#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪১
জাওয়াদ জামী জামী
” আমার জীবনে দ্বিতীয়বার কোন পুরুষ আসবেনা। জীবন আমাকে কঠিন শিক্ষা দিয়েছে। বারবার ঠকতে চাইনা আমি। আপনি যেখানে ছিলেন সেখানেই ফিরে যান। যোগ্য একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করুন। ” চোখ মুছে বলল পেখম।
পেখমের কথা শুনে রাজ্যের চোখমুখ জুড়ে নামল অন্ধকার। আঁখি দুটো ছলছল করছে। ঠোঁটের কোনে মলিন হাসির রেখা।
” একবার ঠকেছ বলেই যে বারবার ঠকবে এমনটা কিন্তু নয়। তুমি বললেই তো আমি অন্য কাউকে গ্রহন করবনা। আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ নারীই হবে তুমি। তোমাকে জয় না করা পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছিনা। ” দৃঢ় গলায় বলল রাজ্য।
” তাহলে থাকুন। তবে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবেননা এটা আশা করব। এতদিন আপনার উপস্থিতি না চাইতেও সহ্য করেছি কিন্তু ভবিষ্যতে করবনা এটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন। ”
” বেশ তবে ঢুকিয়ে নিলাম। কিন্তু কথাটা আজীবন মাথায় থাকবে এই নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা। এমনকি কথাগুলো মনে রাখার স্থায়িত্ব কতক্ষণ হবে, সেটাও বলতে পারছিনা। তবে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমি কোনদিনও তোমার পিছু ছাড়বনা। জীবন আরেকবার তোমাকে পুরুষের সান্নিধ্য দিতে চাচ্ছে। যে পুরুষের ভালোবাসায় তোমার মন থেকে অতীত সম্পূর্ণরূপে মুছে যাবে। যাকে তুমি নিজের সবটুকু দিয়ে কামনা করবে। যাকে ছাড়া তোমার পৃথিবী অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। আর সেই পুরুষটাই হব আমি। ”
রাজ্যের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা পেখম। দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে।
***
” পেখম, তুই তো কিছুই খেলিনা, মা? এই পুডিং একটু খেয়ে দেখ। দেখতো ভালো লাগে কিনা। ” রাজিয়া পারভীন বারবার পেখমকে এটাসেটা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। কিন্তু পেখম কিছুই খাচ্ছেনা।
” আমি কিছু খাবোনা, বড়মা। ইচ্ছে করছেনা খেতে। ”
” তুই আমাদের বাড়িতে এসে না খেয়েই চলে যাবি? আব্বা বেঁচে থাকলে এমনটা করতে পেরেছিস তুই? আজ আব্বা নেই বলে, আমরাও কি জোর করার অধিকার হারিয়েছি নাকি? একটু হলেও তোকে খেতে হবে। ” রাজ্যের বড়মা সাবিকুন্নাহার ধমকে উঠলেন।
” একটু বোঝার চেষ্টা কর, বড়মা। আমি এখানে আসার আগে খেয়ে এসেছি। ক্ষুধা নেই আমার। ”
” পুডিং খেলেই বুঝি তোর পেট ফেটে যাবে? এগুলো কি পেট ভরবার জিনিস? আমাকে বোঝাচ্ছিস তুই? ” সাবিকুন্নাহার নাছোড়বান্দার ন্যায় বললেন।
বাধ্য হয়ে পেখমকে পুডিং-য়ের বাটি হাতে নিতেই হলো।
” চাচী, একটা বিদেশী মাইয়া আইছে, হেয় বাড়ির ভিত্রে আসবার চায়। ” কাজের ছেলে এসে জানাল সাবিকুন্নাহারকে।
” কে এসেছে! নিয়ে এস ভেতরে। ”
