#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী জামী
” রাজ্য, তুই এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? দেশ থেকে এসেছিস সেই কবে, কিন্তু আমার সাথে একবারও দেখা করলিনা? আমি কয়েকদিন এসে ঘুরে গেছি, কিন্তু তোর দেখা পাইনি। কোথায় থাকিস? তোর চোখমুখ এমন শুকিয়েছে কেন? খাসনা ঠিকমত? ” মিশু রাজ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পরম স্নেহে।
মিশুর কথায় রাজ্যের কান্না পেলেও নিজের আবেগকে দমন করল কঠিনভাবে। নিজের কষ্ট কাউকে দেখাতে চায়না সে। গোপনেই কষ্টকে উপভোগ করতে চায়। কিছু কিছু কষ্ট উপভোগেও সুখ। রাজ্য সেই সুখের ভাগীদার কাউকেই করতে চায়না। মনের গহীনে একান্তেই পুষতে চায় কষ্ট নামক গরল।
” আমি আজকাল ভিষণ ব্যস্ত থাকি, আপু। নিয়মিত ক্লাস নিতে হচ্ছে, এছাড়া নানান প্যারা তো আছেই। তাই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনা। ”
” আবোলতাবোল কথা বলে আমাকে শান্তনা দিচ্ছিস! দিনে না-হয় ব্যস্ত থাকিস, রাতে কি করিস? রাতেও তোর কাছে এসেছিলাম। কিন্তু ফ্ল্যাটে কেউ ছিলনা। আমরা তিনঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করেছি তোর জন্য। এমনকি তোকে ফোনেও পাইনি। ”
” আজকাল কখন কোথায় থাকছি সেটা আমি নিজেও বলতে পারছিনা। তোমার ভাই আর বাউণ্ডুলে নেই। তুমিই তো চাইতে, আমি জীবনের প্রতি একটু সিরিয়াস হই? চেষ্টা করছি সিরিয়াস হতে। ”
” তোকে সিরিয়াস হতে বলেছি, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বলিনি। সিরিয়াস হতে গিয়ে নিজের অবস্থা কি করেছিস, সেটা দেখেছিস? দেশে যখনই ফোন করি, মামী শুধুই কাঁদে। তুই নাকি আর দেশে যেতে চাসনা? বিয়ে করতে চাসনা? কেন এমন করছিস? কি হয়েছে তোর? ”
” কিছুই হয়নি, আপু। একটু ব্যস্ত আছি এই যা। তুমি টেনশন নিওনা। ভালো কথা, কি রান্না করেছ আমার জন্য? ”
” তোর সব পছন্দের খাবার। ”
” তাড়াতাড়ি দাও, ক্ষুধা লেগেছে ভিষণ। ”
মিশু আর কিছু না বলে কিচেনে গেল।
সেদিন বিকেলেই মিশু নানা ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেল। সে ভেঙে পরলেও রাজ্যকে ফোন দিল। কিন্তু রাজ্যের ফোন বন্ধ পায়।
***
মীর বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। মীর রেজাউল করিমের ছেলেমেয়েরা বাবাকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। রাজিয়া পারভীন বারবার ছেলেকে ফোন দিচ্ছেন কিন্তু ওর ফোন সুইচড অফ। এবার তিনি ছেলের ওপর একটু বিরক্তই হলেন। তার ছেলে এত দ্বায়িত্ব জ্ঞানহীন হবে এটা তিনি ভাবতেই পারছেননা। কিন্তু তিনি জানতেই পারলেননা, তার ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করে নিউ জার্সির হসপিটালে ভর্তি আছে।
***
” মীর চাচার জানাজায় তোমরা কেউ যাবেনা? ”
পারভীন আক্তার জিজ্ঞেস করলেন তার স্বামী আর দেবরদের। সৌভাগ্যক্রমে গতকালই তার দুই দেবর রাকিব আর রাশেদ পরিবার নিয়ে গ্রামে এসেছেন।
