#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১৭
জাওয়াদ জামী জামী
দরজা খুলেই আইভি রহমান অবাক হলেন। পেখমের চাচা রাকিব আহমেদ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
” আরে বেয়াই যে! ভেতরে আসুন। হঠাৎ করেই আসলেন, আপনাকে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। ”
” হঠাৎ করেই আসতে হয় বুঝলেন? এই যে আমাকে দেখে আপনি অবাক হয়েছেন, এটা দেখতে বেশ লাগল কিন্তু। ”
আইভি রহমানের সাথে হেসে কথা বললেন রাকিব আহমেদ। আইভি রহমান লক্ষ্য করলেন রাকিব আহমেদ গাড়িতে এসেছেন। এবং দুইজন লোক গাড়ি থেকে নানান সাইজের কার্টুন বের করছে। ইতোমধ্যে পেখম উপস্থিত হল সেখানে। চাচাকে দেখে ও বেশ অবাক হয়েছে। রাকিব আহমেদ ভাতিজীকে দেখে হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলেন।
” কেমন আছিস, মা? এত শুকিয়েছিস কেন? তোর কি শরীর খারাপ? ”
” আমি ভালো আছি, চাচা। তুমি ভেতরে এস। কার্টুনে কি আছে, চাচা? ”
” তোদের পছন্দের খাবার, পিঠা আরও অনেক কিছুই আছে। ”
” মুদুল, আমি পেখমকে নিতে এসেছি। শুধু পেখম বলছি কেন, তোমাকেও নিতে এসেছি। বিয়ের পর তোমরা গ্রামে যাওনি। আব্বা বারবার তোমাদের দেখতে চাইছিলেন। ” রাতে খাবার টেবিলে রাকিব আহমেদ সবার সামনে কথাগুলো বললেন।
চাচা শ্বশুরের কথা শুনে মৃদুল কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। সে নীরবে খেয়েই চলেছে। এদিকে রাকিব আহমেদ ওর দিকে তাকিয়ে আছেন উত্তরের আশায়।
” মৃদুল, বেয়াই তোমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, তুমি কি শুনতে পাওনি? ” ছেলেকে নীরব থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন মিনহাজ রহমান।
এবার নড়েচড়ে বসল মৃদুল। চোখ তুলে চাইল রাকিব আহমেদের দিকে।
” আসলে চাচা, এই প্রস্তাবটা আমাকে না দিয়ে আম্মুকে দিলেই বোধহয় ভালো হত। আম্মু আমাদের অভিভাবক। এই পরিবারের কর্ত্রী সে। আম্মুই নির্ধারন করেন, আমরা কে, কখন, কোথায় যাব। ”
মৃদুলের কথা শুনে সামান্য হাসলেন রাকিব আহমেদ। তিনি এমন ভাব করলেন, যেন মৃদুলের কথায় কিছুই মনে করেননি। এদিকে পেখম তাকিয়ে আছে চাচার দিকে। ও ভালো করেই চেনে নিজের চাচাকে। এই বাড়িতে সবার সামনে মৃদুলকে চড় মারতে তিনি দুইবার ভাববেননা। ভেতরে ভেতরে একটু ভয়ই পাচ্ছে পেখম।
” এটা তুমি আগে বলবেনা! আগে জানলে আমি বেয়ানের কাছেই প্রস্তাবটা দিতাম। এদিকে আমি ভেবেছিলাম, তুমি শিক্ষিত ছেলে, প্রতিষ্ঠিত ডক্টর, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াও তাই নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তোমার নিজেরই আছে! তোমাকে দেখে কিন্তু বোঝা যায়না তুমি এখনো ফিডার খাও, না মানে বলতে চাচ্ছি, আম্মুর আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াও? আমাদের পরিবারের পুরুষেরা অবশ্য এমন নয়। তারা তাদের মা-স্ত্রী’কে সম্মান