#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৩৯.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
পায়চারী করছে মেয়েকে নিয়ে ছাদে। মেয়েটা বাবার কোলে শান্ত। আকাশের চাঁদটা ঝলমল করছে। মেয়েটা কেমন বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। এত অল্পতেই সব ভেঙেচুরে আসলো নিচে। অথচ বউটা দুটো বছর কি করে সহ্য করলো। বেঞ্চিতে বসলো। মেয়ে বুকের সাথে লেপ্টে আছে। মেয়েকেই বিচার দিচ্ছে।
– আম্মা শুনেন, বাবার দোষ নেই বুঝছেন। সবাই বাবাকে ভুল বুঝে। আপনি বাবাকে ভুল বুঝবেন না কখনো। আপনি আমার সব। আপনি ভুল বুঝলে বাবা ম*রে যাবো সেদিন।
মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ভাগ্যিস এই বাচ্চা বুঝেনা। বুঝলে সেও বাবাকে মাফ করতোনা। পরক্ষনে বললো,
– ও আম্মা শুনেন না, বাবার তো আপনার মায়ের মত সাহস আর ধৈর্য্য নেই বলেন। কি করবো ভুল তো করে ফেলেছি। আম্মাকে বলবেন মন থেকে মাফ করতে। খুব কষ্ট দিয়েছি কিন্তু কখনো কি অসম্মান করেছি বলেন? আপনারো কি এখন বাবাকে পাগল মনে হচ্ছে?
অনেক রাত হয়েছে। মেয়েটা অনেকক্ষন কিছু খায়নি। ছাদের দরজা খুলে নিচে নেমে এলো। বাসায় ঢুকতেই দেখে ড্রইং রুমে সবাই বসে আছে। মা ডাইনিং এ। সুলতানা ছেলের দিকে তাকিয়েই বুঝছে তার এত বুঝদার ছেলে আজ কেঁদেছে। ঠিক কতটা কাঁদলে ছেলেটার চোখ,মুখ সব ফোলা। কেউ কথা বাড়াচ্ছেনা। আফিয়া খালাকে ডেকে শেহজাকে ওর মায়ের কাছে দিতে বললো খাওয়ানোর জন্য। বেসিনে ভালো করে মুখ ধুয়ে বাবার কাছে বসলো। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আব্বু যা হয়েছে, হয়েছে। ছেলেকে আমি কাল বুঝিয়ে বলব। আমি আপাতত শেফালীকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিনা। ওর মত আছে কিনা জেনে নিবেন।
শেফালী পাশেই ছিলো। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– না ভাইজান। করবোনা বিয়ে।
– ঠিক আছে। লাইফটা নিজের মতো সেট করো।
শেফালীর মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমের কাছে গিয়ে থমকে গিয়েছে। দরজা আবজানো। একটু ঠেলে ঢুকলো। ভেবেছিলো রুমের অবস্থা খুব খারাপ থাকবে। কিন্তু না গুছানো সব। এই যে এই নাটক গুলোই মেজাজ খারাপ করে। সবাই অভিনয় করে যেন কিছুই হয়নি। দিয়া মেয়েকে খাওয়াচ্ছে খাটে বসে। শাহাদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামালো। শাহাদ ফ্রেশ হতে চলে গেলো ওয়াশ রুমে।
ধীর পায়ে দিয়ার পাশে বসলো। দিয়া মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,
– রাগ কমেছে।
বাধ্য বাচ্চার মত উপর নিচ মাথা ঝাকালো।দিয়া খোঁচা দিয়ে বলে,
– কেমন লাগলো আজ?
শব্দহীন। নিষ্পলক চেয়ে আছে সহধর্মিণীর পানে। দিয়া পুনরায় বললো,
– আমি দুবছর সহ্য করেছি।
– সময়কে তো আটকে দিতে পারবোনা।
– তাহলে পুনরায় অশান্তি করছেন কেনো? আর আটকালেও বা কি করতেন শুনি?
দিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শাহাদ। উঠে দাঁড়ায়, জানালার পাশে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কিছুই না।
– এমনভাবে বলছেন মনে হয় যেন রহস্য খুলবেন। খেয়েছেন?
– নাহ। খাবোনা।
– আপনি তো শেহজার চেয়েও বেশি বাচ্চামো করছেন।
– এমন কৃত্রিম আচরণ করার কারণ?
– তো কি করবো?
– যা আমার প্রাপ্য তাই করা উচিত।
– আমি পারিনা।
দাঁত খিচিয়ে বললো,
– এগুলো করেই তো মে*রেছো আমাকে।
– ডোন্ট লাই এমপি সাহেব। আমি আপনাকে কিভাবে মা*রলাম? কি চাচ্ছেন বলুন তো?
– শাস্তি দাও। তোমার এমন ভালো মানুষের মত ব্যবহার ভাবাচ্ছে আমায়।
– এটাই আপনার শাস্তি।
ক্রোধ ছড়িয়ে পড়েছে শাহাদের বদনজুড়ে। শেহজা ঘুমিয়েছে। দিয়া মেয়েকে শুইয়ে উঠে পড়লো। নিজে নিজেই বলছে,
– কি সুন্দর করে বেডরুমটা গুছিয়েছিলাম। সহ্য হলোনা কারো। সব প্রিয় ফ্লাওয়ার ভাস ভেঙ্গে দিয়েছে।
শাহাদ ঠোঁট উলটে বলে,
– নতুন এনে দিব।
– হাতটা এখনো আগের মতো?
