সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৩৩+৩৪

0
394

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী জামী

” এসব আপনি কি বলছেন, ভাবী! রাজ্য পেখমকে বিয়ে করতে চায়! কিন্তু কেন? ” রাবেয়া সুলতানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

রাজিয়া পারভীন কি উত্তর দেবেন ভেবে পাননা। সত্যি বলতে কি রাজ্যের কথাবার্তা তারও বোধগম্য হয়নি। তিনি ছেলের মন কিছুতেই বুঝতে পারছেননা। ছেলের মতিগতিও তার বোধগম্য হচ্ছেনা। তবুও তাকে এই মুহূর্তে রাবেয়া সুলতানার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তিনি ভেবেচিন্তে মুখ খুললেন।

” রাজ্য পেখমকে ভালোবাসে। সেজন্যই ওকে বিয়ে করতে চাইছে। ”

” তবে সেদিন কেন বিয়ে না করেই চলে গেল! আমার মেয়েটাকে কেন অপমান করল? ”

” এসবের কোন উত্তরই আমার কাছে নেই, রাবেয়া। রাজ্য আমাকে বলেছে, যেকোন মূল্যেই ও পেখমকে বিয়ে করতে চায়। আমরা কেউ না মানলে ও পেখমকে তুলে নিয়ে যাবে। ওর কথা শুনে আমার ভয় হচ্ছে। না জানি কি থেকে কি হয়ে যায়। আমিও পেখমকে সব সময়ই পুত্রবধূ হিসেবে চেয়েছি, এমনকি এখনো চাই। কিন্তু কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে সেটা ঘটুক তা চাইনা। আমি চাইনা ওর কোন ভুলভাল সিদ্ধান্তের জন্য দুই পরিবারের সম্পর্কে আবারও ফাটল ধরে। ”

” আমি এতকিছু জানিনা, ভাবি। আমি শুধু আমার মেয়ের কথা চিন্তা করছি। আমাদের ভুলের জন্য মেয়েটা শাস্তি পাচ্ছে। ওর এই দুর্দশার জন্য দায়ী আমরাই। মেয়েটা আবারও নতুন করে শাস্তি পাক সেটা আমি হতে দেবোনা। প্রয়োজনে আমি রাজ্যের সাথে কথা বলব। তবুও সমাজের চোখে মেয়েটাকে আমি অপমানিত হতে দেবোনা, কষ্ট পেতে দেবোনা। ”

” আমরাতো মা, আর মা’য়েরাই সন্তানের দুঃখ-কষ্টে বেশি পীড়িত হয়। তুমি যেমন তোমার মেয়ের ভালো চাও, সুখ চাও। তেমনি আমিও আমার ছেলের ভালোটাই চাই। দু’জনের চাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তবুও আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেটাকে শেষ একটা সুযোগ দাও। এবার ওর হয়ে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, রাজ্যকে আর কোন ভুল করতে আমি দেবোনা। তুমি বললে আমি পেখমের সাথে কথা বলব। ” অনুরোধ করলেন রাজিয়া পারভীন।

” আমি এই বিষয়ে কিছুই বলতে চাইনা, ভাবী। না কোন মতামত দিতে চাই। আমি চাই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত পেখমই নিক। আমার মেয়েটা কম কষ্ট পায়নি। নতুনভাবে ওকে কোন কষ্ট দিতে চাইনা আমি। ”

” ঠিক আছে, তোমাকে কিছুই করতে হবেনা। মা হয়ে তুমি তোমার মেয়ের জন্য চিন্তা করবে এটাই স্বাভাবিক। আমিই রাজ্যের সাথে কথা বলব। কিন্তু তোমার কাছে একটাই অনুরোধ করব, যা-ই ঘটুকনা কেন, তুমি রাজ্যকে ভুল বুঝোনা। ওকে একটা সুযোগ দিও। আমি আবারও বলছি, পেখমকে আমি পুত্রবধূ হিসেবে পেতে চাই। আমি চাই ওরা দু’জনেই ভালো থাকুক। মেয়েটার সকল কষ্টে কেউ একজন সুখের প্রলেপ লাগাক। আর সেই একজন রাজ্য হলে ক্ষতি কি? সে-ই তো পেখমের সকল কষ্টের গুরুঠাকুর। যার দ্বারা মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে, হোকনা সে-ই তার সকল সুখের কারন। ”