” হেই, আমি জ্যানেট। রাজ্যর ফ্রেন্ড আমি। ওর কাচেই এসেচি। ” আপাদমস্তক এক বিদেশিনী এসে নিজেকে রাজ্যের বন্ধু বলে পরিচয় দিল।
ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটাকে। একটা বিদেশিনীকে বাংলা বলতে শুনে সবাই বেশ অবাকই হয়েছেন। সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়েটি দেখতেও চমৎকার। রাজিয়া পারভীন ইতোমধ্যেই রাজ্যকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।
” তুমি আমেরিকা থেকে এসেছ? বাংলা জানো তুমি! বাংলা শিখেছ কিভাবে? ” রাজিয়া পারভীন জিজ্ঞেস করলেন।
” আমি আমেরিকান। রাজ্যের জনই ব্যাংলা শিকেচি আমি। ”
” কেন? রাজ্যের জন্য কেন? ”
” আমি ওর ফ্রেন্ড এজনই। ”
মেয়েটার বাংলা শুনে ঋতের ভিষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে রাজ্যের জন্য বাংলা শিখেছে, এটা শুনেই ওর মাথা ঘুরাতে শুরু করল।
” জ্যানেট! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! ”
রাজ্যকে দেখে জ্যানেট দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।
জ্যানেটের এমন কাজে রাজ্য বেশ বিব্রত হয়েছে। বড়দের সামনে জ্যানেট ওকে জড়িয়ে ধরেছে বিষয়টা যথেষ্ট অশোচনীয়। তাই ও জ্যানেটকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল।
হুটহাট রাজ্যকে জড়িয়ে ধরতে দেখে জ্যানেটের ওপর বিরক্ত হলেন রাজিয়া পারভীন। সেই সাথে রাগ হল রাজ্যের ওপর। তিনি রাগী চোখে তাকালেন রাজ্যের দিকে। রাজ্য সেটা বুঝতে পেরে অসহায় মুখভঙ্গি করল।
” কি করছ, জ্যানেট! এদেশে কোন ছেলেকে এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরোনা। এটাকে বেয়াদবি হিসেবে দেখা হয়। এক মিনিট, তুমি আমার গ্রামের ঠিকানা পেলে কিভাবে? ”
” এ্যারোবিন্দ আমাকে টোমার এ্যাড্রেস দিয়েচে। তুমি কুশি হওনি? ”
” অফকোর্স। এসো, আমার আম্মু, বড়মার সাথে পরিচিত হও। আম্মু, এ আমার ফ্রেন্ড জ্যানেট। ”
রাজিয়া পারভীন দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাজ্যকে একবার দেখে পরক্ষনেই তাকালেন জ্যানেটের দিকে।
ঋত আঁড়চোখে একবার তাকাচ্ছে পেখমের দিকে, তো আরেকবার তাকাচ্ছে রাজ্যের দিকে। রাজ্যের অসহায় মুখভঙ্গি দেখে ওর হাসি পাচ্ছে। এদিকে কানন এসে সবটা দেখে তাকালো পেখমের দিকে। পেখমকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে ওর ভয় হচ্ছে।
পারভীন আক্তার, রাবেয়া সুলতানা দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকালেন। জ্যানেটের বডিল্যাঙ্গুয়েজই বলে দিচ্ছে ও রাজ্যকে পছন্দ করে। এটা রুমে উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারছে।
” মা, এবার আমাদের যাওয়া দরকার। ” পেখম উঠে দাঁড়িয়েছে।
” এ কি, পেখম! তুই কোথায় যাচ্ছিস? ঋতের বিয়ের পর তোরা এই বাড়িতে প্রথম এসেছিস। রাতে না খাইয়ে তোদের যেতে দেবোনা। কথা না বলে বসে যা। আর এখানে থাকতে না চাইলে নাবিলার রুমে গিয়ে বস। আগেতো নাবিলার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতি। আজকেও সেটাই কর। ” সাবিকুন্নাহার পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছেন।