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ড্রয়ার খুলে নিজেই ব্যান্ডেজ করে নিলো। দিয়া অন্যপাশে ফিরে ঠোঁট টিপে হেসে আবার মুখটা গোমড়া করে নিলো। মাথার চুল গুলো খুলে ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে আঁচড়ে নিচ্ছে। এমন সময় চোখ গেলো শাহাদের দিকে। মোহ নিয়ে দিয়ার দিকে চেয়ে আছে। দিয়ার মনে দুষ্টুমি খেললো। লাল গাউনে দিয়ার সৌন্দর্য্য আরো বেড়েছে। গায়ের ওড়নাটা একপাশে এনে চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে ঢিলা বেণীগাঁথলো। শাহাদের ধ্যান ভাঙানোর জন্য সেই অবস্থায় একদম ওর মুখের কাছে এসে বললো,
– কি সমস্যা?
হকচকিয়ে গেলো শাহাদ। আমতা আমতা করে বললো,
– কি ছু না।
দিয়ার সামনে থেকে সরে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বেডের একপাশে বসে আছে।
দিয়া আবার ওড়না ঘুরিয়ে শাহাদের সামনে এসে বলে,
– খেতে আসুন।
শাহাদ নজর সরিয়ে বলে,
– দূরে যাও। খাবোনা।
দিয়া ধমকে বলে,
– কি বললেন, এখনি খেতে আসুন।
শাহাদ দিয়ার আওয়াজে রেগে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
– অন্য কেউ হলে চোখ উপড়ে ফেলতাম।
দিয়াও না দমে উলটা ধমকে বলে,
– এখনো সাহস কমেনি? খেতে আসুন। ক্ষুধা পেয়েছে আমার।
দমে গেলো শাহাদ। তার লজ্জাবতী বউ সামনে এগিয়ে ডান পাশের গালে আলতো করে নরম হাত ছোঁয়ালো ,
– আমি অপেক্ষা করবো তাড়াতাড়ি আসুন।
হতবাক শাহাদ। সর্বনাশা মেয়ে। এই মেয়ে এভাবেই শেষ করবে। রুম থেকে বের হওয়ার আগে দিয়া ওড়না টেনে ঘোমটা দিলো। এই সুন্দর চিত্র দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটালো এমপি সাহেবের। পর মুহুর্তে মনে পড়লো এই মেয়েটা স্বাভাবিক আচরণ করছে আঘাত বাড়াবে বলে।
___
লিমন আর প্রফেসর দুজনই রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে আছে। লিমনের দিকে তাকিয়ে উনি বললেন,
– আমি অবাক হলাম লিমন তুমি এভাবে আমাকে কনভিন্স করলে! আমার খুব লজ্জা লেগেছে। শাহাদ সাহেবের কাছে কত ছোট হলাম।
– আপনাকে তো সত্যি বিয়ে করতে হবে না।এছাড়া শেফালী আপাও সুন্দর।
– শুনো ছেলে, এমন বিপদে পড়বো ভাবিনি। শেফালী নিঃসন্দেহে সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ইভেন আবিরকেও। কথা সেটা নয় তাহিকে রিজেক্ট করায় খারাপ লাগছে। কিসব বাহানা দিলাম আদো শাহাদ সাহেব বিশ্বাস করেছে কিনা আল্লাহ জানেন।
– আরেহ স্যার, চিন্তা করবেন না। শেফালী আপাকে বিয়ে দিবে না আমি জানি তাই ওদিকে চাল চেলেছি। আর ডাক্তার তাহি আমার।
– আল্লাহ তোমার সহায় হোন। পাগল হয়ে গিয়েছো। শাহাদ সাহেব শুনলে কি করবে বুঝতে পারছো?
লিমন হতাশ গলায় বললো,
– আমার কিছু হয়ে গেলে আমার আত্নার জন্য মাগফেরাত কামনা করবেন।
__
দিয়া শেফালীর রুমে বসে আছে। এদের একেক ভাইবোনের একেক অবস্থা। শেফালী চুপচাপ বসে আছে মাথা নত করে। দিয়া মুখ খুললো,
– হয়েছে কি আজ তোমাদের? তোমার ভাই আর তুমি মিলে কি শুরু করেছো?
– ও ভাবীজান মাফ করে দাওনা আমাকে।
শেফালী দিয়ার পায়ের কাছে বসে গেলো। দিয়া শেফালীকে সরিয়ে বুকে টেনে বললো,
– আপা মানুষ অনেক ভুল করে, তার মানে এই নয় যে জনে জনে শাস্তি দিতে হবে। তোমার শাস্তি তুমি পেয়েছো তো। তুমি এমন কেনো করছো? তোমার না হয় ভাইজানের মাথা ঠিক নেই তাই এমন করছে।
– আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে ভাইজান খুব রেগে আছে আমার উপর। প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেন না অনেক বছর। শিফা,ছোট ভাইয়া ভুল করলে শাসন করে, ভালো করলে আদর। আমার সাথে তো কথাই বলেনা। নিজেকে পর লাগে এই বাড়ির।
দিয়া নিজেও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। এমপি সাহেব শেফালীকে আদর ও করেন না, শাসন ও করেন না। শেষবার মেরেছিলেন ক্রোধ থেকে। শেফালীকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে।
রান্নাঘরে পা বাড়াতেই শ্বাশুড়ি হেসে বললো,
– বাবু ঠিক হয়েছে?
– হতে বাধ্য আম্মু।
– হয়েছে কি? বলা যাবে?
– আপনি আমারো মা। বলা যাবেনা কেনো? মাফ চাইছে আগের ভুলের জন্য? মাফ করেছি। সেটা নাকি ঠিকঠাক তার মনঃপূত হয়নি।
সুলতানা হা করে তাকিয়ে বলে,
– মাফ আবার মনঃপূর কিভাবে হয়? তবে আমারো প্রশ্ন এত সহজে মাফ করলে কেনো বৌমা?
