সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-২৭+২৮

0
504

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী জামী

” আপু, এদিকে জবরদস্ত ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা এখন ভাইরাল গ্রামের মেয়ে। ” ঋতের কথায় পেখম কপাল কোঁচকায়। এমনিতেই ওর মন ভালো নেই। তারওপর ঋত এমনভাবে বলল যেন কি না কি ঘটে গেছে।

” কি হয়েছে রে? ” ভাবলেশহীন গলায় জিজ্ঞেস করল পেখম।

” প্রনয়া দি’র বিয়ে হবার কথা ছিল পাশের গ্রামের বিধান বিশ্বাসের সাথে। কিন্তু বিয়ের দিন বিধান মাষ্টার আরেকজনকে নিয়ে ভেগে গেছে। এদিকে প্রনয়া দি লগ্নভ্রষ্টা হবে জন্য তার বাড়িতে কান্নার রোল পরে গেছে। সেই সাথে কাকিমা’র গালাগালি। ঠিক তখনই সেখানে হঠাৎ করে উদয় হলো রাজিয়া বড়মা। তার সাথে রাজ্য ভাইয়া, কানন ভাইয়া আর রাজ্য ভাইয়ার বন্ধু অরবিন্দ দা। সব শুনে অরবিন্দ দা প্রনয়া দি’কে বিয়ে করতে চায়। ব্যস হয়ে গেল বিয়ে। আজকে দি’কে নিয়ে মীর বাড়িতে উঠবে অরবিন্দ দা। ”

ঋতের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা পেখম। সেই অবস্থায় নেই ও। জীবন যেখানে ওর সাথে জুয়া খেলছে, সেখানে সে কিভাবে অন্যের বিষয়ে নাক গলাবে। তবুও কিছু একটা বলতে হবে জন্যই বলল,

” ভালো। প্রনয়া দি ভালো থাকুক। সারাজীবন কষ্ট করেছে বেচারি। ”

” তুমি ভালো আছ, আপু? তোমার গলা এমন ভাঙ্গা ভাঙা লাগছে কেন? বড়মাও কতদিন ধরে ঢাকা আছে। বাড়ির বড়রা সবাই মন খারাপ করে থাকে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কেউই কিছু বলেনা। ”

” মা আমার কাছে আরও কিছুদিন থাকবে। সামনে আমার এক্সাম। তাই মা’কে রেখে দিয়েছি। তোরা সবাই ভালো আছিস? ”

” আছি ভালো। বড়মা যে তোমার কাছে আছে, এতে তোমার দজ্জাল শ্বাশুড়ি তোমাকে কথা শোনাচ্ছেনা? এই আপু, শোন? আমি তোমার শ্বাশুড়ির নাম দিয়েছি কাল নাগিনী। ভদ্র মহিলার কথায় কথায় ছোবল মারার অভ্যাস আছে। তার স্বভাবের সাথে নামটা পারফেক্ট, কি বল? ”

পেখম উত্তর না দিয়ে মলিন হেসে অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করল।

***

বাসি বিয়ে সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হল। আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতেই রাজিয়া পারভীন বরকনে নিয়ে বাড়িতে আসলেন।

” প্রনয়া, এই বাড়িতে কিছুদিন থাকতে তোর কোন আপত্তি নেই তো, মা? ” বাড়িতে এসে প্রনয়াকে অরবিন্দের রুমে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন রাজিয়া পারভীন।

” ছোটবেলা থেকেই আমি তোমাদের কাছে মানুষ হয়েছি। এমন একটা দিনও যায়নি যে তোমরা আমাকে খেতে দাওনি। তোমরা আর সৈয়দ বাড়ির জেঠু-জেঠিমারা না থাকলে আমি কোথায় ভেসে যেতাম। আর সেই তুমিই আমাকে এ কথা জিজ্ঞেস করছ, জেঠিমা? ”

