সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৩৭+৩৮

0
352

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী

” সীমা, এতদিন ধরে তোর ফ্ল্যাটে আছি, তুই কি করিস সেটা আজও জানতে পারলামনা। কিভাবে চলে তোর সংসার?তোর স্বামীই বা কোথায়? আর ছেলেমেয়েরা? ”

আইভি রহমান তার বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি এতদিনেও তার বান্ধবীর ইনকামসোর্স কি সেটা জানতে পারেননি। তার বিলাসী জীবন দেখে আইভি রহমান বেশ ভাবুক হয়ে উঠেছেন। সীমাকে তিনি কোন কাজ করতে দেখেননি আজ পর্যন্ত।

” করি কিছু একটা। জানিসই তো আমার হাজবেন্ড দেশের বাহিরে থাকে। ছেলেমেয়েরাও তার কাছেই থাকে। সে-ই আমাকে যাবতীয় খরচ পাঠায়। এর বাহিরে আমার একটা পার্লার আছে। সেখান থেকেই কিছু আসে। ”

” মাঝেমধ্যে তোর নিচের ফ্ল্যাটে কিছু মেয়েরা যাতায়াত করে, তারা কে? ”

” তুই কিভাবে জানলি? ”

” আমি নিচে যাওয়ার সময় দেখেছি। ”

” ওরা আমার পার্লারে কাজ করে। ”

কেন যেন বান্ধবীর কথাগুলো আইভি রহমান বিশ্বাস করতে পারলেননা। সীমার কাজকর্ম তার কাছে সুবিধার মনে হয়না। বেশ কিছুদিন ধরেই তার মনে সন্দেহ জমেছে। সেজন্যই আজকে তাকে জিজ্ঞেস করা। তিনিও তক্কে তক্কে থাকলেন। যেভাবেই হোক জানতে চান সীমা কি করে।

***

” রাবেয়া, একটু আমার রুমে আয়। ” পারভীন আক্তারের ডাকে তার রুমে গেলেন রাবেয়া সুলতানা।

বড় জা’য়ের রুমে রাজ্যকে দেখে অবাক হলেন তিনি। রাজ্যের পাশে তার শ্বশুরও বসে আছেন। ঋতের বিয়ের পর রাজ্য আর এই বাড়িতে আসেনি।

” রাজ্য, তুমি? ”

” আপনাকে কিছু বলতে চাই, চাচী। ”

” কি বলবে? ” রাবেয়া সুলতানা একটু একটু বুঝতে পারছেন রাজ্য কি বলতে চায়।

রাজ্য এগিয়ে যায় রাবেয়া সুলতানার দিকে। তার দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

” বলতে তো চাই অনেক কিছু। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছিনা। আপনি অভয় দিলে আমি বলতে পারি। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, আপনাদের অসম্মান হয় এমন কিছুই বলবনা। ”

” বল শুনি কি বলবে। ” রাবেয়া সুলতানা চোখমুখ শক্ত করে বললেন।

” প্রথমেই আমি আমার পূর্বের করা ভুলের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি যদি সেদিন বুঝতাম, আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পেখমের জীবনে ঝড় উঠবে, তবে সেই ভুল সিদ্ধান্ত কখনোই নিতামনা।”

” আজ এতদিন পর পুরোনো কথা কেন বলছ, দাদু ভাই? সেসব কথা আমরা আর মনে করতে চাইনা। ” সৈয়দ শামসুল হক জানতে চাইলেন।

” প্রয়োজন আছে, দাদু। সেই পুরোনো ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে আমার জীবনে আসছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য আমি লজ্জিত। আমি আপনাদের চোখে চোখ মেলাতে পারিনা শুধু আমারই কারনে৷ আমাকে কি একটা সুযোগ দেয়া যায়না, দাদু? আমি প্রমিজ করছি, আপনাদের কোন অভিযোগের সুযোগ আমি দেবোনা। ”