– আম্মু আর কত এসব? উনি খারাপ ব্যবহার করেছে, আমি করবো এরপর। এসব করতে করতে একসময় বুড়ো হয়ে যাবো। সংসারটা আমার আর করা হবেনা। মানুষটা সুস্থ আছে। একটু ভালোবাসা পেতে চাই আমি। স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে চাই মেয়েটাকে।
এতটুকু বলেই দিয়া শ্বাশুড়িকে সাহায্য করতে লাগলো। সুলতানা কবির অপলক ছেলের বউকে দেখতে লাগলো। মনে মনেই বললো, একটা হীরা পছন্দ করেছে ছেলে। অথচ না বুঝেই কষ্ট দিয়েছিলো মেয়েটাকে। শাস্তি পাক তবে সহনীয়। আল্লাহ যেন দুজনের সম্পর্ক সুন্দর রাখে।
ডাইনিং এ খাবার রেখে ফ্রিজের কাছে গেলো। আইসক্রিমের বক্সটা দেখে মনে মনে বললো, আমার ও ভুল আছে। কখনো উনার কাছে গিয়ে মাফ চেয়েছি? সবাই বলবে উনি তো সেই সুযোগই দেন নি। আমি বলবো সুযোগ দিয়েছেন আমি বোকা ছিলাম,ভয় পেতাম।
হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাসায় ডাক্তার চলে এসেছে চেক আপের জন্য কেউ না বুঝলেও দিয়া স্পষ্ট বুঝতো। তখন মনে হতো দয়া, আজ জানে ওটাই ছিলো না বলা ভালোবাসা। মেডিসিন শেষ হওয়ার আগেই আফিয়া খালা মেডিসিন দিয়ে যেতো। রাতে বিরাতে যখন এটা সেটা খেতে মন চাইতো ফ্রিজ খুলে সবই পেতো। দিয়া ছাড়া এই বাড়িতে কেউ দই তেমন খায়না। অথচ প্রতিদিন নিত্য নতুন দইয়ের আইটেম ফ্রিজে থাকতো। শেফালীর সাথে আজো স্বাভাবিক হতে পারলোনা মানুষটা। শেফালীর করা প্রতিটি ব্যবহারের বিপরীতে শেফালী পেয়েছে ভাইজানের মনের সাথে ভীষণ দূরত্ব। মেয়েটা খুব অসহায়ত্বে ভোগে। সুযোগ সবার প্রাপ্য। ছোট থেকে শিখানো হয়েছে পাপকে ঘৃণা করো পাপী নয়। সেখানে এমপি সাহেব তো আপন মানুষ। তার উপর একটু ও রাগ নেইম তবে সে যেহেতু শাস্তি পেতে চাচ্ছে আগ বাড়িয়ে তাকে তাই দেওয়া হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে রুমে গিয়ে দেখে মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে। মন খারাপ করে লাইট নিভিয়ে বের হয়ে যাবে বলে পা বাড়াতেই গম্ভীর স্বর ভেসে এলো,
– অদ্ভুত শাস্তি দিচ্ছো বউ, না পারছি নিজেকে বোঝাতে না পারছি তোমার বুকে আশ্রয় নিতে।
দিয়া ঘাড় ঘুরাতেই, শাহাদ বেড সাইড ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে দিলো। সামনে এগিয়ে দিয়া শাহাদের পাশে বসলো। মানুষটা কেমন এলোমেলো। নরম তুলতুলে হাতে স্পর্শ করলো চুলগুলো। পাঁচ আঙ্গুলে বিলি কা*টছে। আবেশে অস্তমিত নেত্র।
– এত যত্ন করোনা। নিতে পারছিনা। প্রতি সেকেন্ডের বিট চেক করো,ভয় পেয়ে যাবে। কি করে করলে এমন আমাকে। তোমার স্বাভাবিক আচরণ আমার আজ অস্বাভাবিক লাগছে। একটু রাগ ঝাড়ো সোনা। প্লিইইইইজজ।
দিয়া হেসে বলে,
– শেফালী আপুর মন ভালোনা। আমি আজ রাতটা আপুর কাছে থাকব। আপনি মেয়েকে দেখে রাখবেন কেমন।
– না প্লিজ
চার্জ থেকে ফোন খুলে দিয়া শাহাদকে বিস্মিত রেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে গেলো। চরম হতভম্ব হয়ে শোয়া থেকে উঠে পড়লো শাহাদ। নিজেকে শান্ত করার একটাই পন্থা ছিলো। দিয়ার কাছাকাছি থাকা।অথচ মেয়েটা বুঝলোই না। তখনই রুমে সুলতানা কবির ঢুকলো। ছেলেকে এমন উদাসীন হয়ে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলো,
– বাবু শরীর খারাপ লাগছে?
মায়ের কথায় সৎবিৎ পেয়ে দু পাশে মাথা নাড়ায়। মাকে বসতে বললো। সুলতানা কবির বসেই হেসে বললো,
– তাহির সাথে কথা বললাম। আপাতত বাদ দাও ওদের বিয়ের চিন্তা। মেয়েগুলা যেমন চাইছে তেমন থাকতে দাও।
উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো শাহাদ। কিছু কথা বলে উঠে গেলো সুলতানা কবির। মা উঠে যাওয়ার পর শাহাদ আনমনে বিড়বিড় করলো,
– এই তাহলে শাস্তি।
___
‘সিক্স স্পাইডার’ দের কল কানেক্ট হয়েছে। একসাথে ছয় জনের চেহারা ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে৷ সবাই প্রয়োজনীয় ফাইল পত্র নিয়ে বসেছে। লিমন, শাহীন-পাভেলকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
– আমাকে অন্য কাজ দেও ভাইরা। এই কাজ আর পারবোনা।
বাকিরা ভ্রু কুচকে বললো,
– তুই সুস্থ আছিস? মেয়ে পটানো তো তোর প্রিয় কাজ।
– আগে ছিলো।
একসাথে সবাই বলে উঠলো,
– মানে?