রাবেয়া সুলতানা নিরবে সবটা শুনলেন। তিনি রাজিয়া পারভীনের কথার পিঠে কোন কথাই বললেননা। তবে তিনি পেখমের পাশে থাকবেন। আর রাজ্যের সাথেও দেখা করবেন।

***

সকাল সকাল সৈয়দ বাড়ির সকলেই হৈ হুল্লোড়ে মেতেছেন। পারভীন আক্তার পিঠা বানাচ্ছেন। উঠানের কোনের রান্নাঘরটি শুধুমাত্র বাড়ির সবাই গ্রামের আসলেই ব্যবহার করা হয়। মাটির চুলায় সবার জন্য খাবার রান্না করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি আর রাবেয়া সুলতানা। রাবেয়া সুলতানা, মেহনাজ তাকে সাহায্য করছে। সৈয়দ রাশেদ আহমেদের স্ত্রী সাফিয়া সকলকে পিঠা পরিবেশন করছে। ছেলেরা সবাই উঠানে মাদুর পেতে বসেছে। পরশের স্ত্রী বৃষ্টি , প্রান্তরের স্ত্রী মেহরিন শ্বাশুড়িকে কাজে সাহায্য করছে।

সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ভাতিজা-ভাতিজী, নাতি-নাতনীদের নিজের চারপাশে বসিয়ে রেখে তাদের সাথে খুনসুটি করছেন। রাকিব আহমেদ, রাশেদ আহমেদও তাদের সাথেই খুনসুটি করছেন। তাদের পাশে বসে সবকিছু দাঁত কেলিয়ে দেখছে কানন। শ্বশুর বাড়িতে তার আপ্যায়ন নেহাৎই মন্দ হচ্ছেনা। যদিওবা মেহনাজ তাকে এখনো দু’চোখে দেখতে পারছেনা। কিন্তু বাকি সকলেই কাননকে যথাযোগ্য জামাইয়ের মর্যাদা দিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক চেয়ারে বসে সবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন। তার পরিপূর্ণ সংসারে হয়তো কিছু ত্রুটি-বিচ্চুতি আছে, কিন্তু তারপরও দিনশেষে এরা সবাই সুখী।

উঠানে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসল রাবেয়া সুলতানা’র। এ বাড়ির সব ছেলেমেয়েই তাদের বাবাকে নিজেদের পাশে পায়। বিপদেআপদে সব বাবাই তাদের ছেলেমেয়ের মাথায় ওপর বটবৃক্ষের ন্যায় ছায়া দিচ্ছে। কিন্তু তার ছেলেমেয়েরা সেই ছোটবেলা থেকেই বাবা’র আদর, স্নেহ থেকে বঞ্চিত। বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন, তার স্বামী অন্য কাউকে মন দিয়েছেন অনেক আগেই। সে কখনোই স্ত্রী’কে ভালোবাসেননি। চাকরির অযুহাতে বিভিন্ন জায়গায় দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। ছুটিছাটায় গ্রামের বাড়িতে আসলে জৈবিক তাড়নায় স্ত্রী’র নিকটে গেছেন মাত্র। তাই তাদের মধ্যে মানসিক বন্ধন তৈরী হয়নি কখনোই। যতটুকু সম্পর্ক ছিল, সেটাও শুধুমাত্র শারীরিক। আর এই সম্পর্কের জেরেই রাবেয়া সুলতানা জন্ম দিলেন দুটি সন্তানের। কিন্তু একদিন তার স্বামীও ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে স্ত্রী-সন্তানদের ছাড়লেন। খবরটা শুনে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন স্বামীর কাছে। কিন্তু তার স্ত্রী চরম অপমান করে তাড়িয়ে দিল রাবেয়া সুলতানাকে। সৈয়দ সানোয়ার হোসেন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখলেন প্রথম স্ত্রী’র অপমান। কোন প্রতিবাদ করলেননা। লজ্জায়, অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল রাবেয়া সুলতানার। কিন্তু সন্তানদের কথা চিন্তা করে তিনি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সেদিন। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক যখন জানতে পারলেন, তার ছেলেকে বোঝালেন, ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। কিন্তু সৈয়দ সানোয়ার হোসেন কিছুতেই শুনলেননা। রাগে-দুঃখে সৈয়দ শামসুল হক ছেলেকে ত্যাজ্য করলেন। নিজের সকল সম্পত্তি থেকে ছেলেকে বঞ্চিত করলেন। সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের সকল সম্পদ তিনি তার ছেলেমেয়ের নামে লিখে দিলেন। সেই সাথে ব্যাংকে টাকা রাখলেন পেখম, রিশানের নামে। রাবেয়া সুলতানাকেও নিজের সম্পত্তির কিছু অংশ লিখে দিলেন। অসহায় তিনজন মানুষকে আগলে রাখলেন। তবুও মাঝেমধ্যে রাবেয়া সুলতানা’র বুকে হাহাকার করে। সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে তার দম বন্ধ হয়ে আসে। ইচ্ছে করে কোথাও গিয়ে নিজের দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাক। কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গা তার নেই। আব্বা-আম্মার মৃত্যুর সাথে সাথে ভাইরাও তাকে পর করে দিয়েছে। তার সকল দুঃখে-কষ্টে তিনি এই সৈয়দ বাড়ির মাটি কামড়ে পরে থেকেছেন এতকাল। বাকি জীবনটাও হয়তো সেভাবেই কাটবে।

