চক্ষু চড়কগাছ। সামনে হতবিহ্বল হয়ে এগিয়ে এলো। পাভেলকে দেখে সদ্য ছুটে এসে বললো,
– ভাই দেখেন এই কাদার মধ্যে বাচ্চা পোলাপানের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবাই কেমন তাকিয়ে আছে। হাত টা ছিলে…
পাভেল হাত দিয়ে থামিয়ে দিল সদ্যকে। শিফার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি শুনছি এসব? এখানে এভাবে বসে আছো কেনো?
ভারী মোটা স্বরটা শুনে শিফা তড়াক করে তাকালো। নিজের আপাদমস্তক দেখে পাভেলকে দেখছে। এই অবস্থায় পাভেল তাকে দেখলো! এই জিনিসটা ভেবেই কেমন অস্বস্তিতে ভরে উঠলো ভেতরটা। আচমকা বাচ্চাদের মত কান্না জুড়ে দিল। ওর এই পরিবর্তনে বন্ধুরা সব আঁৎকে উঠলো। এই তো বাঘিনীর মত গজ গজ করছিলো। এখন এমন ভেবলীর মতো কাঁদছে কেনো? পাভেল নিজেও ভয় পেলো। হাঁটু গেড়ে বসলো ওর সামনে। নিজের প্যান্টেও কাদা লাগলো। শিফার হাত ধরে উঠিয়ে বললো,
– ঠিক আছে, কিছু বলতে হবে না বাসায় চলো।
শিফাও বাধ্য বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। তৎক্ষনাৎ ঘটে গেলো এক অদ্ভুত কান্ড। কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে পাভেলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে শিফার গালে চটাস করে এক চ/ড় লাগিয়ে দিলো। পাভেল অকস্মাৎ ধাক্কায় সামনে ঝুঁকে গেলো। শিফা কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়লো। উর্মিলা গজ গজ করে বললো,
– এবার শান্তি পেয়েছি৷ বেশি দেমাগ না তোর। একদম কাদায় কাদায় হয়েছে দেমাগ।
পাভেল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একটা মেয়ে সাথে কিছু পাতি মাস্তান নিয়ে এসেছে। আন্দাজ করেছে এই সেই মেয়ে। একবার শিফার দিকে তাকিয়ে পুনরায় উর্মিলার দিকে তাকালো। উর্মিলা খেয়ালই করলোনা সে কাকে ধাক্কা দিয়েছে। পাভেল নিজেকে আর সংযত করতে না পেরে কষে এক চড় লাগালো উর্মিলার গালে। এই প্রথম কোনো মেয়ের গালে হাত তুললো। এমন পুরুষালী চ*ড় খেয়ে উর্মিলার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। আঙ্গুল তুলে পাভেল একটাই কথা বললো,
– কার কলিজায় হাত দিয়েছিস তুই জানিস?
তোর সেই হাতই আমি ভে/ঙে ফেলবো।
পাভেল সামনে উদ্ধত হলে খেয়াল করলো সামনে আগাতে পারছেনা। ওদের মধ্যেই এক পাতি গুন্ডা পাভেলের পা জড়িয়ে বসেছে। নিচের দিকে তাকাতেই ছেলেটা বলে উঠলো,
– ভাই, স্যরি মাফ কইরা দেন। আমার ছোট বোন। বুঝেনাই। এই মেয়েটা এ আপনাদের পরিবারের এই কথা জানলে ওরে সাবধান কইরা দিতাম।
ছেলেটা পাভেলকে দেখেই চিনে ফেললো, এমপির পি এস বলে কথা। শিফার সাথে এমপির কোনো কানেকশন আছে কিনা কে জানে? বোন তো সেকথা বললো না। পাভেল একটা লাথি মে/রে সরিয়ে বললো,
– আমাদের পরিবারের না হলে কি তুইসহ ওই মেয়েকে মা*রতি?
– না ভাই ওটা বলিনি।
পাভেল শিফার দিকে তাকিয়ে দেখে মাইশা,সদ্য ওর মুখ ধুইয়ে দিয়েছে ততক্ষনে। ঠোঁটের পাশটা কে*টে গিয়েছে। মাইশা ওই জায়গায় টিস্যু দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। পাভেল চোখ বুজে নিজেকে সামলে বললো,
– ঝামেলার কান্ডারি কে?
মাইশা বলে উঠলো,
– ভাইয়া উর্মিলা।
পাভেল গর্জে উঠলো,
– ভাই-বোন মাফ চা শিফার কাছে… কুইক।
উর্মিলা ভাইয়ের ধমকে শিফার দিকে তাকিয়া মাফ চাইলো। শিফা কিছু বললো না। পাভেল শিফার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো। মাইশা আর সদ্যকে বললো,
– বাসায় যাও, চিন্তা করবে বাবা মা।
ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আর হ্যাঁ পাতি মাস্তান, আজকের ঘটনা যেন এখানে শেষ হয়। ওর বাবা বা ভাইদের কানে উঠলে তোকে আমি আস্ত পুঁতে দিব। বাকি রইলো তোর বোন। সামলে রাখ। রাজনীতির ময়দান এত সুবিধার নয়। মেয়েদের নিরাপত্তা দেয়া এখন অনেক কঠিন। যেভাবে উড়তেছে কোনো রাঘব বোয়ালের চোখে পড়লে একদম গিলে নিবে। তোর বাপের খেমতা থাকবেনা রক্ষা করার,মাথায় রাখিস।
– জ্বি ভাই।
বাইকে উঠেই শিফাকে পেছনে বসার নির্দেশ দিলো। বাধ্য বাচ্চার মত শিফা উঠে বসলো। বাইক থামলো একটা রেস্টুরেন্টে। হাতের ইশারায় অনুসরণ করতে বললো পাভেল। উপরে রুফটপে বসেই শিফাকে ফ্রেশ হতে যেতে বললো। নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিলো। যতখানি পেরেছে কাদা ধুয়ে মুছে এসে বসলো। ততক্ষনে পাভেলের খাবার অর্ডার শেষ৷
– শুরু করো।
শিফা চুপচাপ খাচ্ছে। পাভেল ফোনে কি যেন করছে। শব্দহীন খাবার খাচ্ছে। পাভেল হাতের ফোনটা রেখে বললো,
– ভদ্র মেয়ের মতো ব্যাপারটা এড়িয়ে আসা যেত না?
নিরুত্তর শিফা। পাভেল ফোস করে দম ফেলে বললো,
– বাসায় কি জবাব দেবে?
তবুও নিরুত্তর। এবার পাভেল ক্ষেপে উঠলো। এতক্ষন প্রশ্ন করছে। কোনো উত্তর দিচ্ছেনা। কিসের এত অভিমান।এখন পর্যন্ত কথা বলছেনা। অনেক উচ্চস্বরেই বললো,
– এ্যাই ষ্টুপিড তোমার সমস্যা কি? কথা কানে যায়না। কথা বলছো না কেনো?
টুপ টুপ করে চোখের জল বেয়ে পড়ছে। চোখের পানিতেই পাভেলের মন গলে গেলো। আর কথা বাড়ালোনা। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার থেকে একটু স্যাভলন আর তুলা নিয়ে শিফাকে পাশের চেয়ারে বসতে বলে শিফার পাশে বসলো। হাত দিয়ে থুতনী তুলে ঠোঁটের কোণায় স্যাভলন লাগানো তুলাটা চেপে ধরলো। শিনশিন করে উঠলো কা*টা। চোখ মুখ খিচে ফেললো হাল্কা আওয়াজ করে। পাভেলের ক্ষীন স্বর কানে আসলো,
– আস্তে আরেকটু। ভালো হয়ে যাবে। বাসায় যেয়ে মেডিসিন নিবে ঠিক আছে।
শিফা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের মত মাথা কাত করে নাড়ালো। বিলটা মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। লিফটে উঠেই শিফা পাভেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আপনার করে নিলেই তো পারেন। তখন তো কেউ মা/র/তে আসবেনা।
এ যেন সরাসরি কেউ মাথায় বাঁশ দিয়ে সজোরে আঘাত করলো। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। লিফট থামলো। কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই বাইকে উঠে বসলো। শিফা বুঝে গেলো আর হয়তো কোনো কথা আসবেনা এই মানুষটার পক্ষ থেকে। শান্ত মেয়ের মত বসে পড়লো বাইকে। তখন শিফা বাইকের পেছনের হ্যান্ডেল ধরে বসলেও এখন পাভেলের কোমড় জড়িয়ে বসলো। ছোট্ট পাতলা হাত দুটো দিয়ে নিজের পেটের কাছে উপস্থিতি পেয়েও শুকনো ঢোক গিলে বাইক স্টার্ট দিলো। মনোযোগ দিলো পিচ ঢালা রাস্তায়। বাড়ির সামনে এসেই শিফা নেমে পড়লো। দারোয়ান গেট খুলে দিলো। শাহীনের গাড়িও তখন গেটের সামনে। শাহীন নেমে পড়লো। শিফার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে রে? ব্যান্ডেজ কেনো?
