#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫৮.
(অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
থাপ্পড় যে এক ধরনের শিল্পতে রূপ নিয়েছে তা থাপ্পড় মঞ্জিল ওরফে সুলতানা মঞ্জিল না থাকলে অজানা থেকে যেতো। থাপ্পড়ের ধরন এক, শব্দের পরে যে অনুভূতি হয় তাও এক, হালকা জ্বলুনি লাগে গালে। মনে হয় যেন মরিচ বাটা লাগিয়ে দিয়েছে, কানের মাঝে জল তরঙ্গের মতো ভো ভো আওয়াজ করে অথবা একশ বছর আগে যে সাদাকালো টেলিভিশনে এন্টেনা নড়ে গেলে ঝিরিঝিরি আওয়াজ করতো তেমন করে। বেশি কিছু না মাঝে মাঝে বয়রা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে এই আর কি? আসল কথায় আসা যাক, আজকের থাপ্পড় থেরাপির যোগ্য প্রার্থী হিসেবে নাম লিখিয়েছে শাহাদ ইমরোজের ছোট বোন সাইদা রোজা শিফা। ধরাও খেয়েছে ভাইয়ের কাছে। গতদিনের খুশির সংবাদ পেয়ে সবাই যখন আহ্লাদে আটখানা, ঠিক তখনই খুশির মহল থেকে শিফা হঠাৎ গায়েব৷ শিফাকে খুঁজতে খুঁজতে তার বেডরুমে হাজির হয় শাহীন। বোনকে না পেয়ে বের হয়ে যাবে সেই মুহুর্তে চোখ গেলো বোনের টেবিলের উপর রাখা ডায়েরীর উপর যার ভাঁজে শুকনো লাল গোলাপ রাখা, কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। মেজর ভাইয়ের আনচান মন শান্ত হচ্ছেনা। হাসি মুখেই এগিয়ে গিয়ে দেখলো ডায়েরীর সব পাতাই সাদা। কিছু পাতা ছেঁড়া। সিক্স স্পাইডারদের চিফ। মনের মাঝে উদ্ভট চিন্তা আসাটা স্বাভাবিক। ডায়েরীর কোথাও লিখা নেই শুধু লাল গোলাপ ছাড়া। চেয়ার টেনে বোনের টেবিলে বসে একটা পেন্সিল নিলো। ডায়েরীতে ছেঁড়া পাতায় লেখার উপর আলতো স্কেচ করতেই ভেসে উঠলো প্রতিটি অক্ষর। প্রথমে অধরে হাসি থাকলেও শেষের নামটি পড়ে মেজাজ তিরিক্ষি হলো। প্রেম নিবেদন করে লেখা পাতা। মনে মনে দোয়া পড়ে ভাবলো, এই বোনটাও বুঝি উচ্ছ্বনে গেলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উপরে চিলেকোঠার ঘরে রওয়ানা হলো। বোন এবং বন্ধু দুজনকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে বোনকে ঠাটিয়ে এক চড় দিলো। বন্ধুর নাকে ঘুষি পড়লো। আকস্মিকভাবেই হুলস্থূল লেগে গেলো। শিফার গালে টানা দুটো চড় মারার পর ও যখন শান্ত হলো না, পাভেল তখন শাহীনের নাক বরাবর ঘুষি মে*রে হাত মচকে ধরে দমালো। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
– পাগল হলি বাই******দ কি শুরু করছিস? মেয়েটা ম*রে যাবে।
– আমার বোন আমি যা খুশি করবো তোর কি?
– আমার অনেক কিছু। শিফা বাসায় যাও। আমি কথা বলবো পরে।
ছুটে বেরিয়ে গেলো শিফা। শাহীনকে জোরজবরদস্তি করে রুমে রেখে দরজা আটকে দিলো পাভেল। ধমকে বললো,
– চুপ করে বস, শান্ত হ। বুঝিয়ে বলছি আমি।
– কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি।
– শুনতে হবে, ভুল বুঝেছিস তুই দোস্ত।
– কিসের দোস্ত। তোরা বন্ধুরা কি বোনদের দিকেই চোখ দিস? আর মেয়ে নাই? স্বভাব চরিত্র এত খা*রাপ কেনো তোদের?
পাভেল চিৎকার দিয়ে বললো,
– অনেক হয়েছে থাম। তোর বোনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
– আমি তো ভুল দেখেছি, তাই না? জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো? আর এই কাগজটা দেখ। তোর নামে প্রেমের ছড়াছড়ি। কেউ যাতে না দেখে ছিঁড়ে ও ফেলেছে।
– এক্সপ্লেইন তো করতে দিবি। এরপর শাস্তি দিস।
শান্ত হলো শাহীন। খাটে বসলো পাভেলের। পাশের চেয়ার টেনে বসে পাভেল ব্যক্ত প্রকাশ করলো,
– তুই থাপ্পড় দেয়ার আগে আমি একটা থাপ্পড় দিয়েছি। মেয়েটা কাঁদছিলো শাহীন। ঠান্ডা করতেই ওকে আগলে নিয়ে শান্ত করছি।
শাহীন তেঁতে উঠলো,
– তুই কেনো থা*প্পড় দিবি আমার বোনকে?
পাভেল বিষের শিশিটা বের করে শাহীনের হাতে ধরিয়ে বললো,
– মহান রব জানেন এই জিনিস কোথা থেকে পেয়েছে। এনে আমাকে বললো, পাভেল ভাই আপনি কেনো আমাকে পছন্দ করেন না। আমার কোনো পুরুষেই মন বসেনা। বান্ধবীদের অনেক বয়ফ্রেন্ড আছে। আমার ভালো লাগেনা। কলেজের ছেলেরা বয়ফ্রেন্ড হতে চায়। আমার ওদের ভালো লাগেনা। এসব বলছিলো।
শাহীন সন্দিহান চোখে বললো,
– বিষের শিশি এলো কিভাবে? তোকে কেনো ভয় লাগালো?
– যাতে আমি ওকে ভালোবাসি নয়তো ও বিষ খেয়ে নিবে। ক্রোধ সামলাতে না পেরে কষিয়ে চ ড় দিয়েছি। এসে তুই ও মা/রলি।
শাহীন নিশ্চুপ। পাভেলের মনে হলো শাহীনকে সে মনের অজান্তে ছোট করে ফেলেছে। বোন তো তারও আছে। সুরাইয়ার সাথে যখন নোমানের সম্পর্ক শুনলো বোনকে মে/রেছে অনেক বার। প্রতিটি ভাই চায় বোনের সুন্দর ভবিষ্যৎ। শাহীনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
– কাউকে কখনো বলিনি আজ তোকে বলি, বিশ্বাস কর শিফাকে আমি প্রচন্ড পছন্দ করি। মন থেকে বলছি। কিন্তু অসম্ভব ব্যাপার তাই চেপে গিয়েছি। মেয়েটা যতবার এসেছে ততবার বকেছি, ধমকেছি, ফিরিয়ে দিয়েছি। আজ যখন হাতে বিষের শিশিটা দেখলাম আমার মনে হলো আমার বুক ছিড়ে যাচ্ছে। হুঁশ হারিয়ে থাপ্পড় দিয়েছি। মা/রা/র পর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ফরসা চেহারার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। গালে আমার হাতের দাগ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বুকে টেনে নিলাম। নিজেকে আড়াল করতে এই বাড়ি আসতে চাই না। এজন্যই আমি থাকতে চাইনি চিলেকোঠায়। তুই জোর করলি বস নেই তাই এলাম। আমি এখনই চলে যাবো। আমার জন্য মেয়েটাকে আর মা*রিস না দোস্ত। ছোট একটা মুখ। এতগুলা থাপ্পড় হজম করেছে। দেখ অসুস্থ হয়ে না পড়ে।
শাহীন মাথায় হাত দিয়ে বললো,
– ভাইজান যদি জানতে পারে?
