সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৩৯+৪০

0
351

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী জামী

” আইভি, ব্যাগ গোছাচ্ছিস যে? কোথাও যাবি নাকি? ” আইভি রহমানকে ব্যাগ গোছাতে দেখে সীমা জিজ্ঞেস করল।

” হুম। এখান থেকে চলে যাব। ” গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন আইভি রহমান।

” হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিলি কেন? আর তাছাড়া আমাকেও জানাসনি। ”

” তোকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি, তাই জানাইনি। অনেকদিন হয়ে গেল তোর এখানে আছি। আর কতদিন থাকব। ”

” তুই কিন্তু বলেছিলি, বাকিটা জীবন তুই এখানেই থাকবি। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলি কেন? ”

” যখন বলেছিলাম, তখন জানতে পারিনি তুই এত খারাপ মানুষ। এতদিন তোর বাসায় ছিলাম, তোর হাতের খাবার খেয়েছি, তোর পাশে শুয়েছি এসব মনে হলেই আমার বমি পাচ্ছে। ”

” তুই কি পাগল হয়েছিস, আইভি? কি সব বলছিস! আমি আবার কি করেছি? ”

” কি করিসনি তুই? তুই কি অস্বীকার করবি, পার্লার ব্যাবসার আড়ালে তুই মেয়েদর দিয়ে দেহব্যবসা করাস? তোর নিচের ফ্ল্যাটে যেসব মেয়েদের আসতে-যেতে দেখেছি তারা সবাই তোর নির্দেশেই কাজ করে। নিচের ফ্ল্যাট তোর ব্যাক্তিগত পতিতালয় এটা অস্বীকার করতে পারবি? এতকিছুর পরও তোর সাথে থাকার রুচি আমি পাচ্ছিনা। আগে যদি তোর চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারতাম, তবে কখনোই তোর সাথে আসতামনা। ”

আইভি রহমানের অভিযোগ শুনে অনেকক্ষণ নিরব থাকল সীমা। এরপর মুচকি হেসে বলল,

” সবই যখন জেনে গেছিস, আর কি বলব। তবে তুই এখান থেকে যেতে পারবিনা। আমি তোকে যেতে দেবোনা। তোর দুঃসময়ে তোকে আমার বাসায় আশ্রয় দিলাম, নিজের খরচে তোকে খাওয়ালাম। আমার পুঁজি তোর পেছনে ঢাললাম। এভাবে যেতে দেয়ার জন্য? ”

” কি করতে চাইছিস তুই? ” অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আইভি রহমান।

” অনেক কিছুই, আবার কিছুই না। ”

” আমি যাবোই। আমাকে তুই আটকাতে পারবিনা। ” আইভি রহমান ব্যাগ হাতে নিতেই সীমা তার হাত চেপে ধরল।

” আমার হাত ছাড় বলছি। ” হাত মোচড়াচ্ছেন আইভি রহমান। একপর্যায়ে তিনি ধস্তাধস্তি শুরু করলেন।

ইতোমধ্যে সীমা হাঁকডাক করে তার দু’জন সহযোগীকে ডেকে নিয়েছে। যারা এই বাসাতেই থাকে। তিনজন মিলে আইভি রহমানকে পরাস্ত করে ফেলেছে। একজনতো তাকে দু ঘা লাগিয়েও দিয়েছে। আইভি রহমান হতভম্ব হয়ে গেছেন। জ্ঞান হবার পর থেকে তাকে কেউ কখনো ফুলের টোকা দেয়নি। সেই তিনিই আজ একজন প্রস্টিটিউটের হাতে মার খেলেন! বিষয়টা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে।

” এই তোমরা দু’জন একে শক্ত করে ধরে রাখ। আমি এর মুখ বাঁধছি। নইলে চিৎকার করে আশেপাশের লোকজন ডেকে আনবে। ”

আইভি রহমানের মুখ বেঁধে সীমা ফোন করল কাউকে। অসহায় চোখে আইভি রহমান সব দেখে গেলেন। এরইমধ্যে সেই দু’জন মেয়ে তার দু হাতও বেঁধেছে।

কিছুক্ষণ পর দু’জন ছেলে আসল রুমে। তাদের একজন আইভি রহমানের কপালে পিস্তল ঠেকাল। অপরজন সীমার কথামত আইভি রহমানের ব্যাগ তল্লাশি শুরু করল। কিছুক্ষণ পর তাদের মুখে হাসি ফুটল। আইভি রহমানের ব্যাংকের চেকবই, ক্রেডিট কার্ড তাদের হাতে পৌঁছে গেছে।