” ভাবী, আজকে আর বসবনা। আমরা সবাই এখানে এসেছি, আব্বা একা আছেন বাড়িতে। এদিকে তার দুপুরের খাবার সময়ও হয়ে গেছে। আরেকদিন সময় করে এসে গল্প করব। ” পারভীন আক্তার সত্যিটাই বললেন।
রাজ্য হুট করেই পারভীন আক্তারের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল নিজের রুমে।
” বড়মা, আমাকে ভুল বুঝোনা। জ্যানেটের সাথে আমার বন্ধুত্বের বাহিরে কোন সম্পর্কই নেই। যদিও আমি জানি ও আমাকে পছন্দ করে। তাই ওর সাথে তেমন যোগাযোগও রাখিনা। আর আমি বুঝতেও পারিনি, ও হুট করে এখানে চলে আসবে। ” রাজ্য কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল।
কেন যেন পারভীন আক্তার রাজ্যের কথা বিশ্বাস করলেন। রাজ্যের চোখে তিনি পেখমের জন্য ভালোবাসা দেখেছেন।
” এত উদগ্রীব হতে হবেনা তোমার। ভালোবাসার জোর থাকলে, যাকে চাচ্ছ তাকেই পাবে। আপাতত এসব চিন্তা রেখে বন্ধুকে সময় দাও। ”
রাজ্য চিন্তিত বদনে পায়চারি করছে। বুঝতে পারছেনা এই পরিস্থিতি সামাল দেবে কিভাবে।
***
” ভাইয়া, এসব কি হচ্ছে? জ্যানেট হঠাৎ করে এখানে আসল কেন? কি উদ্দেশ্য তার? আর আমাদের গ্রামের ঠিকানাই বা অরবিন্দ দা তাকে দিল কেন? অরবিন্দ দা’র সাথে কথা বলেছ তুমি? ”
” জ্যানেটের উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিনা। কিন্তু অরবিন্দ ওকে প্রথমে ঠিকানা দিতে চায়নি। ও কৌশলে ঠিকানা হাতিয়েছে। অরবিন্দও বলতে পারছেনা কখন, কিভাবে ও এসব করেছে। ”
” তুমি যত তাড়াতাড়ি পার তাকে বিদায় কর। খোলাখুলি কথা বল তার সাথে। তাকে জানিয়ে দাও তুমি অন্য কাউকে পছন্দ কর। ”
” হুম, আজকেই ওর সাথে কথা বলব। ”
***
” রাজ্য, টোমাকে ডিসটার্ব লাগচে কেন? আমাকে দেকে কুশি হওনি টুমি? ”
” আমার এ্যাড্রেস তুমি কিভাবে পেয়েছ? সত্যি করে বল। ”
” একটা পার্টিতে এ্যারোবিন্দের ফ্ল্যাটে গিয়েচিলাম। সেকানেই লাকিলি একটা ডায়েরি দেকতে পাই। সেই ডায়েরিতেই তুমি সহ কয়েকজনের এ্যাড্রেস দেকতে পাই। ” রাজ্যের প্রশ্নের সত্যি উত্তরই দিল জ্যানেট।
” আমাকে না জানিয়ে কেন এসেছ? এমনকি অরবিন্দকেও জানাওনি। হোয়াই? ”
” আ’ম ইন লাভ উইথ ইউ। টোমাকে না দেখে আমার কারাপ লাগচিল। তাই এসেচি। ইনফ্যাক্ট আমি টোমার জন ব্যাংলা শিকেচি। আমি ব্যাংলা ট্রাই করচি। ”
” তোমাকে আমি আগেও বলেছি, আমি তোমাকে শুধু বন্ধুর চোখেই দেখি। আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি, তাকে ভালোবাসি। এরপরও কেন তুমি আমার পিছু ছাড়ছনা? আমার জন্য তোমার বাংলা শেখার কোন প্রয়োজন নেই। ওকে, তুমি এসেছ, কয়েকদিন এখানে থাক। আমার দেশটা ঘুরে দেখ। এরপর তোমার দেশে ফিরে যাও। ”
” হোয়াই রাজ্য, হোয়াই? এ্যাম আই নট ওর্দি অব ইউ? কি হয় আমাকে ভালোবাসলে? ”
” আমি আগেও বলেছি, আমার মনে আরেকজন অনেক আগেই বাসা বেঁধেছে। সে-ই আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। তাকে স্থানে অন্য কাউকে বসাতে আমি কখনোই পারবনা। ইজ ইট ক্লিয়ার? ”