করে ঠিকই কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তারা কারও দ্বারস্থ হয়না। নিজের মা’কে যেমন মাথায় তুলে রাখে, তেমনি স্ত্রী’কেও তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনা। আর আমার আম্মা কিংবা বড় ভাবী ও এসব স্বামী-স্ত্রী’র বিষয়ে কখনোই মাথা ঘামায়না। তবে এখন তোমার কথা শুনে বুঝলাম, মাঝেমধ্যে মা-স্ত্রী’র পরামর্শ নিতেই হয়। আমরা যদি কয়েকমাস আগেই তাদের পরামর্শ শুনতাম তবে আজকের এই দিনের সম্মুখীন হতে হতোনা। ” হো হো করে হেসে কথাগুলো বললেন রাকিব আহমেদ।
রাকিব আহমেদের কথায যেন বাজ পরল ডাইনিং এরিয়ায়। রাকিব আহমেদের কথা বুঝতে পারার মত বোকা কেউ নেই এখানে। মৃদুল মুখ কালো করে প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। আইভি রহমান চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে পেখমের দিকে। কিন্তু একমাত্র মিনহাজ রহমান নিশ্চিন্তমনে খাচ্ছেন।
” আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বেয়াই? ” দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলেন আইভি রহমান।
” বলতে চাইছিনা, বললাম। বললাম যে, আমরা আমাদের পরিবারের ছেলেদের আঁচলে বেঁধে রাখিনা। তাদের জীবনের ছোটবড় থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তাদেরকেই নিতে শিখিয়েছি। নিজের স্ত্রী’কে কিভাবে সম্মান করতে হয় সেটা শিখিয়েছি। গুরুজনকে কিভাবে সম্মান করতে হয় সেটা শিখিয়েছি। শুধুমাত্র তাদের বইয়ের পাতায় আর মা’য়ের আঁচলেই বেঁধে রাখিনি। তাদেরকে পুরো দুনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়েছি। বেয়াই, অভিভাবক হিসেবে যদি কারো সাথে কথা বলতে হয়, তবে আপনার সাথেই বলব। আমি আপনার ছেলে আর ছেলের বউকে নিতে এসেছি। এখন আপনার ছেলে যদি না যেতে চায় , তবে আমি আমার মেয়েকে নিয়েই গ্রামে যাব। আপনার মতামত চাইছি। ”
” আমার অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে না যেতে চাইলে না যাক। আপনি বউমাকে নিয়েই যান। আমার ছেলের না হয় মা ছাড়া দুনিয়ায় অচল, কিন্তু বউমার তো পরিবার, আত্নীয়স্বজন আছে। দরকার নেই ওর যাওয়ার। ”
অনুমতি পেয়ে গেলেন রাকিব আহমেদ। তিনি মৃদুলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
” বেয়াই যতই বলুক পেখমকে একা নিয়ে যেতে। কিন্তু আমাদের তো মানসম্মান আছে। নতুন জামাইকে রেখেই যদি গ্রামে যাই, তবে বিষয়টা খারাপ দেখায়। একবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়েই দেখ, যদি খারাপ লাগে তবে চলে এস, বাঁধা দেবোনা। যদি আমাদের আতিথেয়তা পছন্দ না হয়, তখন তোমার আম্মুকে বিচার দিও। ”
