সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৪৫+৪৬

0
327

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৫
জাওয়াদ জামী জামী

চোখ খুলেই নিজেকে ডাষ্টবিনের মধ্যে আবিষ্কার করলেন আইভি রহমান। দুর্গন্ধে গুলিয়ে উঠল তার পেটের ভেতরটা। হড়হড় করে বমি করে দিলেন। ক্লান্ত, অবসন্ন আইভি রহমান ওঠার চেষ্টা করেও পারলেননা। ডাষ্টবিনের নোংরা আর বমির মধ্যে মাখামাখি অবস্থা তার। নিজের চরম অসহায়ত্ব টের পেলেন হাড়ে হাড়ে। একই সাথে তার বোধহয়ও হল। তিনি তার এই দুঃসময়ে একজন আপনজনের প্রয়োজনবোধ করলেন। সেই সাথে অনুতপ্ত হলেন নিজের পূর্বের কৃতকর্মের জন্য। মিনহাজ রহমানকে মনে পরছে আজ। তার শত অপরাধ জেনেও মানুষটা তাকে কখনোই অবহেলা করেননি। বারবার তাকে শোধরাতে বলেছেন। কিন্তু তিনি শোনেননি। অনেকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হতেই লক্ষ্য করলেন এখন গভীর রাত। তিনি হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসলেন। গত দুইমাস যাবৎ তিনি বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। এই দুইমাসে পেট পুরে খেতে পাননি তিনি। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হত তাকে। ঘুম ভাঙ্গলে একটু পানির জন্য কত আকুতি করেছেন, কিন্তু কারও মনে দয়া হয়নি। সাথে সাথেই আবার ইনজেকশন দিত। ফলে তার শরীর দুর্বল হয়ে পরেছে। হাঁটার মত অবস্থায় তিনি নেই। বসা অবস্থায় ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে বেড়িয়ে আসলেন ডাষ্টবিন থেকে। সেভাবেই উঠলেন ফুটপাতে। খানিক পরেই তিনি ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতেই শুয়ে পরলেন। প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে তার। এই করুন অবস্থাতেও তার একটুও খারাপ লাগছেনা। নিজের কর্মফল ভোগ করছেন তিনি। বড় ছেলে সব সময়ই তার কাজকর্মের বিরোধিতা করত। তাকে বোঝাত। কিন্তু তিনি সেসব কথা শোনবার মানুষই ছিলেননা। বাধ্য হয়ে ছেলেটা ছাত্র অবস্থায় বাড়ি ছেড়েছিল। তিনি একবারও বাঁধা দেননি কিংবা ছেলের সাথে কোন যোগাযোগও করেননি। আজ তার ছেলে কোথায় থাকে তিনি জানেননা। কিংবা সে বিয়ে করেছে কিনা সেটাও জানেননা। আশ্চর্য হলেও সত্যি এই মুহূর্তে তার নিজের ছেলের নামই মনে পরছেনা। হু হু করে কেঁদে উঠলেন আইভি রহমান।

চোখে আলো পরতেই জেগে উঠলেন আইভি রহমান। সকাল হয়েছে। রাতে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলেন বুঝতেই পারেননি। অতি কষ্টে উঠে বসে একটা পোলে হেলান দিয়ে বসলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেভাবেই হোক ফিরে যাবেন মিনহাজ রহমানের কাছে। তার পায়ে পরে ক্ষমা চাইবেন। এমন বিভীষিকাময় জীবন তিনি কাটাতে পারবেননা। নিজেকে শোধরাবেন তিনি। পোলে হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনে। রাস্তায় কে যাচ্ছে, তাকে ডিঙিয়ে কে বা কারা যাচ্ছে সেই দিকে নজর নেই তার। তিনি নিজের জীবনের পাপের হিসাব করতে ব্যস্ত। ঠিক তখনই তার মনে পরল, গতরাতে তিনি স্বামীর নাম মনে করতে পারছিলেননা। এমনকি রাতে তার স্মৃতি থেকে অনেককিছুই বিস্মৃত হয়েছিল। এই মুহূর্তে তিনি তার সেই বেইমান বান্ধবীর নামও ভুলে গেছেন। সেই সাথে ভুলে গেছেন কোথায় সে থাকে।