” পেয়ে গেছি, ম্যাডাম। এবার কি করতে হবে বলুন ? ” দু’জন ছেলের একজন জানতে চাইল।

” এর থেকে আগে চেক বইয়ে সিগনেচার করে নিতে হবে। এরপর ক্রেডিট কার্ডগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে। শোন আইভি, ভালোয় ভালোয় সিগনেচার করে দে। নইলে তোর লাশ কোন ড্রেনের তলায় নিজের জায়গা খুঁজে নেবে। জেনে রাখ, আমি তোর সাথে মজা করছিনা। ” এক টানে আইভি রহমানের মুখের বাঁধন খুলে দিল সীমা।

” তুই এটা করতে পারিসনা। এই টাকাগুলোই আমার শেষ সম্বল। আমার স্বামী, ছেলে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছ্যেদ করেছে। এই টাকাগুলোই এখন আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আমি কিছুতেই সিগনেচার দেবোনা। ” আইভি রহমান কথা শেষ করতে পারলেননা। সীমার থাপ্পড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার দু’চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রু। এতটা অপমানও তার ভাগ্যে ছিল? এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, এসব তার কর্মেরই ফল।

” আমি বলেছিনা, তোর সাথে মজা করছিনা? তোকে মারতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে, শুনেছিস তুই? তোকে এই কয়মাস এমনিতেই এখানে রেখেছি? বসিয়ে বসিয়ে খাইয়েছি? আমার প্ল্যান ছিল ধীরে ধীরে তোর কাছ থেকে টাকা আদায় করা। কিন্তু তুই যখন সবকিছু জেনেই ফেলেছিস, তখন তো আর লুকিয়ে লাভ নেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিগনেচার কর, নইলে তোকে মরতে হবে। ”

আইভি রহমান সীমার কথা মানতে চাইলেননা। সীমাও তাকে ছাড়লনা। বেশ কয়েকটা থাপ্পড় মারল। বাধ্য হয়ে আইভি রহমান চেকবইয়ে সিগনেচার করলেন। কাজ শেষ হলে তার মুখে আবারও কাপড় বেঁধে, হাত বেঁধে দিল সীমা। দু’জন ছেলে চেকবই, ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল। সীমা তাদের বলেছে আইভি রহমানের সব টাকাগুলো তুলে নিতে।

কয়েকঘন্টা পর ছেলে দু’জন টাকা নিয়ে ফ্ল্যাটে আসল। চল্লিশ লক্ষ টাকা পেয়ে সীমা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল।

” একে আপাতত কিছুদিন ঘুম পারিয়ে রাখি। গেষ্টরুমে ইনজেকশন পাবে, নিয়ে এস। একমাস পর একে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলেই হবে। ” সীমা খুশিতে আত্নহারা হয়ে বলল।

কিছুক্ষণ পরেই আইভি রহমান ঘুমে টলে পরলেন মেঝেতে।

***

” রাবোয়া, তুই সব সময় মন খারাপ করে থাকিস কেন বলতো? সানোয়ার কি তোর সাথে যোগাযোগ করেছিল? কিছু বলেছে তোকে? ” পারভীন আক্তার রাবেয়া সুলতানাকে জিজ্ঞেস করলেন। রাবেয়া সুলতানা উঠানের খোলা রান্নাঘরে কাজ করছিলেন।

” আমার কি শুধু একটাই চিন্তা, ভাবী। নিজেকে নিয়ে যতটা না চিন্তা করি, তার থেকেও বেশি চিন্তা হয় পেখমকে নিয়ে। মেয়েটার সামনে গোটা জীবনটাই পরে আছে। কিভাবে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দেবে সেটাই আমার ভাবনা। এতসব চিন্তার মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে আপনার দেবর। সে কি চাচ্ছে আমার বোধগম্য হচ্ছেনা। সে কেন বুঝতে চাচ্ছেনা, আমি আর তার সাথে নিজেকে জড়াতে চাইনা! যেখানে আমার ছেলেমেয়েরা তাকে চাচ্ছেনা, সেখানে আমি কিভাবে তাকে মেনে নেব? ”

” তুই কি শুধু ছেলেমেয়ের কথা ভেবেই ওকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিস? সেটাই যদি হয়, তবে আমি পেখম, রিশানের সাথে কথা বলব। আমার বিশ্বাস ওরা এতটাও অবুঝ নয়, যে মা’য়ের কষ্ট বুঝবেনা। ”

” আমিও তাকে চাইনা, ভাবী। আপনি শুধু শুধু ছেলেমেয়েদের কাছে আমাকে লজ্জায় ফেলবেননা। যে মানুষটা কোনদিন আমাকে ভালোবাসেনি, আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। সুখের সংসার গড়েছে। সেই মানুষটা হঠাৎ এত বছর এসে ভালোবাসা দেখাবে এটা আমি মানতে পারছিনা। তার এই ভালোবাসা সত্যি হলেও আমি তাকে মনে নেবোনা। সে তার পূর্বের আচরণ ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি আর ভুলবওনা। ”

