#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী জামী
” প্রনয়া দি, কেমন আছো? কোথায় থেকে আসছ? ”
রাজ্য দেখল লম্বা রোগা-সোগা একটা মেয়ে অটোরিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছে। কানন এগিয়ে গেছে মেয়েটার দিকে।
” কানন! আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো ? কবে এসেছ? ”
” আমি বিন্দাস আছি। শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? জামাই বাবুর সাথে ডেটিংএ গিয়েছিলে নাকি? ”
কাননের কথায় মেয়েটার মুখ রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল। লজ্জায় দৃষ্টি অবনত হলো তার। রাজ্য লক্ষ্য করল, মেয়েটা বেশ সুন্দরী। কাঁচা হলুদ গায়ের রং। চোখ দুটো টানা টানা। ওর ভ্রু যুগল সবার নজর কাড়তে বাধ্য।
” ব্যাংকে গিয়েছিলাম বুঝলে? কাকীমা, দিদুন সবাই কেমন আছে? ” স্বল্প কথায় উত্তর দিল সে।
” সবাই তোমার বিয়েতে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আপাতত কয়েকদিন তারা ভালোই থাকবে। দি, রাজ্য ভাইয়ার সাথে তোমার পরিচয় আছে? এই যে ভাইয়া। ভাইয়া, ইনি প্রনয়া দি। নিতাই দাদুর নাতনী। ”
দু হাত একসাথে করে রাজ্যকে প্রণাম জানাল প্রনয়া।
” কেমন আছো, রাজ্যদা? কবে এসেছ? ”
” ভালো আছি। পাঁচ-সাতদিন হয় এসেছি। তুমি কোন সাবজেক্টে পড়েছ? ”
” ইকোনোমিকস নিয়ে পড়েছি। শুনেছি তুমি নাকি ভার্সিটির টিচার হয়েছ। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করব। কিন্তু সেটা আর হলোনা৷ কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের পড়িয়েই স্বপ্ন পূরণ করছি। ”
” রেজাল্ট কেমন তোমার? ”
” ফাইভ, এইটে বৃত্তি পেয়েছিলাম। এসএসসি, এইসএসসিতে জিপিএ ফাইভ ছিল। অনার্স, মাস্টার্স এ সিজিপিএ খারাপ ছিলনা। সেকেন্ড হয়েছিলাম দুটোতেই। ”
” রেজাল্ট তো ভালো। স্কলারশিপের জন্য ট্রাই করোনি কখনো? ”
” দু’বেলা দুমুঠো ভাত জোগাতে যাদের হিমশিম খেতে হয়, তাদের স্কলারশিপের স্বপ্ন দেখাটা বেমানান। তার ওপর আমার মা নেই। মা হীনা সন্তানেরা সমাজের বুকে বিরাট বোঝা। এতটুকু পড়াশোনা যে করতে পেরেছি, তাতেই আমি কৃতজ্ঞ। দাদু-ঠাকমা না থাকলে হয়তো ব কলম থাকতে হত আজীবন। প্রতিটা পরীক্ষার আগে দাদু-ঠাকমা এর ওর কাছে হাত পেতে ফিস জোগাড় করত। গ্রামের সবাই জানে আমাদের পরিবার সম্পর্কে। ” কথা বলতে বলতে প্রনয়ার চোখের কোনে পানি জমল।
রাজ্য, অরবিন্দ ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে আছে প্রনয়ার দিকে। মেয়েটা প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধে লড়াই করছে, সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট। শুধু কানন নির্বিকারচিত্তে সবকিছু শুনছে। ও আগে থেকেই সবকিছু জানে।
” আমি যদি স্কলারশিপের জন্য সাহায্য করতে পারি, তুমি রাজি হবে? ”
” এখন আর কিছুই হবেনা। এতদিন বাবার বাড়িতে ছোটমার দাসী গিরি করেছি, কয়দিন পর অন্য বাড়িতে গিয়ে শ্বাশুড়ির দাসী গিরি করতে হবে। এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে স্থানান্তরিত হচ্ছি শুধু। দাসীবৃত্তির পরিবর্তন হচ্ছেনা। তাই স্কলারশিপের স্বপ্নও দেখিনা আর। এখন শুধু চাওয়া দু’বেলা যেন পেট পুরে খেতে পাই। ক্ষুধার জ্বালা কতদিন সহ্য করব বল? ”