” আগে আসতিস এর এখন থাকবি, এ দুটোর মধ্যে অনেক ফারাক রে, মা। আগে আসতিস আবার চলেও যেতিস। কিন্তু এখন এখানে তোকে বেশ কিছুদিন থাকতে হবে। যেহেতু আমাদের ধর্ম আলাদা, আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো আলাদা। সেহেতু তোর সমস্যা হতেই পারে। সেজন্যই তোকে জিজ্ঞেস করলাম। ”

” সবার আগে আমরা মানুষ। আমাদের দু’জনের শরীরেই লাল রঙের রক্ত বইছে। শরীরের কোথাও আঘাত পেলে তোমরাও যেমন কষ্ট পাও আমরাও তেমনি কষ্ট পাই। তবে কেন জাত-ধর্ম মনুষ্যত্বের থেকেও বেশি প্রাধান্য পাবে? আমি মনুষ্যত্বকে জাত-ধর্মের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেই। ”

অরবিন্দ মৃদু হেসে তাকিয়ে আছে প্রনয়ার দিকে। মেয়েটা যে স্পষ্টবাদী সেটা বুঝতে পারছে সে। যেটা ওর কাছে বেশি ভালো লেগেছ।

” মা, ও তোমার কাছে আরও কিছুদিন থাকবে কিন্তু। ওকে ইউএস এ না নেয়া পর্যন্ত ওকে তোমার কাছেই রেখ। আমি ওর দজ্জাল মা’য়ের কাছে ওকে কিছুতেই রেখে যাবনা। এতে তোমাদের কোন আপত্তি নেইতো, মা? ”

” বাড়ির সবার সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি আমি। কেউই চায়না প্রনয়া ঐ বাড়িতে থাকুক। এতদিন ওকে এই বাড়িতে রাখার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছিলনা বিধায় ওকে এখানে রাখতে পারিনি। কিন্তু এখন বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। এখন বেশি কথা না বলে রাজ্যকে সাথে নিয়ে বাজারে যা। তোর বাবা-চাচা মিলে বাজার করেছে, কিন্তু কিছু জিনিস এখনো কেনা হয়নি। তারা বাজার করে হাঁপিয়ে গেছে। এবার তোরা গিয়ে বাকিটা কিনে আনবি। আগামীকাল কয়েকজন অতিথি আসবে। তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজনও আসবে। ”

” এরইমধ্যে বাজারও করা শেষ! আচ্ছা লিষ্ট দাও। দেখি কি কি বাকি আছে। ”

কিছুক্ষণ পর রাজ্য, কানন আর অরবিন্দ মিলে বাজারের দিকে যায়।

***

পেখম বই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু পড়ায় ওর মন বসছেনা। মৃদুল বারবার ওকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছে। কিন্তু পেখম ওর ফোন রিসিভ না করে ব্ল্যাক লিষ্টে রেখেছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর থেকেই অন্য নম্বর থেকে ফোন আসলে পেখম রিসিভ করে বুঝতে পারে মৃদুল ফোন দিয়েছে। সাথে সাথে ফোন কেটে ব্ল্যাক লিষ্টে দেয় পেখম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবারও অন্য নম্বর থেকে অনবরত ফোন আসতেই থাকে। সেই সাথে ম্যাসেজও আসছে। মৃদুল বারংবার অনুরোধ করছে, ওকে ক্ষমা করে দিতে। সে চাইছে পেখম কেইস তুলে নিক। বাধ্য হয়ে পেখম ফোন থেকে সিমকার্ড খুলে ফেলল। সিদ্ধান্ত নিল ভার্সিটি যাওয়ার পথে আরেকটা সিমকার্ড কিনবে। ও কিছুতেই মৃদুলের মুখোমুখি হতে চায়না। সম্পর্ক রাখতে চায়না তার সাথে। আর ক্ষমা করারতো প্রশ্নই আসেনা।
প্রান্তরের মাধ্যমে পেখম জানতে পেরেছে কেইস কোর্টে গেছে। যেকোন দিন ওদের ডাক পরবে। আর হয়তো মৃদুলকেও আটক করা হবে। ওর বাঁচার কোন পথ নেই। আর সেজন্যই মরিয়া হয়ে গেছে মৃদুল। পেখমের সাথে মধ্যস্থতা করে বাঁচার পথ খুঁজছে সে। যেটা পেখমের কাছে ঘৃণার কারন।

