#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী জামী
” আম্মু, তুমি জানো আমি বর্তমানে বেকার। সঞ্চয় বলতেও তেমন কিছুই নেই। আমার নিজেরই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এখন তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব, কি করব বলতো? তুমি বরং মামা অথবা খালামনিদের কারও কাছে চলে যাও। ”
মৃদুলের কথা শুনে আইভি রহমান স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
” এটা তুমি কি বললে, বেটা! তোমাকে রেখে আমি আমার ভাইবোনদের কাছে যাব? তুমি এটা বলতে পারলে? ”
” তুমি বুঝতে চেষ্টা কর, আম্মু। এভাবে অবুঝের মত কথা বললে তো হবেনা। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক তুমি তো আমার সমস্যা বুঝবে? কিন্তু তুমিই আমার সমস্যার কথা চিন্তা না করে স্বার্থপরের মতে নিজের কথা ভাবছ? ”
” আমি নিজের জন্য চিন্তা করছিনা, বেটা। আমার সব চিন্তা তোমাকে নিয়ে। তুমি একা একা কোথায় থাকবে, কি খাবে সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে
তোমার আব্বু তোমার সাথে বেইমানী করতে পারে, কিন্তু আমি বেইমান নই। ”
” আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবেনা। তুমি নিজের কথা ভাব। আমি এমনিতেই টেনশনে আছি, তুমি আমার টেনশন আর বাড়িয়ে দিওনা। ”
ছেলের কথা শুনে আইভি রহমানের চোখের কোনে পানি জমা হল। যে ছেলের পক্ষ নিয়ে তিনি সব সময়ই স্বামীর বিরুদ্ধে গেছেন, সেই ছেলে আজ তাকে নিজের সাথে রাখতে চাইছেনা! তিনি আর কথা বাড়ালেননা। ফোন করলেন বড় ভাইয়ের কাছে। তাকে সবকিছু জানালেন। সব শুনে তার বড় ভাই তাকে নিজের বাসায় রাখতে চাইলেননা। তিনি কষ্ট সামলে ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বললেন। তার ছোট ভাই রাজি থাকলেও, ভাইয়ের বউ স্রেফ না করে দিল। আবারও কাঁদলেন আইভি রহমান। ভাইদের জন্য তিনি জীবনে কি করেননি? বড় ভাইয়ের চাকরির আগ পর্যন্ত তার সকল খরচ মিনহাজ রহমান দিয়েছেন। তিনি ব্যবসার জন্য পনের লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন বড় ভাইকে। আজ সেই বড় ভাই তাকে বাড়িতে রাখতে চাইছেনা। আর ছোট ভাইয়ের জন্য তিনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেছেন। তার পড়াশোনার খরচ থেকে শুরু করে সব খরচ দিয়েছেন তিনি। এমনকি বিদেশে পড়তেও পাঠিয়েছেন তাকে নিজের খরচেই। আজ ভাইরা তাদের আসল রূপ দেখিয়ে দিল। তিনি রাস্তার মাঝখানেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
মা’কে কাঁদতে দেখে যারপরনাই বিরক্ত হল মৃদুল। সেই অবস্থায়ই আইভি রহমানকে রেখে নিজের গন্তব্যে চলে গেল।
একদিকে ছেলের চলে যাওয়া, অপরদিকে ভাইদের দেয়া আঘাত মেনে নিতে পারলেননা আইভি রহমান। চিরতরে তাদের মন থেকে মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর চোখ মুছে ফোন দিলেন ছোট বোনকে। কিন্তু ছোট বোনও তাকে অবাক করে দিয়ে নিজের বাসায় বোনকে রাখতে চাইলনা। অন্য দুই বোনও নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করল। নিজের আপনজনদের বিশ্বাসঘাতকতায় কাঁদতেও ভুলে গেলেন আইভি রহমান। ইতোমধ্যে তার দেখা হল ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবীর সাথে। সেই বান্ধবীই তাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল।