– মনে হয় আন্দাজ করেছে কিছু। আবার জানতে পারলে আমাকে নিজের হাতে পুঁতে দিবে।
– আমি তো তোকে বিশ্বাস করতে পারছিনা পাভেল। নোমান যা করলো?
পাভেল তাচ্ছিল্যের হাসি হসে বললো,
– ধুর পাগল, আমি কি বলেছি তোকে বিশ্বাস করতে। আমি বের হচ্ছি। খেয়াল রাখিস ওর। বাড়তে দিস না। বস ফিরে এসে এসব শুনলে খুব রাগ করবে। আমার কাছ থেকে ও কিছুই পাবেনা এতটুকু ভরসা রাখিস। ছোট মানুষ ভুল করছে। শুধরে নিবি সকলে মিলে।
ছাদের চিলেকোঠা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো পাভেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে নিরবে। নতুন ঝড় উঠবে নাতো? বন্ধুটাকে কষ্ট দিলো। পাভেল কখনোই বিশ্বাস ভাঙবেনা। বন্ধুর বিয়ে কিছুতেই বোনের সাথে দেয়ার অধিকার তার নেই। লিমন তাহির বিয়েতে যা করেছে। এরপর ভাইজান সম্পর্ক শেষ করে ফেলবে যদি জানতে পারে পাভেল- শিফাফ ব্যাপারে শাহীনের আগ্রহ আছে।
___
গ্যালাপাগোসে আজ তৃতীয় দিন। ঘুরে ফিরে দুদিন এভাবেই কাটিয়েছে। সারাদিন থেকে রাতেই রওয়ানা হবে, হঠাৎ করেই শাহাদ জানান দিলো। আজ সকলে মিলে এক দূর্দান্ত ঘটনার সাক্ষী হবে। শাহাদ জানিয়েছে সবাইকে স্নোর কেলিং করতে হবে। গ্যালাপাগোস এসে যদি মেরিন রিজার্ভ নাই দেখে এর সৌন্দর্য্য দেখা থেকে যে বঞ্চিত হবে। দিয়া ভয়েই আগাচ্ছেনা।
যে যার যার মতো করে এসেছে। শেহজাকে মল্লিকার কাছে দিয়ে দিয়াকে নিয়ে মাস্ক পরেই ঝাঁপ দিলো শাহাদ। পানির নিচে ডুবে থাকাটা দিয়ার জন্য খুব স্বাভাবিক। জড়িয়ে শক্ত পোক্ত পুরুষালি হাতের বাহুতলে আবদ্ধ ছোট হাতটি। আশপাশে সব রঙিন মাছের ঘুরাঘুরি। মাথা উঠালো দুজন। লক্ষ্য করলো হাসের মত একটা পাখি ডুবে ডুবে মাছ খাচ্ছে। শাহাদ দিয়াকে নিয়ে কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলো। অতটা কাছে যায়নি যতটা গেলে পাখিটির মনে হতে পারে মানুষ তার ক্ষতি করছে। শাহাদের মনে হলো এত গ্যালাপাগোস পানকৌড়ি। পৃথিবীতে অসংখ্য পানকৌড়ি রয়েছে তার মধ্যে একমাত্র গ্যালাপাগোস পানকৌড়ি উড়তে পারেনা।
সাগরের তলদেশের মুগ্ধতা উপভোগ করে দুজন যখন তীরে উঠে এলো মাস্ক খুলেই দিয়া খুশিতে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো,
– আপনি না থাকলে আমি জীবনেও এত সুন্দর কিছু দেখতে পেতাম না এমপি সাহেব। কিভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি বলুনতো?
কানের কাছে ফিসফিস করে এমপি বলে উঠলো,
– কিছু চাইলে পাবো?
দিয়া সজোরে মাথা ঝেঁকে বললো,
– অবশ্যই, যদি আমার সাধ্যে থাকে।
– ইনশাআল্লাহ চেয়ে নিব। তবে এখন তুমি ভয়ে চিৎকার দিবে তার আগেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো।
বিস্ময় নিয়ে তাকালো দিয়া এমপির দিকে। দুবার পলক ঝাপটে বুঝার চেষ্টা করলো। মনের কোণে ভয় ভয় লাগছে, কিছু কি খারাপ ঘটবে! দিয়া আশপাশটা ভালো করে দেখছে। লজ্জা লাগছে জড়িয়ে ধরতে। মানুষ আছে অনেক। হঠাৎ চোখ গেলো বৃহৎ এক টিকটিকি বা গিরগিটি প্রজাতির প্রানীর দিকে। চিৎকার দিয়ে উঠলো। লাফিয়ে শাহাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ইয়া আল্লাহ, এটা কি?
শাহাদ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। দিয়া এক পর্যায়ে কেঁদে দিলো। এই গিরগিটি সামনের দিকে এগিয়ে আসছে পা ফেলে। শাহাদ দিয়াকে পাঁজকোলে তুলে বললো,
– বোকা মেয়ে কাঁদছো কেনো? এটাই সেই মেরিন ইগুয়ানা। ড্রাগন প্রজাতির একটি উভচর প্রানী যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই প্রজাতি হিংস্র নয়। এরা জলে এবং স্থলে দুই জায়গায় বাস করে। এরচেয়ে ভয়ানক এক বৃহদাকৃতির টিকটিকি বা গিরগিটি আছে যা কমোডর ড্রাগন নামে পরিচিত। শুধুই ভয়ানক নয় হিংস্র ও মাংসাশী বটে। মেক্সিকো এবং ব্রাজিলে পাওয়া যায়। মেরিন ইগুয়ানা শান্ত, তৃনভোজী প্রাণী। এরা কোনো ক্ষতি করবেনা।
কথা বলতে বলতে অনেক টাই এগিয়ে আসে শাহাদ। শাহাদ দিয়াকে নামিয়ে দিয়ে বললো,
– জানো ফারাহ্, গ্যালাপাগোস নামকরণ কে করেছে?
– কে?
– চার্লস ডারউইন। তার বই ভয়েজ অফ দ্য বিগল এ লিখেছিলেন তার পাঁচ বছরের ভ্রমণযাত্রার কথা। পৃথিবী ভ্রমনের কথা আছে সেই বইতে। দারুন সব জানা অজানা বিস্ময়কর তথ্য । তিনি গ্যালাপাগোসে দু সপ্তাহ ছিলেন। এই যে দেখতে বিশাল দৈত্যাকার কচ্ছপ, সাগরের এই গিরগিটি যা মেরিন ইগুয়ানা, অদ্ভুত সব পাখি যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। এসব নিয়েই ছিলো তার কাজ।
– আপনি এত কিছু কিভাবে জানেন? মনে তো হয় আপনি ডারউইনের পাশে ছিলেন যখন সে গবেষণা করছিলো।
শাহাদ হো হো করে হেসে বললো,
– নেভি কর্মকর্তা আমি, সাগরে,দ্বীপে দিন কেটেছে। আর দ্বীপ সমন্ধে জানবোনা তা কি হয়? আচ্ছা বাদ দাও। ওদিকে দেখো একটা সী লায়ন। দেখেছো কখনো?
দিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
– আল্লাহ এগুলো তো টিভিতে দেখেছি। এত্ত সুন্দর কেনো?
শাহাদ প্রেয়সীর উচ্ছ্বাস দেখছে। মৃদু হেসে বললো,
– ফারাহ্, আমার ছানা আর তোমাকে নিয়ে না এলে হয়তো আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম ট্রিপটা মিস করে ফেলতাম।
– আর আপনাকে না পেলে আমার অসম্পূর্ণ জীবনটা শূণ্যতায় শেষ হয়ে যেত।
দিয়ার গাল টেনে শাহাদ বললো,
– একটা মজার জিনিস দেখবে?
– হুম হুম।
শাহাদ একটা পাখি এবং সী লায়নের মাঝখানে গিয়ে বসলো। দিয়া ভীত হয়ে কিছুটা ছিটকে গেলো। শাহাদের দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই এই দুই প্রাণীর। ঠিক তখনই শাহাদ বলে উঠলো,
– ফারাহ্ আই থিং আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে এদের আর মানুষের মাঝে যে নির্ভয় দৃশ্য তৈরি হয়েছে তা একটি। একটুও ভয় পাচ্ছেনা আমাকে। নিজেদের মত করে খেলছে। পাখিটার তো আমাকে দেখে পালানোর কথা। অথচ সে নিজের মত পাতার উপর খেলছে দেখো।
দিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ভয় অনেকটাই কমে এসেছে। দ্বীপের এমন মোহনীয় পরিবেশ পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে। শাহাদ পাশে এসে বললো,
– চলো, রোদ পড়ছে। ফিরতে হবে। মিস করবো দ্বীপকে তাই না?
– অনেক। আমার জন্য সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে।
কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলো ক্রুজের দিকে। ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে। সকলের কাছে একটি স্মৃতিময় ভ্রমণ হয়ে থাকবে গ্যালাপাগোস। সানক্রিস্টোবালে ফিরেই ইকুয়েডরের ফ্লাইট ধরে সোজা আমেরিকা এরপর বাংলাদেশ। আজ রাতেই সানক্রিস্টোবালের ফ্লাইট। কাল সকাল নাগাদ বাংলাদেশের ফ্লাইট ছাড়বে।
___
রত্নার শরীর টা বেশ খারাপ। রাতের খাবার আগে খেয়েই শুয়ে পড়েছে। তাহি জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। আজ ডিউটি নেই। লিমন অফিসের মিটিংয়ের কাজে গত দুদিন সিলেট। বাসায় থাকলে তাহির পেছন পেছন ঘুরে। এটা সেটা বলে জ্বালিয়ে তোলে। আজ দুদিন কেমন যেন খালি খালি ঘরটা। কিছু পেশেন্ট এর শর্ট কেইস দেখতে দেখতে ঘড়িতে এখন প্রায় দেড়টা। চেয়ারের উপরই ঝিমিয়ে গিয়েছে। কলিংবেলের আওয়াজ আসছে কানে। ধড়ফড়িয়ে উঠলো। এত রাতে কে আসবে। ভয়ে ভয়ে দরজার সামনে গিয়ে ডোর ভিউতে চোখ রাখলো। পুরুষ মানুষের অবয়ব। ঘুম ঘুম চোখ কচলে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলো লিমন। দরজা খুলে দিলো। লিমন তাহিকে দেখে সালাম দিয়ে হেসে বললো,
– স্যরি ঘুম ভাঙিয়ে দেয়ার জন্য। বুঝিনি এত রাত হবে না হয় কাল সকালে আসার মতো করে রওয়ানা দিতাম।
– আসুন। সমস্যা নেই। আমি কাজ করছিলাম। ঘুম গভীর হয় নি।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে লিমন বললো,
– আপনি যান শুয়ে পড়ুন। আমি দরজা আটকে দিচ্ছি।
তাহি দরজা ছেড়ে দিলো। লিমন দরজা আটকে জুতা মোজা খুলে ব্যাগ রেখে ডাইনিং এর ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো। রুমে আওয়াজ হলে আবার তাহির ঘুম ভেঙে যায় যদি। মেয়েটার চোখে ঘুম ছিলো। হাত মুখ ধুয়ে রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো তাহি বেডের উপর লিমনের টিশার্ট ও ট্রাউজার গুছিয়ে রেখেছে। খাটের উপর গুছানো কাপড় দেখে মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো পড়ার টেবিলের উপর খাবার ঢেকে রাখা। লিমন ঢাকনা উলটে দেখলো সাদা পোলাও সাথে মুরগীর রোস্ট, সবজি, টমেটো চাটনী এবং সালাদ। খানিকটা হেসে বললো,
– বাসায় কি কারো দাওয়াত ছিলো?
তাহি হেসে লিমনের পাশে চেয়ার টেনে বসে বললো,
– আপনি যে কারণে এত রাতে সিলেট থেকে ছুটে এসেছেন, সেই কারণে মা রান্না বান্নার আয়োজন করেছেন।
লিমন খাবার মেখে তাহির মুখের সামনে তুলে ধরেছে। ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
– শুভ জন্মদিন ডাক্তার তাহি।
তাহি খাবার মুখে নিয়ে বললো,
– আমার উপহার?
লিমন খেতে খেতে বললো,
– খেয়ে উঠে দিব। খাবার খুব মজা হয়েছে। জানলেন কি করে আমি আসবো?
– আপনি আমার জন্মদিনে থাকবেন না তা হতেই পারেনা। রান্না করার কথা ছিলো আজ। মা বলেছিলেন। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছিলো না তাই রাতেই রাঁধলাম। বেশি কিছু করতে পারিনি। আপনি সাদা পোলাও আর রোস্ট পছন্দ করেন ওটাই করলাম।
লিমন আরেক নলা তুলে দিয়ে বললো,
– আমার জন্য বসে না থেকে খেয়ে নেয়া উচিত ছিলো।
তাহি হেসে বললো,
– হসপিটালেই তো থাকি। সময় দিতে পারিনা বাসায়। আপনি যতক্ষন থাকেন যত্ন করেন। এতটুকু সুযোগ হারাতে ইচ্ছে হলোনা। তাই খাইনি। একসাথে খাব বলে।
লিমন হাসছে। তাহি অধীর আগ্রহে লক্ষ্য করে দেখলো বছর খানেক আগের লিমন এবং এই লিমনে বিষদ তফাৎ। এই লিমন ম্যাচিউর। এই লিমন পরিস্থিতি সামলে নিতে জানে। তাহিকে আগলে রাখতে জানে। সবার আগে তার কাছে গুরুত্ব পায় তাহি।
ব্যাগ থেকে একটা মনিপুরী শাড়ি বের করলো লাল রঙের। কিছু গয়না, আর ঊনত্রিশটা গাঁদা ফুলের একটা লহর। তাহি সাথে সাথে মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,
– আপনাকে দিয়ে সব সম্ভব। এই গাঁদার লহর পেলেন কোথায় এই রাতে?