– একজনের প্রতি লয়্যাল থাকতে চাই। আজ যে সিচুয়েশনে পড়েছি। আমি সিনেমাতে দেখেছি অথচ আজ নিজে ভিক্টিম ছিলাম। নায়িকা মোহনার চরিত্রে সমস্যা জানি তবে এই মহিলা যে এত খারাপ বুঝিনি। আরেকটু হলে আমি ভার্জিনিটি হা*রাতাম।
অকস্মাৎ অটঠাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। লিমন মুখটা ভোতার মত করে বললো,
– আসল কথায় আসো। রেদোয়ান জেঠুমনির সাথে মোহনার বিজনেস ছিলো। মোহনা মেয়ে পাচার সহ ড্রাগ ডিলিং এর বিজনেস করে। মোস্ট ইন্টারেস্টিং হচ্ছে সেখানে গিয়ে আমার হাম্মাদ মামার সাথে দেখা। আমি যে কারণে গিয়েছে মামাও একই কারণে গিয়েছে। আমি কি মামাকে কলে কানেক্ট করবো? মামা জানে আমাদের কথা।
নোমান জানতে চাইলো,
– তুই বলেছিস?
– আরেহ নাহ। সম্ভবত ভাইজান।
– আচ্ছা কর কানেক্ট।
হাম্মাদ মামা জয়েন হতেই সবাই সালাম দিলো। উনি কথা না পেঁচিয়ে সরাসরি বললো,
– হামি একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছি। মুরাদ সাফায়েত মজুমদার এবং আমিরা আপাকে হ*ত্যা করা হয়েছে জানোই। হত্যার জন্য দায়ী রেদোয়ান। হামার উম্মির কোহিনূর ছিলো টার্গেট। একমাত্র কোহিনূরই চিনে বর্ডারের রাস্তা যা দিয়ে সহজে ড্রা*গ ইন্ডিয়া ,চায়না এবং নেপাল পাঠাতে পারবে। মোহনা হচ্ছে এই বিজনেসের কুইন। মোহনার আরেকটা পরিচয় হচ্ছে রেদোয়ানের দ্বিতীয় স্ত্রী। যাকে রেদোয়ান আড়ালে রাখে। এখন এতসব কাহিনীর সাথে মুরাদ মজুমদারের সম্পর্ক হচ্ছে রেদোয়ানের খুব ভালো বন্ধু ছিলো মুরাদ। কোহিনূর বর্ডার চিনে ফেলেছিলো কারণ ওকে বর্ডার পার করেই এই দেশে আনা হয়েছিলো আমিরা আপার জন্য। কোহিনূর ট্রেইনড এবং স্মার্ট ব্রিড। আমিরা এবং হামার উম্মি দিয়ার সব কথাই সে বুঝে। তাই রেদোয়ান পুরো খবর ধামাচাপা দিতে মে*রে ফেলেছে আপা এবং মুরাদ ভাইজানকে। কোহিনূর যেহেতু দামী ব্রিড চেয়েছিলো নিজের কাছে রেখে আরো ব্রিড জন্ম করতে।এই কথা হামিদ মজুমদার জেনে গিয়েছিলো কারণ তাকে হামি জানিয়েছিলাম৷ তাই তিনি কোহিনূরকে সবার অগোচরে রেখে গিয়েছিলেন। হামি আসার পর কোহিনূরের মালকিনকে ফেরত দিই। এখনো উম্মি আর কোহিনূর কেউই সেফ না। শাহাদের জন্য পারছেনা কিছু করতে রেদোয়ান।
পুরোটা সময় সকলে স্তব্ধ ছিলো। শাহীনের মনে হলো জীবনটাই বৃথা। এত প্রিয় চাচার এই রূপ। ইনফরমেশন দিয়ে হাম্মাদ বিদায় নিলো।
হঠাৎ একটা সাসপিশাস কল আসছে অক্টোপাস নামের আইডি থেকে। সকলে ভয়ে আঁৎকে উঠলো। ইয়াজ ভয় পেয়ে বলে,
– ইয়া আল্লাহ কল ট্র্যাক্ড। এখন কল রিসিভ না করলে আমরা বিপদে পড়বো।
পাভেল বললো,
– এভ্রিওয়ান ওয়্যার মাস্ক।
সকলে মুখে মাস্ক দিলো। ইয়াজ কল রিসিভ করতেই অদ্ভুত গা শিহরণ করা গান কাজী নজরুল ইসলামের দূর্গম গিরি,কান্তার মরু ভেসে উঠলো। মিনিট কয়েকের মধ্যে দৃশ্যমান হলো। মাস্ক পরা একজন চেয়ারে বসে আছে। পরনে খুব সাধারণ একটা সাদা হুডি, কালো কালো ছাপ। পেছনের দেয়ালে একটা অক্টোপাসের ছবি। সকলের গলা শুকিয়ে কাঠ। রোবটের মত আওয়াজ করলো অক্টোপাসের ও পাশ থেকে,
– ওয়েলকাম, দিস ইজ অক্টোপাস। ‘সিক্স স্পাইডার’ ইউ আর ডুয়িং ওয়েল।
সবাই চুপ। তবে নিশ্চিত অক্টোপাসের নামের মানুষটা কোনো টেকনোলজি ব্যবহার করছে। সে নিজে কথা বলছেনা। তার স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে, সব রাজনৈতিক নেতাদের কুকীর্তি। কয়েকটা স্পেশাল খুনের আসামীর ডিটেইলস স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সবার মেইলে চলে যাচ্ছে। সকলে মেইল চেক করতে ব্যস্ত। সব বুঝিয়ে অক্টোপাস জানালো,
– রেদোয়ানের নামে মামলা দিবে।
নোমান মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
– ওকে চিফ।
চিফ শুনে বাকি তিনজন ভয় পেয়ে গেলো। তানভীর, লিমন এবং ইয়াজ। অক্টোপাস জানালো,
– আমি এই কেইসটা দীর্ঘ করতে চাইছিনা৷ তাড়াতাড়ি আমার কাজটা শেষ করতে হবে। তোমরা পারলে আমাকে হাতে নিতে হতোনা।
পাভেল উত্তর দিলো,
– স্যরি চিফ।
নোমান প্রশ্ন করলো,
– চিফ আপনি কি কন্টিনিউ করবেন?
