#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৪৮.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
শাহীনের জিপ থেকে নেমে সবাই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাভেল এক পাশে দাঁড়িয়ে তুহিন,হামজা এবং কাব্যের তামশা দেখছে। তুহিন শাহীনের হাত ধরে বলেছে,
– স্যার আমাকে নিয়েন না। হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই না। ওরা ভালো খানা দেয় না। ও স্যার, আর জীবনে এমন করমুনা। আমি কি জানতাম লিমন এমন বিপদে ফালাবে?
শাহীন ধমক দিলো,
– তুহিন হাসপাতালে গেলে সবাই একসাথে যাবো।এমন করছিস কেনো?
কাব্য কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
– ছোট দা* তুমিও ভয় পাচ্ছো?
শাহীন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,
– তোর আমাকে কি মনে হয়? আমার ইউনিটের সদস্যরা আমাকে ভয় পেলেও আমার জম তো থাকে সুলতানা মঞ্জিলে। আমাকে সুলতানা মঞ্জিলের তিন তলা থেকে এক্কেবাড়ে ময়লার ভাগাড়ে ছুঁ ড়ে ফেলবে।
পাভেল ক্ষে পে বলে,
– শা*লা ওদের বিয়েটা দিছিস ভালো কথা, এখন সব গুলাকে ভ য় লাগাচ্ছিস কেনো? পোলা পান গুলা ভরসা হা/রাবে।
কথা শেষ করে পাভেল নাকে কেঁদে বললো,
– ও শাহীন মা*ইর মাটিতে একটাও পড়বে না। এতদিন থা*প্পড় মিশন চালিয়েছে আজ কি চালাবে?
হামজা ঠোঁট উলটে বলে উঠলো,
– ভাই, বুলডোজার।
সকলে শুকনো ঢোক গিলে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো। যদিও এত রাতে সবাইকে দেখে দারোয়ান বিচলিত। তবুও এই বাড়ির ছেলে মেয়ে এরা, যখন খুশি আসবে তাই সালাম দিলো। পাত্তা না দিয়ে সকলকে ঢুকতে দিলো।
এক কদম এক কদম করে এগিয়ে গেলো সুলতানা মঞ্জিলের বিখ্যাত থা*প্প ড় ঘরে, লিমন মজা করে একবার বলেছিলো এই বাড়ির সব থাপ্পড় পড়ে লিভিং রুমে, শাহীনের গালে, শেফালীর গালে, নোমানের গালে এবং সর্বশেষ আজ লিমনের গালে পড়তে যাচ্ছে। অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছুও ঘটতে পারে। কলিং বেল চাপ দিতেই আফিয়া খালা দরজা খুলে দিলো হাসি মুখে। শাহীনকে আচমকা দেখেই অবাক হলো। লিভিং রুম ফাঁকা। ওদের এতজনকে একসাথে ঢুকতে দেখে ঘা ব ড়ে গেলো আফিয়া। সবাইকে বসতে বলে সুলতানা কবির, রায়হান সাহেব কে ডেকে নিলেন। দিয়া ডাইনিংয়ে এসেছিলো পানি নিতে। সবাইকে দেখে হাসি মুখে সালাম দিলো। খুশি হয়ে বললো,
– বাহ ভালোই হলো আজ সবাই একসাথে হলাম অনেক দিন পর। ভাইয়া আপনি তো সারপ্রাইজ দিয়ে দিলেন। আমি আপুকে ডাকছি।
নওরীনকে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি। নিজ থেকেই এসে পড়েছে। এর মাঝে রায়হান সাহেব এবং সুলতানা কবির ঢুকলেন। সকলে দাঁড়িয়ে পড়লো। শাহীন বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরলো। নওরীনের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিলো। চোখের ইশারায় নওরীন যা বুঝার বুঝে গিয়েছে। ঘা/প/লা আছে কোথাও। আবির মামাদের পেয়ে খুশি হলো। ছুটে গিয়ে বড় মামাকে ডেকে আনলো। শাহাদ শেহজাকে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। আফিয়া খালা সবাইকে চেয়ার দিলেন বসতে। শাহাদ সোফায় বসলো। লিমন আর তাহি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। রায়হান সাহেব হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললেন,
– ভালোই হয়েছে তোমরা এসেছো। তাহির তো পরশু বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো। আজই চেয়েছিলাম কাবিন করতে। তাহি ডেট পেছালো। সবাই মিলে কিভাবে কি করবে প্ল্যান করো।
লিমন মাথা নত করে রেখেছে। তাহিও মাথা তুলছেনা। শাহাদ ওদের পর্যবেক্ষন করছে। আজ বিকালের পর তো লিমনের এখানে থাকার কথা নয়। তবে? সাবিনা এবং রত্না নামাজে ছিলো। রুম থেকে বের হয়ে এলো। শাহীনকে আদর করে ওরাও বসলো। সাবিনা প্রশ্ন করলো,
– তাহি অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে?
বাড়িসুদ্ধ সকলের দৃষ্টি তাহির দিকে। কাব্য ভাবছে তাহি আপা অপারেশনের কথা বলে বাড়ি থেকে বের হলো? ওর শরীরে ঘাম ছুটে গিয়েছে। আফিয়া খালা সবাইকে শরবত বানিয়ে দিয়েছে। কারো গলা দিয়ে নামছেনা। শুরু করবে কে? তুহিন এবং হামজার দিকে শাহাদ মুখ খুললো,
– কোনো কাজে এসেছো তুহিন,হামজা?
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ঝাপটে যাচ্ছে। কি উত্তর দিবে? তুহিন কম্পিত গলায় বললো,
– না বস।
শাহাদ প্রশ্ন ছুড়লো,
– তবে? কয়টা বাজে ঘড়ি দেখেছো?
হামজা বললো,
– জ্বি বস, নয়টা চল্লিশ।
– এত রাতে এখানে কি?
– আচ্ছা চলে যাচ্ছি।
হামজা বেকুবের মত উত্তর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। পাভেলের দিকে চোখ যেতেই পাভেল চোখ রাঙিয়ে দিলো। পুনরায় বসে পড়লো। লিমন দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আমার কিছু কথা ছিলো?
রত্না প্রশ্ন শুধায়,
– কি কথা?
অকপটে উত্তর দিলো,
– আমি এবং ডক্টর তাহি বিয়ে করেছি।
হতবিহ্বল সুলতানা মঞ্জিলের লিভিং রুম। কি শুনলো? ভুল শুনেনি তো?
সাবিনা কোনো রকম উঠে দাঁড়ায়। সোজা গিয়ে তাহির গালে প্রচন্ড জোরে সপাটে চ*ড় লাগায়। একই কাজ রত্নাও করলো আজ। লিমনে গালে কষে সর্ব শক্তি দিয়ে
থা/প্প/ড় মা*রলো। বাকিরা নিঃশব্দ। রত্না চেঁচিয়ে বললো,
– এই মানুষ করলাম তোরে। এই প্রতিদান দিলি। চুন কালি মাখালি পরিবারের মুখে। কোন সাহসে তোর চোখ এত ন/ষ্ট হলো যে বয়সে বড়, সম্পর্কে বোন লাগে এমন মেয়েকে বিয়ে করলি। এরচেয়ে তুই আমাকে গার্মেন্টস কর্মী বিয়ে করে এনে দিতি আমি খুশি হতাম।
লিমন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে মা কি ডাক্তার তাহি কে অপমান করলো! নাকি তাকে শাসাচ্ছে? সাবিনা মেয়ের চোয়াল শক্ত করে ধরে বললো,
– রুচি এত নিচে নামলো তোর? হাঁটুর বয়সী ছেলেকে বিয়ে করলি?