– সিলেট থেকে নিয়ে এরপর রওয়ানা দিয়েছি। এই ফুল ভালো থাকবে আশা করছি। ভালো না থাকলে কাল আবার কিনে দেব। ভাইজান আসবে কাল। ছোট করে উদযাপন করবো আমরা। শাড়ির সাথে ফুল পরবেন খুব ভালো লাগবে আমার।
– আচ্ছা।
লিমন আমতা আমতা করে বললো,
– একটা কথা বলি?
– হুম।
– লাইট টা বন্ধ করবেন। একটু রেস্ট নিব। আপনিও শুয়ে পড়ুন।
– শরীর বেশি খারাপ লাগছে?
– খারাপ লাগছেনা। অভ্যাস আছে জার্নির। তবে ক্লান্ত।
তাহি বাতি নিভিয়ে দিলো। লিমন ফোনে মেইল চেক করতে করতে বললো,
– বুঝলেন তাহি, সেদিন যদি ছুটে না যেতাম কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। কি পরিমাণ টেনশন নিয়ে ক্লায়েন্ট ডিল করতে হয়েছে।
লিমনের বস ফোন দিয়েছে। ভেবেছিলো একটু বিশ্রাম নিবে তাও পারলোনা। হয়তো এত রাতে এসে ঠিক ভাবে বাসায় পৌঁছাতে পেরেছে কিনা জানতে ফোন দিয়েছেন। কথা শেষ করে লিমন ঘাড় ঘুরিয়ে তাহিকে বললো,
– কোথায় গেলেন? কি এত কাজ করছেন এখনো না শুয়ে…
আর শেষ করতে পারলোনা। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে একান্ত নারীর দিকে। লাল মনিপুরী শাড়িতে এতটাও মোহনীয় লাগবে লিমনের চিন্তার বাইরে ছিলো। খোঁপায় ফুল গুলো যেন হলুদ আভা ছড়াচ্ছে কামরা জুড়ে। নির্বাক লিমন শুকনো ঢোক গিলে উঠে বসলো। হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। অনুভূতি শক্ত পোক্ত ভাবে নাড়া দিচ্ছে। উঠে দাঁড়ায়। তাহিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রুম থেকে বের হতে যাবে তাহি হাত আকড়ে ধরে বললো,
– আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। আমাকে কেউ কিছু বুঝায় ও নি। আমি নিজেই লাইফে এগিয়ে যেতে চাইছি এবার।
– পরে আফসোস হলে?
– আপনাকে ভালোবাসার চেষ্টা করাতে আফসোস হবে বলছেন?
– হতেও পারে?
– হবে না। আমি যাদের ভালোবাসি সবটা দিয়ে বাসি। আপনার ও অধিকার আছে আমার উপর। জোর খাটান নি তো আজ অবধি। তাহলে সম্মান টুকু দিতে আমার আপত্তি থাকবে কেনো?
– সবসময়ই তো বলেন, বয়সে আপনার চেয়ে ছোট।
– সত্য নয় কি?
– সত্য।
– তবে?
– ঘুমিয়ে পড়ুন আপনাকে সুন্দর লাগছে।
– আমার দিকে তাকিয়ে বলুন।
– সাহস নেই।
তাহি কামরার বাতি জ্বালিয়ে সামনে চলে এলো। লিমন মুগ্ধ হয়ে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তাহি হেসে লিমনের মুখ তাহির দিকে ফেরালো। লিমন মাথা নুইয়ে ফেললো। তাহি লিমনের থুতনি ধরে মাথা উঠালো। লিমন খানিকটা রুঢ় হয়ে বললো,
– আপনার কি আমাকে ফিলিংসলেস মনে হয়? সরুন।
– হুম হয়। দ্য পারসোন, ডাজেন্ট হ্যাভ ফিলিংস ইজ কলড আন রোমান্টিক।
লিমন ক্রোধান্বিত চক্ষুতে তাকিয়ে বললো,
– আমাকে প্রোভোক করে আপনার কি লাভ হচ্ছে? অপমান করছেন তাই না আনরোমান্টিক বলে? কিভাবে কাউকে অপমান করতে হয় আপনারা ডাক্তাররা ভালোই জানেন। আন রোমান্টিক ট্যাগ সহজে লাগানো যায়, আমার যে কত পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তা পরিমাপ করার যন্ত্র আছে আপনার কাছে? এভাবে সেজে গুঁজে আমার সামনে তখনই দাঁড়াবেন যখন আপনাকে ছুঁতে দিবেন এর আগে নয়। সত্যি কথা শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। এখন সরুন জায়গা দিন বের হবো।
লিমন রুম থেকে বেরিয়ে যাবে, তার আগেই তাহি বলে উঠলো,
– আমি বারণ করলাম কখন?
দরজার সামনে এসে থমকে গেলো লিমনের পদচারণ। মনে হলো ভুল শুনেছে। তবুও অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় বার শুনতে। ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
– অনুমতি ও তো দেন নি।
– আপনি স্বশিক্ষিত, আমিও স্বশিক্ষিত। অধিকার ফলাতে আসলে অবশ্যই বাঁধা দিতাম না। এত দিনে এত টুকু বুঝে নিলেন না কেনো আমার আচরণে? অসদাচরণ তো একটিবারও করিনি।
লিমন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মনে হচ্ছে পা দুটো অবশ। তাহি সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চাচ্ছে এ যেন আকাশের চাঁদ পাওয়া। সংশয় কাটিয়ে লিমন এগিয়ে এসে তাহির আনত মুখটা আজলে তুলে বললো,
– আমি স্যরি। বুঝতে পারিনি আপনার কষ্ট গুলো। মাফ করা যায় না এই গর্দভকে?
চোখ বেয়ে পড়া প্রেয়সীর পানি মুছে দিচ্ছে লিমন, অপরদিকে তাহি নাক টেনে বলে,
– কেনো মাফ করব? কষ্ট দিলেন কেনো? আপনি কি ছোট যে কথা বুঝেন না।
হঠাৎ লিমন হো হো করে হেসে উঠলো। তাহি তব্ধা খেয়ে বললো,
– আস্তে… মা উঠবে।
লিমন হাসি থামিয়ে বললো,
– আমাকে কে যেন বলতো আপু ডাকবে। আমি তোমার থেকে বড়ো।
রাগে গাল ফুলিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো লিমনকে। রুমের বাতি নিভিয়ে ধুপধাপ করে শুয়ে পড়লো তাহি। হাসতে হাসতে তাহির পাশে শুয়ে পড়লো। সংকোচ কাটিয়ে এই প্রথম প্রিয় নারীর কোমর ধরে কাছে টেনে ঘাড়ে মাথা রেখে প্রেয়সীর ডান গালে উষ্ণ অধর ছুঁয়ে গেয়ে উঠলো,
– এই দিন যদি না থামে
এই রাত যদি না শেষ হয়
তুমি নীলচে কোন খামে
আমায় মোড়ালে বেশ হয়
পড়ে যাচ্ছি যেন তোমারই নেশায়।
লিমন কি আর গুটায় তার সত্ত্বাকে ভুলে? ফিরে এসেছে পুরোনো সত্ত্বায়। আষ্টেপৃষ্টে মুড়িয়েছে প্রেয়সীকে ভালোবাসায়।
চলবে…
#সায়রে_গর্জন
#নীতি_জাহিদ
৫৯.