” এভাবে বলছ কেন? শুনছি যার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে, তারা ধনী। পাত্রও নাকি জব করে। নাকি বিয়েতে মত নেই তোমার? ”
” আমার কথা বোধহয় তুমি বুঝতে পারোনি, রাজ্যদা। তুমি ভেবে দেখ, আমার মত নিঠুর গরীব বাড়ির মেয়েকে কোন ধনী ঘর থেকে কেন নিতে চাইছে? তারা ভালো করেই জানে আমার বাবা, দাদু’র তাদের আপ্যায়ন করার মত ক্ষমতা নেই। দু-চারজন মেহমান আসলে বসতে দেয়ার জায়গা নেই। সব জেনেশুনে তারা কেন আত্নীয়তা করতে চাইছে? শুনেছি ঐ বাড়িতে সারা বছর দু’জন করে কাজের ঝি থাকে। আমার হবু শ্বাশুড়ি নাকি তাদের একজনকে ছাড়িয়ে দিয়েছে। আরেকজনকেও বিয়ের পর ছাড়িয়ে দেবে। বিনা পয়সায় ঝি পাচ্ছে তারা। এবার বোঝ কাহিনী। তবে সবকিছু শোনার পরও কিন্তু আমি বিয়েতে রাজি। দাদুর বয়স হয়েছে। কতকাল আর তাদের বোঝা হয়ে থাকব বল। ”
” এসব শুনেও তুমি বিয়েটা করবে? পাগল হয়েছ? ”
” উঁহু। আমি সুস্থই আছি। আসলে তুমি জীবনে কখনো অভাবের সাথে লড়াই করোনিতো। তাই আমার সামান্য দুঃখের কথা শুনেই তুমি ব্যথিত হচ্ছ। একমাত্র অভাবীরাই অভাবের কদর বোঝে। আজ আমি যাই। দোয়া করো, একটা চাকরির জন্য ডাক পেয়েছি। যদি হয়ে যায়, তবে বাবা, দাদুকে আর কষ্ট করতে হবেনা। ”
” হয়ে যাবে। পরিশ্রমের ফল সব সময় মধুর হয়। ”
” দাদু বোধহয় তোমাদের বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করেছে। তুমিও এসো। আসছি। ”
প্রনয়া উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করল। রাজ্য অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটাকে। কত সাবলীলভাবে সে নিজের পুরো জীবনের বর্ননা দিল অল্প কথায়! কতটা ধৈর্য্য থাকলে একটা মেয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে! নিজেকে আত্নমর্যাদাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে!
” আশ্চর্য মেয়ে! ” রাজ্য বলেই ফেলল।
” তুমি যদি প্রনয়াদি’র বেঁচে থাকার লড়াই দেখতে, তবে আরও অবাক হতে। স্কুলে চাকরি করে, টিউশনি করে পড়াশোনা করেছে, সংসারের খরচ দিয়েছে। ছোট ভাইবোনদের শখ পূরণ করেছে। তবুও দি’র ছোটমা দি’কে সব সময়ই গালিগালাজ করে, মাঝেমধ্যে চড়-থাপ্পড়ও মারে। বিয়ে হয়ে গেলেই দি এই অত্যাচার থেকে বাঁচবে। ”
অরবিন্দ কোন কথাই বললনা। নীরবে শুনল প্রনয়ার জীবনের দুঃখের উপাখ্যান।
***
পেখম বাসায় এসেছে। ওর সাথে এসেছে প্রান্তর। মুদৃল কিংবা আইভি রহমান কেউই বাসায় আসেনি। পেখম সোজা রুমে গিয়ে ওর বইগুলো ব্যাগে ভরতে শুরু করল। বই গোছানো হলে নিজের পোশার আর গহনা অন্য একটা ব্যাগে রাখল। যে পোশাক আর গহনাগুলো ওর বাবা’র বাড়ি থেকে পেয়েছিল সেগুলোই শুধু নিল। মৃদুলদের দেয়া সব শাড়ি-গহনা আলমারিতে রেখে আলমারি লক করে তার চাবি নিজের কাছে রাখল। ও আইভি রহমানকে কোন সুযোগ দিতে চায়না।