” যাওয়া তো দরকার। কিন্তু ওদের সামনে কিভাবে যাই বল, পারভীন? ” ধীর গলায় বললেন পারভীন আক্তারের স্বামী সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
” কেন? যেভাবে তিন বছর আগে ওদের সাথে ঝগড়া করতে গিয়েছিলে, সেভাবেই যাবে। নিজেদের অহংকারই যদি বজায় না থাকল, তবে কিসের সৈয়দ বংশ তোমাদের? ”
উপস্থিত তিন ভাই বুঝলেন রেগে আছেন পারভীন আক্তার। রাকিব আহমেদ চেষ্টা করলেন বড় ভাবীকে বোঝাতে।
” সেদিন ওরা অন্যায় করেছিল, ভাবী। ”
” ওরা নয়, বল রাজ্য অন্যায় করেছিল। রাজ্যের অন্যায়ের শাস্তি তোমরা ওর পুরো পরিবারকে দিয়েছ, তোমাদের আব্বাকে দিয়েছ। তোমাদের কোন ধারনা আছে গত তিন বছরে আব্বা কত চোখের পানি ফেলেছেন? নিজেদের অহংকার বজায় রাখতে তোমরা তোমাদের বৃদ্ধ আব্বার দিকেও তাকাওনি। দুই বৃদ্ধ দিনের পর দিন কেঁদেছেন, ছটফট করেছেন। কিন্তু তোমরা সেটা বুঝতে পারনি। সব সময়ই নিজেদের সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়েছ। তোমাদের ভুলভাল সিদ্ধান্তে দুই পরিবারের কতবড় ক্ষতি হয়েছে
সেই খবর তোমরা রাখ? ”
” আহ্ পারভীন, কি বলছ এসব? আমরা আবার কি ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিলাম! ”
” তোমরা সব সময়ই নিজেদেরকে সঠিক মনে কর। সেজন্যই তো পেখমের এতবড় ক্ষতি করবার পরেও তোমাদের মধ্যে কোন অনুশোচনা নেই। আমি সেদিন কতবার করে বলেছি, এখনই মেয়েটার বিয়ে দিওনা। পড়াশোনা করছে করুক। কিন্তু তোমরা আমার কথা শুনেছ? আব্বার কথা শুনেছ? যেই ভালো পরিবার দেখেছ, অমনি সেখানে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলে। এখন কি হচ্ছে? তোমাদের সেই পরিবারের মানুষজন এতদিন মুখোশ পরে ছিল, এটা তোমরা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছ। ”
” ভাবী, আমরা বুঝতে পারিনি তাই ভুলটা হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে আমরা পেখমকে ভালোবাসিনা এমনটা কিন্তু নয়। ওর জন্য চিন্তা আমাদেরও হয়। ” রাশেদ আহমেদ মিনমিন করে বললেন।
” ভুল! মুখে মুখে নিজেদের ভুল স্বীকার করলেই বুঝি সাধু হওয়া যায়? পারবে মেয়েটার আগের জীবন ফিরিয়ে দিতে? পারবে মেয়েটাকে সুখী করতে? তোমাদের কথা রাখতে মেয়েটাও সেদিন বিয়েতে মত দিয়েছিল। টু শব্দটি করলনা একরবারও। শুধু তোমাদের সম্মানের কথা ভেবে। আর এদিকে আমি ওর জন্য কত কি ভেবেছিলাম। চেয়েছিলাম পেখমকে মানিয়ে রাজ্যের সাথেই ওর বিয়ে দেব। মীর চাচাও সেটাই চেয়েছিলেন। কিন্তু তোমরা সেটা আর হতে দিলে কই? চাচাও মারা গেলেন অপূর্ণ ইচ্ছে পোষণ করে। আবার তার একমাত্র ভাতৃসম বন্ধুকেও তোমরা তার দেহের পাশে যেতে দিচ্ছনা। এতটাই কি খারাপ ছিলেন তিনি? কি দোষ ছিল তার? পেখমকে নাতবউ করতে চাওয়াই বুঝি তার দোষ? ” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন পারভীন আক্তার।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন কোনকালেই স্ত্রী’র চোখের পানি সহ্য করতে পারেননা। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তিনি স্ত্রী’র পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অতি যত্নে মুছে দিলেন তার চোখের পানি।