” সরি, সরি ভুল সময়ে এসে পরেছি। আপনারা কথা শেষ করুন আমি একটু পর আসছি। ” হঠাৎ করেই রাজ্য এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের দরজায়।

রাজ্যকে অসময়ে দেখে অবাক হয়েছেন দু’জনেই।

” পরে আসবে কেন? এখনই এস। ” পারভীন আক্তার রাজ্যকে ভেতরে ডাকলেন।

” আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটালামনাতো? ”

” মোটেওনা। এখানে বস। ” পারভীন আক্তার একটক টুল এগিয়ে দিলেন।

” হবু শ্বাশুড়িমা, আপনার মুখে আঁধার ঘনিয়েছে কেন? এনি প্রবলেম? ”

” এই ছেলে, কে তোমার হবু শ্বাশুড়িমা? আমার মেয়ে রাজিই হলোনা, এদিকে তুমি আমাকে শ্বাশুড়ি বানিয়ে ফেললে! ”

” মেয়ের মা’ই সব। মেয়ের মা রাজী মানে অর্ধেক বিয়ে হয়ে গেছে। আপনার মেয়েকে চাইলে কয়েকদিনের মধ্যেই পটিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু সেটা করবনা। যাক কিছুদিন। ”

” কথা শোন ছেলের। তুমি কি চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে রাস্তাঘাটে বখাটেদের মত ঘোরাঘুরি শুরু করেছ? আমার মেয়েকে বিয়ে যে করতে চাচ্ছ, বিয়ের পর সংসার চলবে কিভাবে? বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দেবোনা আগেই বলে দিলাম। ”

” ছিহ্ শ্বাশুড়িমা, আপনি আমাকে বখাটে বলতে পারলেন! এই উপাধি আমি আপনার মেয়ের মুখে শুনতে চেয়েছিলাম। যাহোক, বলেই যখন ফেলেছেন, তখন শুনে রাখুন আমি একটা স্বাধীন ব্যাবসার কথা ভেবে রেখেছি। আপনার মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমিই নেব। তার আগে আমাকে হাজার পঞ্চাশেক টাকে দিতে বলবেন সৈয়দ শামসুল হককে। ঐ টাকা দিয়ে আমি একটা হারমোনিয়াম আর ডুগিতবলা কিনব। সেগুলো গলায় ঝুলিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে চুলকানির মলম বিক্রি করব। যা ইনকাম হবে, দু’জনের সংসার বেশ চলে যাবে। ”

রাজ্যের কথা শুনে দু জা জোরে হেসে উঠলেন। পারভীন আক্তার রাজ্যের মাথায় আলতে করে টোকা দিলেন।

” ফাজিল ছেলে, আসল কথা বাদ দিয়ে আজেবাজে কথা বলে। সত্যি করে বল, চাকরি ছেড়ে দিয়েছ? ”

” উঁহু। ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ আছে আমার। ছুটির এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দেশে এসেছিলাম। পরে যেতে দেরি হওয়ায় অথরিটিকে জানিয়ে দিয়েছি, যেতে আরও দেরি হবে। আমি রিজাইন দেব। কিন্তু তারা আমার প্রস্তাব মানেনি। আমার জায়গায় টেম্পোরারি টিচার নিয়োগ দিয়েছে। আমি বছরখানেক ছুটি পাবো। তবে এক বছরের মধ্যে আপনাদের মেয়ে রাজি না হলে আমাকে সত্যিই চাকরিটা ছাড়তে হবে। ”

” এত ভালো চাকরি তুমি ছেড়ে দেবে? আমি বলি কি তুমি ফিরে যাও। আমরা পেখমের সাথে কথা বলি, ওকে রাজি করাই, তারপর তুমি আবার এস। ”

” সরি, বড়মা। আমি ওকে রেখে কোথাও গিয়ে থাকতে পারবনা। চিন্তা করবেননা, চাকরি আমি ঠিকই পেয়ে যাব। ভার্সিটি টপার আমি। আমার চাকরির খোঁজ না করলেও চলবে, চাকরি আমাকে ঠিকই খুঁজে নেবে। ”

” তোমাদের এখনকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি বোঝা দায়। তোমাদের মন-মস্তিস্কে কি চলে সেটা তোমরাই ভালো জানো। এবার বল কেন এসেছ? কারন ছাড়া নিশ্চয়ই এখানে আসোনি? ”

” কারন ছাড়া এই পাগলাগারদে কোন পাগলও আসবেনা। কিন্তু আমার দাদীমাকে সেটা কিভাবে বোঝাই বলুন? তার ইচ্ছে হয়েছে সে পেখমকে দেখবে। আর এই সংবাদটা আমাকেই পৌঁছে দিতে হবে। আপনারা একবার ওকে নিয়ে যান দাদীমার কাছে। দাদীমা হয়তো বেশিদিন বাঁচবেনা। ”

