সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-১১+১২

0
927

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১১
জাওয়াদ জামী জামী

” এমন ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার কপালে কি দুইটা শিং গজিয়েছে? নাকি লেজ বেরিয়েছে পেছন দিয়ে ? ” রাজ্যের কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে হাসল কানন।

” শিং গজালে তোমাকে দেখতে যা লাগবেনা। আমাদের রামু কাকার মহিষকে যেমন কিউট লাগে, তোমাকেও ঠিক তেমনিই লাগবে। আবার লেজ বেরোলেও মন্দ লাগবেনা। রাস্তার পাশের বড় আম গাছটায় বাসা বাঁধবে। গাছের ডালে কলা ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দেব। তুমি ডালে পা ঝুলিয়ে বসে বসে কলা খাবে, আর মাঝেমধ্যে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী দুই-চারটা ডিগবাজি দেবে, শরীর চুলকাবে আর বানর নৃত্য করবে, তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে৷ অবশ্য মাঝেমধ্যে পাড়ার আণ্ডাবাচ্চারা একটুআধটু ঢিল ছুঁড়তে পারে, তবে এটা তোমাকে সহ্য করতেই হবে। কখনোসখনো বড় কিছুর জন্য ছোট ছোট কষ্ট মেনে নিতেই হয়। ”

কাননের কথায় রাগের পারদ তড়তড় করে বাড়ছে। কানের ভেতর ঝাঁ ঝাঁ করছে। হাতের বইটা আলগোছে বিছানায় রেখে সোজা হয়ে বসল রাজ্য। চিল চক্ষুতে চেয়ে আছে কাননের দিকে। কানন সেটা বুঝতে পেরে ফাঁকা ঢোক গিলে এদিক-ওদিক তাকায়। পালানোর পথ খুঁজছে ও। কিন্তু ওর সেই আশায় জল ঢেলে রাজ্য ওর হাত চেপে ধরল।

” এতক্ষন কি বললি, সেগুলো রিপিট কর। ” হিসহিসিয়ে বলল রাজ্য।

” ক..কই তেমন কিছুই বলিনি তো! আসলে অনেকদিন পর আপু গ্রামে এসেছিল, তাই এভাবে হুটহাট চলে যাওয়ায় অবাক হয়েছে সবাই। সবাই বাড়ির লোকজনের কাছে এটাসেটা জিজ্ঞেস করছে। ”

” কিহ্, কে চলে গেছে! পাগল হয়েছিস নাকি অভিনয় করছিস? অভিনয় করে থাকলে তোকে পাবনা রেখে আসার ব্যবস্থা আমি নিজে করব। ”

” আমি সত্যি বলছি, আপু চলে গেছে। ”

এবার সত্যিই রেগে গেল রাজ্য। গাট্টা বসিয়ে দিল কাননের মাথায়। ব্যথায় কানন চোখে অন্ধকার দেখল। মুখ কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে থাকল রাজ্য’র দিকে।

” রাখ তোর আপু। তোর আপুর কথা কে জানতে চাইছে? তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে, রাস্কেল। ”

” এই মুহূর্তে তোমার প্রশ্নের উত্তরের থেকে আপুর খবর জানানোই বেশি জরুরী। কারন সেই আপুটিই এখন তোমার জীবনের লক্ষ্য। তাকে জয় করতে না পারলে তোমার প্রাপ্তির খাতায় বিগ জিরো থাকবে। আ বিগ বিগ জিরো। ” কানন দু-হাত প্রসারিত করে দেখাল।

কাননের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলনা রাজ্য। ও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে কাননের দিকে।

” যা বলবি ঠিকঠাক বলবি। আজেবাজে কোন কথা আমি শুনতে চাইছিনা। আপুর দুঃখের সাথী হতে চাইলে তার কাছেই যা। ”

” আমি নই আপুর সুখ-দুঃখের সাথী তুমি। আমি পেখম আপুর কথা বলছি, বুঝলে? ”

এবার নড়েচড়ে বসল রাজ্য। চোখমুখ জুড়ে শুধুই কৌতুহল।

” কি বলতে চাইছিস খুলে বল। ”

