সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৩৫+৩৬

0
408

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৫
জাওয়াদ জামী জামী

কতক্ষণ মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলেছেন সেটা মনে নেই। হঠাৎ তার ধ্যান ভাঙ্গল। তিনি চোখ মুছে তাকালেন রাকিব আহমেদের দিকে। তাকে আবারও অনুনয় করলেন।

” তোদের সকল অভিযোগ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। তোরা যদি আমাকে শাস্তি দিতে চাস, সেটাও আমি নির্দিধায় মেনে নেব। তবুও একটাবার আমার ছেলেমেয়েকে দেখতে চাই। তুই একটু ওদের ডেকে দে। ”

ঠিক সেই সময় পেখম দাঁড়িয়ে এসে দাঁড়ায় দরজায়। আর ওর কানে যায় সানোয়ার হোসেনের বলা কথাগুলো। পেখম কিছু একটা ভেবে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

” সরি, তোমার অনুরোধ আমি রাখতে পারছিনা। তোমাকে শাস্তি দেয়ার আমরা কেউই নই। তুমি তোমার স্ত্রী-সন্তানের সাথে অপরাধ করেছ। ঠকিয়েছ ওদের, সেই সাথে করেছ বঞ্চিত। আমি কিছুতেই তোমার প্রস্তাব পেখম কিংবা রিশানের কাছে পৌঁছে দিতে পারবনা। পারলে অন্য কেউ দিক। ” রাকিব আহমেদ সাফ জানিয়ে দিলেন।

” কাউকেই কিছু জানাতে হবেনা। আমিই এসেছি। শুনতে চাই তিনি কি বলবেন। ”

সবাই একযোগে তাকালেন পেখমের দিকে। মেয়েটা রিশানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে দাদুর দিকে। রিশান তাকিয়ে আছে উঠানের কোনে আম গাছটার ডালের দিকে। সেখানে দু’টি চড়ুই খুনসুটিতে ব্যস্ত।

সৈয়দ সানোয়ার হোসেন অবাক নেত্রে তাকালেন তার ছেলেমেয়ের দিকে। তিনি ভালো করে দেখছেন দু’জনকে। ছেলেটার আদল পুরোটাই তার মত। রিশানকে দেখে মনে হচ্ছে কৈশোরের সেই সানোয়ার হোসেন। তারই মত চোখ, নাক, এমনকি মুখের গড়নও তারই মত। এই ছেলেটাকে জন্মের পর থেকে আজ অব্দি তিনি ছুঁয়েও দেখেননি। অথচ তার সেই ছেলেই কিনা, তারই কার্বনকপি হয়েছে! এদিকে তার আর লিলির তিনজন ছেলেমেয়েরা কেউই তাদের মত দেখতে হয়নি। সবার চেহারায় বিদেশি ভাব। এবার তিনি তাকালেন পেখমের দিকে। ছোটবেলায় মেয়েটাকে অনেকবারই দেখেছেন তিনি। তিনি বাড়িতে আসলেই মেয়েটা তার আশেপাশে ঘুরঘুর করত। সারাক্ষণ ‘ বাবা ‘ ‘ বাবা ‘ বলে ডাকত। অথচ তিনি একবারও মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকাননি। প্রথম সন্তানের মুখে ‘ বাবা ‘ ডাক শুনে আহ্লাদিত হননি মোটেও। সেই ছোট্ট পেখম আজ কত বড় হয়েছে! মেয়েটার গায়ের রং প্রথম থেকেই বেশ চাপা। ঠিক সানোয়ার হোসেনের মা’য়ের মত। চেহারাও পেয়েছে তার মা’য়ের মত। আর এজন্যই তার ভাইয়েরা, আব্বা পেখমকে খুব ভালোবাসতেন। এটা তিনি শুরু থেকেই দেখেছেন। সানোয়ার হোসেন একনজরে দেখছেন তার ছেলেমেয়েকে। পেখমের কথায় তার সম্বিৎ ফিরল।

” কি বলতে চান বলুন। ”

” তোমরা একটু আমার কাছে এসে দাঁড়াবে। ” স্বগোতক্তির ন্যায় বললেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” এবার বলুন কি বলতে চান? হুট করেই বা কেন আমাদের কথা মনে হল আপনার! ” পেখম রিশানকে নিয়ে সানোয়ার হোসেনের কাছে এসে দাঁড়ায়।

সানোয়ার হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুখোমুখি হলেন ছেলেমেয়ের। ডান হাত দিয়ে ছুঁতে চাইলেন রিশানের গাল। কিন্তু তার আগেই রিশান সরে গেল। রিশানের এমন কাজে একটুও চমকালেননা সানোয়ার হোসেন। তিনি মলিন হেসে তাকালেন পেখমের দিকে।

” আমি কি তোমার মাথায় একটু হাত রাখতে পারি? ” আকুল আর্জি ঝরল সানোয়ার হোসেনের গলায়।