***
কোর্টে হাজিরা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে মৃদুল ধাক্কা খায় হঠাৎই। সে আজকাল গাড়িতে যাতায়াত করেনা। মামলার খরচ চালিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া, নিজের খরচ দেবার পর গাড়ি রাখার মত সামর্থ তার নেই। তাই রিক্সা কিংবা অটোরিকশাই ওর সম্বল। তবে আজকে কোর্ট থেকে বেরিয়ে রিক্সা না নিয়ে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিছুদূর হেঁটে যেতেই ধাক্কা খায় কারও সাথে। হুমড়ি খেয়ে পরেও যায়। কিন্তু উঠার আগেই একটা শক্তপোক্ত হাত ওর শার্টের কলার ধরে টেনে তুলল। সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দিল মৃদুলের গালে। হিসহিসিয়ে বলল,
” কি রে রাস্তায় হাঁটার সময় চোখ বাসায় রেখে আসিস নাকি? এতবড় রাস্তা থাকতে তুই আমার শরীরে এসে হুমড়ি খেয়ে পরলি কেন? ”
আগন্তুকের এহেন আচরণে বেশ অবাক হয়েছে। সভয়ে উল্টো প্রশ্ন করল আগন্তুককে,
” আপনি অযথাই আমার ওপর রাগ করছেন। আমি রাস্তার একপাশ দিয়েই হাঁটছি। আপনাকে ধাক্কা দেইনি, বরং আপনিই আমার শরীরে এসে পরেছেন। ”
” আমাকে কি তোর মত অন্ধ মনে করেছিস? নাকি মাতাল ভেবেছিস আমাকে? আমি কেন তোর শরীরে গিয়ে পরব? এক মিনিট, তুই কি আমাকে গে ভেবে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলি? ”
” এই ভাই, না আমি গে নই। আমার গার্লফ্রেন্ড, বউ দুটোই আছে। ”
” তবে শালা, তুই নিশ্চয়ই লুচু। আ’ম ড্যাম শিওর। তুই আমাকে টাচ করলি কেন? শালার, শেষ পর্যন্ত একটা লুচু আমাকে টাচ করল? এত সাহস কোথায় পেলি? ঘরে বউ রেখে পরকীয়া করিস তোর লজ্জা করেনা, মাদারবোর্ড? ” আচমকাই আগন্তুক বেধরক পেটাতে শুরু করল মৃদুলকে।
মৃদুল আগন্তুকের শক্তির সাথে পেরে উঠলনা। সে এখন পর্যন্ত তার মুখ দেখতে পায়নি। মাস্ক দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিজেকে। শরীরে চাপিয়েছে হুডি। এই অসময়ে কাউকে হুডিতে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল মৃদুলের।
আশেপাশের লোকজন একজনকে নিগৃহীত হতে দেখে এগিয়ে আসলে আগন্তুকের উগ্র মূর্তি দেখে সাহস হারিয়ে ফেলে।
প্রায় আধাঘন্টা পর মৃদুলকে ছেড়ে দিয়ে আপন গন্তব্যে পা বাড়ায় আগন্তুক। কিছুদূর যাওয়ার পর সে মুখ খুলে ফেলল মাস্ক। এরপর শরীর থেকে খুলল হুডি। ছুঁড়ে ফেলল নর্দমায়। ইংরেজি গান গাইতে গাইতে হেঁটে চলেছে সে।
***
” রাজ্য, তুই এখানে? কেমন আছিস? ” রেষ্টুরেন্টে ঢুকবার সময় রাজ্যকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল পরশ।
পরশকে দেখে থমকায় রাজ্য। অনেকদিন পর ও পরশকে দেখছে। আগে যোগাযোগও ছিল। কিন্তু বিয়ের দিন দেশ ছাড়ার পর আর যোগাযোগ হয়নি দু’জনের। রাজ্য নিজ থেকেই যোগাযোগ করেনি। রাজ্য আবারও পরশের সাথে রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করল।
” এইতো চলছে বেশ। তোর খবর কি বল? শুনলাম ডক্টর হিসেবে খুব নাম করেছিস? ”