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে দশটা। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে মেরুন রঙা রেঞ্জ রোভার। গেট খুলে গিয়েছে। সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত। পা ফেলে গাড়ি থেকে নামতেই শাহীন ছুটে এলো। ঝাঁপিয়ে পড়লো ভাইয়ের বুকে। কিছুক্ষন ভাইকে ধরে ছিলো। শাহাদ পিঠ চাপড়ে বললো,
– অভিনন্দন মেজর। আমি খুব খুশি হয়েছি।
নওরিন কাছে এসে শাহাদকে পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাইলো। সালাম করতে না দিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো,
– পা ছুঁবে না। আমার দোয়া সবসময় তোমার জন্য।
দিয়াকে জড়িয়ে ধরতেই দিয়া আনন্দে বলে উঠলো,
– আমি যে কি খুশী আপু, আমি বড় মা হব। সারা রাস্তা এমপি সাহেবকে এই একটাই কথা বলেছি।
নওরীন লজ্জা পাচ্ছে। সবাই তাকে মাথায় তুলে রাখছে। কোথাকার নওরীন আজ কোথায়, স্বামী শ্বশুরঘর সব নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতে আছে।
বাবা- মাকে জড়িয়ে ধরে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করছে শাহাদ-দিয়া দম্পতি। দিয়া শাশুড়ীর বুকে। এদিকে শেহজা ফুফি, চাচীদের কোলে ছুটেছে। সুলতানা মঞ্জিলের লিভিং এরিয়া আজ আবার প্রাণোচ্ছল। সকলের আড্ডার মাঝে শাহাদ শিফাকে কাছে ডাকলো। ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে বাচ্চা? মন খারাপ কেনো? অসুস্থ?
– না ভাইজান।
শাহাদ সবার দিকে তাকাতেই সুলতানা কবির বলে উঠলো,
– বাদ দাও তো বাবু, ওর নাখরা উঠাতে উঠাতে বাড়ির সবাই বিরক্ত। যাও বৌমা ফ্রেশ হয়ে নাও। অনেকটা জার্নি হয়েছে।
শাহাদ মাকে উপেক্ষা করে বোনকে বুকে টেনে আদরে স্নেহে প্রশ্ন করলো,
– বল তো বাচ্চা, কি হয়েছে? আমার ফুলটার মন খারাপ কেনো? ভাবীজান তো অনেক জিনিস এনেছে।
শিফা হালকা হেসে বললো,
– তাহলে যাই ওগুলো দেখে আসি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ভাইজান।
ছুটে গেলো দিয়ার পিছু পিছু। শাহাদের কেনো যেনো ব্যাপারটা ভালো ঠেকলো না। ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ঝুলিয়ে ঘরের কিছু মানুষকে পর্যবেক্ষন করে উঠে নিজ কামরায় চলে গেলো।
___
শেহজাকে ফ্রেশ করে দেয়ার পর থেকে ছুটে বেড়াচ্ছে সবার কোলে। দিয়া সুতি শাড়ি পরে গোসল করে বের হলো। রুমে এসে দেখলো শাহাদ নেই। নিজেও বেরিয়ে এলো। অনেক দিন পর বাড়ির সবাইকে পেয়ে ভীষণ খুশি।
তাহি এসেছে। তাহিকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। ভাবীজানকে পেয়ে খুশিতে উচ্ছ্বসিত। গেটের সামনে তাহিকে ড্রপ করে লিমন গিয়েছে কি যেন কাজে। এর মাঝে ড্রইং রুমে বসেছে আড্ডা। গল্প আড্ডা কোলাহলে আজ ভরপুর সুলতানা মঞ্জিল। তাহি লিমনকে ফোন দিতেই প্রথমবার রিসিভ হলোনা। পরের বার রিসিভ হতেই ও পাশ থেকে এমন কিছু শুনলো যা অপ্রত্যাশিত ছিলো। চিৎকার দিয়ে হেলে পড়লো তাহি, ছুটে এলো বাড়ির সকলে। শাহীন তাহির হাত থেকে পড়ে যাওয়া ফোন হাতে নিতেই দেখলো এখনো লাইনে আছে। কানে দিতেই ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ। শাহাদ ছাদ থেকে নেমে বাড়ির এমন পরিবেশ দেখে হতবাক। প্রশ্ন করলো,
– কি হয়েছে মেজর?
শাহীন ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ভাইজান লিমনের স্পট ডেথ হয়েছে।
– মাথা ঠিক আছে তোমার? কি বলছো এসব।
– পুলিশ জানালো। ওর লাশ আর ফোন দুটোই পুলিশের হেফাজতে।
সবার কথা ছেড়ে তাহিকে জড়িয়ে ধরলো শাহাদ। চেঁচিয়ে বললো,
– আগে নিশ্চিত হও। স্পট ডেথ! এটা কি মুখের কথা যে বললাম আর সবাই মেনে নিলো! যাও কি হয়েছে দেখো। তাহি দেখি ছুটকি, ভাইজানকে দেখ। কিচ্ছু হয়নি…
ভাইয়ের বুকে থেকে দুটো লাইন বললো,
– লিমনও চলে গেলো ভাইজান। কেনো কেউ আমার থাকেনা।
বোনকে চেপে ধরে শাহাদ চেঁচাচ্ছে সবার সাথে। কান্নার রোল পড়ে গিয়েছে কামরায়। এদিকে রায়হান সাহেব রুম থেকে ছুটে এসেছে, সুলতানা কবির কাঁদছে। শোক যেন লিভিং রুমটাকে ঘিরে ফেলেছে। শাহীন বের হবে তখনই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। শিফা দরজা খুলতেই জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– ভূত…
ছুটে এসে বলে,
– লিমন ভাইয়ার ভূত।
সবাই সুস্থ সবল লিমনকে দেখে হতবিহ্বল। লিমন বাড়ির এই অবস্থা দেখে চমকে বললো,
– কি হয়েছে? বড় আম্মু কাঁদছেন কেনো? ডাক্তার তাহি আপনার কি হয়েছে?
তাহি যেন হুঁশ ফিরে পেলো। সব ফেলে ভাইজানের কাছ থেকে সরে ঝাঁপিয়ে পড়লো লিমনের বুকে। এদিকে বেচারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। শাহাদ গম্ভীর মুখে শাহীনের দিকে তাকালো। সুলতানা কবির এগিয়ে যেতেই আরেক হাতে লিমন বড় আম্মুকে বুকে টেনে নিলো। চিন্তিত মুখে বললো,
– ইয়া আল্লাহ কি এমন হয়েছে, এত ভালোবাসা কেনো আমার জন্য?
শিফা বলে উঠলো,
– তুমি না ম/রে গেছো? উঠে আসছো কি করে?
আঁৎকে উঠলো লিমন। শব্দ করেই বললো,
– ইন্না-লিল্লাহ। আল্লাহ আল্লাহ রহম করো। কি বলিস শিফা।
শাহীন ধমকে বলে,
– হা*** জাদা তোর ফোন কই?
– আরেহ বইলো না। মিষ্টি কিনতে গেলাম। পাশে ফোন রেখে টাকা দিচ্ছিলাম দোকানদারকে। এক চোর এসে ফোন নিয়ে দিলো দৌড়। ওই শালার পেছনে ছুটেও পেলাম না। দেখো হাত কে*টে গিয়েছে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে। পরে আর খুঁজে না পেয়ে এদিকে চলে এলাম। মিষ্টি রাখলাম টেবিলের উপর। ফোনটাই গেলো আমার। পুরান ফোন আমার, এত আফসোস নাই।
রায়হান সাহেব খেঁকিয়ে উঠলেন,
– তুই আছোস মিষ্টি নিয়ে, এদিকে তোর বড় মা, বউ,বোনরা সব শোক করছে।
শেফালী সকলের সামনে হঠাৎ হেসে উঠলো,
– ও তাহলে ফোন চোর ম/রছে তুই না?