” না, পারেননা। সেই অধিকার আপনি হারিয়েছেন অনেক আগেই। যখন আমি আপনার একটু স্বান্যিধ্য পাবার জন্য আপনার পিছু পিছু ঘুরেছি, তখন তো একবারও আমাকে কোলে তুলে নেননি। আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা যখন বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাত, তখন আমারও ইচ্ছে করত, আমিও বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাই। তখন কোথায় ছিলেন আপনি আর আপনার এই ফালতু আবেগ? কত রাত বাবা’র পাশে বসে গল্প শুনব বলে জেগে থেকেছি, সেই হিসাব কি আপনি রাখেন? ছোটবেলা থেকেই ভাইয়াদের দেখেছি, বড় চাচা তাদের মাথায় তুলে রাখত, তাদের সকল আবদার পূরণ করত। আমারও ইচ্ছে হত, আমার বাবা এসে আমার সকল শখ পূরণ করুক। ভালোবেসে আমাকে কোলে তুলে নিক। কিন্তু আপনি আসেননি। আপনার সব ভাইয়েরাই তাদের ছেলেমেয়েদের ছায়া দিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমরা দুই ভাইবোন ছিলাম, ছায়া বিহীন পরগাছা। আপনার একবারও মনে হয়নি, আমরা দুই ভাইবোনের পিতার ছায়ার প্রয়োজন? চাচারা আমাদের জন্য যথেষ্ট করেছে। কিন্তু কোন সন্তানের জন্য এতটুকুই কি যথেষ্ট? তাদের বাবা থাকতে কেন দাদা-চাচাদের ওপর নির্ভর করতে হবে? আপনিতো বেকার, অকর্মন্য কোন ব্যাক্তি ছিলেননা। তবুও কেন আমরা চিরটাকালই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে রইলাম? কেন আমরা বাবার ভালোবাসা পেতে হাহাকার করেছি? কেন রিশানকে, বাবা’র কাছে যাব বলে কাঁদতে হয়েছে? কেন ও দিনের পর দিন বাবা’র পথ চেয়ে বসে থেকেছে? ও যখন জানল, আপনি অস্ট্রেলিয়া থাকেন, তখন বারবার বলেছে, বাবা আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে। সবাইকে বলে বেরিয়েছে, আমার বাবা বিদেশে থাকে। বাবা ওর জন্য অনেক খেলনা নিয়ে আসবে, জামাকাপড় নিয়ে আসবে। পাড়ার অনেক প্রবাসীরা দেশে আসল, কিন্তু রিশানের বাবা আসলনা। তবুও রিশানের আগ্রহ একটুও কমলনা। ও পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। কিন্তু ওর জীবনে সেই পরের বছর আসলইনা। ওর ও বাবা’র ভালোবাসা পাওয়া হলোনা। বাবার কোলে বসে গল্প শোনা হলোনা। বাবা’র স্পর্শ কেমন সেটাও জানা হলোনা। এত বছরেও যখন আপনি এসে আমাদের দুই ভাইবোনের তৃষ্ণা মেটাননি, তবে আজ কেন এসেছেন? যখন আপনাকে খুব করে প্রয়োজন ছিল, তখনই আপনি আমাদের ফাঁকি দিয়েছেন। এখনতো আপনাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। তবে আজ কেন আমাদের ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন? আজ আপনি চাইলেও আমরা চাইনা। আমাদের জীবনে আপনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আজ আমরা বড় হয়েছি। নিজেদের দ্বায়িত্ব নিজেরাই নিতে শিখেছি। মা’য়ের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিতে শিখেছি। সেই সাথে শিখেছি, কিভাবে কোন বেইমানকে দূরে ঠেলে দিতে হয়। একটা কথা জানেনতো, জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না? আপনি শুধুমাত্র আমার জন্মদাতা। কিন্তু বাবা হতে পারেননি কখনোই। বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতাই আপনার নেই। শুধু শুধু এতদিন পর এসে কেন আমাদের সুখের ঘরে আঁধার ডেকে আনছেন! আপনার নিজের ছেলেমেয়ে আছে শুনেছি। তাদের নিয়েই থাকুন। ” পেখম আজ কিছু তিক্ত সত্য তুলে ধরল সানোয়ার হোসেনের সামনে।

সৈয়দ বাড়ির প্রতিটি মানুষ এই মুহূর্তে অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখছে পেখমকে। মেয়েটা এত বছর এত অভিযোগ, এত কষ্ট জমা রেখেছিল নিজের ভেতর! কখনোই কাউকে জানতে দেয়নি কিছুই।

পেখমের কথা শুনে সানোয়ার হোসেন স্তব্ধ হয়ে গেলেন। নিজেকে নিয়ে তার এত বছরের সকল গর্ব নিমেষেই ধুলায় লুটালো। তার নিজেরই সন্তান তাকে অস্বীকার করল! অবশ্য এজন্য ওকে দোষ দেয়া যায়না। নিজের দোষেই তিনি পিতা হওয়ার সকল অধিকার হারিয়েছেন।