” সব কিছুই খুলতে হবে নাকি! মানে আন্ডারওয়্যার ও! ঐটা খুললে আমার সম্মান যে হাওয়ায় ভাসবে! তোমার আক্কেল দেখে বাঁচিনা। বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের ইয়ে দেখতে লজ্জা করবেনা তোমার? আমি আন্ডারওয়্যার বাদে সবই খুলতে রাজি আছি। ”

” তোর কি মনে হয়, তোর ইয়ে দেখার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি? এমনিতেও ছোটবেলায় অনেকবারই দেখেছি। সেইবার যখন তোর মুসলমানি করালো, তখন তোর ইয়তে দুর্ঘটনাবশত রফিক চাচাদের মুরগী এসে ঠোকর দিল, তারপর থেকে তোকে আমিই পাহারা দিতাম। ডক্টর আংকেল এসে ড্রেসিং করাতো, তখনও তোর পাশে আমিই থাকতাম। তুই ভয়ে চিৎকার করলে আমিই তোকে শান্তনা দিতাম। ”

” পেখম আপু ঢাকা চলে গেছে। ” এই বাক্যটাই রাজ্যকে থামিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। এদিকে কানন লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে কথাটা বলেছিল।

” কি বললি? ”

” ঋত জানালো পেখম ঢাকা ফিরে গেছে আজ ভোরেই। এতক্ষণে হয়তো ও নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছে। ”

রাজ্য কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে রইল। সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। হঠাৎই একরাশ বিতৃষ্ণায় ছেলে গেল মন।

” খরবটা এখন তুই আমাকে জানাচ্ছিস? আরও আগে জানালে কি হত, ইডিয়ট? তাহলে আমিও ওর পিছুপিছু যেতে পারতাম। তুই একটা অকর্মার ঢেঁকি সেটা কি জানিস? ” বিছানা থেকে নেমে আলমারি থেকে ব্যাগ বের করতে করতে বলল রাজ্য।

” লে হালুয়া, আমিই জানলাম কিছুক্ষণ আগে। তোমাকে আরও আগে জানাবো কিভাবে! ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাচ্ছিলাম। আমাকে ফোনে না পেয়ে ঋত হোয়াটস অ্যাপে নক দিয়েছিল। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কাপড় গোছাচ্ছ কেন? কোথাও যাবে নাকি? ”

” ঢাকা যাব। বউটাকে ঐখানে একা ফেলে রেখে আমি এখানে কিভাবে পরে থাকি। তুই চাইলে আমার সাথে যেতে পারিস। ”

” তুমি কি ভাবীর ঠিকানা জানো! ”

” তুই জেনে আমাকে জানাবি। ”

” এখানেও আমি! ”

” কথা কম। ঋতকে ফোন দে। জেনে নে আমার বউ কোথায় থাকে। ”

” এখনো সে তোমার বউ হয়নি। কিন্তু এমনভাবে বলছ যেন সে আজন্মকাল থেকেই তোমার বউ ছিল! এই তোমার জন্য আমার সরল প্রেমের পথ ক্রমেই কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠছে। কোথায় ভেবে রেখেছি পরিবার থেকে না মানলে, সোজা ঋতকে নিয়ে সটকে পরব। এক বছর পর বউ-বাচ্চা নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে এন্ট্রি নিব, কিন্তু তুমি সেটা হতে দিলে কই? ”

” তুই কি উঠবি নাকি ঘাড় ধরে তোকে নিয়ে যাব? ”

রাজ্য’র মারমুখো ভঙ্গি দেখে ভয় পায় কানন। সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

***

” তুমি আমাকে না বলেই ঢাকা চলে গেলে, কানন ভাইয়া? ”

ঋতের কথায় চমকে উঠল কানন। মেয়েটা রাগ করেছে বুঝতেই পারছে। ও পরেছে অকুল পাথারে। একদিকে ভাই অন্যদিকে ঋত। কার মন রাখবে বেচারা।

” রাগ করিসনা, পাখি৷ আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরব। ভাইয়ার মনের অবস্থা কি সেটা একটু হলেও তো বুঝিস? পুরো রাস্তায় কেমন ছটফট করেছে সে, সেটা যদি জানতিস। পেখমকে বলিসনা ভাইয়া তার খোঁজেই ঢাকা গেছে। ভাইয়ার মন শান্ত করেই আমরা গ্রামে ফিরে আসব। ”

