সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৪৩+৪৪

0
348

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৩
জাওয়াদ জামী জামী

” চাচী,আপনারা এখানে? ” শপিংমলের সামনে রাবেয়া সুলতানাকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল রাজ্য।

রাজ্যকে দেখে বিরক্তিতে ভ্রু কোঁচকালো পেখম। ও অন্যদিকে ফিরে চাইল।

” কেনাকাটা করতে এসেছিলাম। কাজ শেষ এখন বাড়িতে যাব। তুমি ও কি কেনাকাটা করতে এসেছ? ” রাবেয়া সুলতানা জিজ্ঞেস করলেন।

” আমি নই নাবিলা, ঋত, জ্যানেটকে নিয়ে এসেছে কেনাকাটা করতে। আমি ওদের পাহারাদার হয়ে এসেছি। আমাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলে ওরা ভেতরে গেছে। ”

রাজ্যের কথার ধরন দেখে হাসলেন রাবেয়া সুলতানা। এদিকে রাজ্য তাকিয়েছে পেখমের দিকে। ও রিশানের সাথে কিছু একটা বলাবলি করছে আর হাসছে।

” কি রে রিশান, ঘটনা কি? তোর বোন এভাবে হাসছে কেন? ” ইতোমধ্যেই রিশানের সাথে রাজ্যের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে।

” আপু বলছে, আজ তোমার সাথে লেজ নেই কেন? লেজ ছাড়া তুমি নাকি বেমানান। ” হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা রিশানের।

এদিকে রিশানের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে রাজ্য। আপনাআপনিই ওর হাত পেছনের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ হাতাহাতি করে শিওর হয়ে নিল, ওর পেছনে কোন লেজ নেই।

” হুরর, কি বলিস এসব! আমার লেজ থাকতে যাবে কোন দুঃখে! আমি কি হনুমান নাকি যে আমার লেজ থাকবে? ”

” হনুমান না হয়েও কিছু কিছু মানুষের লেজ থাকে। যার জলজ্যান্ত প্রমান তুমি। এবার বল তোমার লেজকে কোথায় ফেলে রেখে এসেছ? আপু জানতে চাচ্ছে। ”

রিশানের কথা শুনে কপাল চাপড়ায় রাজ্য। এদেরকে কিভাবে বোঝাবে যে ওর লেজ কোনকালেই ছিলনা, আজও নেই। ওর রাগ হচ্ছে রিশানের ওপর। কিন্তু নিজের ভালোর জন্যই ওকে রিশানের দুষ্টুমি মেনে নিতে হচ্ছে।

” দেখ রিশান, কথা বলতে না চাইলে চুপ থাক। তবুও উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবিনা বলে দিলাম। ”

” আহ্ ভাইয়া, তুমি এমন ভড়কে গেলে কেন? আমরা তো কানন ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। আপু তাকেই তোমার লেজ বলে অভিহিত করেছে। সত্যিই তুমি লেজ ছাড়া বেমানান। ”

রিশানের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল রাজ্য। মুখে হাসি পুনরায় ফিরে আসল। এতক্ষণ কত আজেবাজে চিন্তাই না মনে এসেছিল।

” ওহ্ তাই বল। কাননও এসেছে। ও ঋতের ব্যাগ ক্যারি করার জব পেয়েছে। আমি বেচারা সিঙ্গেল, ব্যাগও নেই, মালকিনও নেই, তাই ক্যারিও করতে পারছিনা। ” হতাশা ফুটে উঠেছে রাজ্যের চোখমুখে। সেটা দেখে হাসল রিশান, হাসলেন রাবেয়া সুলতানাও। একমাত্র স্বাভাবিক থাকল পেখম।

” রাবেয়া তুমি! কেমন আছ? ” সবার মুখের হাসি বিলীন করতে আচমকাই হাজির হলেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন। তাকে দেখে সবাই বেশ চমকায়।

রাবেয়া সুলতানা কি উত্তর দেবেন ভেবে পাননা। অসহায় চোখে তাকালেন ছেলেমেয়ের দিকে। এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে তার ভিষণ বিরক্ত লাগছে।