প্রান্তর অনেক বলেও পেখমকে নিজের বাসায় নিতে পারলনা। ও প্রাপ্তির ফ্ল্যাটে উঠল। তবে প্রান্তরকে বাসা দেখতে বলল। দুই-একদিনের মধ্যেই ও আলাদা ফ্ল্যাটে উঠতে চায়। প্রান্তর বাধ্য হয়ে কয়েক জায়গায় ফোন দিয়ে বাসা দেখতে বলল।
পেখমকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে প্রাপ্তি ওকে ঘাঁটালোনা। তবে ও রাতে না খেয়ে ঘুমাতে চাইলে, প্রাপ্তি সেটা মানলোনা। ও নিজের হাতে পেখমকে খাইয়ে দিল।
***
পরদিন সকালে রাবেয়া সুলতানাসহ কয়েকজন আসলেন পেখমের কাছে। প্রান্তরের মুখে সব শুনে পারভীন আক্তার রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি সাথে সাথেই ফোন করলেন আইভি রহমানকে। তাকে ইচ্ছেমত অপমান করলেন। এরপর প্রান্তরের সহায়তায় তিনি পেখমকে নিয়ে গেলেন থানায়। মৃদুল এবং তার মা’য়ের নামে মানহানী, নারী নির্যাতন আরও দুইটা মামলা করলেন। রাবেয়া সুলতানাও তাদের সাথে ছিলেন। এরপর রাবেয়া সুলতানা এবং পারভীন আক্তারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিভোর্সের এ্যাপ্লিকেশন করল পেখম। তার চাচারাও এতে সস্মতি জানালেন।
আরও তিনদিন পর পেখম নতুন ফ্ল্যাটে উঠল। ওর সাথে মা এবং বড়মাও আছেন।
***
পেখমের জীবনে এতকিছু ঘটে গেছে গ্রামের কেউ সেটা জানতে পারলনা। সৈয়দ পরিবারের বড়রা ছাড়া ছোটরা কেউই বিষয়টা জানতে পারলনা। এমনকি ঋতও না। তাই রাজ্য জানতেও পারলনা, ওর কাঙ্ক্ষিত রমনী কোন পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছে।
***
” দাদু, প্রনয়া দি’র বিয়ে হবেনা। দি’র হবু জামাই অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। নিতাই দাদু, দিদিমা সবাই কাঁদছে। আর প্রনয়া দি’র ছোটমা দি’কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। ”
পেখমের ভাই রিশান দৌড়ে এসে জানাল দাদুকে। এমনিতেই সৈয়দ শামসুল হকের মন ভালো নেই, তারওপর রিশানের মুখে এমন কথা শুনে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। প্রনয়ার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তিনি আফসোসের সুরে বলে উঠলেন,
” হায়রে নারীজন্ম! তোমরা কি কভু সুখ পেতে জন্ম নাওনি ধরায়? সুখ বুঝি তোমাদের জন্য অলীক বস্তু! ” এরপর তিনি ছুটলেন নিতাই রায়ের বাড়িতে।
***
মৃদুল বারবার পেখমকে ফোন করছে। বাধ্য হয়ে পেখম সিমকার্ড পাল্টে ফেলল। এদিকে আইভি রহমান আর মৃদুল প্রতিদিনই ধর্না দিচ্ছে পরশ, প্রান্তরের বাসায়। তারা কেইস তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করছে। নিজেদের ভুল স্বীকার করতে প্রস্তুত তারা। সেই রেস্টুরেন্টে সেদিন তাদের ভিডিও করেছিল কয়েকজন। তারা সেগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে। এটা মৃদুলের ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলেছে। ওকে হসপিটাল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। সাক্ষী-প্রমান মৃদুলে বিপক্ষে গেলে হয়তো তার রেজিষ্ট্রেশনও বাতিল হতে পারে। এটা নিয়েই ভয় পাচ্ছে মৃদুল। এদিকে মিমো ফিরে গেছে ফিনল্যান্ড। ও এসবের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায়না। সে মৃদুলকে জানিয়েছে, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই ও দেশে ফিরবে। সবকিছু মিলে মৃদুল ভালো নেই। সব প্রমান তার বিরুদ্ধে।
