সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-১৯+২০

0
626

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী

” কেমন আছিস, পেখম সোনা? তোর মুখটা এমন শুকিয়ে গেছে কেন? এতদিন পরে আসলি। তোর দাদু প্রতিদিনই তোর কথা জিজ্ঞেস করত। তার কত সাধ ছিল, তোকে নাতবউ বানাবে। কিন্তু সে অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই দুনিয়া ছাড়ল। কপালে ছিলনা বলে তুই অন্যের ঘরে আলো করছিস। ”

পেখম পারভীন আক্তার আর এর মা’য়ের সাথে মীর রেজাউল করিমের বাড়িতে এসেছে। ওরা এই মুহূর্তে বসে আছে মীর দাদুর স্ত্রী’র সামনে। মীর দাদুর স্ত্রী জেবুন্নেসা পেখমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছেন। তিনি কাঁদছেন। দাদিমার এমন কথায় বেশ অস্বস্তিতে পরল পেখম। আজকের দিনে এমন কথা ও মোটেও আশা করেনি। অথচ কয়েক বছর আগে কত স্বপ্ন বুনেছিল সে। বাড়ি থেকে যখন রাজ্য’র সাথে বিয়ে ঠিক করল, সেদিনও অমত করেনি। দাদুর ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই এই বাড়ির কেউনা কেউ পেখমকে দেখতে যেতেন। রাজিয়া পারভীন প্রতিবেলায় এটাসেটা রান্না করে পেখমের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। মীর দাদু প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওর জন্য চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে যেতেন। সবার অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়ে নিজের অজান্তেই পেখম রাজ্যকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু ওর সেই সুখস্বপ্ন পায়ে মাড়িয়ে রাজ্য বাড়ি ছাড়ে। ওকে মানুষের চোখে ছোট করে দেয়। নিমেষেই পেখমের সব স্বপ্ন উলটপালট হয়ে যায়। আর সেদিন থেকেই ঐ মানুষটার জন্য ঘৃণা জন্মায় পেখমের মনে। সেদিনের পর থেকে তার নাম শুনতে চায়নি পেখম। কিন্তু নিয়তি বারবার সেই নামটা, সেই মানুষটাকে ওর সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। পেখম চুপচাপ বসে থাকল। ওর কিছুই ভালো লাগছেনা।

” রাজিয়া, রাজ্য’র সাথে তোমার কথা হয়েছে? শুনলাম চাচার মৃত্যুর খবর ওকে দিতে পারোনি? ওর বন্ধ ছিল। ” পেখমকে আরেকবার অস্বস্তিতে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন পারভীন আক্তার।

” আব্বার মৃত্যুর দশদিন পর ফোন দিয়েছিল ছেলেটা। ও নাকি ভার্সিটির কাজে অন্য স্টেটে গিয়েছিল। ঝামেলার কারনে ফোনও বন্ধ রেখেছিল। ”

” খবরটা শুনে কান্নাকাটি করেছে বুঝি? ”

” অনেকক্ষণ কথাই বলতে পারেনি। আম্মার সাথে প্রতিদিন কথা বলে আর কাঁদে। কি একটা ঝামেলায় পরেছে, তাই আসতে পারছেনা। ”

” বড়মা, তোমরা কথা বল, আমি নাবিলার সাথে দেখা করে আসি। ”

পারভীন আক্তার, রাজিয়া পারভীন দু’জনেই বুঝলেন পেখম এসব কথা শুনতে চায়না তাই চলে গেল।