মৃদুল বুঝল ওর চাচা শ্বশুর ওকে হাসিমুখে বাঁশ দিল। কিন্তু জামাই হয়ে ওর কিছু বলা শোভা পায়না। তাই অসহায়ের মত আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকল। আইভি রহমান নিরবে সকল খোঁচা হজম করলেন। যেখানে তার স্বামীই তার বিপক্ষে কথা বলছে, সেখানে তিনি কিভাবে পেখমের চাচার বিপক্ষে কথা বলবেন? রাগে তিনি স্বামীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মিনহাজ রহমান সেসবে পাত্তা না দিয়ে খেয়েই চলেছেন।
***
” রাজ্য, তুই এত অস্থির হয়ে আছিস কেন? আমি বুঝতে পারছি এখন তোর ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে। তবুও বলব, নিজেকে সামলা। তোর শরীরও ভালো নেই। বারবার কেন দেশে যেতে চাইছিস! দেশে গেলে কি দাদুকে দেখতে পাবি? তুই দাতুকে ফিরে পাবিনা এটা যেমন সত্য, তেমনি তোকে এভাবে দেখলে তোর পরিবারের সবাই কত কষ্ট পাবে এটা বুঝতে পারছিস? তারা এখনো জানেনা, তোর বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তুই কোমায় ছিলি। তারা সব শুনলে কি রিয়্যাক্ট দেবে জানিসনা? আমি বলি কি, তুই আগে সুস্থ হ। দু-চার মাস সময় নে। যখন পুরোপুরি ফিট হবি, তখন দেশে যাওয়ার কথা চিন্তা করিস। তোর এখন শারীরিক-মানসিক দু’ধরনের রেস্টই প্রয়োজন। ”
গত কয়েকদিন ধরেই অরবিন্দ রাজ্যের পাশে আছে। ওর ফ্ল্যাটেই থাকছে। রাজ্যকে শান্তনা দিচ্ছে, ওর সেবাযত্ন করছে। রাজ্য যখন দাদুর জন্য, বাড়ির সবার জন্য ছটফট করে তখনই সে রাজ্যকে এভাবেই শান্তনা দেয়, বোঝায়।
” আমি কিভাবে নিজেকে সামলাব, অরু? একে একে প্রিয় মানুষদের হারিয়ে ফেলেছি, এটা কি আমার জন্য কম কষ্টের। আর কখনোই সেই প্রিয় মুখগুলোকে দেখতে পাবোনা। এটা ভেবেই আমার যন্ত্রণা হয়। যে মানুগুলো আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন গেঁড়েছে তারাই একে একে হারিয়ে গেল। তারা হারিয়ে গেলেও আমার হৃদয়ের সেই স্থান কিন্তু শূন্য হয়নি। তারা আজীবন সেখানেই থাকবে। শুধু তাদের মুখটা দেখতে পাবোনা কভু। এটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ভিষণ। কিভাবে মনকে শান্তনা দিতে হয়, কিভাবে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে হয় সেটাতো আমার জানা নেই। এই অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে, অপ্রাপ্তির বেদনা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকি বল? ”
অরবিন্দ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে রাজ্য’র দিকে। গত কয়েকমাস থেকেই রাজ্যে’র কথাবার্তা বুঝতে পারেনা ও। এখনও যেমন বলল, প্রিয় মানুষগুলো। এই প্রিয় মানুষগুলো বলতে কি বোঝাতে চাইছে রাজ্য? ওর সাথে বন্ধুত্বের শুরু থেকেই ওর পরিবারের আর কেউ মারা যায়নি। এবার শুধু দাদু মারা গেল। কিন্তু রাজ্য বলল, প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে ফেলেছে। আর কাকে হারিয়েছে সে? কে সেই প্রিয় মানুষ? কিন্তু অরবিন্দ রাজ্যকে কিছুই জিজ্ঞেস করলনা। ওর মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে রাজ্য’কে এই বিষয়ে এখন কিছু জিজ্ঞেস করলে ও কষ্ট পাবে।