” জীবনটা কোন ছেলেখেলা নয়, রাজ্য। তুমি চাইলেই বিয়ের দিন দেশ ছাড়লে, আবার চাইলেই সেই মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে এটা হতে পারেনা। তোমারও দেখতে হবে তোমার একটা ভুল পদক্ষেপে একটা মেয়ের জীবনে কি ভয়াবহ ঝড় উঠেছিল। মেয়েটা কত লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছে সেই খবর তুমি রাখ? তোমাকে একবার বিশ্বাস করে, তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখোনি। আবার এতদিন পর এসে তুমি পেখমকে চাইছ, আমরা তোমাকে কিভাবে বিশ্বাস করি বল? আমাদের বিশ্বাসের জায়গা তুমি হারিয়েছ। ” কেউ কিছু বলার আগেই রাবেয়া সুলতানা বললেন।

” আপনার কথায় কোন ভুল নেই। আমি যা করেছি, এরপরও আমাকে বিশ্বাস করা আপনাদের পক্ষে অসম্ভব। তারপরও একটাই অনুরোধ করব আপনাকে, আমাকে একটা সুযোগ দিন। ”

” এটাও কি সম্ভব, দাদু ভাই? তুমি একবারও ভেবে দেখেছ, পরী বুবু এই কথা শুনলে কি প্রতিক্রিয়া দেবে? এমনিতেই সে তোমার নাম শুনতে পারেনা। এরপরও আমরা যদি তোমার প্রস্তাব তাকে দেই, সে কি করবে এটা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এটা হয়না, দাদু ভাই। আমি পরী বুবুকে রাগিয়ে দিতে পারবনা। ” সৈয়দ শামসুল হক সরাসরি না করে দিলেন।

” আমার কথা মন দিয়ে শোন, রাজ্য। তোমার অনুরোধ রাখতে আমরা পারবনা। যখন পেখমের চাচারা ওর ভালোর জন্য তোমার সাথে বিয়ের কথা ভাবল, পেখমকে সেকথা জানাল, পেখম কোন দ্বিরুক্তি করেনি। ও ভালো করেই জানে, ওর দাদু, চাচারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওর ভালোর জন্যই নিয়েছে। কিন্তু শেষে যখন বিয়েটা হলোনা, ও আঘাত পেলেও কাউকে বুঝতে দেয়নি। ওর দুর্দশার জন্য পরিবারের লোকজনকে দোষারোপ করলেও আবার তাদের কাছেই ফিরে এসেছে। এখন আবার যদি আমরা ওকে তোমার সাথে বিয়ের কথা বলি, ও কি করবে সেটা বুঝতে পারছ? পরিবারের লোকজনের সাথে ওর সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা বুঝতে পারছ তুমি? আর এই অবস্থায় ওকে বিয়ের কথা বলি কিভাবে সেটা তুমি বল? ওর পুরোনো ক্ষত এখনো দগদগে। সেই ক্ষতে আবারও কিভাবে খোঁচা দেই তুমিই বল? আমি মনে করি, আবেগের বশে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়াই মঙ্গল। ”

” আপনাকে কিংবা আপনাদের কিছুই করতে হবেনা, চাচী। যা করার আমিই করব। আপনারা শুধু আমাকে বলুন এই সম্পর্কে আপনাদের কোন আপত্তি নেই? পেখমকে বোঝানোর দ্বায়িত্ব আমার। ”

