সায়রে গর্জন পর্ব-৪+৫

0
3

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৪.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা নাচে আলো নাচে ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে– বাজে আলো বাজে ও ভাই হৃদয়বীণার মাঝে–

জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা॥
আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।

মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা–
পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি–
সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা॥

রাতগুলো কাটে গভীর নিঃসঙ্গতায়। কখন ফুরাবে এই বিষাদের দিন গুলি। কখনো সরাসরি নিষেধ করা হয়নি এই মেয়েকে, এভাবে রাতে বারান্দায় গান না করার জন্য। শুধু কি শাহাদের কানেই বাজে নাকি বাকিরা শুণেও চুপচাপ থাকে! বারান্দা থেকে সোজা রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে মেয়ের পাশে এসে শুয়ে পড়ে। গানের প্রতিটি শব্দ কানে বাজে। শাহাদ উঠে গেলো বিছানা ছেড়ে। মেয়ের গায়ের আশপাশের বালিশ সরিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে দোলনায় শুইয়ে উঠে দাঁড়ায়। সোজা পা ফেলে সুইমিং এর উদ্দেশ্যে। নিচে পুলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় গান ভেসে আসা বারান্দার পানে। বরাবরের মতো হাতে একটা বই, পরনে নীল রঙা সুতি শাড়ি, দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে গাইছে আরাধ্য গান। এত আয়োজন নিয়ে বসতে হয় কেনো গান গাইতে! এই মেয়ের প্রতিটি কাজে আভিজাত্যের ছোঁয়া। অথচ নিষিদ্ধ হালাল এই মেয়ে। হারাম নিষিদ্ধ হলেও নিষিদ্ধ হালাল বড্ড অপরিচিত শব্দ৷ চোখ ধাঁধানো রুপে মাঝে মাঝে হেরে যায় শাহাদের ভেতরের পৌরষত্ব। শত হোক পুরুষ মানুষ। আকর্ষণ থাকবেই। কাবু করাটাই তো শিংহের পরিচয়। দু চোখ বুজে লাফ দেয় পুলের পানিতে। ধপাস করে উঠে পানি। আচমকা এমন শব্দে থেমে যায় গান। দোতলা থেকে পানির উৎসের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মানুষটা সুইমিংপুলে অস্বাভাবিকভাবে সাঁতরাচ্ছে। এ যেন আত্ন-সংযত করার অগ্নি পরীক্ষা। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে রমনী। ঢোক গিলে আঁৎকে উঠে ছুটে যায় নিজের কামরায়। বুক কাঁপছে। তবে কি এবার গানেও নিষেধাজ্ঞা জারি করবে! এত রাতে নিরবে নিভৃতে গাওয়া গানও কর্ণগোচর হলোনা। এবার গানের স্বাধীনতার পায়েও বুঝি বাঁধলো বেড়ি!

___

কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছে শেহজার।উঠেই কাঁদছে। ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে পাঁচটা চল্লিশ। ফজরের নামাজ মিস হয়ে গেলো। শাহাদ উঠে মেয়েকে কোলে নিলো। ঘুম ঘুম চোখে বুঝতে পারছেনা মেয়ে কাঁদছে কেনো। আচমকা দরজায় নক করার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখে সুলতানা কবির। মাকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে। মাকে বলে উঠলো,

– আম্মু শেহজা কাঁদছে কেনো? আমি বুঝতে পারছিনা।

সুলতানা কবির খাটে বসে নাতনীর ডায়াপার চেঞ্জ করতে করতে বললো,

– বাবা হওয়া সহজ, মা হওয়া সহজ নয়। বাবারা সন্তানের সরাসরি দায়িত্ব পালন করে কিছু সময়ের জন্য, অথচ মায়েরা করে সারাদিন। শেহজার মায়ের বয়স টাও খুব কম। ভুল মানুষই করে। আমি জানিনা কি এমন ভুল করেছে মেয়েটা যার দরুন এত বড় শাস্তি দিচ্ছ। জানো বাবু,আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিলো তেইশ আর তোমার বাবার পঁয়ত্রিশ। উনি আমাকে নিজ হাতে সামলে নিয়েছিলো। তুমি হওয়ার পর শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েছিলো।কত রাত আমার সাথে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে তোমার বাবা। আমি সেই ঋণ কখনোই শোধ করতে পারবোনা। সাধারণত বাচ্চারা দুই তিন বছর জালাবে। এই সময়টা মায়েদের অনেক কষ্টে সামলাতে হয়।মাথার উপর একটা বটবৃক্ষ লাগে। আমার যেমন তোমার বাবা ছিলো। তুমি কি কারো বটবৃক্ষ হতে পেরেছো বাবু! তোমার বয়স আটত্রিশ বছর। আর দিয়ার মাত্র বাইশ। তোমার বিয়ে যদি ওর বয়সে হতো তোমার ঠিক বড় একটা মেয়ে থাকতো। আজ শেহজার গালে চড়ের দাগ দেখে তুমি বাড়ি মাথায় তুললে।মেয়ের কষ্ট সহ্য হলোনা তোমার। তবে দিয়া কি কোনো বাবার মেয়ে নয়? বাবা নেই বলে ওকে কষ্ট সহ্য করতে হবে! গত দু বছরে একবার জিজ্ঞেস করেছো মেয়েটা ভালো আছে কিনা! খাওয়া দাওয়া করে কিনা। ওর প্রেগন্যান্সির সময় তোমাকে ওর বড্ড প্রয়োজন ছিলো। অথচ পায়নি। তুমি বুঝতেও পারছোনা ছোট্ট মেয়েটার হেসে খেলে পার করার বয়সে ওর কোলে জীবন্ত একটা বাচ্চা। সংসার কি বুঝে উঠার আগেই মা,স্ত্রী,ছেলের বউ হয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে একটু বুঝে নিও। আমি শেহজাকে নিয়ে যাচ্ছি। ফিডিং করাতে হবে। এত বড় বেডরুমের প্রয়োজন নেই তোমার যদি সেখানে রাজ করার মত রানী না থাকে। তোমার কি কখনোই মনে হয় নি রুমটা খালি?