শাহীন গিয়ে আগলে ধরলো তাহিকে। খালাকে ধমকে বললো,
– তোমরা এমন অদ্ভুত আচরণ করছো কেনো? আমার ধর্ম যেখানে বাঁধা দেয় না ওদের বিয়েতে তোমরা কোন সাহসে এগুলা করছে। কার সাথে নাফরমানি করছো? আমি বিয়ে দিয়েছি ওদের দাঁড়িয়ে। যা বলার আমাকে বলো।
পুনরায় থমকে গেলো লিভিং রুম। কথাটা বলে শাহীন শাহাদের দিকে তাকায়। পরের থাপ্পড় কি ওর গালে পড়বে? না পড়েনি। শাহাদ স্থির। তবে দুটো অলরেডি দুই অপরাধীর গালে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই লিভিং রুমকে থা প্পড় ঘর হিসেবে আখ্যায়িত করা বহাল থাকলো।
রায়হান সাহেব এতক্ষনে বললেন,
– ওরা কি দুজন রাজি ছিলো বিয়েতে?
শাহীন জবাব দিলো,
– জ্বি আব্বু।
– তাহলে আমার বলার কিছু নেই। তবে আমাদের জানানো উচিত ছিলো। পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হতো।
সাবিনা ক্ষেপে বললো,
– কি বলেন দুলাভাই, আপনার আপত্তি নাই? সমাজে মুখ দেখাবো কি করে আমরা? মানুষ কি বলবে? ওর চাচারা আমাকে এমনি খা/রা/প ভাবে। আজকের পর তো আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি লাগবে।
রত্না ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। দিয়া,নওরীন এবং শেফালী গিয়ে ধরলো রত্নাকে।
– কোন সমাজে মুখ দেখাতে চাইছেন খালাম্মা?
গম্ভীর প্রগাঢ় আওয়াজের উৎসের দিকে ফিরে ঘাড় ঘুরালো সাবিনা। পুনরায় প্রশ্ন এলো,
– যে সমাজ আপনার মেয়ের নিরাপত্তা দেয় না ওই সমাজ? যে সমাজ মেয়েকে অলক্ষ্মী, অপয়া বলে সেই সমাজ? যে চাচা ভাই মা রা যাবার পর ফিরে তাকায় নি ওই চাচা? নাকি যে পরিবার একটা বিধবা নারীকে তার সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে সেই পরিবারের?
সাবিনা কাছে এসে বললো,
– আমরা তো সমাজ মানি। বাবা রে কি করলো আমার মেয়েটা, ও আমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করলো? আমাকে মাফ করে দেয়।
সাবিনা শাহাদের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। শাহাদ খালাকে সামলে বললো,
– লিমন ভালো ছেলে, আপনার মেয়েকে সামলে রাখবে। স্বাভাবিক একটি ব্যাপার, স্বাভাবিক ভাবে নেয়াই উচিত। সবার অধিকার আছে, নিজেদের সিন্ধান্ত জানানোর। জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার। ওরা দুজন তাই করেছে। এত চিন্তার কিছু নেই।
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় শাহাদ। শেহজাকে শেফালীর কোলে দিয়ে এক পা আগানোর পর তাহি লিমন দুজনই ছুটে শাহাদের সামনে হাত জোড় করে বসে পড়ে। নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে প্রশ্ন করে,
– হাঁটুতে বসেছো কেনো?
লিমন উত্তর দিলো,
– ভাইজান মাফ করে দেন।
লিমন এবং তাহিকে ধরে উঠিয়ে বললো,
– আমি মাফ করার কেউ না। এখানে মাফ করার মত কিছুই হয়নি। অনেক রাত হয়েছে। তাহিকে স-সম্মানে নিজের বাড়ির নিয়ে যাও।
এতটুকু বলেই পাশ কা টিয়ে চলে গেলো শাহাদ। রুমের দরজা আটকে দিলো জোরে। যা বুঝার বাকিরা বুঝে নিলো। নিরবে পুরো ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলো শাহাদ। সাবিনা চিৎকার দিয়ে বললে,
– দিলি তো মু/খ/পু/ড়ি সব শেষ করে, ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে নিলো। কি না করেছে তোর জন্য।
দিয়া সবাইকে থামিয়ে বললো,
– অনেক হয়েছে খালামনি,চাচী আম্মু এবার থামুন আপনারা। লিমন ভাইয়া তাহি আপুকে নিয়ে রুমে যান। শুধু শুধুই এত কাহিনি। আপনাদের ছেলেকে আমি দেখছি। রাগ করেছে খানিকটা তবে বেশিক্ষণ এই রাগ থাকবেনা। অন্য কারো ব্যাপারে জানিনা তবে লিমন ভাইয়া আর তাহি আপু আপনাদের ছেলের জান। না জানিয়ে এত বড় কাজ করাতে কষ্ট পেয়েছে।
দিয়া এগিয়ে এসে তাহিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আপু আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনারা দুজন আমার বড্ড প্রিয়।
লিমন দিয়ার কাছে এসে বললো,
– ভাবীমা আমি সকালে আসবো ডাক্তার তাহিকে নিয়ে আজ বাসায় ফিরে যাই। ভাইজান ও তো বললো চলে যেতে।
– আপনার মাথা ঠিক আছে ভাইয়া? জেদের বসে বলেছে। এখন যদি সত্যি বেরিয়ে যান সকালে এই বাড়িটাকে ধ্বংসাবশেষ বানাবে আপনাদের না পেলে। আপনারা কেউ যাবেন না। সবাই রেস্ট নিন।
রায়হান সাহেব আর সুলতানা কবির ও সহমত দিয়ার সাথে। সবাইকে থেকে যাওয়ার জন্য বললো। শাহাদের মতিগতি কেউ বুঝতে পারছেনা। ঝড়ের আগে পরিবেশ ঠিক যতটা শান্ত শাহাদ ততটাই নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
___
ঘড়িতে সাড়ে বারোটা। দিয়া মেয়েকে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নক করার পর দরজা খুলে দিলো। শেহজা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে শাহাদের পাশে বসলো। আজ খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে কপালে হাত রেখে বসে আছে।
– এমপি সাহেব?
– হুম।
– রাগ করবেন না প্লিজ। সবারই তো নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। তাই না?
– হুম
– আপনি এত শান্ত হয়ে আছেন কেনো?
– ঠিক আছি আমি।
– আমার কষ্ট হচ্ছে।
কপাল থেকে হাত সরিয়ে ডানে ফিরে মেয়েকে দেখলো শাহাদ। মেয়ের ঝাকড়া চুল হাত দিয়ে সরিয়ে কপালে চুমু দিয়ে হালকা হেসে বললো,
– আমার কলিজার চুল গুলোর যত্ন নেবে ফারাহ্। তোমার মতো কেশবতী বানাবে কেমন?
দিয়া ইষৎ হেসে বললো,
– তা না হয় হবে। কিন্তু রা/গ টা তো কমান।
– নেই তো।
– আছে তো। এই যে প্রসঙ্গ বদলাচ্ছেন।
– প্রসঙ্গ বদলাইনি ফারাহ্। চাচ্ছিনা আমাদের তিনজনের মাঝে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে। আমার কাছে আপাতত আব্বু,আম্মু, তুমি এবং শেহজা আমার পৃথিবী। বাদ বাকি সব ছলনা। কাছে আসো। সব ভাবনা বাদ দাও।
দিয়া মলিন মুখে এগিয়ে যায় শাহাদের দিকে। এক হাতে প্রেয়সীকে আগলে বুকে চেপে ধরে। বুকের ভেতর কেনো এত কষ্ট হচ্ছে? কেনো মেনে নিতে পারছেনা ওদের করা কাজটা? তাহি তো ভু ল কিছু করেনি। অন্যদিকে লিমনের চেয়ে বেশি আগলে কেউ তাহিকে রাখতে পারবেনা। তবে কি তথাকথিত মেল ইগোতে লাগলো? নিজেকে সবার সব ব্যাপারে জড়ানো অনুচিত, অশোভনীয়। এই শেষ, আর কারো ব্যাপারে মাথা ঘামাবেনা।
অকস্মাৎ শাহাদ শব্দ করে হেসে উঠলো। দিয়া লজ্জা পেয়ে বলে,
– হাসছেন কেনো?