” আপু, তুমি এখানে এতসব কথা বলছ কেন! তুমি কি মনে কর, এই মানুষটার আমাদের সামনে দাঁড়ানোর মত মুখ আছে? সে স্বীকার করুক আর না-ই করুক, সে ভালোমতই জানত, এখানে আসলে তাকে এসবের সম্মুখীন হতেই হবে। তবুও সে এসেছে। কেন জানো? সমবেদনা আদায় করতে। হয়তো সে তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখী নয়, তাই সে নতুনভাবে সুখ খুঁজতে এখানে এসেছে। কিন্তু সে ভুলে গেছে, একদিন আমার মা’কে ঠকিয়ে সে নিজের সুখ খুঁজতে গিয়েছিল। আমরা সেই মা’য়েরই সন্তান হয়ে কিভাবে তাকে নিয়ে সুখী হতে পারি! তাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। দাদু-চাচাদের যদি এতে কোন আপত্তি থাকে, তবে আমরা এই বাড়ি ছাড়তে প্রস্তুত। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। তোমার আর মা’য়ের দ্বায়িত্ব আমি নিতে পারব। ”

রিশান মাটির দিকে তাকিয়ে অনায়াসেই কথাগুলো বলল। ও সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মুখের দিকে তাকাতে চায়না। যে মানুষটাকে সে কখনোই দেখেনি, বড় হওয়ার পর যার কুকর্ম সম্পর্কে জানতে পেরেছে, সেই মানুষটাকে ও মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে কবেই। অথচ এই মানুষটার জন্যই ও একটা সময় বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছে। এই মানুষটাকে একটাবার ‘ বাবা ‘ ডাকবার জন্য কতইনা ছটফট করেছে। আজ সেই মানুষটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ তাকে ‘ বাবা ‘ ডাকার কোন ইচ্ছেই হচ্ছেনা রিশানের।

আজ বুঝি সানোয়ার হোসেনের আঘাত সহ্য করার দিন! তিনি এক মুহূর্তের জন্য সেটাই ভাবলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, তিনি তো সত্যিই অপরাধী। তাই ছেলেমেয়ের দেয়া বিষবাক্য নিরবেই হজম করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, তার পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। তিনি দাঁড়াতে পারছেননা। আঁকড়ে ধরলেন চেয়ার। এ-ও কি সম্ভব! তার আশেপাশের সবাইতো কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই বসে! তাদের কি কোন সমস্যা হচ্ছেনা? অনেকক্ষণ পর তিনি আবিষ্কার করলেন, তার পা দুটো কাঁপছে।

” রিশান দাদু ভাই, তুমি এসব কি বলছ? তুমি জানোনা, তুমি আর পরী বুবু আমাদের কাছে কি? তোমাদের জন্য আমি আমার ছেলেকে ত্যাগ করেছি। একজন সানোয়ার হোসেনের থেকেও তুমি, পরী বুবু আর বউমা আমাদের কাছে অধিক আদরের। শুনে রাখ, যাকে আমি ত্যাগ করেছি, তাকে কিছুতেই এই বাড়িতে ঠাঁই দেবোনা। তাকে শুধু তার কৃতকর্মের ফল দেখানোর জন্য থাকার অনুমতি দিয়েছি। আশা করছি ইতোমধ্যেই সে তার কৃতকর্মের ফল দেখতে পেয়েছে। এরপরও এই বাড়িতে থাকাবে কি না সেটা একান্তই তার বিষয়। ” সৈয়দ শামসুল হক কঠোরভাবে প্রকাশ করলেন নিজেকে।

” আমি চলে যাব, আব্বা। তবে অনেক বছর পর এই বাড়ির আঙ্গিনায় পা রেখেছি, একবার আম্মার রুমটা না দেখে যেতে কষ্ট হবে যে। ঐ রুমের প্রতিটি কোনে আম্মার ছোঁয়া লেগে আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আম্মার ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার কিছুটা পেতে বড্ড ইচ্ছে করছে। আম্মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারিনি, তার কবর জিয়ারত করতে চাই। এরপর আমি চলে যাব। ” সানোয়ার হোসেন আকুল গলায় আবেদন করলেন।

” মা’য়ের দোহাই দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে চাইছ! আচ্ছা যাও। হাজারহোক মা’য়ের সন্তান ছিলে তুমি। তবে একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে, হঠাৎ করেই তোমার পরিবারের লোকজনের প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠল কেন? এত বছরে কেন তোমার ভালোবাসা উপচে পরেনি? তুমি এখানে এসেছ, সেটা তোমার স্ত্রী জানে? সে তো আবার ফরোয়ার্ড মেয়ে। অন্যের স্বামীকে ছিনিয়ে নিতে সে ভালো পারে। সে তোমাকে এখানে আসতে বাঁধা দেয়নি? ”

আব্বার কণ্ঠে ব্যাঙ্গ টের পেলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন। তিনি জানতেন এই প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে।

” সবাই জানে আমি আমার বাড়িতে এসেছি। তবে বাঁধা দেয়নি কেউই। বাঁধা দেয়ার মত ফালতু সময় তাদের হাতে নেই। আমি তাদের কাছে শুধুমাত্র টাকা উৎপাদনের হাতিয়ার। আমি তাদের জন্য অঢেল টাকা খরচ করছি, এটাই অনেক। তারাও সেটাই চায়। তাই আমি কি করছি, কোথায় যাচ্ছি এটা জেনেও যেমন তাদের কোন লাভ নেই, তেমনি আমি এখানে এসেছি বলে তাদের কোন ক্ষতিও হচ্ছেনা। তারা তাদের চাহিদামত টাকা পেয়ে গেছে, তাই আমি এখানে আসব জেনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ”