” কেঁদোনা পারভীন, স্বীকার করছি ভুল আমাদেরই ছিল। আমরা যাব মীর চাচার জানাজায়। তার পরিবারের পাশে থাকব আমরা। আবার পেখমকেও তার প্রাপ্য সুখ ফিরিয়ে দেব। আমাদের ভাতিজীকে আমরা আর কষ্ট পেতে দেবোনা। ”
কিছুক্ষণ পরই সৈয়দ শামসুল হক তার ছেলে-বউমাদের সাথে চললেন তার বন্ধুর বাড়ি।
***
মীর দাদুর মৃত্যুর সংবাদ শুলে পেখম ফুঁপিয়ে কাঁদছে। দাদু ওকে কত ভালোবাসত সেটা পেখম জানে। এইতো সাড়ে তিনমাস আগেও গ্রামে গিয়ে দাদুকে দেখতে গিয়েছিল। দাদু সেদিন ওর হাত ধরে খুব কেঁদেছেন। বারবার ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ওকে মীর বাড়ির বউ করতে না পারার দুঃখ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পেখমকেই নাতবউ হিসেবে দেখতে চান। সেদিন নিজের কতশত ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন পেখমকে। কতশত স্মৃতি স্মরণ করেছেন সেদিন। প্রান খুলে কথা বলেছেন পেখমের সাথে।
মৃদুল রুমে ঢুকে পেখমকে কাঁদতে দেখে কপাল কোঁচকায়।
” কি হয়েছে, কাঁদছ কেন? ”
” মীর দাদু আর নেই। ” এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে পারলনা পেখম।
” কোন মীর দাদু? ওহ্ বুঝতে পেরেছি, যার নাতী তোমাকে রিজেক্ট করেছিল? বিয়ের দিন তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে ইউএস চলে গিয়েছিল? তুমি পারও বটে! যাদের জন্য সমাজে তুমি অপমানিত হলে, তাদের জন্যই তুমি কাঁদছ! একটু ন্যাকামো হয়ে গেলনা? জাস্ট বিরক্তিকর। ”
মৃদুলের কথা শুনে পেখম অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘৃণায় ওর শরীর রি রি করছে। নিজেকে এই মানুষটার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতেও ঘৃণা হচ্ছে।
” তোমরা, এই পরিবারের সবাই গর্ব করে নিজেদের শিক্ষিত, সমাজের উচ্চবর্গের মানুষ বলোনা! তোমরা কি জানো এটা ডাহা মিথ্যা? একজন উচ্চশিক্ষিত, সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের ভাষা কখনোই এমন হতে পারেনা। আদতেই তোমরা তা নও। তোমাদের আপাদমস্তক মিথ্যার প্রলেপে ঢাকা। তোমরা হলে নামধারী শিক্ষিত, সুশীল। তোমাদের ভেতরটা পুরোটাই অন্ধকার। ”
” জাস্ট সাট-আপ। মুখে লাগাম দাও। এই মুহূর্তে আমার সামনের ব্যক্তিটি যদি তুমি না হতে, তবে এতক্ষণে তার কয়েকটা দাঁত মেঝেতে থাকত। এতদিন শুধু প্রবাদ শুনেছি, কুমিরের কান্না। আজ সেটা দেখেও নিলাম। আর কত ঢং যে তুমি দেখাবে, আল্লাহ মালুম। ”
পেখম বিছানায় বসে আছে। ওর দু-চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। দু-চোখের স্বচ্ছ সরোবরে নিশ্চিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে অন্তহীন কষ্টেরা। একটা কথাই ভেবে চলেছে মেয়েটা, সব সময় কেন ওকেই কষ্ট পেতে হয়? অপমান কেন ওর পিছু ছাড়েনা? ওর জীবনে সুখ কেন অধরা?
