সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৩১+৩২

0
490

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী জামী

” অনেকদিন হলো তোর সাথে আছি। এবার যে বাড়ি ফিরতে হবে, মা। তাছাড়া তোর দাদু, চাচারাও চাইছে আমি গ্রামে যাই। তারা চাইছে তুইও আমার সাথে যাবি। অনেকদিন তুই গ্রামে যাসনা, আব্বা তোকে দেখতে চাচ্ছে। এছাড়াও পরশ, প্রান্তর বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। ” রাবেয়া সুলতানা মেয়েকে বললেন।

মা’য়ের কথায় তার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল পেখম। একই সাথে রাগ তড়তড়িয়ে মাথায় উঠতে চাইছে।

” আমি কোথাও যাবোনা। তোমার যেতে ইচ্ছে করলে তুমি যেতে পার। আমাকে দেখার ইচ্ছে হলে দাদুই এখানে আসবে। তবুও আমি গ্রামে যাচ্ছিনা। যার ইচ্ছে হবে সে বাড়িতে যাবে, এর মধ্যে আমাকে জড়াচ্ছ কেন? ”

” এসব তুই কি বলছিস, পেখম! তোর ভাই-ভাবী, চাচা-চাচী গ্রামে যাবে, তারা চাইছে তুইও সেখানে যাবি। একসাথে সবাই মিলে কয়টা দিন আনন্দ করবি। বিয়ের পর ঋত প্রথমবার বাবার বাড়িতে আসবে, মেয়েটাও চাচ্ছে তুই বাড়িতে যাবি। এতে তোর এত আপত্তি কিসের? ” রাবেয়া সুলতানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

” তুমি কোন ধাতুতে গড়া, মা? কেন আজীবন ঐ বাড়িতে মাথা নিচু করে পরে থাকলে? হ্যাঁ, মানছি তোমার বাবার বাড়ির কেউ তোমার খোঁজ নেয়নি, তোমার প্রাপ্য অধিকার তোমাকে দেয়নি। যেতেনা সেখানে। তুমি তো অশিক্ষিত নও? হাতের কাজও জানো তুমি। একটা কাজ ঠিকই জুটিয়ে নিতে পারতে। আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে ঠিকই আলাদাভাবে থাকতে পারতে। তবুও কেন ঐ বাড়িতেই থাকতে হলো তোমাকে? তোমার কখনো মনে হয়নি, যে মানুষটা তোমাকে, আমাদের দুই ভাইবোনকে ছুঁড়ে ফেলে নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছে, সেই মানুষের বাড়িতেই থাকা আমাদের শোভা পায়না? চাচী তোমাকে দিনরাত কথা শোনাত, আমাকে, রিশানকে অপমান করত। এসব দেখেও তুমি কেন চুপচাপ থাকতে? পাড়া-প্রতিবেশিদের নানান কটুকথা তুমি নীরবে সয়ে গেছ। শুধু তোমার স্বামী তোমার কাছে নেই বলে? সে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে বলে? তুমি নিজের সাথে সাথে আমাদেরও কষ্ট দিয়েছ, মা। ” বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল পেখম।

রাবেয়া সুলতানা এত বছর পর মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে থমকালেন। বছরের পর বছর ধরে তার মেয়ে যে বুকে কষ্ট চেপে রেখেছে, সেটা তিনি আজ বুঝতে পারছেন। সেই সাথে তার প্রতি পেখমের অভিমানও তিনি ধরতে পারলেন আজ। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন

” তোর সকল অভিযোগ আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছিস, একটা যুবতী মেয়ে সন্তানদের দিয়ে কোথায় যাবে? এই দুনিয়া পুরুষের জন্য যতটা সহজ, নারীদের জন্য ততটাই কঠিন। এখানে পদে পদে মেয়েদের হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। নারীরা যেখানে নিজের ঘরেই নিরাপদ নয়, সেখানে বাহিরের দুনিয়া তো তাদের জন্য দুর্গম প্রান্তরের ন্যায়। যেখানে-সেখানে ওৎ পেতে থাকে মানুষ রূপী কতগুলো হায়েনা। আমিও অনেকবার ভেবেছি, তোদের নিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকব। কিন্তু পরক্ষণেই তোদের কথা ভেবে, নিজের সম্মানের কথা ভেবে সেই পদক্ষেপ আর নিতে পারিনি। তবে ঐ বাড়িতে আমাকে কেউ উপেক্ষা করেনি কখনোই। সবাই ভালোবেসেছে। তবে মেহনাজ সব সময় কটুকথা শোনাত। এটা ওর স্বভাব দোষ। ওর একার অন্যায়ের শাস্তি আমি পুরো পরিবারকে দিতে পারবনা কখনোই। আমাকে খুশি করতে তারা তোর বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তোর দাদু তাকে ত্যাজ্য করেছে। শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসে জন্যই তারা এতবড় একটা কাজ করেছে। সেই পরিবারের মানুষগুলোকে আমি কিভাবে কষ্ট দিতাম তুইই বল? ”

” বুঝেছি মা, তুমি কোনদিনও তাদের বিপক্ষে যাবেনা। ঠিক আছে, তুমি থাক তাদের নিয়ে। এর ভেতর আমাকে জড়াবেনা। রিশান ঐ বাড়িতে আর যাবেনা। ও আমার কাছেই থাকবে। এখন থেকে ওর ভালোমন্দ সবকিছুর সিদ্ধান্ত আমি নেব। আমি চাইনা তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আমার মত রিশানের জীবনও নষ্ট হয়ে যাক। ”

” পেখম! তুই এতটা স্বার্থপর হলি কবে? যে পরিবারের মানুষজন তোকে এতগুলো বছর বুকে আগলে রেখেছে, তোকে বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। আজ তুই তাদেরকেই দোষী করছিস? এত বদলে গেলি কেন? আমি তোর মা। তোর কষ্ট আমি বুঝি। সন্তানের কষ্ট যে মা বোঝেনা, তার মা হওয়ার কোন যোগ্যতাই নেই। আমি স্বীকার করছি, তোর সাথে যা ঘটেছে সেগুলো সুখকর নয়। একজন নারীর জন্য সেটা অপমানজনক আর বেদনার। যা একজন নারীকে সমাজের চোখে ছোট করে দেয়। ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এই ট্রমা থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনা। আমি চাইনা আমার মেয়ে সেই চরম অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাক। আর কেউ থাকুক না থাকুক তোর পাশে আমি আজীবন থাকব। কিন্তু তুই এটা ভাবিসনা যে তোর এই পরিস্থিতির জন্য পরিবারের লোকজন কষ্ট পাচ্ছেনা কিংবা অনুশোচনা করছেনা। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তোর ভালো করতে গিয়ে তারা খারাপটাই করে ফেলেছে। এই যে তুই তাদের সাথে ঠিকমত কথা বলিসনা এতে তারা ভীষণ কষ্ট পায়। তোর চাচারা লজ্জায় তোর সামনে এসে দাঁড়াতে পারছেনা। তোর বড়মা প্রতিনিয়ত সবাইকে দোষারোপ করছে। সেই সাথে নিজেকেও দোষ দিচ্ছে। এসব দেখে তোর দাদু অসুস্থ হয়ে পরেছে। তাদের শাস্তি তারা ইতোমধ্যে পেয়েই গেছে, তুই আর তাদের কি শাস্তি দিবি? ”

” এত ভালো কেন হলে, মা? ভালোমানুষির মূল্য এভ সমাজ তোমাকে কখনো দিয়েছে? একটু কঠোর হলে কি হত? একটু কঠোর হলেই বোধহয় আজ এত বছর স্বামীহীনা দিন কাটাতে হতোনা। সেদিন যদি একটু সাহস দেখাতে, তবে তোমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য যদি তোমার ভাইদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, তবে তোমার প্রাপ্য ঠিকই বুঝে পেতে। ভাসুর-দেবরদের মুখাপেক্ষী হতে হতোনা। আমার জীবনটাও অন্যরকম হত। ” ফুঁপিয়ে কাঁদছে পেখম।