সবাইকে নিরব থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” রাবেয়া, কথা বলবেনা আমার সাথে? এতটাই নিকৃষ্ট মানুষ আমি? ”

” মা, আমরা এখন যাব। তুমি যেতে চাইলে আমাদের সাথে আসতে পার। ” পেখম চোখমুখ শক্ত করে বলল।

সৈয়দ সানোয়ার হোসেন বুঝলেন তার মেয়েটার মনে আকাশসম অভিমান জমা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই বাবার অনাদরে বেড়ে উঠা মেয়েটিকে দেখে তার মনে উথলে উঠল ভালোবাসা। তিনি এক ধাপ এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে।

” মাগো, আমি জানি আমার ওপর তোমার রাগ-ক্ষোভ অযৌক্তিক নয়। এটাই আমার প্রাপ্য। কিন্তু পিতামাতার মন বড়ই বেহায়া হয়। তাই আমি চাইব, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। বাকি জীবনটুকু তোমাদের নিয়েই কাটাতে চাই আমি। ”

” আপনার স্ত্রী-সন্তান তো আছে। তাদের কাছে যাননা কেন? তাদের মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে নিন। অযথা আমাদের নিয়ে কেন টানাটানি করছেন? ”

” তুমি যাদের কথা বলছ, তাদের কাছে আমি শুধু টাকার খনি। টাকাই তাদের কাছে সব। কিন্তু আমি ভালোবাসার কাঙাল। ”

” অথচ আপনি ভালোবাসা পেতেই আমার মা’কে ছেড়ে গিয়েছিলেন, নিজের সুখ খুঁজতে! আজ এতবছর পর হঠাৎ কেন ভালোবাসা পেতে ছুটে আসলেন? আজ আমাদের আপনাকে প্রয়োজন নেই। যেখান থেকে এসেছিলেন, সেখানেই ফিরে যান। ”

” রাবেয়া, তোমারও মুখে আমি শুনতে চাচ্ছি, তুমি কি চাও। আজ আমি তোমাদের কাছে ছুটে এসেছি বলেই কি সবাই আমাকে এভাবে কথা শোনাচ্ছে? ”

” পেখম যা বলছে, সেটা শুধু ওর কথা নয়, আমারও কথা। আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো আছি। ”

রাজ্য বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের দিকে। সেদিনের পর থেকে এই লোকটাকে ওর সুবিধাবাদী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। অথচ একটা সময় ও ভেবেছিল, পেখম, রিশানের কাছে ওদের বাবাকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু ও ভুল ছিল। এই মানুষটা তার কাঙ্ক্ষিত মানুষদের কাছ থেকে ভালোবাসা না পেয়ে ছুটে এসেছিল তারই ছুঁড়ে ফেলা এই নারীর কাছে। তিক্ত মন নিয়ে আরেকদিকে তাকাল রাজ্য। ওকে এখন যেতে হবে। অন্যদের ব্যাক্তিগত বিষয়ের আলোচনা শোনা শোভা পায়না মোটেও।

” রাবেয়া, তুমি যদি পেখম, রিশানকে বোঝাও তবে ওরা তোমার কথা ঠিকই শুনবে। একটু বোঝাও ওদের। ” আবারও বললেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেন।

” আমি যা বলার বলে দিয়েছি। আপনি যেতে পারেন। ”

” তুমি আমার কথা না শুনে এখানে এসেছ! গল্প করছ পূর্বেই ছুঁড়ে ফেলে যাওয়া বউয়ের সাথে? দুশ্চরিত্র পুরুষ। ”

রাবেয়া সুলতানা সবে তার কথা শেষ করেছেন। রাজ্যও পা বাড়িয়েছে। কিন্তু ওকে থমকে দাঁড়াতে হল। কারও উত্তেজিত গলা শুনে আপনাআপনি থেমে গেল তার পা। ঘুরে তাকাল সে।

” লিলি, তুমি এখানে এসেছ কেন? হোটেলে ফিরে যাও। ” সৈয়দ সানোয়ার হোসেন চাপা গলায় ধমক দিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে।