***

কাননের কাছে পেখমের ডিভোর্সের কথা শুনে রাজ্য ভিষণ চমকে গেছে। ও বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কাননের দিকে। মেয়েটার ওপর দিয়ে এত ঝড়-ঝঞ্ঝা গেছে! কিভাবে সবকিছুর মোকাবিলা করেছে মেয়েটা! আজ পেখমের এমন দুর্গতির জন্য নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে রাজ্যের।

” কিছু বলছনা যে, ভাইয়া? ” রাজ্যকে নিরব থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল কানন।

” কি বলব আমি! নিজের ইচ্ছেতেই একটা মেয়েকে অপমান করেছি, তার মন ভেঙেছি। আমি শুধু দূর থেকে তার কষ্টের কথা শুনতে পারি। তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা চিন্তা করলে, তার সেই ঘৃণামিশ্রিত মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল রাজ্য।

” কিছুই কি করার নেই, ভাইয়া? মেয়েটা কি এভাবে কষ্ট পাবে? ও তো এতটা অসম্মান, অপমান, কষ্ট ডিজার্ভ করেনা। ”

” আমি ঢাকা যাব। তুই কি যাবি আমার সাথে? ”

” কবে যাবে? অরবিন্দ দা কবে গ্রামে ফিরবে? সে ফিরলে তাকেও নিয়ে যাবে? ”

” ওরা দু’জন মিলে পুরো দেশ ঘুরে দেখুক। ওর ছুটি আরও একমাস আছে। যতদিন ইচ্ছে ততদিন বেড়াক ও। আমি ঢাকা যাই। ও ফিরলে আমিও গ্রামে আসব। কালকে যেতে পারবি? ”

” কেন পারবনা! ”

পরদিন সকালে ওরা দু ভাই মিলে ঢাকা রওনা দিল।

***

” আব্বা, আসব? ” মেহনাজ এসে দাঁড়ায় সৈয়দ শামসুল হকের রুমের দরজার সামনে।

” এসো, বউমা। ”

” আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি, আব্বা। যদিও এই মুহূর্তে এসব কথা বলা আমার সাজেনা, কিন্তু বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে। আমি জানি এই বাড়ির কারোরই মন-মানসিকতা ঠিক নেই। সবাই পেখমের জন্য কষ্ট পাচ্ছে। ”

” কি বলতে চাও, বউমা। ”

” আমি আপনার কাছ থেকে অনুমতি চাচ্ছি আব্বা। আপনার ছেলে কিছুতেই আমার কথা শুনতে চাচ্ছেনা। তাই আপনিই শেষ ভরসা। আমার বড় আপাকে তো আপনি চেনেন। আপার বড় ননদের ছেলে ডক্টর। আপার ননদ ঋতকে দেখে পছন্দ করেছে। সে তার ছেলের জন্য ঋতকে চেয়েছে। ছেলে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাবে ছয়মাস পরই। তারা চাচ্ছে ছেলে ইংল্যান্ড যাওয়ার আগেই বিয়েটা হোক। ছেলেকে আমি চিনি। সে যথেষ্ট ভালো। ওর পরিবারও ভালো। তাই আমার অমত নেই। কিন্তু আপনার ছেলে কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা। আমি জানি সে আপনার কথা কিছুতেই অমান্য করবেনা। আপনই বলুন ছেলে ডক্টর, ওর বাবা প্রফেসর, মা স্কুলের টিচার, ছেলে ভাইবোনেরা ডক্টর, সরকারি কর্মকর্তা। এমন পরিবারকে কি খারাপ বলা যায়? ঋত কি সেখানে খারাপ থাকবে? ”

মেহনাজের কথা শুনে তার দিকে তাকালেন সৈয়দ শামসুল হক। তার চোখে টলমল করছে অশ্রুদল৷ এমন একটা পরিস্থিতিতেও মেহনাজ কিভাবে নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে পারছে! এতটাও স্বার্থপর মানুষ হয়!