দীর্ঘক্ষন পর চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় পেখম। মৃদুল সেই যে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে, এরপর আর রুমে আসেনি। নিশ্চয়ই স্টাডি রুমে আছে সে। হসপিটাল থেকে ফিরে হয়তো খায়ওনি সে।
স্টাডি রুমের দরজা ভেতর থেকে লাগানো। পেখম বেশ কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দেয়না মৃদুল। বেশ কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল পেখম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমে আসতেই একজন মেইডের মুখোমুখি হলে, তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, মৃদুল অনেক আগেই খেয়েছে। মলিন হেসে পেখম পা বাড়াল রুমের দিকে। ও বুঝে গেছে, আজকে আর মৃদুল রুমে আসবেনা। গত তিন মাসে এটা সে অনেকবারই করেছে। প্রথম প্রথম পেখম বুঝতনা মৃদুলের মনোভাব। কিন্তু এখন ঠিকই বুঝতে পারে।
***
বেশ রাত হয়েছে। আকাশে থালার মত রুপালী চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চাঁদের আলো শরীরে মেখে ধরনী হয়েছে গরবিনী।
পেখম জানালার গ্রীলে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে দূর অন্তরীক্ষে। চিন্তা করছে জীবনের নানান অধ্যায়ের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠার গল্পের কথা। এতটুকু জীবনে কতকিছুই দেখা হয়েছে, কতইনা শিক্ষা পেল জীবন থেকে। ছোটবেলা থেকে বাবার আদর বিনা বেড়ে উঠেছে। আজীবন মা’কে কাঁদতে দেখেছে। পেয়েছেছে নানার বাড়ির সবার কাছ থেকে অবহেলা-অনাদর। দোষ একটাই, মা কেন তার বাবার অমতে বিয়ে করেছিল। তাই চিরতরে বাবার বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা বাড়ি ছেড়ে যাবার পর মা দুই-তিন বার ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু মিলেছিল চরম অপমান। মামা-মামীদের অকথ্য গালাগালি। অবশ্য নিজের বাড়িতেও কম হেনস্তা হয়নি ওর মা। মেহনাজ চাচীও ওদের কম কথা শোনায়না। চাচা-ভাইয়াদের কথা রাখতে বিয়েতে রাজি হল, কিন্তু এখানেও দুর্ভাগ্য ওর সঙ্গ ছাড়েনি। প্রথম থেকেই শ্বাশুড়িসহ নানান আত্নীয়রা এটাসেটা বলত। শুরুতেই মুখ বুজে সহ্য করে গেলেও পরে আর সহ্য করতে পারেনি পেখম। ওদের কথার পিঠে উত্তর দিয়েছে। কিন্তু এতে ওরা যেন আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এখন কটুকথা ছাড়া তারা আর কথাই বলতে পারেনা। প্রথমদিকে মৃদুল সবকিছু শুনেও না শোনার ভান করে থেকেছে। কিন্তু আজকাল সে-ও যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে পেখমকে। এই তিনমাসেই পেখম হাঁপিয়ে উঠেছে। বাকি জীবন এসব সহ্য করবে কিভাবে সেটাই ভেবে পায়না।
দরজা খোলার শব্দে গার ঘুরিয়ে পেছনে তাকায় পেখম। শ্বাশুড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাঁকা ঢোক গিলল। বুঝতেই পারছে ভদ্র মহিলা ওকে কথা শোনানোর জন্যই রুমে এসেছে। চোখ মুছে মনে মনে প্রস্তুত হয় পেখম। সংসার যুদ্ধে যখন নেমেইছে, তখন আর কটুকথার ভয় কিসের?