– তোমার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা বেড়াল ছানা গুটিশুটি মেরে উম খুঁজছে।
– খুঁজছিই তো।
– কোথায়?
– এই যে, এখানে।
আঙুল তাক শাহাদের বুকে। শাহাদ দু হাতে বুকের সাথে চেপে ধরলো দিয়াকে। আহ্লাদ নিয়ে বললো,
– ওলে আমার ছোট্ট বউটা। এত্ত আদর কেনো তুমি? কাছে আসলে আমার রা*গ, দুঃখ কষ্ট সব এক নিমিষেই হাওয়া।
দিয়ার খিলখিল হাসি শাহাদের কানে বাজে। থুতনী তুলে অধরে অধর ছুঁইয়ে দিলো। দিয়া উপলব্ধি করছে শাহাদের ভেতরের তোলপাড়। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে মানুষটা। কথা না বাড়িয়ে দিয়া খাট থেকে নেমে ল্যাম্পশেড নিভিয়ে পুনরায় শুয়ে পড়লো। শাহাদ ফোনে মেইল চেক করে ফোন রেখে দিয়ার দিকে ঘুরলো। দিয়া দুহাত মেলে দিতেই শাহাদ হেসে বলে,
– এই পুতুলের মত হাত দুটো দিয়ে ছোট্ট বুকটাতে কিভাবে আগলে রাখো দানবটাকে?
– এই পুতুলের মতো হাতের,ছোট্ট বুকের মালিকই পারে দানবটাকে মনুষ্য সত্ত্বায় ফিরিয়ে আনতে।
– সব উপায় মুখস্ত তাই না?
– হুম।
– আমার রজনীগন্ধা। তুমি আস্ত একটা ফুলবাগান ফারাহ্। ঘোর কাটাতে চাইলেও পারিনা।
– পারতে হবে কেনো? সারাজীবন আমার ঘোরেই থাকবেন। যখন আমি থাকবো না তখন ও। মনে থাকবে?
জড়িয়ে ধরলো সহধর্মিণীকে। দিয়া বকবক করেই যাচ্ছে। শাহাদ চুপ করিয়ে দিলো,
– শুষষ। ডোন্ট ডিস্টার্ব….
– এমপি সাহেব বারান্দায় যাবো।
প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো। পাঁজকোলে তুলে নিলো স্ত্রীকে। তান্ডব করা প্রকৃতি। ভিজিয়ে দিয়েছে বারান্দার সব গাছকে। বর্ষা সেই কবে পেরিয়েছে তবুও প্রকৃতি মাঝে মাঝে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে নিজের ক্রো/ধ ঝাঁড়ে জনজীবনের উপর। দিয়া মুখে হাসি রেখে আবদার করে বললো,
– একটা অনুরোধ করি?
সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– হুম।
– আপনার গানের গলা মন্দ নয়। ভালো লাগে। আমার জন্য একটি গান গাইবেন?
অনুরোধ শুনে চুপ শাহাদ। পুরো পৃথিবীটাকে অসহ্য লাগছে। তবুও মন চাইছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেয়সীর আবদার রাখতে। গলা ছাড়ে,
– এই বুকে বইছে যমুনা
নিয়ে অথৈ প্রেমের জল
তার তীরে গড়বো আমি
আমার প্রেমের তাজমহল
আমার প্রেমের তাজমহল
আমার প্রেমের তাজমহল।
জানে ঈশ্বর জানে আল্লাহ
তোমার প্রেমের কত মূল্য
কিছু সৃষ্টি হয়নি ধরা
তোমার প্রেমের সমতূল্য
এই প্রেম যে কত গভীর
খুজে পায় না কোন তল
তার তীরে গড়বো আমি
আমার প্রেমের তাজমহল।
__
ছাদের উপর সবাই। পাভেলের চিলেকোঠা সবার আশ্রয়স্থল। তুহিন,হামজা জোর করে চলে গিয়েছে। শাহীন, পাভেল ও চায়নি ওদের ঝামেলায় রাখতে। চিলেকোঠায় এখন লিমন, পাভেল এবং কাব্য। শাহীন কিছুক্ষণ আগেই রুমে ফিরেছে। লিমনকে সবাই রুমে যাওয়ার জন্য বলছে। অথচ সে ঘাপটি মে*রে এক জায়গায় বসে আছে। উলটো কাব্যকে ধমকে বললো,
– কিসের রুম? এটা কোনো বিয়ে? আমি কাগজে কলমে সই করেছি এরচেয়ে বেশি কিছু নয়।
কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে চিলেকোঠা থেকে তিনজন। আগামীকাল কি হবে তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। হঠাৎ গানের গলা কানে আসায় ছাদের রেলিং ধরে তিনজনই উঁকি দেয় নিচে। কিছু দেখা যাচ্ছে না তবে গলা স্পষ্ট। কাব্য বলে উঠে,
– এটা বড় ভাইজানের গলা না?
লিমন স্তব্ধ। পাভেল মাথা নেড়ে বলে,
– হুম। ভাবীমা হয়তো স্বাভাবিক করতে চাইছে বসকে।
লিমন হেসে বললো,
– কি করলাম আমি এটা?
কাঁধে পাভেলের ভরসার হাত। ফোস করে দম ফেললো লিমন।
___
শাহীন – নওরীনও আজ বারান্দায়। নওরীনের মাথা শাহীনের কাঁধে। পুরো ঘটনা শোনার পর থেকে আগামীকাল নিয়ে শঙ্কিত। গানের ভারী গলা বাতাসে আরো ঝঙ্কার তুলেছে। নওরীন কাঁধ থেকে মাথা তুলে শাহীনের দিকে তাকায়। শাহীন নওরীনের দিকে। নওরীন প্রশ্ন ছুড়ে,
– কে গায়?
শাহীন ভ্রু কুচকে গানে মনোযোগ দিয়ে চোখ বুজে বললো,
– ভাইজান।
নিশ্চুপ কপোত-কপোতী। শাহীন আফসোসের স্বরে বললো,
– বড্ড আঘাত করে ফেলেছি আমরা প্রতিটি ভাই-বোন ভাইজানকে। মানুষটা আর ভরসা করবেনা। একটি বার জানালাম না।
নওরীন মলিন গলায় বললো,
– তোমার সব কাজে আমি পাশে ছিলাম। তবে এবারের কাজ টা ঠিক করোনি। মানুষটাকে সবাই মিলে কষ্ট দিয়েছো। ভেবেই কেমন যেন লাগছে লিমন ভাইয়া আর তাহি আপা? আসলেই কি এরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে?