” আমি আর কি বলব, বউমা! সিদ্ধান্ত তো তুমি নিয়েই নিয়েছ? ঋত তোমার মেয়ে, মা হয়ে তুমি কি মেয়ের খারাপ চাইতে পার? আচ্ছা আমি রাকিবকে বলব। ”

সৈয়দ শামসুল হক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন। মাঝেমধ্যে নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে হয়। একটা সময় যিনি দাপটের সাথে সংসার পরিচালনা করেছেন, সকলের চাওয়া-পাওয়ার খেয়াল রেখেছেন, সকলের মতামতের গুরুত্ব দিয়েছেন। আজ তিনিই সংসারের বোঝাস্বরূপ।

***

” কানন ভাইয়া, তুমি তাড়াতাড়ি গ্রামে এস। না না তুমি আজকেই বাড়িতে আসবে। ” ঋতের কথা শুনে ধড়মড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল কানন।

” কি এমন জরুরি কাজ যে আমাকে আজকেই বাড়িতে যেতে হবে? তুই জানিস, আমি ভাইয়ার সাথে আছি। সেটা তোর বোনের জন্যই। ”

” কেন, তোমার ভাইয়া কি কচি খোকা? সে ঢাকায় একা থাকতে পারবেনা? ”

” নাহ্ আমার ভাইয়া মোটেও কচি খোকা নয়। তার মন খারাপ সেজন্য আমি তাকে সঙ্গ দিচ্ছি। ”

” কতজনের মন খারাপের সঙ্গী হতে চাও তুমি? তুমি যদি গ্রামে না আস, তবে নিজের মন খারাপের সঙ্গী কিন্তু নিজেকেই হতে হবে। না-কি লোক ভাড়া করবে সঙ্গী হতে? ”

” এই সকাল সকাল আবোলতাবোল বকছিস কেন? রাতে কি শুকনো পাতা সেবন করেছিলি?”

” কাননের বাচ্চা, আজেবাজে কথা বলবিনা বলে দিচ্ছি। শুকনো পাতা তুই খাস, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী খায়, তোর ছ্যাকাখোড় ভাই খায়। ”

” চুপ কর, পেত্নী। আমি কাননের বাচ্চা নই। আমি কানন। কাননের বাচ্চারা তোর পেট থেকে ডাউনলোড হবে। আর তার ক্রেডিট পুরোটাই আমার হবে। হুদাই প্যারা দিস ক্যান? যাহ্ গিয়ে ঘুমা এখনো সকাল হয়নি।”

” ঐ আশা করেই বসে বসে আঙুল চোষ। নয়মাস পর যখন অন্যের ক্রেডিটের বাচ্চা ডাউনলোড দেব, তখন বুঝবি প্যারা কাকে বলে। জামাই, বাচ্চা সুদ্ধ তোর বাড়িতে গিয়ে তোর গোষ্ঠীর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। আমার বাচ্চা তোকে মামা বলে ডাকবে, সেই খুশিতে ডগমগ হয়ে তুই আমার বাচ্চাকে ললিপপ কিনে দিবি। বিষয়টা খুবই উপভোগ্য হবে তাইনা? ”

” আশ্চর্য! তুই-তোকারি করছিস কেন! এখনও তোর বাচ্চা নেয়ার বয়স হয়নি। যে বয়সে তুই নিজেই ললিপপ খাস, সেই বয়সে বাচ্চাকে ললিপপ খাওয়ানোর কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্য নষ্ট করছিস কেন? ”

” তুই যদি গ্রামে না আসিস, তবে সত্যিই আমি বাচ্চাকে ললিপপ খাওয়ানোর কথা চিন্তা করব বলে দিলাম। ”