চলবে…
#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী
আটদিন পর জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল রাজ্য। ততক্ষণে ভিজিটিং আওয়ার পেরিয়েছে। কর্তব্যরত নার্স রাজ্য’র জ্ঞান ফিরতে দেখেই ডক্টরকে ডাকল। ডক্টর এসে চেক-আপ করার পরই রাজ্য তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়।
দশদিন পর অরবিন্দ’র সাথে বাসায় ফিরল রাজ্য। অ্যাকসিডেন্টের পর ওর ফোন ড্যামেজ হওয়ায় পুলিশ কোন কন্টাক্ট নম্বর পায়না। কিন্তু আই কার্ড থেকে যাবতীয় তথ্য বের করে যোগাযোগ করে ওর ভার্সিটিতে।
” থ্যাংস, দোস্ত। তুই না থাকলে আমি বোধহয় এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হতামনা। ” গত কয়েক বছরে রাজ্য আর অরবিন্দ আগের থেকেও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ওর সম্বন্ধ ‘ তুমি ‘ থেকে ‘ তুই ‘ তে এসেছে।
” এভাবে বলিসনা, রাজ্য। আমি তোর জন্য কিছুই করিনি, আমি যা করেছি আমার বন্ধুর জন্য করেছি। তুই আমার জন্য কি কি করেছিস, সেটা আমি ছাড়া কেউই জানেনা। সবার জীবনে তোর মত বন্ধু থাকা খুবই প্রয়োজন বুঝলি? ”
” অরু, মিশু আপু আসেনি? আমার জ্ঞান ফেরার পর আপু একবারও আমাকে দেখতে গেলনা, কিন্তু কেন? ”
” আমি তিনদিন আগে মিশুদি’র ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেখানে নেই। দি’র নেইবার বলল, সে পরিবারসহ দেশে গিয়েছে। ”
অরবিন্দের কথা শুনে রাজ্যের ভ্রু কুঁচকে আসল। মিশুপু ওকে না জানিয়ে দেশে গিয়েছে! এমনটা হওয়ার কথা নয়তো! রাজ্য’র মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। দেশে সবাই ভালো আছে তো ? দাদু সুস্থ আছে নাকি সে অসুস্থ হয়ে গেছে? রাজ্য আর কিছু ভাবতে পারলনা। কর্ডলেস হাতে তুলে নিল৷
***
রাজিয়া পারভীন কুরআন তিলাওয়াত করছেন। গত দশদিন ধরে তিনি নিয়মিত তিনবেলা কুরআন তিলাওয়াত করছেন। তিলাওয়াতের মাঝেই ফোন বেজে উঠল। রাজিয়া পারভীন ধীরেসুস্থে তিলাওয়াত শেষ করলেন। কুরআন রেখেই ফোন হাতে নিয়েই তিনি তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলেন।
” রাজ্য, এতদিন কোথায় ছিলি বাবা? কেমন আছিস তুই? এই কয়দিন তোকে কতবার ফোন দিয়েছি তুই জানিস? তোর জন্য বাড়ির সবাই চিন্তা করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ” কেঁদে উঠলেন রাজিয়া পারভীন।
” আমি ঠিক আছি আম্মু। তোমরা কেমন আছ? দাদু, দিদুন ভালো আছেতো? ফোনটা একবার দাদুর কাছে নিয়ে যাওতো। অনেকদিন দাদুর সাথে কথা হয়না। এই কয়দিন আমার সাথে কথা না বলে , আমার কোন খবর না পেয়ে, দাদু নিশ্চয়ই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে? ”
ছেলের এহেন প্রস্তাবে অতিকষ্টে কান্না সংবরণ করলেন রাজিয়া পারভীন। দাদুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার ছেলে কি প্রতিক্রিয়া দেবে সেটাই তার চিন্তার বিষয়। রাজিয়া পারভীন নিরব থাকতে দেখে রাজ্য আবারও অস্থিরচিত্তে জিজ্ঞেস করল,