” কেন ফিরে যাব? তোমার কথামত সব হবে? এজন্যই আজকাল আমাকে ভালো লাগেনা? যোগাযোগ করেছ বড় বউয়ের সাথে? ফিরিয়ে নেবে তাকে? ” লিলি সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের ধমককে পাত্তা দিলনা।

” পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করোনা, লিলি। হোটেলে ফিরে যাও। লোকজন আমাদের দেখছে। ”

” আই ডোন্ট কেয়ার। লোকজন দেখলে দেখবে। তাদেরও জানা উচিত, একটা প্রতারক তার স্ত্রী-সন্তানদের দূর দেশে রেখে এসে, এখানে তার প্রাক্তন স্ত্রী’র সাথে সময় কাটাচ্ছে। যেখানে সেই প্রাক্তন স্ত্রীকে একটা সময় সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছিল সে। এত বছর পর কি দেখলে তার মধ্যে? হঠাৎই এই নারীর মোহে মজলে কেন? তাবিজ করেছে নাকি? ”

লিলির কথা শুনে ঘৃণায় শরীর রি রি করতে থাকল সকলের। রাবেয়া সুলতানা ঘৃণার চোখে তাকালেন সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের দিকে। পেখম রাগ ঢাকবার চেষ্টা করছেনা। নগ্ন রাগ ফুটে উঠেছে ওর চোখেমুখে।

” নিজের জবানে লাগাম দিন। কার সম্পর্কে কি বলছেন সেই ধারনা আপনার আছে? আমার মা আপনার হাজবেন্ডের কাছে যায়নি। উল্টো আপনার হাজবেন্ডই আমার মা’য়ের কাছে এসেছে। তার কাছে, আমাদের কাছে ক্ষমা চাইছে। সম্মান করতে না পারলে করবেননা। কিন্তু কাউকে অসম্মান করার অধিকার কেউ আপনাকে দেয়নি। ” পেখম ধীর গলায় কথাগুলো বলল।

” ওহ, তুমিই তাহলে সানোয়ারের প্রথমা স্ত্রী’ র মেয়ে? তোমরা মা-মেয়ে মিলেই তাহলে সানোয়ারকে বশ করেছ? তা এত বছর পর হঠাৎ করে উদয় হলে কেন? টাকাপয়সার দরকার? যেই শুনেছ সানোয়ার লাখ লাখ টাকা কামায়, তখন আর নিজেদের লোভ সামলাতে পারলেনা? ভাগ নিতে হাজির হয়ে গেলে? তোমার রূপের যেই শ্রী দেখছি, তাতে তো কোন ভদ্রলোক তো পাতে তুলবেইনা, এমনকি কোন রিক্সাওয়ালাও চাইবেনা তোমাকে । এখন টাকাই সব। টাকার গন্ধেই একমাত্র মৌমাছি ভিড়বে। আর সেজন্যই কি সানোয়ারকে হাত করেছ? লোভী মেয়েমানুষেরা। ”

” কিপ ইওর মাউথ সাট। আ’ম সারপ্রাইজ টু ইওর কারেজ! চিপ উইমেন, আপনার জানা নেই এই মেয়ের যোগ্যতা সম্পর্কে। এই মা’য়ের সম্মান কতটুকু তা যদি আপনি জানতেন, তবে এতগুলো কথা বলতেননা। চেহারা দিয়ে মানুষের যোগ্যতা বিচার করছেন আপনি? তবে জেনে রাখুন, আপনার এই সুশ্রী চেহারার আড়ালে কুৎসিত মনটা আমরা ঠিকই দেখে নিলাম। নিজে একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীকে অপমান করতে আপনার একটুও বাঁধছেনা? যে নারীকে আপনি ইনসাল্ট করছেন, একদিন সেই নারীই সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের জীবনে প্রথম নারী ছিল। আপনি তার জীবনে দ্বিতীয় নারী। এই নারী যদি সেদিন ছাড় না দিত, তবে আজ আপনি এখানে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় কথা বলতে পারতেননা। সৈয়দ সানোয়ার হোসেনের জীবন দ্বিতীয় নারী হয়ে আসতে পারতেননা। ইনি যদি কোন পদক্ষেপ নিতেন তবে আপনিসহ সৈয়দ সানোয়ার হোসেন জেলের কুঠরীকে পঁচে মরতেন। কিন্তু ইনি আপনার মত কুচুটে নন। তাই আপনারা সহিসালামতে নিজেদের জীবন কাটাচ্ছেন। শুকরিয়া আদায় করা উচিত আপনার। ”