***

সামনের পেছনের গাড়ির হর্নের শব্দ কর্ণ গহবরে ধাক্কা দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মাথা ব্যাথার আগমন। যানজটে আটকে আছে পনের মিনিট যাবৎ। একটুখানি বাতাসের আশায় গাড়ির জানালা খুলে দিয়েছিল মিথুন। কিন্তু বাতাস তো দূরের কথা বাতাসের নামগন্ধের দেখা নেই। তারউপর উপড়ি পাওনা হিসেবে জুটেছে হর্নের শব্দ। ড্রাইভারকে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিতে বলে সিটে হেলান দিয়ে বসল মিথুন। এই ওর এক বাজে অভ্যাস। গাড়ির জানালা বন্ধ রাখতে পছন্দ করেনা মোটেও । আচানক জানালা দিয়ে একটা হাত প্রবেশ করল গাড়ির ভেতরে। প্রথমে চমকায় মিথুন। পরে দেখল একটা বাচ্চা মেয়ে সাহায্যের আশায় হাত পেতেছে। বাচ্চাটাকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। ওয়ালেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে মেয়েটির হাতে দিল। টাকা পেয়ে মেয়েটা খুশিতে ডগমগ হয়ে অন্য গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। মেয়েটার খুশি দেখে মিথুনের মুখটা হাসিহাসি হয়ে গেল। মেয়েটা কোথায় যায় দেখবার জন্য জানালা দিয়ে মাথা বের করল। ততক্ষণে মেয়েটা পেছনের একটা গাড়ির নিকট পৌঁছে গেছে। বেশ মনোযোগ দিয়ে মিথুন দেখছে মেয়েটিকে। মেয়েটি একটা গাড়ি থেকে আরেকটা গাড়ির কাছে যেতেই মিথুন নিজেও ঠিকভাবে বসার প্রস্তুতি নিল। মাথা ঘোরাতেই চমকে উঠল। অতি পরিচিত একটা মুখ দেখে বিস্ময়ে কপাল কুঁচকে গেল। ততক্ষণে ওর গাড়িটা নড়ে উঠেছে।

” মিজান, গাড়িটা সাইডে দাঁড় করাও। ”

ড্রাইভার গাড়ি সাইড করতেই গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে আসল মিথুন। প্রায় দৌড়ে গিয়ে পৌঁছাল ফুটপাতের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পোলের দিকে।

আইভি রহমান একটা পাউরুটিতে কামড় দিয়েছেন। চিবোচ্ছেন বেশ খানিকক্ষণ যাবৎ। কিন্তু তার গলা আর বুক শুকনো থাকায় গিলতে পারছেননা। তাকে দেখে দয়াপরবশ হয়ে একজন স্কুল ছাত্রী তাকে পাউরুটি কিনে দিয়েছে।

” আম্মু! ”

অনেক বছর পর পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকালেন আইভি রহমান। ঝাপসা চোখে তাকালেন সামনে। তার সামনে উবু হয়ে বসা মুখটিকে দেখে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তার মনে হচ্ছে, সামনে বসা ছেলেটিকে তিনি চেনেন। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেননা সে কে।

” তুমি কে বলতো? আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আমি চিনি। তুমি আমার খুব কাছের কেউ। তোমার কণ্ঠস্বরও আমার খুব পরিচিত। কে তুমি, বাবা? ”

” আম্মু, আমি মিথুন। তোমার ছেলে। তুমি এখানে, এভাবে বসে আছ কেন? তোমার এমন অবস্থা কিভাবে হয়েছে? ” মা’কে অপ্রকিতস্থ অবস্থায় দেখে মিথুনের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।

” মিথুন আমার ছেলের নাম? আমি জানি আমার একটা বড় ছেলে আছে, কিন্তু ওর নাম কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। ”

মিথুন বুঝল ওর আম্মু স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার কিছু একটা হয়েছে। সে আর সময় নষ্ট করলনা। আইভি রহমানকে গাড়িতে তুলল। তাকে নিয়ে সোজা ছুটল হসপিটালের দিকে।