” আমি একটা কথা বলি, রাজ্য? বিষয়টা এখন শুধু তোমার আর পেখমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা একটা পারিবারিক ইস্যুতে পরিনত হয়েছে। আজ হয়তো তুমি আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে পেখমকে পেতে চাইছ , কিন্তু একটা সময় তোমার আবেগ কেটে গেলে আজকের দিনের এই কথাগুলো দিব্যি ভুলে যাবে। তখন যে তোমার পেখমকে উটকো ঝামেলা মনে হবেনা এর কোন প্রতিশ্রুতি তুমি দিতে পারবে? এছাড়াও তোমার পরিবার বিষয়টাকে কিভাবে নিবে, এটাও দেখার বিষয়। আগে পেখমের নামের ডিভোর্সি ট্যাগ ছিলনা। তোমার পরিবারও পেখমকে সাদরে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এখন পেখম সমাজের চোখে শুধুই একটা ডিভোর্সি মেয়ে। সমাজ ওর দিকেই আঙুল তুলবে সর্বদা। কেউ একবারও বলবেনা স্বামীর কাছে প্রতারিত হয়ে মেয়েটা নতুনভাবে বেঁচে থাকার পথ বেছে নিয়েছে। একথা তোমার যে মনে আসবেনা তার গ্যারান্টি কি? তাই যা বলবে, যেটা করবে ভেবেচিন্তে করবে। আবার তোমার কোন ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পেখমকে যেন কষ্ট না পেতে হয় একটু খেয়াল রাখবে। মনে রেখ, রাবেয়াও কিন্তু ভুক্তভোগী। ও হয়তো তোমাকে জোর গলায় কিছু বলতে পারছেনা। কিন্তু এই কথাগুলোও যে ওর মনে আছে সেটা আমি জানি। ” পারভীন আক্তার এবার আর চুপ থাকলেননা। তিনি মনের কথাগুলো বলেই ফেললেন।

” আমি শুধু পেখমকে সারাজীবন ভালোবেসে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে চাই। ওর সকল বিপদেআপদে ঢাল হয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে চাই। ওকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে চাই। ওর সকল দুঃখে আপন করে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে চাই। সর্বোপরি ওকে ভালোবেসে বুকে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে চাই। আগের সেই রাজ্য এখন আর নেই। তার মনে ভালোবাসা নামক অলীক বস্তুর জন্ম নিয়েছে। আর সেটা শুধু পেখমের জন্যই। আর রইল আমার পরিবারের লোকজনের কথা। তারা পেখমকে মানল কি মানলনা সেটা আমার কাছে ম্যাটার করেনা। প্রয়োজনে পেখমের জন্য আমি পুরো দুনিয়ার সাথে লড়ব। তবে ঘটনা লড়াই অব্দি যাবেনা এর নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি। স্বীকার করছি একবার আমি আপনাদের ঠকিয়েছি। আর সেটাই প্রথম এবং শেষবার। বড়মা, প্লিজ আপনারা আমাকে শেষ সুযোগ দিয়ে দেখুন। আমি আপনাদের নিরাশ করবনা। ”

রাজ্যের কথায় রাবেয়া সুলতানা এবং পারভীন আক্তার দু’জনেই নিরব থাকলেন। রাজ্যের কথাগুলো তাদের মন ছুঁয়ে গেছে। ছেলেটা যে তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেনা, সেটা তার চোখের তারায় স্পষ্ট। কিন্তু পেখমের এতবড় সিদ্ধান্ত তারা একা নিতে চায়না কিছুতেই।

” তোমার সব কথা শুনলাম, দাদু ভাই। কিন্তু একটা বেকার ছেলের হাতে আমি আমার নাতনীকে কিভাবে তুলে দেই বল? তুমি আমেরিকা থাকে এসেছ কয়েকমাস হয়ে গেছে। এতদিন নিশ্চয়ই ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তোমাকে চাকরিতে বহাল রাখেনি। তুমি দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। চাকরি বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করছনা। যে নিজের চাকরির প্রতি উদাসীন, সে তার বউয়ের খেয়াল কিভাবে রাখতে পারে, এটা আমাকে বোঝাও। ” সৈয়দ শামসুল হক চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন রাজ্যের দিকে।

রাজ্য দাদুর কথা শুনে রাবেয়া সুলতানা আর পারভীন আক্তারের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল দাদুর দিকে। তবে তার আগে বলল,

” বড়মা, চাচী, আপনারা কানে আঙ্গুল দিন। আমি দাদুর সাথে একটু দুষ্টু আলাপ করব। যেগুলো আপনাদের শুনতে ভালো না-ও লাগতে পারে। ”