” এই অস্থায়ী জীবনে আমি নিজের জন্য, তোদের জন্য কিছুই চাইনা। অনন্তকালের ঐ জীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি তোদের নিয়ে ভালো থাকতে চাই। তাই এই নশ্বর জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দেইনি কখনোই। নিজেও নির্ভেজাল জীবনযাপন করেছি, তোদেরকেও সেটাই শিখিয়েছি। মনের মধ্যে রাগও পুষে রাখিনি কখনো। সবাইকে ক্ষমা করতে জীবন আমাকে শিখিয়েছে। মনে রাখবি, তুই মানুষকে যেটা দিবি, সেটাই ফেরত পাবি। সম্মান কখনো চেয়ে পাওয়া যায়না, অর্জন করতে হয় নিজ গুণে। যেই সম্মান আমি তোর পরিবার থেকে পাই, সেটা আমার অর্জন। তেমনি আমিও চাই আমার মেয়েও জীবনের প্রতিটা পদে সম্মানিত হোক। অর্জন করুক সেই সম্মান। কিন্তু সেটা যুদ্ধ করে নয়, সেটা অর্জন করতে হবে নিজের উদারতা আর মন-মানসিকতার দ্বারা। মৃদুল তোর অপরাধী, সে তোকে ঠকিয়েছে, তোকে আঘাত করেছে। তুই তাকে শাস্তি দিয়েছিস, আমি তোর পক্ষে ছিলাম। কিন্তু মৃদুল যদি প্রথমেই নিজের কৃতকর্মের জন্য তোর কাছে ক্ষমা চাইত, তোকে তোর প্রাপ্য সম্মান দিত, নিজেকে বদলে ফেলত, তখন তোকে বলতাম ওকে ক্ষমা করে দিতে। কিন্তু ঐ সংসারে তোকে আমি রাখতামনা। কখনো কখনো কারও জীবনে না থেকেও তাকে ক্ষমা করা যায়। আর সেটাই হয় সবথেকে বড় শাস্তি। অভিযুক্ত তার ভুল বুঝতে পারবে, ক্ষমা পাবে, কিন্তু ক্ষমাকারীকে কখনোই পাবেনা। আজীবন তাকে পরাজয়ের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াতে হবে। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে বল? ”

পেখম মন দিয়ে মা’য়ের বলা কথাগুলো শুনছিল। চিরকালই মা’য়ের বাধ্য মেয়ে ছিল সে। তাই আজও মা’য়ের কথার বিপরীতে কিছুই বললনা। ও জানে, ওর মা চিরকালই শান্তির পক্ষে। কোন ঝামেলায় জড়ায়না কখনোই। তাই মা’য়ের সামনে প্রতিবাদ করতে যাওয়া মানেই শান্তির বানী শুনে নিজেকে শান্তনা দেয়া বৈ কিছুই নয়।

” এবার আমাকে কি করতে বল? ” হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল পেখম।

” তুই আমার সাথে বাড়িতে যাবি। কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসবি সেখানে। ”

” তথাস্তু। ” পেখম ভাবলেশহীন গলায় বলল।

” আগামী সপ্তাহে মামলার রায় হলেই আমরা গ্রামে যাব, ঠিক আছে? ”

” হুম। ”

পেখম চিন্তায় আছে রায় নিয়ে। ও চায় মৃদুলের সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হবে, সেটা ও জানেনা। তাই চিন্তাও মাথা থেকে যাচ্ছেনা।