***

গ্রামে বিশদিন কাটিয়ে ঢাকায় ফিরল পেখম। ওকে বাসায় ফিরতে দেখেও ওর সাথে কোন কথাই বললেননা আইভি রহমান। এমনকি মৃদুল বাসায় এসে পেখমকে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা৷ পেখম তার সাথে কথা বলতে চাইলে সে এড়িয়ে গেল। এসব দেখে পেখমের ভিষণ রাগ হয়। রাশেদ আহমেদ ওকে রাখতে এসেছিলেন। কিন্তু আইভি রহমান পেখমের চাচার সাথে দুই-একটা কথা ছাড়া আর কিছুই বলেননি। এমনকি তাকে থাকতে পর্যন্ত বলেননি। তাকে পরোক্ষভাবে অপমান করেছেন আইভি রহমান। সেটা বুঝতে পেরে রাশেদ আহমেদ এখানে দেরি না করেই চলে গেছেন। যাওয়ার সময় তার চোখে পানি দেখছে পেখম। চাচার চোখের পানি ওকে কাঁদাচ্ছে। সব মিলিয়ে পেখম আর কোন কথাই বললনা মৃদুলের সাথে। ও বই নিয়ে চলে গেল বেলকনিতে।

সাতদিন হয়েছে পেখম ঢাকায় এসেছে, কিন্তু মৃদুল ওর সাথে এখন পর্যন্ত কথা বলেনি। পেখমও আর তার সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি। দু’জন দু’জনের মত থাকছে। আইভি রহমানও পুরোদমে ইগনোর করছেন পেখমকে। মিনহাজ রহমান অফিসের কাজে দেশের বাহিরে গেছেন। তাই এই বাড়িতে পেখম পুরোপুরি একা হয়ে গেছে।

***

বন্ধুদের জোড়াজুড়িতে পেখমকে রেস্টুরেন্টে যেতেই হল। এমনিতেই এসব ও পছন্দ করেনা, তারওপর আজকে আবার ওদের সাথে তিনজন ছেলে আছে। এছাড়াও আজকে ওরা ক্লাস শেষে অনেকক্ষন আড্ডাও দিয়েছে। নভেম্বর মাস চলছে। দিনের স্থায়িত্ব এমনিতেও ছোট হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে নিশ্চয়ই সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে। পেখম ছোট থেকেই ইন্ট্রোভার্ট। ছেলেদের সব সময়ই এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব হয়না ওর বান্ধবীদের জন্য। তাই অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ও রেস্টুরেন্টে গেল।

রেস্টুরেন্টে এসে যে যার মত খাবার অর্ডার দেয়। সবাই মিলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বিল আসবে সবাই মিলেই দেবে।

পেখম নিজের জন্য শুধু একটা বার্গারের অর্ডার দিল। ওয়েটার খাবার সার্ভ করলে, সবাই হামলে পড়ে খাবারের ওপর। এটা দেখম পেখম আর ওর বান্ধবী প্রাপ্তি মুখ টিপে হাসল।

বার্গার খেতে খেতে রেস্টুরেন্টের কোনার একটা টেবিলের দিকে চোখ গেল পেখমের। ঐ অংশটা মোটামুটি অন্ধকারই বলা চলে। টেবিলের ওপর কয়েকটা ক্যান্ডেল জ্বলছে। কোন কপোত-কপোতী নিশ্চয়ই ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে আসবে। দুইজন ওয়েটার ব্যস্ত ভঙ্গিতে টেবিল সাজাচ্ছে।

” তোমরা আরও কত সময় নেবে বলতো? তাড়াতাড়ি কর। নয়তো আমার বাসায় ফিরতে লেইট হবে। অলরেডি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ” কোনার টেবিল থেকে চোখ সরিয়ে বন্ধুদের বলল পেখম।

” এতকিছু না ভেবে একটু চিল করতে পারোনা? সব সময় এত বাসা, স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কর কেন বলতো? এদের বাহিরেও তো তোমার একটা জীবন আছে! নিজেকেও মাঝেমধ্যে সময় দিতে হয় বুঝলে? জীবনের মূল্যবান সময়টা এদের পেছনে নষ্ট করলে, নিজের জন্য রাখবে? নিজেকে ভালো রাখার জন্য হলেও নিজেকে একটু সময় দিতে হয়। ” চাওমিন খেতে খেতে বলল ফারহান।