মা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে চলে গেলো। নিরবতা পালন করে রইলো। এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই তার কাছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর ছয়টা। এখন আর ঘুম হবে না। উঠে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে গিয়ে ওযূ করে আসে। সালাত আদায় করে জগিং স্যুট পরে বের হলো। প্রকৃতি যদি অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারে! যদি পাড় ভাঙা নদীর একটি গতিপথ হতো! একেবারে বিলীন হবে নতুবা নতুন জায়গা নতুন পলিমাটি জেগে উঠবে৷ আগের মত সেই নদী আর থাকবেনা।

প্রাতঃকালীন ব্যায়াম সেরে রুমের পাশে নিজের ব্যক্তিগত জিমে গিয়ে কয়েকটা পুষ আপ দিলো এবং ট্রেডমিলে কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করলো। রুমে এসে সাদা পাঞ্জাবীতে নিজেকে পুনরায় সাজিয়ে নিলো। ডাইনিং এ সবাই খেতে বসেছে। শাহাদ আজ সবজি মুখে দিয়েই মুখ কুঁচকে গিলে নিলো। শরবত মুখে দিতেই চিনির পরিমান অনেক বেশি, ডিম মুখে দিতেই কুসুম একেবারে কাঁচা রেখে দিয়েছে সিদ্ধ হয়নি।
শাহাদ চুপচাপ বসে আছে কিছুই বলছে না। শেফালী মুখে দিতেই বলো,

– আজকের খাবার এমন অদ্ভুত কেনো? মহারানী কি তরকারি রাঁধতে ও ভুলে গেলো।

শিফা রেগেই উত্তর করলো,

– আব্বু স্যরি মাফ করবেন, জোরে কথা বলার জন্য৷ বড় ভাবীর জ্বর একশ তিনের উপরে। বেচারী সকাল থেকে বমি করছে। আম্মু,আমি অনেক কষ্টে মাথায় পানি দিয়েছে। চোখ অবধি মেলতে পারছেনা। তুমি এত অকৃতজ্ঞ কেনো আপা! ভাবীর সাথে সব সময় এমন করো। আজাইরা বসে অন্ন ধ্বংস না করে মাঝে মাঝে তো রান্নাঘরে যেতে পারো।

শেফালী চেতে উঠে বললো,

– যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা,আমার বাপের অন্ন আমি ধ্বংস করছি তোর কি? তুই ইদানীং বেশি ভাবী ভাবী করছিস না।

শাহাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। শেফালী আর শিফা দুজনের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছেড়ে বললো,

– এটিই প্রথম এবং এটিই শেষ। পরবর্তীতে আমি খাবার টেবিলে যদি এভাবে ঝগড়া করতে দেখেছি এই বাড়িতে ডাইনিং টেবিলের এক্সিসটেন্সই রাখবোনা।

সকাল বেলা ধমক খেয়ে প্রতিটি প্রানী নিরব।রায়হান সাহেব খুব খুশি হলেন। শেফালী বড্ড বাড় বেড়েছে। উনি সন্তানদের বকা দেয়া পছন্দ করেন না তাই নিজেকে সংযত রাখেন। এর মাঝে গুটি গুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো দিয়া। সুলতানা কবির উঠে গিয়ে ধরতে ধরতে বললো,

– আজ উঠতে গেলে কেনো মা, আমি তোমার রুমে নাস্তা নিয়ে আসতাম।

দূর্বল গলায় ধীর স্বরে বললো,

– আমি ঠিক আছি আম্মু, সবার নাস্তা শেষ? আমাকে একটু আগে জাগাতেন। আমি তো কিছু বানাতেও পারলাম না।

শাহাদ একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো। এক রাতেই এত পরিবর্তন। চোখ মুখ সব ফুলে গিয়েছে। শরীরে প্রাণের সঞ্চার নেই বললেই চলে। কিসের জন্য এমন করছে। জ্বর হয়েছে ডাক্তার দেখাবে তা না করে ঘরে বসে আছে কেনো! দিয়া লক্ষ্য করলো টেবিলের খাবার গুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। একটু এগিয়ে আসে। দেখতে পেলো কেউ কিছুই খায়নি। আজ ছুটা কাজের বুয়া আর আফিয়া খালা মিলে রেঁধেছে।

শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে বললো,

– আম্মু,আব্বু আপনাদের তো ঔষধ আছে। আপনারা বসুন। দশ মিনিটের মধ্যে আমি বানিয়ে নিয়ে আসছি।

রায়হান সাহেব বললেন,

– ব্যস্ত হয়ো না তো মা, তুমি খেয়ে নাও। সুলতানা দিয়াকে কিছু বানিয়ে ঔষধ খাইয়ে দাও। ওর জ্বর কমেছে কিনা দেখো না কমলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।

সুলতানা গায়ে হাত দিয়ে দেখলো গায়ে এখনো জ্বর। শাহাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আম্মু আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিব নিয়ে যাবেন ডাক্তার কাছে।

কথা শেষ করেই বেরিয়ে গেলো শাহাদ। গাড়ি পাঠাবে বললো! দিয়া কি ঠিক শুনলো! নিজের গাড়িটা কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। মেরুন রঙা ছাদ খোলা গাড়িটাতে বসা সুলতানা এবং রায়হান সাহেব ছাড়া এই বাড়ির কোনো প্রাণীর নসিব হয়নি। আজ মানুষটা দিয়ার জন্য গাড়ি পাঠাবে বলল! এই কেয়ার টুকু টান ছিলো নাকি দয়া?
___

বিকেলে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। ডাক্তার জানিয়েছে ভাইরাল ফিভার। ঠান্ডা লাগানোর ফলে এসব হয়েছে। শেহজাকে ও মেডিসিন দিয়েছে। মায়ের অসুস্থতা মেয়ের উপর প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। বাড়িতে অনুষ্ঠান। রায়হান সাহেবের ছোট বোন আসছে নেদারল্যান্ড থেকে। তিনি ছেলেকে বিয়ে করাতে চান বাংলাদেশে। মেয়েও দেখেছেন। মেয়ের পরিবার বাংলাদেশে থাকে। বিয়ে আগামী সপ্তাহে।রায়হান সাহেব চাচ্ছেন বোনের ছেলের বিয়ে এই বাসা থেকেই দিতে। বোনের এই কূল,সেই কূলের মধ্যে অভিভাবক এখন রায়হান সাহেবই আছেন। শাহাদ গিয়েছে রিসিভ করে নিয়ে আসতে। কলিং বেল বেজে উঠলো। শিফা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ফুফু মঞ্জিলা, উনার ছেলে নিশাদ এবং মেয়ে নিশি এসেছে। রুমে ঢুকতেই সবাই অভ্যর্থনা জানালো। পেছনে শাহাদ ও আছে। সোফায় বসে সকলে কুশল বিনিময় করছে। মঞ্জিলা দিয়ার খোঁজ করে বললো,

– ভাবী বড় বৌ কই? বিয়ের সময় ও তো আমি আসতে পারলাম না।

– শিফা তোর বড় ভাবীকে ডেকে আন। আসলে মঞ্জিলা, বউয়ের জ্বর। অসুস্থ মেয়েটা।

– ওমা হঠাৎ,বাড়িতে অনুষ্ঠান। ওর কত দায়িত্ব। বংশের বড় বউ।

– ঠান্ডা লাগছে, ভাইরাল ফিভার। ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করোনা।

সবার কথার মাঝেই দিয়া, শিফা রুমে প্রবেশ করলো। দিয়ার কোলে ছোট্ট শেহজা। বাবাকে দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে। এতক্ষন ফোনে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো। অনেক গুলো মেইল এসেছে। সেগুলোই চেক করছিলো। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই শেহজা বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। শাহাদ গাঢ় করে মেয়ের দু গালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মঞ্জিলা অবাক হয়ে দেখছে। দিয়াকে দেখে বলেই ফেললো,

– ওমা বউ তো আমাদের শিফা থেকেও ছোট।

শিফা হেসে বলে,

– একদম সেরকম লাগছেনা? আসলে ভাবী আমার বড়।

নিশাদ কেমন অদ্ভুত ভাবে দেখছে। দিয়া সেই চাহনীতে কিছুটা বিচলিত হলো। শাহাদ এর মাঝেই বলে উঠলো,

– আম্মু শেহজাকে ডাক্তার কি বলেছে?

