সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-০১

0
1582

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#সূচনা_পর্ব
জাওয়াদ জামী জামী

” বড়মা, পেখম আপুকে বিয়ে করবেনা জন্য রাজ্য ভাইয়া বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ”

দেবরের ছেলে সিনানের মুখে এহেন অলক্ষুণে কথা শুনে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলেন রাবেয়া সুলতানা। বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করছে। সৈয়দ শামসুল হকের নাতনীর বিয়ে উপলক্ষ্যে আশেপাশের তিন গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে দাঁড়ানোর তিল পরিমাণ জায়গা নেই। রাবেয়া সুলতানা নিজের রুমে কিছু একটা করছিলেন, ঠিক তখনই তার ছোট দেবর সৈয়দ রাকিব আহমেদ এর ছেলে সিনান এসে তাকে এই দুঃসংবাদ দেয়। রাবেয়া সুলতানা বিশ্বাস করতে পারছেননা সিনানের কথা। তবুও তিনি অতিকষ্টে সিনানকে বললেন,

” আজকের দিনে এমন মজা করতে নেই, সিনান বাবু। এসব শুনলে তোমার পেখম আপু কষ্ট পাবে। তুমি গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলা কর। ”

” ও বড়মা, আমি মিথ্যা বলছিনা। তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর। সত্যিই রাজ্য ভাইয়া বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আমি চুপিচুপি রাজ্য ভাইয়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম, তারা কখন আসবে সেটা দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম ঐ বাড়ির দাদু, চাচ্চু, বড়মারা সবাই কান্নাকাটি করছে। দাদু অসুস্থ হয়ে গেছে। ঐ বাড়ির বড় চাচ্চু মাঝেমধ্যে চিৎকার করে রাজ্য ভাইয়াকে গালাগালি করছে। ”

রাবেয়া সুলতানা এবার আর সিনানের কথা অবিশ্বাস করতে পারলেননা। তিনি অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলেন সিনানের দিকে। তবে কি মেয়েটারও কপাল পুড়ল? সমাজের চোখে মেয়েটার হেনস্তা হওয়ার আরেকটা কারন সৃষ্টি হল? রাবেয়া সুলতানার দু-চোখ ভরে আসল কষ্টের অশ্রুমালায়।

***

দরজায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেখম। এসব কি বলছে, ছোট চাচা! দাদুও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তার চোখে পানি টলমল করছে। ওর সর্বশরীর কাঁপছে। সত্যিই যদি রাজ্য ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তবে ওর কি হবে? রাজ্য ভাইয়া কেন এমন করল? দিশেহারা হয়ে এদিকওদিক তাকায় মেয়েটা। আত্নীয়স্বজনসহ পাড়াপ্রতিবেশীরা সবাই আগ্রহভরে দাদি-চাচাদের আলোচনা শুনছে। মাঝেমধ্যে কানাঘুষাও করছে। আরও একবার সবার সামনে লজ্জায় পরতে হবে। এই সতের বছরের জীবনে নিজের বাড়ির মানুষ, পাড়া-পড়শীর কাছে কম হেনস্তা হয়নি। তবে কি আরও একবার হেনস্তার জন্য নতুন ইস্যু পেতে চলেছে সবাই?

” আব্বা, আপনি যদি আমাদের সাথে না যান তবে আমরা তিন ভাই মিলে যাব রাজ্যদের বাড়িতে। আমরা সবাই তাদের কাছে জানতে চাইব, তারা কেন আমাদের সম্মান নিয়ে খেলল? তাদের ছেলে যখন আমাদের পেখমকে বিয়ে করবেইনা তবে কেন সে রাজি হয়েছিল? জবাব তাদের দিতেই হবে। ” সৈয়দ শামসুল হকের ছোট ছেলে সৈয়দ রাকিব আহমেদ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে।

” রাকিব, তুমি যে খবরটা পেয়েছ সেটা কি যাচাই করে দেখেছ? ” সৈয়দ শামসুল হক এর বেশি কিছু বলতে পারলেননা। তিনি নাতনীর ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির হয়ে পরেছেন। তিনি বারবার ভাবছেন হতভাগ্য মেয়েটার কথা।

” শুধু আমি নয় আব্বা, আপনার বাকি দুই ছেলেও আসল খবরটাই পেয়েছে। রাজ্য বাড়িতে নেই। সবাই ধারনা করছে ও আমেরিকা ফিরে গেছে। এবার বলুন আমরা কি করব? আমরা আমাদের ভাতিজীর জীবন নষ্ট হতে দেবনা। ওদের অন্যায়ের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েই ছাড়ব। চিটিং কেইস করব। ওদের টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামাব। মীর রেজাউল করিমের অহংকার চূর্ণ করেই তবে ছাড়ব। তারা কেন আমাদের ঠকালো সেই জবাব ওদের দিতেই হবে। ”