” এত দার্শনিক মার্কা কথাবার্তা আমি বলতেও পারিনা আবার বুঝিওনা। তুমি দয়া করে তাড়াতাড়ি খাও। বিয়ে করোনি তাই এসব বোঝনা। একটা মেয়ের বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবনের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। বিয়ের আগে শুধু সে একটা বাড়ির মেয়েই থাকে। বিয়ের পর সে একজনের স্ত্রী, কারও ভাবী, কারও বউমা। তাই দ্বায়িত্ব স্বভাবতই একটু বেশিই থাকে। ”

” বন্ধুরা, আমাদের মধ্যে একমাত্র পেখমই এই আজব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। তাই আমাদের পক্ষ থেকে উচিত ওকে আলাদাভাবে ট্রিট দেয়া। চল আমরা সবাই মিলে ওকে একটা আইসক্রিম খাওয়াই? ” রিহাম প্রস্তাব দিল।

” আমার কোন ট্রিট লাগবেনা। তোমরা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর, সেটাই হবে আমার বড় ট্রিট। আমি…..। ”

কথা শেষ করতে পারলনা পেখম। একটা পরিচিত অবয়বকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখে ওর কথা আটকে গেছে। পেখম বন্ধুদের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিল। এদিকে সেই অবয়ব একটা মেয়ের হাত ধরে এগিয়ে গেল সেই কোনার টেবিলের দিকে। তারা হাসিমুখে কথা বলছে। পেখম আঁড়চোখে দেখল ছেলেটা একটা চেয়ার টেনে ধরল, আর মেয়েটা সেখানে বসল।

পরবর্তী পনের-বিশ মিনিট পেখম স্থির হয়ে বসে রইল। ওর চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝড়ল যখন দেখল, সেই ছেলেটি মেয়েটার মুখে কোন একটা খাবার তুলে দিল। বন্ধুরা হঠাৎই পেখমকে নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে একটু অবাকই হয়। তারা বারবার পেখমতে জিজ্ঞেস করছে, ওর কি হয়েছে। কিন্তু পেখম ওদেরকে কিছুই জানালোনা।

***

রাত এগারোটার দিকে মুদুল বাসায় আসল। পেখম তার অপেক্ষাতেই ছিল।

” এত দেরি হল যে? ”

মৃদুল কোন উত্তর দেয়ারই প্রয়োজনবোধ করলনা। ও কাবার্ড থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তার এমন আচরণে পেখম মৃদু হাসল শুধু।

***

” ম্যাডাম, একটা কথা কইলে কি আপনে রাগ করবেন? ”

রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল পেখম। তখনই একজন মেইড এসে ওকে জিজ্ঞেস করল। পেখম লক্ষ্য করেছে, ও গ্রাম থেকে আসার পর থেকেই মেয়েটা ওকে দেখলে কেমন উসখুস করে, যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলেনা।

” আমি তোমাদের অনেকবার বলেছি, আমাকে ভাবী অথবা আপু ডাকবে। যা বলার বেল ফেল, আমি কিছুই মনে করবনা। ”

” আপনারে অন্যরকম মনে হয়, তাই কথাডা কওনের সাহস করবার পারতাছি, আপা। আপনে রাগ হইলে কিন্তু কমুনা। ”

” হেয়ালি না করে কি বলবে বল। আমি কিছুই মনে করবনা। ”

” আপা, আপনে যখন গেরামে গেছিলেন, তখন স্যার মানে আপনার জামাই একটা মাইয়ারে নিয়া বাসায় আইছিল। ম্যাডাম সেই মাইয়ারে হেব্বি আদর করছে। তারে পাশে বসায়া নাস্তা খাওয়াইছে। মাইয়াডা স্যাররে ‘ বেবি ‘ কইয়া ডাকতাছিল। আমরা সকলেই দেখছি। ”

” তোমার কাজ শেষ? তাহলে ড্রয়িংরুমে যাও। গিয়ে সবকিছু মুছে ফেল। কোন নোংরা যেন না থাকে। ”