ধমকে উঠলো শাহাদ,
– যেই মা*রা যাক, হাসির কিছু দেখছিনা। চোরের জায়গায় লিমন থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছু ছিলোনা। দোয়া করো যে ও সুস্থ আছে। ফোনের উপর দিয়ে গিয়েছে। জান বেঁচেছে আলহামদুলিল্লাহ। লিমন ফ্রেশ হয়ে নাও।
শাহাদ উঠে নিজ কামরায় যাওয়ার আগে তাহি এবং লিমন দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– এভাবে থেকো দুজন। ভালো লাগছে তোমাদের দেখে।
শাহাদ ভেতরে ঢুকতে শাহীন পিঠের উপর কিল দিয়ে বললো,
– কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো আল্লাহ। কলিজায় পানি ছিলোনা।
লিমন সোফায় বসে তাহির দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে এখনো পানির দাগ। তবে কি তার বউ তার জন্য কাঁদলো? সম্পর্কটা ধীরে ধীরে শক্ত পোক্ত হচ্ছে তবে।
সুলতানা কবির তাহিকে বললো,
– লিমনকে রুমে নিয়ে যা। হাতটা ড্রেসিং করে দেয়। আমি খাবার পাঠাচ্ছি।
___
– বেরিয়ে পড়ো।
আদেশের স্বর ফোনের ও পাশ থেকে কানে বাজতেই যার যার কাজে বেরিয়ে পড়লো। সেই প্রতিক্ষিত প্রভাত। আগামীকাল উন্মোচন হবে নতুন দ্বার।# সায়রে_গর্জন পুনরায় উঠবে। খুলেছে পুরোনো সব মুখোশ। আজ রাতের আঁধারে সুসজ্জিত হবে পুরোনো প্রাঙ্গন। সম্মুখে ফিরবে প্রাণোদিত ব্যক্তি সকল গোপনীয়তা ভেঙে।
__
ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠছে বার বার। শেহজা উঠে কাঁদছে। মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে পাশ ফিরে দেখে মানুষটা নেই। চোখ কচলে নেমে পড়লো খাট থেকে। ওয়াশরুমের দরজা খুলে গেলো। ঘড়িতে পাঁচটা। বুঝতে পারলো সালাত আদায়ের জন্য উঠেছে। দিয়া খানিকটা হেসে নিজেও ওযূ করে আসলো। এসে দেখে দুটো জায়নামাজ বিছানো। স্বামীর পেছনে সালাত আদায় করলো।
শাহাদকে শুধালো,
– চা বানিয়ে দিবো?
– আমি নিয়ে আসছি। তুমি বসো। দেখে মনে হচ্ছে জেট ল্যাগ লেগেছে তোমার। রেস্ট নাও।
– তা একটু আছে। চলুন আমিও যাবো কিচেনে।
কিচেনে যেতেই শাহাদ চায়ের পানি বসাতে বসাতে বললো,
– আজকে টিভিতে যদি কোনো এলোমেলো সংবাদ দেখতে পাও একদম বিচলিত হবে না কেমন?
– কেমন সংবাদ?
– পদত্যাগ করেছি।
দিয়ার মুখে হাত। হতভম্ব হয়ে মাথায় হাত রেখে বললো,
– ইয়া আল্লাহ কেনো?
– কি করবো এত পাওয়ার দিয়ে। চারদিকে শত্রু বাড়িয়েছি। একটু শান্তি চাই। আমার কাজ হয়ে গেছে। রাশেদের কেইসের সমাধান হয়েছে।
– কি করবেন এবার?
হাসছে শাহাদ। কথা বলতে বলতে পানি ফুটে গিয়েছে। দুটো টি ব্যাগ বের করে চুবিয়ে দিয়ে দিয়ার দিকে এক কাপ বাড়িয়ে বললো,
– দিন রাত লটকন আর স্ট্রবেরি খাব।
মুখ ঘুরিয়ে দিয়া হাসিটাকে আড়াল করে পুনরায় বললো,
– আগে তো এমন ছিলেন না এমপি…
– এখন আর এমপি নেই, কি ডাকবে ভেবে নাও।
– যাই ডাকি তাই নাই হয়ে যায়, শেহজার বাবাই ভালো।
– চাইলে ফারাহর স্বামী ও ডাকতে পারো অথবা অন্যদের মত এ্যাই শুনছেন, ওগো একটু এদিকে আসুন। সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং রাইট?
– আপনি এসব কথা কোথায় পান বলুন তো?
ততক্ষনে দুজনের চা খাওয়া শেষ। কাপ দুটো ধুয়ে বললো,
– আমি যে কি জিনিস এখনো আপনি বুঝলেন না শাহাদপ্রিয়া?
তীক্ষ্ণ চোখে দিয়া বুঝার চেষ্টা করছে। দুজনের মাঝে নিবিড় কথোপকথন,
– কাল বলেছিলাম আমার প্রাপ্য চেয়ে নিব। আজ সময় এসেছে।
– কি প্রাপ্য?
– সন্ধ্যা হোক। তখন চাইবো।
– আমি তো ভাবলাম আপনি আবার টিপিকেল স্বামীদের মতো শেহজার ভাই চাইবেন।
শাহাদ হো হো করে হেসে বললো,
– ওটা চাইতে হবে কেনো, আল্লাহ দিলেই আসবে। সেখানে তো আমার কন্ট্রিবিউশান ও থাকবে তাই না।
– কিভাবে যে এত বেফাঁস কথা বলেন? আহা! কেউ দেখবে, কি করছেন?
– তাতে কি? হালাল,বৈধ বউ কোলে নিয়েছি। কাউকে পরোয়া করি নাকি? অন্যের বউ তো নি নাই।
– না ঠিক আছে, আপনার ভাষ্যমতে এই বাড়িতে আপনার কিছু সন্তানতুল্য ভাই বোন থাকে। ওরা যদি দেখে?
শাহাদ মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
– এখন কেউ উঠবেনা। আরো কিছুক্ষন পর উঠবে। তোমার দেবররা উঠলে ও উঠতে পারে।
দিয়া চমকে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
– মানে, কোন দেবর?
– মেজর আর বিচ্ছু।
– ছিঃ। কি বলেন এগুলো? আপনি না বড়।
– মজা করলাম।
রুমে ঢুকে দরজা আটকানোর জোর শব্দ। শাহীন একপাশ থেকে বেরিয়ে এলো, অপর পাশ থেকে লিমন। দুজন, দুজনকে দেখে লাফিয়ে উঠেছে। শাহীন লিমনকে ধমকে বললো,
– এ্যাই তুই এখানে কি করিস?
লিমন নাক মুখ কুঁচকে বলে,
– তুমি কি করো?
– ক্ষুধা লেগেছে তোর ভাবীর। ভাবলাম নুডুলস করে দি? তুই কেনো এসেছিস?