চলবে…
#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী জামী
” কোথায় যাচ্ছ, মা? ” রাজিয়া পারভীনকে বাহিরে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল অরবিন্দ।
” পূর্ব পাড়ার নিতাই কাকার বাড়িতে যাচ্ছি, বাবা। কাকার নাতনীর বিয়ের দিন ছিল আজ। কিন্তু বিয়েটা হবেনা আর। মেয়েটার কাছে এই মুহূর্তে কাউকে থাকতে হবে। কাকা, কাকী ছাড়া মেয়েটার আপন কেউ নেই। ”
” আমিও ভাবছিলাম এবার যাব ঐ বাড়িতে। তুমি যখন যাচ্ছ, আমিও যাই তোমার সাথে? ” রাজ্য ওর মা’কে বলল।
” ও বড়মা, আমাকে না নিয়েই যাচ্ছ যে? ”
” অরু, তুইও যাবি নাকি? চল আমরা সবাই মিলে যাই মেয়েটার কাছে। ” রাজ্য অরবিন্দকে জিজ্ঞেস করল।
” মা’র যদি আপত্তি না থাকে, তবে আমিও যেতে পারি। ” অরবিন্দ অনুমতির নিতে তাকাল রাজিয়া পারভীনের দিকে।
” চল যাই। আমি কি তোদের বারণ করেছি? ”
***
বারান্দায় বসে উদাস নয়নে ছাঁদনাতলার দিকে তাকিয়ে আছে প্রনয়া। ওর পরনে কাঁচা হলুদ রংয়ের শাড়ী। বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে মেয়েটা। ওর এলো চুলগুলো বারান্দার মেঝেতে লুটাচ্ছে। পাশেই বসে আছে নিতাই রায় ও তার স্ত্রী ননীবালা। তারা হাপুসনয়নে কাঁদছে।
” অপয়া, অলক্ষ্মী মেয়েমানুষ। এই মেয়ে আমার সংসারে অমঙ্গল হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে গো। বুড়ি ধারী মেয়ের এতদিন বাপের বাড়িতে থেকে সাধ মিটেনি। আরও কতকাল এখেনে থেকে আমার স্বামীর অন্ন ধ্বংস করবে ঠাকুরই জানে। এই বুড়ি ধারীর জন্য আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিনে। বুড়ি ধারী মরেওনা। আমার গলার কাঁটাও যায়না। এই বিয়ে বিয়ে করে, মানুষটা কম পয়সা খরচ করলোনা গো। ”
উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রনবের ছোট বউ গিরিবালা হাজারটা কথা শোনাচ্ছে প্রনয়াকে। কিন্তু সেসবে প্রনয়ার কিছুই যায় আসেনা। ও ছোটবেলা থেকেই ছোটমা’র এমন অভিশাপ, কটুকথা শুনেই বড় হয়েছে।
” বউমা, এবার একটু ক্ষেন্ত দেও। আর কত কথা শোনাবে তুমি মাইয়াডারে? চিরটাকালই মাইয়াডারে তুমি মান-অপমান কইরা আইছ। একটুও তোমার দয়া-মায়া হয়না মাইয়াডার উপর? জীবনে কুনদিন ওর পাশে থাকনাই। ওর এই দুক্কের সময়ে অন্তত ওর পাশে থাক। তা-ও যদি তোমার পাপের পাইশ্চিত্তি হয়। ” ননীবালা চোখ মুছতে মুছতে বলল।
” আইছে জ্ঞানের সাগর। আপনার কাছ থেকে জ্ঞান নিতে চাইতাছে কেডা? এই বুড়ি ধারী এতকাল আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খেয়েছে, এখন আবার তার পক্ষ নিয়া আপনে আমার হাড়মাস জ্বালাইতে আসছেন? বলি কি, বুড়া বয়সে ভীমরতিতে ধরছে আপনারে? তাইলে শুইনা রাখেন, আমিও ভীমরতি ছুটাইতে জানি। ঝেঁটিয়ে সকলের ভীমরতি ছুটিয়ে দোব। ”
ননীবালা জানে ছোট বউমার সাথে কথা বলা মানে নিজের সম্মান নিজের হাতেই ধ্বংস করা। তাই সে চুপ মেরে গেল।