মেয়েটা অবাক নয়নে চাইল পেখমের দিকে। পেখমের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ব্যর্থ হল। ওর শান্ত চোখমুখ দেখে খানিকটা হতাশও হল। সে-তো মিথ্যা কিছুই বলেনি। সত্যিইতো স্যার একটা মেয়েকে নিয়েই এসেছিল। কথাটা শোনার পরও ম্যাডাম এমন ভাবলেশহীন রইল কেন, এটাই তার মাথায় আসছেনা।

***

” ডুড , সত্যিই কি আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি! আমার কিন্তু এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। ”

” এখন বিশ্বাস না হলেও চলবে। এয়ারপোর্টে গিয়ে , প্লেন থেকে নেমে তবেই বিশ্বাস করিস। ভালো কথা আমাদের কিন্তু কেউ রিসিভ করতে আসবেনা। আমি সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছি। ”

” তুই যদি রাস্তাঘাট চিনে থাকিস, তবে কেউ না থাকলেও চলবে। ভালো কথা, এই রাজ্য, তোর পরিবারে কে কে আছে বলতো? ”

” তুই ভালো করেই জানিস আমার পরিবারে কে কে আছে। হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? ”

” তুইতো জানিস, গত কয়েকবছরে একে একে আমার বাবা-মা, দিদি, দাদা সবাই মারা গেছে। এইযে তুই আমাকে তোর বাড়িতে নিয়ে যাবি, এমনকি আমাকে বলেছিস, তোর পরিবার মানে আমার পরিবার। তাহলে নিজের বাড়িতে যাব বাবা-মা, ভাইবোন, আত্নীয়স্বজনদের জন্য কিছু নিয়ে যাবনা এটা কি হয়? তুই আমাকে সবার নামের লিষ্ট দে। তাদের বয়স আর চেহারার বর্ননা দে, পারলে সবার ছবি দেখা। আমি সবার জন্য শপিং করব। ”

” ক্ষেপেছিস নাকি! আমার পরিবারে কতজন মানুষ জানিস? সবার জন্য শপিং করতে গেলে তোর পকেট ফাঁকা হবে, এটা আমি নিশ্চিত। ”

” তুইওতো সবার জন্য শপিং করেছিস, তোর পকেট কি ফাঁকা হয়েছে? আর শুধু তোর পরিবার বলছিস কেন? ঐটা কি আমার পরিবার নয়? ”

” ভুল হয়েছে, গুরু। এই নে আমার ফোন, আমার সবার ছবির জন্য আলাদা ফোল্ডার আছে। তুই সবাইকে দেখে নে। ”

রাজ্যের কাছ থেকে ফোন নিয়ে অরবিন্দ একে একে সবার ছবি দেখতে লাগল। আর নিজের ফোনে নিল সেগুলো।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী জামী

” পেখম, তুই কি এই মেয়েটাকে চিনিস? ” প্রান্তর ওর ফোন বাড়িয়ে ধরল পেখমের দিকে।

ভাইয়ার ফোনের দিকে তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায় পেখম। ঠোঁটজোড়া যেন পরস্পরের সাথে সেঁটে গেছে। পেখম ভাবছে, এই মেয়ের ছবি ভাইয়ার ফোনে আসল কিভাবে?

” কি রে কিছু বলছিসনা কেন? চিনিস একে? ” পেখমকে নিরব থাকতে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করল প্রান্তর।

” চিনিনা। তবে রাস্তাঘাটে এক-আধবার দেখেছি এই যা। ” পেখম শুধু এতটুকুই বলল।

” তুই কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস? কিংবা আমার ওপর রেগে আছিস? ”

” রেগে থাকব কেন, ভাইয়া! তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে? ”

” এই যে আমরা দুই ভাই গত একমাস আগে থেকে তোদের ইনভাইট করছি, কিন্তু তোরা আসলি না। অনেক জোড়াজুড়ির পর আজকে এসেছিস কিন্তু একা। মৃদুলকে আনিসনি। ”