রাজ্য এসে দাঁড়িয়েছে পেখম আর লিলির মাঝখানে। ওর ঝাঁঝালো কণ্ঠের কথাগুলো শুনে থমকে গেল লিলি। তার চোখে কিছুটা ভয়ের চিহ্ন। সেই সাথে অপমানেরও। তবুও সে নিজের গলা দমিয়ে রাখলনা। দ্বিগুণ তেজে জিজ্ঞেস করল,

” এই ছেলে কে তুমি? তোমার এত সাহস হয় কি করে আমাকে ইনসাল্ট করার? ”

” এই যে মমতাময়ীকে আপনি অপমান করছেন, সে আমার মা। আর কোন ছেলে তার মা’কে অপমানিত হতে দেখলে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবে? আরও অপমানিত হতে না চাইলে আপনি চলে যান। নয়তো আমি আপনাকে এমনভাবে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামাব, যে সারাজীবন আপনি এই দিনটার কথা মনে রাখবেন। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে এদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তারপর যাবেন। ”

” হোয়াট! আমি ক্ষমা চাইব! তা-ও এই মিডল ক্লাস মহিলার কাছে! ভেরি ফানি। জীবন থাকতে আমি এদের কাছে ক্ষমা চাইবনা। শুনেছ তুমি? ”

” কাকে মিডল ক্লাস বললেন আপনি? এই ভদ্রমহিলার পরিবার সম্পর্কে কোন ধারনা আছে আপনার? ইনার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে কোন ধারনা আছে আপনার? আমার মনে হয় আপনিই কোন লো ক্লাস ফ্যামিলিতে বেড়ে উঠেছেন। তাই একটা নারীর সংসার ভাঙ্গার সাহস করেছিলেন। আর এতগুলো বছর পর এসে ইনাদের অপমান করছেন। কোন এলিট ফ্যামিলির সন্তান হলে অবশ্যই ইনাকে সম্মান করতেন আপনি। ইনার ত্যাগকে স্যালুট করতেন আপনি। কিন্তু সেই বিবেকবোধ আপনার নেই। তাই ইনার সাথে সাথে ইনার সন্তানকেও কটু কথা শোনাতে আপনার বাঁধছেনা। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আপনি যোগ্যতার থেকেও প্রাধান্য দিচ্ছেন! আপনার মত মানুষের জন্যই বর্ণবাদের জন্ম হয়। চাচী, অনেক হয়েছে। এবার বাড়িতে চলুন। ”

রাজ্যের কথা শুনে পেখম ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। এই বিরক্তিকর মানুষটার রূপ এক লহমায় পরিবর্তিত হতে দেখে ও যারপরনাই অবাক হয়েছে। এতগুলো মানুষের সামনে সে ওদের সম্মান বাঁচাতে তৎপর দেখে চোখে পানি আসল পেখমের। আজ এই মানুষটা না থাকলে হয়তো সকলের সামনে ওদেরকে অপদস্ত হতে হত। ও যতই লিলি নামক ভদ্রমহিলার কথার উত্তর দিক না কেন, তার সাথে ও পেরে উঠতনা এটা নিশ্চিত। হঠাৎই রাজ্যের গলা কানে আসল পেখমের। তার চড়া গলা শুনে চমকে উঠল পেখম।

” কি দেখছেন আপনারা? মজা নিচ্ছেন? লজ্জা লাগা উচিত আপনাদের। একজন এসে দুইজন মহিলাকে অপদস্ত করছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে থেকে দেখছেন! আপনারাও এই মহিলার মত কুৎসিত মনের অধিকারী। কেউ একজন এগিয়ে এসে যদি ইনাদের পাশে দাঁড়াতেন, তবে এই মহিলা আজ গলা উঁচিয়ে কথা বলতে পারতনা। নিজেদের পরিবারের কারও সাথে যদি এমনটা ঘটত, তখনও কি আপনারা নিশ্চুপ থেকে মজা দেখতেন? যতসব ফালতু লোকজন। ” রাজ্যের ধমক খেয়ে আশেপাশে ভিড় করা লোকজন সুড়সুড় করে যে যার পথে চলে গেল।