” দোস্ত, এক জীবনে সবাই যদি সবকিছু পেয়েই যেত, সকল প্রাপ্তির সুখ যদি এক জীবনেই অর্জন করত, তবে সে তার অভিযোগগুলো কোথায় জমাতো? সকল অভিযোগের খাতার প্রতিটা পাতা যে সাদা-ই থেকে যেত। স্বয়ং ঈশ্বরই চাননি, তার সৃষ্টিকূল সকল পূর্ণতায় মেতে উঠুক উচ্ছ্বাসে। সেখানে তুই আমি কে, সকল অভিযোগগুলোকে হেলা করার? তাই না চাইতেও কিছু কিছু অপ্রাপ্তি মেনে নিতেই হয়। ”
রাজ্য মলিন চোখে তাকায় বন্ধুর দিকে। ছেলেটাকে আজকাল ওর খুব আপন মনে হয়।
অরবিন্দ রাজ্যের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। ছেলেটার চোখ ছলছল করছে। যেন বুকে ভেতর জমিয়ে রেখেছে কতশত কষ্ট। সেই কষ্টগুলোই বুঝি অশ্রুকনা হয়ে জমা হয়েছে নয়ন সরোবরে। অরবিন্দ অবাক হয়, একদিনের এই বেহোমিয়ান ছেলেটাই আজকে একটা সনামধন্য ভার্সিটির প্রফেসর। নিজেকে আমূল পরিবর্তন করেছে। অরবিন্দ’র মত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেকে পরমবন্ধু হিসেবে গ্রহন করেছে। ওর পরিবারের সকল বিপদেআপদে রাজ্য এগিয়ে এসেছে সবসময়। করেছে সাহায্য।
” অরু, এরপর দেশে গেলে তোকে নিয়ে যাব বুঝলি? আমরা দুই বন্ধুতে মিলে পুরো দেশ ঘুরব। তোকে আমার আম্মুর হাতের পিঠা খাওয়াব। আমার বড়মার হাতের হাঁসের মাংস খুব মজার হয় জানিস? তোকে খাওয়াব। আর দু’জন অসাধারণ রমনীর সাথে তোর পরিচয় করাব। যাদের দেখলেই তোর মনে হবে, পৃথিবীতে তাদের জন্মই বুঝি মা হওয়ার জন্য। ”
” তারা কারা? ”
” গেলেই দেখতে পাবি। যাবিতো? ”
” কেন যাবনা! ছোটবেলায় মা’কে হারিয়েছি। মা’য়ের আদর কি তা আমি জানিনা। তোর সাথে গিয়ে মা’য়ের আদর খেতে চাই বুঝলি? ”
রাজ্য হেসে অরবিন্দের পিঠ চাপড়ে দিল।
চলবে…
#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী
” অবশেষে জিত তোমারই হল? আমার, আম্মুর সিদ্ধান্তকে তুমি অপমান করে বাবার বাড়িতেই যাচ্ছ তাহলে? আমি চিন্তা করছি, একটা মানুষ কত সৌভাগ্যবান হলে তোমার মত বউ পায়! ”
পেখমকে ব্যাগ গোছাতে দেখে খোঁচা মেরে বলল মৃদুল। কিন্তু পেখম মৃদুলের কথার কোনও প্রত্যুত্তর করলনা। সেই মানসিকতাই ওর নেই। নিরবে নিজের কাজ করছে। পেখমকে নিরব থাকতে দেখে বিরক্ত হয় মৃদুল। ওর হাত থেকে কাপড় নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
” কথা বলছনা কেন? আজকাল নিজের মত চলতে শিখে গেছ দেখছি। নিজেকে বড্ড বেশি যোগ্য ভাবতে শুরু করে দিয়েছ? তাহলে শুনে রাখ, আমিও কিন্তু অযোগ্য নই। আজও আমাকে নিজের করে পেতে অনেকেই চায়। তারা কিন্তু সবাই তোমার থেকেও যোগ্য। বেটার অপশন কিন্তু আমিও চুজ করতে জানি। ”
এবার আর পেখম চুপ করে থাকলনা। ব্যাগটা একপাশে রেখে মুখোমুখি হল মৃদুলের।