” এতটুকুতেই তোমার মনে হচ্ছে, আমি রাগ করেছি? তোমরা আমার বড় ভাই, তোমাদের সাথে রাগ করা মানে নিজের সাথেই রাগ করা, এটা বোঝনা? ”

” তোর মনে কখন কি চলে সেটাতো কখনোই বুঝতে পারিনি, তাই কখন রাগ করিস কখন অভিমান করিস এটা জানতে পারলামনা আজ-অব্দি। ”

” রাগের কথা উঠছে কেন, ভাইয়া? আমাকে কি তোমাদের এতটাই স্বার্থপর মনে হয়? তোমাদের কাছে আমি কতটা ঋণী সেটা দুনিয়ার আর কেউ না জানুক, আমিতো জানি। ”

” আর সেজন্যই বুঝি জীবনের কঠিনতম সময়ে, কাউকে পাশে না রেখে একাই লড়াই করছিস? কাউকে জানতেই দিচ্ছিসনা, কতটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস? ”

” এসব কি বলছ, ভাইয়া? কিসের লড়াই, কিসের টানাপোড়েন? ”

” এই যে তুই বললি, মেয়েটাকে চিনিসনা এটা তুই মিথ্যা বলেছিস। আমি স্বীকার করছি, তোর সাথে আমরা অন্যায় করেছি। নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তোকে মৃদুলের সাথে বিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস কর, ওরা যে এতটা নীচ, অহংকারী এটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা গোপনে ওদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু কেউ একবারও বলেনি এমন মানুষ। আবার মৃদুলের সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছি। তখন জানতে পেরেছিলাম, তিন বছর আগে ওর একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা ওর বাবা মেনে নেয়নি। মৃদুলও বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। মেয়েটাও পরে হায়ার স্টাডির জন্য ফিনল্যান্ড পাড়ি জমায়। আমি মৃদুলের সাথে বিয়ের আগেই এই বিষয়ে কথা বলেছিলাম। মৃদুলও সবটা স্বীকার করেছিল। এটাও বলেছিল মেয়েটার সাথে ওর আর সম্পর্ক নেই। আমি এবং আমরা তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন রিস্ক নিতে চাইনি। তাই আমরা ধীরেসুস্থে এগিয়েছি। যখন মনে হয়েছে, ও তোর জন্য পারফেক্ট তখনই রাজি হয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমরা ভুল ছিলাম। মানুষ চিনতে ভুল করেছি আমরা। ”

ড্রয়িংরুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা রাজত্ব করছে। পেখম ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে আছে। ও বুঝতে পারছেনা ভাইয়ার কথার পিঠে কি বলবে। পেখম সেদিনের পর গোপনে মৃদুল আর ঐ মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। তখনই ও জানতে পেরেছে মিমো নামের মেয়েটা মৃদুলের প্রাক্তন ছিল। আদৌ কি সে প্রাক্তন? কখনো কি তাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল? ছাড়াছাড়ি যদি হতোই তবে বিয়ের পর থেকেই মৃদুল ওকে অবহেলা করতনা। মাঝরাতে ফোন আসলে বিছানা ছেড়ে, রুম ছেড়ে স্টাডি রুমে যেতোনা। একটা সময় পেখম সত্য আবিষ্কার করেছে। জানতে পেরেছে, দু’জনের বিচ্ছেদ লোকদেখানো ছিল। তারা সবাইকে জানিয়েছে, তাদের বিচ্ছেদের কথা। কিন্তু গোপনে ঠিকই সম্পর্ক রেখেছে। পেখম ভেবেছিল, সবাইকে সবকিছুই জানাবে কিন্তু কয়েকটা দিন পর। ও আগে মৃদুলের সাথে কথা বলতে চাইছে। কিন্তু যখন ভাইয়া সবকিছু জেনেই গেছে, তাই আর লুকোচুরির কোন প্রয়োজন নেই।

” তুমি কিভাবে এতকিছু জানলে, ভাইয়া? ”