ছোট ছেলের মুখে নিজের বাল্যবন্ধুর সম্পর্কে এহেন কটুবাক্য শুনে সৈয়দ শামসুল হকের বুক চিনচিন করছে। দুই পরিবারের সম্পর্ক কম দিনের নয়। সৈয়দ শামসুল হক আর মীর রেজাউল করিমের বাবাও ছিলেন পরম বন্ধু। তাদের বাবাদের বন্ধুত্বের সূত্র থেকেই, তাদের দু’জনের মধ্যেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সুসম্পর্ক গড়ায় গভীর বন্ধুত্বে। আর সেই বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে গত সত্তর বছর যাবৎ। তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছেন, এই দীর্ঘ বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে শীঘ্রই। তিনি এটাও বুঝতে পারছেন, রাজ্যর চলে যাওয়ার পেছনে মীর রেজাউল করিমের কোন হাত নেই। হাত নেই তার পরিবারের কোনও সদস্যের। কিন্তু এই কথা তিনি তার গোঁয়ার ছোট ছেলেকে বোঝাবেন কেমন করে!

” আব্বা, আপনি চুপ করে বসে থাকবেননা। আপনার মতামতের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা পেখমের জীবন নষ্ট হতে দিতে পারিনা। ” সৈয়দ শামসুল হকের বড় ছেলে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবার কথা বললেন।

” একটা বিয়েই যে পেখম দিদিভাইয়ের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করত এমনটা কিন্তু নয়। তোমরাই বলছ রাজ্য বাড়ি ছেড়েছে। আবার সেই তোমরাই আবার বলছ, পেখমের জীবন নষ্ট হতে দেবেনা। তোমরা কি রাজ্যকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছ? পারবে ওকে ফিরিয়ে আনতে? ”

” প্লিজ আব্বা, আপনি আপনার দর্শনের কথা বাদ রাখেন। এখন যুক্তিতর্কের সময় নয়। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি করতে চাই। কি করলে পেখমের ভালো হবে। তবে তার আগে ঐ বেইমান ছেলেটার বাড়িতে যেতে হবে। আপনি যদি অনুমতি না দেন, তবে আমরাই যাব। ” সৈয়দ রাকিব আহমেদ গলা চড়িয়ে বলল।

সৈয়দ শামসুল হক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

” শুধু তোমরা যাবে কেন! আমিও যাব। নিজের চোখেই দেখব দুই পরিবারের বিচ্ছেদ। রাজ্য দাদুভাইয়ের একটা ভুল কিভাবে দুই পরিবারের বন্ধুত্বের সম্পর্ক পাল্টে শত্রুতায় রুপান্তরিত হয় সেটা আমাকে দেখতেই হবে। ”

***

উঠানের মাঝখানে মীর রেজাউল করিম বসে আছেন। তাকে ঘিরে তার ছয় ছেলেমেয়ে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে বসে আছেন।

” বউমা, তুমি কি রাজ্য দাদু ভাইকে ফিরিয়ে আনতে পারোনা? দাদু ভাই তোমাকে ফোন দিলে তুমি তাকে আমার হয়ে অনুরোধ করে দেখ। আমি ওদের বুঝিয়ে বলব। দাদু ভাই ফিরে আসলেই বিয়ে দেব। নয়তো আমি ঐ বাড়ির মানুষদের সামনে কোন মুখে দাঁড়াব! হায় আল্লাহ, এই বয়সে এতটা অপমানও আমার ভাগ্যে ছিল! ” মীর রেজাউল করিমের হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে মীর বাড়ির অন্দরমহলের আবহাওয়া।

” আব্বা, আপনি এভাবে ভেঙে পরবেননা। রাজ্য আমাকে ফোন দিলেই আমি ওকে অনুরোধ করব। সেই সাথে অনুরোধ করব সৈয়দ পরিবারের সবাইকে। তারা যেন কিছুদিন অপেক্ষা করে। ”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন রাজ্য’র মা রাজিয়া পারভীন। যদিও তিনি বুঝতে পারছেন তার ছেলেকে ফেরানো অসম্ভব। যদি তিনি ঘুনাক্ষরেও টের পেতেন রাজ্য এমন ঘৃণিত কাজ করবে, তবে কখনোই এই বিয়েতে রাজি হতেননা। ছেলের প্রতি তার ভিষণ রাগ হচ্ছে। এই মুহূর্তে ওকে সামনে পেলে তিনি নিশ্চয়ই দু ঘা লাগিয়ে দিতেন। জিদ্দি ছেলেটা নিজের জিদ বহাল রাখতে বংশের মুখে এভাবে চুনকালি মাখাতে পারে এটা তার কল্পনায়ও ছিলনা।