– লিমন বাসে আর তাহি ভরসা চায়। যা অন্য কেউ দিতে পারবেনা। সৃষ্টিকর্তাই সব ঠিক করার মালিক। আল্লাহ যেন সব ঠিক করে দেয় নিরা। আমি আমার পরিবারকে পূর্বের মত হাসিখুশি চাই। ভাইজানকে চাই ছাদ হিসেবে।
– ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছো ছাদের ইটগুলোকে। পুনরায় ভিত্তি গড়তে কতখানি সময় লাগে সেটাই দেখবার বিষয়।
– আল্লাহ ভরসা।
– আমিন।
__
আজানের স্পষ্ট বানী কানে আসছে, এলার্ম বাজছে। ফোন হাতড়ে দিয়া এলার্ম বন্ধ করে দেখলো শেহজা এখনো ঘুমে। পাশ ফিরে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখছে মানুষটার আজ হুঁশ নেই। অন্য সময় দিয়াকে আগে ডেকে তুলে। অন্ধকারে ও অনুমান করতে পারছে মানুষটা কতটা ভেঙে গিয়েছে এক রাতের ঘটনায়। হালকা খোঁচাখোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে কপালে অধর ছোঁয়ায় দিয়া। এই তো গত বছর ও একা ঘুমিয়েছে অথচ আজ মানুষটা মিশে আছে তার মাঝে। শাহাদের ঘুমের অবস্থা দেখে দিয়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। দুহাতে দিয়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আছে। মাথা দিয়ার বক্ষে। মানুষটার ঘুম দেখেই বুঝা যাচ্ছে রাতে ঘুমাই নি। হয়তো দিয়া ঘুমানোর পর ও জেগে ছিলো। শেহজাকে যেভাবে আদরে যত্নে বড় করেছে, তাহিকে তেমনি আগলে রেখেছিলো। তাহি এমন একটা কাজ করাতে মনের ভেতর কষ্ট লেগেছে। রাতে একটি কথাই তাহি সম্বন্ধে বলেছে,
– জানো ফারাহ্, তাহি আমার কাছে বোন কম মেয়ে ছিলো বেশি। ওর জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমার নেয়া। বড় হওয়ার পর ওকে আমি ছেড়ে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু চোখে চোখে রেখেছি যদি কোনো ভুল করে বসে। রাশেদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলাম। রাশেদ ও চলে গেলো। এরপর ও মেয়েটা বিপথে যায় নি। আমি কি তবে খুব বড় ভুল করলাম নিলয়ের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করে?
দিয়া রাতে অনেক বুঝিয়েছিলো। শেহজা উঠে যাওয়াতে পুনরায় শুয়ে পড়েছিলো। কি বুঝলো মানুষটাই জানে।
চিন্তাসব একপাশে ফেলে বর্তমানে দিয়া উঠার চেষ্টা করছে শাহাদকে না জাগিয়ে। হাতের বেষ্টনী আরো দৃঢ় হলো। দু হাতে দিয়াকে চেপে ধরে বললো,
– আর পাঁচ মিনিট পর ওঠো। নতুবা সত্যি নামাজের পর এই ঠান্ডা পানিতে গোসল করাবো।
– কিহ? আপনি ঘুমে নেই?
– উহু।
– নামাজের দেরি হচ্ছে।
– ওকে যাও।
শাহাদ দিয়াকে ছেড়ে দিলো। ভেঙচি দিয়ে দিয়া উঠে গিয়ে ওযূ করে এলো। দুজনে প্রাতঃকালের প্রার্থনা সেরে বসলো। শাহাদের মাথা ব্যাথা করছে শুনে এক কাপ কফি এনে দিলো। শেহজাকে খাইয়ে দিয়া উঠে যাবে ভেবেছিলো, মেয়েটা উঠতেই দিলোনা। শাহাদ ল্যাপটপে কাজ করছে এবং ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিচ্ছে। এক পর্যায়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে কম্ফর্টারের ভেতরে এসে দিয়ার কোমড় ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। দিয়া মুচড়ে উঠলো। আদুরে ধমক দিলো শাহাদ,
– মেয়ে ঘুমিয়েছে, একদম চুপ।
– মানে?
– বলেছিলাম না তখন পাঁচ মিনিট থাকতে, অমান্য করেছো। এখন শাস্তি।
দিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
– এখন না প্লিজ উঠতে হবে।
___
নাস্তার টেবিলে কেউ বসছেনা। রায়হান সাহেব ব্যতীত বাকিরা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদ রুমের দরজা খুলে ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে এসেছে।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিজের চেয়ার টেনে বসলো। ব্রেডে এক কামড় দিয়ে পুনরায় সবার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,
– এভাবে দাঁড়িয়ে কেনো? সার্কাস চলছে?
রায়হান সাহেব সবাইকে বসার ইঙ্গিত দিলেন। বারো চেয়ারের ডাইনিং টেবিল। দুই মাথায় দুজন বসে। শাহাদ এক মাথায়, অন্য মাথায় রায়হান সাহেব। সাবিনা এবং রত্না; সুলতানা কবিরের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। শাহাদ খেয়ে টিস্যুতে মুখ মুছে সাবিনাকে বললো,
– খালাম্মা আপনার প্রথম ভুল এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন লোক সম্মুখে। দ্বিতীয় ভুল মেয়ের মন না বুঝা। তৃতীয় ভুলকে ভুল বললে গুনাহ হবে পাপ বলতে হবে। বয়সের ব্যবধানটা কোনো মুখ্য বিষয়ই নয়। মেয়ে কেমন আছে,কেমন থাকবে এটাই প্রকৃত ব্যাপার হওয়া উচিত। এটাকে বড় ইস্যু বানাবেন না প্লিজ।
এক চুমুক কফি খেয়ে পরবর্তীতে তাকালো রত্নার দিকে। হাসি মুখে বললো,
– ছেলের চেয়ে বয়সে বড় বিধবা বউ মেনে নিতে কি খুব সমস্যা হবে চাচী আম্মু?
রত্না কাল থেকেই এই ব্যাপার মেনে নিতে পারছেনা। একে তো বয়সে বড় অন্যদিকে বিধবা। তার ছেলেটা কত সুন্দর। কেমন বেখাপ্পা লাগছে। মেয়ের কি এতই অভাব ছিলো? শাহাদের প্রশ্নে আজ রত্না মুখ খুললো,
– বাবা আমি সত্যি মেনে নিতে পারছিনা। আমার ছেলেটা অবিবাহিত। এরপর বয়সেও তিন চার বছরের বড় তাহি…
এর মাঝে লিমন একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো মাকে,
– আম্মু…
শাহাদ লিমনের দিকে তাকিয়ে সুউচ্চ স্বরে বজ্রকন্ঠে ধমকে বললো,
– এমন চ ড় দিবো বিছানা থেকে উঠতে পারবিনা,
বে য়া দপ। মায়ের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয় জানিস না?
কেঁপে উঠেছে ডাইনিং রুম। শেহজা চিৎকার দিয়ে উঠেছে। শেফালীর কোলে ছিলো। মেয়েটা বাবা বলে আরো জোরে কেঁদে উঠলো। শেফালীকে দিলো বজ্রধমক,
– সরা ওকে চোখের সামনে থেকে। কি লাভ এত আদর করে?