এরপর সে দাদুর মুখোমুখি হয়ে বলল,

” আর কতদিন এভাবে বউ বউ করে ঘুরে বেড়াবো বল? আমার বউটাকে নিজেদের কাছে রেখে দিয়ে, আমাকেই জব করতে বলছ! বউহীন জীবনটা যে রংহীন টলটলে পানি এটা জানোনা? দাদুর মুখে শুনেছি, তুমিও অল্প বয়সে বিয়ে করে, বউয়ের চারপাশে ঘুরঘুর করতে, আর বছর বছর একটা করে প্রোডাশন দিত দাদিমা। আজ সেই তুমি আমাকে স্বাবলম্বী হতে বলছ! তুমি জানোনা, পুরুষের সকল অনুপ্রেরণার উৎস তার বউ? আমার বয়সে তুমি তিন বাচ্চার বাপ হয়ে, চতুর্থ বাচ্চার প্রতিক্ষায় ছিলে। কিন্তু আমাকে দেখ, আমি বউ বিহীন পরগাছা হয়ে বাপের ঘাড়ে বসে আছি। খাবারে কোন স্বাদ পাইনা, সবকিছুই ঘাসের মত লাগে। ঘুমাতে পারিনা, মনটা বউ বউ করে। বুকটা বউয়ের ছোঁয়া পেতে চায়। আরও অনেককিছুই হয়। সেগুলোও বলব এখন? ”

রাজ্যের এমন নির্লজ্জ কথা শুনে লজ্জায় খুক খুক করে কেশে উঠলেন সৈয়দ শামসুল হক। পারভীন আক্তার রাবেয়া সুলতানার হাত ধরে বাহিরে চলে গেলেন।

” চুপ কর ফাজিল ছেলে। লজ্জা নামক বস্তু কি তোর শরীরে নেই? ”

” বউ না থাকলে পুরুষ মানুষ একটুআধটু নির্লজ্জ হয়। দাওনা আমার বউকে আমার কাছে। একটা সুখের সংসার হোক আমার। তার রংহীন জীবনটাকে আমার ভালোবাসার ছোঁয়ায় রঙিন করতে চাই। ওকে আমার সাত বাচ্চার মা বানাতে চাই। দেখবে আমি কেমন সংসারী হয়ে উঠেছি। ”

সৈয়দ শামসুল হক হেসে হাত রাখলেন রাজ্যের কাঁধে। ছেলেটার চোখে তিনি পেখমের জন্য ভালোবাসা দেখেছেন।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী জামী

” বড়মা, দাদু ভাইয়ের স্যুপ বানানো হয়েছে? ”

রুমে ঢুকেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল পেখম। বড়মার রুমে দাদুর সাথে রাজ্যকে দেখে ও বিস্মিত হয়েছে। সেই সাথে রাগও উঠছে প্রচুর।

” দাদু, এই অভদ্রলোক এখানে কেন? আর তোমারই বা এর সাথে কিসের এত কথা? ” রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে জিজ্ঞেস করল পেখম। পারলে ও রাজ্যের গলা টিপে ধরে।

পেখমকে দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে ওর দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসল রাজ্য। মুখোমুখি হল পেখমের।

” দাদু, চোখ বন্ধ কর প্লিজ। ”

রাজ্যের কথায় দাদু জানালার দিকে তাকালেন।

দাদুকে চোখ ঘোরাতে দেখে রাজ্য তৎক্ষনাৎ ফুঁ দিল পেখমের চোখেমুখে। ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

” যতই আমাকে অভদ্র বল, আমি মোটেও রাগ করবনা। আমার বৃষ্টি বিলাসীনিতে নিজের করে পেতে হলে এই সামান্য কথাটুকু আমি হাসিমুখে সহ্য করে নেব। নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করতে এসেছি আমি। তাই নিজের রাগকে প্রশ্রয় দেবোনা। প্রয়োজনে আমার বৃষ্টি বিলাসীনির সকল রাগ মাথায় তুলে নাচব। নিজের ভালোবাসাকে জয় করতে যা যা করার দরকার আমি করব। ”

রাজ্যের কথাগুলো শুনে রাগে রি রি করছে পেখমের সর্বাঙ্গ। দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকালো রাজ্যের দিকে।

” ভালোবাসা মাই ফুট। কয়েক মিনিটের জন্য আপনার পাশে বসেছি বলেই কি ধরে নিয়েছেন, আপনার কথায় আমি নাচব? তবে আমি বলব, আপনি নিজের ভুল ধারনা বদলানোর চেষ্টা করুন। আমি পেখম কোন স্বস্তা মেয়ে নই, যে আপনার কথায় নাচব। তাই। নিজেকে এতটা প্রাধান্য দেয়ার দরকার নেই। ”