সানোয়ার হোসেনের কথা শুনে তার দিকে চমকে তাকায় পেখম আর রিশান। আজ প্রথমবারের মত রিশান বাবাকে দেখছে। ও যত বাবাকে দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে। বাবারা এত সুন্দর হয়! অজানা অনুভূতি ঘিরে ধরেছে রিশানকে। একটা সময় বাবা’র শরীরের গন্ধ কেমন জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। আজ সেই বাবা তার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেই অনুভূতির ছিঁটেফোঁটাও নেই আজ। তবে তারপরও কেন অজানা অনুভূতি ছড়িয়ে পরেছে ওর হৃদয়ে? রিশান বুঝতে পারল, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে এই বেইমান মানুষটাকে হয়তো ক্ষমা করে দেবে। কিন্তু সেটা হবে ওর মা’য়ের সাথে বেইমানি করা। যেটা রিশান চায়না। তাই ও ঝড়ের বেগে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।

পেখম সানোয়ার হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেটা সবারই চোখে পরল। আজ পেখমের বুকটা একটু ঠাণ্ডা হল। এত বছর ওর ভেতরটা জ্বলত। বারবার মনে হত, বাবা নামক মানুষটা ওদের চরমভাবে ঠকিয়েছে। কিন্তু আজ সেই বেইমান মানুষের চোখেমুখে ঠকে যাওয়ার ছাপ। দিনশেষে সে-ও ঠকেছে। একজনের ভালোবাসা পায়ে মাড়িয়ে অন্য একজনের হাত ধরেছিল যে, তাকেও তার ভালোবাসার মানুষটাই দিনের পর দিন ঠকাচ্ছে।

” তার মানে, দিনশেষে আপনিও ঠকে গেছেন? আপনি আমার মা’কে ঠকিয়েছেন, আর আপনাকে ঠকাচ্ছে আপনার ভালোবাসার মানুষেরা! যাদের কাছে আপনার কোন মূল্যই নেই! অথচ আমার মা’য়ের কাছে আপনিই ছিলেন সব। ইচ্ছে করলেই আপনি শেষ বয়সটা সুখে কাটাতে পারতেন। কিন্তু নিজের হাতেই নিজের সুখের রাস্তা আপনি বন্ধ করে দিয়েছেন। ভালো থাকবেন। অনেক অনেক টাকা উপার্জন করবেন আর স্ত্রী-সন্তানদের চাহিদা মেটাবেন। আশা করি, আজকের পর আপনার সাথে আর কখনোই দেখা হবেনা। ” পেখম আর সেখানে দাঁড়ালোনা। বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল৷

সানোয়ার হোসেন অসহায় চোখে ছেলেমেয়ের যাওয়া দেখলেন। যাদেরকে তিনি একবিন্দুও ভালোবাসা দেননি, তাদের থেকে ভালোবাসা চাওয়াটা বোকামো। কিন্তু তার বেহায়া মন এই ছেলেমেয়ের ভালোবাসাই পেতে চাইছে। তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। তিনি খুব করে চাইছেন, ছেলেমেয়েদের হাত ধরে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াতে। ওদের সাথে খুনসুটি করতে৷ কিন্তু সেসবের উপায় তিনি রাখেননি। তিনি পাপী। এই পাপের মোচন তিনি কিভাবে করবেন, সেই উপায় তার জানা নেই।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী জামী

কম্পমান পায়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়ির প্রতিটা ইঞ্চি দেখতে লাগলেন। ঘরের দেয়ালে হাত বুলিয়ে আম্মার ছোঁয়া অনুভব করতে চাইছেন। তার চোখে পানি। নিজের ভুলের জন্যই আজ তিনি পরিবার ছাড়া। সাফিয়া, মেহনাজসহ তাদের ছেলেমেয়েরা সৈয়দ বাড়ির মেজো ছেলের করুণ দশা দেখছে।

ধীরে ধীরে সৈয়দ সানোয়ার হোসেন এসে দাঁড়ালেন আম্মার রুমে। এত বছর পরও রুমটা সেই আগের মতই আছে। আম্মার ব্যবহৃত সেই পুরোনো আলমারিটা এখনো সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আলনা, যার একপাশে জায়নামাজ আর তসবিহ ঝুলিয়ে রাখত আম্মা। সেটা এখনো আছে। আর তাতে জায়নামাজও ঝুলছে। আব্বার জন্য খাটের পাশের টেবিলে জগ ভর্তি পানি, পানের বাটা রাখত আম্মা। সেই টেবিলও আছে, জগ ভর্তি পানি, পানের বাটাও আছে। শুধু নেই আম্মা। যার নিপুন হাতের ছোঁয়ায় সৈয়দ বাড়ির প্রতিটা কোন ঝলমল করত, সেই মানুষটাই আর নেই। বিছানায় হাত রেখে আম্মাকে অনুভব করতে চাইছেন তিনি। কাঁদছেন অঝোরে।