” মা, চল। আর আপনি কান খুলে শুনে রাখুন, আমাদের জীবনে আপনার স্থান আর নেই। আপনি আমাদের কাছে মৃত৷ আপনার স্ত্রীকে বলে দিয়েন, আপনার ওপর আমাদের কোন ইন্টারেস্ট নেই। তেমনি আপনার টাকাপয়সার ওপরও নয়। আই স্পিট অন ইওর ওয়েলথ। চল, রিশান। ”

” আপনার স্বামীকে আঁচলের তলায় বেঁধে রাখবেন। নয়তো যখনতখন ছুটে পালাবে। এত রূপ থাকা স্বত্বেও তো আপনার স্বামীকে ধরে রাখতে পারলেননা। সেইতো তিনি ছুটে আসলেন তার ছুঁড়ে ফেলে দেয়া স্ত্রী’র কাছেই। ভবিষ্যতেও যাতে এমনটা করতে না পারেন, সেটা কিন্তু আপনাকেই দেখতে হবে। ভবিষ্যতে এমনটা হলে, আর আপনি এসে গলা উঁচু করে কথা বললে কিন্তু আমি আপনাকে ছেড়ে দেবোনা। সেদিন আপনার চুলের মুঠো ধরে আপনাকে আমার পায়ের নিচে ফেলব। আমার সকল অপমানের শাস্তি সেদিন আপনাকে দেব। আমার মেয়েকে অপমান করার শাস্তি আপনাকে দেব। বারবার আপনাদের দৌরাত্ম আমি মেনে নেবনা । আপনাকে দেখিয়ে দেব, শোধ আমিও নিতে জানি। ”

রাবেয়া সুলতানা ছেলেমেয়ের হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলেন। রাজ্য একটা অটোরিকশা ডেকে ওদের তুলে দিল।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৪
জাওয়াদ জামী জামী

” পেখম, আমরা তোকে একটা অনুরোধ করতে এসেছি। আমাদের ফিরিয়ে দিসনা মা। ”

অসময়ে রাজিয়া পারভীন আর মীর আমজাদ হোসেনকে বাড়িতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছে পেখম। তার ওপর আবার রাজিয়া পারভীনের মুখে আবদার কথাটা শুনে ওর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।

” আপনারা আমাকে আদেশ করতে পারেন, বড়মা। অনুরোধ কথাটা বলে আমাকে লজ্জা দেবেননা। ”

” মাগো, আমরা জানি রাজ্য তোর সাথে অন্যায় করেছিল। তোর জীবনে যা যা ঘটেছে, তার দায়ভার রাজ্যকেও নিতে হবে। ও যদি বিয়েটা করত, তবে তোর সাথে এতকিছু ঘটতনা। কিন্তু মা, তুই কি একবারও ভেবে দেখেছিস, তোর পরিবারের লোকজন এবং আমরাও সমান দোষী? আমরা তোর ভালো চাইতে গিয়ে খারাপটাই করেছি। আমাদের উচিত ছিল রাজ্যের মনের কথা জেনে নেয়া। কিন্তু সেটা না করে শুধু ওর মুখের কথা বিশ্বাস করে, বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে তোর সাথে অন্যায় করার সাহস পেয়েছে রাজ্য। আবার তুই যখন এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতেই পারিসনি, ঠিক তখনই তোর পরিবার আরেকটা ভুল সিদ্ধান্ত নিল। তুইও বরাবরের মতোই তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালি। কিন্তু আবারও তুই ঠকলি। অথচ আমরা কেউই চাইনি দিনশেষে তুই-ই ঠকে যা, প্রতারিত হ। আমরা তোকে কতটা ভালোবাসি সেটা তোর অজানা নয়। আর সেই ভালোবাসা থেকেই তোর কাছে অনুরোধ করছি, মা। আর একটা সুযোগ আমার ছেলেকে দে। ও নিজের কৃতকর্মের জন্য যেকোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছে। আমি এতদিন এসব বিষয়ে মাথা ঘামাইনি। কিন্তু আজ আর পারলামনা। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারিনা আমি। ও শুধুমাত্র তোর জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে এখানে পরে আছে। ও সব সময় বলত, রেকর্ড নম্বর নিয়ে নিজের ভার্সিটির টিচার হবে। হয়েছিলও তাই। কিন্তু ওর সেই স্বপ্নও তোর কাছে নস্যি। সে তোকে পাওয়ার জন্য অবলীলায় ওর স্বপ্ন পায়ে মাড়াতে দুইবারও ভাবেনি। ওকে ওর স্বপ্ন পূরণের সুযোগটা তুই করে দে, মা। ও বেঁচে থাকুক ওর ভালোবাসা আর স্বপ্নকে নিয়ে। ” মীর আমজাদ হোসেন হাতজোড় করে বললেন।