***

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হু হু করে কাঁদছে মৃদুল আর আইভি রহমান। প্রমান তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে যাওয়ায় মৃদুলকে এক বছরের এবং আইভি রহমানকে সাত মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই সাথে জরিমানা করন হয়েছে। জরিমানা ধরা হয়েছে তিন লক্ষ টাকা। সেই সাথে বাতিল হয়েছে তার সার্টিফিকেট।

পেখম কিছুটা দূরে বসে মৃদুল আর ওর মা’য়ের কান্না দেখছে। ওর একটুও খারাপ লাগছেনা। এই মানুষটাকে ও সুযোগ দিয়েছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু সেই সুযোগ সে নেয়নি। মূল্য দেয়নি পেখমের উদারতার, চরম অপমান করেছে পেখমকে। আইভি রহমান ছেলের সাথ দিয়েছেন সব সময়। ন্যায়-অন্যায় বাছবিচার করেননি। আজ তারা তাদের পাপের শাস্তি পেয়েছে। এটা হবারই ছিল। মৃদু হেসে পেখম মা’য়ের হাত ধরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ওদের পিছু পিছু পরশ, প্রান্তরও এসে দাঁড়িয়েছে। পেখম ওদের দেখেও না দেখার ভান করল। আজকাল কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করেনা ওর।

” পেখম, আমরা কাল গ্রামে যাচ্ছি। তুইও আমাদের সাথে যাবি। ” পরশ ধীর গলায় বলল।

” আমি মা’কে নিয়ে দুইদিন পর যাব। ”

” তাহলে আমরাও দুইদিন পরই যাব। একসাথেই যাব সবাই। ”

” তোমরা চলে যেও। আমার কিছু কাজ আছে। সেগুলো শেষ করেই তবে যাব। ”

পরশ বুঝতে পারল পেখম ওদের সাথে যেতে চায়না। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে বোনকে রাগিয়ে দিতে চাইলনা।

একটা রিক্সা ডেকে পেখম মা’কে নিয়ে উঠে বসল।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী জামী

” মা, তুমি কাঁদছ কেন? কি হয়েছে? ” রাবেয়া সুলতানাকে কাঁদতে দেখে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল পেখম।

” আমার ছোট চাচী মারা গেছেন। এখনই জানতে পারলাম। ”

” ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। নানু কোথায় ছিল ? গ্রামের মামার কাছে নাকি চিটাগং? ”

” গ্রামে এসেছিল একমাস আগে। আর মৃত্যুও হয়েছে গ্রামে। ”

” তাহলেতো তোমাকে যেতে হবে। ”

” আমি নয় আমরা সবাই মিলেই যাই। কালতো আমাদের গ্রামে যাওয়ার কথা। আজই আমরা রওনা দেই। চাচীর দাফন হয়ে গেলে নাহয় বাড়িতে যাব। কি বলিস তুই? ”

” হুম এটাও করা যায়। তুমি তাহলে রেডি হও। আমি রিশানকে রেডি হতে বলছি। আমাদের ব্যাগতো গোছানোই আছে। প্রয়োজনিয় কিছু বাদ গেলে তুলে নিতে হবে। ”

একঘন্টক পর পেখম মা’কে নিয়ে নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

***

অনেক বছর পর বাবার গ্রামে পা রাখলেন রাবেয়া সুলতানা। আবেগে তার দুচোখ ভিজে আসল। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাইশটা বছর কেটেছে এই গ্রামে। শৈশব কৈশোরের কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই গ্রামের ধূলিকণায়। দাদা-দাদী, আব্ব-আম্মা, ভাইদের নিয়ে ছিল ভরপুর সংসার। কালের পরিক্রমায় সেগুলো এখন শুধুই স্মৃতিময় অতীত।

অনেক বছর পর কত নিকট আত্মীয়দের সাথে দেখা হল, কথা হল। হল ছোট চাচীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। এই চাচী তার কাছে আরেকটা মা ছিলেন। তার নিজের ভাইয়েরা যখন তার কোন খোঁজ নেয়নি, এই মানুষটাই তার খোঁজ রেখেছেন। তার শ্বশুর বাড়িতে গেছেন। আজ সেই মানুষটাও চলে গেলেন। কেন এমন হয়? যারা মন থেকে ভালোবাসে, যারা দ্বায়িত্ব পালন করে, ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে, তারা কেন হারিয়ে যায়?