অনেকক্ষণ পর সানোয়ার হোসেনের মনে পরল আম্মার রুমের বারান্দার কথা। শৈশবে যে বারান্দায় বসে তারা চার ভাই খেলতেন। শীতের দুপুরে বারান্দার জলচৌকিতে বসে রোদ পোহাতেন। তাদের চার ভাইকে নিয়ে আম্মা পড়াতে বসাতেন। কতশত স্মৃতি আছে বারান্দা ঘিরে। তিনি দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেন বারান্দার দিকে। সেই জলচৌকি আজ আর নেই। কালের পরিক্রমায় হয়তো তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তবুও তার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি কিছুই।

বারান্দায় এসে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিলেন সানোয়ার হোসেন। তার চোখ পরল বারান্দার কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা নাগ চাঁপা গাছের দিকে। ঝোপালে গাছের প্রতিটা ডাল ফুলে ছেয়ে গেছে। হুট করে তাকালেই মনে হবে, সবুজের মাঝে সাদা তারার মেলা। ফুলের গন্ধে ম ম করছে বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি আশেপাশে দেখার চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চোখ গেল ডানপাশের বারান্দায়। এই বারান্দা থেকে পড়ার ঘরের সেই বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। ছোটবেলায় মাস্টার কাকা এসে তাদের চার ভাইকে ঐ ঘরেই পড়াতেন বলে, তারা ঘরটার নাম দিয়েছিলেন পড়ার ঘর। সানোয়ার হোসেন লক্ষ্য করলেন সেখানে বারান্দায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। পেছন ফিরে থাকায় তিনি তার মুখ দেখতে পেলেননা।

একে একে পুরো বাড়ি দেখে তিনি পা বাড়ালেন পড়ার ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকেই তার চোখ পরল বুকশেলফের দিকে। তাদের পুরোনো সেই বুকশেলফের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও দুইটা বুকশেলফ। সেগুলো ভর্তি হরেকরকম বই দিয়ে। একপাশে রিডিং টেবিল। আরেক পাশে আছে ছোট্ট একটা খাট। খাটে দুইটা বই সযতনে রাখা। কেউ হয়তো এই রুমে তার বাসা গেঁড়েছে। সানোয়ার হোসেনের জানা হলোনা এই রুমটা পেখমের অধীনে। ছোট থেকেই এই রুমের প্রতি ভিষণ রকমের টান মেয়েটার। বিশেষ করে রুমের বইগুলোর প্রতি তার অধিক ভালোবাসা। রুমটা খুঁটিয়ে দেখে তিনি আসলেন বারান্দায়।

বারান্দায় কারও শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন রাবেয়া সুলতানা। সামনাসামনি সানোয়ার হোসেনকে দেখে তার পা থেমে গেল। তিনি বুঝতে পারেননি, মানুষটা এই রুমেও আসবে। রাবেয়া সুলতানা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো আম্মার রুম দেখেই বিদায় নেবেন। তাই এখানে এসে আত্নগোপন করেছিলেন।

সানোয়ার হোসেন অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন রাবেয়া সুলতানার দিকে। অনেক বছর আগে দেখা সেই যুবতী নারী আজ মাঝবয়েসী নারীর রূপ পেয়েছে। তার চোখেমুখে মাতৃত্বের ছাপ প্রকট। সানোয়ার হোসেনের হুট করেই মনে পরে গেল সেদিনের কথা। যেদিন এই নারীই তার সংসার হারানোর ভয়ে ছুটে গিয়েছিল ঢাকায়। সেই ফ্ল্যাটে লিলিকে দেখে ভিষণ চমকে গিয়েছিল। নিজের সংসারের জন্য, সন্তানদের জন্য কতশত অনুরোধ করেছিল লিলিকে। তার পায়ে পর্যন্ত পরেছিল। কিন্তু লিলির জিদের কাছে পাত্তা পায়নি এই নারীর আকুতি। অবশ্য তার নিজের দোষও কম ছিলনা। সানোয়ার হোসেনের শত তুচ্ছতাচ্ছিল্যেও যে নারী কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সেই নারীই নিজের সংসার বাঁচাতে কত আকুতি করেছে। আজ সেসব অতীত। সানোয়ার হোসেন লক্ষ্য করলেন যুবতি রাবেয়া সুলতানাও যেমন সুন্দরী ছিল , মাঝবয়েসী রাবেয়া সুলতানাও তেমনি সুন্দরীই রয়েছে। রয়েছে তেমনি নমনীয়। যার চেহারায় সব সময় খেলা করত মমতা। আজও ঠিক তেমনিই রয়েছে সে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাবেয়া সুলতানা সানোয়ার হোসেনকে অতিক্রম করতে গেলেই, মানুষটার ডাকে তাকে থমকে দাঁড়াতে হয়।

” রাবেয়া! ”

রাবেয়া সুলতানা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তাকে নিরব থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” কেমন আছ? ”

” আছি বেশ। ”

” এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলে যে? আমার জানামতে এই বাড়িতে তোমার জন্য একটা রুম বরাদ্দ ছিল। ”

সানোয়ার হোসেন রাবেয়া সুলতানার সাথে কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু রাবেয়া সুলতানা সেটা মোটেও চাইছেননা। তিনি এখান থেকে বেড়োতে চাইছেন। তাই দায়সারা গোছের উত্তর দিলেন