***

পেখম গ্রাম থেকে ফিরেছে পনের দিন আগে। হুট করেই সেদিন ও রিশানকে নিয়ে ঢাকা এসেছিল। এবার ও রাবেয়া সুলতানাকে রেখেই ঢাকা এসেছে। ক্লাস শেষ করে শপিংয়ে এসেছে পেখম। বড়মা তার নাতি-নাতনীদের কেনাকাটার জন্য টাকা দিয়েছে পেখমের কাছে। সেগুলো কিনতেই ওর শপিং-এ আসা। একগাদা জিনিসপত্র কিনে পেখম শপিংমলের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে কোন রিক্সা দেখতে পাচ্ছেনা। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সাথে আশেপাশে তাকায় রিক্সা পাবার আশায়। ঠিক তখনই ওর চোখ যায় ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকা এক ব্যাক্তির দিকে। তার পরনের পোশাক মলিন। চোখমুখ উসকোখুসকো। গালে অনেকদিনের না কামানো দাড়ি। এতগুলো মাস পর মৃদুলকে এই অবস্থায় দেখে হাসি পেল পেখমের। ওর সাথে বেইমানী করা মানুষটা যে ভালো নেই, সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পেখম আর তাকালোনা মৃদুলের দিকে। একটা রিক্সা এসে দাঁড়াতেই তাতে উঠে বসল।

***

আইভি রহমানের রিপোর্ট হাতে নিয়ে মলিন মুখে বসে আছে মিথুন। রিপোর্ট বলছে, আইভি রহমানের স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে। অতীতের অনেককিছুই তিনি ভুলে গেছেন। আর এসব নিজ থেকে ঘটেনি, ঘটানো হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট ঔষধ বেশ কিছুদিন তাকে ইনজেক্ট করা হয়েছে। তার ফলেই আইভি রহমান অনেককিছুই ভুলে গেছেন। এছাড়াও তার শরীরে নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নার্ভের সমস্যা দেখা দিয়েছে। মিথুন সিদ্ধান্ত নিল আইভি রহমানকে আরও কিছুদিন হসপিটালে রেখে চিকিৎসা করাবে।

***

প্রনয়া’র ভিসা হয়ে যাওয়ায় ও ইউএস এসেছে। ও একা আসতে ভয় পাচ্ছিল, তাই রাজ্য ওর সাথে এসেছে। ওকে অরবিন্দের কাছে পৌঁছে দিয়েই দেশে ফিরবে। ও গ্রামে থাকতেই পেখম ঢাকা গেছে। প্রনয়ার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পেখমের সাথে দেখা হয়নি ওর। সেটা নিয়ে বারবার আফসোস করছে আর সামনে যা পাচ্ছে তাতেই মাথা ঠুকছে। কিন্তু অরবিন্দ সেসবে কান না দিয়ে রাজ্যকে নিজের কাছে আটকে রেখেছে। কিছুদিন পর প্রনয়ার জন্মদিন। সে চাইছেনা জন্মদিনের আগে রাজ্য দেশে যাক। তাই বাধ্য হয়ে রাজ্যকে এখানে থাকতে হচ্ছে। অবশ্য এরমধ্যে একদিন রাজ্য ভার্সিটিতে গেছে। তাদের সাথে কথাবার্তা বলেছে। কতৃপক্ষের অনুরোধে ওকে কয়েকদিন ক্লাসও নিতে হবে। সবদিক মিলিয়ে রাজ্য বিপদে পরেছে। ও নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে অরবিন্দের অনুরোধ রক্ষা করছে। অবশ্য মাঝেমধ্যে বাগে পেলেই তাকে দু-চার ঘা বসিয়ে দিতে দ্বিধা করছেনা।

***

আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন আইভি রহমান। তাকে নিজের বাসায় এনেছে মিথুন।

” তোর বাসা এটা, মিথুন? ”

” হুম, আম্মু। আমার ছেলেমেয়েকে দেখবেনা? ”

” ডেকে নিয়ে আয়, দেখি আমার নাতি-নাতনীদের। ”

” ঊর্মি, বাচ্চাদের নিয়ে এস। ” মিথুন স্ত্রীকে বলল। এ কয়দিন নিয়মকরে ঊর্মি হসপিটালে গিয়ে শ্বাশুড়ির সেবা করেছে। তবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যায়নি।