” একটু বেশিই শুনেছিস। কতদিন থাকবি দেশে? একদিন বাসায় আয়। দেশে আসিস কিন্তু আমার সাথে যোগাযোগ করিসনা, এভাবেই দূরে সরিয়ে দিলি? অথচ আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম। ” আফসোস করে বলল পরশ।
” কিছু কাজ আছে, সেগুলো শেষ করেই তবে ফিরব। আমি ইচ্ছে করেই তোর সাথে যোগাযোগ করিনা। তোর সামনে কোন মুখে দাঁড়াতাম বল? আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে আমার কারনেই। ”
” দোষ আমাদেরও ছিল। তোর কাছে একবার জিজ্ঞেস করে নিলেই এমন সমস্যার সৃষ্টি হতোনা। আমরা শুধু আমার বোনের সুখ চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম ও ভালো থাকুক। কিন্তু পারলামনা। কেন চলে গিয়েছিলি সেদিন? দাদুর মুখ চেয়ে অন্তত থাকতে পারতিস? তাহলে আজ আমার বোনটার এই দুর্দশা হতোনা। প্রতিবারই ওর ভালো করতে গিয়ে আমরা ওর দুর্দশাই ডেকে এনেছি। ” আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল পরশের গলা। চোখ ভিজে গিয়েছে জলে। পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে কাঁদতে পারলনা।
” আমি ভুল করেছি, দোস্ত। কোন বন্ধনে আটকাতে চাইনি বলেই চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পেখমের পুরো জীবনটাই তছনছ হয়ে যাবে। জানিস, আমি খুব করে চাই মেয়েটার জীবনকে আগের মত সাজিয়ে দিতে? ওর জীবন থেকে ৃ। প্রথমদিন শুধু প্রান্তরকে ডেকেছিল মৃদুল আর ওর মা’য়ের আসল রূপ দেখাতে। এরপর সব ঝামেলা একাই সামলাচ্ছে। ”
” তোর বোনটা বড্ড জিদ্দি, বুঝলি? মাথা মোটা মেয়ের বোঝা উচিত, বিপদে পরিবারের সবাইকে নিজের পাশে দরকার। ”
” খবরদার এই কথা কখনো ওর সামনে বলিসনা। যদি কখনো দেখা হয় আরকি। তবে কিন্তু তোর মুখ থাকবে কিন্তু একটাও দাঁত থাকবেনা। ”
” সেবাও তাকেই করতে হবে। তোর কি মনে হয়, আমার দাঁত ফেলে দিয়ে সে এমনিতেই পার পেয়ে যাবে? তাকে নিজের বন্দীনি না করে এমনিতেই ছেড়ে দেব? ”
” রাজ্য, তুই কি সেটাই বলতে চাচ্ছিস, যেটা আমি ভাবছি? ”
” এত সময় লাগল বুঝতে? এই বুদ্ধি নিয়ে ডক্টর হয়েছিস? ”
” ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিসতো? এখন এমন সিদ্ধান্ত কিন্তু তোর জন্য সুখকর হবেনা। আগেরবার তোর পুরো পরিবার পেখমের পক্ষে ছিল। এখন কিন্তু সেটা হবেনা। আর তোর হয়ে আমরাও পেখমের সাথে কোন কথাই বলতে পারবনা। ইনফ্যাক্ট আমাদের পুরো পরিবারই এই বিষয়ে নিশ্চুপ থাকবে এটা নিশ্চিত থাক। আমরা পেখমের জীবন নিয়ে আর কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবনা, সেটা পেখম আমাদের পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই যা করবি চিন্তাভাবনা করে করবি। ”
” কুল, ম্যান। এসব নিয়ে তোদের ভাবতে হবেনা। তোরা শুধু দেখে যাবি। আর তোর বোনকে বলে দিস, এটাই তার জীবনের শেষ কান্না। এরপর থেকে ওকে আর কাঁদতে দেবোনা আমি। ”
” কি খাবি বল? তুই কি এখনো ক্রিম কফি খাস? এরা কিন্তু বেশ ক্রিম কফি বানায়। ”
” যেখানে ঘুষ দেবার কথা আমার, সেখানে তুই আমাকে ঘুষ সাধছিস! ”
” দোষী ছিলাম আমরা। তাই নিজেদের দোষ হালকা করতেই এতটুকু করতে চাচ্ছি। ”
” তাহলে একটা সিগারেট দে। মনটা ধোঁয়ার জন্য আনচান করছে। ”