” বেটার অপশন বলতে কি বোঝাতে চাইছ তুমি? কথা বাড়াতে চাইনা বলে চুপ করে থাকি কিন্তু সেটাকেও তুমি অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছ? আর কি বললে? বেটার অপশন খুঁজছ! আর কি বেটার অপশন চাও তুমি? আমি তোমার জীবনে না আসলে নিশ্চয়ই কোন ডক্টরকেই বিয়ে করতে, নয়তো কোন ফার্স্টক্লাস অফিসার। এর থেকে বেশি কিছু পেতেনা নিশ্চয়ই। আমিও কিন্তু কয়েক বছর পরই বুয়েটের সার্টিফিকেট পাব। এবং চাইলে স্কলারশিপ নিয়ে বাহিরেও পড়তে যেতে পারি। কিংবা চাইলে বিসিএস ও দিতে পারব। এবং আমি বিশ্বাস করি বিসিএস দিলেও আমি বাকিসব পরীক্ষার মতই রেজাল্ট করব। এবার বল আমাকে কোনদিক দিয়ে তোমার বেটার অপশন মনে হয়না? তবে হ্যাঁ, হয়তো চাইলে সুন্দরী একটা মেয়ে তুমি পেতে পার, কিন্তু আমি এটা গ্যারান্টি দিতে পারি, সে আমার থেকে যোগ্য হবেনা কোনদিক দিয়েই। একটা কথা মনে রেখ, প্রথমজনকে অবহেলা করে দ্বিতীয়জনের কাছে গেলেই কিন্তু তাকে জয়ী বলেনা । দ্বিতীয়জন যে তাকে সাদরে গ্রহণ করে নিবে এমনটাও কিন্তু নয়। সর্বদাই মনে রেখ, প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। ”
” নিজেকে নিয়ে অনেক বড়াই করছ দেখছি! চ্যাটাংচ্যাটাং কথাও বলতে শিখে গেছ! এত অহংকার কিন্তু ভালো নয়। তোমার মত হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রী দেশের আনাচেকানাচে হরহামেশাই দেখা যায়। তাই এত অহংকার করার কিছুই নেই। ”
” তোমরাই আমাকে শিখিয়েছ, কিভাবে নিজেকে নিয়ে গর্ব করে কথা বলতে হয়। কিভাবে নিজেকে প্রায়োরিটি দিতে হয়। একই বাড়িতে একসাথে বাস করে তোমাদের গুণাবলী শিখবনা এটা কি করে হয় বল? ”
” একটা প্রবাদ আছে জানো তো? ‘ বেশি বাড় বেড়োনা ঝড়ে পরে যাবে। ‘ ভবিষ্যতে অহংকার করে কিছু বলার আগে এটা মাথায় রেখ। ”
” তাহলে তো তোমাদের আরও আগেই ঝড়ের কবলে পরা উচিত ছিল! এনিওয়ে, এসব নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। আমার গোছগাছ এখনো বাকি আছে। তুমি চাইলে কিন্তু আমাদের সাথে যেতে পারো। বিয়ের পর এখনো শ্বশুর বাড়িতে যাওনি। আমার আত্নীয় স্বজনরা তোমাকে দেখতে চায়। ”
” আমি নিজেকে কুরবানির গরু মনে করিনা। কারও দেখতে ইচ্ছে করল, আর আমি গিয়ে নিজের চেহারা দেখিয়ে আসলাম। কতদিনের জন্য যাচ্ছ? ”
” যতদিন ইচ্ছে হবে, ততদিন থাকব। ” পেখম আর কিছু বললনা। আজকের জন্য যথেষ্ট হয়েছে।
মৃদুল দেখল ও কিছুতেই পেখমের সাথে কথায় পেরে উঠছেনা। তাই আর ওকে ঘাঁটালোনা। তবে ও ভেবে পায়না, যে মেয়ে বিয়ের পর কখনো টু শব্দটি করেনি, সেই মেয়ে হঠাৎই কেন এত বাচাল হলো? প্রতিটা কথারই উত্তর সে দিয়েই ছাড়ে। ছোটবড় কাউকেই ছাড়েনা।
***
অনেকদিন পর মেয়েকে দেখে অঝোরে কাঁদলেন রাবেয়া সুলতানা। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকের ছলাৎ করে উঠল। মেয়েটার চেহারার এ কি হাল হয়েছে! তিনি পেখমকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে, পারভীন আক্তার তাকে থামিয়ে দিলেন।