নাতি-নাতনীদের দেখে আবেগে কেঁদে ফেললেন আইভি রহমান। মনে হচ্ছে তার সামনে দু’টো পুতুল এসে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের জমজ বাচ্চা মিথুনের। আইভি রহমান কোলে নিলেন বাচ্চাদের।

” আমি কত দুর্ভাগা, নাতি-নাতনীদের মুখ প্রথমবার দেখছি কিন্তু ওদের দেবার মত কিছুই নেই আমার কাছে। ”

” কিছুই দিতে হবেনা, তুমি শুধু দোয়া কর। তাতেই হবে। ”

রাতে খাবার পর মা’য়ের রুমে গিয়ে বসল মিথুন।

” আম্মু, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ”

” বল, বাবা। ”

” আমি যদি তোমাকে অন্য কোন ফ্ল্যাটে রাখি, তুমি কি রাগ করবে? আসলে এই বাসায় আব্বু প্রতিদিনই আসে। সে তোমাকে এখানে দেখলে হয়তো আর কখনোই আসবেনা। তোমার সিচুয়েশন আব্বুকে জানিয়েছি, কিন্তু আব্বু এ নিয়ে কোন কথাই বলতে চায়না। ইনফ্যাক্ট এ বিষয়ে তার কোন আগ্রহই নেই। ”

আইভি রহমান সব শুনে নিরব থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর তিনি মুখ তুলে চাইলেন।

” তোকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছি বোধহয়? তোর সিদ্ধান্তের ওপর কোন কথা বলবনা আমি। যার জন্য আমি আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যায় করেছি, আমার সেই ছেলে বিপদের সময় আমাকে নিজের কাছে রাখেনি। আমার খোঁজ নেয়নি। কিন্তু তুই সব ভুলে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিস। তুই যা বলবি আমি সেটাই শুনব। আমার এতদিনের পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি। এজন্য কোন আফসোস নেই আমার। ”

” রাগ করোনা, আম্মু। আমার ছেলেমেয়েরা দাদুকে একদিন না দেখলে থাকতে পারেনা। ”

” রাগ করিনি, বাবা। তুই আমাকে যেখানে রাখবি আমি সেখানেই থাকব। শুধু প্রতিদিন বাচ্চা দুটোকে দেখিয়ে নিয়ে আসবি। একদিনেই ওদের ওপর মায়া জন্মে গেছে। তুইও যাবি বউমাকে নিয়ে। এক কাজ কর, এখন তো আমি ঐ বাড়িতে থাকিনা। তুই বউমাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে থাক। বউমারও শ্বশুর বাড়িতে থাকার অধিকার আছে। ”

” না আম্মু, এখানেই আমি বেশ আছি। ”

” নতুন বাড়িতে কবে পাঠাবি আমাকে? ”

” কালকেই। সন্ধ্যায় আব্বু এখানে আসবে। তার আগেই তোমাকে নিয়ে যাব আমি আর ঊর্মি। ফ্ল্যাটটা এখানেই। পাঁচ মিনিট লাগবে হাঁটলে। তুমি চাইলে তোমার নাতি-নাতনীদের সারাদিন নিজের কাছেই রাখতে পারবে। খাবারদাবার এখান থেকেই নিয়ে যাবে ঊর্মি। ও প্রতিদিন তিনবেলা করে তোমার কাছে যাবে। ”

” ঠিক আছে, বাবা। ” মিথুন যে এখনো তার জন্য ভাবছে, তার ব্যবস্থা করছে এতেই তিনি খুশি।

চলবে…

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৬
জাওয়াদ জামী জামী

” পেখম, প্লিজ একটু দাঁড়াও। আমার কথা শোন প্লিজ। প্রতিদিন এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি, শুধু তোমাকে কিছু কথা বলব বলে। প্রায় বিশদিন পর তোমার দেখা পেলাম আমি। ” ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই পেখম মুখোমুখি হল মৃদুলের।