” তুই এখনো সিগারেট খাস! শালা তোর হার্টের ক্ষয় শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই। এসব খাওয়া ছেড়ে দে। ”
” বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করছিস, তুই কি বুঝবি আমার মত বউহীনদের জ্বালা? যার বউ নেই, সিগারেটই তার সম্বল। ধোঁয়ায় নিজেকে না পোড়ালে এ জ্বালা কমেনা, বুঝলি? ”
” দোস্ত, সেইদিনগুলো মাঝেমধ্যে ভিষণ মিস করি জানিস? তুই ইউএস এ থেকে আসলেই আমরা আড্ডা দিতাম। মাঝেমধ্যে মেয়েদের দেখতে চলে যেতাম বিভিন্ন জায়গায়। মেয়েদের হলের চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। সুন্দরীদের প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াতে দেখলে কি যে ভালো লাগত। তোর মনে আছে, একবার একটা মেয়েকে তুই চোখ মেরেছিলি? আর মেয়েটা তোকে জুতো দেখিয়েছিল? ” পরশ যেন মেই সময়ে ফিরে গেছে। ও বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
” আর একবার তুই মদ খেয়ে একটা মেয়েকে আই লাই ইউ বলতে গিয়ে নর্দমায় পরেছিলি, সেটা মনে আছে নিশ্চয়ই? তোর বউ জানে? ”
” দোস্ত, এসব কথা মাটি চাপা দে। বউ শুনলে বাপের বাড়ি যাবে চিরতরের জন্য। ” অনুনয় ঝরল পরশের গলায়।
” তাহলে শালা তুইও ভুলে যা আমি কি করেছি। তোর তো একটা বউ আছে। বউয়ের আদর ভালোবাসা পেয়েছিস, এখন সে চলে গেলেও তোর আফসোস থাকার কথা নয়। কিন্তু আমি এখনো পিওর সিঙ্গেল। এখনো পর্যন্ত কোন মেয়েকে একটা চুমুও দিতে পারিনি। আর চুমু পাওয়া তো স্বপ্নের ব্যাপার। বিয়ের পর বউয়ের সামনে যা খুশি বলিস। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, তুই বানিয়ে বললেও আমার বউ কোথাও যাবেনা। ”
” এত বিশ্বাস নিজের ওপর? কাহিনী কি, দোস্ত? আমাকেও বল। কথায় কথায় বউ বাপের বাড়ি চলে যেতে চায়। ”
” শালা বিয়ের আগেই প্রেম করে ভেতরের মাল-মশলা আগেই শেষ করে বসে আছ, তোমার বউ থাকবে কেম্নে? ” রাজ্য আর কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু পরশ ওর মুখ চেপে ধরল। ও জানে রাজ্য একবার মুখ খুললে ওর মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি পরবে।
চলবে…
#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী জামী
নিজের সামনে রাজ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকায় পেখম। এতদিন পর এই লোকটা কোথায় থেকে আসল? ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছিল সে। রাজ্যকে দেখেও দেখলনা। পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেই রাজ্য ওর ধরল। রাজ্য’র এমন
দুঃসাহসিক কাণ্ডে রাগে কাঁপতে শুরু করল পেখমের সর্বাঙ্গ। ঘুরে তাকাল রাজ্যের দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
” আমাকে কি রাস্তার সস্তা মেয়ে মনে হয় আপনার? এভাবে হাত ধরার সাহস পেলেন কোথায়? হাত ছাড়ুন। ”
পেখমের এহেন অভিযোগ শুনে থমকায় রাজ্য। ওর হাতের মুঠো ঢিলে হয়ে আসলেও পেখমের হাত ছাড়লনা। নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলল,