আমজাদ চাচাকে এভাবে ভেঙে পরতে দেখে পেখম বিব্রত হয়। চাচাকে কি বলবে ভেবে পায়না। মানুষটাকে না বলার সাধ্য ওর নেই। আবার হ্যাঁ বলতেও বিবেকে বাঁধছে। সাধাসিধা এই মানুষটা সব সময় ওকে সন্তানের মতই ভালোবেসেছে।

” পেখম মা, তোর চাচার কথার সাথে আমি একমত। তোর কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার ছেলেকে একটা সুযোগ দে। ফিরিয়ে দিসনা আমাদের। মা হয়ে তোর কাছে হাতজোড় করছি আমি। ”

পেখম মহাবিপদে পড়েছে। কিভাবে দুটো মানুষের কথা অমান্য করতে হয়, সেটা ওর জানা নেই। তবুও ও হাল ছাড়লনা।

” চাচা, বড়মা, আমার সম্পর্কে কোনকিছুই আপনাদের অজানা নেই। আজ হয়ত আবেগের বশে আপনার ছেলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আবেগ কেটে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছেন? তখন হয়তো আমাকে আর ভালো লাগবেনা। আমাকে কুশ্রী মনে হবে তখন। একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করেছে জন্য হয়তো দেয়ালে মাথা ঠুঁকবে। কোন একদিন যদি তার মনে হয়, আমার থেকেও বেটার অপশন সে পেত, তখন কি হবে বলতে পারেন? আমি এসবের কোনকিছুই শুনতে চাইনা, বড়মা। এত টানাপোড়েনের মাঝে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চাই আমি। আবারও কোন ধোঁকা, কোন প্রতারনা মেনে নেয়ার মত সহ্য শক্তি আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত। জীবন নিয়ে আর কোন উচ্চাশা আমার নেই। ”

” হয়তো, যদি শব্দ দু’টো বাদ দিচ্ছিসনা কেন! কেনইবা তোর মনে হচ্ছে তোর সাথে আবারও খারাপটাই হবে? সব সময় পজিটিভটাই ভাববি। জীবন তোকে একটা সুযোগ দিতে চাচ্ছে। সেটা গ্রহন না করে কেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিস? একবার রাজ্য তোর সাথে প্রতারনা করেছে বলে তেন ভাবছিস, ও তোর সাথে বারবার এমনটাই করবে? এবার সেটা হবেনা। তোর জন্য ওর চোখে আমি শুদ্ধ ভালোবাসা দেখেছি। ওর জীবন থাকতে তোকে কষ্ট পেতে দেবেনা সেই নিশ্চয়তা আমি তোকে দিচ্ছি। তুই শুধু একবার রাজি হ। দেখবি আমার ছেলে তোর অতীতের সকল কালো স্মৃতি মুছে দিয়েছে। তুই ভুল করেও মনে করতে চাইবিনা সেসব। এই মা’য়ের প্রথম এবং শেষ অনুরোধটা তুই রাখ, মা। ”