” এই দ্যাখ, আবারও তুই বলে! এই তোর কি হয়েছে সেটা বলবি দয়া করে? ”

” আম্মু আমার জন্য পাত্র ঠিক করেছে। পাত্র ডক্টর। আম্মু চাচ্ছে বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি হোক। ” এক নিঃশ্বাসে বলল ঋত।

” কিহ্! তোর মা জানে, শারিরীক দিক দিয়ে তুই বউ হিসেবে পারফেক্ট হোসনি এখনো? অযথা একটা ছেলের হক মারার অধিকার তোর মা’য়ের নেই। ”

” কি বলতে চাইছিস তুই? আমার শারিরীক ত্রুটি আছে? কুত্তা তুই আমাকে অপমান করছিস? তোর সাহস কত! তোর সাথে ব্রেকাপ। ”

” ও ঋত সোনা, আমি সে কথা বলিনি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, তুমি এখনো ছোট আছ। একদিন তোমাকে চুমু দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি রাজি হওনি। সেজন্যই বলেছি, এসবের জন্য তুমি মেন্টালি প্রস্তুত নও। তুমি রাগ করোনা, বাবু। ”

” হ, সেদিন তোকে চুমু দিতে দিতাম, আরেকদিন তুই অন্য কিছু করতে চাইতিস। আমাকে এতই পাগল ভেবেছিস তুই? ”

” নাউজুবিল্লাহ, তুমি আমাকে লুচু মনে কর, ঋত সোনা! আমিতো শুধু সেদিন তোমার গালের মেক আপের স্বাদ কেমন দেখতে চেয়েছিলাম। খারাপ মতলব আমার ছিলনা। ”

” কুত্তা, আমি মেক-আপ দেইনা। তুই রাখ তোর ঢংয়ের কথা। বাড়িতে আসবি কিনা বল? না আসলে আগামী তিনদিনের ভেতর বিয়ে করব আমি। ”
কাননকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রাখল ঋত। রাগে কাঁপছে মেয়েটা।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী জামী

” তুমি আমার মেয়ের এতবড় সর্বনাশ করলে কেন? আমার বাচ্চা মেয়েটাকে ফুসলিয়ে ফসলিয়ে নিজের অকর্মা কাজিনের সাথে বিয়ে দিলে? তোমার জন্য দুই পরিবারের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। চাচার মৃত্যুর পর যা-ও একটু স্বাভাবিক হয়েছে, তুমি আবারও তা শেষ করে দিলে। আমার কত স্বপ্ন ছিল আমার মেয়েকে কোন ডক্টর, ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিয়ে দেব। এই তোমরা বেরিয়ে যাও, আমি এই বিয়ে মানিনা। আমি আমার মেয়েকে আমার পছন্দ করা পাত্রের সাথেই বিয়ে দেব। আমার মেয়ে এখনো নাবালিকা, তার বিয়ের বয়স হয়নি। আমি তোমাদের নামে কিডনাপিং কেইস করব। ”

মেহনাজের সাথে সাথে সৈয়দ বাড়ির প্রত্যেকে হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা কখনো কল্পনা করেনি ঋত কাননকে হুট করেই বিয়ে করবে। সৈয়দ রাকিব আহমেদ রেগে কাননের দিকে এগিয়ে গেলে তার বড় ভাই তাকে আটকালেন৷

ঋত রাজ্যের পেছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা’র দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই।

” রাজ্য, তুমি এই মুহূর্তে কাননকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। আমরা ভুলিনি পেখমকে তুমি কি চরম অপমান করেছিলে। তোমার জন্যই মেয়েটার আজ এই দুর্দশা। সেই তুমি আবারও আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করতে তৎপর হয়েছ? সেদিন তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি বলে ভেবোনা আজও তোমাকে ছেড়ে দেব। আমি তোমার পরিবারের সবার সাথে কথা বলব। তোমাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিব আমি। ” রাকিব আহমেদ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন।