” আম্মু, কথা বলছনা যে? তোমার কি শরীর খারাপ? ”
” আমি ঠিক আছি, বাবু। তুই এত চিন্তা করিসনা। এতদিন তোর খবর না পেয়ে আমরা সবাই চিন্তায় মরে যাচ্ছি। ”
” এইতো আমি ফোন দিয়েছি, আর চিন্তার কোন কারন নেই। একে একে সবার সাথেই কথা বলব। মিশুপি’র সাথেও কথা বলব। সে আমাকে না জানিয়ে দেশে গেল। এটা মোটেও ঠিক করেনি। কিন্তু তার আগে তুমি দাদুকে ফোনটা দাও। আগে দাদুর সাথে কথা বলি। দাদুর জন্য খুব টেনশন হচ্ছে। ”
” রাজ্য, তুই একটু শান্ত হ বাপ। আমার কথা মন দিয়ে শোন। কথা দে, ভেঙে পরবিনা। ”
” কি হয়েছে, আম্মু? তুমি এমন কথা বলছ কেন? ” ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞেস করল রাজ্য। ওর বুক দুরুদুরু করছে৷
” আব্বা আর নেই, বাপ। দশদিন হয় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ” এতটুকুই বলতে পারলেন রাজিয়া পারভীন। কান্নায় ভেঙে পরলেন তিনি।
মা’য়ের মুখে দাদুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে রাজ্যের হাত থেকে ফোন পরে গেল। ধপ করে বসে পরল সোফায়। সর্ব শরীর কাঁপছে। এ কি শুনল! দাদু আর নেই! দাদুর শেষ সময়ে তার পাশে থাকতে পারলনা, দাদুর জানাজায় উপস্থিত হতে পারলনা, দাদুর কবরেও একমুঠো মাটি দিতে পারলনা, এমনই হতভাগা সে! অথচ দাদু তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। হু হু করে কেঁদে উঠল ছেলেটা। দাদু নেই, আর কখনেই তার হাসিমাখা মুখটা দেখা হবেনা। তিনি আর কখনোই রাজ্যসাহেব বলে ডাকবেননা। এসব ভেবেই রাজ্যের বুকের ভেতর হাঁসফাঁস করছে।
রাজিয়া পারভীন ছেলেকে ডেকেই চলেছেন। কিন্তু রাজ্য সাড়া দিচ্ছেনা। তিনি বুঝলেন রাজ্য কাঁদছে।
রাজ্যকে এভাবে কাঁদতে দেখে অরবিন্দ ওর দিকে ছুটে গেল।
” রাজ্য, কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে? ডক্টরের কাছে যাবি? ” রাজ্যকে জড়িয়ে ধরল অরবিন্দ।
অরবিন্দের কথার কোন জবাব দিতে পারলনা রাজ্য। অনর্গল কেঁদেই যাচ্ছে। অরবিন্দ আর কিছুই জিজ্ঞেস করলনা। বন্ধুকে কাঁদতে দিল। মনকে হালকা করতে কখনো কখনো কান্নার ভিষণ প্রয়োজন।
***
” বড় ভাই, আমি ঢাকা যেতে চাচ্ছি। পেখমকে নিয়ে আসব। মেয়েটা কিছুদিন গ্রামে এসে বেরিয়ে যাক। আপনি কি বলেন? ” রাকিব আহমেদ তার বড় ভাইয়ের থেকে অনুমতি চাইলেন।
” কবে যাবে? একাই যাবে নাকি সাথে কাউকে নেবে? ”
” আমি একাই যাব। সকালে গিয়ে বিকেলেই পেখমকে নিয়ে ফিরে আসব। তাই আর কারও যাওয়ার দরকার নেই। ভাবছি আগামী পরশুই যাব। মেজো ভাবী, তুমি আর ভাবী মিলে বেয়াই বাড়িতে কি কি পাঠাবে তার জোগাড় কর। ”
” ভাবী, তোমরা সবকিছু বেশি বেশি করে দিও। যাতে ওরা কোন ভুল ধরতে না পারে। ” রাশেদ আহমেদ বললেন।