রাবেয়া সুলতানা তার ভাইদের দেখলেন কিন্তু কথা বলতে এগিয়ে গেলেননা। সিদ্ধান্ত নিলেন সামনাসামনি পরলেই তবে তাদের সাথে কথা বলবেন, তার আগে নয়।

” রাবেয়া, তুমিও এসেছ দেখছি ? কেমন আছ? ” রাবেয়া সুলতানার বড় ভাইয়ের বউ জিজ্ঞেস করলেন।

” আমার মাতৃসমা চাচী মারা গেছেন আর আমি আসবনা! ”

” আর কে কে এসেছে তোমার সাথে? নাকি শ্বশুর বাড়ির লোকজন তোমাকে একাই পাঠিয়েছে? ”

” আমার সাথে আমার ছেলেমেয়েরাও এসেছে। এছাড়াও আমার শ্বশুর, ভাসুর, বড় জা এসেছে। ”

” তোমার ছেলেমেয়েরা কোথায়? ”

রাবেয়া সুলতানা পেখম রিশানকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন।

” এই যে আমার ছেলেমেয়ে। ”

পেখম, রিশান কেউই তাদের মামীকে চিনতে পারলনা। খুব ছোটবেলায় তারা মামা-মামীকে দেখেছে। তাই তাদের চেহারাও মনে নেই। পেখম, রিশান মা’য়ের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিল। কিন্তু রাবেয়া সুলতানা তাদের আগ্রহকে পাত্তা দিলেননা।

” ওমা, তোমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে দেখছি? মেয়েকে কি পড়াশোনা করাচ্ছ নাকি ঘরে বসিয়ে রেখেছ? ”

ভাবীর গলায় বিদ্রুপের আভাস পেলেন রাবেয়া সুলতানা। তিনি মনে মনে প্রস্তুত হলেন সকল বিদ্রুপের জবাব দিতে।

” পেখম বুয়েটে পড়ছে। রিশান এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। আমার মেয়ে এসএসসি, এইচএসসি তে দেশ সেরাদের একজন হয়েছিল। রিশানও এই পর্যন্ত কখনো সেকেন্ড হয়নি। ”

রাবেয়া সুলতানার কথায় বেশ চমকায় তার বড় ভাবী। সে এমনটা শোনার আশা করেনি।

” রাবেয়া, এসেছিস? কেমন আছিস? এরা নিশ্চয়ই পেখম আর রিশান? ” তাদের কথার মাঝেই হঠাৎই উদয় হলেন রাবেয়া সুলতানার বড় ভাই। রাবেয়া সুলতানা বড় ভাইকে দেখেও নিরুত্তাপ রইলেন। কোন উৎসাহ দেখালেননা।

” চাচী মারা গেছে, আর আমি আসবনা এটা তো হতে পারেনা। আব্বা-আম্মার মৃত্যুর পর তিনিই আমার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন। আমার আরেকটা মা হয়ে এত বছর আমাকে আগলে রেখেছিলেন। ”

রাবেয়া সুলতানার কথায় চুপসে গেলেন তার বড় ভাই। তবে তিনি লজ্জিত হলেননা মোটেও।

” আমাকে চিনতে পেরেছ তোমরা? আমি তোমাদের বড় মামা। আর এ তোমাদের বড় মামী। ”

” ওহ্। ভালো আছেন আপনারা? ” পেখম এতটুকুই জিজ্ঞেস করল।

” ভালো আছি। তুমি পড়াশোনা করছ? ”

” হুম। বুয়েটে আছি। ”

” বাহ্। তুমিতো খুব ভালো স্টুডেন্ট দেখছি! ”