” চাচা, আপনি একবার আমার কথা শুনুন প্লিজ। আমি যা করেছি ওদের দু’জন ভালোর জন্যই করেছি। আমি চাইনি আপনাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তে ঋতের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক। কাননও আজীবন কষ্ট পাক। আপনি ঠিক বলেছেন, পেখমের অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমার সেদিনের সেই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য মেয়েটার জীবন তছনছ হয়ে গেছে। যেটা আমি চাইলেও আগেরমত করতে পারবনা। ঠিক সেজন্যই আমি আজ ঋত,কাননের বিয়ে দিয়েছি। কারন আমি চাইনি আপনাদের একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারনে এই বাড়িতে আরেকবার পেখমের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো ঋত বিয়েতে রাজি হত। কিন্তু ও কি কানন ব্যাতিত কাউকে ভালোবাসতে পারত? ওকে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকতে হত। একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে সংসার করার কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। নিজের মন একজনকে দিয়ে, শুধু শরীরটা আরেকজনকে দেয়াকেই সংসার বলেনা। সেই সংসারে সুখ আসেনা কভু। আপনারা হয়তো কোন ডক্টর, ইঞ্জিনিয়ারকেই ঋতের সুখের মাপকাঠি ভেবেছেন। আদৌ কি এতে সুখ আসে? পেখম কি পেরেছে সুখী হতে? হয়তো আজ কানন আপনাদের চোখে যোগ্য নয়, কিন্তু একদিন ও নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারবেনা, এটা আমরা এখনই বলতে পারি? আমরা কি পারিনা ওকে একটা সুযোগ দিতে? ঋতের সুখের জন্য, কাননের স্বপ্ন পূরণের জন্য আপনারা কি ওদের বিয়ে মেনে নিতে পারবেননা? ঋতকে ছাড়া কানন কিছুই নয়। একটা সুযোগ আপনারা কাননকে দিন। ও যদি আপনাদের চাওয়া পূরণ করতে না পারে, তবে ঋতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। আমি কথা দিচ্ছি কেউ আপনাদের বাঁধা দেবেনা। প্লিজ চাচা, আমার রিকুয়েষ্ট একটু ভেবে দেখুন। আপনাদের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে ঋতের সুখ। ”

” আসছে ঢং করতে। এমনভাবে বলছ যেন, তুমিই সবকিছু ঠিক করে দেবে? পারবে পেখমের সুখ ফিরিয়ে দিতে? যে নিজের জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, সে আবার আমার মেয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে। আমি পেখমকে পছন্দ করিনা এটা যেমন ঠিক, তেমনি মেয়েটার এই দুর্দশাও মানতে পারছিনা এটাও একশোভাগ সত্যি। তুমি যদি সেদিন না পালাতে, তবে মেয়েটার শরীরে আজকে ডিভোর্সি তকমা লাগতনা। এই তুমি তোমার এই অবর্মা ভাইকে নিয়ে যাওতো। আমি আমার মেয়ের বিয়ে আমার পছন্দের পাত্রের সাথেই দেব। কাউকে জানতেই দেবোনা ও তোমার প্ররোচনায় ভুল করেছে। আমি তোমাকে পুলিশে দেব। তোমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে জেলের ভাত খাওয়াব। তোমার বাপ-চাচার বড় বড় গালগল্প বের করব আমি। ”