– শেহজার মেডিসিন দিয়েছে। টেস্ট দিয়েছে কিছু। দু একদিনের মধ্যেই করাতে বলেছে। ওর আসল মেডিসিন হলো ওর মা। মা সুস্থ থাকলে ইনশাআল্লাহ মেয়ে ও সুস্থ থাকবে।

সারাক্ষন দুষ্টুমি করবে কিন্তু বাবাকে পেলে এই মেয়ে দুষ্টুমি কি সেটাই ভুলে যায়। এই যে এত সুন্দর করে চুপটি মে/রে বাবার কোলে বসে আছে। মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠে বাবার দুষ্টুমিতে। শাহাদ মেয়েকে কাতকুতু দেয় আর মেয়ে হাসে। শাহাদ উঠে দাঁড়ায়।মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে যাবে। গায়ের পাঞ্জাবি বদলে নিতে হবে। সারাদিন অনেক দৌঁড়ঝাপ করেছে গোসল করে চেঞ্জ করা প্রয়োজন। ফুফুর এবং কাজিনদের উদ্দেশ্যে বললো,

– তোমরা বসো আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।

নিশি বললো,

– ভাইজান, বাবুকে দিয়ে যান।

– পরে নিও এখন আমার আর প্রিন্সেস এর পারসোনাল টাইম।

শাহাদ চলে গেলো নিজের রুমে। দিয়া সোফায় বসে কথা বলছে ফুফুদের সাথে। শিফা,শেফালী,নিশি এবং নিশাদ নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি করছিলো। কথার মাঝে নিশাদ দিয়াকে বললো,

– ভাবীজান আপনার রুপের রহস্য কি বলুন তো! বিয়ের পর আমার বউটাকে টিপস দিবেন।

উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো। দিয়া বিব্রত বোধ করে কিঞ্চিৎ হাসলো। শিফা নিশাদকে বলে,

– ভাইয়া, ভাবীজান আর ডেকোনা। বড় ভাইজান শুনলে রাগ করবে। ভাবীমা ডাকো।

– বড় ভাইজান কি ডাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে?

শেফালী মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,

– আর বলিস না, গতবার আজমাত ওরে ভাবীজান বলাতে ভাইজান সবার সামনে ধমক দিছে।

শিফা একটু রেগে বললো,

– আজমাত ভাইয়ার ও দোষ ছিলো। ভাবীর সাথে ফ্লার্ট করছিলো ভাইজানের সামনে। ভাইজান এসব পছন্দ করে না এটা তো ও জানতো।

নিশাদ মলিন মুখ করে বলে,

– বেচারা আজমাত। বেক্কল তো বুঝে সারে নাই যে সামনে সাক্ষাৎ যম বসে ছিলো।ওর কপাল ভালো ভাইজান ওরে আছাড় দেয় নাই।

হঠাৎ শিফা আর নিশি হো হো করে হেসে উঠলো। নিশাদ হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে,

– তোমাকে বড় ভাইজান এইচ এস সি পরীক্ষার টেস্টে ম্যাথে ফেল করার অপরাধে একটা আঁছাড় দিয়েছিলো না।মনে আছে!

পুনরায় পুরো ড্রইং রুমে হাসির ছটা। মঞ্জিলা বলে উঠলো,

– ভাবী আমার সেই কথা মনে পড়লেই মুখটা ভয়ে শুকিয়ে যায়। কিভাবে শাহাদ নিশাদকে আঁছাড় মা*রছিলো।

দিয়া ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নিশাদ লজ্জা পেয়ে বলে,

– এসব বাদ দাও তো! ভাবীমা সামনে। লজ্জা দিও না।

দিয়া অবাক হয়নি। এটাতেই অভ্যস্ত।এ বাড়ির সব ছেলেরা দিয়াকে ভাবী মা ডাকে। শাহাদের কড়া নির্দেশ। কথা বলার সময়ও সবাই চোখ নামিয়ে কথা বলে। দিয়া উঠে যায় জায়গা থেকে। সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়েছে। একটু কফি খাওয়া দরকার।বাড়ির সকলের জন্য নাস্তাও বানাবে। রান্না ঘরে যেতেই কানে এলো শেফালীর গলা নিশিকে বলছে,

– এই মেয়ে থেকে সাবধান। ভাইজান ঘরে জায়গা দেয় না।

____

ছাদে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে শিফা। ভীষণ মন খারাপ। বড় ভাইজান কখনোই তাকে বকা দেয়না।অথচ আজ ধমক দিলো। গাছের ফুলগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে।এই সময়টাতে ছাদে কেউ আসেনা। গোধূলি বেলায় সঙ্গহীন থাকতে বেশ পছন্দ এই মেয়ের।প্রিয় মানুষটার রুম দেখা যায় সরাসরি। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। পরক্ষনে সকালের বকার কথা পুনরায় মনে উঠায় মন খারাপ করে গোলাপ গাছে পানি দিতে শুরু করে।

– আমার ছোট্ট গোলাপটা নেতিয়ে যাক,
তবু ঝরে না পড়ুক,
আমার বাগানের গোলাপটাতে সহস্র কাঁটা থাকুক
ছিড়ে নেয়ার আগে যেন হাতে ফুটুক,
আমার লাল গোলাপটা আরো রঙ্গিন হোক।

কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে বড় ভাইজান দাঁড়িয়ে আছে। শিফা ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে ফেললো। ভাইজান তো কখনো এই সময় ছাদে আসে না। কথা গুলো তাকেই বলেছে তা স্পষ্ট। শাহাদ এগিয়ে এসে বোনের মাথায় হাত রেখে বলে,

– আমার গোলাপটার কি ভাইজানের উপর বড্ড অভিমান হয়েছে?