” আপনার ছেলেমেয়েরা কি করছে ? বিয়ে দিয়েছেন ওদের? ” জিজ্ঞেস করলেন রাবেয়া সুলতানা।

এবার থমকানোর পালা তার বড় ভাইয়ের। কারন তার ছেলেমেয়েরা কেউই কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট করে ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারেনি। তার তিনজন ছেলেমেয়ের মধ্যে দুইজন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছে। আর একজন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। দু’জন ইতোমধ্যে বিয়েও করেছে। তা-ও পালিয়ে। তিনি মুখ কাঁচুমাচু করে উত্তর দিলেন,

” মীরা আর রিহাম প্রাইভেট ভার্সিটিতে আছে। আর জিসান ব্যবসা করছে। ”

রাবেয়া সুলতানা সবটাই জানেন তাই কিছুই বললেননা।

” তুমি কি আজ এখানে থাকবে, রাবেয়া? নাকি শ্বশুর, ভাসুরের সাথে বাড়িতে যাবে? ” রাবেয়া সুলতানার ভাবী জিজ্ঞেস করল।

” এর উত্তর কি দেয়া খুব জরুরী? আমি যদিও এখানে থাকি, তবে আপনাদের কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আপনাদের কোন খরচ করতে হবেনা এটা নিশ্চিত থাকুন। আমার শ্বশুর তার পুত্রবধূকে বোঝা করবেননা কারও নিকট। এতগুলো বছর তিনি আমাদের দ্বায়িত্ব নিঃসংকোচে পালন করেছেন, এই একটা দিনও করতে পারবেন। তিনি আপনাদের মত বেইমান নন। ” আজ সুযোগ হাতছাড়া করলেননা রাবেয়া সুলতানা।

” তুমি কি আমার সাথে ঝগড়া করতেই এখানে এসেছ? কাকে বেইমান বলছ তুমি? কার এত দায় পরেছে তোমার সাথে বেইমানী করার? যতসব উটকো ঝামেলা এসে জুটেছে। আমার জীবনটা জ্বালিয়ে খেল। ” খেঁকিয়ে উঠল রাবেয়া সুলতানার ভাবী।

” কাকে উটকো ঝামেলা বলছ তুমি? তোমার বিয়ের আগেই আমার বিয়ে হয়েছে। আমার কোনও দ্বায়িত্ব তোমাকে পালন করতে হয়েছে? বিয়ের পর থেকেই বাহিরে থেকেছ, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কোন দ্বায়িত্ব পালন করেছ কখনো? কখনো শ্বাশুড়িকে একমুঠো ভাত রান্না করে খাইয়েছ? নাকি শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে কখনো নায়র নিয়ে এসেছ? যখন আমার ছেলেমেয়েসহ আমাকে রেখে তাদের বাবা বাড়ি ছাড়ল, তখন কোন খোঁজ নিয়েছিলে আমার? একবারও ফোন করেছ? কখনো জানতে চেয়েছ, আমি কি করছি, ছেলেমেয়েদের কিভাবে মানুষ করছি? এসব কিছুই না করে উল্টো আমার সব সম্পত্তি গ্রাস করেছ সবাই মিলে। আব্বা আমার জন্য বিশ লাখ টাকা রেখেছিল সেটাও ফুঁসলে আব্বার কাছ থেকে নিয়েছ। আমি ত্রিশ বিঘার মত জমিজমা পেতাম সেগুলোও দিলেনা। আবার এসেছ বড়বড় কথা বলতে? ”

” রাবেয়া, বড় ভাবীর সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা তোর জানা নেই? মানুষকে সম্মান করতে ভুলে গেছিস? তোর মুখে এত বড় বড় কথা মানায়না। নিজের স্বামীকেই যেখানে ধরে রাখতে পারিসনি, সেখানে তোর এত তেজ কিসের? ”

বড় মামার নোংরা কথা শুনে চুপ থাকতে পারলনা পেখম। সে মা’য়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