” বুঝেছি, এখন ভাইয়াই সব, আমি কিছুইনা। ”

” তুই আমার কি সেটা শুধু আমিই জানি। শোন, আমাদের সম্পর্ক দুই পরিবারের কেউ-ই মানবেনা। সেজন্য ভাইয়ার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। তুই পারলে পেখমকে একটু বুঝা। ওরা দু’জন এক হতে চাইলে দুনিয়ার কেউ-ই ওদের বাঁধা দিয়েও কিছুই করতে পারবেনা। আর একবার ওরা এক হয়ে গেলে আমাদের রাস্তাও ক্লিয়ার হয়ে যাবে। তোকে নিজের করে পেতে আমার আর কোন বাঁধা থাকবেনা। ”

” তুমি বলতে চাইছ, রাজ্য ভাইয়ার ওপর আমাদের সম্পর্কের পরিনতি নির্ভর করছে? ভাইয়া যদি না ফিরত, আর আপুকে যদি তার পছন্দ না হতো, তখন তুমি কি বলতে? আমাদের এক হতে ভাইয়াকে কেন প্রয়োজন হবে? সে-তো চলেই গিয়েছিল। তবে এখন কেন তাকে প্রাধান্য দিচ্ছ? আমি এখন পর্যন্ত তাকে কিছু বলিনি, শুধু তোমার কথা ভেবে। নয়তো সে যে অন্যায় করেছে, তারপরও কি পেখম আপুর পক্ষে তাকে মেনে নেয়া সম্ভব? হ্যাঁ তুমি বলতে পার, ওদের দু’জনকে মেলাতে হবে দুই পরিবারের স্বার্থে। কিন্তু তুমি এটা বলতে পারোনা, আমাদের সম্পর্কের পূর্ণতার জন্য তাকে প্রয়োজন। তাই উল্টাপাল্টা যুক্তি না দিয়ে সঠিক কথা বল। ”

” রেগে যাচ্ছিস কেন, পাখি! আমি বোধহয় তোকে বোঝাতে পারিনি। ভাইয়া না আসলে, পেখমকে নিজের করে পেতে না চাইলে ব্যাপারটা একরকম ছিল। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। ভাইয়া পেখমকে পেতে দুনিয়ার বিরুদ্ধে যেতে দুইবারও ভাববেনা। প্রয়োজনে সে নিজের পরিবারের বিপক্ষেও যাবে। কিন্তু আমি চাইছিনা রাগের বশে ভাইয়া দুই পরিবারের কাউকে চটিয়ে দিক। এমনিতেই সারাক্ষণ আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি। একবার যদি পেখম রাজি হয় তবে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। পেখমের দিকে তাকিয়ে দুই পরিবারের সকলে রাজি হলেও হতে পারে। ”

” থাক এত সাফাই দিতে হবেনা। তাড়াতাড়ি এস তাহলেই হবে। ”

” খুব বেশি রাগ হয়েছে? ”

” একটু। ”

” আমি দুই-একদিনের মধ্যেই ফিরব। তুই এক কাজ কর, পেখমে ফোন দিয়ে বেলকনিতে আসতে বল। আমরা ওর বিল্ডিংয়ের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। ওকে দেখার জন্য ভাইয়া ছটফট করছে। ওকে একনজর দেখতে পেলেই ভাইয়া শান্ত হবে। এরপর আমরা হোটেলে ফিরে যাব। ”

” হোটেলে উঠেছ কেন? বড় চাচার না ফ্ল্যাট আছে সেখানে? ”

” ভাইয়ার সিদ্ধান্ত, তাই। ”

” তোমার ভাইয়াকে আরেকবার সামনে পেলে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতাম। আমার আপুকে কাঁদানোর শাস্তি এখনো তাকে দেইনি। ”

” আমি ভাইয়াকে বলে রাখব। ”

” কিহ্! ফাজিল ছেলে, তুমি ভাইয়াকে বলে দেবে? ”

” বলে দেব কেন! আমি শুধু তাকে জানিয়ে রাখব যে, তার শাস্তি পাওনা রয়েছে। ”

” ফোন রাখ, ফাজিল পোলা। তোর সাথে কোন কথা নেই। ”