শিফা দুপাশে মাথা নাড়ে। গলা ধরে আসছে। কথা বললেই কেঁদে দিবে। শাহাদ বোনকে পাশের সিমেন্টের টুলে বসিয়ে বললো,

– এত দূর্বল হলে তো হবে না ফুল। তোমাকে আমি মেয়ের মতো করে বড় করেছি। আমি আঘাত দিব ভাবলে কি করে! তোমার জন্মের সময় সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়া মানুষটা আমি ছিলাম। আমার শাসনে যদি আমার ফুল কষ্ট পেয়ে ঝরে যেতে চায়,আমি ব্যর্থ।

অকস্মাৎ হাউমাউ করে কেঁদে দিলো শিফা। শিফা শাহাদের যতখানি আদর পেয়েছে তার সিকিভাগ ও শেফালী পায়নি। শেফালী সবসময় ছিলো ভিন্ন রকম। শিফার জন্মের পর সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে শেফালী। কোল থেকে ফেলে দিয়েছে,বালিশ চাপা দিয়েছে৷ ওর ধারণায় ছিলো শিফা ওর প্রতিদ্বন্দ্বী। শাহাদ,শাহীন বরাবরই আগলে নিয়েছে শিফাকে। আজো দিয়াকে রক্ষা করতে গিয়ে শিফা বকা খেয়ে বসলো এই কথা শাহাদের কর্ণোগোচর হয়নি। এই ছোট্ট বোনটার কাছে শাহাদ কৃতজ্ঞ। তার মেয়ে এবং মেয়ের মাকে সবসময় শিফা আগলে রেখেছে শেফালী থেকে। বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

– নিজেকে সাইদা রোজা শিফা হিসেবে গড়ে তোলো, নিজের চারপাশটায় বেষ্টনী গেঁথে দাও। যেন কেউ ছুঁতে এলে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ফিরে যায়। সেখানে শাহাদ ইমরোজ ও যদি ঘায়েল হয় তাতেও যেন তোমার সফলতায় বাঁধা না আসে।

শিফা নাক টেনে ক্রন্দনরত গলায় বলে,

– আপনি আমার আইডল ভাইজান। আমি নিজেকে গড়ে তুলব কিন্তু আমাকে বেষ্টনী দেয়ার দায়িত্ব আপনার। আপনার দোয়া ছাড়া আমার চলবেনা।

শাহাদ হাসে। সেই সাথে শিফাও হাসে। ভাইবোনের এই দৃশ্য আড়াল থেকে দুজন দেখে। একজন মন থেকে দোয়া দেয়,তার অন্তরাত্মা কাঁপে কিভাবে এই পাহাড়সম লোক থেকে তার বোনের হাত চাইবে। অপরজনের চোখে ক্রোধের আগুন। তার আগুনে জ্বালিয়ে দিবে ভাইবোনের এই ভালোবাসা। ধূলিসাৎ করবে সব। যেমনটা করেছিলো বছর দুয়েক আগে!!

চলবে…

#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ডাইনিং এ সবাই সন্ধ্যার নাস্তা খাওয়ার জন্য বসেছে।টেবিলে সাজানো আছে হরেক রকম খাবার।আজ সব খাবার সুলতানা নিজে রান্না করেছে ছোট ননদের জন্য। সাহায্য করেছে শিফা আর নিশি। সুলতানা কিছুতেই দিয়াকে কাজ করতে দিবেনা। বসিয়ে রেখেছে ডাইনিং এ। রায়হান সাহেব এসেছেন কিছুক্ষন আগে। সবার সাথে গল্প করছেন। শিফা ডেকে এসেছে বড় ভাইজানকে। শাহাদ মেয়েকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। একেবারে স্যুটেড বুটেড হয়ে। কালো ব্লেইজার,ভেতরে অফ হোয়াইট শার্ট, কালো ফরমাল প্যান্ট। শার্টের উপর দুটো বাটন খোলা। ব্লেইজারের কলারে ব্রুচ লাগানো। চুল গুলো সেট করা। চশমাটা পরিবর্তন করেছে। রিমলেস পরেছে আজ। কোথায় যাচ্ছে মানুষটা। দিয়া এক নজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে টেবিলে হেড ডাউন করে রেখেছে। শাড়ির আঁচল তুলে ঘোমটা টেনে রেখেছে চোখ নত। তাকাবেনা নিষিদ্ধ জিনিসের দিকে। বুকের ভেতরটা আজ চিনচিন করে উঠলো। এই মানুষটা কেনো তাকে ভালোবাসতে পারলোনা। সে কি ভালোবাসার যোগ্য ছিলোনা! একমাত্র মেয়ে শেহজাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় অথচ শেহজার গর্ভধারিনী মায়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। বুকের গহীন থেকে উৎপন্ন দীর্ঘশ্বাস আজ পরিবেশ ভারী করে রেখেছে। রায়হান সাহেবের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে দিয়ার,

– কোথাও কি যাচ্ছ তুমি?