” একদিন রাস্তার পাশে ওদের দু’জনকে দেখেছিলাম। ওরা হাত ধরাধরি করে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকছিল। আমার সন্দেহ হল। তাই ওদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করেছি। আর তাতেই সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে। এখন তুই চাইলেই ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিব। আমার বোনকে ঠকানোর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। ”

” তোমরা কিছুই করবেনা, ভাইয়া। যা করার আমি করব। আমি শুধু তোমাদের আমার পাশে চাই। তোমাকে রিকুয়েষ্ট করব, বিষয়টা গোপন রাখার জন্য। কাউকেই এ বিষয়ে কিছুই জানাতে চাচ্ছিনা। আমি যখন মনে করব , তখন সবাইকে জানাব। আর যখন বলব, সাহায্য প্রয়োজন, তখন তোমরা আমাকে আগলে রেখ। ”

” তোর পাশে আমরা সব সময়ই আছি। আর কখনোই নিজেদের সিদ্ধান্ত তোর ওপর চাপিয়ে দেবোনা। এবার থেকে তোর ভালোমন্দের সিদ্ধান্ত তুই নিবি। আমরা তোকে নির্দিধায় সাপোর্ট দেব। আর হ্যাঁ, এসব চিন্তায় যেন নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসবিনা। পড়াশোনা করবি মন দিয়ে। ”

” যতই কিছু হয়ে যাক না কেন, পড়াশোনা আমি ঠিকই করব, ভাইয়া। বড় আমাকে হতেই হবে। কিছু মানুষকে আমি দেখিয়ে দিতে চাই, চেহারা দিয়ে নয়, সাফল্য অর্জন করতে হলে মেধা, পরিশ্রম আর যোগ্যতা লাগে। ”

” যা-ই কিছু হয়ে যাক না কেন, তোর পাশে আমরা সব সময়ই আছি। তাই নিজেকে কখনোই একা ভাববিনা। প্রয়োজনে শুধু একবার ডাকবি আমাদের। ”

সেদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত পেখম ভাইয়ার বাসায় কাটালো। ও আইভি রহমানকে বলেই গিয়েছিল। তাই এতটা সময় থাকতে পারছে। ও ইচ্ছে করেই দেরিতে বাড়ি ফিরবে। আজকাল ঐ বাড়িতে পেখমের দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্বশুর আর কয়েকজন মেইড ছাড়া কথা বলার মত কেউই নেই। আর ওর শ্বশুর বেশিরভাগ সময়ই অফিসের কাজে কখনো দেশের বাহিরে আবার কখনো দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। তাই ঐ বাড়িতে পেখম একাই কাটায় বেশিরভাগ সময়। আইভি রহমান প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। কখনো মেয়ের বাসায়, আবার কখোনো কখনো ভাই-বোনদের বাসায়, বান্ধবীদের বাসায়, ক্লাবে এভাবেই কাটে তার দিন।

***

রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশের দিকে পেখম বাসায় আসল। মুদুল কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছে। তবে বাসায় এসে পেখমকে না দেখে মোটেও অবাক হলোনা। সে জানত, পেখম আজ ওর ভাইয়ের বাসায় গিয়েছে।

পেখম রুমে এসে দেখল মৃদুল বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। হাতের পার্স, ফোন ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে মৃদুলকে জিজ্ঞেস করল,

” এসে গেছ তুমি? কখন এসেছ? ডিনার করেছ? ”

” দশ মিনিট হলো এসেছি। ডিনার করে এসেছি। কিন্তু তোমার এত দেরি হলো কেন? আজকে না আসলেই পারতে। ”

” বিষয়টা তোমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি না এসে পারতামনা। তুমি কিন্তু ঠিকই দিনের পর দিন দেরি করে বাসায় আসছ, কখনোবা আসছোইনা। তোমার কোন পিছুটান না-ই থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। ”

” কি বলতে চাচ্ছ তুমি? ক্লিয়ার করে বল। ”