ঋত ফোন কেটে দিলে কানন মাথা চুলকে হাসল। এই মুহূর্তে ঋতকে রাগানোর প্রয়োজন ছিল। নয়তো সে উল্টাপাল্টা কথা বলতেই থাকত।

***

রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাজ্য। ওর নজর সামনের বিল্ডিংয়ের তিনতলার বেলকনির দিকে। দুই ঘন্টা যাবৎ ও এখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু একবারের জন্যও পেখমের দেখা পায়নি। এই দীর্ঘসময়ে একটাবারের মতও বিরক্ত হয়নি রাজ্য। কিংবা মনে জন্মায়নি কোন হতাশা। ও আশায় বুক বেঁধে আছে, পেখমের দেখা পাবে বলে। মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। এই মেয়েটাকে ছাড়া দুনিয়া ওর কাছে পানসে মনে হয়। ওর মায়া কাটানো রাজ্যের পক্ষে অসম্ভব।

আরও আধাঘন্টা পর বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় পেখম। মেয়েটা ফোনে কারও সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এক পর্যায়ে সে নিচে উঁকি দিয়ে কিছু একটা দেখল।

***

” ঋত, তুই ডাহা ফেইল। দারোয়ান আংকেল আজও ইউনিফর্ম পরেই এসেছে। তুই কোন ম্যাজিক জানিসনা বুঝলি? ” হাসতে হাসতে বলল পেখম।

” দূর, আমার ফ্রেন্ড যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবেই করেছি আমি। কিন্তু আমার ধারনা না মিললে আমার কি দোষ বল? ও কয়েকটা কথা শিখিয়ে দিয়েছিল আর বলেছিল সেভাবে করলে, অনেক দূরের মানুষ কি করছে, কি খাচ্ছে, কি পরে আছে সব জানা যায়। ” ঋত গোমড়ামুখে বলল।

” তোকে বুদ্ধু বানিয়েছে, বুঝলি? তুই যে এত বোকা সেটা আমি জানতামনা। ” পেখম হেসেই চলেছে।

কথা শেষ হলে ঋত হাঁফ ছাড়ল। ও পেরেছে। ওর কথা বিশ্বাস করে পেখম বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন প্রেমিকের তৃষ্ণার্ত বুক শীতল করতে পেরেছে। বাকি সবার মত ঋতও রাজ্যের ওপর রেগে ছিল। কিন্তু যেদিনজানতে পারল রাজ্য নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত, সেদিন ও রাজ্যকে ক্ষমা করে দিয়েছে। ও নিজেও একজনকে হৃদয় উজার করে ভালোবাসে। প্রেমের ভাষা ও বোঝে। একজন প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসা কতটা প্রবল সেটা ও কাননকে দিয়েই বুঝেছে। তাই রাজ্যের ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়েছে। সাথ দিয়েছে রাজ্যের।

ঋতের সাথে কথা শেষ করে কিছুক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়ালো পেখম। কয়েকটা ফুলের টব রাখা আছে সেখানে। কিছুক্ষণ গল্প করল পুষ্পরাজীর সাথে। এরপর চলে গেল ভেতরে।

পুরোটা সময় রাজ্য ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। দু-চোখ ভরে দেখছিল তার বৃষ্টি বিলাসীনিকে। যে মেয়েটাকে বিয়ে না করেই ফিরে গিয়েছিল, একটাবারের জন্যও ভাবেনি মেয়েটার কথা। আজ সেই মেয়েই ওর হৃদয়ের মনিকোঠায় আসন গেঁড়েছে। মিশে গেছে ওর অস্তিত্বে। যে মেয়েটাকে ছাড়া ওর বেঁচে থাকা অসম্ভব। যেকোন মূল্যেই ওর এই মেয়েটাকে চাই।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী

” সরি, ম্যাম। এক্সট্রেইমলি সরি। আ’ম হেল্পিং ইউ। ”

হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পেখমের হাত থেকে শপিং ব্যাগ ভূপাতিত হল। প্রায় সাথে সাথেই অপরদিক থেকে অনুশোচনা ভেসে আসল। পেখম কোন প্রত্তুত্যর না করে ব্যাগগুলো তুলতে শুরু করল। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি পেখমের নীরবতা পাত্তা না দিয়ে পেখমের সাথে হাত লাগাল। এবার পেখম একটু বিরক্তই হল। লোকটার গায়েপড়া স্বভাব ওর পছন্দ হচ্ছেনা।