” এই যে অপয়া মা”’গী, এমন ভং ধইরা বইসা রইছস ক্য? ঘরবাড়ি কি তর বাপে পরিষ্কার করব? দুইদিন ধইরা খুবতো বইসা আছিলি নবাবজাদীর মত। নবাবজাদী হওয়ার সাধ মিটছে এখন? ফকিন্নির আবার রানী হওয়ার ইচ্ছেও হয়! শোনরে ফকিন্নি, তুই আজীবন ফকিন্নিই রইবি। রানী হওয়া হইবনা তোর। ” গিরিবালা তেড়ে যায় প্রনয়ার দিকে। ওর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছে।
গিরিবালা’র কথাগুলো শুনে আজকে কেন যেন রাগ হচ্ছে প্রনয়ার। সে-তো রানী হতে চায়নি। চেয়েছিল ঘরনি হতে। কারও রমনী হতে। কিন্তু বরাবরের মত ভাগ্য ওর সাথে নিদারুণ ছলনা করেছে। ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল প্রনয়া। মুখোমুখি হল ছোটমা’র। আজ ওকে প্রতিবাদী হতেই হবে। নইলে আজকের দিনের জন্য ওকে আজীবন খোঁটা দেবে সে।
” ভুল বললে তুমি। রানী হওয়ার শখ আমার কোনদিনই ছিলনা। ঐটাতো তোমার শখ। আমি চিরকালই এই বাড়ির দাসী, তোমার দাসী। তাই বিয়ে ঠিক হওয়া স্বত্বেও আমাকে বাড়ির সব কাজ করতে হয়েছে। তুমি পায়ের ওপর পা তুলে বসে থেকেছ এতকাল। বাবা’র কষ্ট কখনোই তোমার চোখে পরেনি। সে তোমাকে ভালো রাখতে নিজেকে বলি দিতেও প্রস্তুত থাকে। তাই তোমার মুখে এসব কথা মানায়না। আমি তোমাদের কারোই অন্ন ধ্বংস করিনা। নিজে ছোটখাট একটা কাজ করি। সেটা দিয়েই নিজের খরচ চালাই, সাথে তোমার ছেলেমেয়েরও। আর তুমি যে বসিয়ে খাওয়াবেনা, সেটা শুধু আমি কেন পুরো তল্লাটের মানুষ জানে। ”
” হতচ্ছাড়ি মা”’গী, আমারে জ্ঞান দিতাছে! অজাতের ঘরের অজাত, তোর বিষ যদি আইজকা আমি না কমাই, তবে আমার নাম গিরিবালা নয়কো। ”
” মুখ সামলে কথা বল। সব সময় তোমার গালিগালাজ সহ্য করবনা আমি। এটা আমার দাদুর বাড়ি। এখানে তোমার যা অধিকার, সে অধিকার আমারও আছে। ”
” তুই আমাকে অধিকার শিখাইতাছোস! আইজকা তরে শিক্ষা দোব আমি। ”
অবস্থা বেগতিক দেখে নিতাই রায় এবং ননীবালা প্রনয়ার দু’পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা গিরিবালাকে প্রতিহত করবে।
” কাকে শিক্ষা দিবি তুই, গিরিবালা? তুই কাকার উঠোনো দাঁড়িয়ে তারই নাতনিকে আজেবাজে কথা বলছিস? তোর সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমি। এতদিন তোর কীর্তির কথা লোকমুখে শুনেছি, আজ নিজের চোখে দেখলাম। আজ আমার মনে হচ্ছে, তোর মত বেয়াদব মেয়ে অত্র এলাকায় একজনও নেই। প্রনবসহ এই বাড়ির সবাই তোকে সহ্য করে কিভাবে সেটা ভেবেই আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। ”
রাজিয়া পারভীনকে কেউই লক্ষ্য করেনি। তিনি এতক্ষণ বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গিরিবালার প্রতিটা কথাই তার কানে গিয়েছে। শুধু তার কানে নয়, উপস্থিত সকলেই কথাগুলো শুনেছে।
রাজ্য, অরবিন্দ, কানন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এসব কাননের কাছে নতুন কিছু না হলেও অরবিন্দ আর রাজ্যের কাছে নতুন। বিয়ে ভাঙ্গার অপরাধে পাত্রীকেই দোষী করছে, তারই পরিবারের একজন! যেন অপরাধী এই মেয়েটাই!