মৃদুলকে দেখে প্রথমে চমকালেও খুব দ্রুতই নিজেকে স্বাভাবিক করল পেখম। ও মৃদুলের কথা না শোনার ভান করে সামনে হাঁটতে থাকে। মৃদুলও ওর পিছে হাঁটতে শুরু করল।

” প্লিজ পেখম, বেশি সময় নিবনা। একটু দাঁড়াও। ” আবারও অনুনয় করল মৃদুল।

” কিসের কথা আপনার সাথে? আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই, থাকতেও পারেনা। আর কখোনো আমার সামনে আসবেননা, আমাকে বিরক্ত করবেননা। ফের যদি এমন করেন, তবে আমি পুলিশে খবর দেব। ”

” সেটা তুমি ভালোই পার। বড় ভাই পুলিশের কর্মকর্তা জন্য ভাব দেখাও? ভুলে যেওনা আমিও কিন্তু ফেলনা নই। তোমার অহংকার চূর্ণ করবার ক্ষমতা আমার আছে। আমি এসেছি তোমার সাথে কয়টা কথা বলতে, আর তুমি আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছ? ”

” এইতো নিজের রূপে এসে গেছেন। আপনি একটা গিরগিটি সেটা কি জানেন? নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে সব করতে পারেন আপনি, এটা আমি জানি। আর সেজন্যই আপনাকে সাবধান করেছি। আপনার সাথে কথা আমার অনেক আগেই ফুরিয়েছে। ”

” তোমার কথা ফুরোতে পারে, আমার ফুরোয়নি। আমার জীবন, ক্যারিয়ার নষ্ট করে দিয়ে বড় গলায় কথা বলছ? তোমার জবান বন্ধ করার ক্ষমতা আমি রাখি এটা মনে রেখ। ভালোয় ভালোয় বলছি, কেসটা তুলে নাও। আমি বিরক্ত হয়ে গেছি এসবে। আমার সেভিংস প্রায় শেষের দিকে। রেজিষ্ট্রেশনও বাতিল হয়ে গেছে। নানান চিন্তা আমাকে ঠিক থাকতে দিচ্ছেনা। আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছ তুমি। ”

” আমি আপনার জীবন নরক বানিয়েছি! যদি বলি উল্টোটা ঘটেছে? আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করিনি। আপনারাই আমাকে পছন্দ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমার সাথে বেইমানী করেছেন, ঠকিয়েছেন আমাকে৷ কেইস আমি তুলবনা। দেখি কেমন জবান বন্ধ করতে পারেন আপনি। পাপ করার আগে একবারও মনে হয়নি, এর শাস্তি কখনো না কখনো পেতেই হবে? এতকিছুর পরও একটুও লজ্জা হয়না আপনার! বড় গলায় কথা বলছেন? হুমকি দিচ্ছেন আমাকে? ”

” হুমকি মনে করলে হুমকি। আমি আবারও বলছি, কেইস তুলে নাও। শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে। আমার কথার অন্যথা হলে তোমাকেও শান্তিতে থাকতে দেবোনা। ”

মৃদুলের কথায় ওর দিকে তাকিয়ে হাসল পেখম। এতকিছুর পরও এর মধ্যে কোন অনুশোচনা দেখতে পেলনা।

” কি করবি তুই? আদৌও কি কোনকিছু করার ক্ষমতা তোর আছে? ফাঁপড় নিচ্ছিস? এতক্ষণ অনেক কথা বলেছিস। তোর কপাল ভালো, মুখের ভেতর দাঁতগুলো এখনো ঠিকঠাক আছে। আর একটা কথা বললে তোর মুখের মানচিত্র আমি পাল্টে দেব। ”

হুট করেই রাজ্যকে দেখে চমকে গেল পেখম। আরও বেশি চমকালো রাজ্যের চেহারা দেখে। ওর লাল চোখদুটো দেখে পেখম ঢোক গিলল। কানন ওর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রাগে ফোঁসফোঁস করছে সে।

পেখমের মত মৃদুলও চমকায়। সে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে রাজ্যের দিকে। কিছু একটা ভাবছে সে। চেনার চেষ্টা করছে তাকে। অনেকক্ষণ পর যেন কিছু একটা মনে পরে গেল। ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।