শিফা মুখ খোলার আগেই বললো,
– পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে। চিন্তা করিস না। ওয়ান টাইম লাগিয়ে দিয়েছি। বাসায় নিয়ে একটা প্যারাসিটেমল খাইয়ে দিস।
শাহীনের দৃষ্টি পড়তেই শিফা কাচুমাচু করে উঠলো। পাভেলের দিকে তাকিয়ে ভাবলো মিথ্যা বললো কেনো এই লোক! শাহীন ফোন হাতে নিয়ে শিফাকে ইশারা করলো আসতে। ততক্ষনের বাইক পার্ক করে ফেলেছে পাভেল। শাহীন বাসায় ঢুকে পড়লো। শিফা দরজায় অপেক্ষা করছে পাভেলের জন্য। পাভেল নিজের চিলেকোঠায় উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেই পেছন দিকে থেকে শিফা ডাক দিলো,
– পাভেল ভাই?
পাভেল থেমে শিফার দিকে ফিরে বললো,
– পাভেল ভাই রাইট? ভাই ডেকেছো না এটার মর্যাদা দিও। তখন যা বলেছো এই কথা যেন আর কখনো না শুনি।
শিফাকে ওভাবে রেখে উপরে উঠে গেলো পাভেল। রেখে গেলো ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মন ভাঙ্গা মেয়েটাকে। এই মানুষটা কি কখনো তাকে বুঝবেনা?
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৪.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়লো হাম্মাদ। ভেবেছিলো এই ঘোড়া ভাগ্নিকে তার জন্মদিনে এখানে ডেকে এনে পুনরায় হস্তান্তর করবে। বাংলাদেশের মত জায়গায় জিপসী ভেনার ঘোড়ার সাদা ব্রিড খুবই বিরল। আমিরাকে মুরাদ দিয়েছিলো জন্মদিনে, রক্ষণাবেক্ষণে ঘোড়ার উপর প্রভাব পড়তে পারে বলে সরিয়ে রেখেছিলো হামিদ মজুমদার। এই ঘোড়ার প্রতি নজর ছিলো অনেকের৷ সুযোগ বুঝেই সরিয়ে ফেলেছিলো নাতনীর বড় হওয়া অবধি ঘোড়া হেফাজতে রাখার জন্য, একশ বছরের পুরোনো একটি আস্তাবলে। সেই আস্তাবলের মালিক ছিলো হামিদ মজুমদারের এক বন্ধু। এতদিন অনাদরে কেউ বুঝতেই পারেনি এই ঘোড়ার দাম ত্রিশ পেরিয়ে পঞ্চাশ লাখে ঠেকেছে। এক একটা জিপসী ভেনারের মূল্য প্রায় পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ ইউ এস ডলার৷ হাম্মাদ আস্তাবল থেকে জিপসীকে উদ্ধার করে নিজের জিম্মায় রেখেছে। ভাগ্নীকে হস্তান্তর করার সময় এসে গিয়েছে। নির্দেশ এসেছে ঘোড়াকে সাজিয়ে রাখার।
__
টেবিলে সাজানো সব বরষার খাবার। বৃষ্টিতে খিচুড়ি, জলপাই চাটনী,বেগুন ভাজা, তিতা করলা ঝুরঝুরে ভাজা আর গরুর মাংস ভুনা। দু হাতে মাখিয়ে শেহজা খাচ্ছে। দিয়া একটু করে খাচ্ছে আর মেয়েকেও খাবার গুছিয়ে দিচ্ছে। এর মাঝে শেফালী বললো,
– ভাবীজান কি শুরু করলেন, আপনি সরেন আমি ওরে খাওয়ায় দি। এভাবে খেলে পেট ভরবে?
দিয়া খানিকটা হেসে বলে,
– ভরবে আপা, আপনি শুধু দেখে যান। খাওয়া শেখার দরকার আছে। এত আহ্লাদে রেখে পরে বাবা মা কাছে না থাকলে আমার মত প্যাচ প্যাচ করে কাঁদবে।
সুলতানা কবির মেয়েকে ইশারায় শান্ত হতে বললেন। শিফাকে খাইয়ে দিচ্ছে রায়হান সাহেব। আজ শুক্রবার হওয়াতে দেরি করে উঠেছে। ঘুম ঘুম চোখে বাবার গলা জড়িয়ে বায়না ধরেছে খাইয়ে দিন। আদরের ছোট মেয়ের বায়না রাখতেই নিজেও খাচ্ছে মেয়েকেও খাইয়ে দিচ্ছে। গত দুমাস শাহাদের সাথে কারো কোনো যোগাযোগ হয়নি। প্রথম মাসের পর ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী আরো একমাস থাকতে হচ্ছে। থেরাপির মধ্যে থাকাতে ডাক্তার বারণ করেছে কথা বলতে,প্রেশার নিতে। মাঝে মাঝে হামজা দূর থেকে ভিডিও কলে দেখিয়েছে। শিফা খাবার চাবাতে চাবাতে বলে,
– আব্বু আপনার কোনো অদ্ভুত গুন নেই যা আমরা পেয়েছি? দেখুন না শেহজা কি সুন্দর ভাইজানের মত তিতা করলা চাবাচ্ছে। আমার ও তো তিতা লাগে ওর কি লাগছে না?
রায়হান সাহেব হেসে বলেন,
– আমার সব গুলো সন্তানই আমার দোষ গুলো পেয়েছে। তোমাদের খারাপ দিক গুলো আমার,ভালো দিক গুলো তোমাদের মায়ের। যেমন ধরো তোমার বড় ভাইজানের রগচটা স্বভাবটা আমার পেয়েছে। আমি এক কালে এমন ছিলাম। শাহীনের ভাঙচুর করার স্বভাবটা আমার, শেফালীর মতো মিথ্যা আমি ও বলতাম তবে এত বেশি না। আর তোমার মতো বাবা মায়ের কাছে আহ্লাদ করতাম।
শেফালী মাথা নত করে রেখেছে। ওর স্বভাবটা সবচেয়ে খারাপ। বাবা যে কথাটা ওকেই হিট মেরে বলেছে সেটা বুঝতে পেরেছে। রায়হান সাহেব পুনরায় কথা প্রসঙ্গে বদলে সরাসরি বললো,
– শেফালী তোমার ভাইজান আসার সময় হয়েছে। নিজেকে তার সামনে এবার ঠিক ভাবে উপস্থাপন করবে। আমাকে আর লজ্জ্বিত করবেনা, ঠিক আছে?