” অনেক বলেছেন, আর নয়। আমার মা কি আপনাদের সাথে যেচে কথা বলতে এসেছিল? আপনারাই এসেছেন কথা বলতে, আবার আপনারাই আজেবাজে কথা বলছেন!সৈয়দ সানোয়ার হোসেন তার স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে গিয়েছিল নিজের ইচ্ছেতে। এখানে আমার মা’য়ের করার কিছুই ছিলনা। সে তার পূর্ব প্রেমিকার সাথে সংসার পেতেছে, এখানে আমার মা’য়ের দোষ কোথায়? আপনারা বোনের বিয়ে দেয়ার আগে খোঁজ নিয়েছিলেন? নিলেই জানতে পারতেন, সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের একটা প্রেমিকা ছিল। যে তার কাছে ওয়াদাবদ্ধ ছিল। নিজের হাতে আমার মা’কে আপনারা ধরে বেঁধে একজনের হাতে তুলে দিলেন কিন্তু কোন খোঁজ নিলেননা! কিভাবে পারলেন? নানা ভাই অসুস্থ ছিল বলে তাড়াহুড়ো করে বোনকে বিদায় করলেন, তার জীবনটা নষ্ট করলেন, আবার গলার জোরও দেখাচ্ছেন? ভুলে যাবেননা, আমার মা যদি একবার আইনের দারস্থ হয়, তবে আপনারা কেউই পার পাবেননা। সে আপনাদের মত অভদ্র, বেইমান নয় জন্যই এতগুলো বছর মুখ বুজে সব সহ্য করেছে। নয়তো আপনাদের জেলে থাকার কথা ছিল এতদিন। সব প্রমান কিন্তু এখনো আমার মা’য়ের কাছে আছে। ”

” পরী বুবু, কি হয়েছে তোমার? এত রাগ করছ কেন? এদের সাথে কি এত কথা তোমার? বউমা, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে অযথা সময় নষ্ট করছ কেন! তোমার আব্বা-আম্মা নেইতো কি হয়েছে? আমি কি মরে গেছি? আমি কি তোমাকে নিজের মেয়ের মত করে বুকে আগলে রাখিনি? তোমার প্রাপ্য তোমাকে দেইনি? তবুও এত আফসোস করছ কেন? মনে রেখ, তোমার এই বাবা এখনো দুনিয়ার বুকে আছে। চলে এস। আমাদের বাড়িতে যাবার সময় হয়েছে। ”

রাবেয়া সুলতানা আর কোন কথা না বলে শ্বশুরের সাথে বাড়ির ভেতরে গেলেন।

***

” রাজ্য, তোর কি কোন সমস্যা হয়েছে? আমাকে খুলে বল সবকিছু, কিছুই লুকাবিনা বলে দিলাম। ” রাজিয়া পারভীন রাজ্যের চুলে বিলি কেটে বললেন।

” তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে, আম্মু? আমার কোন সমস্যা হবে আর তুমি জানবেনা এটা কি হতে পারে? ”

” কথা ঘুরাবিনা বলে দিলাম। তুই দেশে এসেছিস ছয় মাসের বেশি হয়েছে। অরবিন্দ বারবার তোকে ডাকছে কিন্তু তুই যাচ্ছিসনা। কোনও ভার্সিটির শিক্ষকের ছুটি এতদিন থাকে সেটা আমার জানা নেই। তুই কি ভার্সিটির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস? দিনের পর দিন ঢাকা থাকিস কেন? কি কাজ সেখানে? আজ আমার কাছে কিছুই লুকাবিনা বলে দিলাম। ”