” তোমার কি মনে হয়, ওরা গলার জোর কমিয়ে কথা বলার মানুষ? মেয়ের বিয়েতে কি কম দিয়েছিলে? বিয়ের পরও কি আমরা কম দিয়েছি? এতকিছু দেয়ার পরও কি ওরা ওদের মুখ বন্ধ রেখেছে? যারা কথা বলার তারা অল্প দিলেও কথা শোনাবে, বেশি দিলেও কথা শোনাবে। তার থেকে বরং পাঁচ কেজি মিষ্টি নিও যেও। কিছু কিছু কুকুরকে মুগুরের ওপরে রাখতে হয়, বুঝলে? ” রেগে উঠলেন পারভীন আক্তার।
” ভাবী, তুমি তো দেখছি ওদের ওপর ভিষণ খেপেছ! তুমিই বোধহয় ওদের সাইজ করতে পারবে। ” রাকিব আহমেদ গম্ভীরমুখে বললেন।
” কাউকেই সাইজ করতে হবেনা। এসবের প্রভাব আমার মেয়ের ওপর পরবে। আমি চাইনা আমার মেয়ে আজীবন আমার মতই কাঁদুক। ছোট থেকেই মেয়েটা আমার কষ্ট পেয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কষ্ট পাক সেটা আমি চাইনা। ” রাবেয়া সুলতানা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
রাবেয়া সুলতানার চোখের পানি দেখে সকলেই মাথা নিচু করলেন। তাদের ভাইয়ের জন্যই যে তার এই অবস্থা সেটা তারা জানেন। বিয়ের পর থেকেই তার ভাই স্ত্রীকে সুখ দেয়নি। সব সময়ই তার নজর বাহিরের দিকে ছিল। শুধুমাত্র রাবেয়া সুলতানা ধৈর্য্যশীলা মহিলা জন্যই এই সংসারে থেকে গেলেন এতকাল।
” কেঁদোনা, মেজ ভাবী। আমরা পেখমের ভাগ্য তোমার মত হতেই দেবনা। যে করেই হোক আমরা পেখমকে সুখী করবই। প্রয়োজনে মৃদুলের সাথে কথা বলব। আমরা পেখমের ভালো চাই। যখন জানতে পারলাম, মৃদুলের পরিবার থেকে বিয়ের প্রপোজাল এসেছে, খোঁজ খবর নিলাম। জানলাম ওদের বংশ বুনিয়াদ ভালো, সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ছেলে ডক্টর। তাই আর অমত করিনি। কিন্তু কে জানত, ওরা ওপরে ওপরে সুশীল মানুষের মুখোশ পরে আছে! ভুল যেহেতু আমরা করেছি, তাই ভুল সংশোধনও আমরাই করব। ”
” কি করবে তোমরা? এসব নিয়ে যত ঘাঁটাঘাঁটি করবে, ততই বিষয়টা খারাপের দিকে গড়াবে। তোমরা আর যাই কর, আমার মেয়ের সংসার ভেঙ্গোনা। আমি সারাজীবন অপয়া অপবাদ মাথায় নিয়ে সংসার করে এসেছি, আমি জানি এসব অপবাদ কতটা অপমানের। নিজের অপমান-অপবাদ সহ্য করতে পারলেও, মেয়ের নামে এমন অপবাদ সহ্য করতে পারবনা কিছুতেই। ”
” আহ্ রাবেয়া, কি শুরু করলি বলতো? তুই এমন আজেবাজে কথা চিন্তা করছিস কেন? মনে রাখিস, আমরা যতই নরম হয়ে থাকব, ওরা ততই আমাদের মাথায় উঠে নাচবে। মাঝেমধ্যে চোখে আঙুল দিয়ে ওদের ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। তবেই ওরা বুঝবে, পেখম একা নয়। আমরাও আছি ওর সাথে। চোখ মুছে রান্নাঘরে চল। পিঠা বানাতে হবে। তোর মেয়ের পছন্দের পিঠা বানিয়ে দিবি। ওর পছন্দের খাবার রান্না করে পাঠাবি। কাউকে পাঠাতে হবে সহদেব কাকার বাড়িতে। কাকিমা হাঁস বিক্রি করছে শুনলাম। কয়েকটা হাঁস কিনতে হবে। মৃদুল নাকি হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করে। চল যাই। ” পারভীন আক্তার এক ধমকে থামিয়ে দিলেন রাবেয়া সুলতানাকে। তিনি এই মুহূর্তে তাকে ধমক না দিলে রাবেয়া সুলতানা কাঁদতেই থাকতেন। কিন্তু তিনি তার বোন সমতুল্য জা’য়ের চোখের পানি সহ্য করতে পারেননা।