” পেখমকে এই কথা কিভাবে বলব, ভাবী? সেদিন কাননও বলল চাচীর শরীরটা ভালো নয়। আমাদেরও তাকে দেখতে যাওয়া দরকার। কিন্তু পেখমকে রাজী করাবে কে? ” রাবেয়া সুলতানা উত্তরের আশায় চাইলেন পারভীন আক্তারের দিকে।

” আপনার না পারলে আমাকে জানাবেন। আমি আপনার মেয়েকে কোলে করে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। ”

” বড় ভাবী, মেজো ভাবী, এই ছেলে এখানে কেন? তোমরা একে এত আস্কারা দিচ্ছ কেন এটাই আমি ভেবে পাচ্ছিনা। এই ছেলেটাই আমার ঋতকে বিয়ের জন্য উস্কে দিয়েছিল। এ-ই নাটেরগুরু। ” মেহনাজ এসে রাজ্যকে দেখে রেগে উঠল।

” হবু শ্বাশুড়ি আম্মা, আপনার মেয়েকে উস্কানোর আমি কে? আপনার মেয়েই যে অকালে পেকে গিয়েছিল, সেই খবর রাখলে আজ আপনি আমাকে দোষারোপ করতে পারতেননা। সাধেই তো আর বলিনা, এটা বাড়ি নয় পাগলাগারদ। আমি চললাম, হবু শ্বাশুড়িগন্স। কখন যেতে পারবেন আমাকে জানিয়ে দিয়েন। আমার রাজ্যের রানীকে অভর্থ্যনার আয়োজন করতে হবে। ” রাজ্য কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

” ও এসব কি বলে গেল, ভাবী? বারবার ও আপনাদের শ্বাশুড়ি বলছে আর আপনারাও মজা নিচ্ছেন? ”

” মেহনাজ, আমরা মজা নিচ্ছিনা। ছেলেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বারবার আমাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছে। সুযোগ চাচ্ছে। আমরা শুধু ওকে একটা সুযোগ দিতে চাচ্ছি। ”

” পেখম জানে? ”

” নাহ্। তবে পেখমের বিষয়টা রাজ্যই সামলাতে চেয়েছে। ”

” আমার কিছুই বলার নেই। তবে দেখবেন মেয়েটা যেন আরও একবার আঘাত না পায়। ”

” পেখমের জন্য তোর চিন্তা দেখে আমার ভালো লাগছে। তোর মত আমরাও পেখমের জন্য চিন্তা করি, মেয়েটার ভালো চাই। শেষটা যেন সুখের হয় সেটাই আমরা চাই। ”

” মাঝখানে আমার ঋতের কপাল পুড়ল। ”

” এসব কি বলছিস, মেহনাজ? ঋত সুখে আছে। কানন ওকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। ঐ বাড়ির সবাই ঋতকে মাথায় তুলে রাখে। তুই মা হয়ে যদি এসব কথা বলিস, তবে পাড়াপ্রতিবেশিরা কি বলবে? মেয়ে যেখানে সুখে আছে, সেখানে তুই অশান্তিতে ভুগছিস কেন? মেয়ের সুখে কি তুই সুখী নোস? ” রাবেয়া সুলতানা বললেন।

” কিজানি। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমার মন কেন যেন মানতে চায়না। ”

” একবার মনকে প্রবোধ দে। ঋতের সুখী চেহারার দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে দেখ। দেখবি তোরও ভালো লাগবে। ”

” চেষ্টা করব, ভাবী। কিন্তু ঐ ছেলেটা তোমাদের কোথায় যেতে বলল? ”

” চাচী অসুস্থ। সে পেখমকে দেখতে চেয়েছে। রাজ্য এসেছিল আমাদের জানাতে। ”

” যাবে তোমরা? ”

” যেতে তো হবেই। ”

” আমাকেও নিয়ে যেও। মেয়ের সংসারটা একবার দেখে আসব। ”

” আচ্ছা, যাস। ”

তিন জা কিছুক্ষণ নিরব থাকল। পারভীন আক্তার আর রাবেয়া সুলতানা ভাবছেন কিভাবে পেখমকে রাজী করাবেন। মেহনাজ ভাবছে, শেষমেশ হয়তো কাননকেই মেয়ে জামাই বলে মেনে নিতে হবে। ওদের সাথেই আত্নীয়তা করতে হবে। নিজের চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়ে এখন মেয়ের চাওয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪০
জাওয়াদ জামী জামী

” এই যে বাবা, তোমাকে সেদিন আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম মনে হয়? সেদিন তুমি ছাড়া সবার সাথেই কথা বলেছি। তোমার পরিচয়ও জানা হয়নি। ”

রাজ্য আর কানন কেনাকাটার জন্য শহরে এসেছে। ওরা কাজ শেষ করে বাড়িতে ফেরার পথে কাকতালীয়ভাবে সানোয়ার হোসেনের সাথে দেখা হযে গেল। ওরা দু’জন এখানে সানোয়ার হোসেনকে দেখে অবাকই হয়েছে।