– ঠিক আছে আব্বু।
আড্ডা গল্পে মেতে উঠেছে সুলতানা মঞ্জিল।
__
ইতিমধ্যে রক্তের জন্য হাহাকার লেগে গিয়েছে হাসপাতালে। কোথাও মনির রক্তের ব্লাড সেম্পল মিলছেনা। মিলছেনা বললে ভুল হবে এবি পজিটিভ ব্লাডের ডোনার পাওয়া যাচ্ছেনা। কেউ দিতেই চাইছেনা। কমন একটা রক্তের গ্রুপের ডোনার পাওয়া যাচ্ছেনা ভাবলেই মনে হয় এটাই কি শাস্তি এই মেয়ের? বংশে কারো নেই এই রক্ত। সকলের অজানা আজকের এই খবর। এই খবর লিক হলে অনেক বড় বিপদের আশঙ্কায় আছে শাহীন। শেষমেষ ফোন দিয়ে চাচা-চাচীকে জানানো হলো মনির এক্সিডেন্টের কথা। কিছুক্ষন পর ছুটে এসেছেন উনারা। হাসপাতালের করিডরে সকলে বসে আছে। শেষশেষ ডোনার পেয়েছে তাহি। অদ্ভুতভাবে ডোনার হচ্ছে রোদসী, রাশেদের বোন।
নিচে ক্যান্টিনে এসে শাহীন একটানা বকে যাচ্ছে ইয়াজ এবং তানভীরকে। মনির এই অবস্থা কি করে হলো সেটা ভেবেই আতঙ্কে আছে সকলে। দুজনেরই মাথা নত। পাভেল ক্যান্টিনে ছুটে এসেছে। শাহীন পাভেলকে দেখে মুখ খুলবে এর আগেই পাভেল বললো,
– যত যা বলার ইচ্ছা পরে বলবি আপাতত প্লেন ল্যান্ড করবে দুঘন্টার মধ্যে। রেডি হ। রাস্তায় প্ল্যান করিস কি উত্তর দিবি।
শাহীন মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। ইয়াজ পাশের টেবিল থেকে গ্লাস তুলে ঢক ঢক করে সবটুকু পানি গলদঃকরন করে নিলো। তানভীর পাভেলের হাত ধরে বলে,
– ও পাভেল ভাই এবার কি করবো? ইচ্ছে করে তো করিনি।
পাভেল দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– তোর এখানে কি? যা হেড কোয়ার্টারে। তোর কাজ শেষ। বাকিটা আমি দেখছি।
তানভীর বেরিয়ে গেলো এক ছুটে। ইয়াজের অসহায় দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, আমার ও সাহায্য চাই ভাই। পাভেলের অগ্নি চাহনী ইয়াজের দিকে ফিরে শাহীনকে পর্যবেক্ষন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শাহীনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ভেঙ্গে পরিস না, এতেই আল্লাহ মঙ্গল রেখেছেন।
– কি উত্তর দিব আমি।
– যা সত্যি তাই। এখন উঠ সময় নষ্ট করিস না। অলরেডি নেতাকর্মীরা ভীড় করবে। আমি সবাইকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
তাহির সাথে দেখা করে সবাইকে রেখে বেরিয়ে পড়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে এমন মুখ করে থাকতে দেখে পাভেল শাহীনকে ধমকে বললো,
– চেহারা ঠিক কর, আগাম কিছু টের পেলে দেখবি থোবড়া বদলায় রাখবে৷
তুহিন গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,
– ভাই আমি কিন্তু কিছু জানিনা। আপনাদের আগে পিছে আমি ছিলাম না, আমারে ফাঁসাইবেন না।
পাভেল দিলো এক বজ্রধমক। কেঁপে উঠলো গাড়িতে বসা সকলে,
– এই নেমক***ম বিপদে পড়লে ভাইগা যাইতে চাস? মিশনে তুই ছিলিনা? ওদের যখন ভুল হয়েছে তার মানে ভুলটা সবার। এই দায়ভার ও সবার। আলাদা করোস কেনো নিজেকে। পরের বার আমি তোকে আর উদ্ধার করবোনা কিছু থেকে।
তুহিনের মুখটা চুপসে গেলো। আমতা আমতা করে ক্ষীন স্বরে বলল,
– স্যরি, অন্য কেউ হলে তো সমস্যা ছিলোনা।কিন্তু ওই মনি কুটনীর ব্যাপার আসলেই আমার কেন জানি রাগ লাগে ভাই, আমি শিউর সবার লগে আমারে আমসত্ত্ব বানাবে।
– বানালে হবি।
বাধ্য বাচ্চার মত উত্তর দিলো,
– আইচ্ছা।
___
তাহি ফার্মাসি থেকে ঔষধ নিচ্ছে। মনিকার বাবা, মা দুজনই কাঁদছে। কিছুক্ষন আগে ডাক্তার জানিয়েছে অপারেশন করতে হবে। লিমন ও এসেছে তার মাকে নিয়ে। লিমনের মা রত্না বসেছে মনির মা মোমেনার পাশে। কেনো যেন মোমেনা কখনোই রত্মাকে পছন্দ করেনি। মেয়ের উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে এরপর ও তার ঔদ্ধত্য কমে নি। রত্না বললো,
– ভাবী আমাদের মনি ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না।
– আমার মেয়ের উপর কুনজর লেগেছে মানুষের। ওর ভালো কারো সহ্য হয়না। অলক্ষ্মী গুলো সারাদিন আশেপাশে ঘুরলে মেয়ের ভালো হবে কি করে! কই গো এতক্ষন হলো তোমার ভাই ভাবী তো এলো না।
রত্নাকে পাত্তা না দিয়ে রেদোয়ান সাহেবকে বললো এই কথা। লিমন আর তাহি সামনেই ছিলো। মেয়ের উপর কুনজর লেগেছে কথাটা যে স্পষ্ট তাহি আর রত্নাকে বলেছে উপস্তিত সকলের বোধগম্য হয়েছে। লিমন মাকে ধরে বললো,
– আম্মু তোমার শরীর ভালোনা,এত করে বললাম এসোনা। এখন চলো। জেঠু, জেঠিমা আর মনি আপা ভালো আছে। ডাক্তার তাহি অনেকক্ষন এখানে ছিলেন।উনারা নিজেদের সামলে নিবে। আপনি যান রেস্ট নেন অথবা অন্য প্যাশেন্টের কাছে যান। উনাদের একটু একা থাকতে দিন।
তাহি লিমনের ইঙ্গিত বুঝে সরে গেলো জায়গা থেকে। সারাজীবন তাহিকে কথা শুনিয়েছে এই মহিলা। অথচ সকাল থেকে তাহি দৌঁড়ঝাপ দিয়ে রক্ত জোগাড় করেছে। তাহি সরে যেতেই আবার ছ্যান ছ্যান করে উঠলো মোমেনা,
– কত্ত বড় বেয়াদপ। আজ আমার মেয়েটা সুস্থ থাকতো, তাহলে বুঝিয়ে দিতাম বেয়াদপটাকে।
– আগে আপনার মেয়ে সুস্থ হোক জেঠী…
লিমন মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই কথা বললো। রেদোয়ান সাহেব দেখছে ভাতিজাকে। কত বড় হয়েছে,কথার পিঠে কথাও আজ শুনাতে পারে এই ছেলে।ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো, সে চিন্তিত। অনেকক্ষন হয়েছে বড় ভাইকে কল করেছে, শেফালি কি এই খবর ভাইয়াকে এখনো দেয় নি! হয়তো দিয়েছে রাস্তায় তারা। লিমন মাকে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় মোমেনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– জেঠিমা গেলাম, প্রয়োজন হলে জানাবেন। যদিও মনি আপার জন্য কাউকে প্রয়োজন নেই।দেখবেন একটু পর উঠে নিজের অপারেশন নিজেই করে ফেলবে।
– লিমন…
মায়ের ধমকে চুপ তো হলোই না উল্টা মাকে জোর করে বের করে নিয়ে আসলো। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে রত্না প্রশ্ন করলো,
– কিরে লিমন ভাবী,ভাইজান আসলোনা যে?
– না আসাই ভালো। বড় আম্মুর শরীরের অবস্থা জানোনা, আর বড় আব্বু ও তো এসব ধকল নিতে পারেনা। জেঠীকে দেখছো কেমন ছ্যাৎ ছ্যাৎ করছে। এছাড়া একটা নিউজ আছে আম্মু?
– কি?
লিমন হেসে বলে,
– না কিছুনা, তুমি কি যাবে ওই বাসায়? বড় আম্মু বেশ কিছুদিন বলছিলো তোমাকে নিতে।
– গেলে যদি ছোট ভাবী পরে কথা শুনায়?
– বাদ দাও তো। চলো।
আসল কথা চেপে গেলো লিমন। তাহিকে মেসেজ দিলো। যদিও জানে মেয়েটা যাবেনা এখন। এখানে তার অতীব গুরুত্বপূর্ণ কা/ল/না/গি/নী রোগীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। রওয়ানা দিলো সুলতানা মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে।
__
পাভেলের ফোনে মেসেজ। ভাইব্রেশনের জন্য ফোন হাতে নিলো। মেসেজ দেখে মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো। মনে মনে নিজেকে অশ্রাব্য গালি দিলো এই ভেবে যে কেনো নাম্বারটা ব্লক করলোনা। পাশে শাহীন বসে আছে। এবার ফোন বেজে উঠলো। কেটে দিতেই পুনরায় বেজে উঠলো। শাহীন বিরক্ত হয়ে বললো,
– ফোন ধর নাহয় বন্ধ কর।
ফোন সাইলেন্ট করে মেসেজ দিলো,
– দোহাই লাগে শিফা, আমাকে শূলে চড়াবে জানতে পারলে। আর মেসেজ দিও না।
ও পাশ থেকে মেসেজ এসেছে,
– দিব না আগে বলেন ভালোবাসি।
– বাসিনা।
মেসেজ দিয়েই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো।
.