শেহজা কেঁদে দুহাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে। শাহাদ এবার ধমক দিলো অবলা অবুঝ দুধের বাচ্চাটা কে,
– একদম চুপ। বেশি আদর করে মাথায় তুলে ফেলেছি।
থমকে গিয়েছে সকলের হৃদ স্পন্দন। শেহজাকে ধমকানোটা বাড়ির সকলের আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে। কি বুঝলো বাচ্চা মেয়েটা! কেঁপে উঠে হেচকি তুলছে। মুখের আওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়েটার শরীর কাঁপছে। দু চোখে পানি। দু বছর হয়নি এখনো, তবে কাছাকাছি তো হয়েছে। এই বাচ্চা মেয়ে কি তবে বুঝলো বাবার ধমক! শেফালীর দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। বুকের সাথে চেপে ধরলো শেহজাকে। ফুফুর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো মেয়েটা। সুলতানা কবির শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকেছে। নওরীনের চোখে পানি। সাবিনা- রত্না যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। পাভেল – শাহীনের মাথা নত। লিমন যেন জমে কাঠ। তাহির আজ মনে হলো লিমনকে বিয়ে করার চেয়ে গলায়
দ ড়ি দেয়াই ভালো ছিলো। কালকের নিস্তব্ধতা তবে এই ঝড়ের আভাস। দিয়া শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া ব্যতীত প্রতিটি মানুষ আঁৎকে উঠেছে। শেফালীকে আস্তে বললো শেহজাকে নিয়ে যেতে। নওরীন ও চলে গেলো আবিরকে নিয়ে। ছেলেটা ভয়ে গুটিসুটি মে*রে গেছে।
লিমনকে ইঙ্গিত করে শাহাদ বললো,
– ফার্দার যদি দেখেছি মায়ের সাথে এভাবে কথা বলেছিস জিভ টেনে ছি ড়ে ফেলবো। কি পেয়েছিস তোরা? নিজেরা সব বুঝিস? আর তাহি? তুই আমাকে কেনো জানাস নি এসবের ব্যাপারে। তুই লিমনকে বিয়ে করবি জানালে কি আমি বাঁধা দিতাম নাকি ধরে বেঁধে বিয়ে দেয়ার ডিসিশন নিতাম। আমি খুশি হতাম এটা ভেবে যে আমার বোনটা এত বছর পর কিছু চাইছে আমার কাছে। তা না কি করলি নিজেরা বিয়ে করলি। মনে হয় যেন টিনেজ বাচ্চা। প্রমাণ করলি যে তোদের কেউ নেই। এতটা বছর ধরে যে দুজনের অভিভাবক হয়ে সব দায়িত্ব পালন করলাম সব বৃথা।শাহীনকে জানানো গেলে ব্যাপারটা আমাকে জানানো হয়নি কেনো? নাকি আমার স্নেহে গাফেলতি ছিলো। কোনটা?
তাহি কাঁদছে। গালে এখনো চ*ড়ের দাগ। দিয়া গ্লাসে পানি ঢালছে। শাহাদের প্লেটের পাশে রাখলো। এক ঢোক পানি গিললো শাহাদ। তাহি চোখ মুছে ভেজা গলায় বললো,
– ভাইজান আমি ভ য় পেয়েছিলাম।
– তাই? কেনো? আমি বাঘ না ভাল্লুক। এত বছর পাস নি তবে কাল কেনো পেলি?
লিমন এবার দাঁড়িয়ে বলে,
– ভাইজান আমাদের মাফ করে দেন। আপনি বললে আমি ডাক্তার তাহিকে ডিভোর্স দিয়ে…
এবারের থা*প্পড় টা লিমনের নাক ফাটিয়ে দিয়েছে। গালের ঠিক কোনপাশে লেগেছে আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। থা প্প ড় ঘর থেকে পরিবর্তিত হয়ে সুলতানা মঞ্জিলের নাম থা প্পড় মঞ্জিল হয়ে গেলো। লিমনের নাক দিয়ে
র ক্ত ঝরছে। আঙুল তুলে শাহাদ শাসালো,
– বিয়ে করেছিস সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোর। বুঝে শুনে শাহাদের বোনের গায়ে নিজের নামের ট্যাগ লাগিয়েছিস। ভুলেও যদি জানতে পারি ওর এক ফোঁটা চোখের পানির কারণ তুই, জ্যান্ত ক/ব/র দিব সুলতানা মঞ্জিলের মাটিতে মনে রাখিস।
তাহির দিকে ফিরে বললো,
– বিয়ে যখন করেছিস নিশ্চয়ই সব জেনে করেছিস, লিমন শাহাদ ইমরোজের জানের টুকরা। লিমন বাচ্চা নয় যে ওর স্নেহের প্রয়োজন, স্বামী হিসেবে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা যেন ও পায়। তোর দ্বারা যদি আ ঘা ত পায় তবে শাহাদের সাথে তোর সেদিনই সব সম্পর্ক ছিন্ন হবে৷ ভুলে যাবি তুই শাহাদের বোন ছিলি।
হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো। পেছনে ফিরলোনা। দিয়ার মুখে হাসি। বাকিরা স্তব্ধ। মুখের বুলি হারিয়ে ফেলেছে। ঠান্ডা মাথায় সমাধান করে দিয়ে গেলো। তবে যে ঝড় তুলেছে সেই ঝড়ের ধাক্কা সকলে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৪৯.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
প্রতিটি মেয়ের জীবনে প্রথম পুরুষ তার বাবা। সন্তানের কাছে বাবা একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব। যার তুলনা শুধু বাবা নিজেই। বাবার জায়গা কারো পক্ষে দখল করার সাধ্য নেই। সব প্রশ্নের সহজ সমাধান বাবা। বাবা-সন্তানের বন্ধন অন্য প্রতিটি বন্ধনের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়,মজবুত। সুলতানা মঞ্জিলে সেই সম্পর্কে আজ চোট লেগেছে। ভাববার বিষয় চোট কতখানি গভীর?
মেয়ের মাথায় পানি দিতে ব্যস্ত দিয়া। সুলতানা কবির নাতনীর হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে। ছোটদের রাগ থাকেনা, কষ্ট হয়না, এতকিছু কি বুঝে এতটুকু বাচ্চা! এসব কথা শুনেই বড় হয় মানুষ নামক সামাজিক জীব। অতি অপ্রিয় মিথ্যা এটি। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক,বুঝদার মানুষ রাগ, দুঃখ এবং কষ্ট প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু শিশু পারেনা বোঝাতে। তার মানে এই নয় যে তার রাগ নেই,কষ্ট নেই। মানসিক কষ্ট ছোট থেকেই শুরু হয়। মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে শিশু কাল থেকে। তাদের কষ্ট প্রকাশ পায় অন্যভাবে। এই যে বাবার ধমক, রাগ, কোলে না নিয়ে তাচ্ছিল্য বাচ্চা মেয়েটার অবুঝ হৃদয়ে এমন ভাবে আঘাত দিলো শরীর কেঁপে জ্বর এসেছে। কেঁপে কেঁপে কাঁদছে ঘুমের মাঝে। হঠাৎ করে উঠে চিৎকার দেয়। মাঝে মাঝে বাবা ডাকে। সুলতানা কবিরের কান্না বন্ধ হচ্ছেনা। নাতনীর পাশ থেকে সরছে না। শাহাদের ফোন বন্ধ। দিয়া স্বাভাবিক আছে। সবাইকে হেসে বললো,
– এত চিন্তা করছেন কেনো আপনারা? মাঝে মাঝে বকা খাওয়া ভালো। বেশি আহ্লাদে রাখলে ঝামেলা। এখনি দেখেন যেই না ঝাড়ি দিলো অমনি জ্বর বাঁধিয়েছে। বড় হলে তো টু শব্দ ও করা যাবেনা।
রত্না ভেজা গলায় বলে,
– চুপ করো বৌমা। ওই দুই অপরাধীর জন্য আমাদের শেহজাটার এই অবস্থা। এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার দোষ হলো, সে লিমন-তাহির ভাইঝি।
__
মোমেনা এসেছে মেয়েকে সাথে নিয়ে রেদোয়ানের সাথে দেখা করতে। মনি হুইলচেয়ারে বসে আছে। টাকার প্রতি লোভ লালসা তো তার ছিলোনা। কাউকে ভালোবেসে এতটা নিচে নেমেছিলো যে একটার পর একটা ভুল করেছে,অন্যায় করেছে। পাপ কাজে লিপ্ত হয়েছে। নিজের চরিত্রে দাগ লাগিয়েছে।