” এই রুমে পেখম থাকে। তাই আমাকে আসতেই হয়। ”

” বাড়িতে এতগুলো রুম থাকতে, ও এই রুমে থাকে! কেন? ”

” বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করে, তাই। ”

” আমার দিকে তাকাচ্ছনা যে? একবারও যে জিজ্ঞেস করলেনা কেমন আছি? ”

” ভালো থাকার জন্যই তো আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। তাই আর নতুন করে জিজ্ঞেস করার দরকার কি। আর অধিকার নেই বলেই তাকাচ্ছিনা। তাকানোর প্রয়োজনওবোধ করছিনা। ”

” ভালো থাকতে চাইলেই কি ভালো থাকা যায়? কাউকে কাঁদিয়ে, কারও চোখের পানি পায়ে মাড়িয়ে কেউ সুখে থাকতে পারেনা। এটা আমি একটা সময় পর বুঝতে পেরেছি। ”

” শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক। ”

রাবেয়া সুলতানা আবারও পা বাড়ালেন বাহিরের দিকে। এই মুহূর্তে তার ভিষণ কান্না পাচ্ছে। এখানে আর কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালে তিনি নির্ঘাত কাঁদবেন। এই মানুষটা তার জীবনে প্রথম পুরুষ। তাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলেন তিনি। এক অষ্টাদশী কন্যার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ছিল মানুষটার জন্য। তাই তার শত অবহেলাও তিনি হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। কয়েকদিন তাকে না দেখলেই হাঁসফাঁস করত তার বুক। যখন সে বাড়িতে আসত, লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতেন রাবেয়া সুলতানা । সেদিনের সেই সুদর্শন যুবক তার বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঝড় তুলেছিল।তিনি ভেবেছিলেন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তার ভালোবাসায় ধরা দেবে মানুষটা। কিন্তু না, সেটা হয়নি। তাকে ভালোবাসায় বাঁধতে পারেননি রাবেয়া সুলতানা। এতকিছুর পরও এতগুলো বছর পর রাবেয়া সুলতানা তাকে ভুলতে পারেননি কিছুতেই। আসলেই প্রথম ভালোবাসা কখনোই ভোলার নয়।

” চলে যাচ্ছ যে? আমার সাথে কথা বলতে বুঝি ঘৃণা হচ্ছে? ”

রাবেয়া সুলতানা হাসলেন। তিনি তাকে বোঝাবেন কিভাবে, যাকে একবার মন থেকে ভালোবাসা যায়, তাকে কখনোই ঘৃণা করা যায়না। ভালোবাসার মাঝে কখনোই ঘৃণা স্থান পায়না। তবে তিনি মুখে বললেন অন্য কিছু।

” ঐ যে সবকিছুর মূলে রয়েছে অধিকার। যেখানে অধিকার নেই, সেখানে ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা করতে যাওয়াটা বোকামি। আপনার আর আমার রাস্তা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছে। তাই এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলাটাও অশোভনীয়। ” আবারও চলে যেতে উদ্যত হলেন রাবেয়া সুলতানা।

” প্লিজ যেওনা। অনেক বছর ধরে কারও সাথে মন খুলে কথা বলতে পারিনি। কাউকে জানাতে পারিনি ভেতরের ক্ষতের গভীরতা কতটুকু। ভেতরের কথাগুলো জমে পাথরের রূপ নিয়েছে। সেই পাথর গলাতে কাউকে দুদণ্ড প্রয়োজন। ” আকুতি করলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” আমিই কেন! যাননা অন্য কারো কাছে। অন্যকেই শোনান আপনার দুঃখের উপাখ্যান। আমাকে আঘাত দিয়ে আবার আমার কাছেই এসেছেন নিজের দুঃখের গল্প শোনাতে! হায়রে মানুষ। একজনকে ঠকাতে ঠকাতে এমন স্তরে নিয়ে গেছেন যে, দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ তার ওপরই হেসেছে। আবার তাকেই দুঃখের গল্প শোনাতে চাচ্ছেন? আর তাছাড়া আপনার তো দুঃখ থাকবার কথা নয়। আমিতো আপনার অযোগ্য ছিলাম। তাই ভালো থাকতে যোগ্য এজনকে বেছে নিয়েছিলেন। তারপরও কেন এত হা-হুতাশ করছেন! ”

” যোগ্য-অযোগ্য বিবেচনাবোধ যদি তখন থাকত, তবে আমার জন্য তোমাদের কাঁদতে হতোনা। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিনা, তুমি কেন এ বাড়িতে থেকে গেলে? কেন এতগুলো বছর একা একা কাটিয়ে দিলে? চাইলেই তুমিও নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারতে। ”