.
গাড়িটা কোনো রকম পার্ক করে ছুট লাগিয়েছে চারজন। সোজা হয়ে ভদ্র ভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আশপাশে প্রেস,নেতাকর্মীরা সকলে সালাম দিচ্ছে। পুলিশ দিয়ে ঘেরাও আজ এয়ারপোর্ট। আবহাওয়া আজ ঠান্ডা। চারদিকে হৈহৈ রৈরৈ রব। এমপি শাহাদ ইমরোজ সুস্থভাবে দেশে ফিরে আসছেন। সকলের মুখে উপচে পড়া উত্তেজনাকর হাসি। প্লেন ল্যান্ড করেছে সেই আওয়াজ কানে স্পষ্ট। পাভেল এবং শাহীন একজন অন্যজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ইয়াজ- তুহিন একে অন্যের কাঁধে হাত দিয়ে রেখেছে। এইতো ভাইজান হাসি মুখে এগিয়ে আসছে পুলিশ অফিসার,নিরাপত্তা কর্মীদের সাথে। পরনে একটা অফ হোয়াইট গ্যাভাডিং, গায়ে কালো হুডি, চোখে রিমলেস গ্লাস, মাথায় হুডির ক্যাপ, পায়ে ক্যাজুয়াল ক্যাটস। ঠোঁটের কোণে হাসি। এইরূপে এমপিকে এর আগে খুব কম মানুষ দেখেছে। হয়তো অসুস্থতার খাতিরে নিজেকে স্বাভাবিক সুস্থ রাখতে আজ খুব সাধারণ পোশাকে সেজেছে। প্রেসের লোকজন ছবি তুলতে ব্যস্ত। কথা বলতে চাইছে কিন্তু সুযোগ পাচ্ছেনা। আশপাশ থেকে লাগাতার প্রশ্ন আসছে,
– স্যার আপনার শরীর কেমন?
– স্যার আপনি কাউকে না জানিয়ে যাওয়ার পেছনে কি কোনো কারণ আছে?
– আপনার রোগটা কি ছিলো?
আরো অনেক প্রশ্ন। একেবারে সামনে এসে দাঁড়াতে ইয়াজ- তুহিন ছুট লাগালো। ঝাপিয়ে পড়লো শাহাদের বুকে। দুহাতে স্নেহের ছোটদের জড়িয়ে ধরলো। ওদের ছেড়ে আরেকটু এগিয়ে আসতেই শাহীন আর পাভেলকে দেখতে পেলো একে অন্যের হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। দু হাত মেলে দিতেই দুই দিক থেকে বুকে আঁছড়ে পড়লো দুজন। এ যেন অগ্রজ-অনুজদের মিলনমেলা। পাভেল-শাহীনের চোখে পানি। এয়ারপোর্টের অবস্থা আরো গুরুতর হচ্ছে।পুলিশের সহায়তায় বেরিয়ে আসলো। নিজের রেঞ্জ রোভারটাকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে হাসি ফুটলো। গাড়িতে চেপে বসলো প্রত্যেকে। হামজাকে বাড়িতে নামিয়ে দিলো। ইয়াজ এবং তুহিন মাঝপথে নেমে পড়লো পার্টি অফিসের বাহানা দিয়ে। আসল উদ্দেশ্য হাসপাতাল।
__
রায়হান সাহেব দুশ্চিন্তায় ছটফটিয়ে উঠলেন। শেফালীকে ধমক দিলেন। চাচা ফোন দিয়েছে সেটা কেনো জানায় নি। মনি যে হাসপাতালে এই কথা তিন/চার ঘন্টা পর জানতে পারছে ব্যাপারটা দুঃখজনক। শাহীন বা পাভেল কেউই ফোন তুলছে না। লিমন ও একনাগাড়ে বকা খেয়ে যাচ্ছে। শিফা বললো,
– আব্বু একটু পর যান। ছোট ভাইয়া একটু ঝামেলায় আছে। মেসেজ দিয়েছে রাস্তায়, বাসার দিকে আসছে।
লিভিং রুমে বাড়ির প্রতিটি মানুষ চিন্তিত। অকস্মাৎ শিফা শেফালীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– আপু ইচ্ছে করে আব্বুকে জানাও নাই তাই না?
শেফালী বকা খেয়ে ও বেহায়ার মত মুচকি মুচকি হাসছে। শিফাকে বলল,
– হ্যাঁ, ডাইনীটার সাথে একদম ভালো হয়েছে। আমার জীবন তেজপাতা করেছে। ওকে দেখতে কেনো যাবে আব্বু আম্মু? আল্লাহ সেদিন ভাইজানকে ভাবীজানের উসিলায় রক্ষা করছে। নাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত?
– সে তো আব্বুর বকাই খেলে?
– সারাজীবন খারাপ কাজের জন্য বকা খেয়েছি, আজকে একটা মারাত্মক প্রশংসনীয় কাজ করেছি।আমার আত্মা শান্তি পেয়েছে। এখন চুপ থাক।
পাশ থেকে লিমন তাল দিলো,
– শুনো কি হয়েছে? মেয়েটা হাসপাতালে এরপর ও জেঠীমার দেমাগ কমেনা ডাক্তার তাহিকে কতগুলা কথা শুনালো।
শেফালী ভ্রু কুচকে বলে,
– ডাক্তার তাহি মানে? তাহি আপা?
– হ্যাঁ
– আপা কি তোর চেয়ে ছোট? নাম ধরে কেনো ডাকছিস? বল যে তাহি আপা?
– এমা ছিঃ ছিঃ আপন বোন নাকি…
সুলতানা কবির ধমকে উঠলেন,
– একদম চুপ,অন্যায় করাটা করেছে আবার ফিসফিস করছে তিন মাথা মিলে। ইচ্ছে করছে থা/প/ড়ে মুখ চপা বদলে দিই।
তিনজনই চুপ। দিয়া বললো,
– আম্মু আমি ভেতরে যাবো আপনার নাতনীকে নিয়ে।
সকলে স্পষ্ট বুঝলো দিয়া মনিকে নিয়ে কোনো আলোচনায় থাকতে চাইছেনা।
.
.
.
ঠিক তখনই বাড়ির গেট থেকে গাড়ির আওয়াজ এলো। দিয়া রুমে চলে গেলো। শিফা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
– এইতো ভাইয়া আসছে?
লিমন ছুটে বেরিয়ে যাবে তখনই রায়হান সাহেব ধমক দিলো,
– এমন করছো কেনো দুজন জীবনে শাহীনকে দেখোনি?
উত্তেজনা, কৌতুহল দমিয়ে রাখা যে কি কষ্ট হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আবার দুজন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে একে অন্যের মুখ দেখে। কলিং বেল বাজতেই আফিয়া খালা দরজা খুলে দিলো। দরজার সামনে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলো তব্দা খেয়ে। সুলতানা কবির বললো,
– আফিয়া তোমার আবার কি হইছে? কে আসছে?
আফিয়া খালা হু হা করে কেঁদে কেটে বলে উঠলো,
– ও আম্মা আমি কারে দেখতাছি?
সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে এলো। ধীর পায়ে ঠোঁটের কোণে এক পেশে হাসি রেখে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ালো। পেছনে পাভেল এবং শাহীন। সুলতানা কবির ছেলেকে দেখে কেঁপে উঠলো। মুখে উচ্চারণ করলো,
– আল্লাহ…
রায়হান সাহেবের চক্ষু ছানাবড়া। সেই মুগ্ধ হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দুহাতে বাবা মাকে জড়িয়ে ধরলেন। রায়হান সাহেব ছেলের কপালে স্নেহের চুমু খেলেন। সুলতানা কবির গুনগুন করে কাঁদছে,
– আমার আব্বা… আমার মানিক। আল্লাহ তোমার কাছে লাখ কোটি শুকরিয়া। আমার বাবু আমার চোখের সামনে। আমার আর চাওয়ার নাই।
রায়হান সাহেব একটু সরে এসে ইশারা দিলেন, মাকে যেন সামলায়। শাহাদ মাকে এবার দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
– আম্মা, এমন করে কাঁদলে বাবু কষ্ট পাবে তো। এবার থামেন। মুখটা দেখান। আমি কতদিন দেখিনা আমার বেহেশতের মুখ।
সুলতানা কবির ছেলের বুক থেকে মুখ তুলে দুহাতে ছেলের গালে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকলো। পেছন থেকে শাহীন টিপ্পনী কা/টছে,
– ইশ! ভাইজান আপনি তো সবার আদর নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তো কোনো দিন ও এত আদর পেলাম না।
সুলতানা কবির তেঁতে উঠে শাহীনকে ধমকে বলে,
– হ্যাঁ তোমরা তো বাতাসে বড় হইছো। এত হিংসা কেনো। আমার বাবুটা কতগুলা মাস পর আমার কাছে আসছে।
মাকে ছেড়ে সামনে তাকালে দেখে ছোট ছোট তিনভাই বোন তাকিয়ে আছে ছলছল চোখে। হাত মেলে দিতেই তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়লো। শেফালী, শিফা আর লিমন শক্ত করে ভাইজানকে ধরে রেখেছে। কাঁদছে সবাই। এতদিনের দুশ্চিন্তা সরেছে মাথা থেকে। ঠোঁট বিস্তৃত হাসি। রত্নাকে দেখে সালাম দিলো শাহাদ। কাছে এসে রত্না মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– আব্বা সুস্থ থাক। আমি আল্লাহর কাছে বলেছি আমার হায়াৎটুকু ও যেন আমার বড় ছেলেটাকে দেয়।
ভাইবোনদের ছেড়ে মাতৃসমতুল্য চাচীকে ধরে বললো,
– চাচীআম্মু এমন কথা যেন না শুনি, আজকের শাহাদ আপনাদের অবদান। চাচাজান চলে যাবার পর আপনি আমার দায়িত্ব। আর লিমন কখনোই আমার কাছে আমার চাচাতোভাই ছিলোনা। ও বরাবরই আমার সন্তানতুল্য। রজত,লিমন,শিফা, শেফালী,কাব্য,নিশাদ,নিশি প্রত্যেকে আমার প্রাণ। ফুফিও রাস্তায় কাঁদছিলো ফোনে। আপনাদের মুখে হাসি ফোটাতে মহান রব আমাকে আবার নতুন জীবন দিয়েছেন অথচ এখনো সকলের চোখে পানি। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
দুহাতে চোখ মুছে রত্না বললো,
– আর কাঁদবোনা বাবা, এবার শুধু হাসবো।
এর মাঝে আফিয়া খালা দিয়াকে ডেকে নিয়ে আসছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে ছুটে এসেছে দিয়া। প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখে বিস্মিত দিয়া। শাহাদ তখনো দেখেনি প্রিয়তমা স্ত্রীকে। শেহজা বাবাকে দেখে সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– বাবা, বাবা কোলে
শাহাদ মেয়ের গলা শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে তার রানী আর রাজকন্যা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। ঘোমটার নিচে বুঝা যাচ্ছে চুল খোলা। পরনে একটা হলুদ রঙা গাউন। এতেই যেন অগোছালো মেয়ের সৌন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আপন মানুষকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। চোখে মুখে আনন্দ প্রকাশ পাচ্ছে। বাকিরাও আশ্চর্য ছোট্ট শেহজার কথা শুনে। এই মেয়ে কোলে বলা শিখলো কখন? শাহাদের মনে হলো কত শত বছর এই প্রানটাকে দেখেনি। কত ভালোবাসায়, আদরে বাবাকে বলছে কোলে নিতে। এ যেন উত্তপ্ত ধরনীর বুকে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি, শ্রাবনের ধারা ঝরছে টুপুরটুপুর ঝংকারে, শুভদৃষ্টি হলো সকলের প্রিয় যুগলের, প্রেয়সীর চোখে আনন্দ অশ্রু আর প্রিয়তম স্বামীর ঠোঁটে অনাবিল হাসি। গুটি পায়ে এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। শেহজার গালে চুমু দিতেই মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে! বাবার গালে, মুখে, নাকে নিজ থেকে ঠোঁট লাগিয়ে আপ্পা দিচ্ছে। ভিজিয়ে দিয়েছে বাবার মুখ আদরে আদরে। শাহাদ হাসছে, তার সাথে খিলখিল করে হাসছে ছোট্ট শেহজা। গত কয়েকমাস এই মেয়েটাকে কেউ হাসতে দেখেনি এভাবে। অথচ আজ ওর হাসিই থামছেনা। শাহাদ দ্বিধা, লজ্জ্বা, বিভেদ সব ভুলে আরেক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলো প্রিয় সহধর্মিণীকে। আছড়ে পড়লো স্বামীর বুকে। অর্ধাঙ্গীর মাথার অগ্রভাগে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। শব্দহীন আজ সুলতানা মঞ্জিলের লিভিং রুম। হাস্যজ্বল প্রতিটি মুখ। সুখ ফিরেছে তাদের। প্রাণ ফিরেছে রায়হান সাহেবের পরিবারের। স্রষ্টা ফিরিয়ে দিয়েছেন তাদের মোনাজাতে রাখা প্রিয় মানুষটাকে। একেই কি বলে সর্বসুখ?
সহধর্মিণীর কানের গোড়ার চুলে সকলের অগোচরে হালকা ফুঁ দিলো। শরীর জুড়ে শীতল হাওয়া শিহরিত। কানে আলতো ভাবে ঠোঁট স্পর্শ করে ফিসফিস স্বরে বললো,
– শুভ জন্মদিন শাহাদের রানী। আজ থেকে শাহাদ পুরোপুরি আপনার।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৫.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
লিমন গলা ঝেড়ে কেশে উঠলো। দিয়া লজ্জ্বা পেয়ে বুক থেকে সরে যেতে চাইলো,শাহাদ আষ্টেপৃষ্টে ধরলো। লিমনের দিকে ফিরে বললো,
– তোর গলায় কি সমস্যা?
– না মানে ভাইজান কই কি সমস্যা?
– য/ক্ষা রোগীর মতো খুক খুক করছিস কেনো?
লিমনের থেকে নজর সরিয়ে দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– একটা কম্ফোর্টেবল ড্রেস পরে এসো?