***
” পেখম, এসব কি রান্না করেছ! ” ডাইনিং টেবিলে এসেই খেঁকিয়ে উঠলেন আইভি রহমান।
” মাসকলাইয়ের ডাল, শুটকি ভুনা, পুঁইশাক চচ্চড়ি, আলুর ডাল। ” পেখম নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল।
” তোমাকে আমি এগুলো রান্না করতে বলেছিলাম? এসব থার্ডক্লাস খাবার কে খাবে? আমার ছেলেমেয়েরা এসব খায়না তুমি ভালো করেই জানো। তারপরও এসব কেন রান্না করেছ? ”
” বাবা আমাকে এগুলো রান্না করতে বলেছেন। আজকে বাবার পছন্দের খাবারই না হয় খান। কালকে আপনাদের ফেভারিট খাবার রান্না করব। ”
” কে বলেছে? তোমার শ্বশুর? সে বলেছে, আর তুমিও রান্না করেছ! আজব! আচ্ছা মানলাম, সে বলেছে তাই এসব রান্না করেছ। আমিওতো বলেছিলাম, রাতে নানরুটি, কাবাব, মিক্স স্যালাড হবে। সেগুলো করেছ? শ্বশুরের ইচ্ছে পূরণ করেছ ঠিকই, কিন্তু আমাদের ইচ্ছেকে অসম্মান করলে। ”
” আমি বাসায় এসেছি সন্ধ্যার আগে। সেটা আপনি জানেন। এতটুকু সময়ের মধ্যে এতকিছু রান্না কিভাবে করব! আজকে এগুলোই খান। কাল রাতে নান, কাবাব, স্যালাড যা বলবেন তাই করে দেব। ”
” তুমি আমাকে অর্ডার করছ? তোমার ইচ্ছেতে আমরা খাবার খাব? তোমার এই গাঁইয়া খাবার তুমিই খাও। আমি ফুড পান্ডায় অর্ডার করছি। আমরা মা-ছেলে সেগুলোই খাব। যতসব গাঁইয়া মেয়ে। কোন কুক্ষণে যে এই মেয়েকে ছেলের বউ করে এনেছিলাম। আমার ছেলের জীবনটা নিজ হাতে শেষ করে দিলাম। ”
পেখম ওর শ্বাশুড়ির কথা গায়ে মাখলনা। আজকাল তাদের কথা পেখম এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। নিজের মত করে চলতে শিখে গেছে ও। বেশ বুঝতে পারে, এরা ওর কোন কাজেই লাগবেনা। এরা শুধু নিজেরটাই সুদেআসলে বুঝে নিতে জানে।
” বউমা, এসো তুমি আর আমি এই টেস্টি খাবারগুলো খাই। এরা মা-ছেলে ফুড পান্ডায় হোক আর ফুড ডগে হোক, যেখানে খুশি সেখানে অর্ডার করুক। এরা নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য পায়ে দলানোর মানুষ বুঝলে? এদের কথা কানে নিওনা। এসো আমার প্লেটে খাবার তুলে দাও। ” মিনহাজ রহমান চেয়ার টেনে বসলেন। সেই সাথে স্ত্রীকে কথাগুলো শোনাতে ভুল করলেননা৷
আইভি রহমান স্বামীর কথার উপযুক্ত জবাব হাতড়ে পেলেও কিছুই বললেননা। কারন এখন ডাইনিং টেবিলের সামনে তিনজন মেইড দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে তিনি আর অপমানিত হতে চাননা। তিনি ভালো করেই জানেন, তার কথার প্রত্যুত্তরে মিনহাজ রহমান কটুকথাই বলবেন। তাই রাগ হলেও কথাগুলো তিনি নিরবে হজম করলেন।
বিঃদ্রঃ গত কয়েকদিন থেকে আমি ভিষণ অসুস্থ। ইন্টারনাল কিছু প্রবলেম দেখা দিয়েছে। গত চারদিন থেকে স্যালাইন চলছে। আজকে ক্যানুলা খুলতেই অনেক কষ্টে এতটুকু লিখতে পেরেছি। আপনাদের এতদিন অপেক্ষা করানোর জন্য আমি লজ্জিত।
চলবে…