রাজ্য’র কথা শুনে অবাক হয়ে গেল জ্যানেট। বেদনা ক্লিষ্ট নয়নে তাকিয়ে থাকল রাজ্যের দিকে। কিন্তু ওর দিকে খেয়ালই নেই রাজ্যের। এখন মনে হচ্ছে, এখানে এসে ও ভুল করেছে। রাজ্য প্রথম থেকেই ওকে বন্ধুর চোখেই দেখত।
” ওকে, আই’ল লিভ। ”
রাজ্য হ্যাঁ, না কিছুই বললনা। এই মুহূর্তে জ্যানেটকে ওর সহ্য হচ্ছেনা।
চলবে…
#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪২
জাওয়াদ জামী জামী
” হেই আন্টি, আ’ম লিভিং। সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। সরি এগেইন। ”
জ্যানেটের কথা শুনে তার দিকে অবাক নয়নে তাকালেন রাজিয়া পারভীন। লেখাপড়া করার সুবাদে কিছু কিছু ইংরেজি তিনি জানেন। তাই জ্যানেটের কথার মানে তিনি বুঝতে পারলেন।
” তুমি এসেছ আজকেই। আজকেই আবার যাওয়ার কথা বলছ কেন? আগামী পনের দিন তুমি এখানেই থাকবে। প্রথমবার তুমি বাংলাদেশে এসেছ, দেশটা আগে ঘুরেফিরে দেখ, তারপর যাওয়ার কথা চিন্তা কর। ”
” ফর হুম আই’ভ খাম, আই’ভ ফাইনালি বিখেইম দ্য কজ অব হিজ এনোইয়েন্স। বাট নট এনিমোর। সো আই ওয়ানা ঠু গো ব্যাক উইথ রেসপেক্ট। ”
জ্যানেটের কথায় যারপরনাই অবাক হলেন রাজিয়া পারভীন। তিনি জ্যানেটের কথার ধরনে কিছু আন্দাজ করলেন। এই বিদেশিনী যে তার ছেলেকে ভালোবাসে, সেটা তার কথায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিদেশিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার খারাপ লাগলেও সেটাকে পাত্তা দিলেননা। কখনোসখনো বড় কিছু পেতে হলে, ছোট ছোট খারাপ লাগাকে সযতনে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়।
রাজিয়া পারভীন তার মেয়ে নাবিলাকে ডাকলেন। তাকে বলে দিলেন, জ্যানেটকে গ্রাম ঘুরে দেখাতে। নাবিলা সোৎসাহে রাজি হল।
***
” আম্মু, জ্যানেট তো চলে যেতে চাচ্ছিল, তুমি ওকে আটকালে যে? ”
” একটা মেয়ে সাতসমুদ্র পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে, তাকে ক’টাদিন বাড়িতে না রেখেই, তাকে আপ্যায়ন না করেই বিদায় করব! এই তোর শিক্ষা? এমন শিক্ষা তো তোকে দেইনি। ”
” রিয়্যাক্ট করছ কেন, আম্মু! আমিও চাই জ্যানেট কিছুদিন থাকুক। সেকথা ওকে বলেছিলাম। কিন্তু ও থাকতে চাইলনা। ”
” ভয় পাচ্ছিস? ”
” একটু। জ্যানেটকে পেখম দেখেছে। ওর মনে যদি সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তবে ওকে পাওয়ার আশা আমার চিরতরে বাদ দিতে হবে। পেখম যে পরিমানের ত্যাড়া মেয়ে, ও কোনদিনও আমাকে ওর আশেপাশে ভিড়তে দেবেনা। ”
” ও তোর মত বোকা নয়। তাই উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা ওর মনে আসবেনা। বন্ধু আর প্রেমিকার মধ্যকার ফারাক ও ভালোভাবেই বুঝবে বা জানবে। ”
” সেটাই আশা করব আমি। কিন্তু তারপরও ভয় থেকেই যায়। ”
” এতকিছু চিন্তা করে তোর মাথা নষ্ট করতে হবেনা। আমি জ্যানেটের বিষয়টা সামলে নেব। ও কয়েকটা দিন এখানে থাকুক। হুট করেই যদি চলে যায়, তবে সেটাই হবে সন্দেহের বিষয়। পেখম কিংবা ওর মা, বড়মা ভাবতে পারে সত্যিই তোর সাথে জ্যানেটের সম্পর্ক আছে। আর সেজন্য আমরাই ওকে বাড়িতে রাখিনি। ”