” তুমি তো আর বাচ্চা নও যে, ক্লিয়ার করে বলতে হবে। এই যে রাতের পর রাত দেরি করে বাসায় ফিরছ, সকালে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছ, আমার দিকে তাকানোর সময় নেই তোমার। আমার সাথে ঠিকমত কথা বলতে কষ্ট হয়, আমাকে সময় দিতে পারোনা। তোমার কি মনে হয়না, আমাকে ইগনোর করছ? এতকিছু আমি কিভাবে সহ্য করছি বলতো? ”

” তুমি ভালো করেই জানো আমি কত ব্যস্ত থাকি। দিনরাত রুগী দেখেই সময় পার করছি। তোমাকে সময় দেয়ার মত সময় আমার কই? ”

” দেশে তুমি একাই ডক্টর নও। আরও ডক্টর আছে। তাদেরও সংসার আছে। তারাও স্ত্রী-সন্তানদের যথেষ্ট সময় দেয়। আমার ভাইয়া-ভাবীও ডক্টর। তারা তাদের প্রফেশন ঠিক রেখে সংসার কিন্তু সামলাচ্ছে। এবং তারা যথেষ্ট সুখী। ভাইয়া-ভাবী কিন্তু তোমার মত অযুহাত দেয়না। আবার তোমার বড় ভাইয়াও ডক্টর। তিনিও কিন্তু স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখেই আছেন। সপ্তাহে দুই দিন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাহিরে যান, তাদের সময় দেন। কিন্তু তোমার কাছে সেই সময় নেই। আমারও তো ইচ্ছে করে, তোমার সাথে বাহিরে যাই। দু’জনে হাত ধরে হাঁটি। খোলা আকাশের নীচে বসে দু’জনে গল্প করি। আমার স্বপ্ন পূরণ করবে, সেই সময় তোমার কোথায়। ”

” এনাফ। ইনিয়েবিনিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা শুনিয়ে দিলে তো? একবারও ভাবলেনা, আমার ইচ্ছে কি? আমার এসব করতে ভালো লাগেনা। যতসব মিডিল ক্লাস চিন্তাভাবনা। আমার ভাইয়া কিংবা তোমার ভাইয়ার সাথে আমাকে মেলাতে যাও কেন? জানোনা, প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা? তাদের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছে, স্বপ্ন সবই আলাদা হয়? আমি তোমার সাথে খোলা আকাশের নীচেও হাঁটতে পারবনা, আবার হাত ধরাধরি করেও হাঁটতে পারবনা। এত আদিখ্যেতা আমার ধাতে নেই। ”

” বউয়ের আবদার তোমার কাছে আদিখ্যেতা মনে হয়! কিন্তু যখন অন্য কারো হাত ধরে হাঁট সেটাকে ভালোবাসা মনে হয় বুঝি? তবে বিয়ে করেছিলে কেন? তোমার একবারও মনে হয়নি, বউয়ের একান্ত কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে? তার ইচ্ছে পূরণ করা তোমার নৈতিক দ্বায়িত্ব? ”

” ক…কার হাত ধরে হেঁটেছি? কাজের চাপে তোমাকে সময় দিতে পারিনা বলে, আমাকে এভাবে ব্লেম করছ! এখনতো মনে হচ্ছে তুমি সেলফিশ একটা মানুষ। তোমাকে বিয়ে করাই আমার জীবনের বাজে সিদ্ধান্ত। ”

” এখন মনে হচ্ছে এসব! আগে মনে হয়নি? নাকি আগেও মনে হয়েছিল, কিন্তু কোন একজন মানুষের চাপে সেটা প্রকাশ করোনি? এভাবে অভিনয় করতে পারলে? একবারও বিবেকে বাঁধলনা? আমার জীবন নিয়ে খেললে কেন? কে অধিকার দিয়েছিল তোমাকে? আমি কিংবা আমার পরিবার কিন্তু একবারও তোমাকে রিকুয়েষ্ট করিনি, আমাকে বিয়ে করার জন্য। তোমরাই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলে। দিনের পর দিন ভাইয়ার বাসায় গিয়ে ধর্না দিয়েছ। আর এখন আমাকে ইচ্ছেকে তোমার আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে! এভাবে বেইমানী না করলেই পারতে। ”