” আমি আরও কিছুদিন দেশে থাকলে কোন সমস্যা হবে, আম্মু? আমি দুই মাসের ছুটিতে দেশে এসেছিলাম। তবে পরবর্তীতে ভার্সিটিতে ইমেইল করেছি। তাদের জানিয়ে দিয়েছি, আমি আগামী কয়েকমাস ক্লাস নিতে পারবনা। তারা যদি আমাকে ভার্সিটিতে রাখতে চায় আমি থাকব, নয়তো এখানকার ঝামেলা থেকে মুক্ত হলেই নতুন করে কোথাও এ্যাপ্লাই করব। তারা আমাকে আরও কিছুদিন সময় দিয়েছে। আমার জায়গায় টেম্পোরারি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। ”

” ঝামেলা থেকে মুক্ত হলেই, মানে? কোন ঝামেলায় জড়িয়েছিস তুই? কেন মাঝেমধ্যে উদাসীনতা ভর করে তোর ওপর? কেন হুটহাট তোর মন খারাপ হয়ে যায়? আর কেনইবা দিনদিন তুই এত রোগা হয়ে যাচ্ছিস? আমাকে সবটা বল, বাপ। তোর মুখের দিকে তাকালে আমার বুকটা ফেটে যায়। তোর মলিন মুখ আমার দেখতে কষ্ট হয়। ”

রাজ্য মা’য়ের কোলে মাথা রাখল। চুপচাপ অনুভব করছে মা’য়ের আদর। সেই সাথে প্রস্তুতি নিচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার।

” আমি পেখমকে বিয়ে করতে চাই, আম্মু। আশা করব তোমাদের কোন আপত্তি থাকবেনা এতে। আমার অতীতে করা ভুলের মাশুল আমি দিতে চাই। ”

” কিহ্! পেখমকে বিয়ে করবি! তবে সেদিন কেন চলে গিয়েছিলি? সত্যি করে বল, কি চাইছিস তুই? ” রাজিয়া পারভীন সত্যিই অবাক হয়ে গেছেন।

” আমি শুধু পেখমকে চাই। আর কিছুই নয়। সেদিন চলে গিয়েছিলাম, ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে সেসব না ভেবে। সেজন্য আমি লজ্জিত। এবার তোমার মত জানতে চাইছি আমি। তুমি পাশে থাকলে, তোমার দোয়া থাকলে আর কিছুই লাগবেনা আমার। ”

” আমি সব সময়ই চেয়েছি পেখম আমার পুত্রবধূ হোক। ওর মত মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখনো চাই। কিন্তু আমি আমার ছেলের মতিগতি বিশ্বাস করতে পারছিনা। সে একবার পেখমের সাথে যে অন্যায় করেছে, ভবিষ্যতে যে করবেনা তার নিশ্চয়তা কি? ”

” তুমি মা হয়ে যদি নিজের ছেলেকে অবিশ্বাস কর, তবে তাবৎ দুনিয়ার মানুষ তো করবেই। আমি আমার ভুল স্বীকার করেই পেখমকে চাইছি আমার জীবনে। একই ভুল বারবার কোন সুস্থ মানুষ করতে পারেনা। আমাকে যদি তোমার সুস্থ মানুষ বলে মনে হয় তবে তুমি আব্বুর সাথে কথা বল। আমি ইউএস যাওয়ার আগেই পেখমকে নিজের করে পেতে চাই। যদি কেউ রাজি না থাকে, তবেও কোন সমস্যা নেই। প্রয়োজনে আমি ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। ”

” থাক হয়েছে। কাউকে তুলে নিয়ে যেতে হবেনা তোর। আমি তোর আব্বুর সাথে কথা বলে সরাসরি পেখমের সাথে কথা বলব। এইবার আমি আর কাউকেই এসবের ভেতর জড়াবোনা। তবে একটা কথা, পেখম রাজি না থাকলে কিন্তু তুই জোর করতে পারবিনা? ”

” তোমার শেষের কথাটা আমি কোনদিনও মানতে পারবনা। যত তাড়াতাড়ি পার পেখমের সাথে কথা বল। ”

রাজ্য ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাজিয়া পারভীন ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকলেন গমনরত ছেলের দিকে। এ যেন এক অচেনা ছেলেকে তিনি দেখছেন।

চলবে…