” রাবেয়া, এই রাবেয়া, কি এত ভাবছিস? ” পারভীন আক্তারের ডাকে চমকে উঠলেন রাবেয়া সুলতানা। চোখ মুছে তাকালেন বড় জা’য়ের দিকে। তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন পারভীন আক্তার।

” কিছু লাগবে, ভাবী? ”

পারভীন আক্তার বেশ বুঝতে পারছেন রাবেয়ার কি হয়েছে। তিনি জানেন এই মানুষটা কত কষ্টে দিনাতিপাত করে। কত কষ্ট জমা রয়েছে তার বুকের মাঝে। তবে তিনি এই মুহূর্তে রাবেয়া সুলতানাকে সেসবের কিছুই বললেননা। মৃদু হাসলেন।

” নতুন জামাই আছে বাড়িতে। সে কি কি পিঠা খেতে পছন্দ করে সেটা ঋতের কাছ থেকে শুনে নে। ”

” বড় ভাবী, জামাইয়ের পছন্দকে এত প্রাধান্য দিতে হবে কেন? সে কোন লাটের পুত্র, যে তার পছন্দের খাবার, পিঠা করতে হবে? বাড়িতে আরও ছেলে আছে, তাদের পছন্দের খাবার রান্না করেন। পেখম এসেছে অনেকদিন পর, ওর পছন্দের খাবার রান্না করলে কি ক্ষতি হয়ে যাবে? ” মেহনাজ রেগে উঠল।

” মেহনাজ, এসব কি কথা? কানন তোর মেয়ের স্বামী। কোথায় তুই দেখেশুনে ওর পছন্দের খাবার রান্না করবি। কিন্তু সেটা না করে রাগারাগি করছিস। কানন লাটেরই ছেলে। বেশি কথা না বলে এগুলো নিয়ে সাফিয়াকে দে। ”

মেহনাজ বরাবরই পারভীন আক্তারকে ভয় পায়, তাই বড় জা’য়ের মুখে তর্ক করার সাহস পেলোনা। নিরবে জা’য়ের নির্দেশ পালন করতে লাগল।

পেখম দাদুর পাশে বসে আছে। দাদুর সাথে টুকটাক কথা বলছে।

” পেখম, এটা খেয়ে বলতো কেমন হয়েছে? ” পেখমের সামনে একটা প্লেট এগিয়ে ধরল মেহনাজ। পেখম দেখল প্লেটে চারটা পাটিসাপটা পিঠা রয়েছে।

মেহনাজের এমন কাজে সবাই হতবাক হয়ে গেল। পেখম বিশ্বাসই করতে পারছেনা চাচী ওর জন্য পিঠা নিয়ে এসেছে। ও হাত বাড়াতেও ভুলে গেছে।