শাহাদ মেয়েকে পুনরায় আদর করে শিফার কোলে দেয়। বাবাকে উদ্দেশ্য করে জবাব দেয়,

– বানিজ্যমন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে। আমার ফিরতে দেরী হবে। আপনারা খেয়ে ঘুমিয়ে যাবেন।

শাহাদ মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলো। মঞ্জিলা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

– শাহাদের ভরা সংসার দেখেই আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো লাগছে ভাইয়া।

রায়হান সাহেব চিন্তিত। উনার নিরবতা দেখে সুলতানা মুখ খুলবে তখনই দিয়া বলে উঠলো,

– আম্মু আমি রুমে যাই,শেহজাকে খাওয়াতে হবে।

সুলতানা কবিরের সম্মতি দেখে স্থান পরিত্যাগ করলো দিয়া। এখন হয়তো সেখানে সকলে সাংসারিক আলোচনা করবে যা শাহাদ এবং তাকে ঘিরে। এসব শুনতে আর ভালো লাগে না। দু’ দুটো বছর ধরে, স্বামী থাকতে ও না থাকার মতো একই ছাদের নিচে আছে। মেয়েরা যে সময়টা পরিবার পরিজন আপন মানুষ নিয়ে কা*টায়, দিয়া সে সময়টা পাশে কাউকে পায়নি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে অনেক ঘা ত, প্র/তি/ঘা/ত সে মেনে নিয়েছে। ওইদিনগুলোর কথা মনে আসলেই বুক চিড়ে কান্না আসে। মনে হয় তখনই এই
হ/ত/চ্ছা/ড়া জীবনকে শেষ করে দিতে পারতো তাহলে বাকি জীবনটা আফসোসের হতো না। কিন্তু জীবনের উপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনো অধিকার নেই। নেহাৎ আ/ত্ম/হ/ত্যা মহাপা*প নাহয় কবে বাবা-মায়ের কাছে চলে যেত। বাবা – মা যেদিন এক্সিডেন্টে মারা যায় সেদিন চোখের সামনে শুধু অনিশ্চিত জীবন দেখেছে। বাবা মাকে নিয়ে দেশে ফেরার পর দাদার কাছে গিয়েছিলো।দাদা বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো না জানিয়ে বিয়ে করার অপরাধে। বাবা সেই গ্রামে নিজের নামে থাকা জমিতেই টিনের ঘর তোলে। গ্রামের কলেজে বেছে নেয় শিক্ষকতার পেশা। গ্রামের লোকজন বলতো বিদেশ থেকে এত পড়াশোনা করে আসা মানুষটা আজ গ্রামে পড়ায়। বউটা কুফা। বাবাতো বিয়ের আগেই শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলো। সেই পেশা চাইলেই নিয়মিত করতে পারতো৷ কিন্তু তা না করে গ্রামেই পড়িয়েছে, আবাদী জমিতে চাষাবাদ শুরু করেছিলো। সুখেই ছিলো। কোনো কিছুর অভাব বোধ করেনি দিয়া ছোটবেলায়। অভাবের মধ্যে ছিলো একটা ছাদ পেটানো বাড়ি। এটা ও দিয়ার বাবার ইচ্ছাকৃত কাজ।দিয়ার বাবা মুরাদ মজুমদার খুব বই পাগলা মানুষ ছিলেন। তার কয়েকটা প্রিয় উক্তির মধ্যে হুমায়ুন আহমেদের একটি ছিলো,

‘ পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে।
শ্রাবন মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে।
সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না।
কোনো মানে হয়… ”

দিয়ার বাবা যখন কবিতা আবৃত্তি করতেন, আমিরা তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন।কিছু কথা বুঝতেন,কিছু বুঝার নাগালের বাইরে। তবে অনেকটা বাংলা আয়ত্ত করে নিয়েছিলো আঠারো বছরের সংসার জীবনে। আজো দিয়াদের টিনের চালে ধুপধাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে। সেই সেতার শুনার জন্য কেউ নেই। মুরাদ টিনের চালে বৃষ্টির ঝনঝন করা শব্দের ভক্ত ছিলেন, পুকুর ভর্তি রাজহংসীর বিচরণ উনাকে মুগ্ধ করতো।একমাত্র কন্যা দিয়াকে নিয়ে জমির আইল ধরে হেঁটে আসতো। প্রতি শনিবার গ্রামে বাজারের দিন, বাজার করে আসার সময় দিয়ার মায়ের জন্য এক মুঠ কাচের চুড়ি নিয়ে আসতে ভুল করতোনা। মা সেই কাচের চুড়ি আগলে রেখে বলতেন,