” চাচা, আপনি এখানে? চলুন কোথাও গিয়ে বসি। ” পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট দেখে সেখানে গিয়ে বসল তারা।

” আমি কানন আর এ আমার ভাইয়া রাজ্য। আমরা মীর রেজাউল করিমের নাতি। আমার আরেকটা পরিচয়ও আছে। আমি রাকিব চাচার মেয়ে ঋতকে বিয়ে করেছি। ” রেস্টুরেন্টে বসে প্রথমে কথা বলল কানন।

” তোমরা মীর চাচার নাতি! তোমরা কার ছেলে? ” সবিস্ময়ে জানতে চাইলেন সানোয়ার হোসেন।

” আমি মীর হাসিবের ছেলে। আর ভাইয়া মীর আমজাদ হোসেনের ছেলে। ”

” তুমি রাজ্য! ”

” জ্বি। ” রাজ্য দু’জনের কথপোকথন শুনেই বুঝেছে মানুষটা কে হতে পারে।

” কত বড় হয়ে গেছ তোমরা! রাজ্য, তোমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমি বাড়িতে আসলে তুমি আমার সাথে বেশিরভাগ সময় কাটাতে? তোমাকে নিয়ে কত জায়গায় বেড়াতে গেছি আমি? ”

” অল্প অল্প মনে পরে। আমাদের বাড়িতে আপনার ভালোই যাতায়াত ছিল। এরপর আমি চলে গেলাম দেশের বাহিরে। তারপর কারো খোঁজ নেয়া হয়ে ওঠেনি। হুট করেই একদিন শুনলাম, আপনি বাড়ি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। দাদুর সাথে কথা বলতে গেলেই তিনি আপনার কথা বলে আফসোস করতেন। ”

রাজ্যের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” সেদিনের সেই ভুলের মাশুল আজ দিচ্ছি। আমি সেদিন যেমন দম্ভভরে সবাইকে ছেড়ে গিয়েছিলাম, তেমনি আজ সবাই আমাকে ত্যাগ করেছে। নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছেও আজ আমি মূল্যহীন। তারা আমার উপস্থিতিও সহ্য করতে পারেনা। ”

” এর জন্য কি আপনিই দায়ী নন? মাফ করবেন, আপনি আমার গুরুজন। আপনার ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে হয়তো আপনার সাথে কথা বলা আমার শোভা পায়না। তারপরও বলতে হচ্ছে। কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যেগুলো আমরা আবেগের বশে নিয়ে থাকি, সেগুলো কি আসলেই আমাদের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসে? আপনি রাবেয়া চাচীকে চরমভাবে ঠকিয়েছেন। একবারও কি ভেবে দেখেছিলেন, আপনি চলে যাওয়ায় চাচীর ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছিল? একজন যুবতী মা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমাজের মুখোমুখি হয়েছে কিভাবে? আপনি কিন্তু আবেগের বশে ঠিকই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আবেগের সাথে সমঝোতা করেননি। বরং বিবেককে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আঁকড়ে ধরেছেন আপনার ছেলেমেয়েকে। তাদের মুখ চেয়েই বেঁচে আছেন। তিনি আবেগকে পরাস্ত করেছেন। সেই সাথে পরাস্ত করেছেন নিজের সকল চাহিদা। আর আপনার ছেলেমেয়েরা? তারা কিন্তু আপনার পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়েই বেড়ে উঠেছে। অথচ একজন কর্মক্ষম বাবা তাদের ছিল । আজও তারা আপনার পরিবারের মানুষদের ওপরই নির্ভর করে। এবার বলুন, তাদের অবস্থান থেকে আপনাকে বয়কট করা কি অন্যায়? আপনার একটা ভুল আপনার ছেলেমেয়ের জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। পেখম চলার পথে হোঁচট খেয়েছে। ওকে দু’জন মানুষ ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ঠকেছে ও। ঠিক তার মা’য়েরই মত। ও যতবার চাচীর দিকে তাকায় নিশ্চয়ই ততবারই আপনার কথা মনে হয়। রিশানের ক্ষেত্রেও তাই। ওরা যে আপনাকে মেনে নেবেনা এটাই কি স্বাভাবিক নয়? এখন আপনার বদলে যাওয়া, আপনার ভুল স্বীকারোক্তি কোনটাই তাদের ওপর প্রভাব ফেলছেনা। ”

” তোমার কথায় যুক্তি আছে। আমি স্বীকার করছি নিজের অপরাধ। আমি একজন ঘৃণিত স্বামী, ঘৃণিত পিতা। শত অপরাধের পরও তো আমি একজন স্বামী, একজন পিতা। আর সেজন্যই বোধহয় তাদেরকে আরেকবার ফিরে পেতে চাইছি। ”