” দিদি, আপনি! ” গিরিবালা চমকে উঠল রাজিয়া পারভীনকে দেখে। সে আর কিছু বলতে পারলনা।
” থামলি কেন? শিক্ষা দিতে চাইছিলি না মেয়েটাকে? দেখি কেমন শিক্ষা দিতে পারিস তুই। যেখানে মেয়েটা তোদের ভালো রাখতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সেখানে তুই মেয়েটাকে অপমান করছিস, বাজে কথা বলছিস? কিভাবে পারিস রে তুই? কখনো ভেবে দেখেছিস, প্রনয়ার জায়গায় যদি তোর ছেলেমেয়ে থাকত আর তোর জায়গায় প্রনয়ার মা, তখন কি হত? অবশ্য প্রনয়ার মা তোর মত ছিলনা। ওর মধ্যে শিক্ষা, সংস্কার ছিল। ও তোর মত এত নিচে নামতে পারতনা। ”
গিরিবালা এতকিছু শুনে একবারে চুপসে গেল। সে আরও ভড়কে গেল, যখন রাজ্য, কাননের সাথে অন্য একজনকে দেখল।
” দ…দ..দিদি, তুমি এসো বারান্দার এসে বস। ও কানন, তুমিও এস। কইরে হেমা, এদিকে আয়তো, মা। তোর বড়মা আইছে, তার জন্য জল বাতাসা নিয়ে আয়। ”
” থাক গিরিবালা, এত আদিখ্যেতা দেখাতে হবেনা। তোর জল বাতাসা তুইই খা। সর এখান থেকে। আমি প্রনয়ার কাছে এসেছি। ” রাজিয়া পারভীন ঠেলে সরিয়ে দিলেন গিরিবালাকে।
” বড়মা! ” আর কিছুই বলতে পারলনা মেয়েটা। হু হু করে কেঁদে উঠল। রাজিয়া পারভীন ওকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
” প্রনয়া দি, কেঁদোনা। তোমার চোখে পানি মানায়না এটা জানোনা তুমি? তুমি কাঁদছ কোন দুঃখে! কাঁদবে তো ঐ বেকুবটা, যে তোমার মূল্য বুঝলনা। হিরাকে কাঁচ ভেবে পায়ে মাড়িয়েছে যে, কাঁদবে সে। আসলে সে তোমার যোগ্যই নয়। ” কানন প্রনয়ার কান্না থামানোর চেষ্টা করল।
এবার প্রনয়ার হুঁশ হল। ও ভুলেই গিয়েছিল বড়মার সাথে আরও তিনজন এখানে এসেছে। ও চোখ মুছে তাকাল কাননের দিকে।
” ভালো বলেছিস কিন্তু। রাজ্যদা, তুমিও এসেছ! এমন দিনে আসলে যে তোমাদের আপ্যায়ন করার মত অবস্থায় কেউই নেই। একটু অপেক্ষা কর, তোমাদের বসতে দেই। ”
” এত অস্থির হয়োনা। আমরা জানি, আজ এই বাড়ির কারোরই মন-মানসিকতা ঠিক নেই। নিজেকে সামলাও। আজ যেটা হবার ছিল, হয়তো তোমার জন্য সেটা ঠিক ছিলনা বলেই শুরু না হতেই শেষ হয়ে গেছে। শেষে কষ্ট পাওয়ার থেকে শুরুতেই কষ্ট পাওয়া ভালো। অবশ্য যে সম্পর্ক শুরুই হয়নি, সেটা নিয়ে ব্যথিত না হওয়াই তোমার জন্য মঙ্গল। ”
” আমার নাতনী যে লগ্নভ্রষ্টা হল, রাজ্য দাদু। কুমি জানোনা, আমাদের সমাজে লগ্নভ্রষ্টা মেয়েরা সকলের ঘৃণার পাত্রী। আমার নাতনী যে আজীবন কষ্ট পাবে, কাঁদবে সেটা কোনদিনও ভাবতে পারিনি। পোড়াকপালি জন্ম থেকেই কষ্ট পাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় ওর জন্মই হয়েছে কষ্ট পেতে। ” নিতাই রায় হাহাকার করে বললেন।
” আহ্ দাদু, তুমি ভেঙে পরোনাতো। দেখে নিও প্রনয়ার সাথে ভালোই হবে। যার শেষ ভালো তার সব ভালো, প্রবাদটা কেন ভুলে যাও? ”
” ভুলে যাইনি। কিন্তু এই হতভাগীর বেলায় এই প্রবাদটা খাটবেনা। ও জন্মদুঃখিনী। লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে বিয়ে করবে কে বল? আমরা চোখ বুঝলে, হতভাগীর কি হবে, সেটা ভাবলেই আমার দুনিয়া আঁধার হয়ে যায়। ”