” তুমি অযথাই অনুরোধ করতে যাবে কেন, ভাবী? রাজ্য কি এমন ভুল করেছে? আমি তোমাদের আগেই নিষেধ করেছিলাম, আর যার সাথেই রাজ্য’র বিয়ে দাওনা কেন, পেখমের সাথে বিয়ে দিওনা। আমার কথা তোমরা কেউ শুনেছ? এবার দাও ছেলের বিয়ে। আগে দু’চার বছরে ছেলের মুখ দেখতে পেতে, এখনতো দশ বছরেও রাজ্য এমুখো হবেনা। তখন ছেলেকে না দেখে থাকবে কি করে? ”

মীর রেজাউল করিমের ছোট ছেলে মীর মাহমুদের দিকে সবাই একযোগে তাকালেন। সবার চোখেই বিস্ময়। সবথেকে বেশি বিস্ময় দেখা গেল মীর রেজাউল করিমের চোখে। তিনি বুঝতে পারছেননা সৈয়দ বংশের প্রতি তার ছেলের এত ঘৃণার কারন। তিনি অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করেছেন মাহমুদ ঐ বংশের কাউকেই পছন্দ করেনা। কিন্তু কেন? প্রশ্নটা অনেকবার তার মনে উদয় হলেও তিনি এখন পর্যন্ত মাহমুদকে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেননি। কিন্তু এবার তিনি প্রশ্নটা না করে পারলেননা।

” আমি আগেও লক্ষ্য করেছি তুমি ঐ বাড়ির মানুষদের তেমন একটা পছন্দ করনা। কিন্তু আমি যতদুর জানি ওরা মানুষ হিসেবে কেউই খারাপ নয়। তাদের প্রতি তোমার কেন এত রাগ, মাহমুদ? ”

” আপনার চোখে দুনিয়া শুদ্ধ মানুষই ভালো, আব্বা। আসলে মানুষ বাছাইয়ের ক্ষমতা আপনার নেই, তাই ওদের আপনি ভালো মনে করেন। ওরা যদি এতই ভালো হবে, তবে সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের বিচার করলনা কেন? আসলে ওরা সবাই এক গোয়ালের গরু, বুঝলেন? ”

” চুপ কর, মাহমুদ। তোমার মত অর্বাচীনের কাছ থেকে আমি ওদের বিষয়ে কোন কথাই শুনতে চাইনা। যদি পার সমাধান দাও, কিন্তু দয়া করে অশান্তি সৃষ্টি করোনা। ” মীর রেজাউল করিমের হুংকারে মিইয়ে গেলেন মীর মাহমুদ।

রাজ্য’র বাবা মীর আমজাদ হোসেন অসহায়ের ন্যায় বসে সবার কথপোকথন শুনছেন। এদের কথপোকথন তার অসহ্য লাগছে। সমাধানের বদলে এটা ঘটনা অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি হতাশ হয়ে গেছেন।

***

মীর বাড়ির উঠানে মুখোমুখি বসে আছেন সৈয়দ শামসুল হক ও মীর রেজাউল করিমের পরিবার। তাদের কারও মুখেই কোনও কথা নেই। মীর রেজাউল করিম লজ্জায় বারবার মুখ লুকাচ্ছেন।

মীর মাহমুদ লক্ষ্য করছেন সৈয়দ রাকিব আহমেদ রাগে গজগজ করছেন। যেটা তার মোটেও পছন্দ হলোনা। তিনি রাকিব আহমেদকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

” এভাবে সবাই চুপচাপ বসে আছেন কেন? আপনাদের যদি কিছু বলার না-ই থাকে তবে আমি যেতে চাই। বসে থাকার মত সময় আপনাদের থাকলেও, আমার হাতে নেই। ”

মীর মাহমুদের কথা শুনে রাগে ফেটে পরলেন সৈয়দ রাকিব আহমেদ। তিনি তেড়ে গেলেন মাহমুদের দিকে।

” খুব বেড়েছ না? মানুষ এম্নিতেই বলেনা, চোরের মায়ের বড় গলা। তুমি একাই ব্যস্ত, আর আমরা বসে বসে খাই? ছেলেকে মানুষ করতে পারেনি আবার বড় বড় বাতেলা। ”

ব্যাস আগুনে ঘি ঢালতে এতটুকুই যথেষ্ট। শুরু হয়ে গেল ঝামেলা। সমাধানের বদলে শত্রুতার সৃষ্টি হলো দুই পরিবারে। দুই বৃদ্ধ অসহায় চোখে দেখলেন ভাঙ্গনের দৃশ্য। কেউ তাদের কোন বারণ শুনলনা, নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত থাকল।

চলবে…