” রাজ্য সব মেয়ের হাত ধরেনা। যার তার হাত ধরার অভ্যাস নেই তার। কেবলমাত্র যে যোগ্য আর অসাধারণ তার হাতই ধরে। আর সেই যোগ্য আর অসাধারণ মেয়ের হাতই জীবনে প্রথমবার ধরেছে সে। তাই এত তাড়াতাড়ি ছাড়ার প্রশ্নই ওঠেনা। ”
পেখম এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল ওদের কেউ তেমন একটা লক্ষ্য করছেনা। যে যার মত চলাফেরা করছে। তবুও পেখমের রাগ কমলনা। নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে।
” আপনি হাত ছাড়বেন, নাকি আমি চেঁচিয়ে লোকজন ডাকব? ” হাত মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলল পেখম। কিন্তু ও যতই মোচড়ামুচড়ি করছে, ততই রাজ্যের হাতের মুঠো শক্ত হচ্ছে।
” ডাকতে পার। আমি আমার বউয়ের হাত ধরে রেখেছি, এতে অসুবিধা কোথায়? ” রাজ্য তাকিয়ে আছে পেখমের চোখের দিকে।
” কিহ? কি বললেন আপনি? বেয়াদব লোক একটা। ” পেখম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
” এখনো কিছু বলিনি। লোকজন ডাকলে বলব, তুমি আমার বউ। ”
” কি চাইছেন আপনি? ” দাঁত কিড়মিড়িয়ে জিজ্ঞেস করল পেখম।
” একেই বলে বুদ্ধিমতি রমনী। ভদ্র মেয়ের মত আমার সাথে যাবে। আমি কিছু কথা বলব সেগুলো মন দিয়ে শুনবে। ”
” মগের মুল্লুক পেয়েছেন? আপনার সাথে আমি যাব! কোন দুঃখে? কে আপনি? আমাকে অর্ডার করার সাহস দিয়েছে কে আপনাকে? ”
” মগের নয়, বল হবু বউয়ের মুল্লুক। আমার সাথে কোন দুঃখে যাবেনা। যাবে সুখে। আমি তোমার উড বি। তাই তোমাকে অর্ডার করতে কোন সাহসের প্রয়োজন নেই আমার। এবার বল ভদ্র মেয়ের মত যাবে, নাকি মাঝ রাস্তায় তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটব আমি? অবশ্য এই মুহূর্তে আমি চাইছিনা তুমি ভদ্র মেয়ের মত আচরণ কর। পুরুষরাও চায় মাঝেমধ্যে তাদের শখের রমনী একটু অবাধ্য হোক। শখের রমনীকে ছোঁয়ার একটা বাহানা খোঁজে তারা সর্বদা। এই মুহূর্তে আমার মনেও আমার শখের রমনীকে ছোঁয়ার সাধ জেগেছে। ”
রাজ্যের চোখমুখে কোন কপটতা দেখলনা পেখম। তার চোখের তারায় নেই কোন ছলনা। তবুও রাজ্যের কথাগুলো পেখমের মন ছুঁতে পারলনা একটুও। ও ভুলতে পারেনা, এই মানুষটাই ওকে জীবনে প্রথমবার বিরহের বেদনায় সিক্ত করেছে। কিন্তু আজ সে কি চাইছে? কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে? সে কি জানেনা, গত একবছরে ওর জীবনে কতশত ঝড় বয়েছে? শতবার ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে গেছে ওর ভেতরটা? এই মুহূর্তে রাজ্যকে অনেককিছু বলতে চাইলেও কিছুই বলা হয়ে উঠলনা। রাজ্যের দৃঢ় চোয়াল দেখে বুঝল, এই মানুষটার বিপরীতে গেলেই, সে যা বলেছে তাই করবে। পাবলিক প্লেসে কোন সিনক্রিয়েট চায়না পেখম।
” কোথায় যেতে হবে? ”
” ভয় পাচ্ছ? ভয় নেই। কোন বদ্ধ জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাবনা। এস। ”
রাজ্য পেখমের হাত ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। ওর পিছুপিছু পেখমও হাঁটছে।
সামনের পার্কের দিকে রাজ্যকে যেতে দেখে স্বস্তি পায় পেখম। এতক্ষণ একটু ভয়ে ভয়ে ছিল সে।
পার্কের মোটামুটি নিরিবিলি জায়গা দেখে সেখানে নিজে বসে পেখমকেও বসতে ইশারা করল রাজ্য। পেখম টু শব্দটি না করে চুপচাপ বসল।