” কোর্টের বাহিরে সেদিন আপনিই ছিলেন? আমাকে মারতে মারতে আধমরা করেছিলেন! অবশ্য আপনার চেহারা সেদিন মাস্ক দিয়ে ঢাকা ছিল। কিন্তু এই চোখ আর কণ্ঠস্বর আমি ঠিকই চিনতে পেরেছি। আমার কাছে এখন সব ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আপনার প্রেমিকা আপনাকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে তাইনা? আজকেও এসেছেন প্রেমিকাকে প্রটেক্ট করতে? আপনার সাথে আদালতেই কথা হবে। আপনাকে ছাড়বনা আমি। ” মৃদুল কড়া গলায় বলল।

” সেদিন তোকে যে কেন শেষ করলামনা! আজকে আমার আফসোস হচ্ছে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোকে বাঁচিয়ে রাখা। আদালতে যাবি? তবে যা। কিছু প্রমান করতে পারবি? তোর বিরুদ্ধে কিন্তু অনেক প্রমানই আমার কাছে আছে। পেখমের পেছনে তুই দুইজনকে লেলিয়ে দিয়েছিস, সেটা কিন্তু আমি জানি। প্রমানও আছে আমার কাছে। আমি আমার প্রিয় নারীকে প্রটেক্ট করছি, প্রেমিকাকে নয়। পারলে আমাকে ঠেকিয়ে দেখা। ”

মৃদুল আর রাজ্যের কথা পেখমের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। কেইস চলাকালীন সময়ে পেখম শুনেছিল কে বা কারা মৃদুলকে ভিষণ মেরেছে। কিন্তু দুষ্কৃতকারী কে সেটা জানা যায়নি। অথচ আজ ও শুনছে ঘটনাটা রাজ্যই ঘটেছিল। আবার সে আজকে বলছে, মৃদুল ওর পেছনে দু’জনকে লেলিয়ে দিয়েছে! অবশ্য পেখম কয়েকদিন থেকেই খেয়াল করছে দু’জন লোক সন্দেহজনকভাবে ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ও যেখানেই যায়, কাকতালীয়ভাবে লোক দুটোও সেখানেই যায়।

” এসব মিথ্যা কথা। আপনি আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। ” মৃদুল কাঁপা গলায় বলল।

” আচ্ছা! তাহলে আদালতেই সব প্রমান হয়ে যাবে? তোকে আরও পাঁচ বছর জেলে পঁচানোর মত রসদ আমার কাছে আছে। আমি চাইলেই এই মুহূর্তে তোর পোষা কুত্তাগুলোকে সবার সামনে ন্যাংটো করে ছেড়ে দিতে পারি। করব? দেখবি? জামিনে বেরিয়ে এসে দাদাগিরি ফলাতে চাইছিস? কিন্তু তোর বোধহয় জানা নেই, তোর মত কয়েকশো রাস্তার ছ্যাঁচড়াকে আমি পকেটে রাখি। দাদার সাথে দাদাগিরি ফলাতে আসার মত ভুল করিসনা। কখন কোথায় মরে পরে থাকবি টেরও পাবিনা। জেনে রাখ, ফাঁকা বুলি আউড়ানোর স্বভাব নেই আমার। আমি নগদে বিশ্বাসী। পেখমের পেছনে তুই কিংবা তোর পোষা কুত্তাদের দেখলেই সাথে সাথে যমেরবাড়ি পাঠিয়ে দেব। ”

রাজ্যের কথাগুলো শুনে ভয় পায় মৃদুল। ও মুহূর্তেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়। রাজ্যের দিকে তাকিয়েই ও বুঝতে পেরেছে, লোকটা ফাঁকা বুলি ঝাড়ছেনা। তারপর যখন খেয়াল করল, ওদের চারপাশে পাঁচ-ছয়জন ছেলে ঘুরঘুর করছে, তখন ওর ভয় আরও বেড়ে গেল। ছেলেগুলো যে এর পক্ষের সেটা বুঝতে বাকি রইলনা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে কোনোরকম মিনমিন করে পেখমের কাছে ক্ষমা চেয়ে কেটে পরল মৃদুল। সে কথা দিল ভবিষ্যতে পেখমের আশেপাশেও আসবেনা।