সকলে হতচকিত। শাহাদ পুনরায় বললো,
– সাইকেল রাইডিং তো পারো, ধরো তোমাকে এখন সাইকেল চালাতে হবে এমন একটা ড্রেস পরে এসো। প্রশ্ন করবেনা কোনো। দ্রুত যাও। পাঁচ মিনিট সময়।
দিয়া রুমে চলে যেতেই সবাই প্রশ্ন করছে। শাহাদ নিশ্চুপ। দিয়া রুমে ঢুকে দেখলো এই একটাই ড্রেস আছে যেটা সামলে বসা যাবে। মজুমদার বাড়িতে থাকতে বানিয়ে ছিলো। দিয়া বেরিয়ে আসলো সাত মিনিটের মাথায়। এক পলক দিয়াকে দেখে সবাইকে বললো,
– নিচে চলো সবাই একটা জিনিস দেখাবো।
দিয়ার হাতটা শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে সোজা হাঁটা দিলো। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আব্বু, আম্মু চলুন একটা সুন্দর জিনিস দেখাবো।
শাহাদ সকলকে নিয়ে নিচে নেমে আসলো। বাড়ির বাগানের এক কোণায় এক অদ্ভুত সুন্দর জিনিসের সাক্ষাৎ হলো রায়হান সাহেবের পরিবারের সদস্যদের। মাথায় লম্বা সাদা চুল,লেজের চুল গুলাও ভীষণ সুন্দর। এত সুন্দর ব্রিড এর আগে সরাসরি কেউ দেখেনি। দিয়া সেদিকে তাকিয়ে দেখে হাম্মাদ খুশি মনে এগিয়ে আসছে। দিয়া আজ কিশোরীর ন্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বললো,
– মামু…কোহিনূর…
শাহাদ দিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
– যাও কোহিনূরের কাছে। তোমার জন্মদিনের প্রথম উপহার।
দিয়া চুলগুলোকে সুকৌশলে খোঁপা করে মাথায় পুনরায় ওড়না প্যাঁচিয়ে ছুটে গেলো। কোহিনূর সাদা ব্রিড, এর মাঝে দিয়া পরেছে সাদা একটা গাউন যার মাঝখানে কাটা। সহজেই সাইকেল,বাইক এবং ঘোড়াতে চড়া যাবে। দেখতে পুরো রাজকুমারী লাগছে। আজ মনে হয় যেনো ইরানী কন্যার সব সৌন্দর্য্য ফুটে উঠেছে। দিয়াকে দেখে কোহিনূর ছটফট করে দুপা মাটি থেকে উঠিয়ে দিলো। এভাবেও কূর্নিশ করা যায়? খুশিতে কোহিনূর দিয়ার চারপাশে চক্কর লাগাচ্ছে। এত বছর পর কোহিনূর দিয়াকে শনাক্ত করে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে জীব – পশু এরা মানুষের চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ। দিয়া কোহিনূরকে আগলে ধরে কেঁদে দিলো। কোহিনূরের ও চোখে পানি। হাম্মাদ ভাগ্নিকে দেখে হাসছে। একটু জোরেই বললো,
– আমিরা আপা ও এভাবে কোহিনূরের প্রিয় ছিলো।
দিয়া এক লাফে কোহিনূরের পিঠে চড়ে বসে। শিফা,শেফালী আঁৎকে উঠে চিৎকার দেয়। শাহাদ ও ভয় পেয়ে জোরে বলে,
– ফারাহ্ পড়বে…
কে শুনে কার কথা? দিয়া কোহিনূরের পিঠে চড়ার সাথে সাথেই কোহিনূর পুনরায় শূন্যে সামনের দু পা তুলে দেয়। লাফিয়ে চলছে বাগান জুড়ে। শেহজা মাকে ঘোড়ায় দেখে নিজেও হাত তালি দিচ্ছে আর চিৎকার দিচ্ছে। দিয়ার মুখে সেই হাসি। বাতাসের তোড়ে খুলে গেলো চুল। দুহাত শূন্যে মেলে দিলো দিয়া। শাহাদের মনে হলো রূপকথার রাজকন্যা। এই মোহময়ী সৌন্দর্য্য আড়াল করতেই হামিদ মজুমদার সরিয়ে ফেলেছিলো কোহিনূরকে। একদল এখনো বসে আছে কোহিনূর এবং তার মালকিনকে আত্নসাৎ করার লক্ষ্যে। কোহিনূরের মালকিন আমিরার পর দিয়া।দূর্বল চিত্তের হামিদ মজুমদার না পারলেও এবার হাম্মাদ – শাহাদ মুখোশ উন্মোচন করবে তাদের। এই কোহিনূর সংক্রান্ত কারণেই যে মুরাদ- আমিরার প্রানঘাতি হয়েছে একথা ধরনীর বুকে অবস্থানরত কিছু মানুষই জানে। যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে তারা এবং শাহাদ,হাম্মাদ।
ঘোড়া একেবারে শাহাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। দিয়া শাহাদকে বলে,
– উঠবেন আপনি?
– না না আমি পারিনা, তুমি চাইলে শেহজাকে উঠাতে পারো।
দিয়া খিলখিল করে হেসে বলে,
– আপনি পানির জাহাজ চালাতে পারেন অথচ ঘোড়া পারেন না?
শাহাদ মাথা নাড়ালো দুপাশে। হেসে বললো,
– বেঁচে ফিরেছি আল্লাহর রহমতে, আবার আধমরা করতে চাও নাকি? আমার পেরে লাভ নেই, তোমার মত অত সাহস নেই। মেয়েটাকে তোমার মত অসীম সাহসী বানাও।
সুলতানা কবির এগিয়ে এসে বললেন,
– বৌমা আমার নাতনীটা ভয় পাবে, উঠানোর প্রয়োজন নেই মা।
শাহাদ মাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
– কিচ্ছু হবে না আপনার নাতনীর, সাথে তার মা আছে৷ আল্লাহ ভরসা।
শাহাদ মেয়েকে ঘোড়ায় তুলে দিলো। কোহিনূর লাফিয়ে উঠলো। শিফা,শেফালী ভয়ে সুলতানা কবিরের পেছনে লুকিয়েছে। অন্যদিকে সুলতানা কবির শাহাদের পেছনে। দিয়া ওড়না দিয়ে মেয়েকে কোমরের সাথে বেঁধে পুনরায় একটা চক্কর লাগালো। আরেকবার ঘুরে এসে থামলো আগের জায়গায়। দিয়া নেমে আসলো। কোহিনূর আজ থেকে সুলতানা মঞ্জিলে থাকবে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন সহিসের ব্যবস্থা করে দিলো হাম্মাদ। দিয়া দুহাতে নিজের চোখ মুচছে। হাম্মাদ ভাগ্নীকে ধরে বললো,
– উম্মি, তোমার জন্য কেউ সারাজীবন থাকবেনা। হামিও থাকবোনা। তুমি মা- বাবার জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন। আমিন।
নাক টেনে বললো,
– আমিন।
ঘড়িতে সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে। প্রায় সাড়ে ছয়টা। শাহাদ বিশ্রামের জন্য রুমে গিয়েছে। ডাক্তার এসেছে, চেক আপ করছে। নেতাকর্মীরা দেখা করবে জানিয়েছিলো সব মিটিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে। চুপি চুপি শাহীন এবং পাভেলকে নিয়ে রায়হান সাহেব কিছুক্ষন আগে বেরিয়েছেন। ভাইয়ের অনুরোধ রাখতে এই কর্তব্য পালন করা উচিত। সমাজে বাস করতে হলে কিছু কাজ দায়িত্ব এড়ানো যায়না। কি হলো ঘটনা বৃত্তান্ত শুনে আসা প্রয়োজন।
ডাক্তার চলে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষন। দিয়া ডাইনিং এ শাশুড়িকে সাহায্য করছে। শরবত বানাচ্ছে সবার জন্য। নওরীন অফিস সেরে এসে শাহাদের সাথে দেখা করেছে। জা এর সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে। গল্প করছে এর মাঝে শিফা গান গাইছে দিয়ার কানের সামনে। দিয়ার কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গান গাইছে,ওর সাথে তাল দিলো শেফালী আর নওরীন।
– রূপ সুহানা লাগতা হ্যেয়, চাঁদ পুরানা লাগতাহে, তেরে আগে ও জানাম। তু ভি ক্যায়া চিজ হ্যেয়, হার দিল আজিজ হ্যেয়, দিল চাহে দেখে তুজে… হাম হার দাম। রূপ সুহানা লাগতা হ্যেয়…
সুলতানা এবং রত্না কিচেনে চলে গেলো মেয়েদের দুষ্টুমি দেখে। দিয়া লজ্জ্বায় লাল হয়ে বললো,
– আল্লাহ এমন করছো কেনো? কি শুরু করলে তিনজন।
শেফালী বলে উঠলো,
– আজ ভাবী ঘোড়ায় চড়ে যেভাবে বাজিমাত করলো,উফ হামে তো মারডালা। ভাইজান কেমন করে তাকিয়ে ছিলো মোহাবিষ্ট হয়ে…
শিফা নাক কুঁচকে বলে,
– জঘন্য তোমার হিন্দি? ইন্ডিয়ান গভমেন্ট শুনলে তোমার ভিসা নিষিদ্ধ করে দিবে।
– উফ থাম, ওয়েট ওয়েট ভাইজান আজ রাতে ভাবীজানের জন্য গান গাইবে কিভাবে বলি?
শিফা বললো,
– বলো বলো…
এক কানে হাত দিয়ে অন্য হাত শূন্যে ছড়িয়ে সুর টেনে গাওয়ার মতো ভান করে বললো,
– আমি ফেসে যাই,তোমার উড়া চুলে
তুমি হাসলে ওই গালে আমি ফেসে যাই…
ও আমি ফেসে যাই তোমার চোখের জলে
চুয়ে পড়া কাজলে আমি ফেসে যাই…
ও আমি ফেসে যাই..
ও ও ও ও…
দিয়া চোখ বড় বড় করে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। শাহাদ বোনদের দিকে তাকিয়ে সোজা পেছনে এসে দাঁড়ায়। পেছন থেকে আওয়াজ ছাড়ে,
– কার মনে এত প্রেম, কে এত ফেসে যাচ্ছে?
নওরীন মাথায় ঘোমটা টানে। শিফা আর শেফালী থতমত খেয়ে গিয়েছে। শাহাদের চাহনী দেখে শিফা ভয়ে বললো,
– ভাইজান… গা নে র ক লি… খেলছিলাম।
– বোর্ড পরীক্ষার আর কয়দিন আছে?
– এইতো যাচ্ছি পড়তে?