সেই রোবট স্বরে উত্তর দিলো,
– অক্টোপাস অফিসিয়ালি দশ বছর আগেই শেষ। কন্টিনিউ করার কিছু নেই। আজকের মিটিং এ অক্টোপাস উপস্থিত হয়েছে মুরাদ মজুমদারের কেস ডিসমিস করতে। সব প্রমান দেয়া হলো। নাও ইট’স ইউর ডিউটি।
– ওকে চিফ।
আচমকা তানভীর বললো,
– চিফ আমরা তিনজন নতুন। আপনি আমাদের চিনেন না। আপনার অনেক গুনগান শুনেছি। আমাদের একটু দোয়া দিবেন।
সেই সাথে মাথা সমস্বরে বলে উঠলো ইয়াজ এবং লিমন,
– ইয়েস চিফ।
নোমান, পাভেল সাথে সাথে বললো,
– স্যরি চিফ। দে আর ইনফ্যান্ট।
আচমকা লিমন বলে উঠল,
– এই দেয়ালটা আমার পরিচিত…
ঠিক সেই মুহুর্তে অক্টোপাস মাস্ক খুলে ফেললো একটানে। ইয়াজের মনে হলো কেউ সপাটে গালে একটা চ*ড় মে*রেছে। লিমন দেখা মাত্র দু হাতে মুখ ঢেকেছে। তানভীরের ও একই দশা।
ইয়াজ আমতা আমতা করে বলব,
– আর ক র বো না বস….
___
ঘড়ির কাঁটা তিনটায় ঠেকেছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। টেবিলের বোতলটাতে পানি নেই। পাশে বউ নেই পানি থাকবে কি করে! উঠে ডাইনিং এর সামনে দাঁড়ালো। শেফালীর রুমে দরজা খোলা। অনুমতি ছাড়া কখনো কোনো বোনের রুমে প্রবেশ করেনি। অন্যদিকে হঠাৎ দিয়াকে দেখার জন্য মনের ভেতর ছটফটে ভাব তৈরি হয়েছে। মনকে শান্ত করতে চেয়েও পারলোনা।
করে ফেললো অন্যায়টা। বোনের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো মাঝখানে আবির আর সে দুপাশে দুই মাকে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। একপাশে মা,অন্য পাশে মামীমা। অন্য সময় হলে তুলে নিয়ে যেত। কিন্তু আজ মন সায় দিলোনা। দিয়া নিজেই যেহেতু দূরে থাকতে চাচ্ছে তাকে দূরে থাকতে দেয়া উচিত। ঘুরে গেলো দরজার দিকে, বের হওয়ার সময় রিনরিনে আওয়াজ এলো,
– ঘুমিয়ে পড়ুন। মেয়ে একা। আমি এখানে ঠিক আছি।
ঘাড় ঘোরাতেই স্বচ্ছ চোখে নজর দিলো অর্ধাঙ্গীনির দিকে। দিয়ার গলা শুনে শেফালী নড় চড়ে উঠলো। সামনে ভাইয়ের ছায়া দেখে লাফিয়ে উঠলো।
– ভাইজান কিছু লাগবে?
দিয়া শেফালীর দিকে না ফিরেই বললো,
– আপা শুয়ে পড়ো। কিছু লাগবেনা।
শাহাদ শান্ত স্বরে বোনকে বললো,
– শুয়ে পড়। শুভ রাত্রী।
শাহাদ বেরিয়ে যেতে যেতে চরম বিস্মিত হলো এই ভেবে যে, এই মেয়ের কি একটুও ভয় হলো না! কি করে সম্ভব। কিভাবে কাট কাট কথা বললো, ঘুমিয়ে পড়ুন। মনে হলো যেন আদেশ করছে। নাকি আমিই ফেসে গেলাম!
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৪০.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠেছে। বুক কাঁপছে এই অনর্থ আজই কেনো হতে হলো। আকাশের রূপ বদলেছে। মেঘের ঘনঘটা শুরু হচ্ছে। ছাদের চিলেকোঠায় আজ অমাবস্যা নেমেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। পাভেলের সামনে এখন সাক্ষাৎ যমরাজের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। পাভেলকে ইশারা দিলো পানি পান করার। গলাটা ভিজিয়ে পাভেল চুপচাপ খাটে বসলো। সরাসরি প্রশ্ন, কোনো বনিতা ছাড়াই,
– দোষটা কার?
কিছুক্ষন আগে শাহাদ উপরে এসে যা দেখার দেখে গিয়েছে। মধ্যরাতে একটা মেয়ে কখনোই সম্পর্ক ব্যতীত পর পুরুষের ঘরে আসবেনা। কিছুক্ষন আগে শিফা এসে পাভেলকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলো, সাথে নিজের হাতে বানানো পায়েশ খাওয়ালো। পাভেল আজ শিফাকে নিষেধ করেনি। নিজের শরীর ও ক্লান্ত, মেয়েটা কষ্ট করে বানিয়ে নিয়ে এসেছে বারণ করলে হয়তো কেঁদে দিত। এই পুরো ঘটনা শাহাদ লক্ষ্য করেছে ছাদে এসে। চুপচাপ দেখেছে। শিফা চলে যাওয়ার পর পাভেলের রুমে ঢুকেছে। শাহাদ নিজেই উপরে এসেছিলো পাভেলের উপহার দিতে। এছাড়া কিছু রাজনৈতিক আলোচনাও ছিলো। কিন্তু যা দেখলো তাতে সব ইচ্ছে দমে গেলো। পুনরায় প্রশ্ন করলো,
– দোষটা কার?