” কোথায় যেতাম? আব্বা মারা গেল আপনি চলে যাওয়ার চারমাস পর। আর আম্মা এক বছর পর। আব্বা-আম্মার মৃত্যুর পর ভাইয়েরা আমাকে পর করে দিল। পরে জানতে পারলাম, আপনি চলে যাওয়ায় পরপরই কৌশলে আব্বার কাছ থেকে সব প্রপার্টি তারা লিখে নিয়েছিল। তারা আমার প্রাপ্য আমাকে দিতে চায়নি। এসব শোনার পর ঐ বাড়িতে কিভাবে যেতাম? আর এ বাড়ির কেউই চায়নি আমি বাচ্চাদের নিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকি। তাই না চাইলে এ বাড়িতেই পরে থাকতে হয়েছে আমাকে। ”

” এতকিছু ঘটে গেছে! সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। যদিও জানি, যে অন্যায় আমি করেছি, তার কোন ক্ষমা হয়না। তবুও মানুষেরই মন তো, ক্ষমা পেতে, আপনজনদের ফিরে পেতে উন্মুখ হয়ে থাকে। ”

” আপনি যত সহজে বলছেন, তত সহজে কি আমি ক্ষমা করে দিতে পারব? আপনার কোন ধারনা নেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি কিভাবে দিনাতিপাত করেছি। কিভাবে ওদের শান্তনা দিয়েছি, নিজেকে শান্তনা দিয়েছি। আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আমার পক্ষে ক্ষমা করাটা খুব কঠিন। ”

” তুমি অনেক বদলে গেছ। আগে বেশ চুপচাপ ছিলে। হাজার কষ্টেও কোন টু শব্দটি করতেনা। ”

” আপনি আমাকে বদলাতে বাধ্য করেছেন। আপনার দেয়া শত আঘাতেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি বলেই আপনি আমাকে আঘাতের পর আঘাত করতে পেরেছেন। সেদিনের আমি’র সাথে আজকের আমি’র আকাশপাতাল তফাৎ। আপনি চাইলেই এখন আমাকে তিল পরিমান আঘাত দিতে পারবেননা। আমার চতুর্পাশে আপনার দেয়া আঘাত পৌঁছানোর আগেই আমার ছেলেমেয়েরা সেটাকে আটকে দেবে। ”

” যোগ্য মা’য়ের যোগ্য সন্তানরূপে তাদের গড়ে তুলেছ তুমি। তুমিই স্বার্থক মা, আদর্শ মা। ”

” কিন্তু আপনি আদর্শ পিতা হতে পারেননি। ”

” সেজন্য আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে। ”

” আমি আসছি। এভাবে আপনার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগছেনা। ”

” যাবেইতো। তোমাকে ধরে রাখার মত কোন কাজ আমি করিনি। সেই জোর আমার নেই। ”

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেননা রাবেয়া সুলতানা। তিনি ঘুরে তাকালেন সানোয়ার হোসেনের দিকে। তার চোখে চোখ রাখলেন।

” কেন জোর নেই আপনার? কেন আমাকে ধরে রাখার কাজ করলেননা? আমি কোনদিন আপনার হাত ছাড়তে চাইনি, কিন্তু আপনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। আপনার জন্য আমার পুরো জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমার মেয়েটার জীবনও আপনার জন্যই নষ্ট হয়েছে। বাবা না থাকায় ওর জীবনের সকল সিদ্ধান্ত অন্যেরা নিয়েছে। যেগুলো ওর জন্য সুখকর ছিলনা। দাদা-চাচাদের সম্মান জানাতে গিয়ে আমার মেয়েটার গলায়ও বিয়ে রূপী ফাঁসি পরল। সংসার হারালো মেয়েটা। কি দোষ ছিল আমার মেয়েটার? কি দোষ করেছিল আমার রিশান? কেন আমার ছেলেটা বুভুক্ষুর ন্যায় বাবাকে কাছে পেতে চাইত? শুধুমাত্র আপনার জন্য আমার ছেলেমেয়েদের শৈশব, কৈশোর শেষ হয়ে গেছে। ওরা হাসতে ভুলে গেছে। দশ বছর বয়সেই ওরা পরিনত মানুষের মত আচরণ করেছে। আপনি কেড়ে নিয়েছেন ওদের শৈশব-কৈশোর। আপনিই ওদের হাসি ছিনিয়ে নিয়েছেন। আজ এত বছর পর এসেছেন ক্ষমা চাইতে? লজ্জা করছেনা আপনার? ” রাবেয়া সুলতানা কান্নায় ভেঙে পরলেন। তার এত বছরের সকল দুঃখ-কষ্ট কান্না হয়ে ঝড়ে পরছে দু-চোখ বেয়ে।

***

” পেখম মা, তুই মন খারাপ করে থাকিসনা। রিশানকে ডেকে নিয়ে আয়। জানিসনা ভালোমন্দ, সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানুষের জীবন? একজীবনে সবাই সবকিছু পায়না। আবার কেউ পেয়েও হারায়। আবার অনেকেই দুঃখের কিনারায় গিয়েও সুখ নামক অলীক বস্তু আঁকড়ে ধরে। তুই দেখিস তোদের জীবনে অধরা সুখ ঠিকই ধরা দেবে। তুইতো বুঝদার মেয়ে। সেই তুই-ই যদি এভাবে ভেঙে পরিস, তবে রাবেয়াকে সামলাবে কে? রাবেয়া কেমন কষ্ট পাচ্ছে দেখেছিস? তোদের সকল অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট আমরা জানতে পারলেও সে-তো কাউকেই কিছু জানায়নি। শুধুমাত্র তোদের কথা ভেবে আমরা অনেক বলার পরও নতুন করে সংসার করেনি। আমরা জানি তুই সাহসী। এই পরিস্থিতি তুই ঠিক সামলে নিতে পারবি। ওঠ মা, রাবেয়া রিশানকে নিয়ে আয়। তোর দাদু, চাচারা তোদের জন্য অপেক্ষা করছে। ” পারভীন আক্তার পেখমের মাথায় হাত বুলিয়ে সস্নেহে বললেন।