রাজ্য মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। জ্যানেটের বিষয়টা ওকে ভাবাচ্ছে।
***
” আম্মু, বড়মা তোমরা কোথায়? দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। ”
ঋত বাড়ির বাহির থেকেই হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছে। ওর গলার আওয়াজ পেয়েই সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন। ঋত ততক্ষণে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। ঋতের পাশে জ্যানেটকে দেখে মেহনাজ, পারভীন আক্তার, রাবেয়া সুলতানা তিনজনই অবাক হয়ে গেছেন।
” বড়মা, চাচী, তোমরা সবাই কেমন আছ? ” নাবিলা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল।
” ভালো আছি। আয় ভেতরে আয়। ”
” বড়মা, জ্যানেটকে নিয়ে আসলাম। ওকে আমাদের গ্রাম দেখাব বলে সাথে নিয়ে বেড়িয়েছি। ”
” ভালো করেছিস। ভেতরে আয়। ”
ঋত, নাবিলা জ্যানেটকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেল।
***
” আপু, ও আপু, কিছুতো বল। এভাবে বসে আছ কেন? আমি সত্যি বলছি, জ্যানেট রাজ্য ভাইয়ার ফ্রেণ্ড। ওর সাথে বন্ধুত্বের বাহিরে ভাইয়ার কোন সম্পর্ক নেই। ”
ঋত এসে পেখমকে নানানভাবে বোঝাচ্ছে। কিন্তু পেখম ওর কোন কথাই কানে নিচ্ছেনা। তবে অনেকক্ষণ ধরে ঋতের ঘ্যানঘ্যানানি শোনার পর ও মুখ খুলল।
” তুই তোর ভাসুরের পক্ষে হঠাৎই সাফাই গাইছিস কেন? আমি কি একবারও বলেছি, জ্যানেটকে নিয়ে আমার কোন সমস্যা আছে? সমস্যা কি আদৌও থাকবার কথা? যেখানে তোর ভাসুরের সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই, সেখানে তার কাছে কে আসলো না আসলো সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে যাব কেন! শোন, এতকিছু ভাববার সময় আমার নেই। যে যার মত থাকুক, এর ভেতর আমাকে জড়াবিনা বলে দিচ্ছি। ”
” রাজ্য ভাইয়া তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। আজ থেকে নয়। অনেকদিন থেকেই। বিয়ের দিন ভাইয়া যে চলে গিয়েছিল, তার দুই কি তিনমাস পর দেশে এসে তোমাকে দেখে তোমার প্রেমে পড়েছিল। তখন সে জানতনা তুমিই সেই। পরে জানতে পেরে অনেক পাগলামি করেছে, অনুশোচনা করেছে। তার ছন্নছাড়া জীবনে একটা ছন্দ এসেছিল। বাউণ্ডুলে মানুষটার আমূল-পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু যেদিন জানল, তোমার বিয়ে হয়েছে, সেদিন যদি তার মুখখানা তুমি দেখতে। সে নিরবে দুঃখ হজম করেছে। ফিরে গেছে ইউএস। মনেপ্রাণে তোমার সুখ কামনা করেছে। আবারও তার জীবনটা অগোছালো হয়ে গেছে। এখন তার একটাই চাওয়া, তার জীবনে তোমাকে ফিরে পাওয়া। তোমাকে পাওয়ার জন্য সে পুরো দুনিয়ার বিপক্ষে যেতে প্রস্তুত। আমি তার ছটফটানি, তোমাকে পাওয়ার ব্যাকুল আশা, তোমাকে হারানোর কষ্ট নিজ চোখে অবলোকন করেছি। মুখে বলে তার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে আমি পারবনা। আমি সকল কিছু অনুভব করেছি। আর সেজন্যই আজকে তোমার মুখোমুখি হয়েছি। তুমি আমার বোন। আমাদের সম্পর্ক আবিচ্ছেদ্য। আমি তোমার ভালোটাই চেয়েছি সবসময়। তোমার প্রতি আমার অধিকারবোধ থেকেই কথাগুলো বললাম। ” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল ঋত।