পাভেল কেঁপে উঠলো। সাথে সাথে উত্তর করলো,
– বস আমার।
– শিফা কেনো এসেছে এখানে? তুমি ডেকেছো?
পাভেল শাহাদের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গিয়েছে। কি উত্তর দিবে? নিজেকে আশ্বস্ত করলো। যা হওয়ার হবে, আগে ব্যাপারটা স্বাভাবিক করতে হবে। নোমান, শেফালীর পরিনতির কথা সবাই জানে। পাভেলের হঠাৎ মনে হলো আজকের পর সব পরিবর্তন হয়ে যাবে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হয়তো শিফাকে আর দেখতে পাবেনা।
শাহাদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– গো ব্যাক টু ইউর ফ্ল্যাট। ইফ নিডেড আই উইল কল। ওকে?
– বস?
শাহাদ ঘুরে দাঁড়িয়ে সরাসরি পাভেলের চোখের দিকে তাকালো। পাভেল শাহাদের চোখ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছে। সাথে সাথে নিজের চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলে বললো,
– ঠিক আছে বস।
আর কিছু বলার সাহস হয়নি। শাহাদ নেমে এলো নিচে। শাহাদের মনে প্রশ্ন ঘুরছে, দোষটা কার? পর মুহূর্তে মনে হলো, দোষটা তার। সুযোগটা শাহাদের কাছ থেকেই পেয়েছে সবাই। ব্যালকনিতে এসে চুপটি করে বসে আছে।
পাশে চেয়ার টানার শব্দে ঘুরে তাকালো। নিস্তব্ধ রজনীতে এই শব্দটাও ভয়ানক লাগছে। দিয়া পাশে বসেই বললো,
– জানিনা আপনার মাঝে কি চলছে। তবে এতটুকু বলতে পারি আপনি নিজের মধ্যে নেই। কি হয়েছে?
– ঘুমাওনি কেনো?
– আসছেনা।
– ইদানীং শূন্যতা অনুভব করি, রাশেদকে মনে পড়ে। সব সামলে নিতে যেয়ে ক্লান্ত আমি। সবই স্বাভাবিক এরপর ও অস্বাভাবিক।
দিয়া উঠে দাঁড়িয়ে রজনীগন্ধা গাছটার কাছে গিয়ে বললো,
– আমি আপনাকে মন থেকে মাফ করে দিয়েছি এমপি সাহেব। ভালোবেসে সংসারটা সামলাতে চাই কিন্তু আপনি যা চাইছেন ওটা পেতে যে সত্যি সময় লাগবে।
– কতদিন?
দিয়া হেসে বলে,
– বছর, দিন নয়।
মাথা নত শাহাদ। চক্ষুস্থির মেঝেতে। দিয়া পুনরায় বললো,
– আমার তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা।
শাহাদ মুচকি হেসে জোরেই বললো,
-ফ্যান্টাস্টিক।
দিয়া নিশ্চুপ। নিজেকে দমিয়ে আনত স্বরে পুনরায় বললো,
– ফারাহ্…
– জ্বি।
– ধন্যবাদ। এখন বুঝতে পারছি। পরীক্ষা কখন?
– বাইশ তারিখ থেকে।
– কখন যেতে চাও?
– আব্বু-আম্মুকে বলেছি। আগামীকাল যেতে চাচ্ছি।
– আমি এখন জানলাম!
আবারো নিরবতা।
– যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
বারান্দা থেকে রুমে ঢুকে গেলো। দিয়া বারান্দার দরজা আটকে রুম থেকে বের হওয়ার সময় শাহাদ বলে উঠলো,
– এভাবে মাফ না করে কাছে থেকে আরো কঠিন শাস্তি দিলেও সয়ে নিতাম। দু বছর যতটুকু আঘাত দিয়েছি, তার চেয়ে আশঙ্কাময় হবে আমার আগামী দিনগুলো।
আর কথা বাড়ানো হয়নি। দিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমে চলে গেলো। এই রুমটা তার বড্ড প্রিয়। কষ্টের দিনগুলোর সাক্ষী। চোখের পানির স্বাক্ষী।সংসারটা দিয়া করবেই। তবে সব গুছিয়ে। এত ঝামেলার মাঝে নিজেকে গুছানো হয়নি। গত পরশু চাচাজান ফোন দিয়ে জানিয়েছে পরীক্ষার কথা। মজুমদার বাড়ির পরিবেশ আগের তুলনায় স্বাভাবিক। কল্পনা,মঈন এবং তমা চাচী প্রতিটি মানুষ অধীর আগ্রহে থাকে দিয়ার জন্য। তমা চাচীও এখন দমে গিয়েছে। কল্পনার বিয়ে হয়েছে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শ্বাশুড়ির অত্যাচার সইতে না পেরে বাবার বাড়ি থাকে। ছয়মাসের একটা মেয়ে আছে। স্বামী বিদেশ থাকে। স্বামীর নির্দেশেই বাবার বাড়ি থাকছে। দূরত্বটা হয়তো পরীক্ষা অবধি সবাই ভেবে নিচ্ছে, এই দূরত্ব বেশ সময়ের। এছাড়াও কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়ে গিয়েছে যা এতদিন ভুল জেনে এসেছে। মজুমদার বাড়ির দেয়াল জানে সেসব গল্প, বাবাজানের গড়ে তোলা দিয়ার প্রিয় খামার বাড়ির দরজা খুলবে এবার। কি আছে সেই বাড়ির প্রাঙ্গনে। সেদিন রাতেই বুঝতে পেরেছিলো শাহাদ ইমরোজ কিছু একটা লুকাচ্ছে। এম সাফায়েত যে বাবাজানের নাম সে কথা দিয়া জানে। হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একা শাহাদকে রেখে যাবে, মনি যদি পুনরায় কু-দৃষ্টি দেয়। নিজেকে আশ্বস্ত করে ভাবলো, তবে তাই হবে দিয়ার ভবিতব্য। মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, আল্লাহ যা করেন সব ভালো করেন।
___
সকালটা বিষন্ন। সারা রাত গগন কাঁপিয়ে বজ্রপাত, মুষলধারে বৃষ্টি, মাটিতে সোধা গন্ধ৷ আজ নাস্তার টেবিল শান্ত। টুকটাক চামচের আওয়াজ। শেহজা লেপ্টে আছে বাবার বুকে৷ একটু করে মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে। রায়হান সাহেব এর মাঝে দিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
– বৌমা পরীক্ষা শেষ কবে?