” ইট’স ওকে। আই’ল হ্যান্ডেল ইট। ”

পেখম একটিবারের জন্যও সামনের ব্যাক্তির দিকে তাকালোনা। কিন্তু রাজ্য ওকে ঠিকই সাহায্য করল। ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হল রাজ্যের। বিস্ময়ে পেখমের আঁখিদ্বয় কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। এই লোকটাকে ঢাকায় দেখে নিজের ওপরই রাগ হলো। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে কেন এর সাথেই দেখা হতে হবে? দ্রুত জায়গা ত্যাগ করতে চাইল পেখম। এমনকি শপিংমলও ছাড়তে চাইল।

” হেই, ওয়েট। হোয়াটস’ দ্য হারি? ক্যান আই টক টু ইউ? প্লিজ ডোন্ট সেই। ” অনুনয় ঝরল রাজ্যের গলায়।

” আমি ক্যান্ট। আই ডোন্ট লাইক টকিং টু ইউ। ” পেখম হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেল।

রাজ্য ভ্রুঁ উচিয়ে পেখমের যাওয়া দেখল। মেয়েটা ওকে সরাসরি অপমান করল এটাকে ও কিছুই মনে করছেনা। ও যা করেছে পেখমের সাথে তার তুলনায় এটা কিছুই নয়। পেখম চড় মারলেও রাজ্য একটুও অবাক হতোনা। কিন্তু মেয়েটা ওকে চড় না মেরে সামান্য কথাটুকু বলেই চলে গেল! এটাই হজম হচ্ছেনা রাজ্য’র।

” আমার বৃষ্টি বিলাসীনি কি কাউকে আঘাত দিতে পারেনা? ও কি সহজেই অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়? ওকে ওপর থেকে যতটাই কঠিন দেখায়, ভেতরে কি ও ততটাই কোমল? নয়তো আমাকে দেখে রিয়্যাক্ট করলনা কেন! ” এক গাল হাসিতে উদ্ভাসিত হলো রাজ্যে’র বদন। আপনমনেই নিজের সাথে কথা বলছে।

” বুঝতে পেরেছি, আমার বৃষ্টি বিলাসীনি আর সবার মত নয়। ওকে জয় করতে আমার হয়তো একটু দেরি লাগবে কিন্তু কঠিন হবেনা। রাজ্য তোর মিশন বেগেইন’স নাউ। ইয়োর লেডি ইজ অনলি ইয়োর’স। ”

***

বাসায় ফিরে সারাদিন পেখমের মেজাজ খিঁচড়ে থাকল। কারো সাথে কথা বললনা, কারো ফোন রিসিভ করলনা। থেকে থেকেই রাগ তড়তড়িয়ে মাথায় উঠে নাচছিল। একটা কথা ওর মাথায় আসছিলনা, হুট করেই ওর সাথে কেন রাজ্যর ধাক্কা লাগল? অন্য কেউও তো থাকতে পারত তার জায়গায়? কিন্তু সে-ই কেন? আবার সে একদম নরমালভাবে কথা বলছিল, যেন সেখানে পেখমকেই আশা করছিল! সে একটুও চমকায়নি! কেন? অনেক প্রশ্ন এসে জমা হল পেখমের মনে। অনেকগুলো কেন ‘র উত্তর ওকে জানতে হবে। কিন্তু কিভাবে জানবে? কার কাছে জিজ্ঞেস করবে? নানান চিন্তা করতে করতে পেখম বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। চিন্তিত বদনে পায়চারি করছে সেখানে। হঠাৎই ওর চোখ গেল সামনের রাস্তায়। চমকে উঠল মেয়েটা। রাজ্য দাঁড়িয়ে আছে গেইটে। কথা বলছে দারোয়ান আংকেলের সাথে! সে এই বাসার ঠিকানা পেল কোথায়? কি চাইছে সে? চলেই তো গিয়েছিল, তবে ফিরে এসে কেন হুটহাট ওর সামনে উদয় হচ্ছে?