” কি রে তাকিয়ে আছিস কেন? নে খেয়ে দেখ। তোর ভালো লাগলে বড় ভাবীকে আরও কয়েকটা বানাতে বলব। ” পেখমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও কথা বলল মেহনাজ।

” সত্যিই এগুলো আমার জন্য এনেছ, চাচী? ”

” এই বাড়িতে তোরই নাম পেখম, তাইনা? আমি পেখমের জন্যই এনেছি পিঠাগুলো। ”

পেখম তবুও তাকিয়ে রইল।

” কি রে, নিবিনা? আমি তোর জন্য এগুলো এনেছি, বিশ্বাস করতে পারছিসনা বুঝি? সত্যিই এগুলো তোর জন্য এনেছি। দিনশেষে আমি একজন মা। আগে তোকে যতই কথা শোনাইনা কেন, মেয়ে আমারও আছে। ওকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে আমার হুঁশ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অনুধাবন করতে পেরেছি, তুইও কোন মা’য়েরই মেয়ে। তোরও কষ্ট হয়। ”

মেহনাজের কথায় অশ্রুবিন্দু জমা হলো পেখমের চোখের কোনে। সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তবে তাদের অবাক হওয়ার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ রইলনা। হঠাৎই গাড়ির হর্ন তাদের মনযোগে বিঘ্ন ঘটায়।

গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনে সবাই একে-অপরের মুখপানে চাইল। কে আসল? আনোয়ার হোসেনসহ তারা তিন ভাই একযোগে তাকালেন দরজার দিকে।

কিছুক্ষণ পর উঠানের গেইট ঠেলে অতি পরিচিত এক অবয়ব ভেতরে ঢুকল। তাকে দেখে সবাই একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

সৈয়দ শামসুল হক ঝাপসা চোখে দেখলেন ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসা আগন্তুককে। বেশ কিছুক্ষণ পর চিনতে পারলেন তাকে। সাথে সাথেই রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি আঁকড়ে ধরলেন পেখমের হাত।

পেখম তাকিয়ে আছে আগন্তুকের দিকে। স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসা মুখখানা চিনতে পারল। ও ছোট থেকে বেড়ে উঠেছে এই মুখের কয়েকটা ছবি দেখে। যে মানুষটা ওকে, রিশানকে কখনোই ভালোবাসেনি। সেই মানুষটার আজ আবির্ভাব হয়েছে হঠাৎই। আজ একটুও আবেগী হলোনা পেখম। মুহূর্তেই বিদ্রোহ করল সকল আবেগ। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পরল অজানা অনুভূতি। রাগে কাঁপতে থাকল সর্বশরীর।

সুঠামদেহী একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে আসছেন।

রাবেয়া সুলতানা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছেন সেই মানুষটাকে। বহু বছর আগেই যিনি তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিলেন। এত বছর পর তার আগমন ভুমিকম্পের ন্যায়ের ন্যায় কেঁপে উঠল তার পায়ের নিচের মাটি। রান্নাঘরের খুঁটি আঁকড়ে ধরলেন তিনি।

” কেমন আছেন, আব্বা? ” গুরুগম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” কেন এসেছ তুমি? এই বাড়ির দরজা অনেক বছর আগেই বন্ধ হয়েছে তোমার জন্য। সেটা কি ভুলে গেছ তুমি? ” মুখ ফিরিয়ে নিলেন সৈয়দ শামসুল হক।

” কিছুই ভুলিনি আমি। মানুষের মনতো, তাই মাঝেমধ্যেই আপনাদের কথা মনে পড়ে। সেজন্যই এসেছি। ”

” তোমার কথা আমরা ভুলেও মনে করিনা। মনে করার প্রয়োজনবোধও করিনা। যে পথে এসেছ, সেই পথেই বেড়িয়ে যাও এক্ষুণি। ”

আব্বার কথা শুনে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন। এরপর মুখ তুলে চাইলেন তার দিকে।

” চলে যাব, আব্বা। আমাকে দু’টো দিন এই বাড়িতে থাকতে দিন। অনেকদিন আপনাদের সংস্পর্শে ছিলামনা, মনটা বড্ড উচাটন হয়ে আছে। আপনাদের সংস্পর্শই কেবল আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারে। ”