” রাবেয়া, মেয়েটা মাত্রই বাড়িতে আসল, তুই ওকে নিয়ে ঘরে যা। শরবত করে রেখেছি। মেয়েটাকে শরবত দে। ও আব্বার সাথে দেখা করুক। মেয়ের সাথে গল্প করার অনেক সময় পাবি তুই। পেখম যে কয়দিন থাকবে, সে কয়দিন তোর রান্নাঘর থেকে ছুটি। তুই সারাক্ষণ মেয়ের কাছেই থাকবি। ”
রাবেয়া সুলতানা বড় জা’ এর কথা হাসিমুখে মেনে নিলেন। পেখম গেল দাদুর সাথে দেখা করতে।
ঋত, রাত পেখমকে পেয়ে ভিষন খুশি। সিনানও অনেকদিন পর বড় আপুকে দেখে ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। পেখম ওদের সবার জন্য চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। সেগুলো সবার মাঝে ভাগ করে দিল।
সবার মুখে হাসি থাকলেও মেহনাজ মুখ কালো করে আছে। সে পেখমের এত আদর-ভালোবাসা মানতে পারছেনা। শুধু পেখম নয় এ বাড়ির কোন ছেলেমেয়ের প্রতি সবার টান সে মানতে পারেনা। সে চায় সবাই শুধু তার মেয়েদেরই ভালোবাসুক। সে সব সময়ই নিজেরটাই ভেবে এসেছে। পেখম এসে দাঁড়ায় মেহনাজের সামনে। তবে আজকে সে একটু বেশিই রেগে আছে। সে চায়নি রাকিব আহমেদ পেখমকে আনতে যাক। কিন্তু তার কথা না শুনেই রাকিব আহমেদ ভাতিজীকে আনতে গেছেন। এজন্য সে গতকাল থেকেই রাগে গজরাচ্ছে।
” কেমন আছ, চাচী? তোমার কি শরীর খারাপ? এমন শুকনো লাগছে কেন? ”
” আদিখ্যেতা দেখাতে এসেছিস? তুই ভালো করেই জানিস আমার কি হয়েছে, তারপরও জিজ্ঞেস করছিস! তোর কি আদৌও আমার কিংবা আমার মেয়েদের জন্য চিন্তা কিংবা ভালবাসা আছে? থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারতিস, আমি কেমন আছি? ”
মেহনাজের কথায় মৃদু হাসল পেখম। ও বুঝতে পারছে চাচীর রাগের কারন। চাচীর কথার উত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নেয় মেয়েটা। আগে হলে এমনটা চিন্তাই করতে পারতনা। কিন্তু আগের সেই পেখম আর আজকের পেখমের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। আগে সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করলেও এখন তা পারেনা। জীবনের প্রতিটি পদে পদে ঠোকর খেতে খেতে পেখম একটাই শিক্ষা পেয়েছে। সেটা হল, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে লড়াই করতে হয়। লড়াই ছাড়া চলার পথ কখনোই সুগম হয়না। কণ্টকাকীর্ণ পথ উৎরে যাওয়ার একমাত্র উপায়ই হলো, লড়াই। একটু প্রস্তুত হয়েই ও মেহনাজের কথার জবাব দিতে শুরু করল।
” তোমরা সবাই আমার আপনজন। তাই তোমাদের সবার প্রতিই আমার অফুরান ভালবাসা আছে। এটা কিন্তু তুমিও জানো। তারপরও কেন এমন কথা বলছ, চাচী? আমিতো চাচাকে আমার শ্বশুর বাড়িতে ডেকে পাঠাইনি। এমনকি আমি জানতামওনা চাচা যাবে। তবুও কেন আমাকে দোষী করছ? এরপর থেকে আর কাউকেই আমাকে আনতে যেতে হবেনা। একা একা চলাফেরা করতে শিখে গেছি আমি। চলার পথে আমার কোন সহযোগীর প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই নিজেকে সহযোগী করেছি। ”
পেখমের উত্তর শুনে মেহনাজ অবাক হয়ে গেছে। যে মেয়েটা একটা সময় সাত চড়ে রা কাটতনা, সেই মেয়েটা এভাবে কথা বলতে শিখেছে!