পেখম স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ঋতের কথাগুলো। ও জানতনা রাজ্য দুই বছরের বেশি সময় ধরে ওকে চেয়ে এসেছে। বিষয়টা ওকে সত্যিই অবাক করেছে।
” এখন আমাকে কি করতে বলিস? আমি কি তোর ভাসুরের পা ধরে ক্ষমা চাইব? তাকে ইনিয়েবিনিয়ে বলব, আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিন? পারবনা। সে আমাকে ভালোবেসেছে, এটা তার সমস্যা, আমার নয়। আমি তাকে বলিনি, আমাকে ভালোবাসুন। পাকনামি করতে গেছে কেন সে? এবার পাকনামির ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। ”
” তুমি এত ত্যাড়ামো করছ কেন, আপু! আগেতো তুমি এমন ছিলেনা। একটা দূর্ঘটনাই কি মানুষকে এতটাই বদলে দেয়! কেন এত বদলে গেলে তুমি? আমরা সেই আগের পেখমকে চাই। আজকের পেখম আমাদের কাছে অচেনা। আপু, মানুষ অনেক সময়ই জানায়-অজানায় হাজারো ভুল করে। কিন্তু ভুল করার পর যে অনুতপ্ত হয়, ক্ষমা চায়, নিজেকে পরিবর্তন করতে চায়, সে-ই খাঁটি মানুষ ৷ তাকে একটা সুযোগ দেয়া কি আমাদের উচিত নয়? যদি তাকে সুযোগই না দিলাম, তবে আমরা খাঁটি মানুষের কাতারে কিভাবে পরব বলতো? ”
” ঋত, তুই এত ভারী ভারী কথা বলতে শিখেছিস কবে! এত বড় হয়ে গেছিস তুই? আমার ছোট্ট বোনটা এত বুঝদার হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। সব সময়ই এমন থাকবি, বুঝলি? ”
” কথা কাটাতে চাচ্ছ? তোমার থেকে এটা আশা করিনি মোটেও। যেখানে আমরা সবাই চাচ্ছি, তুমি রাজ্য ভাইয়াকে একটা শেষ সুযোগ দাও, সেখানে তুমি আমাদের সবার চাওয়া ইগনোর করছ সজ্ঞানে। জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা, আপু। একটা দূর্ঘটনা তোমার সাথে একবার ঘটেছে বলেই যে তার পুনরাবৃত্তি বারবার হবে, এটা কিন্তু নয়। একটা বেইমানের জন্য তুমি কেন নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? তাকে দেখিয়ে দাও, তাকে ছাড়াই তুমি পরিপূর্ণ। অন্য একজন তোমাকে তার রানী করে রেখেছে। কতদিন তুমি একা থাকবে? একজন নারী কখনো পুরুষ ছাড়া পূর্ণ হতে পারেনা। তেমনি কোন পুরুষও নারী ছাড়া অপূর্ণ। আবার তোমাকে আগলে রাখার জন্য সব সময় আমরা কিন্তু থাকবনা। মেজো চাচা থেকেও নেই। দাদুর বয়স হয়েছে। বড় চাচারও তাই। চিরকাল তারা কেউই বেঁচে থাকবেনা। যাদের ওপর আজ তুমি নির্ভর করছ, তাদের অনুপস্থিতিতে তোমার দ্বায়িত্ব কে নেবে? বেঁচে থাকতে হলে তোমার কাউকে না কাউকে প্রয়োজন হবেই। সেটা কেন রাজ্য ভাইয়া হবেনা সেটা বল? ”
” আমি জীবনে প্রতারিত হয়েছি কয়েকবার। আর সেই প্রতারনা শুরুই করেছিল তোর রাজ্য ভাইয়া। আমার জীবনের প্রথম এবং প্রধান প্রতারক সে। কিভাবে আমি তাকে সুযোগ দেই, সেটা তুই-ই বল? কিভাবে আমি তাকে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসাবো সেটা তুই বলে দে? সে যে আমাকে আবারো ঠকাবেনা তার নিশ্চয়তা কে দেবে? আর বেঁচে থাকতে হলে কোন পুরুষের দরকার পরবে কেন? আমি স্বাবলম্বী হলে কাউকেই প্রয়োজন হবেনা। নিজের চাহিদা আমি নিজেই মেটাতে পারব। ”