সেই রাতে আর রান্না করলনা পেখম। দুশ্চিন্তায় চোখে ঘুম আসছেনা।

পাঁচদিন পর পেখম বাসা পাল্টাল তবে সেটা খুব গোপনে। ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার রেখে গেছে। বাড়িওয়ালা আংকেলকে সেগুলো বিক্রির দ্বায়িত্ব দিয়েছে। ও শুধু নিজের কাপড়চোপড় আর বইপত্র নিয়ে ফজরের নামাজের পর পরশের বাসায় গিয়ে উঠেছে। সেখান থেকে সকালে নতুন ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে। পরশ এই ফ্ল্যাট ঠিক করেছে।

***

সেদিন সকালে রাজ্য পেখমের আগের ফ্ল্যাটে গিয়ে জানতে পারল, ও খু্ব ভোরেই বাসা ছেড়েছে। নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানা জানতে চাইলে দারোয়ান আংকেল জানায়, তিনি জানেননা। হতাশ রাজ্য হোটেলে ফির আসল। কাননকে টেনে তুলল ঘুম থেকে। ফোন করতে বলল ঋতকে। কানন কলের পুতুলের ন্যায় ফোন করল ঋতকে।

***

সাতদিন সব ঠিকঠাকই ছিল। নতুন ফ্ল্যাটে পেখমের দিনকাল ভালোই যাচ্ছে। ঠিক আটদিন পর পেখম রাজ্যকে দেখল বাসার সামনের রাস্তায়। সে আরেক বিল্ডিংয়ের দারোয়ানের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। পেখম কিছু কেনাকাটা করে বাসায় আসছিল৷ রাজ্যকে দেখে তড়িঘড়ি করে গেটের দিকে পা বাড়াল। ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল৷

পেখমের মাথা এলোমেলো লাগছে। এটা কাকতালীয় হতেই পারেনা। লোকটা কি করে ওর ঠিকানা জানল? কে হতে পারে সেই কালপ্রিট, যে ওর ঠিকানা এই লোকটাকে দিচ্ছে? পেখম ফোন করল বাড়িতে। মা, বড়মা, দাদু সবার সাথে কথা বলল। বাড়ির সবাই জানে ও বাসা পাল্টেছে। নতুন বাসার ঠিকানাও জানে। পেখম বুঝল, কারোনা কারো মাধ্যমেই লোকটা ওর ঠিকানা পেয়েছে। কিন্তু সেই অদৃশ্য ব্যক্তিটা কে হতে পারে? বারবার বাসা পাল্টানোও সম্ভব নয়। কি করবে এবার?

***

” রাবেয়া, একবার মীর চাচাকে দেখতে যাবি? চাচা হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেননা। ”

বড় জা’য়ের কথা শুনে তার দিকে তাকালেন রাবেয়া সুলতানা। তিনি শুনেছেন মীর চাচা অসুস্থ। কিন্তু এখনো তাকে দেখতে যাননি তিনি। তার বড় জা মাঝেমধ্যেই চাচাকে দেখতে যান। কিন্তু তিনি এখনো যেতে পারেননি সংকোচের কারনে। শুধু সংকোচ নয়, রাগও আছে কিছুটা। যে বাড়ির ছেলে তার মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে ইচ্ছে হয়না তার। অবশ্য মীর চাচার ওপর মায়া নেই, সেকথা তিনি কখনোই বলবেননা। বরং মীর চাচাকে তিনি নিজের পিতার মতই শ্রদ্ধা করেন এবং আজীবন করবেন। তবুও তিনি ও বাড়িতে পা রাখবেননা। ”

” আপনিই গিয়ে চাচাকে দেখে আসেন, ভাবী। ”

” তুই এখনো চাচার ওপর রাগ করে আছিস, রাবেয়া? চাচা, চাচী, ঐ বাড়ির বউ-ছেলেমেয়েরা সবাই ক্ষমা চেয়েছে। এমনকি রাজ্যও ক্ষমা চেয়েছে। সে তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। ”

” রাজ্য ক্ষমা চেয়েছে! কিন্তু কেন? ক্ষমা চেয়ে এখন কি কোন ফায়দা আছে? আমার মেয়ে যা অপমানিত হওয়ার হয়েছে। যা দুর্নাম হওয়ার আমার মেয়েরই হয়েছে। ওর ক্ষমা চাওয়া না চাওয়ায় এখন কিছুই যায় আসেনা। ” একটু রুক্ষভাবেই বললেন রাবেয়া সুলতানা।