ছেলের আকুল আবেদনের কাছে হার মানল সৈয়দ শামসুল হকের পিতৃ সত্তা। তিনি মাথা নেড়ে সায় জানালেন।

” পেখম, তুই ঘরে গিয়ে বস, আমি তোর জন্য পিঠা নিয়ে আসছি। ” পেখমকে উঠে যেতে দেখে মেহনাজ জোর গলায় বলল।

সৈয়দ সানোয়ার হোসেন দেখলেন পেখম নামের মেয়েটি একটা ছেলের হাত ধরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করছে। এত বছর পর পেখমকে চিনতে পারার কথা নয় তার। তিনি এতক্ষণ আব্বার সাথে কথা বলেছেন। কারও মুখের দিকে তাকানোর কথা ভাবেননি। তাই তিনি পেখমের মুখটাও দেখতে পাননি। মেয়ের মুখখানা একনজর দেখার জন্য তার ভেতরে আঁকুপাঁকু করতে থাকে।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী জামী

” মা, ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন? ” পেখম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

পেখমের গলা পেয়ে তার দিকে ফিরে চাইলেন রাবেয়া সুলতানা। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

” এই বাড়িতে থাকার মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাই চলে যাচ্ছি। ”

” কোথায় যাবে, মা? ”

” নিজের ভাইয়েরা জায়গা না দিলে কি হবে, এত বড় পৃথিবীতে আমার মত একজন মানুষের জায়গা ঠিকই হয়ে যাবে দেখিস। ”

” আমারও ব্যাগ গোছানো শেষ। চল দেরি না করে বেরিয়ে পরি। তোমার মেয়ে যথেষ্ট বড় হয়েছে, মা। সে তার মা আর ভাইয়ের দ্বায়িত্ব নিতে পারবে। ”

” তুই কেন যাবি? পাগলামি করিসনা, পেখম। এটা তোর দাদুর বাড়ি। এখানেই তোর আত্মীয়পরিজন থাকে। তাদের কষ্ট দিয়ে তুই কেন যাবি? ”

” তুমি যেকারণে যাচ্ছ, আমিও সেকারণেই যাচ্ছি। ঐ লোকটার মুখোমুখি হওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। ”

” সে তোর বাবা। ”

” তুমি একথা বলছ! সে কি কোনদিনও আমাদের বাবা হতে পেরেছে? শুধুমাত্র সার্টিফিকেটে নাম থাকলেই সে বাবা হয়না। একজন বাবাকে হাজারো দ্বায়িত্ব, কর্তব্য পালন করতে হয়। সন্তানদের ভরসার জায়গা হতে হয়। সন্তানদের বুকে করে রাখতে হয়। সুখে-দুঃখে বটগাছের ন্যায় ছায়া দিতে হয়, আগলে রাখতে হয়। সে এগুলোর মধ্যে কোন দ্বায়িত্বটা পালন করেছে? করেনিতো?, তবে কেন তার উপস্থিতিতে এই বাড়িতে থাকব বলতে পার? ”

” রিশান কিছু বলেছে? ” রাবেয়া সুলতানা ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

” ওর ব্যাগ গোছানোও শেষ। ”

” তবে চল দেরি না করে বেরিয়ে পরি। ”

” কোথায় যাবে, বউমা? আমাকে কি তোমার এতই অবিবেচক আর অকৃতজ্ঞ বলে মনে হয়? আমি আমার মেয়ের মত পুত্রবধূ, নাতি-নাতনীদের কখনো পর করে দিতে পারি বলে তোমার মনে হয়? ” সৈয়দ শামসুল হক এসে দাঁড়ালেন রাবেয়া সুলতানার দরজায়।

শ্বশুরের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন রাবেয়া সুলতানা।

” একথা কেন বলছেন, আব্বা! আমি আপনাকে চিরটাকালই আমার আব্বা বলেই মনে করেছি। কখনো আপনাকে শ্বশুরের চোখে দেখিনি। আপনিই আমার আব্বা। ”