মৃদুল চলে যেতেই রাজ্যের দিকে তাকায় পেখম। সেই সাথে অগ্নিদৃষ্টিকে ভষ্ম করে দিতে চাইল তাকে। এক ফাঁকে রাগী চোখে তাকাল কাননের দিকে।

” পর্দার অন্তরালে তাহলে আপনিই ছিলেন? আপনি তো দেখছি মিচকে শয়তান! ”

” কানন তোর বউয়ের বড় বোনকে বলে দে, আমি তার বোনের জামাইয়ের বড় ভাই। আমাকে শয়তান বলা মানে আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে শয়তান বলা। অথচ আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীর মানুষরা যে সাধু পর্যায়ের সেটা সে ভালো করেই জানে। ”

” অসহ্য। কানন ভাইয়া, তুমি এই লোকটাকে আমার সামনে আসতে নিষেধ করে দিও। আর একবারও যদি সে আমার সামনে আসে, তবে লোকজন ডেকে তাকে আমি গণধোলাই খাওয়ানোর ব্যবস্থা করব। ”

” আমি তোমার জন্য প্রতিদিন তিনবেলাই গণধোলাই খেতে রাজি আছি। কখন থেকে শুরু করবে? এখনই? তাহলে লোকজন জড়ো কর। এই আমি বসলাম। ” রাজ্য ধপ করে ফুটপাতে বসল।

রাজ্যকে এইভাবে বসতে দেখে পেখমের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। এই মানুষটা যে বেপরোয়া সেটা বুঝতে ওর বাকি রইলনা। এই লোকের সাথে কথায় বা কাজে পেরে ওঠা ওর কম্ম নয়। ভেতরে ভেতরে সে এতকিছু করেছে জেনে পেখম হতবাক হয়েছে। সামনে একটা রিক্সা আসতেই সেটাতে উঠে বসল পেখম।

***

রাতে রাবেয়া সুলতানার ফোন পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল পেখম। দাদু ভিষণ অসুস্থ হয়ে গেছেন। তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে রাত নয়টা বেজে গেছে। এসময় একা একা গ্রামে যাওয়া ওর পক্ষে অসম্ভব। ওর যখন চিন্তায় দিগবিদিক জ্ঞান হারানোর অবস্থা, ঠিক তখন ওকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসল কানন। ওকে অসময়ে দরজার সামনে দাঁড়াতে দেখে অবাক হয়ে গেল পেখম।

” কানন ভাইয়া, তুমি? ভেতরে এস। ”

” তুমি কি গ্রামে যাবে? গেলে চল। আমরাও গ্রামে যাচ্ছি। ”

” কে কে যাচ্ছ? হঠাৎ তুমি গ্রামে যাচ্ছ কেন? ”

” দাদু নাকি অসুস্থ হয়ে গেছেন, সেজন্যই আমরা যাচ্ছি। তুমি গেলে আমাদের সাথে যেতে পার। ”

পেখম আর কিছু না ভেবেই রাজি হল।

” তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি ব্যাগ গুছিয়ে নেই। ”

গাড়ির পাশে রাজ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও না দেখার ভান করল পেখম।

” রিশান, তুই আমার সাথে বস। পেখম আপু, তুমি সামনে গিয়ে বস। ” কানন পেছনের সিটে বসে রিশানকে ওর পাশে বসতে বলল। রিশান ওর কথামত কাননের পাশে গিয়ে বসল।

পেখমের মন খারাপ থাকায় ও কিছু না বলে সামনের সিটে গিয়ে বসল। রাজ্য বসল ড্রাইভিং সিটে। ওদের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আড়াইটা থেকে তিনটা বাজবে।

ওরা ঢাকা ছেড়েছে অনেক আগেই। টাঙ্গাইল রোডে এসে একটা ছোটখাটো হোটেল দেখে রাজ্য গাড়ি থামাল। রিশান ঘুমাচ্ছে। কাননেরও ঘুম পেয়েছে। পেখম জেগে আছে। ও চুপচাপ বাহিরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজ্যকে গাড়ি থামাতে দেখেও কিছু বললনা পেখম।

” চাইলে বাহিরে আসতে পার। আসবে? ”