পারভীন আক্তার বুঝলেন রাবেয়ার মনে এখনো পুরোনো ঘা দগদগে অবস্থায়ই আছে। তিনি বোঝেন একজন মা’য়ের মনের দুঃখ। কতটা দুঃখ পেলে একজন মা একসময়ের অতি আপনজনের থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন পারভীন আক্তার।

” আমি একটু ও বাড়িতে যাব। তুই কি চাচার জন্য পাবদামাছের ভুনা করে দিবি? চাচা তোর হাতের পাবদামাছ ভুনা খুব পছন্দ করত। ”

” কেন দেবনা, ভাবী! তিনি যে আমার বাবারই মত। আমি পাবদামাছ, বোয়ালমাছ আর মুরগী রান্না করে দিচ্ছি। আপনি চাচার পাশে বসে থেকে খাইয়ে আসবেন। আমাকে একঘন্টা সময় দিন। এরমধ্যে সব রেডি করে ফেলছি। ”

কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলেন রাবেয়া সুলতানা। তিনি একে একে সব রান্না করলেন।

***

” পেখম মা, একটু শুনবা? ” দারোয়ানের ডাকে দাঁড়ালো পেখম।

” জ্বি আংকেল, বলুন। ”

” এইগুলান জামাই বাবা তোমারে দিয়া গেছে। ”

” কে! জামাই বাবা কে! আপনি বোধহয় ভুল করছেন। এগুলো আমার নয়। ”

” কি কও, মা! সংসার করবার গেলে জামাই-বউয়ের ঝগড়া হইবারই পারে, তাই বইলা তারে অস্বীকার করবা তুমি! শোন মা, স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক বড়ই পবিত্র আর মজবুত। খুব সহজে এই সম্পর্ক ভাঙ্গেনা। তুমি রাগ কইরা রইছ জন্য জামাই বাবা তোমার জন্য এইগুলান কিনা আনছে। দেখো সে চায়না এই সম্পর্ক ভাঙ্গুক। ”

” আংকেল, এসব আপনি কি বলছেন! আপনাকে কে বলেছে আমি বিবাহিত? আর জামাইবা কাকে বলছেন? শোনেন চাচা, আমার বিয়ে হয়নি। কোন জামাই নেই আমার। কেউ আপনাকে মিথ্যা বলেছে। ”

” রাজ্য বাবা আমার সাথে মিথ্যা কথা কইবারই পারেনা। আড়াই বছর আগেই তার সাথে তোমার বিয়া হইছে। কিন্তু তুমি তখন ছুডু আছিলা বইলা জামাই বাবা প্রথমে রাজি আছিলনা। বিয়ার পর হেয় তোমারে রাইখা বিদেশ চইলা যায়। আড়াই বছর পর দেশে আইছে। এতদিন হেয় তোমার লগে যোগাযোগ করে নাই জন্য তুমি তার উপর রাগ হইছ। অবশ্য রাগ হওনেরই কথা। জামাই বাবা তো তোমার সাথে কম অন্যায় করেনি। ”

দারোয়ান আংকেলের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে পেখম। এতদিনে বুঝতে পারছে রাজ্য’র মতলব। রাগে ওর শরীর কাঁপছে। সেই সাথে লোকটার ওপর ঘৃণা জন্মালো। এতদিনও তাকে ঘৃণা করেনি মেয়েটা। কিন্তু আজ প্রথমবারের মত মনে হল, ঐ লোকটাকে ও প্রচন্ড ঘৃণা করে। রাগের পারদ তড়তড় করে বেড়েই চলেছে। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

” আজকের পর থেকে আমাকে কেউ কিচ্ছু দিলে নিবেননা। এগুলো তাকে ফিরিয়ে দেবেন। ভবিষ্যতে যদি এমনটা করেন, তবে আমি বাড়িওয়ালাকে জানাব। আর ঐ লোকটাকে বলে দেবেন, পেখম কোন ভিখারি নয় যে, যার-তার দান গ্রহন করবে৷ ”