বড়মার আদেশ উপেক্ষা করার সাধ্য নেই পেখমের। ও মাথা নেড়ে সায় জানায় তার কথার মা’কে ডাকতে যায়।

***

” ভাইয়া, ঘটনা তো ঘটে গেছে। ” কানন উত্তেজিত গলায় বলল।

রাজ্য সবেমাত্র খাবার টেবিলে বসেছে। এখনো খাবার মুখে তুলতে পারেনি। এরইমাঝে কানন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল।

” কি ঘটেছে? রাকিব চাচা বাবা হতে যাচ্ছে নাকি? তুই দুলাভাই হচ্ছিস? কোন ধরনের প্রোডাক্ট? শালা না শালী? ”

রাজ্যের কথা শুনে বিরক্তিতে চোখমুখ কোঁচকায় কানন।

” কিসব উদ্ভট কথাবার্তা বলছ? আমার কোন শালা-শালী আসছেনা। আসলে তোমার ভাতিজা-ভাতিজী আসবে। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির বয়স হয়েছে, এখন তাদের ইটিসপিটিস করার দিন নেই। ”

” তোর শ্বশুরের বয়স পঞ্চাশ হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। বিদেশে এই বয়সে অনেক পুরুষই প্রথম সন্তানের বাবা হয়। আর তুই বলছিস তাদের দিন নেই! পুরুষরা এই বয়সেও ফিট থাকে বুঝলি? তাই তোর শালা-শালী জন্মানোর চান্স কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। ”

” ধুর বাল, কি বলতে এসেছিলাম, আর তুমি আমাকে কি হাদিস শুনিয়ে যাচ্ছ। ”

কাননকে রাগতে দেখে রাজ্য ওকে আর ঘাঁটালনা। গুরুগম্ভীর গলায় বলল,

” কি বলবি বলে ফেল। ”

” সৈয়দ সানোয়ার হোসেন মানে পেখমের বাবা আজ হুট করেই বাড়িতে এসেছিল। ”

” এতদিন পর কি মনে করে এসেছে ভদ্রলোক? ” রাজ্য বেশ অবাক হয়েছে।

” পরিবারের সবাইকে দেখতে। তবে কেউই তার সাথে ভালো আচরণ করেনি। এমনকি পেখম, রিশানও তাকে অপমান করেছে। ভদ্রলোক খুব কাঁদছিলো জানো? সে কার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। ” একে একে কানন সবকিছু খুলে বলল রাজ্যকে।

” কিহ্! একটা মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করার পরও কারো কাছেই ক্ষমা পায়নি! পেখম নিজের বাবাকেও ক্ষমা করেনি! তাহলে আমার কপালে কি আছে আল্লাহই জানেন। দুর এসব কি ভাবছি। দোষ তো আমার শ্রদ্ধেয় হবু শ্বশুর মশাইও করেছিলেন। সে যদি আমার কিউট শ্বাশুড়িমা ‘কে ছেড়ে না যেত, তবে আমার বউটা কি অভিমান করত? কানন, তুই কি জানিস আমার হবু শ্বশুর এখন কোথায়? ”

” রাজশাহী আছে। সেখানের হোটেলে উঠেছে। কিন্তু তুমি এসব জেনে কি করবে? ”

” আমার রাস্তা ক্লিয়ার করব। বউকে পেতে হলে বউয়ের বাপ-মায়ের মনোমালিন্য দূর করতে হবে। তাদের মনের মিলন পুনরায় ঘটাতে হবে। ”

” তাদের মিলন ঘাটাবে মানে? যেখানে সবাই সানোয়ার চাচাকে দেখে বিরক্ত হয়েছে, সেখানে তুমি তার পক্ষ নিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে নাকি? ভুলেও এমনটা করোনা। এমনিতেই পেখম তোমার নাম শুনলে অযু করে। তারউপর যদি ও শোনে, তুমি ওর বাবার পক্ষে কাজ করছ, তবে নির্ঘাত তোমার নাম শুনলে, শয়তান তাড়ানোর দোয়া পাঠ করবে। ”

” চুপ থাক ইডিয়ট, কোথায় কি বলতে হয় এখনো সেটা শিখিসনি? আমি কারও পক্ষে কাজ করবনা। আমিতো শুধু কলকাঠি নাড়ব৷ আর সেটা আমার বৃষ্টি বিলাসীনিকে নিজের করে পেতেই করব। ”

কাননের কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকলনা। ওর মনে হচ্ছে, খবরটা রাজ্যকে দিয়ে ভুল করলনাতো?

চলবে…