– তোমার বোনের মাথা ব্যাথা করছে। ভেবেছিলাম এক কাপ কড়া চা করে দিব। রাতে কেঁদেছে অনেক।
শাহীনের ফোনে মেসেজ আসতেই তাকিয়ে দেখে ভাইজান। শাহীন ভুলবশত মেসেজ জোরেই পড়লো,
– মেকানিক ডেকে এনে আজই গিজার লাগাবে দুই রুমে। গর্দভ।
লিমন শাহীনের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আজব বেইজ্জতি। ভাইজানের চোখ দুটোতে সব ধরা পড়তে হবে কেনো?
শাহীন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,
– আমাদের কাজ গুলো ও তো সেরকম। এই সময়টাতে না বের হলেও তো পারতাম। ভাইজানের জায়গায় এখন আব্বু আম্মু বের হলে কি হতো?
– কি হতো, যা সত্যি তাই বলতাম।
– সাধে ভাইজান তোকে বেক্কল ডাকে না। হতচ্ছাড়া।
– ভাইজান যে ভাবীমাকে কোলে নিলো?
– আরেহ বোকা, আমাদের দুজনকে আড়াল করতেই কোলে নিয়েছে। যেন ভাবীমা আমাদের না দেখে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ উলটা টি শার্ট পরেছিস।
লিমন মুখ চেপে হেসে বলে,
– আমি নাহয় বেক্কল তুমি কি? গায়ে ভুলে ভাবীর ওড়না পেচিয়ে এসেছো টাওলের জায়গায় মনে হয়।
লিমন তখনও হাসছে। হেসে কুটি কুটি হয়ে বললো,
– ভাইয়া স্যরি যেমনটা ভাবছো,অমন কিছুই না। উলটা টি শার্ট পরেছি এটা সত্যি। রাতে অস্থির লাগাতে খুলে ঘুমিয়েছিলাম। এলার্মের শব্দে উঠে দেখি বিবিজান আমার মাথার পাশে বসেই ঘুমিয়েছে। জাগালাম পরে বললো মাথা ধরেছে। তাই তড়িঘড়ি করে উলটা টি শার্ট পরে এলাম। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা বুঝলাম না।
– আমার কোনো ব্যাপার নাই। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিরার ওড়নায় মুখ মুছি। ওটাই গলায় ঝুলিয়ে চলে এসেছি। আমি কি আর জানতাম এমন সিচুয়েশনে পড়বো। ছিঃ ছিঃ ভাইজান কি ভাবলো।
লিমন ফোস করে দম ফেলে বললো,
– কি আর ভাববে, তোমার টা গায়ে মাখেনি আমার ক্ষেত্রে তো বোধ হয় ভেবেই নিয়েছে নেক্সট বড় আব্বা ডাকতে আরেকজনকে নিয়ে আসবো।
শাহীন হেসে বললো,
– মন্দ বলিস নি।
– তোমার বোনকে বলে দেখো। আমাকে ঝাটা সাতটা নিয়ে দৌঁড়াবে।
– বেশরম ঘুমাতে যা। কিভাবে বউয়ের বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলছিস?
বকতে বকতে শাহীন চলে গেলো, এদিকে লিমন মুখ বেকিয়ে বললো,
– সব তো নিজেই বললো আর দোষ আমার। যত দোষ, সব লিমন ঘোষের।
চা নিয়ে রুমে ঢুকেই দেখে তাহির মাথায় ঘোমটা। সালাত আদায় করেছে হয়তো। গায়ের টি শার্ট খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে বললো,
– যা হয়নি ভাইজান তাই ভেবে বসে আছে।
দোয়া পড়ে লিমনের গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘোমটা খুলে বললো,
– কি হয়নি আর ভাইজান এলো কি করে? গেলেন তো চা বানাতে।
– সে অনেক কাহিনী বাদ দিন। চা টা খেয়ে নিন। বারান্দায় চলুন গল্প করবো।
___
সকাল দশটা। শাহাদের স্টাডি রুমে ব্যস্ত সমাবেশ আজ। বাড়িভর্তি মেহমান। শাহাদ আসার পর থেকে বাড়িতে অতিথিদের হিড়িক পড়েছে। তবে এক্ষেত্রে শাহাদ সকলকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে আসতে। স্টাডি রুমে এই মুহুর্তে লিমন, ইয়াজ,তানভীর,নোমান, পাভেল এবং শাহীন আছে। তুহিন, হামজা এবং লাবিব বাইরে। প্রস্তুতি চলছে গোপনীয় কিছুর। লিভিং রুম দিয়ে স্টাডি রুমে প্রবেশের দরজা আজ খোলা। বেডরুমের দরজা বন্ধ আছে। রায়হান সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে শাহাদ সরাসরি স্টাডি রুমে ঢুকে সিক্স স্পাইডারের মুখোমুখি বসলো। রুম থেকে পাভেল ব্যতীত সবাইকে বের হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললো,
– পরবর্তী নির্দেশের পূর্বে যেন কেউ এখানে পা না রাখে।
সকলে বেরিয়ে পড়তেই পাভেলের দিকে বাণ ছুঁড়লো,
– বয়সে আমি নিজেই অনেক বড় ফারাহ্ থেকে। বয়স আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। প্রশ্ন হচ্ছে আমার বোন কয়বার অপমানিত হয়েছে তোমার কাছে মি. পাভেল?
ধুকপুক শুরু হয়েছে বুকের মাঝে। যা হওয়ার ভয় ছিলো তাই হলো। নিশ্চিত ঘরের কোণায় ক্যামেরা লাগানো নতুবা এই খবর যায় কি করে সুদূর গ্যালাপাগোস। শাহীন নিজেই তো ঘাবড়ে আছে। মাথা আনত পাভেলের। পরে মনে হলো বস প্রশ্ন করেছে। চুপ থাকাটা অপমান। হালকা মাথা তুলে বললো,
– বস, একটি বার ও অপমান করিনি। বকা দিয়েছি, দূরে থাকতে বলেছি। দুদিন আগে কথা শুনেনি দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চ/ড় মে/রেছি। আপনি বললে মাফ চাইবো।
শাহাদ ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে বলে,
– ও আচ্ছা, তা চড় মা/রার অধিকার কে দিয়েছে?