দীর্ঘ সময় ধরে নিরব থাকল রাজ্য। ওর নজর সামনের দীঘির কালচে জলের দিকে। পেখম একবার রাজ্যের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাল একটু দূরে বসা দু’জন প্রৌঢ়ার দিকে। যারা হেসে হেসে কথা বলছে। একজন কথা বললে আরেকজন চুপটি করে শুনছে। বেশ লাগছে দেখতে।
রাজ্য কখন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সেটা লক্ষ্য করেনি পেখম। শুধু হুট করে দুই প্রৌঢ়ার দিক থেকে চোখ ফেরাতেই দেখল রাজ্য ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল সেটা জানেনা সে। কিন্তু সেই দৃষ্টির গভীরতা ঠিকই বুঝেছে।
” এভাবে বোবার মত বসে থাকার জন্য আমাকে নিয়ে এসেছেন? আপনার হয়তো কোন কাজ নেই, কিন্তু ব্যস্ততা আমাকে ঘিরে রেখেছে। কথা না থাকলে বলুন, আমাকে বাসায় যেতে হবে। ”
” বুঝেছি কোলে ওঠার সাধ জেগেছে তোমার। এটা এমন ইনিয়েবিনিয়ে বলার দরকার কি! সোজাসুজি বলে দিলেই আমি কোলে নিতাম। ”
” অসভ্য লোক একটা। ”
” সেই সাথে প্রেমিক পুরুষও। একটার সাথে আরেকটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ”
” কি বলতে চান বলুন। ”
” এত উতলা হচ্ছ কেন? বাসায় গিয়ে কি করবে? ছোটমাকে ফোন করে দাও। বল তোমার যেতে দেরি হবে। ”
” এবার কিন্তু আমি সত্যিই চেঁচাব? আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঠাঁটিয়ে কানের নিচে দেব। ” পেখম রাগে কাঁপছে।
” আজকাল ভিষণ জিদ্দি হয়েছ দেখছি! তবে আমার সেই লাজুকলতা আর নরম কোমল পেখমকেই পছন্দ। ”
” যাতে বারবার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে কোন অসুবিধা না হয়? একবার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েও শান্তি হয়নি বুঝি? ”
” তোমাকে ভাঙতে চাইনি কখনোই। শুধু নিজে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম নিজের সাথে নিজেই পুরো দুনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বুঝতে পারিনি আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তে কারও মন ভাঙ্গতে পারে। তার জীবনটা ওলট-পালট হয়ে যাবে। কিন্তু যখন বুঝলাম, তখন আমি নিজেই প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছি। নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি বারংবার, ঘৃণা করেছি নিজেকে। পরিত্রাণ মেলেনি আজও। তুমি তো জানো, দশ বছর বয়সেই দেশ ছেড়ে ফুপির কাছে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে অহরহ বিয়ে ভাঙ্গতে দেখেছি। অনেক সম্পর্ক শেষ হতে দেখেছি। এসবের জন্য কখনো কাউকে অনুশোচনা করতে দেখিনি। তাই আমি ভেবেছিলাম, আমিও চলে গেলে কারোরই কিছুই যাবে আসবেনা। যদি জানতাম এমন হবে, তাহলে কখনোই যেতামনা। ” ম্লান গলায় বলল রাজ্য।
” এসব বলে এখন লাভ কি? যা ঘটার সেটা ঘটেই গেছে। এসবে এখন আমার কিছুই যায়-আসেনা। আমি ভুলে গেছি সেসব। ”
” ক্ষমা করা যায়না আমাকে? একটা শেষ সুযোগ দেয়া যায়না? আমি কোন অভিযোগের সুযোগ দেবোনা তোমাকে। ”
কাতর গলায় বলল রাজ্য। ওর কণ্ঠের কাতরতা স্পর্শ করল পেখমের হিয়া। কিন্তু পেখম নিজেকে শক্ত রাখল। এতদিন পর এসে মানুষটার বলা কথাগুলো ওকে ভাবাচ্ছে। কেন সে এমন বলছে?