” বাব্বাহ্ ঢাকার পানি তোর পেটে ভালোমতোই পরেছে দেখছি! স্বীকার করতে হবে, সেখানকার পানির গুণ আছে। নয়তো তোর মত মেয়ে এভাবে কথা বলে! দেখিস এত ভাব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবার মানুষের কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে আসিসনা যেন। ”
” আমিতো শুধু কথার উত্তর দেব, চাচী। অপমানিত হতে যাব কেন? মানুষজন যে ধরনের প্রশ্ন করবে, সে-ধরনের উত্তরই পাবে। একটা কথা জানো তো চাচী, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কিছুই করার থাকেনা? আমি শুধু ঘুরে দাঁড়িয়েছি এই যা। এতে যদি তোমার মনে হয়, ঢাকার পানিই এসবের জন্য দায়ী, তবে আমি আর কি বলব বল। ”
পেখমের সাথে পেরে উঠলনা মেহনাজ। তাই সে সোজা নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। সেই সাথে মনে মনে হাজারটা গালি দিল পেখমকে।
***
গ্রামে এসেছে সাতদিন হয়ে গেছে। অথচ এই সাতদিনে মৃদুল কিংবা আইভি রহমান কেউ পেখমকে একবারও ফোন দেয়নি। উল্টো পেখম তাদের ফোন দিয়েছে, কিন্তু তারা কেউই রিসিভ করেনি। কিন্তু মিনহাজ রহমান প্রতিদিন দু-একবার পুত্রবধূকে ফোন দেন। মেয়েটার খোঁজখবর নেন। পেখমের মা-চাচীদের সাথে কথা বলেন। আইভি রহমান এমন করছেন সেটা নিয়ে পেখমের আফসোস নেই। কিন্তু মৃদুলের এহেন আচরণ ওকে ভিষণ পোড়াচ্ছে। মানুষটার সাথে যতই ঝগড়াঝাটি, মনোমালিন্য হোকনা কেন, সে তো পেখমের স্বামী। আর দিনের পর দিন স্বামী যদি রাগ করে থাকে, তবে সেই মেয়ের দিনকাল কেমন যায়, সেটা পেখম হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। ওর অস্থির লাগলেও সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছেনা। অনেকবার মৃদুলকে ম্যাসেজ দিয়েছে কিন্তু সে রিপ্লাই দেয়নি। পেখম নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। মৃদুল আর ওর মা’য়ের এমন আচরণের কারন ও বুঝতে পারেনা। ওরা কি চায়, সেটাও বোধগম্য হয়না পেখমের। মাঝেমধ্যেই নিজেকে উচ্ছিষ্ট মনে হয় তার। বারবার মনে হয়, সবার অবহেলা আর অনাদর পেতেই বুঝি পৃথিবীতে এসেছে ও। কিন্তু এই অবহেলা আর অনাদরের কোন কারন খুঁজে পায়না মেয়েটা। যখন কিছুই খুঁজে পায়না, তখন ওর মনে হয় গায়ের কালো রংটাই বুঝি সবকিছুর জন্য দায়ী। কালো জন্য বাবা কখনোই ওকে কাছে টেনে নেননি। কখনো ওর সাথে হাসিমুখে কথা বলেননি। একসময় ওদের ছেড়েই চলে গেলেন। সব সময় কোন ও কষ্ট পায়? অনেকবার নিজেকে প্রশ্নটা করেছে পেখম। কিন্তু কোন উত্তর পায়নি। আকাশপাতাল ভাবনা এসে ভর করেছে পেখমের মন-মস্তিস্কে। এক সময় হু হু করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। আর কত অবহেলা সইবে? ফোন হাতে নিয়ে মৃদুলের নম্বর বের করল।
চলবে…