– আমার দিয়ারানী যখন বড় হবে এই সব চুড়ি তার হবে।

দিয়ার মা ইরানি বংশদ্ভূত ছিলেন।মালয়েশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে এগ্রিকালচারের উপর মাস্টার্স করতে গিয়েছিলেন দিয়ার বাবা।সেখানেই পরিচয় আমিরার সাথে।এরপর সৌদিতে আসেন হজ্জ্ব পালনে। আমিরার পরিবারের সকলে থাকতেন সৌদিতে। আমিরার পরিবার মুরাদকে মেনে নিতে অগ্রাহ্য করায় পালিয়ে আসে আমিরা।আর কখনো যায়নি বাবার দেশে। সুন্দর ছিমছাম সাজানো সংসার ছিলো দিয়াদের। দিয়া মায়ের ওড়না দিয়ে বউ সাজতো। দিয়ার ইন্টার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ। পরদিন ঘুরতে যাবে মুরাদের ফুফুর বাড়ি।ব্যাগ গুছিয়ে বিকালের নাস্তা খেতে বসেছিলো তিনজন। বাবাকে উকিল জায়গা সংক্রান্ত কাগজ নিয়ে ফোন দিয়েছে। দিয়ার দাদাই খবর দিয়েছিলো যেতে। সাথে মাকে নিয়ে যেতে বলেছে কারণ বাবার বেশির ভাগ জায়গা মায়ের নামে লেখা। দিয়াকে রেখে গিয়েছে পাশের বাড়ির তাহমিনা আপার কাছে। দিয়া আর তাহমিনার বয়সের ব্যবধান এক বছর। তাহমিনা গ্রামের কলেজে ডিগ্রিতে পড়ে। বাবা মা আসার আগ অবধি গল্প চলে। ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। এতক্ষন খুশি হলেও এবার দুশ্চিন্তা শুরু হলো। দিয়া নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো দেখে আসার জন্য,বাবা মা এসেছে কিনা। সাথে এসেছে তাহমিনা এবং তাহমিনার বাবা। বাড়ির সামনে একটা সাদা হাসপাতালের গাড়ি।উপরে লাইট জ্বলে গাড়িটার। দিয়া ঠেলে ভীড়ের মধ্যে বড় উঠলো,

– আমার বাবাজান,আম্মিজান কি আসছে?

হ্যাঁ সেদিন দিয়ার বাবা- মা এসেছিলো। তবে পায়ে হেঁটে নয়, সাদা গাড়ির সিটে করে। একসাথে দুজনের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো, স্পট ডেথ। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য যে দেখার মত,সহ্য করার মত ছিলোনা। কেঁদেছিলো গ্রামের প্রতিটি মানুষ। সবার একটা দুশ্চিন্তা মুরাদের মেয়েটার কি হবে! একই গ্রামে থেকে দাদাসাহেব এত বছর এড়িয়ে চললেন,ছেলের বিদায়বেলায় গগন বিদারী কান্নায় ফেটে পড়লেন।বুকে আগলে নিলেন নাতনীকে। দাদা সাহেবের জীবদ্দশায় দিয়া থেকেছে রাজকন্যার মতো। দাদীজান বিদায় নেন প্রথমে,এরপর দাদাসাহেব।ততদিনে দিয়ার বাবার জায়গা সম্পত্তি সব কিছু নিয়ে ঝামেলা চলছিলো। দিয়া এত সব বুঝে উঠতে পারছিলোনা। শ্বশুর রায়হান সাহেবের অফিসের ম্যানেজার ছিলেন বাবার বন্ধু নওয়াজ আংকেল।তার কাছে মুরাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র থাকাতে একদিন দিয়ার চাচার সাথে দেখা করতে যায়। দিয়াকে অনেক দিন পর দেখে নিজেও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সেবার আংকেলই ছিলো দিয়ার বিয়ের ঘটক। দরজায় কড়া নড়ার আওয়াজ পেয়ে দিয়া শেহজাকে খাওয়ানো শেষ করে উঠে বসে। একা থাকলেই রাজ্যের চিন্তা ঘিরে ধরে। নেতিয়ে পড়া শরীর নিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে নিশি এবং শিফা। শিফা দিয়ার জন্য জুস নিয়ে এসেছে। এই মেয়ে দুটোকে অনেক আপন আপন লাগে।দিয়ার নিসঙ্গতা কেটে যাবে এখন এদের সাথে।

___

পাভেল গাড়ি চালাতে চালাতে নিজের বার বার রিং হওয়া ফোনের দিকে চোখ যাচ্ছে। গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোন ধরলে বস যে হাত পা ভেঙ্গে দিবে তার ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এই সেক্টরের লোকদের নিয়ে বড্ড ঝামেলা। এরা জন্মের পর থেকেই মনে হয় যেন নিয়ম- শৃঙ্খলা শিখে জন্ম নিয়েছে।

– পাভেল গাড়ি সাইডে রেখে ফোন ধরো।

আদেশ পেয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করালো। ফোন ধরে কথা শেষ করেই পুনরায় স্টিয়ারিং ঘুরালো। গাড়ি গিয়ে থামলো সরাসরি সেনা কুঞ্জে। গাড়ি থেকে নেমেই প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গেলো। কালো ব্লেইজারে এমন সুদর্শন পুরুষ দেখে চোখ আটকে গেলো কোনো এক তনয়ার। ঢুকতেই বানিজ্য মন্ত্রী দেলোয়ার হোসেন এগিয়ে এলেন শাহাদকে দেখে। হ্যান্ডশেক করে চমৎকার হাসি দিয়ে সবার মাঝে নিয়ে গেলেন। এখানে উপস্থিত আরো অনেক এমপি,মন্ত্রীসহ দলের সিনিয়র নেতাকর্মী ছিলেন। প্রায় সবাই পরিবার নিয়ে এসেছে।

– পরিবার নিয়ে আসো নি কেনো শাহাদ?