” মা, তুমি আর বাবা অনুমতি দিলে আমি প্রনয়াকে বিয়ে করব। ” অরবিন্দের বলা একটা বাক্যই নিতাই রায়সহ সবাইকে স্তব্ধ করে দিল। অরবিন্দ অনুমতির আশায় তাকিয়ে আছে রাজিয়া পারভীনের দিকে।
” তুমি কে? তোমাকে তো আগে কখনো দেকিনি? কোন বাড়ির পুত তুমি? জাত কি তোমার? ” ননীবালা এক নাগাড়ে জিজ্ঞেস করল।
” কাকিমা, ও রাজ্যর বন্ধু। ও আমেরিকা থাকে। তবে ওর বাড়ি কলকাতায়। অরু বাবা, তুমি কথা বল কাকিমার সাথে। ”
অরবিন্দ এগিয়ে গিয়ে প্রনাম করল নিতাই রায় আর ননীবালা দেবীকে।
” আমি অরবিন্দ সেন। কলকাতায় বাড়ি। বাবা-মা কেউই নেই। গত কয়েক বছর থেকে আমেরিকা থাকি। সেখানে একটা ব্যাংকে চাকরি করি। আপনাদের আর বাবা-মা’র যদি অমত না থাকে তবে আমি আপনার নাতনিকে বিয়ে করতে চাই। ”
” এক মিনিট, আপনি কি আমাকে করুণা করছেন? একটা লগ্নভ্রষ্টা মেয়েকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে মহান হতে চাইছেন? ”
” আপনার এ কথা কেন মনে হল! ”
” কেন মনে হবেনা? চেনা নেই, জানা নেই আপনি হুট করে বিয়ে করতে চাইছেন। এমনও নয় যে আমার পরিবার ধনী, শিক্ষিত, সমাজের চোখে সম্মানিত। আপনার প্রস্তাব শুনে সন্দেহ হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? ”
” আপনি….
” তুই থাম, অরু। আমি প্রনয়াকে যা বলার বলছি। শোন প্রনয়া, সেদিন যখন তোমার সাথে আমাদের রাস্তায় দেখা হয়েছিল, সেদিনই তোমাকে দেখে ফিদা হয়ে গেছিল ও। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট, যাকে বলে। যখন ও শুনল তোমার বিয়ে হবে কয়দিন পর, তখন বেচারা ব্রকআপের স্বাদ পেয়েছিল। যেটা আমার এড়ায়নি। গত তিন-চার দিন বেচারা মুখটা আমসির মত করে রেখেছিল। হাসতে ভুলে গেছিল, খেতে পারতনা, ঘুমাতে পারতনা। কিন্তু আজ যখন শুনল তোমার হবু বর অন্য কাউকে নিয়ে পালিয়েছে, তখন থেকে ওর চেহারা দেখার মত হয়েছে। একা একাই হাসছে। খুশির ঠ্যালায় সকালে চারটা পরোটা বেশি খেয়েছে। একটা ডিমের জায়গায় দুইটা ডিম খেয়েছে। গত কয়দিনের খাবার একবেলায় খেয়েছে। এরপরও কি তোমার সন্দেহ হচ্ছে, ও তোমাকে পছন্দ করেনা? ”
রাজ্যের কথা শুনে অরবিন্দ লজ্জায় রাজিয়া পারভীনের আঁচল দিয়ে মুখ ডাকল। মনে মনে হাজারটা গালি দিচ্ছে রাজ্যকে।
” নিতাই দাদু, দিদিমা, তোমরা রাজি হয়ে যাও। এমন পাত্র হাতছাড়া করতে নেই। ওর গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। তোমার নাতনী যদি এক বিন্দুও কষ্ট পায়, তবে তার দায় আমি নেব। পাত্র হিসেবে অরু লাখে এক। ”
” কাকাবাবু, এই ছেলেটা গত পনেরদিনে আমার নিজের ছেলে হয়ে গেছে। আমি বলছি, ওর মত ছেলে হয়না। প্রনয়া ওর সাথে সুখে থাকবে। প্রনয়া, রাজি হয়ে যা, মা। সারাজীবন বাড়ির মানুষের কথা ভেবেছিস৷ একবার অন্তত নিজের কথা ভাব। ” রাজিয়া পারভীন যতটুকু সম্ভব বোঝালেন সবাইকে।
রাত আটটার লগ্নে বিয়ে হল অরবিন্দ আর প্রনয়ার। সবাই খুশি হলেও গিরিবালা খুশি হলোনা মোটেও। তার মুখে আঁধার নেমে রইল পুরোটা সময়।
চলবে…