শিফা পালিয়ে গেলো। শেফালী মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শাহাদ পুনরায় বললো,
– আবিরকে খাইয়ে দাও। মজা মাস্তি পরে করবে। বাচ্চাটার ক্ষুধা লেগেছে।
শেফালী মাথা ঝাকিয়ে নওরীনকে নিয়ে রানাঘরে চলে গেলো। ফেলে রেখে গেলো দিয়াকে। দিয়া একবার শাহাদের দিকে তাকিয়ে শরবতের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো। চেয়ার টেনে বসে তিন চুমুকে শরবতটা খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। দিয়ার দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু নিচু করে ধীর গলায় বললো,
– আমি ফেসে গিয়েছি…
দিয়া লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বুজে ফেললো,শাহাদ রুমে চলে গেলো। শেফালী,নওরীন বের হলো রান্নাঘর থেকে,শিফা লুকিয়ে ছিলো পর্দার আড়ালে। শাহাদের রুমের দরজা লক করার আওয়াজ পেয়ে তিনজন পুনরায় একই গান গেয়ে উঠলো, রূপ সুহানা লাগতা হ্যেয়…চাঁদ পুরানা লাগতা হ্যেয়…তেরে আগে ও জানাম। আমি ফেসে যাই… আড়াল থেকে এই কপোত-কপোতীর ছোট্ট আলাপন পাজি গুলো দেখে নিয়েছে। কি বলেছে তা শোনেনি, শুনলে এতক্ষণে লজ্জা দিয়েই মেরে ফেলতো। লজ্জায় দিয়া দুহাতে মুখ ঢাকলো।
__
শাস্তি এমনো হতে পারে! পাপ কাউকে ছাড়ে না, অনেক রকমের শাস্তি হতে পারতো এই পাপী নারীর। কিন্তু সব ফেলে এমন শাস্তি হলো যার থেকে রেহাই নেই। যার কোনো সমাধান নেই। ভেতরে অপারেশন চলছে৷ মোমেনার মাথায় হাত। রেদোয়ান আজ নিঃস্ব। একটা মাত্র মেয়ে। কতই না আশা ছিলো এই মেয়েকে নিয়ে। বেশ কিছুদিন আগে মেয়ে বললো একটা ডাক্তারি ডিগ্রির জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হবে। অথচ এই মেয়ে বাংলাদেশে কি করছে! আবার আজ এমন এক্সিডেন্টের মুখোমুখি হলো। রায়হান সাহেব ভাইয়ের পাশে বসে ভাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে খুব কড়া করে বলতে জীবনে শুধু টাকাই চিনলি মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলিনা। পরক্ষনে মনে হলো ভাইকে বলে কি হবে? নিজের মেয়েটাও তো মানুষ হলোনা। ডাক্তার বেরিয়ে এলো ওটি থেকে। চিন্তিত স্বরে বললো,
– ওনার দু পায়ের যা অবস্থা, রাখার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারলাম না। কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।
মোমেনা চেয়ার থেকে আর উঠতে পারলোনা। রেদোয়ানের দু চোখে অশ্রু। কি করলো মেয়েটা। পরিণত বয়স থেকে সবকিছুতে বাড়াবাড়ি করা শুরু করে, এতদিন ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলাটা আজ এক মহাভুলের কারণ হয়ে দাঁড়ালো।
রায়হান সাহেব এসে শাহীনের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
– আপাতত তোমার মা ছাড়া বাকিদের এই বিষয়ে আলোচনা করতে বারণ করে দিবে। শাহাদের কান অবধি হালকা বিস্তর আলাপ ও যেন বিষয়ে না উঠে খেয়াল রাখবে। ঠিক আছে?
– জ্বি আব্বু।
– আব্বু, আম্মু তো আসতে চাইছেন?
– পাভেলকে বলো নিয়ে আসতে। লিমনকে বাড়ি থেকে নড়তে বারণ করো। বাড়ির পরিবেশ আমরা না ফেরা অবধি যেন স্বাভাবিক থাকে।
– আচ্ছা আব্বু।
__
হাসপাতাল থেকে ফেরা হয়েছে সকলের। রাতের খাবার খেয়ে যে যার যার রুমে অবস্থান করছে। রায়হান সাহেব সবাইকে রুমে ডেকে সাবধান করে দিয়েছেন বার বার যেন শাহাদ জানতে না পারে। দিয়া রুমে ঢুকেই দেখলো শাহাদ মেয়েকে বুকের উপর শুইয়ে মেয়ের সাথে দুষ্টুমি করছে। মেয়ে মাথা বাবার বুকের সাথে লেপ্টে রেখেছে। বাবা কথা বলছে আর মেয়ে বুঝদার বাচ্চার মতো হু,হা করছে। এই যেমন মাত্র শাহাদ বললো,
– আম্মা বাবাকে তুমি মিস করেছো? হু?
– হু
– বাহ তুমি বাবার সব কথা বুঝো জানবাচ্চা?
এবার চুপ করে আছে। শাহাদ পুনরায় বললো,
– আম্মা, বাবাকে ডাকো তো…
– বাবা, বাবা
দিয়া দরজা আটকে খাটের এক কোনায় বসলো চুপচাপ। শাহাদ দিয়াকে দেখে মেয়েসহ উঠে বসে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে দিয়াকে বললো,
– ফারাহ একটা চমৎকার কাজ করেছি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি তুমি খুবই খুশী হবে।
দিয়া কৌতুহল নিয়ে তাকালো। শাহাদ মেয়ের থুতনী ধরে আদো গলায় বললো,
– বাবা, মা বলোতো।
শেহজা সাথে সাথে দু হাতে তালি দিতে দিতে বলে,
– মা মাম্মা.. বা বা
দিয়া মুখে হাত দিলো। মেয়ে একবার মা বলছে তো আরেকবার বাবা বলছে। মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিয়া বললো,
– আপনি শেখালেন কি করে? এত মাস চেষ্টা করেও মেয়ে মুখ দিয়ে মা শব্দ উচ্চারণ করেনি।
– কারণ তুমি মা শব্দ মেয়েকে শেখাওনি, বাবা শিখিয়েছো আগে। মেয়ের দোষ দিবেনা।
দিয়া ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জ্বা পেলো৷ উঠে গেলো বসা থেকে কাজের বাহানায়। শেহজা হাই তুলছে। দিয়া শেহজার বিছানা গুছাতে ব্যস্ত। শাহাদ মেয়েকে কাঁধে নিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বেলকনিতে গেলো। মিনিট পনেরো পর মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় নিয়ে ফিরলো। শেহজার বেডে ওকে শুইয়ে দিলো। শেহজাকে শুইয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো দিয়া আচমকা দ্রুত পা চালালো। খপ করে দিয়ার হাতটা ধরলো। দিয়া মুখে শব্দ করে উঠলো। শাহাদ মুখ চেপে ধরে বললো,
– আস্তে কি করছো ফারাহ্… মেয়েটা উঠবে।
নিস্তেজ হয়ে গেলো দিয়া। শাহাদ দেখলো শেহজা নড়েচড়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শাহাদ দিয়ার দিকে তাকালো,
– পালাচ্ছো কোথায়?
– কোথায়… না তো?
আপন অধর কামড়ে অধর কোণে একপেশে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে মানুষটা। হ্যাজেল আইয়ের মানুষটার প্রেমে পড়তে মন ও আজ বেহায়া হয়ে উঠেছে। প্রিয় পুরুষের এই হাসি যেন উপছে পড়ার খুশির ঝলক। চোখ মুখ সবই যেন হাসছে। দিয়া লজ্জ্বা পেয়ে মাথা নোয়ালো।
– জন্মদিনের দ্বিতীয়, তৃতীয় অনেক উপহারই আছে আমার ট্রলিতে। সবই বস্তুগত। আরেকটা উপহার হলো শাহাদ স্বয়ং। কোনটা চাই? চিঠির কথা মনে আছে?