মীর আমজাদ হোসেন এবং রাজিয়া পারভীন নানানভাবে বোঝালেন পেখমকে। পেখম নিশ্চুপ হয়ে দু’জনের কথাগুলো শুনে গেল।

সেই রাতেই সৈয়দ শামসুল হক আসলেন পেখমের রুমে। তাকে ধরে নিয়ে এসেছেন পারভীন আক্তার। তিনি আর আগেরমত নেই। ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারেননা। তার দিনও হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। এটা বাড়ির প্রত্যেকেই বুঝতে পারেন।

দাদুকে রুমে আসতে দেখে পেখম বিছানা থেকে উঠে গিয়ে তাকে ধরে বিছানায় এনে বসালো।

” দাদু, তুমি আসতে গেলে কেন? আমাকে বললেই আমি তোমার কাছে যেতাম। ”

” একটা প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছি, পরী বুবু। কিছু কথা বলতে চাই তোমার সাথে। ”

পেখম বুঝল দাদুর প্রয়োজন কি। কি কথা বলতে চান দাদু।

” আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চাও। কিন্তু এটা কি আদৌও শোভা পায়, দাদু? ”

” কেন শোভা পায়না? তুই কি কোনদিকে অযোগ্য? নাকি তোর বংশপরিচয় নেই? নাকি তুই অনাথ? একটা সময় রাজ্য ভুল করেছিল ৷ এখন যখন সে ভুল শুধরে একটা সুযোগ চাচ্ছে, সেটা দিতে দোষ কোথায়? একটা ছেলে কতটা ভালোবাসলে এভাবে সব ছেড়ে থাকে তুইই বল? ও তোর সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু তুই সেই সুযোগ ওকে দিচ্ছিসনা। তোর আশেপাশে ভিড়তে দিসনা তুই ওকে। ওর সাথে ঠিকমত কথা বললে বুঝতি কেমন ছেলে ও। ” পারভীন আক্তারও বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

” পরী বুবু, রাজ্য সেদিন আমার কাছে এসেছিল। ও নিজের কৃতকর্মের জন্য বারবার ক্ষমা চাচ্ছে। আরেকটা সুযোগ চাচ্ছে। যে ব্যাক্তি নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়, তাকে ক্ষমা করা উচিত বলে আমি মনে করি। একবার তার সাথে কথা বল। তার কথা মন দিয়ে শোন। একটা সুযোগ তাকে দাও। তোমাকে নিয়েই আমার যত চিন্তা। ঐ কুলাঙ্গার যদি তোমাদের সাথে বেইমানী না করত, তবে বউমাকে এতটা কাঁদতে হতোনা। তোমরাও বাবার আদর পেতে। বিপদেআপদে তাকে পাশে পেতে। আমি চোখ বুজলে তোমাদের কি হবে, এটা ভেবেই নির্ঘুম রাত কাটে আমার। আমার অন্য ছেলেরা তোমাদের যতই ভালোবাসুক না কেন, তারাতো তোমার পিতা নয়। তাদেরও পরিবার আছে। তোমার বাবার অবর্তমানে আমিই ছিলাম তোমাদের অভিভাবক। সেজন্যই আমি চাচ্ছি আমার অবর্তমানে, কেউ একজন তোমাদের দ্বায়িত্ব নিক। তোমাদের আগলে রাখুক। তোমার দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিক। রিশান দাদু ভাইয়ের একটা ভরসার হাত হোক। তোমার দুঃখিনী মা’য়ের মুখে হাসি ফুটুক। ব্যাস এইটুকুই আমার চাওয়া। আমার চাওয়া একমাত্র তুমিই পূরণ করতে পার। ”

” আমি ভেবে দেখব, দাদু। তুমি রুমে গিয়ে ঘুমাও। চল আমি তোমাকে রুমে দিয়ে আসি। ” পেখম দাদুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে ধরে রুমে নিয়ে গেল।

***

” আপু, আসব? ”

ঋতকে দেখে নড়েচড়ে বসল পেখম।

” ঋত, এত বড় হয়ে গেলি কবে! আমার রুমে আসতেও জিজ্ঞেস করতে হবে! ”