” সুযোগ চাইছেন! সরি। আমার জীবনে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটে গেছে, আমি যা সহ্য করেছি, এরপরও কোন পুরুষকে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আপনি ডেকেছেন, আমি এখানে এসেছি। আপনার কথা শুনেছি। কিন্তু ভবিষ্যতে আর এভাবে আমাকে ডাকবেননা। আমি এসব পছন্দ করিনা। ভালো করে শুনে রাখুন, কোন পুরুষের জন্য আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করতে আমি আর রাজি নই। ”
” পুরুষের জন্য সময় নষ্ট করতে চাওনা! তবে কার জন্য চাও? কোন নারীর জন্য? মাই গুডনেস, তুমি কি লেস…..! এজন্যই দুনিয়ার সকল পুরুষদের অপছন্দের তালিকায় ফেলেছ? ” কথাটা শেষ না করেই পেখমের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল রাজ্য।
পেখম প্রথমে রাজ্যের কথা বুঝতে পারেনি , কিন্তু যখন বুঝতে পারল, লজ্জায় ওর মাথা আপনা-আপনি নিচু হয়ে আসল। এই লোকটা ওকে সরাসরি অপমান করছে! ওর নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে?
” ছিহ্ আপনার চিন্তাভাবনা এত জঘন্য? কি সুখ পাচ্ছেন আমাকে আঘাত করে? আমি শুনেছিলাম আপনি টিচার। একজন শিক্ষকের ভাষা এমন নোংরা হয় সেটা আমার জানা ছিলনা। আপনার মত শিক্ষকের কাছে কোন শিক্ষার্থীই নিরাপদ নয়, এটা কি জানেন? এই আপনি কি আদৌ টিচার? আমার সন্দেহ হচ্ছে। ”
উল্টো তীর নিজের দিকে আসায় ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকল রাজ্য। এই মেয়েটা একটু বেশিই প্রতিবাদী হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে।
” আমার কাছে তুমি ব্যাতীত দুনিয়ার সকলেই নিরাপদ। তাই আমার জন্য না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাব। নেক্সট এ আমার সামনে আসলে মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা কর। নইলে তোমার ঠোঁট দুটো বন্ধ করার উপায় আমার ভালোমত জানা আছে। তবে আপাতত লুচু ট্যাগ শরীরে লাগানোর ইচ্ছে নেই, তাই তুমি বেঁচে গেলে। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বাসায় যাও। ”
রাজ্য আর কিছু না বলে একটা রিক্সা ডেকে পেখমকে উঠতে বলল। পেখম রাজ্যের কর্মকাণ্ডে অবাকই হয়। কিন্তু কিছু না বলে রিক্সায় চড়ে বসল। সারাটা পথ ভাবতে থাকে। তবে কোন সমাধান পায়না।
চলবে…