ভ্রু নাচিয়ে হাসি মাখা ঠোঁটের কোণে প্রশ্ন করলো। পকেট থেকে কিছু একটা বের করে দিয়ার আধ খোলা খোঁপায় বেঁধে দিলো। খোঁপায় হাত দিয়েই বুঝতে পারলো রজনীগন্ধার গাজরা। দিয়া আরক্তিম গালে পিটপিট করে তাকালো।পুনরায় গাল নোয়ালো। এত লজ্জা কি করে ভর করলো? শাহাদ মাথা নিচু করে কবিতার মত আওড়ালো,
– আমি ফেসে যাই, তুমি হাসলে ওই গালে আমি ফেসে যাই।
একে তো মেয়েটা লজ্জ্বায় রাঙা এর মাঝে শেফালীদের তখনের সেই গানের লাইন আবার বলছে মানুষটা। লাজে লাল হয়ে আছে। অকস্মাৎ দিয়ার মনে হলো এই যাহ, শরীর কাঁপছে কেনো? পুরোনো অনুভূতি, বুক কাঁপছে। শাহাদ এমন একটা কাজ করে বসবে ভাবনাতীত ছিলো। পা টলছে। এখনি কিছু ধরে শক্তপোক্তভাবে দাঁড়াতে হবে৷ শাহাদের ওষ্ঠের বিচরণ তখন দিয়ার গলায়,পরপর কানে, বাম গালে। নিজের ভারসাম্য রক্ষার্থে শাহাদের দু কাঁধ আগলে ধরলো। প্রেয়সীর শরীর জুড়ে কম্পন টের পেয়ে দুষ্টুমি মাখা হাসি দিয়ে সরাসরি কোলে তুলে নিলো। মৃদু হলদে ল্যাম্পশেডের আলোয় সেই হাসি সুস্পষ্ট। এবারে সুর ছাড়লো,
– এখন অনেক রাত, তোমার কাঁধে আমার নিশ্বাস আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়…
সূর্য, দিনপঞ্জিকা, বর্ষপঞ্জিকা সব মিলিয়ে তিন বছর পেরিয়ে শাহাদ ইমরোজ আজ প্রেয়সীতে পুনরায় ডুব দিয়েছে। প্রিয়ার উষ্ণ অধর আজ শাহাদের ছোঁয়ায় আদ্রতা পেয়েছে। সিক্ত পরশ আজ কায়াজুড়ে। সবচেয়ে সুন্দর ব্যক্তিগত মুহুর্তের সাক্ষী হয়েছে শাহাদ-দিয়া দম্পতি। আজ শাহাদ নিজেকে আড়াল করেনি, রাখেনি কোনো গোপনীয়তা, কালো মলাটে বাঁধা ডায়েরীতে ছিলো তার রচিত ফারাহ্কাব্য। যেখানে ছিলো তিন বছরের চাপা প্রণয়গাঁথা। সেই ডায়েরী আজ তুচ্ছ। সুন্দরতম মিলন ঘটলো শাহাদ-দিয়া দম্পতির।
শাহাদ বলে উঠলো,
– তোমার ঠোঁটে চুমু খেতে গিয়ে মারাত্মক ভয় পেয়েছি ফারাহ্?
দিয়া ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
– কেনো?
– Burmese Grape চেনো?
– উঁহু।
– যাকে আমরা লটকন বলি। ভেতরে ফলটা দেখেছো কেমন জুসি জুসি,টসটসে৷ একটু আঘাত পেলেই শেষ… আমি তো ওই ফিলটাই…
– চুপ করবেন…
– একদম না। আরেকবার…
.
.
.
সহধর্মিণীর বুকে মাথা রেখে খানিকটা সময় নিশব্দ রইলো। শাহাদপ্রিয়াও স্বামীর মাথা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। চিঠিতে লেখা শাহাদের সেই আকুতি আজো ভুলেনি। প্রিয় স্ত্রীর অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন কানে বিঁধছে। বুক থেকে মাথা না তুলেই প্রশ্ন করলো,
– কি হলো সোনা… আমি কি কোনো ভাবে বেশি করে ফেলেছি?
নাক টেনে চোখ মুছে বললো,
– নাহ।
– তাহলে বিষাদময় জল কেনো অক্ষিজুড়ে? তবে কি ধরে নিব সুখের?
– দুটোই।
শাহাদ মাথা তুলে প্রশ্ন করলো,
– দুটোই?
– হুম। ব্যক্তিগত মানুষটাকে কাছে পেয়ে আর…
– আর কি?
এবার জোরেই কেঁদে দিলো,
শাহাদ সোজা উঠে বসলো। দিয়াকে উঠিয়ে বুকে টেনে নিলো। শাহাদের লোমশ উন্মুক্ত বুক প্রেয়সীর চোখের জলে সিক্ত।
– আস্তে সোনা… মেয়ে উঠবে? বেশ লজ্জ্বার পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তুমি কি চাও মেয়ে এই অবস্থায় দেখুক বাবা মাকে?
– নাহ।
– থামো? কি হয়েছে তাই বলো?
– আপনি আমাকে না বলে কোন সাহসে সিঙ্গাপুর গিয়েছেন? কিছু হলে আমি মেয়েকে নিয়ে কোথায় যেতাম? এই কাজের জন্য আমি আপনাকে একটু ও মাফ করবোনা। প্রতিটি দিন,ক্ষণ আমার কাছে এক একটা বছর লেগেছে। আমরা মা মেয়ে জড়াজড়ি করে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়েছি। মেয়েটা আমার বুক পেয়েছে কাঁদার জন্য। আমি তো কারো বুক পাইনি কাঁদার জন্য। আপনার কিসের অধিকার ছিলো আমাদের এভাবে কষ্ট দেয়ার?
দিয়ার মাথাটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে শাহাদ। নিজের অজান্তেই চোখ বুঁজে। গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা অশ্রু। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলীতে চেপে মুছে নেয়। সত্যি এই প্রশ্নের উত্তর শাহাদের অজানা। হাসপাতালের দিনগুলো কে*টেছে অসহ্য যন্ত্রণায়, মাঝে মাঝে মনে হত এই হয়তো শেষ। ইচ্ছাশক্তি আর অশেষ করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করলেও কম হবে, এভাবে বেঁচে ফিরে আসার কথা তো ছিলোনা। অপারেশন কেবিনে একবার কানে এসেছিলো ডাক্তারের কথা, ইটস মিরাকেল! জীবনে কিছু মিরাকেল সত্যি ঘটে যায়, যা তার সাথে ঘটেছে।মেয়ের ভাগ্যে, পিতৃমাতৃহীন প্রেয়সী অদৃষ্টে তার নাম লিখা ছিলো। একেই বলে রহমত এবং তাকদীর। মাথায় একটাই নেশা চেপেছিলো তাকে সুস্থ হতে হবে, ফিরতে হবে। হিতের বিপরীত কিছু মাথায় আসেনি। হয়তো স্রষ্টাই আনতে দেয়নি। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
– এই মহাপরাধ সংঘটনের কারণে অধমের জন্য কি শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন এমপি বধূ?
বুক থেকে মাথা উঠিয়ে এক ধাক্কা দিতে শাহাদকে সরিয়ে বললো,
– মেয়েকে নিয়ে যা খুশি তা করুন, মেয়ে আপনার প্রাণ। খবরদার মেয়ের মায়ের কাছে ঘেঁষবেন না। দূরে থাকবেন।
– একটু আগে যে কত কিছু ঘটে গেলো? আমার সব ভালোবাসা নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছো তার বেলায়?
– যা হয়ে গিয়েছে তা শেষ। নতুন করে ঘেঁষবেন না।
– কোথাও যেন শুনেছিলাম মেয়েদের ফিলিংস কাজ করে কম। বাট ইম্পোরটেন্ট কথা হচ্ছে, এতক্ষন যে পরিমান ভালোবাসা দিলাম তাতে আপনার একমাস চলে যাবে। স্যরি টু সে দ্যাট আপনাকে ছাড়া আমার একদিন ও চলবে না। সো এসব রুলস ফুলস আমার সাথে খাটাতে আসবেন না মিসেস শাহাদ,ক্লিয়ার?
– আপনি এত বাচাল তো ছিলেন না?
– সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।
– কিহ? কি বুঝাতে চেয়েছেন আপনি?
শাহাদ মুচকি হাসি দিয়ে পুনরায় ঝাপটে ধরলো দিয়াকে। দিয়া দূরে ঠেলছে আর বলছে,
– কাছে আসবেন না…
এতটুকুই… বাক্য আর শেষ হলোনা। ওষ্ঠদ্বয় প্রিয়পুরুষের কব্জায়। খুনশুটি,দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসাই একটা সম্পর্কের প্রাণ। ততক্ষন টিকে থাকবে যতক্ষন মানুষগুলো টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। শাহাদ ইমরোজকে পুরোপুরি জয় করে নিয়েছে শাহাদপ্রিয়া ফারহানা মেহতাব দিয়া।
চলবে…