” তুমি স্বস্তা মেয়ে হতে যাবে কেন! সৈয়দ বাড়ির মেয়েরা যে স্বস্তা হতে পারেনা, সেটা আমি কেন অত্র এলাকার সবাই জানে। নিজেকে এতটা নিচু জায়গায় নামিওনা যে মানুষ বাঁকা চোখে দেখে। নিজের সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করোনা। কোন ভদ্র, সভ্য, সুশীলা যেটা করেনা। ”

” আমি কি সেটা আপনার কাছ থেকে শুনবনা মোটেও। অন্যের বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজেরটা ভাবুন। আর এক্ষুণি বেরিয়ে যান এই বাড়ি থেকে। ”

” আমি নিজেরটা নিয়েই মাথা ঘামাচ্ছি। ভবিষ্যতেও ঘামাব। তোমার বোধহয় জানা নেই, আমি নিজের বলতে তোমাকেই বুঝি। কথা ক্লিয়ার? ”

” অসহ্য। দাদু, এই মুহূর্তে তাকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল। এই লোকটাকে আমার সহ্য হয়না। আর তোমরাই বা কেমন, এমন উটকো ঝামেলাকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছ! ”

” এত হাইপার হয়োনা। আগেই বলেছি, নিজের বলতে তোমাকেই বুঝি। সেই সুবাদে আমার, তোমার কোন পার্থক্য থাকার কথা নয়। আর সেই জোড়েই আমি এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। সেটাও যদি না মানো, আরেকটা সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিই। সম্পর্কে তুমি আমার বেয়ান। কানন এই বাড়ির জামাই। সেই হিসেবে আমি আসতেই পারি। ভুল কিছু বললাম, বেয়ান সাহেবা? ” পেখমের দিকে ঝুঁকে বলল রাজ্য।

” একটা মানুষ এতটা অসহ্য কিভাবে হতে পারে! মিনিমাম লজ্জাটাও কি নেই আপনার? ”

” লজ্জা থাকলে কেউ ভালোবাসতে পারেনা। প্রেয়সীর মন পেতে গেলে একটুআধটু নির্লজ্জ হতেই হয়। আর এই যে তুমি আমাকে অসহ্য বলছ, তুমি কি ভেবে দেখেছ, সেদিন আমি ইউএস চলে না গেলে, আজ তুমি আমার বউ থাকতে। তখনও কি আমার কর্মকাণ্ড তোমার কাছে অসহ্য লাগত? মোটেওনা লাগতনা। আমার এই হুটহাট কাছে আসা, তোমাকে বিরক্ত করা এসবের মাঝে তুমি ভালোবাসা খুঁজে পেতে। বরং এসব না করলেই আমি তোমার কাছে আনরোমান্টিক বলে গন্য হতাম। সেদিন আমি সেই অন্যায় করেছি বলেই আজ তুমি আমাকে ‘ অসহ্য ‘ বলার সুযোগ পাচ্ছ। তবে বেশিদিন আমাকে ‘ অসহ্য ‘ লাগবেনা তোমার। তোমার মন আমি ঠিকই জয় করব দেখে নিও। হয়তো কিছুদিন দেরি হবে, কিন্তু অসম্ভব নয়। ” রাজ্যের ঠোঁটের কোনে ঝুলছে এক টুকরো মলিন হাসি।