” তবে কেন চলে যেতে চাইছ? সন্তানের প্রতি মমতা প্রত্যেক বাবা-মা’রই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমিও সেই মমতার জোরেই সানোয়ারকে বাড়িতে থাকতে বলেছি। অনেক বছর পর নিজের সন্তানকে সামনে দেখে আবেগ দমিয়ে রাখতে পারিনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি আমার নাতি-নাতনীদের কথা ভাববোনা, তোমার কথা ভাববোনা। ও এসেছে সবার সাথে দেখা হোক, কথা হোক তারপর চলে যাবে। ওকে আমি ত্যাজ্য করেছি, এই বাড়িতে চিরকাল রেখে দেয়ার জন্য তো নয়ই। কিংবা ওর সাথে যোগাযোগ রাখবার জন্যও নয়। ও কি বলতে চায় সেটা শুনেই ওকে বিদায় করব আমি। আমি চিরকালই ন্যায় বিচার করার চেষ্টা করেছি, আজও তাই করব। তোমরা যেওনা, বউমা। পরী বুবু তুমি আমাকে রেখে যেওনা। তুমি, রিশান তোমরা দু’জনই আমার কলিজার একটা অংশ। তোমাদের মুখ চেয়েই আমি বেঁচে থাকার করে ভাবি। ” হু হু করে কেঁদে উঠলেন সৈয়দ শামসুল হক।

শ্বশুরকে কাঁদতে দেখে তার দিকে ছুটে গেলেন রাবেয়া সুলতানা। তার হাতদুটো ধরলেন।

” আপনি কাঁদবেননা, আব্বা। কোথাও যাবোনা আমরা। আপনার ছেলে যে কয়দিন এখানে থাকবে থাকুক। শুধু আমাদের সামনে যেন না আসে, এই অনুরোধ করব আপনাকে। আমি চাইনা তার মুখোমুখি দাঁড়াতে। সে সম্পর্ক ঘুচেছে অনেক আগেই। তার জন্য আমার মনে ছিঁটেফোঁটা অনুভূতিও নেই। সে আমাকে চরমভাবে ঠকিয়েছে। আমার কাছে সে বেইমান বৈ আর কিছুই নয়। ”

” ঠিক আছে, বউমা। তুমি যা বলবে তাই হবে। তোমরা তোমাদের মত থাকবে। কেউ তোমাদের বিরক্ত করবেনা। ”

পেখম মা আর দাদুর কথার মাঝে কোন কথাই বললনা। তবে মা’য়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিল। যদিও এতে তার আপত্তি ছিল। কিন্তু মা’য়ের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাল।

***

” হঠাৎ করেই এত বছর পর তোমার মনে হল পরিবারের কথা? পরিবার বলছি কেন! তুমি কি কখনো আমাদেরকে পরিবারের সদস্য বলে মনে করেছ? তুমি নিজেকে নিয়েই নিজের পরিবার গড়ে তুলেছিলে। ” পারভীন আক্তার কড়া গলায় বললেন। দেবর বলে তিনি সৈয়দ সানোয়ার হোসেনকে একচুলও ছাড় দিলেননা।

” আমি সব সময় তোমাদেরকেই আমার পরিবার ভেবেছি, বড় ভাবী। তোমরা ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতেও পারিনি। আর তাছাড়া আমি তোমাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনি। আব্বাই কিন্তু আমাকে অস্বীকার করেছেন। ত্যাগ করেছেন আমাকে। তোমরাও সেদিন নিরব ছিলে। ” মিনমিন করে বললেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” আজ এতদিন পর এসে, এসব কথা বলতে তোর লজ্জা করছেনা, সানোয়ার? আব্বা তোকে বিনা কারনে ত্যাগ করেছিলেন? আমরা সবাই মিলে কত অনুরোধ করেছি, সেসব তুই ভুলে গেছিস! তুই চাইলেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে পারতিস। কিন্তু তুই স্ত্রী-সন্তানদের বদলে অন্য একটা মেয়েকে বেছে নিয়েছিলি। তুই সব সময়ই নিজেকে নিয়ে ভেবেছিস। স্কুল, কলেজে পড়ার সময় পর্যন্ত তুই এই বাড়ির ছেলে ছিলি। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর তুই বদলে গেছিলি। পর করে দিয়েছিলি সবাইকে। আজ এত বছর পর এসে তুই আব্বাকে দোষারোপ করছিস? কি ভেবেছিস তুই, আব্বা তোকে ক্ষমা করে দিয়েছে বলে, আমরাও তোকে ক্ষমা করে দেব? কক্ষণো না। ” সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেননা। চিরকালের চুপচাপ স্বভাবের মানুষটা হঠাৎই খেঁকিয়ে উঠলেন। তিনি সৈয়দ সানোয়ার হোসেনকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারছেননা।