দিয়া আবিরকে খাওয়াতে খাওয়াতে উত্তর দিলো,
– আব্বু ভাইভা সহ শেষ হতে দু মাস লাগতে পারে।
– আচ্ছা। শেফালীকে নিয়ে যাবে সাথে? ওখানে মঈন বা তমা ভাবী কি একা সামলাতে পারবে?
– সমস্যা নেই। কল্পনা আপু আছে। এছাড়া ওই বাড়িতে তো কাজ গুছানোর অনেক মানুষ আছে। শেফালী আপু বেড়াতে চাইলে যেতে পারে। কিন্তু আবিরের যে স্কুল আছে।
শাহাদ বলে উঠলো,
– শেফালী যাওয়ার দরকার নেই৷ আমি যাবো।
দিয়া তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,
– আপনার অনেক কাজ যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
কতটা সূক্ষ্মভাবে প্রত্যাখ্যান করলো প্রস্তাব। সুলতানা কবির কিছুটা আঁচ করলেন ব্যাপারটা। তিনিও চান ছেলে আর তার বউ ব্যাপারটা নিজেরা মিটিয়ে নিক। তাই রায়হান সাহেব কথা বলার আগেই নিজেই বলে উঠলেন,
– বাবু তুমি গেলে বৌমার পড়া হবেনা। এখানে থেকে সারা বছর পড়তে পারেনা। আমার দাদুপাকে সামলানোর জন্য তমা ভাবী, কল্পনা আছে। আদরে আদরে থাকবে ওরা৷ প্রয়োজন হলে আমি যাব। তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
শাহাদ মায়ের চোখের ভাষা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। এই চোখের ভাষাই বলে দিচ্ছে আজ মা দিয়াকে সাপোর্ট করছে। শাহাদ মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। শিফা প্রশ্ন করলো,
– ভাবীজান কখন বের হবেন?
– এইতো কিছুক্ষন পর।
এরপর সবাই টুকটাক কথা বলছে। এর মাঝে শাহাদ বললো,
– ফারাহ্ বিকেলে যাও। আমি মিটিং টা শেষ করে আসি।
– সমস্যা নেই। চাচাজান আসছে গাড়িতে। চলে যেতে পারবো আমি। আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ।
শাহাদ আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েকে নিয়ে। দরজার সামনে এগিয়ে গেলো, মেয়েকে আদর করে বুকের সাথে চেপে ধরে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি নিজেও জানো না ফারাহ্ কি ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছো আমার কাছ থেকে। এমনভাবে দ্বিধায় ফেললে ওই বাড়িতেও আমি যেতে পারবোনা। সুস্থ মস্তিষ্কে দেয়াল তুলে দিলে।
– আপনাকে তো আমি যেতে বারণ করিনি।
– যে দেয়াল তুলেছো আমার কাছে ভাঙ্গার অ/স্ত্র নেই।
মেয়েকে কোলে দিয়ে বেরিয়ে যাবে এমন সময় শিফা ছাদ থেকে নামছে মুখ কালো করে। বিষন্নতার ছাপ মুখ জুড়ে। শাহাদ গলা ভারী করে বললো,
– এখন কি কাজে ছাদে গিয়েছো?
ভয় পেয়ে গিয়েছে শাহাদকে দেখে। ভীত ভাব নিয়ে উত্তর দিলো,
– না মানে ভাইজান। এমনি।
– যাও পড়তে বসো।
শাহাদ পা বাড়াবে এমন সময় শিফা প্রশ্ন করলো,
– ভাইজান আজ তো কোচিং আছে বিকেলে।
– হুম তো?
– আমাকে তো পাভেল ভাই নিয়ে আসে প্রতিদিন। উনি তো নেই বাসায়…
– গাড়ি পাঠিয়ে দিব। আজ থেকে ড্রাইভার দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে। পাবলিক বাসে চড়তে পারো আমি জানি। এখন আপাতত প্রয়োজন নেই। রুমে যাও।
বেরিয়ে গেলো শাহাদ। দিয়া সব শুনছে এতক্ষন। শিফার চেহারায় মলিনতা দেখে মনে হলো কিছু ব্যাপার আছে।
___
গাড়ি চলছে মজুমদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। শেহজা মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছে। আসার সময় বুঝেনি কি ফেলে আসছে। দিয়াদের গাড়ি বেরিয়েছে সাড়ে এগারোটার দিকে।
শাহাদ মিটিং পোস্ট পন্ড করে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে পুনরায় বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। বাড়ির গেটে গাড়ি প্রবেশ করতেই ডোর খুলে ছুটে বেরিয়ে গেলো। উপরে সিড়ির কাছে দৌঁড়ে উঠলো। দরজা খোলা থাকাতে ভেতরে ঢুকেই দেখলো লিভিং রুমে সবাই বসে আছে। সুলতানা কবিরের চোখে পানি৷ আঁচলে চোখ মুছে সামনে আগাতেই ছেলেকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো,
– বাবু, কখন আসছো বাবা?
– আম্মু ওরা চলে গিয়েছে?
– হ্যাঁ এই মাত্র।
– শেহজা আমাকে খুঁজে নি?