পেখম রাজ্যের কথা শুনে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। রাজ্যের কথাগুলোর পিঠে কি বলবে সেটা ভুলে গেছে। মনে পরে গেল সেদিনের কথা। যেদিন ওর সকল আশাকে নিমেষেই গুঁড়িয়ে দিয়ে রাজ্য দেশ ছেড়েছিল। প্রথমবার ঠকেছে এই মানুষটার কাছে, দ্বিতীয়বার ওকে ঠকিয়েছে মৃদুল। এই মানুষটা সেদিন ওকে প্রত্যাখ্যান না করলে আজ মৃদুলের কাছে চরমভাবে অপমানিত হতে হতোনা কিছুতেই। সহসাই রাগ তড়তড় করে বাড়তে শুরু করল। রক্তলাল চোখে তাকালো রাজ্যের দিকে। চোখ রাখল রজ্যের চোখে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” ঠক, প্রতারক, আমার সামনে দাঁড়াতে আপনার লজ্জা করেনা? স্বেচ্ছাচারিতা করতে গিয়ে আমাকে সকলের কাছে হাসির পাত্রী বানিয়েছেন। আমাকে ছুঁড়ে ফেলার সময় যখন আপনার মনে কোন ভালোবাসা ছিলনা, এখন আবার হঠাৎ করেই ভালোবাসা উদয় হল কিভাবে? নাকি আমার সেই অপমানে আপনার এখনো পূর্ণ শান্তি মেলেনি? আমাকে পুরোটা শেষ করেই তবে ক্ষান্ত দেবেন? তবে শুনে রাখুন, পারবেননা, কিছুতেই পারবেননা। সেই আগের পেখম আজ আর নেই। আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্য এক পেখম। আপনার করা অপমানেই যার পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। একেকজনের করা অপমানে পেখম নিজেকে ভেঙ্গেচুরে নতুনভাবে গড়েছে। এখন যদি আমাকে আঘাত করতে চান, অপমান করতে চান তবে আপনাকেই ভুগতে হবে ভিষণভাবে। ”

পেখম হাঁপাচ্ছে। মৃদু কাঁপছেও। রাজ্য ভালোভাবেই লক্ষ্য করছে মেয়েটাকে। রাগের মাঝেও মেয়েটার মুখে ফুটে উঠেছে বেদনা। যার জন্য দায়ী একমাত্র সে নিজে।

” যে ভালোবাসতে জানে, সে কখনো আঘাত করতে জানেনা। স্বীকার করছি, সেদিন যখন দেশ ছেড়েছিলাম, তখন তোমার প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসাও ছিলনা আমার মনে। কিন্তু আমি তোমাকে অপমান করার জন্য কিংবা আঘাত করার জন্য চলে যাইনি। সিদ্ধান্তটা নিতান্তই আমার ছেলেমানুষী ছিল। আমি বুঝতে পারিনি, একটা ভুলের জন্য তোমাকে এতটা ভুগতে হবে। ” মাথা নিচু করল রাজ্য। আর কিছুই বলতে পারলনা।

” কি এমন হলো যে হঠাৎ করেই ভালোবাসার আবির্ভাব হলো? ভণ্ডামি করার মানুষ পাচ্ছেননা তাই আমাকেই টার্গেট করেছেন বুঝি? ”

” কি করে বোঝাই তোমাকে। হয়তো ভাগ্য সেদিন চায়নি আমাদের দু’জনের মিলন হোক। সেজন্যই হয়তো আমি তোমাকে আঘাত করেছিলাম। আর তুমিও ঠোকর খেয়েছ। আজ যখন আমি নিজের ভুলের জন্য তোমার কাছে, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, তখন কেন আমাকে অবিশ্বাস করছ! বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই অনুতপ্ত। আমি মন থেকেই তোমাকে পেতে চাইছি। প্রয়োজনে আমাকে শাস্তি দাও। ” ফ্যাঁসফেসে শোনাল রাজ্যের গলা।

রাজ্যের এত আকুতিও পেখমের মন গলাতে পারলনা। ও নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল। সৈয়দ শামসুল হক করুণভাবে তাকিয়ে রইলেন রাজ্যের দিকে। ইচ্ছে থাকলেও তিনি রাজ্যের নিকট গিয়ে দাঁড়াতে পারছেননা। আবার পেখমকেও ভুল বলতে পারছেননা।

***

রুম থেকে বেরিয়েই রাজ্য মুখোমুখি হল মেহনাজের। এমনিতেই ওর মন ভালো নেই, তারওপর মেহনাজকে দেখেই ওর মুখ শুকিয়ে গেল।