” নাহ্। ”

রাজ্য কথা না বাড়িয়ে সোজা চলে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরে। কিছুক্ষণ পর একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে আসল। খুলে দিল পেখমের দিকের দরজা। একটা চা ভর্তি কাপ বাড়িয়ে ধরল পেখমের দিকে। ততক্ষণে রিশানও জেগে উঠেছে। ও গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ পায়চারী করল।

পেখম নিরবে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে রাজ্যের দিকে। ওদের জন্য অনেক খাবার এনেছে সে। রিশান আর কানন দু’জন মিলে খাচ্ছে সেগুলো। রাজ্যও শুধু চা নিয়েছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার। রাজ্য বিরক্ত হয়ে বারবার ঠিক করছে চুলগুলো। পরক্ষণেই আবার যে কি সেই। দৃশ্যটা দেখতে মন্দ লাগছেনা।

রাতের আঁধার চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে ওদের গাড়ি। জানালা খুলে রেখেছে পেখম। শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওর সর্বাঙ্গ। থেকে থেকেই কেঁপে উঠছে সে। জানালা বন্ধ করতে আলসেমি লাগছে। হুট করেই গাড়ি থামাল রাজ্য। পেখমের দিকে তাকিয়ে বলল,

” শীত লাগছে? বন্ধ করব জানালা? ”

” উঁহু। ”

রাজ্য বুঝলনা পেখমের ‘ উঁহু ‘ র মানে। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকাল ওর দিকে। এরপর কোলে থাকা শার্ট বাড়িয়ে ধরল পেখমের দিকে।

” বিরক্ত না লাগলে এটা শরীরে জড়াতে পার। গতকাল নতুন কিনেছি। একবার আধাঘণ্টার জন্য গায়ে দিয়েছিলাম। ”

পেখম কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকল রাজ্যের দিকে। হাত বাড়িয়ে নিল শার্টটা। শরীরের সামনের দিকে জড়ালো সেটা। এতক্ষণ গলায়, বুকে বাতাস লাগছিল। শার্ট জড়ানোর ফলে একটু আরামবোধ হচ্ছিল।

অনেকক্ষণ থেকেই হালকা সুগন্ধ পাচ্ছে পেখম। বুঝতে পারছিলা কিসের সুগন্ধ। গাড়ি ব্রেক করতেই সামনের দিকে ঝুঁকতেই বুঝল শার্ট থেকে পারফিউমের সুগন্ধ আসছে। কোন ব্রাণ্ডের পারফিউম সেটা বুঝলনা পেখম। ছেলেদের পারফিউম সম্পর্কে ওর কোন ধারনা নেই। বিয়ের পর থেকেই মৃদুলের জন্য তেমন একটা কেনাকাটা করেনি পেখম। প্রথম থেকেই দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ছিল চোখে পরার মত। তাই মৃদুলের ব্যাবহৃত কোন জিনিসপত্র তেমন একটা ঘেঁটেও দেখতনা। মৃদুল সেটা পছন্দও করতনা। অনেকদিন পর অতীত মনে পরতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পেখম। এই অতীতের সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো ওর পিছু ছাড়বেনা কখনোই।

রাজ্য গাড়ি চালানোর ফাঁকে আঁড়চোখে দেখছে পেখমকে। মেয়েটা যে কিছু একটা ভাবছে সেটা বুঝতে পারছে। মেয়েটার বিষন্ন মুখই বলে দিচ্ছে ও নিজের অতীতের কথা ভাবছে।

” কি এত ভাবছ? আমি ড্রাইভার হিসেবে মোটেও খারাপ নই। আমেরিকার রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভ্যাস আছে আমার। লাইসেন্সও আছে। তাই কোন দূ্র্ঘটনা ঘটার ভয় নেই। তুমি শুধু হাসিমুখে বসে থাক, দেখ আমি গাড়িকে উড়িয়ে গ্রামে নিয়ে যাব। আমার হাতে গাড়িও এ্যারোপ্লেন হয়ে যায়। ” পেখমকে অতীত থেকে ফেরাতেই বলল রাজ্য।

রাজ্যের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে হাসল পেখম।

চলবে…