” ফিরে চাইলেই কি সব ফিরে পাওয়া যায়? যদি ফিরে পাওয়া যেত তবে আমি আমার বৃষ্টি বিলাসীনিকে কবেই আপন করে পেতাম। নিজের করে নিতাম। আমিও যে তার কাছে আপনার মতই অপরাধী। ” আনমনে বিরবির করে বলল রাজ্য।

সানোয়ার হোসেন ভ্রু কুঁচকে তাকালেন রাজ্যের দিকে। তিনি বুঝতে পারলেননা ছেলেটা হঠাৎ কেন নিরব হয়ে গেল।

” চাচা, এটা আপনার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়। এই বিষয়ে কোনকিছু বলা আমাদের শোভা পায়না। আর তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমরা পেখম, রিশানকে দেখেছি। চাচীকে দেখেছি। তাদের স্ট্রাগল দেখেছি। সেজন্য স্বভাবতই আমাদের রায় ওদের পক্ষেই যাবে। আপনি বরং এসব নিয়ে চাচীর সাথে একান্তে কথা বলুন। তিনি যেটা চান সেটা মেনে নিন। তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করুন। এতটুকুই বলতে পারি আমরা। ” রাজ্যকে চুপ থাকতে দেখে কানন বলল। রাজ্যের হাবভাব ওর ভালো লাগছেনা।

” চাচা, আমি শুনেছিলাম পেখম, রিশান ছাড়াও আপনার ছেলেমেয়ে আছে? আরেকটা সংসার আছে? তারা আপনার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেবে? ” রাজ্য জিজ্ঞেস করল।

” জীবন আমাকে অনেককিছুই শিখিয়েছে। তিনজনকে অবহেলার বিনিময়ে আমার ভাগ্যে অবহেলাই জুটেছে। জুটেছে অপমান আর তিরস্কার। আমার থাকা না থাকায় তাদের যায় আসেনা। ”

” এবার বুঝলাম। এক কূল হারিয়ে আপনি পুরোনো কূলে আবারও নতুন করে বাঁসা বাঁধতে চাইছেন? তারমানে আপনি, দ্বিতীয় পক্ষের কাছে অবহেলিত হয়ে প্রথমপক্ষের কাছে এসেছেন! ভালোবেসে নয়? তারা যদি আপনাকে ভালোবাসত, সম্মান করত তাহলে বোধহয় আপনি এখানে আসতেননা? আপনার পিতৃস্নেহ হঠাৎ করেই উথলে উঠার কারন এটাই? আর এদিকে আমি ভেবেছিলাম, আপনি সত্যিই এদের ভালোবেসে এখানে এসেছেন। ভেবেছিলাম, আপনার পক্ষ নিয়ে চাচীর সাথে কথা বলব, তাকে বোঝাব। দাদুকে বলব, আপনাকে মেনে নিতে। এখন মনে হচ্ছে, আমার ধারনা কতটা ভুল ছিল। আশ্চর্য মানুষ আপনি! নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেননা দেখছি। ”

সৈয়দ সানোয়ার হোসেন মাথা নিচু করলেন। রাজ্য তাকে এভাবে দোষ দেবে তিনি বুঝতে পারেননি। সত্যিই কিন্তু তিনি এক কূল হারিয়ে আরেক কূল আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন। তবুও তিনি হার মানলেননা। রাজ্যকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

” আমার ভুল বুঝোনা। আমি সত্যিই আমার স্ত্রী-সন্তানদের ফিরে পেতে চাই। সত্যিই আমি ওদের ভালোবাসি। তুমি একটু রাবেয়াকে বোঝাও। ”

রাজ্য মৃদু হেসে তাকায় সানোয়ার হোসেনের দিকে। এই মুহূর্তে মানুষটাকে ওর সহ্য হচ্ছেনা। তাকে স্বার্থপর ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছেনা। ভিষণই বিরক্ত লাগছে তাকে।

***

পেখম বিরক্তি নিয়ে মীর বাড়িতে পা রাখল। নেহাৎ বড়মা অনুরোধ করেছে। তাই সে এই বাড়িতে পা রেখেছে। নয়তো রাজ্যের মত বেয়াদব মানুষের উপস্থিতিতে এই বাড়িতে আসার কোন ইচ্ছেই ছিলনা ওর।

পেখমকে দেখে রাজিয়া পারভীন উচ্ছ্বসিত হয়ে এগিয়ে আসলেন।

” পেখম মা, তুই এসেছিস? কেমন আছিস তুই? এসো রাবেয়া, ভেতরে এসো। ” রাজিয়া পারভীন তাদেরকে নিয়ে গেলেন তার শ্বাশুড়ির কাছে।

পেখমকে দেখে বৃদ্ধা ভিষণ খুশি হলেন। ওকে নিজের পাশে বসিয়ে নিলেন। নানান গল্প শুরু করলেন তিনি।