বানিজ্যমন্ত্রীর প্রশ্নে শাহাদ কিছুটা বিচলিত হয়ে গেলো। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে বললো,

– আমার মেয়েটা ভাইরাল সিকনেসে ভুগছে। তাই বাইরে নিয়ে আসতে চাইনি।

– আ’ম স্যরি আসলে বুঝতে পারিনি।

তখনই দলের সিনিয়র নেতা পারভেজ বলে উঠলেন,

– দু বছরে কোনো প্রোগ্রামেই তো দেখলাম না বউ বাচ্চাকে। আমাদের এম পি সাহেব বউকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। দেখাবেন না।

কুটিল হাসিতে উপস্থিত অনেকেই সায় দিয়ে হাসছে। ঠান্ডা মস্তিষ্কে প্রতিউত্তর করলো,

– বউ কি শোপিছ যে দেখাতে হবে। লোকে এসে দেখে যাবে আর প্রশংসা করে বলবে বাহ শাহাদের শোপিছ টা তো চমৎকার। কোথা থেকে কিনেছে! এমন কিছু কি নেতা সাহেব?আমার সম্পদ আমারই থাকুক।নিলামে উঠাবোনা।

অপমানে মুখ একদম শুকনো বেলুনের মত চুপসে গেলো। প্রসঙ্গে পালটে শাহাদ দেলোয়ার হোসেনকে বললো,

– স্যার চলুন ম্যাডামের সাথে দেখা করে আসি। আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে আসার আগে।

দেলোয়ার হোসেনের সহধর্মিণী রোকেয়া আক্তার শাহাদকে পছন্দ করে। শাহাদকে দেখেই এসে জড়িয়ে ধরলেন। নিজের ছেলের মতো স্নেহ করেন। দেলোয়ার হোসেনের হাসপাতালের দিনগুলোতে পরিবারের মত পাশে ছিলো। নিজে থেকে,দলের ছেলেদের দিয়ে তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। দেলোয়ার হোসেন নববধূ এবং বরের কাছে নিয়ে গেলেন। নিজেদের মধ্যে আলাপ সারতেই আত্নীয় স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তখনই উনার ছোট মেয়ে এসে পাশে দাঁড়ায়। মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,

– শাহাদ আমার ছোট মেয়ে এলিন। ইউ কে থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। এখন পি এইচ ডির জন্য এপ্লাই করেছে। গত সপ্তাহে এসেছে বোনের বিয়েতে।

পরিচয় করিয়ে দিয়ে দেলোয়ার সাহেবের ডাক পড়লে ওদের রেখে উনি চলে যায়।
শাহাদকে দেখে এলিন হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– নাইচ টু মিট ইউ।

শাহাদ মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

– আসসালামু আলাইকুম। আ’ম স্যরি দিস ইজ নট মাই রিচুয়াল একচুয়েলি।আ’ম ওকে উইথ মাই সালাম।

এলিন কিছুটা বিব্রত হলো।হাত সরিয়ে মুঠ করে নিলো। সালামের উত্তর দিলো,

– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আ’ম স্যরি।একচুয়েলি আই হ্যাভ টু বি মোর কেয়ারফুল। আই ফরগোট দিস ইজ বাংলাদেশ। সো নিড টু ফলো ইট’স রিচুয়ালস।

– অলসো নিড টু স্পিক ব্যাংগলি ইনফ্রন্ট অফ পার্লামেন্ট মেম্বার।

– আ’ম স্য ও রি… আমি দুঃখিত।ভীষণ ভাবে। আমি খুব ভালো বাংলা পারি কিন্তু মাঝে মাঝে অভ্যস্ততায় ইংরেজি চলে আসে।

শাহাদ উপর নিচ মাথা নাঁড়ালো। আশপাশে মানুষের প্রচন্ড ভিড়। নিচে ছোট বাচ্চারা খেলা করছে। হঠাৎ একটা বাচ্চার দিকে চোখ পড়লো। কেমন যেন আদুরে লাগলো। বুকের মাঝে হালকা চিনচিন করে উঠলো। কেনো যেনো কষ্ট হচ্ছে। পাশে হাঁটছে এলিন। এলিন বক বক করেই যাচ্ছে। এলিন প্রশ্ন করলো,

– আপনি পড়াশোনা কখন শেষ করেছেন?

শাহাদ সম্বিত পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– কেমন পড়াশোনা? পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন?

– ইয়েস।

– বারো বছর আগে।

– কিহ?

এলিন চমকে তাকালো। মুখের এমন ভঙ্গি করলো যেন ভূত দেখেছে। আচমকা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলো,

– আপনার বয়স কত?

এবার শাহাদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো,

– এক্সিউজ মি।

এলিনকে ওভাবে রেখেই শাহাদ সামনে হেঁটে গেলো। শাহাদ এক পর্যায়ে হলের মধ্যে দৌঁড় দিলো। সকলে এভাবে শাহাদকে দৌঁড়াতে দেখে বিস্মিত। দেলোয়ার সাহেব এগিয়ে আসছে। এলিন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে,

– শাহাদ দৌঁড়াচ্ছেন কেনো?

চলবে…