” কে বলেছে, আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি? ওকে এই বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছি বলেই কি তাকে ক্ষমা করা হয়ে গেছে? ওকে আমি কিছু জিনিস বোঝাতে এই বাড়িতে থাকার অনুমতি দিয়েছি৷ ওর ও বোঝা উচিত, এই পরিবারে ওর মূল্য কতটুকু। পরিবারের লোকজন ওকে কি চোখে দেখে। ওর সন্তানেরা ওকে কতটা সম্মান করে। কান খুলে শুনে রাখ, এই বাড়িতে তুমি শুধুমাত্র দুই দিনের অতিথি। হ্যাঁ, অতিথি। তোমাকে আমি অতিথি ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারছিনা। তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্কই অবশিষ্ট নেই। আমাদের মনে তোমার জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই। যে মানুষ নিজের সন্তানদের তুচ্ছ করে সুখের পথ খোঁজে, আর যাই হোক তাকে আমি নিজের সন্তান বলে মনে করিনা। যেটা বলতে এত বছর পর এখানে এসেছ, সেটা বলে তুমি বিদায় হও। কারন তোমার এখানে আসাতে আমার পরী বুবু আর রিশান দাদাভাই বউমাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে একবাক্যে ত্যাগ করেছি, শুধুমাত্র তাদের জন্য। শুনেছ তুমি, তোমার ছেলেমেয়ে এই বাড়ি ছাড়তে চেয়েছে, শুধুমাত্র তুমি এসেছ জন্য। আর আমার কাছে তোমার চেয়ে তারা বেশি দামী। ” একসাথে এতগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি রাগে কাঁপছেন। তাকে কাঁপতে দেখে ছুটে আসলেন পারভীন আক্তার।

” আপনি শান্ত হন, আব্বা। আমি রাবেয়াকে সামলাচ্ছি। ওদেরকে আমরা কিছুতেই এই বাড়ি থেকে যেতে দেবোনা। আমরা ছাড়া ওদের কেউই নেই। পেখমের এই দুঃসময়ে ওকে আমরা একা কিছুতেই ছেড়ে দেবোনা। আমরা পাশে ছিলাম বলেই এত সংকটেও মেয়েটা নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। সাফিয়া , তুই আব্বাকে পানি এনে দে। আমি রাবেয়ার কাছে যাচ্ছি। ” পারভীন আক্তার দেরি না করে রাবেয়া সুলতানার রুমের দিকে ছুটলেন।

সাফিয়া এক গ্লাস পানি এনে শ্বশুরের হাতে দিল৷

বড় ভাবীর মুখে পেখমের ‘ দুর্দশা ‘ হয়েছে কথাটা শুনেই সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের বুক ধক করে উঠল। পেখমের কি হয়েছে জানার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে গেলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন বড় ভাইয়ের দিকে। অশান্ত কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞেস করলেন,

” বড় ভাই, পেখমের কি হয়েছে? ভাবী কি বলে গেল? ”