অন্ধ ভালোবাসা বরাবরই খারাপ। শাহাদের দিকে হাত বাড়িয়ে যে ভুলটা করেছে তার মাশুল আজ পুরো পরিবারকে গুণতে হচ্ছে। চাইলে জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো। কারো কোনো ক্ষতি হলো না। যা হওয়ার নিজের হলো। বাবাও ঠকালো মাকে। এখন বড় বাবার আশ্রয়ে থাকতে হয়। বাবাকে জেল ছাড়ানোর কোনো উপায় জানা নেই। হত্যা মামলার আসামী রেদোয়ান। শুনেছিলো মুরাদ নামে বাবার একজন কাছের বন্ধু ছিলো। অথচ সেই বন্ধু ও তার স্ত্রীকে বাবা কিসের লোভে খুন করলো? শাহাদ জানে সেই কথা৷ এখন বাবার পাপের সর্বোচ্চ সাজা হবে। বাবার আদরের পরী আজ পথের ভিখারি।
বাবার সাহস বরাবরই বেশি ছিলো। অথচ মা মেয়ে ভেবেছে তা সৎ সাহস ছিলো। রক্তে এদের সাহস। কেউ সেই সাহস সৎ কাজে লাগিয়েছে আর কেউ অসৎ কাজে। সব কটা ভাই এক বাবার। রায়হান সাহেব ঠিক যতটা নিষ্ঠাবান ছিলেন, রেদোয়ান ছিলো বিপরীত। দুই পরিবার দু রকম শিক্ষা পেয়েছে। মনির সাজা হতে পারতো তাহিকে ফাসানোর দায়ে, ইয়াজের নামে রেইপের তকমা লাগানোর জন্য সর্বশেষ শাহাদের সম্মানহানির জন্য। মনিকে মাফ করে দিয়ে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ও বাড়ির মানুষজন। টাকার সম্পর্ক ছাড়া কেউ সম্পর্কে রাখতে নারাজ।
___
স্কেজেউল অনুযায়ী বিকেলের মিটিং,কাজ শেষ করে সবে মাত্র ফোন হাতে নিলো। রাগ করে আজ পাভেলের সাথে কথা বলছেনা। ওকে আসতে বারণ করেছে। মিটিং রুমে জ্যামার থাকার কারনে ফোনে নেটওয়ার্ক ছিলোনা, কারো সাথেই যোগাযোগ করা হয়ে উঠে নি। আন্তর্জাতিক আলোচনা ছিলো আজ মন্ত্রণালয়ে। সব সামলে হাঁপিয়ে উঠে মাঝে মাঝে। শাহীনের মেসেজ দেখে ঘাবড়ে গেলো।
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো মন্ত্রণালয় থেকে। ড্রাইভারকে বললো স্পিড তুলতে ৮০। বিকেল বেলা। রাস্তা ফাঁকা আজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুলতানা মঞ্জিলে পৌঁছাতে হবে। শাহীনের মেসেজ ঢুকার পর নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা৷
গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে নিচে। রায়হান সাহেব কিছুটা স্বস্তি পেয়ে বললো,
– এইতো শাহাদ এসেছে। এবার যদি আমার নাতনীটা শান্তি পায়।
মেয়েটা মায়ের কোলে। কারো কাছে যাচ্ছেনা। কিছু খেতে চাইছেনা। জ্বর একশ তিন। কয়েক বার বমি করেছে জোর করেছে খাওয়ানোতে। দিয়া হাল ছেড়ে চুপ করে বসে আছে।
ধুপধাপ পা ফেলে নিচ থেকে ছুটে এসেছে। যেভাবে দৌঁড় দিয়েছে বাকিরা বিচলিত হয়ে গিয়েছে। জান হাতে দিয়ে এসেছে। কে জানতো সকালের ঘটনা এত বড় রূপ ধারণ করবে? শাহাদ গায়ের ব্লেইজার ছুঁড়ে মে*রে শার্টের হাতা গুটিয়ে দিয়ার কোল থেকে শেহজাকে নিতে চাইলো। শরীর ছুঁতেই শাহাদ কেঁপে উঠলো। ধোঁয়া বের হবে এমন উত্তপ্ত গরম। ছোট্ট শরীরটা এই গরম কিভাবে সইছে? পিটপিট নয়নে মেয়েটা তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নেয়ার চেষ্টা। বাবার কোলে যেতে চাইছেনা। শাহাদ পুনরায় চেষ্টা করলো। এবার দিয়াকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরলো শেহজা। মুখ ঘুরিয়ে নিলো শাহাদ থেকে। শাহাদের চক্ষু ছানা বড়া। দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আসছেনা কেনো?
দিয়া কিঞ্চিৎ হেসে বললো,
– হয়তো ভ য় পেয়েছে বা রা/গ করেছে। সমস্যা নেই আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। স্বাভাবিক হয়ে যাবে ও।
শাহাদ ক্ষে পে উঠলো,
– অসম্ভব।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,
– আম্মা আসো। এইতো বাবা চলে এসেছি।
বাচ্চার ভেতর কতটা অভিমান জমেছে হয়তো এমন চিত্র না দেখলে কেউ বুঝতেই পারতোনা। চিৎকার দিয়ে কেঁদে মুখ ফিরিয়ে নিলো। খামছে ধরেছে দিয়ার শাড়ি৷ শাহাদের কলিজা ধক করে উঠলো। মেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো! মেনে নিতে পারছেনা শাহাদ। যেই মেয়ে বাবা ছাড়া কিছু বুঝেনা, বাবার পায়ের আওয়াজ শুনলেই খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়, দূর থেকে গলা শুনলে বাবা বাবা বলে চিৎকার দেয়, বাবার কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকে। বাবাকে পেলে যেই মেয়ে মাকে ভুলে যায়। বাবার শার্ট, পাঞ্জাবি, টি শার্ট জড়িয়ে ঘুমায়, আজ সেই মেয়ে বাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
মুহূর্তে মুখাবয়বে পরিবর্তন এলো শাহাদের। অসহায় চোখে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– সরো তুমি? আমার মেয়েকে আমার কোলে দাও।
দিয়া মুখটাকে অসহায় করে বললো,
– যেতে চাইছেনা তো আমি কি করবো?
শাহাদ জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইছে। এদিকে রায়হান সাহেব, সুলতানা সবার বারণ সত্ত্বে ও কাউকে তোয়াক্কা করছেনা এক্স কমান্ডার। সুলতানা বলছে,
– বাবু, মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না। ব্যাথা পাবে।
রায়হান সাহেব ও একই কথা বললেন,
– তুমি ফ্রেশ হও। ডাক্তার ডেকেছি। এসে একবার দেখে যাক।
কে শুনে কার কথা! শাহাদ বার বার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়ের দিকে কোলে নেয়ার জন্য। যত ধরছে মেয়ের কান্নার জোর বাড়ছে। জোর করে মেয়েকে কোলে নিলো। মেয়েটা কোলেই কাঁদছে অনবরত। নেমে যেতে চাইছে। ছটফট করছে নামার জন্য। গা উত্তপ্ত। মেয়ের চিৎকার শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না গম্ভীরমুখো এক্স কমান্ডার। কেঁদে দিলো উচ্চস্বরে সকলের সামনে,
– আম্মারে বাবা আর বকা দিবোনা। এমন করেনা তো আম্মা। বাবাকে মাফ করে দেন।
শেহজা আরো জোরে কাঁদছে। মেয়ের সাথে কাঁদছে বাবাও, চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। বাবা মেয়ের কান্নায় রুম ভারী হয়ে উঠেছে। বাকিরা ভীত শাহাদের অবস্থা দেখে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে মেয়ের কিছু হলে তো সে পাগল হয়ে যাবে! এমন ভাবে কথা বলছে নিশ্বাস যেন আটকে আছে। শাহাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে পাগলের প্রলাপ বকছে,
– আপনি এমন করছেন কেনো আম্মা? বাবা কষ্ট পাচ্ছে তো। বাবা ম*রে যাবো আম্মা আপনি মুখ ঘুরিয়ে নিলে। একবার বাবা বলেন আম্মা৷ অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আজ আমার মাকে বকে৷ আর কোনোদিন ও বকা দিবোনা। আপনি আমাকে বকা দেন, মা*রেন। তাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েন না আম্মা। কথা বলেন?