” এই রে, ডাকিনীর মুখোমুখিই হতে হল অবশেষে। রাজ্য তৈরী হয়ে যা আরেকদফা অপমানের জন্য। ” বিরবির করে বলল রাজ্য।

” একি! তুমি! তুমি এখানে কি করছ? ”

” বড়মার কাছে এসেছিলাম। ”

” কেন? তার কাছে কি দরকার? এই বাড়িতে ঢোকার বাহানা খোঁজ সব সময়? নিজে ঢুকতে পারোনি বলে, ভাইকে পাঠিয়েছ আমাদের ল্যাজে আগুন দিতে। আর কি চাও? ” খেঁকিয়ে উঠল মেহনাজ।

মেহনাজের কথা শুনে রাজ্য তার শরীরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কিছু একটা দেখতে শুরু করল। হুটহাট রাজ্যের এহেন কাজে মেহনাজ চমকে যায়। সে এক লাফে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,

” এই ছেলে এভাবে কি দেখছ? বেয়াদব একটা। ”

” দেখছিলাম আপনার সত্যিই লেজ আছে কিনা। ” দাঁত কেলিয়ে উত্তর দিল রাজ্য।

” অসভ্য ছেলে, লেজ থাকতে যাবে কোন দুঃখে? ”

” একটু আগেই না বললেন, আপনাদের লেজে আগুন দিতে পাঠিয়েছি! তাই দেখছি আপনার লেজ আছে নাকি। সেই সাথে পরিকল্পনাও করছি, লেজ না আগুন কোথায় দিতে হবে। ”

রাজ্যের গা জ্বালানো কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল মেহনাজ।

” এই ছেলে, তুমি সত্যিই বিদেশে ছিলে? নাকি ঢাকার কোন বস্তিতে টোকাইদের সাথে বড় হয়েছ? কোন সভ্য দেশে বেড়ে উঠা মানুষ কখনো এমন বর্বর হতে পারেনা। আবার নাকি কোন ভার্সিটির টিচার! এমন স্বভাবের টিচারও কি আদৌ হতে পারে! ”

” আমি বর্বর নই চাচী, দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। আমাকে মেয়ে জামাইয়ের চোখে দেখুন। দেখবেন আমাকেই সভ্য, বিনয়ী বলেই মনে হবে। ” বিগলিত হেসে বলল রাজ্য।

” কিহ্ মেয়ে জামাই? পাগল হয়েছ? তোমার মত পাগলের গোষ্ঠীর সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবোনা কখনোই। ”

” একটা মেয়েকে তো অলরেডি দিয়েছেনই। আর ক বছর পর এই পাগলের গোষ্ঠীর বংশধরকে জন্ম দেবে আপনার মেয়ে। তাকে আবার আপনি কোলে নিবেন, আদর করবেন। তার ডায়াপার পাল্টে দেবেন। তাহলে আমাকে মেয়ের জামাই করতে সমস্যা কোথায়? আফটার অল, আমি একজন হাইলি এডুকেটেড পার্সন। ভালো জব করি। আবার দেখতে শুনতেও হ্যান্ডসাম। কি দেবেনতো আপনার মেয়েকে? ” রাজ্য ইচ্ছে করেই মেহনাজের সাথে এভাবে কথা বলছে। ও আসলে মেহনাজকে বিরক্ত করতে চাচ্ছে।

” জীবনেও না। আমার মেয়ে এখনো ছোট। সবেমাত্র সেভেনে পড়ছে। তোমার মত দামড়া গন্ডারের সাথে ওকে মোটেও মানাবেনা। ”

” আহ্ চাচী, রাতের কথা বলছিনাতো। রাত ছাড়া কি এ বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই? আমি তার কথা বলছি। আমার পাশে শুধু তাকেই মানায়, আর তার পাশে আমাকে। ” রাজ্য মেহনাজকে চিন্তার সাগরে ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

মেহনাজ অনেক ভাবল। কিন্তু পেখম ছাড়া বিবাহ উপযুক্ত আর কোন মেয়েকেই পেলোনা। চমকে উঠে সে পারভীন আক্তারকে খুঁজতে শুরু করল। খবরটা তাকে না জানালেই নয়।

চলবে…