” আপনি এসব বলতেই পারেন। কারন মেয়েটা আপনার। আর সন্তানের জন্য বাবা-মা’ র যতটা চিন্তা হয়, আর কারো সেটা হবেনা সেটাই স্বাভাবিক। তারপরও আমি বলব, আপনি একবার ভেবে দেখুন। ঋত কিসে সুখে থাকবে সেটা ভাবুন। বাবা-মা হিসেবে সন্তানের সুখ নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব আপনাদেরই। বিয়ের পর ঋতের মলিন মুখ সহ্য করতে পারবেন? পারবেন ও সুখে নেই কথাটা মানতে? পারবেন শুধু শরীরসর্বস্ব ঋতকে দেখতে? যে ঋতের মনটা পরে থাকবে কাননের কাছে, যে ঋতের কিশোরী মনের স্বপ্ন শুধুই কাননকে ঘিরে, সেই ঋত কিভাবে কাননকে ছাড়া বাঁচবে সেটা একবার ভেবে দেখুন? এটা রাগ করার সময় নয়। ” অনুনয় ঝরল রাজ্যের গলায়।

” এই তুমি চুপ কর। আমাকে জ্ঞান দিওনা। কে চাইছে তোমার জ্ঞান শুনতে? আমার মেয়ের কিসে ভালো হবে সেটা আমিই বুঝব। তোমার মত বাটপারের কাছ থেকে কোন জ্ঞান চাইনা আমার। বেরিয়ে যাও তুমি তোমার ভাইকে নিয়ে। ঋত, তুই আমার কাছে আয়। বাপ-দাদার সম্মান নষ্ট করে শান্তি হয়নি? আবার গিয়ে লুকিয়েছিস এই লাফাঙ্গার পেছনে? তোর ছাল-চামরা যদি আমি না ছাড়িয়েছি তবে আমার নাম মেহনাজ নয়। ভালোবাসার মত আর কাউকে পেলিনা? মীর বংশের এই অসভ্যকে ভালোবাসতে হলো তোর? ”

” তুমি চুপ করবে? আমি কথা বলছি দেখছোনা? সব সময় এত বেশি কথা বল কেন? রাজ্য, তুমি তোমার পরিবারের লোকজনকে আসতে বল। আমি একা আমার মেয়েকে তোমাদের বাড়িতে পাঠাবনা। আমার মেয়ে শুধু স্বামীর সাথে শ্বশুর বাড়িতে যাবে এটা আমি হতে দেবোনা। ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আসলেই তবে আমি আমার মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাব। ”

রাকিব আহমেদের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রাজ্য, ঋত, কানন।

” কি বললে তুমি? তুমি ঋতকে ঐ বাড়িতে পাঠাবে? তুমি পেখমের কথা ভুলে গেছ? মেয়েটাকে কি অপমানটাই না করেছিল এই ছেলে। সেই বাড়িতে তুমি আমার মেয়েকে পাঠাবে? কক্ষনোনা। আমি ঋতকে ওদের সাথে কিছুতেই পাঠাবনা। ” তেতে উঠল মেহনাজ।

” ঋত শুধু তোমারই মেয়ে নয়, ও আমারো মেয়ে। আমার মেয়েকে আমি কোথায় পাঠাব না পাঠাব সেটা আমি ভালো বুঝব। আমি আমার মেয়ের সুখ চাই, কোন মিথ্যা ঐশ্বর্যের মাঝে ওকে ডুবিয়ে দিয়ে ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে দেবোনা। আমার মেয়েকে সুখী দেখতে চাই আমি। রাজ্য, তুমি তোমার বাড়িতে কথা বল। ”

” আমার বাড়ির সবাই বাহিরে অপেক্ষা করছে। অনুমতি পেলেই তারা ভেতরে আসবে। তারা তাদের ছেলের বউকে বাড়িতে নিয়ে যেতে অস্থির হয়ে গেছে। ”

” বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে মানে? ” অবাক হলেন রাকিব আহমেদ।

” আমাদের সাথে তারাও এসেছে। তারা তাদের ছেলের বউকে এখানে একা রাখতে সাহস পাচ্ছিলনা। ”

” তোমার সাথে সাথে তোমার বাড়ির লোকজনও পাগল হয়ে গেছে, রাজ্য? ” পারভীন আক্তার হেসে বললেন।

” তারা তাদের বড় ছেলের ভুলের মাশুল দিচ্ছে মাত্র। সেজন্যই ছোট ছেলের বউয়ের ব্যাপারে কোন ভুল করতে চায়না। ”