” সেসব শুনে তুই কি করবি? তুই শুনতে পাসনি, আব্বা কি বলল? তুই এসেছিস বলে, রাবেয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ি ছাড়তে চাইছে। লজ্জা করছেনা তোর? এই বাড়িতে তোর অবস্থান এই বাড়িতে কোথায়, সেটা তুই বুঝতে পারছিস? শুধুমাত্র তোর জন্যই আজ পেখমের এই অবস্থা। কোন সন্তানের জীবনে বাবা’র গুরুত্ব কতটুকু সেটা জানিস তুই? তুই ওদের ছেড়ে দিয়েছিলি জন্য রিশান, পেখমকে কত কটুকথা শুনতে হয়েছে সেটা জানিস? রাবেয়াকে কতকিছু সহ্য করতে সে সম্পর্কে কোন ধারনা আছে তোর? শুধুমাত্র পেখমের বাবা ছিলনা জন্য মৃদুল ওর সাথে এতবড় বেইমানী করার সাহস করেছে। ও জানত, পেখমের হয়ে কথা বলার মত কেউ নেই। বাবা না থাকায় সবরকম বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে মেয়েটাকে। তোর মত এক বেইমান জুটেছিল ওর ভাগ্যে। যে অন্য একটা মেয়ের জন্য পেখমকে ছেড়েছে। যেমনটা তুই করেছিলি রাবেয়ার সাথে। ছোটবেলায় আম্মা বলত, অনেক সময় বাবা-মা’র পাপের শাস্তি ভোগ করে তাদের ছেলেমেয়েরা। আমারও তেমনি মনে হয়, তোর পাপের শাস্তি ভোগ করছে পেখম। তুই কেন আসলি? কেন আমাদের পুরোনো ক্ষতে নতুনভাবে আঘাত হানলি? ” সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তেড়ে আসলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের দিকে। তাকে আটকালেন সৈয়দ রাকিব আহমেদ।

” বড় ভাই, আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? এই বেইমানকে এতটা প্রাধান্য দেয়ার কি আছে! তাকে সরাসরি জানিয়ে দিচ্ছেননা কেন, আমরা কেউই তাকে চাইনা? তার থেকেও মেজো ভাবী, পেখম, রিশানের মূল্য আমাদের কাছে বেশি, এটা তাকে বলে দিন। তাকে বলে দিন, একটা বেইমানকে আমরা কখনো ভাই বলে মানবনা। ”

রাকিব আহমেদের কথাগুলো সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের বুকে তীরের মত বিঁধল। আজ নিজেকে সত্যিই তার ঘৃণা হচ্ছে। তবে এতকিছুর পরও ‘রিশান ‘ নামটা শুনলেই তার বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠছে। সেই ছোটবেলায় দু-একবার ছেলেটাকে দেখেছিলেন তিনি। যেদিন রাবেয়া তার কাছে ছুটে গিয়েছিল, তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে, সেদিন ছেলেটার বয়স বোধহয় চার কি পাঁচ মাস ছিল। রাবেয়ার কোলের ভেতর হাত-পা নেড়ে খেলছিল ছেলেটা। সেদিন তার খুব ইচ্ছে করছিল ছেলেটাকে ছুঁয়ে দেখবার। ছেলেকে একটু আদর করতে তার বুক তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু লিলি’র কারনে তিনি নিজের বুকে ছেলেকে জড়িয়ে প্রশান্তির পরশ নিতে পারেননি। লিলি সেদিন রাবেয়ার সাথে ভিষণ দুর্ব্যবহার করেছিল। তিনিও নিরব ছিলেন শুধুমাত্র লিলিকে শান্ত করতে। সেদিনের সেই ছোট্ট রিশান আজ কতবড় হয়েছে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তার। এত বছর পর আজ তিনি জানতে পারলেন, তার ছেলের নাম ‘ রিশান ‘। আজ তার পিতৃ সত্তা ভিষণভাবে আন্দোলিত হচ্ছে। খুব করে ছেলেকে কাছে পেতে মন চাইছে। পেখমকে খুব কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে । তাই ভাইদের কোন অপমান তার গায়ে মাখছেনা।

” রাকিব, একবার রিশানকে ডেকে আনবি? আমি প্রয়োজনে দূর থেকে ওকে দেখব। ও কত বড় হয়েছে, সেটা বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে। ”

” এখন দেখে কি করবে? তোমার ছেলেমেয়েরা তোমাকে দেখতে চায়না এটা নিশ্চিত থাক। এটাও জেনে রাখ, তুমি তাদের কাছে মৃত। ”

সৈয়দ সানোয়ার হোসেন আর কিছু বলতে পারলেননা। মাথা নিচু করে বসলেন চেয়ারে। তার দু-চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রু।

চলবে…