” ভুল বললে, আপু। ঢাকায় কয়েকজন ছেলে তোমাকে কিভাবে বিরক্ত করত সেটা ভুলে গেছ? প্রান্তর ভাইয়া না থাকলে তুমি কি সেখানে টিকতে পারতে? তেমনি জীবনে প্রতিটা পদে পদে চলতে গেলে পুরুষের প্রয়োজন। তুমি যতই স্বাবলম্বী হওনা কেন, কোন পুরুষই কেবলমাত্র তোমার সিকিউরিটি দিতে পারবে। সোসাইটির মানুষ যখন দেখবে তুমি একা, তখন তারা তোমার একাকিত্বের সুযোগ নেবে। কিন্তু যখন তোমার পাশে কেউ থাকবে, তারা তোমাকে সমীহ করবে। আমি তোমার ছোট হয়ে এতকিছু বুঝলে, তুমি বুঝবেনা কেন? একটা কথা কি জানো? রাজ্য ভাইয়া তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। তার চোখে আমি তোমাকে হারানোর ভয় দেখেছি। জ্যানেট সবার সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে, সেটা নিয়ে ভাইয়াকে চিন্তিত হতে দেখেছি। আর যাই করুক, সে তোমাকে ছেড়ে যাবেনা কখনো। ”
” আর সেজন্যই বুঝি তোকে পাঠিয়েছে তার হয়ে সাফাই গাইতে? আর তুইও মেয়েটাকে নিয়ে নাচতে নাচতে চলে এসেছিস? তোকে বোকা বানিয়েছে লোকটা, বুঝলি? ”
” মোটেওনা। ভাইয়া জানেইনা আমরা এখানে এসেছি। জ্যানেট আসায় ভাইয়া বিরক্ত হয়েছে। তবে হ্যাঁ, জ্যানেট ভাইয়াকে ভালোবাসে এটা সত্যি। কিন্তু তার প্রতি ভাইয়ার কোন আগ্রহ নেই। আমি ওদের দু’জনের কথপোকথন শুনেছি। অবশ্য সেটা তারা জানেনা। সেখানেই ভাইয়াকে বলতে শুনেছি, সে অন্য একজনকে ভালোবাসে। তার পক্ষে অন্য কাউকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তোমার কাছে একটাই রিকুয়েষ্ট, ভাইয়াকে শেষ একটা সুযোগ দাও। ”
” পেখম আপু, কেমন আছো? ” ঋতের কথা শেষ হতেই নাবিলা রুমে আসল।
” আছি ভালোই। তুই কেমন আছিস বল? অনেকদিন পর এদিকে আসলি তুই। ”
” তুমি থাকোনা তাই আসাও হয়না। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এ জ্যানেট। ভাইয়ার ফ্রেণ্ড। জ্যানেট, ইট’স পেখম। মাই ব্রো’জ ফিউচার ওয়াইফি। ইজ’ন্ট সি বিউটিফুল? ” নাবিলা পেখমের পাশে বসে জ্যানেটকে বলল। ওর মুখে হাসি। কিন্তু পেখম ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকল।
” ভেরি প্রিটি। ইউ আ ভেরি লাকী। রাজ্য, ইজ ভেরি গুড গাই। গুড লাক টু ইউ। ” বিষাদ বদনে বলল জ্যানেট।
” ইট’স নট হোয়াট ইউ থিংক। নাবিলা হ্যাড ফান। ”
” ওয়ান ডেই আই স ইওর পিকচার অন রাজ’স ফোন। হি টুক গ্রেট কেয়ার। আই আস্কড হিম এ্যাবাউট দ্য পিকচার। হি লাফড। হি সেইড, মাই বৃষ্টি বিলাসীনি। আই ডিডন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট হি সেই। বাট টুডেই ইট সিমস দ্যাট দ্য ওয়ার্ডস হ্যাড আ ডিপার মিনিং। ”
জ্যানেটের কথার বিপরীতে পেখম কি বলবে ভেবে পায়না। ও ঋতের দিকে তাকায়। ঋত হেসে বলল,
” ইউ আর রাইট। সি ইজ ব্রাদারস ফেভারিট উইম্যান। দ্য অ্যাপল অব মাই ব্রাদার’স আই। ”
ঋতের কথা শুনে পেখম কপালে হাত দেয়। বিষয়টাকে আরও ঘেঁটে দিল মেয়েটা।
চলবে…