” রাজিয়া, রাজ্য কোথায়? ওকে দেখছিনা যে? আর আমাদের ঋত সোনা কই? ওর শ্বাশুড়িই বা কোথায়? ”

” কাননকে নিয়ে ও কেনাকাটা করতে গেছে। ঋত ওর শ্বাশুড়ির রুমে আছে। শ্বাশুড়ির সাথে গল্প করছে। আপনি বসেন ভাবী, আমি ওকে ডেকে আনছি। ”

রাজ্য বাড়িতে নেই শুনে পেখম হাঁফ ছাড়ল। অসহ্য মানুষটাকে দেখতে হবেনা ভেবেই স্বস্তি লাগছে।

ঋত মা, বড়মা আর পেখমকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলল। ওর আম্মু যে এই বাড়িতে আসবে সেটা ওর কল্পনাতেই ছিলনা। কিছুক্ষণ মা’য়ের বুকের সাথে মিশে রইল মেয়েটা।

রাজিয়া পারভীন সকলকে নিয়ে গেলেন। তার শ্বাশুড়ি অসুস্থ, তাই এই রুমে বেশি হট্টগোল করতে মানা করেছেন বাড়ির ছেলেরা। সবাই রাজিয়া পারভীনের সাথে গেলেও পেখম রইল দাদীমার কাছে। দাদীমাও ওকে ছাড়তে চাইছেনা।

রাজ্য বাড়িতে ঢুকে অতিথিদের দেখে অবাক হয়ে গেছে। ও হাসিমুখে এগিয়ে গেল সকলের দিকে।

” আম্মু, তোমার নিজের বেয়ান আর হবু বেয়ানদের ঠিকভাবে আপ্যায়ন করেছ তো? মনে রেখ, তোমার আপ্যায়নের ওপরই আমার ভাগ্য পাল্টাতে পারে। ঠিক বলেছিনা, হবু শ্বাশুড়িগন্স? ”

রাজ্যের কথা শুনে মেহনাজ একটু অবাকই হয়। রাজ্য যে পেখমের বিষয়ে সিরিয়াস এটা সে বুঝতে পারছে। আর রাজ্যের মা-ও ছেলের কথায় কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। বরং সে হাসিমুখে ছেলের কথা মেনে নিল। এটাও তাকে অবাক করেছে। এখন তার মনে হচ্ছে, এই পরিবারের মানুষগুলো খারাপ নয়।

” ফাজিল ছেলে, আমাদের আপ্যায়ন করার কিছুই নেই। আমরা কি অতিথি নাকি? বিয়ের পর থেকেই এই বাড়িতে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছি। আর আমাদেরকেই বলছে আপ্যায়ন করতে। ” পারভীন আক্তার মৃদু ধমকে উঠলেন।

” তখনকার বিষয় আর এখনকার বিষয়ে অনেক পার্থক্য, বড়মা। তখন আপনারা ছিলেন দাদুর বন্ধুর দিকের আত্মীয়। আর এখন আপনারা কাননের শ্বশুর বাড়ির দিকের আত্মীয়। আবার ভবিষ্যতে আমার শ্বাশুড়িও হতে চলেছেন। একের ভেতর তিন যাকে বলে। আপ্যায়নও সেরকমই হওয়া দরকার তাই না? ও হবু শ্বাশুড়িমা, আপনার মেয়ে আসেনি? মেয়েকে ছাড়াই জামাই বাড়িতে এসেছেন? ”

” একটু তো লজ্জা কর, বাপ? এখানে আমরা সবাই গুরুজন। ”

” গুরুজন মানছি, পর তো নও। বলনা, তোমার বউমা এসেছে? ”

” তোর দাদীমার কাছে। ”

” ওকে। তোমরা গল্প কর। আমার হবু শ্বাশুড়িদের আদরযত্ন কর ঠিকভাবে। আমি একটু তোমার বউমাকে বিরক্ত করে আসি। ”

” রাজ্য, এমন কিছু বলবিনা যাতে মেয়েটা রেগে যায়। ও রেগে গেলে তোর খবর আছে। ”

” শান্ত হও, মাতা। ”

***

” দাদীমা, তোমার এত টেনশন কিসের বলতো? তোমার ছেলেরা তোমাকে মাথায় করে রেখেছে। তুমি খাবে দাবে আর আল্লাহকে ডাকবে। কিন্তু সেগুলো না করে তুমি একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে আছ। কেন, দাদীমা? ”

” তার নাতীর জন্য। বউহীন নাতীকে দেখে তার সুখ-শান্তি উধাও হয়েছে। তার আদরের নাতী শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়, সেটা তার ভালো লাগেনা। আমি ঠিক বলেছিনা, দাদীমা? আমার বউ দেখার জন্য তোমার যত টেনশন, তাইনা? ”