– স্যরি বস। আমি মাফ চেয়ে নিবো।
তখনই শিফা ডুকলো স্টাডি রুমে। শাহাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই পাভেল দাঁড়িয়ে পড়লো। মাথা নোয়ানো। শিফার দিকে না তাকিয়েই বললো,
– শিফা স্যরি, সেদিনের চ*ড়ের জন্য।
শাহাদ গম্ভীরস্বরে বললো,
– পাভেল শিফাকে জানাও নি তোমার জন্য পাত্রী রেডি।
– মা নে বস…
আমতা আমতা করছে পাভেল।
– আচ্ছা সমস্যা নেই, আমি জানিয়ে দিচ্ছি। শিফা তোমার পাভেল ভাইয়ার বিয়ে আগামী মাসে। আশা করি এমন কিছু করবেনা যাতে বাড়ির মান সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়।
ভাইয়ের সামনে ফুঁফিয়ে কেঁদে দিলো ছোট্ট শিফা। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাভেল। নির্বুদ্ধিতা যেন এই মুহুর্তে ঘিরে ধরেছে। কি দরকার ছিলো মেয়েটাকে জানানোর! শাহাদের ফোন আসাতে উঠে খানিকটা দূরে গিয়ে রিসিভ করলো। পাভেল শিফার দিকে তাকাতেই দেখে মেয়েটা কেঁদে যাচ্ছে। ক্ষীণ স্বরে বললো,
– শিফা এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। কেঁদোনা।
শিফার চোখের দিকে সরাসরি তাকালো, লাল লাল চোখ গুলো যেন ভস্ম করে দিচ্ছে পাভেলকে। কিছুটা পাভেলের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– আপনার বিয়ের দিন সবচেয়ে বেশি খুশি পাবেন আমাকে, সবচেয়ে বেশি আনন্দ করবো সেদিন আমি। আমি যখন দুকদম এগিয়ে ছিলাম, আপনি কি পারতেন না এক কদম আগাতে? আপনি বরং তিন কদম পিছিয়েছেন। অভিনন্দন পাভেল ভাই। আমি খুব খুশি।
বেরিয়ে গেলো শিফা। শাহাদ নিজের জায়গায় এসে বসলো। পাভেলকে বসার অনুমতি দিয়ে বাকিদের আসতে বললো। প্রায় ঘন্টা খানেক মিটিং করলো সাথে বাকিদের জানিয়ে দিলো পাভেলের বিয়ের কথা। থমথমে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে স্টাডি রুমে। ওদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। শাহাদ বের হওয়ার পর পর পাভেল দু হাতে মুখ ঢাকলো। নিস্তব্ধতা ঘেরা কামরা। প্রায় দশ মিনিট, কেউ পাভেলের নিরবতা ভাঙেনি। আজ মনে হলো ওকে একটু একা ছাড়া প্রয়োজন। তানভীর, ইয়াজ ঘটনা পুরোপুরি না জানলে বাকিদের সাথে নিরবতা পালন করছে। শাহীন পাভেলের কাঁধে হাত রেখে বললো,
– আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।
নোমান টিস্যু এগিয়ে দিলো। মুখ থেকে হাত সরাতেই বাকিরা লক্ষ্য করলো ভেজা গাল, ভেজা চোখ। দুটো বাক্য বেহায়ার মতো সবার সামনে বলে ফেললো,
– শাহীন আমি কি করে শিফার জায়গায় অন্য মেয়েকে মেনে নিবো। ভাবতেই ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। অন্যদিকে এই সাহসটুকু নেই যে ভাইজানকে বলব শিফাকে দিয়ে দিন।
মুখে শব্দ না করে কাঁদছে পাভেল। পুনরায় বললো,
– আমার অনুভূতির এক পারসেন্ট ও আমি শিফাকে আজ অবধি দেখাই নি। এতদিন আমলে নি নাই। আজ মনে হচ্ছে আমি ওকে ছাড়া শ্বাস নিতে পারবোনা।
সবাই উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো। নোমান বুঝিয়ে বললো,
– ভুলে যা এসব। আজকের দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু ভুল হলেই মারাত্মক বিপদ। বসকে গন্তব্যে পৌঁছানো আমাদের দায়িত্ব।
দুহাতে চোখ মুছে বললো,
– আচ্ছা। শাহীন আমি চিলেকোঠায় যাচ্ছি। বসের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেষবারের মতো শিফাকে পাঠা। ভালো করে মাফ চেয়ে নিব।
___
– যা করছেন মোটেও ভালো হচ্ছে না শেহজার বাবা?
সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরনে। শার্টের হাতা গুটিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে ডানহিল আইকনের পারফিউম বডিতে স্প্রে করলো। দিয়াকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চট করে পাতলা অধরে অধর ছুঁয়ে বললো,
– এসব নিয়ে আপনি না ভাবলেও চলবে বেগম শাহাদ।
মুখটা মলিন করস অন্যদিকে তাকিয়ে খাটের কোণায় বসে বিড়বিড় করে বললো,
– ভালোবাসায় এই লোকটার কি এলার্জি বুঝিনা। সব জায়গায় ঘাপলা পাকাবে। রহস্য করা যেন স্বভাব।
– কিছু বললে তুমি?
– না কি বলবো, কিছু না। যাচ্ছেন কোথায়?
– কাজ আছে বাইরে। আমি এখন বের হলে রাতে ফিরবো একেবারে। সন্ধ্যায় গাড়ি আসলে তৈরি হয়ে চলে যেও। একটা ইনভাইটেশন আছে।
– আমি একা?
– না, তুমি, আব্বু,আম্মু এবং মেজর।
– যেতে ইচ্ছে করছে না।
– আজ তোমার একটা স্বপ্ন পূর্ণ হবে শাহাদপ্রিয়া। যা শাহাদ ইমরোজ কখনোই করতো না আজ তা করবে।
কাছে এসে স্ত্রীর কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রেখে গেলো অজানা কৌতুহল। কি হতে যাচ্ছে??
___
পায়ের উপর পা তুলে একহাতে কফি অন্য হাতে জলন্ত সিগারেট। কাপের কফিটুকু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চেনা পরিচিত হাসিটা দিয়ে বলল,
– মিস. এলিন আমি কিন্তু একান্তই আমার সহধর্মিণীর। যে কাজ বিগত এক বছর ধরে করে যাচ্ছেন সেটা বন্ধ করার জন্য বহুবার বলেছি। কাজটা করতে গিয়ে নিজের বাবাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলেন। স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আপনি, আপনাকে এসব মানায় না। শাহাদ ইমরোজ একান্তই তার ব্যক্তিগত নারীর। প্রথম বার কেউ ভুল করলে তাকে মাফ করে দিই। দ্বিতীয় বার বুঝিয়ে বলি কৌশলে। তৃতীয়বার শাস্তি দিই। গতরাতে আমার স্ত্রীকে মেসেজে আজকের যা ঘটবে সেসব ঘটনা বলার একেবারেই অনুচিৎ হয়েছে। আমার পেছনে যে স্পাই লাগিয়েছেন, সেই স্পাই কিন্তু আমার আন্ডারে থাকা নেভি অফিসার।
মাথা নত এলিনের। সে চেয়েছিলো বাবার পাওয়ার কাজে লাগিয়ে শাহাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে। যদি দিয়ার মনে শাহাদ সম্পর্কে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া যায় তবে তাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। এলিনের রাস্তা স্বচ্ছ হবে। গতরাতে দিয়ার ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে কিছু ডকুমেন্টস এবং ভিডিও পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি ছবিতে শাহাদ তার কিছু মেইল এবং ফিমেল এক্স-কলিগদের সাথে আলোচনায় বসেছিলো। দিয়া তখন ওয়াশরুমে। দু দু বার কল এসেছে। শাহাদ দিয়াকে কয়েকবার ডাকার পর দিয়া জানালো কার মেসেজ যেন দেখে। সেই মেসেজের আদ্যোপান্ত পড়ে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।
– এনিওয়ে এলিন থ্যাংকস ফর দ্য ট্রিট। এন্ড আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি। আজ আপনি বাসায় ফিরতে পারছেন না, আগামীকাল যেতে পারবেন। আপনি আমার সারপ্রাইজ নষ্ট করে দেয়ার পায়তারা করছেন। আমি তা কিছুতেই মেনে নেব না মিস। আজকের জন্য শাহাদের আতিথেয়তা গ্রহন করুন।
বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। শাহাদের ইশারায় কিছু মুখোশ পরা মানুষ এলিনকে নিয়ে গেলো। মুহুর্তে কি থেকে কি হয়ে গেলো সকলের অজানা। কি হবে আজ!
চলবে…
( আর মাত্র একটি পর্ব)