” আমার সাথে কানন ভাইয়াও আছে। সে তার বউয়ের বড় বোনের রুমে আসবে অনুমতি ছাড়াই! ”

” নিজেকে কানন ভাইয়ার বউও বলছিস, আবার তাকে ভাইয়াও ডাকছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? ”

” ওকে একটু বোঝাও, পেখম আপু। সময়ে-অসময়ে ভাইয়া ডেকে আমার মুডের চৌদ্দটা বাজিয়ে দেয়। বাচ্চা মেয়েকে বিয়ের প্যারা কি সেটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। ” কানন রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল।

” ভাইয়া, আমাকে তুমি আবারও আপু ডাকছ? আগে আমাকে নাম ধরে ডাকতে, কত ভালো লাগত। সম্ভাষণ না পাল্টালে কিন্তু তোমার খবর আছে। ”

” পাগলে কামড়িয়েছে আমাকে! তোমাকে নাম ধরে ডাকি আর ভাইয়া আমার কান ছিঁড়ে নিক। তার নির্দেশ, তোমাকে আপু ছাড়া নাম ধরে ডাকা যাবেনা। ভাবী নাকি মা’য়ের মত। তাই তোমাকে মা’য়ের মতই সম্মান করতে হবে। ”

” সে বলেছে তাই তোমাকে হুকুম পালনও করতে হবে! এতদিন যে নাম ধরে ডেকেছ, সেটা দুইদিনের লোকের কথায় বাদ দেবে? তাকে বলতে পারলেনা, তুমি ছোটবেলা থেকেই আমাকে না ধরে ডাক? ”

” তার যুক্তির সাথে পেরে উঠবনা আমি। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তার নির্দেশ তোমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। বড় ভাইয়ার আদেশ কিভাবে অমান্য করি বল? হাজার হোক সে প্রেমিক পুরুষ। তার চাওয়াকে অসম্মান করি কিভাবে বল? ”

” থাক আর সাফাই গাইতে হবেনা। তোমার যা খুশি ডাক। ”

” তাহলে ভাইয়াকে ভেতরে আসতে বলি? ” কানন আগ্রহ নিয়ে তাকাল পেখমের দিকে।

” মানে কি! সে কি বাড়িতে এসেছে? তুমি তার মধ্যস্থতাকারী হয়ে এখানে এসেছ নাকি? ”

” তাকে কি তোমার এত বোকা মনে হয়? সে বাড়ির বাহিরে আছে। তোমাকে একনজর দেখবার জন্য সেই সকাল থেকে চায়ের দোকানে বসে আছে। দোকানে যত লোকজন আসছে সবাইকে ফ্রিতে চা-বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। যারা পান, বিড়ি-সিগারেট খায় তাদেরকে তাদের পছন্দের বিড়ি-সিগারেট খাওয়াচ্ছে। এবার তোমার মনে একটু দয়া হলে বেচারা বাড়ি যেতে পারে। সকাল থেকে চা-পান-বিড়ি-সিগারেটের ওপর বেঁচে আছে আমার ভাইটা। আসার সময় দেখলাম, এক মুরুব্বির সাথে গল্প করছে আর পান চিবাচ্ছে। সওয়াব হচ্ছেনা বল? ”

” মদ-গাঁজা খায়না? এক কাজ কর, তাকে মদ-গাঁজার ব্যবসা করতে বল। এলাকার যারা গাঞ্জুট্টি, মদখোর আছে তাদেরও উপকার করুক। ফ্রিতে তাদেরকেও মদ-গাঁজা খাওয়াক। সওয়াবের ঘাটতি থাকলে পূরণ হয়ে যাবে এই সুযোগে। পারলে হোম ডেলিভারি দিতে পারে। সওয়াব আরেকটু বেশি পাবে। ”

” গ্রেট আইডিয়া, আপু। এই কানন্যা তুমিও ভাইয়ার সাথে কাজে লেগে পর। যারা এসব কিনে খেতে পারেনা তাদের উপকারে আসবে প্রজেক্টটা। ” ঋতের কথায় রাগে কাননের মাথায় আগুন ধরে গেল। ও কটমট করে তাকাল ঋতের দিকে।

চলবে…