পেখম আর সেখানে দাঁড়ায়না। দ্রুত গতিতে বিল্ডিংয়ে ঢুকে গেল। দারোয়ান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সিকিউরিটি রুম থেকে রাজ্য সবটাই শুনল। দারোয়ান প্রথমে ওর কথায় রাজি হয়নি। তাই মনোমত একটা গল্প শুনিয়ে তাকে রাজি করাতে হয়েছে। রাজ্য বুঝল, এই পদ্ধতিতে কাজ হবেনা। যেভাবে হোক সরাসরি পেখমের সাথে কথা বলতে হবে। ওর কাছে মাফ চাইতে হবে।

***

চারদিন পর পেখম বাহিরে এসেছে। ওর ক্লাস শুরু হবে আরও কিছুদিন পর। আজকেও বাহিরে আসতনা। কিন্তু সবজি শেষ হওয়ায় আসতেই হলো। গেইটের বাহিরে এসে রিক্সার জন্য দাঁড়াল। কিন্তু একটাও রিক্সা দেখলনা। বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যেতেই কোথায় থেকে ওর পাশে এসে দাঁড়ায় রাজ্য। তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে ওর সাথে। পেখম রাজ্যকে দেখে ভিষণ বিরক্ত হলো। একটা রিক্সা আসতেই ডাক দিল।

” পেখম, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। আমাকে দশ মিনিট সময় দিতে পারবে? ”

ঠিক তখনই রিক্সা এসে দাঁড়ায় পেখমের পাশে।

” সরি, দশ মিনিট কেন, দশ ন্যানো সেকেন্ড সময়ও আপনাকে দিতে ইচ্ছুক নই আমি। আর আমি এটাও চাইনা, যখন-তখন যেখানে-সেখানে এসে আমাকে বিরক্ত করুন। এসব কার্যক্রমের জন্য আপনাকে আমার ছ্যাঁচড়া মনে হচ্ছে। নিজেকে আর নিচে নামাতে না চাইলে, আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকুন। আর অন্যের কাছে মিথ্যা গল্প বলাও বাদ দিন। এসব মিথ্যা গল্প ফেঁদে আমাকে কাবু করতে পারবেননা। ”

পেখম উঠে পরল রিক্সায়। রাজ্য একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

” আমি ভুল করেছি। ক্ষমা করে দাও আমাকে। তুমি যদি বল, আমি দুনিয়ার সামনে নিজের ভুল স্বীকার করতে রাজি আছি। ”

কথা শেষ করতে পারলনা রাজ্য। পেখম হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” এই মুহূর্তেই নিজেকে ছ্যাঁচড়া প্রমান করা কি খুবই জরুরি? মীর দাদুর বংশধর নিজের স্বার্থের জন্য এত নিচে নামতে পারে, এটা জানা ছিলনা। আমার জানামতে তাদের শিক্ষায় কোন ভুল ছিলনা। তবে কি ভুল আপনার নিজের মধ্যেই ঘাপটি মেরে ছিল? যেগুলো ফরেনে গিয়ে ডানা মেলেছে? আপনার শতশত ভুল হয়তো তাদের কাছে সঠিক লাগতে পারে, কিন্তু আমার কাছে ভুল ভুলই। যে একবার ভুল করে, সে বারবার ভুল করতেই পারে। ক্ষমা চাইতে এসেছেন? আপনাকে ক্ষমা অনেক আগেই করেছি। কারন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। সেদিন সেই আঘাত না পেলে আমি এতদূর আসতেই পারতামনা। আপনি আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, একটা মেয়ের পড়াশোনা কতটা দরকার। তাকে স্বাবলম্বী হতে গেলে পড়াশোনার প্রয়োজন আছে। কারও সমকক্ষ হতে গেলেও পড়াশোনাই প্রথম প্রায়োরিটি পায়। আশা করব আজকের পর থেকে এমন ছ্যাঁচড়ামি করবেননা। মামা, চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। ”

রাজ্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। তাই পেখমের কথায় এতটুকুও কষ্ট পেলোনা। কারন মেয়েটা ভুল কিছু বলেনি। কিন্তু যখনই ‘ ছ্যাঁচড়া ‘ শব্দটা মনে হচ্ছে তখনই ওর মাথার একটা তার ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।

” আমি ছ্যাঁচড়া! ওকে করবনা আর ছ্যাঁচড়ামি। কাল থেকে ডিরেক্ট এ্যাকশন হবে। বেষ্ট উইশেস ফর টুমোরো, রাজ্য। ”

চলবে…