– প্রথমে বুঝে নাই কোথায় যাচ্ছে। গাড়িতে উঠে ছটফট শুরু করে দিয়েছে বাবা,বাবা করে।
শাহাদ মাথা ঝাঁকালো। বিনা বাক্য ব্যয়ে বেরিয়ে এলো পুনরায়। রওয়ানা দিলো অফিসের দিকে। মেয়েটাকে দেখার জন্য ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। দিয়াকে ফোন দিলো। ফোন রিসিভ হলোনা। পুনরায় দিলো। তবুও রিসিভ হলোনা। আর পারলো না নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। সিটে মাথা এলিয়ে কপালে হাত রেখেই চোখ বন্ধ করলো। গড়িয়ে পড়লো অশ্রু দু চোখ বেয়ে। মনে মনে একটাই কথা বললো,
– ফারাহ্, এভাবে কষ্ট দিচ্ছো? আমার কাছ থেকে মা – মেয়ে দুজনই দূরে সরে গেলে? আমি কিভাবে থাকবো তোমাদের ছাড়া।
পথের দূরত্বটা কিছুই নয়। কিন্তু মনের দূরত্ব! শাহাদের মনে হলো দিয়ার স্পেস প্রয়োজন। নিজেকে সংযত করা প্রয়োজন।
___
হন্তদন্ত করে প্রতিটি মানুষ উপস্থিত হয়েছে হাসপাতালে। একেক দিক থেকে একেকজন ছুটে এসেছে। রক্তের প্রয়োজন। কোনো রকম প্রোটেকশন ছাড়াই ছুটে এসেছে সব ফেলে শাহাদ। দু ব্যাগ র*ক্ত দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। শরীর একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। এত বিপদ।এত ঝড়-ঝাপটা আর শরীর সইছে না। পাভেল হাসপাতালের সব ফরমালিটিস পূরন করেছে। এখানে কেউই এতটা অসতর্ক নয় যে এত বড় এক্সিডেন্ট ঘটে যাবে। ছেলেটা আই সি ইউতে। শাহাদ ইয়াজের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই ইয়াজ শাহাদের পা জড়িয়ে বললো,
– বস আমি লিমনকে ইনফোরমেশন দেয়ার আগেই ও বেরিয়ে পড়ে৷ বাইক নিয়ে বেরিয়ে ছিলো। যখন তিনশ ফিট পেরিয়ে গেলো একটা গাড়ি ওকে ফলো করছিলো। ও শুধু ফোনে এতটুকুই বলেছিলো, ইয়াজ ভাইয়া আমাকে ফলো করছে, দশজনের মতো। হাতে ধারালো দেশীয় অস্ত্র। ভাইজানকে খবর দিও চাচাজানের লোক এরা। আমি এদের মধ্যে একজনকে চাচাজানের বাসায় দেখেছি। এরপর লাইন ছুটে যায়।
পাভেল কাছে এসে বললো,
– চাচাজান কেনো এমনটা করবে?
শাহাদ শান্ত স্বরে বললো,
– তুলে নিয়ে আয় পাখিকে।
ইয়াজ এবং পাভেল ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বস বলছে এই কথা? পাভেল পুনরায় বললো,
– বস, আপনি শ্যুর?
– ততক্ষন খাতির করবি যতক্ষন মুখ দিয়ে আসল কথা বের না করে, আমার লিমনের প্রতি ফোঁটা রক্তের মূল্য আমি চুকাবো। কাউকে কোনো নিউজ দেয়ার প্রয়োজন নেই।
– জ্বি বস।
তাহি ছুটে এসেছে শাহাদের ফোন পেয়ে। শাহাদ তাহিকে বললো,
– আমাকে হেল্প কর। ওকে এখানে দেখার মত আপাতত কেউ নেই। চাচী আম্মুর অবস্থা জানিস। একজন নারীর সেবা দরকার।
– ভাইজান ও কেমন আছে?
– বুঝতে পারছিনা। আল্লাহ রহম করুক। মাথা, বুকে লেগেছে। বুকে অনেক গুলো স্টিচ পড়েছে।
– বুকে কি করে লাগলো?
শাহাদ নিরব। বুকে যে দাগ ওটা কোপানোর দাগ। তাহি একপাশে বসলো।
ইয়াজ এবং পাভেল মিলে ডাক্তারকে কনভিন্স করেছে। পুলিশ কেস হওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো। সিচুয়েশন শান্ত করতে অনেকটা সময় লেগেছে। পাভেলকে আড়ালে নিয়ে গেলো।
– জ্বি বস।
– তোমার ম্যাডামের জন্য ওই বাড়িতে নিরাপত্তার কি অবস্থা?
– বাড়ি অলরেডি সেফ আছে। ভেতরে তিনজন আছে। বাইরেও বেশ কয়েকজন আছে।
– তুমিও সাবধানে থেকো।
শাহাদ সামনে থেকে চলে গেলো। পাভেল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবলো, ভাইজান সাবধানে তো থাকতেই হবে। আমার ঘরে- বাইরে সব জায়গায় বিপদ। তাই তো কোনো রকম প্রতিবাদ না করেই আপনার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম। জানালাম না ছোট মেয়েটাকে। বুঝতে দিলাম না যে, আর কখনো ওই বাড়ির চিলেকোঠা টা পাভেলের হবে না।
___
টিভিতে নতুন হেডলাইন
“নায়িকা মোহনা মিশু কিডন্যাপড।
বিকেল চারটার দিকে দূর্বৃত্তরা তার বাড়িতে এসে তুলে নিয়ে গেলো।
-পদ্মা টিভি।”
“মোহনা মিশুর মুক্তির জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে শিল্পী গোষ্ঠী। চারদিকে গুজবে ভরপুর। তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ে মোহনার আসল ইতিহাস।
– বাংলা নিউজ।”
প্রতিটি খবরের চ্যানেল ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই নিউজ। শাহাদ এলইডি স্ক্রিনে তাকিয়ে কুটিল একটা হাসি দিলো।
চলবে…