” আজেবাজে কথা বলবেনা বলে দিলাম। নিজেকে কি প্রিন্সেস ডায়না মনে কর? তোমাকে পাওয়ার জন্য ধর্না দেয়ার মত মানুষ বলে আমাকে তোমার মনে হয়! রাবিশ। আমি চাইলেই দেশের প্রথম সারির মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম। নিজেকে প্রায়োরিটি দেয়া বন্ধ কর, তবেই বুঝবে তোমার লেভেল কি। ”

” প্রিন্সেস ডায়না হতে চাইনা আমি। মনেও করিনা নিজেকে। নিজের লেভেল সম্পর্কে যথেষ্ট ধারনা আমার আছে। হ্যাঁ, তুমি চাইলেই প্রথম সারির মেয়ে তুমি পেতেই পার। কিন্তু লয়্যাল কাউকে যে পাবেনা এটা আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি। আর যেদিন তুমি এটা বুঝতে পারবে, সেদিন তোমার পাপের শাস্তি তুমি পাবে । অবশ্য জানতে পারাটাও কম শাস্তি নয়। সেদিন তোমার পাশে কাউকেই পাবেনা। এমনকি তোমার আম্মুও থাকবেনা। আজ তার কথা শুনে , নিজেকে ভালো রাখতে, নিজের ভালোবাসাকে কাছে পেতে আমার সাথে যে অন্যায় তুমি করলে তার ফল তোমাকে পেতেই হবে। ”

” ভয় দেখাচ্ছ! আরে যাও, তোমার মত মেয়ে যে আমার কি করতে পারবে, সেটা আমি ভালো করেই জানি। গলার জোড়ে সবকিছু আদায় করা যায়না, এটা মনে রেখ। ”

” আমি কখনোই গলার জোড়ে বিশ্বাসী নই। এই যে দেখ, তুমি আমার সামান্য কথায়ই রিয়্যাক্ট করছ, চেঁচিয়ে কথা বলছ। কিন্তু আমার গলার আওয়াজ একটুও বাড়েনি। কারন আমি ঘরের কথা পরকে জানাতে পছন্দ করিনা। তবে গোপন কথা যখন ঘরের মধ্যে থাকেনা, তখন সেটার দফারফা করতেই হয়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিতে হয়। ”

” রাখো তোমার দার্শনিক কথাবার্তা। নিজেকে খুব জ্ঞানী ভাবো তাইনা? দুই পয়সার মেয়েমানুষ। ”

” জাষ্ট সাট-আপ। এই তোমার শিক্ষা? সমাজের প্রতিষ্ঠিত ডক্টরের ভাষা এটা? কাকে তুমি দুই পয়সার মেয়ে বলছ? সমাজে আমার পরিবারের অবস্থান সম্পর্কে তোমার জানা নেই? শুধু পড়াশোনা শিখে ডক্টরই হয়েছ। কিন্তু মানুষকে সম্মান করতে শেখোনি। তোমার মত মানুষ সমাজে আবর্জনা বৈ কিছুই নও। নিজের ভালো চাইলে আজ থেকে ভাষা সংযত করবে। নয়তো তোমার পুরো সোসাইটির সামনে তোমার গালে চপেটাঘাত করতে আমার একটুও বাঁধবেনা। জেনে রাখ, আমি আগের সেই পেখম নই। তোমরা আমাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করেছ। আর আমিও তোমাদের দেয়া আঘাতে ভেঙ্গেচুরে এক নতুন পেখম হয়েছি। তাই এরপর থেকে কথা বলার সময় সাবধানে কথা বলবে। ” পেখম রাগে কাঁপছে। আজ প্রথমবার মৃদুল পেখমের এমন রূপ দেখে ভড়কে গেল। ও আর কিছু না বলে সোজা স্টাডি রুমে চলে গেল৷

চলবে…