মেয়ের সারা শরীরে হাতে,মুখে আদরে ভরিয়ে তুলেছে। নেতিয়ে যাচ্ছে শেহজা। শাহাদ চিৎকার দিয়ে বললো,
– শেহজা…আম্মা কি হয়েছে?
মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে রুম থেকে। জ্বরের ঘোরে মেয়ে আরো বেশি জ্বালাচ্ছে। শাহীন পাভেল,কাব্য এবং লিমন ও পিছনে ছুটেছে। দিয়া খাটের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ,নির্বাক। শরীর চলছেনা। শাহাদ গেট দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে একটা রিকশায় চড়ে বসলো। হুঁশ হারিয়ে বসেছে শাহাদ। গাড়ি ফেলে রিকশায় উঠেছে। তার সাথে বাকিরাও দুইটা রিকশা নিয়ে শাহাদের পিছু নিলো। হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায় রিকশা।
ভয় পেয়ে মেয়েটার এমন হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে জ্বর এসেছে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জোর করে মেডিসিন খাইয়ে দিলো। সারাদিন কিছু না খাওয়াতে শরীর দূর্বল। বাসায় নিয়ে খাওয়ানোর পরামর্শ দিলেন। জ্বর কমার জন্য ঔষধ দিলেন। কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেই ঘুমিয়ে পড়লো বাবার কোলে। আশে পাশে মানুষজন আছে৷ বাইরে ভিড় ও আছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই দেখতে পেলো সব ভাইয়েরা সামনে। কথা না বাড়িয়ে চিন্তিত মুখে হেঁটে বেরিয়ে এলো৷ পাভেল উবার ডেকেছিলো। সবাই মিলে উঠে পড়ে। শেহজাকে বুকে চেপে রেখেছে। আর কত রাগ দেখাবে!
বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই বেরিয়ে এলো। থমথমে পরিবেশ সুলতানা মঞ্জিলের। সকলের অপেক্ষা সুলতানা মঞ্জিলের জান নিয়ে ফিরে আসার। মেয়ে অনেকটাই শান্ত বাবার কোলে। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সুলতানা কবির এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি অবস্থা বাবু? ডাক্তার কি বলেছে?
মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসেছে শাহাদ। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আম্মু আজকে আমার মেয়েটার কিছু হলে আমি সত্যিই ম*রে যেতাম।
চোখ মুখ লাল হয়ে আছে শেহজার। ভাপ যাচ্ছে শরীর দিয়ে৷ শাহাদের সাদা শার্ট ভিজে গিয়েছে নিজের ঘাম ও মেয়ের শরীরের উত্তাপে। বদলানো দরকার। অথচ মেয়েকে বুক থেকে সরাতে ইচ্ছে করছেনা। সকালে যেই কান্ড ঘটিয়েছে, সবার রা*গ মেয়েটার উপর ঝেড়েছে। এখনো শাহাদের চোখে পানি। শার্টের হাতায় চোখের পানি মুছে নিরবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি ম*রে যাবে এই মেয়ের কিছু হলে। শাহাদের সবটা জুড়ে এই শেহজা। মেয়েকে আদর করছে তৎক্ষণাৎ চোখ গেলো তাহির দিকে। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। উঠে দাঁড়ায় শাহাদ। তাহির সামনে যেতেই ওড়নায় মুখ মুছে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। এক হাত বাড়িয়ে দিতেই শাহাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে জোরে কেঁদে দেয়। কোলে শেহজা, আরেক পাশে তাহি। কাঁদতে কাঁদতে বলছে,
– আমি বুঝিনি ভাইজান আপনি এত কষ্ট পাবেন। আমি আর এমন কাজ করবোনা। আপনি ছাড়া কেউ নেই আমার। আমাকে মাফ করে দেন। বাবা নেই কখনো বুঝতে দেন নি আপনি আর খালুজান। আপনি যদি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন আমার কি হবে?
শাহাদ হালকা হেসে বলে,
– কান্না বন্ধ কর। যা হবার হয়েছে। আমি সবসময় আছি ইনশাআল্লাহ। যেভাবে যা করলে ভালো থাকবি তাই কর।
লিমনকে ইশারায় ডাকলো। গুটি পায়ে এগিয়ে আসলো। তাহিকে ছেড়ে লিমনকে বুকে নেয়। লিমনের চোখেও পানি তবে মুখে কথা নেই। বুকে চেপে ধরে বললো,
– আমি যা জানি তোর সম্পর্কে অনেকেই অনেক কিছু জানেনা। সেই জানা থেকে বড় ভাই হিসেবে আমি তোকে শুধু স্নেহই করিনা, শ্রদ্ধা ও করি। দুজনের সিদ্ধান্তকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভবিষ্যৎ তোদের হাতে। সাজিয়ে নেয়। অতীতকে মনে করে ভবিষ্যত নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। ঠিক আছে?