হুট করেই রাজ্যকে আবির্ভাব হতে দেখে পেখমের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। ও স্থির হয়ে রইল।

” দাদু ভাই, তুমি আমার বুবুকে রাগিয়ে দিওনা। ”

” আমি ভুল কি বললাম! তোমার বুবুকে দেখার পর, তুমি দিব্যি সুস্থ হয়ে গেছ, এটা কি তোমার বুবু লক্ষ্য করেছে? তারমানে কি দাঁড়াল? তোমার নাতীর বউ দেখলেই তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে, এই তো? তোমার বউহীন নাতীর সুখ আর তোমার সুস্থতা এক সুতোয় বাঁধা, এটা তুমি কেন বলছনা তোমার বুবুকে? ”

” দাদীমা, আমি গেলাম। এই অসভ্য মানুষের সামনে বসে থেকে তার আজাইরা প্যাচাল শোনার কোন ইচ্ছে আমার নেই। ” পেখম উঠতে গেলেই রাজ্য ওর হাত ধরে পুনরায় বসিয়ে দিল।

” এত যাই যাই কর কেন? আমার মনে ঝড় তুলে, এত পালাই পালাই করলেই কি আমি মেনে নেব? তুমি যেমন ঝড় তুলেছ, তেমনি তুমিই ঝড় থামাবে বুঝলে? ”

” আমি বাহিরে যাব। ”

” আমার কথা শোনার পরই তুমি ছাড়া পাবে। এস আমার সাথে। ” রাজ্য পেখমের হাত ধরে নিয়ে গেল ওর রুমে। পেখম বাঁধা দিয়েও ওকে আটকাতে পারলনা।

” কি শুরু করেছেন আপনি? আমাকে কি আপনার হাতের পুতুল ভেবেছেন? ” রাজ্যের রুমে এসেই খেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল পেখম। ওর হাত তখনো রাজ্যের হাতের মুঠোয়।

” উঁহু। তুমি পুতুল হতে যাবে কেন? তুমিতো আমার রাজ্যের রানী। ”

” ঢং করছেন? আপনার ঢং আমার বিরক্ত লাগে। ”

” আর বিরক্তির মাঝেই আমি ভালোবাসা খুঁজে বেড়াই। ”

” অসহ্য। ”

” ভালোবাসি। ”

” আমি আপনাকে ঘৃণা করি। ”

” সত্যি? ”

পেখম থমকায়। সেই কিশোরী বয়সের আবেগ আজও গেঁথে আছে হৃদয়ে। তাকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখেছিল, সেগুলো আজও অমলিন। সেগুলো কি কভু ভোলা যায়? ওর কিশোরী মনে ঝড় তুলেছিল রাজ্য নামক মানুষটা।

” বল সত্যি কিনা? ” রাজ্য আবারও জিজ্ঞেস করল।

” কেন এসেছেন? আমার শরীরে ডিভোর্সির ট্যাগ। তারপরও কেন এমন করছেন? সমাজের ভয় নেই আপনার? ” ফুঁপিয়ে উঠলো পেখম।

” সমাজকে আমি থোড়াই কেয়ার করি? আমার কাছে ভালোবাসা আগে। পরে দুনিয়ার সবকিছু। আর ভালোবাসা কোন বাঁধা মানেনা। ডিভোর্স নামক শব্দটা ভালোবাসার কাছে নস্যি। ”

” অন্য একজনের ছোঁয়া কাউকে নিজের করে পেতে ঘৃণা করবেনা আপনার? আমার পুরো শরীরে অন্য একজনের ছোঁয়া লেপ্টে আছে। ও আমাকে এখানে ছুঁয়েছে, এখানে ছুঁয়েছে আমার সর্ব শরীর ছুঁয়েছে ও। আবেগের বশে ভালোবাসি বলছেন, পরে আপনার আফসোস হবেনা? ” পেখম পাগলের মত করছে।

” মোটেওনা। তোমাকে ভালোবাসি মানেই এই নয় যে তোমার শরীরই আমার কাছে সব। আমি তোমার শরীর নয়, মন ছুঁতে চাই। শরীর ছোঁয়াছুঁয়ির খেলাকে আমি ঘৃণা করি। আমি বিশ্বাস করি, মন ছুঁতে পারলেই শরীর আমার বশে আসবে। আর একবার মন ছুঁতে পারলেই, ভালোবাসায় সিক্ত হয় দু’টো জীবন। যে ভালোবাসা হীনতায় আমি ভুগছি। তুমিই পারো আমাকে ভালোবাসায় সিক্ত করতে। ”

পেখম কিছুই বললনা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। ও বেশ বুঝতে পারে ওর মা, বড়মাও চায় ওকে এই মানুষটার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু পেখমের বিবেক বাঁধা দেয়। যখনই মনে হয়, ও ডিভোর্সি তখনই নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে।

চলবে…