***

পেখম ফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কানন ভাইয়ার সাথে ঋতের বিয়ে হয়ে গেছে! আর সবকিছুর নাটের গুরু রাজ্য নামের লোকটা! রাজ্য নামটা ঘুরে ফিরেই ওকে শুনতে হয়, যেটা ওর ভালো লাগেনা। ঐ লোকটার জন্যই ওর এই অবস্থা। ওকে লজ্জার সাগরে ফেলে যে লোকটা দেশ ছেড়েছিল, সেই লোকটাই আবার ঋত-কাননের বিয়ে দিয়েছে! তবে বেশি কিছু ভাবার আগেই ফোন আসল পেখমের। ওর ল ইয়ারের ফোন।

***

” তোমরা এই বাড়িতে? ” মিনহাজ রহমানের গলা পেয়ে মৃদুল, আইভি রহমান সামনে তাকায়।

” তু..তুমি এসেছ? তোমার না আরও তিনমাস পর আসার কথা ছিল? ”

” কেন আমি না আসলেই কি বেশি সুবিধা হত? তোমরা নির্বিঘ্নে তোমাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে পারতে? কিন্তু সেটিতো আমি হতে দেবোনা। কি ভেবেছিলে তোমরা একটা মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছ আর আমি সেটা চোখ বন্ধ করে দেখব? সেটি হচ্ছেনা। ”

” এসব তুমি কি বলছ, আব্বু? তুমি জানোনা পেখম আমাদের নামে ফ্রড কেইস করেছে, নারী নির্যাতন কেইস করেছে। আরও কয়েকটা কেইস করেছে। ”

” আমি সবই জানি। তবে মনেপ্রাণে চাইছিলাম, সে আরও কয়েকটা কেইস করুক। যাতে তোমরা মা-ছেলে সারাজীবন জেলে পঁচে মর সেই ব্যবস্থাই করতে বলব ওকে। ”

” আব্বু! ”

” খবরদার ঐ দুষিত মুখে আমাকে আব্বু ডাকবেনা বলে দিচ্ছি। আমি কাগজে-কলমে তোমাকে ত্যাজ্য করেছি। তাই আমাকে আব্বু ডাকার অধিকার তোমার নেই। এই নাও সব পেপারস। এতে তোমাকে ত্যাজ্য করার সব প্রুভ আছে। আর হ্যাঁ আইভি, তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি আমি। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। যথাসময়ে তুমি ফোন পাবে। তবে তোমাদের সব পাওনাই আমি মিটিয়ে দেব। হিসেবমত তুমি যা যা পাও সবই তোমাকে দেব। তোমাদের একঘন্টা সময় দিচ্ছি, তোমরা নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এক ঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে যাবে। ”

” তুমি এটা করতে পারোনা। কি ভুল আমাদের? আমরা কোথাও যাবোনা। আমি প্রয়োজনে আদালতে যাব। ” বুক চিতিয়ে বললেন আইভি রহমান।

” যেখানে খুশি যেতে পার। আমিও চাই তুমি আদালতের স্বরনাপন্ন হও। এতে আমার সুবিধা হবে। তোমাদের বিরুদ্ধে সব প্রমানই আমার কাছে আছে। তোমাদের শাস্তি দেয়ার কোন সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনা। ”

এবার দমে গেলেন আইভি রহমান। তার মুখে কোন কথা জোগালনা। তাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন মিনহাজ রহমান।

” চুপ মেরে গেলে কেন? আরও কিছু বল, শুনি? ভালোই লাগছিল শুনতে। কথা শেষ করে নিজেদের কাপড়চোপড় গোছাও। একঘন্টার বেশি সময় আমি দেবোনা। ”

মিনহাজ রহমানের হুমকিতে কাজ হল। তারা সুড়সুড় করে নিজেদের রুমের দিকে গেল। একঘন্টা পর নিজেদের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসল রুম থেকে।

চলবে…