লিমন মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
– জ্বি ভাইজান।
দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে শাহাদ বললো,
– ঠিক আছে সবাই বসো আমি ফ্রেশ হয়ে নিই। শেহজা জন্য ভেবো না। ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
রুমের দিকে যাওয়ার আগে দিয়াকে ডেকে নিলো,
– ফারাহ্ রুমে আসো কথা আছে।
পুনরায় থেমে শাহীন এবং পাভেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কালই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ডাকো। সব ব্যবস্থা করো বাগানে। আমাদের ক্লোজ গেস্টদের ইনভাইট করো। ঘরোয়া বিয়ে পড়ানো হবে। আর এই ক্রিমিনাল দুটোকে আলাদা রুমে রাখার ব্যবস্থা করো।
লিভিং রুমে বোম পাঠিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো শাহাদ। বাকিরা থতমত খেয়ে গেলো। রায়হান সাহেব আর সুলতানা বেগম মুখ টিপে হাসছে। অন্যদিকে সাবিনা,রত্না গাল ফুলিয়ে বসে আছে। বাকিরা সবাই হো হো করে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খায় মত অবস্থা। মুহুর্তে পরিস্থিতি বদলে গেলো। সুলতানা কবির উঠে দাঁড়ায়। রায়হান সাহেবকে বলে,
– বাবুর বাবা সবাইকে ফোন দাও। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আর সাবিনা, রত্না আমার সাথে আসো কাজ আছে।
___
শিফা কালকের পর আজ বিকেলে এসে সব শুনে চুপ হয়ে গিয়েছে। ভাইজানের রিয়েকশন শুনে ভয়ে আশ পাশে থাকানো বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য দিকে পাভেল শিফাকে দেখলে পালাই পালাই অবস্থা।
ঘড়িতে এখন সন্ধ্যা। নওরীন,শিফা,শেফালী বাকি কাজিনদের ফোন দিয়ে চলে আসতে বলেছে আধ ঘন্টার মধ্যে। নিজেদের মাঝে প্ল্যান করলো ঘরোয়া একটা হলুদ আজই হয়ে যাক। শাহাদের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া শেষ। মঞ্জিলা রীতিমতো রওয়ানা দিয়েছে পরিবার নিয়ে। রেদোয়ানের সাজা শুনানির সময় দেশে এসেছিলো। যত যাই হোক ভাই বলে কথা। নিশাদ বউ এবং নিশিকে নিয়ে এসেছে বেশ কিছুদিন আগে। সুলতানা মঞ্জিল আবার আরেকটা বিয়ের সাক্ষী হতে যাচ্ছে।
___
মেয়েকে বুকে আগলে রেখেছে, সহাস্য বদন। কিছুক্ষণ পর পর মেয়ে বাবার গাল,নাক,চোখে চুমু দিচ্ছে। বাবাও মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে।
চোখ ফেরানো দায় এই ধূসর রঙা চোখের মানবের উপর থেকে। ভাবনায় যখনই হানা দেয় মানুষটি তার, মনের ভেতর প্রজাপতি উড়ে। গম্ভীরমুখো মানুষটি যখন তার ছোট্ট হাত পায়ে বেড়ে ওঠা মেয়ের সাথে ব্যক্তিগত আলোচনায় ব্যস্ত, তার ঘোরে বিভোর তখন ছোট্ট প্রানীর মা। মেয়ে এখন বেশ খানেকটা সুস্থ। বাবার উপর রাগ করে জ্বর বাঁধিয়েছে ছোট্ট প্রাণ খানা। রক্ত বলে কথা। কি প্রবল তেজ! কথা ছোঁয়ানো যাবেনা! খোদ শাহাদ ইমরোজকে ও এই মেয়ে গোল খাইয়ে দিলো। মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য যেই সময়টুকু বরাদ্দ ছিলো তাতেই এক্স কমান্ডার তার পোশাক বদলে এসেছে। দুটো ঘন্টা যাবৎ বুকে নিয়েই বসে আছে, এর মাঝে মেয়ের জ্বর ছেড়ে দিয়েছে। রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে মেয়ের সাথে। ছোট্ট পাখির মতো ঠোঁট আওড়ে হাজারো অভিব্যক্তি। একটু পর পর কিছু দূর্বোধ্য ভাষা উত্থাপিত করছে বাবার সামনে। মনে হচ্ছে যেন বকা দেয়ায় অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। কমান্ডার সাহেবের অবস্থা দেখে দিয়া হাসছে। মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তরে মুখের অবস্থা করুন করে দুঃখিত জানাচ্ছে । এই যেমন এখন মেয়েকে উত্তর দিচ্ছে,
– একদম আমার আম্মা সব ঠিক বলে। হ্যাঁ তাই তো বাবা পঁচা। দাদা… আচ্ছা দাদাকে বলবো বাবাকে বকে দিতে কেমন।
মেয়ে মাথা ঝাকাচ্ছে। দিয়া চক্ষু ছানা বড়া করে এদের বাপ-কন্যার অবস্থা পরোখ করছে ঠোঁট উলটে। আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধা দিলেই কেলেঙ্কারি হবে এমন অবস্থা। এক পর্যায়ে দিয়া বলে উঠলো,
– অনুগ্রহপূর্বক একটু কি তাকাবেন বাবা- মেয়ে?
দুজনই তাকিয়েছে একসাথে। হেসে দিয়া বললো,
– ধন্যবাদ পিতা ও কন্যা। কন্যার পিতা এই মেয়েকে কি সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিবেন?
স্ত্রীর কথা শুনে চিন্তিত ভঙ্গি করলো। যেন উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত। কিছুটা ভেবে বললো,
– দূরে যাওয়ার কারণ?
– মেয়েরা কি বাবার কাছে সারাজীবন থাকতে পারে?
শাহাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আম্মা, চলে যাবেন বাবাকে ছেড়ে? থাকতে পারবেন?
মেয়ে কি আর বুঝে!
অসহায় বদনে উত্তর দিলো,
– জানিনা কি করবো? সে অনেক পরের কথা। মেয়ের বাড়ির পাশে একটা ছোট্ট একটা টিনের বাড়ি বানিয়ে মেয়ের মাকে নিয়ে বাসা বাঁধবো। মেয়েটাকে সারাদিন নিজেদের কাছে রেখে রাতে জামাইর কাছে পাঠাবো। সহজ সমাধান।
– ইশ! আপনি কত আমাকে বাপের বাড়ি যেতে দেন…
– দিই না বলছো? ছিলেনা বুক খালি করে দু মাস?
– কোথায় বুক খালি ছিলো প্রতি সপ্তাহে চলে যেতেন।
– সে তো মেয়ের জন্য।
দিয়া ভ্রু কুচকে ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
– ঠিক আছে মাথায় রাখলাম।
রুম থেকে বের হয়ে যাবার প্রস্তুতি নেবে, সিংহের ন্যায় ক্ষীপ্র গতি চালিয়ে খপ করে হাত ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে মুখ জুড়ে। ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসি এমপি সাহেবের অধর কার্ণিশে। ফুঁ দিলো কেশবতীর ললাট জুড়ে থাকা চুলে। আর কত ঘোরে আচ্ছন্ন করবে মানুষটা। এভাবে আকর্ষিত করলে যে কোনো নারী প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যমুনার জলে গলায় কলসী বেঁধে ডুব দিতে চাইবে। এমন নয় যে স্বামী নতুন, তবুও কেনো ঘোর থেকে বের হয়ে আসা দুষ্কর। চোখের মনিতে যার প্রেম ভাসে, নাকের সূঁচালো ধার যেন বলে দিচ্ছে তার ব্যক্তিত্ব কতটা প্রখর। চোখের মোটা মোটা পুরুষালি পাপড়ির মোহে আটকে গিয়েছে মন। সাক্ষাৎ সর্বনাশ এই পুরুষ। দূরে থাকাই শ্রেয় নারী জাতির।
– যা বলিনা তা বুঝে নিতে পারোনা?
সেই ভারী কন্ঠস্বর। ঢোক গিলতেও গলা কষ্ট বোধ করছে। কি বুঝাতে চাইলো! কি বুঝে নিতে বললো? মাঝে মাঝে অতি দুষ্টু, কখনো কখনো রহস্য। পুনরায় শীতল মোহ জাগানো স্বর,
– মেয়ের চোখ দুটো ঢাকো।
ভ্রু কুচকে এলো দিয়ার। গাঢ় চোখের চাহনীতে কথা না বাড়িয়ে যা করতে বলা হয়েছে তাই করলো।
শক্ত অমসৃণ পুরুষালি এক হাত দিয়ার কোমড়ে, অন্যহাতে কোলের মেয়েকে শক্ত বেষ্টনীতে আবদ্ধ করেছে। দিয়া হাত দিয়ে শেহজার চোখদুটো ধরলো। একদিকে মেয়ে ছটফট করছে। অন্যদিকে বাবা মায়ের কোমল ও ষ্ঠে আলতো স্পর্শে স্ব-অধর ছুঁয়ে দিলো উষ্ণতা সমেত। চোখ দুটো আপনা আপনি বুজে এলো। বেশ কিছুটা সময় পর চট করে মেয়েকে নিয়ে সরে গেলো। হতবাক দিয়া। কি করে নেশা লাগিয়ে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। পুরোটা সময় ঘোরেই কে/টে গেলো অথচ অনুধাবন করতে পারেনি। শক্ত পোক্ত ব্যক্তিগত পুরুষটি আরাম করে হেডবোর্ডে মাথা এলিয়ে বললো,
– দিজ বার্মিজ গ্রেইপ ইজ মোর সুইট দেন এনি আদার গ্রেইপ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। নিড ইট রেস্ট অফ মাই লাইফ এজ মেডিসিন।
চলবে…