সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-৪৯

0
342

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪৯
জাওয়াদ জামী জামী

অনুভূতিহীনভাবে মীর বাড়িতে পা রাখল পেখম। প্রথমবার বিয়ের পর যত আবেগ, উত্তেজনা নিয়ে মৃদুলের বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছিল, তার ছিঁটেফোঁটাও রইলনা আজ। নাবিলা পেখমের হাত ধরে নিয়ে গেল রাজ্যের রুমে। আগে কখনোই এই রুমে আসেনি পেখম। এই বাড়ির প্রতিটা কোন ওর চেনা শুধু এই রুমটা বাদে। রুমে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায় পেখম। দেয়ালে ওর ছবি ঝুলছে! বৃষ্টিতে জুবুথুবু পেখম দৌড়ে যাচ্ছে। অনেক চিন্তা করেও মনে করতে পারলনা এই ছবি কে তুলেছে, কিংবা কবে তুলেছে? অবাক নয়নে তাকিয়েই রইল ছবির দিকে।

” অবাক হচ্ছ, আপু? আমরাও প্রথমে অবাক হয়েছিলাম ছবিটা দেখে। ভাইয়াকে চেপে ধরেছিলাম, কোথায় পেয়েছে ছবিটা। অনেক চাপাচাপির পর জানতে পেরেছিলাম, ভাইয়া নিজে ছবিটা তুলেছে। ” পেখমকে অবাক হতে দেখে নিজ থেকেই বলল নাবিলা।

” আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে, নাবিলা? ভিষণ তেষ্টা পেয়েছে। ” সত্যিই পেখমের পিপাসা পেয়েছে। ছবিটা দেখে ওর মাথা ঘুরছে।

” এক গ্লাস কেন, এক ড্রাম পানিও আনতে পারব তুমি চাইলে। ” নাবিলা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

***

রাজিয়া পারভীন কাঁদছেন। একটু দুরেই চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে রাজ্য কৌতুহলী চোখে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সাথে ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা। পেখমের হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁদছেন তিনি।

” বেয়াদব ছেলে, এভাবে হাসছিস কেন? আমার কান্না দেখে সুখ পাচ্ছিস? ” শাড়ির আঁচলে নাক মুছে বললেন রাজিয়া পারভীন।

” সুখ পাব কোন দুঃখে! আমিতো এটাই ভাবছি তুমি কেন কাঁদছ। একমাত্র ছেলের বিয়ে উপলক্ষে কোথায় তুমি খুশিতে সাম্বা ডান্স দিবা। কিন্তু সেটা না করে তুমি কাঁদছ। কেন কাঁদছ, মা জননী? এই অধমকেও একটু জানাও তার কারন। ”

” আমি খুশিতে কাঁদছিরে, হতচ্ছাড়া। আমার কতদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে সেটা তুই জানিস? সেই এতটুকুন কাল থেকে পেখমকে আমি ছেলের বউ বানাতে চাইতাম। ওকে বউমা বলে ডাকতাম। কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ পেখম আমার ছেলের বউ হয়েছে, সেই আনন্দে আমি কাঁদছি। তুই চুপ থাক। আমাকে একটু শান্তিতে কাঁদতে দে। ” কথাগুলো বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি।

পেখম বড়মা’র কথা শুনে স্থানকাল বিবেচনা না করেই হাসতে শুরু করল। পেখমকে হাসতে দেখে রাজিয়া পারভীন ওর মাথায় টোকা দিলেন।

” পাজি মেয়ে, তুই আবার হাসিস কেন? আমার সুখ তোদের সহ্য হচ্ছেনা? তোরা কি চাসনা আমি তোদেরকে নিয়ে সুখে থাকি? ”

” তোমার কান্নার কারন শুনে হাসি আটকাতে পারিনি, বড়মা। সরি আর হাসবোনা। ” কথাটা মুখে বলল ঠিকই, কিন্তু হাসি বন্ধ করলনা।

” তুই আমাকে ‘ বড়মা ‘ বলছিস কেন? আমি তোর শ্বাশুড়ি হই। আমাকে ‘ মা ‘ ডাকবি আজ থেকে। আজ দুপুর পর্যন্ত আমি তোর ‘ বড়মা ‘ ছিলাম। বিকেল থেকে তোর ‘ মা ‘ হয়ে গেছি। এখন একটু চুপচাপ বসে থাক। আমি প্রানভরে কেঁদে নেই। ”

পেখম রাজিয়া পারভীনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যিই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন! পেখম ভাবছে , খুশিতেও মানুষ এভাবে কাঁদতে পারে!

অনেকক্ষণ পর চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হলেন রাজিয়া পারভীন। পেখমের দু’হাতের উল্টোদিকে চুমু দিয়ে, ওর হাতে বালা পড়িয়ে দিলেন। তার পাশে থাকা বাক্স থেকে বের করলেন সাতনরি হার। পড়িয়ে দিলেন পেখমের গলায়। গহনার বাক্সটা ধরিয়ে দিলেন পেখমের হাতে।

” এগুলো এখন থেকে তোর। তুই যখন ক্লাস এইটে পড়তিস, একদিন আব্বা এসে বললেন, তোকে নাতিবউ বানাতে চান তিনি। সেইমত সৈয়দ চাচার সাথে কথাও বলেছেন। আমি তার পরদিনই আনন্দে এই হারটা গড়াতে দিয়েছিলাম। আশা ছিল পুত্রবধূকে বরন করব এটা দিয়ে। এরপর মাঝেমধ্যেই দু’একটা করে গয়না গড়াতে দিতাম। শুধুমাত্র তোকে দেব বলে। তোর সেই ছোটবেলা থেকেই তোর এই মায়াভরা মুখটা, তোর চাহনি আমাকে বড্ড টানত। মনে মনে খুব চাইতাম, তুই যেন আমার রাজ্যের বউ হয়ে এই বাড়িতে আসিস। আজ অবশেষে আমার এত বছরের আশা পূরণ হয়েছে। দোয়া করি তুই সুখী হ। আমার বাঁদর ছেলেটার জীবন পূর্ণ কর। দু’জনে দু’জনের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হ। ” রাজিয়া পারভীন পেখমের কপালে চুমু দিয়ে বললেন।

” বাহ্ আমে দুধে মিলে গেল দেখছি! আর আমি আমের খোসা পরে রইলাম বাহিরে। ” রাজ্য কৃত্রিম আফসোসের সাথে বলল।

” বাহিরে থাকবি কেন? তুইও আমার কলিজার টুকরা। তোদের সুখী হতে দেখলেই আমি সুখী হব। ”

” ক্ষুধা লেগেছে, আম্মু। আমার কিপ্টা চাচাশ্বশুর না আমাকে খাইয়েই মেয়েকে বিদায় দিয়েছে। তাড়াতাড়ি খেতে দাও। ”

” তুই খেলিনা কেন? মানা করেছিল কেউ? সবাই তোকে কতবার খেতে বলল। নিজে না খেয়ে চাচা শ্বশুরের দোষ দিচ্ছিস? ”

” খুশির ঠ্যালায় তখন পেট আপনাআপনিই ভরে গিয়েছিল। তাই খাইনি। ”

” একটু অপেক্ষা কর, আমি খাবার নিয়ে আসছি। পেখম, তুই গহনাগুলো আলমারিতে তুলে রাখ। তোর কাপড়চোপড়ও তুলে রাখ। রাজ্য, আলমারির চাবি পেখমের কাছে দে। তুই তো আবার তোর আলমারির চাবি কাউকে দিসনা। কাপড়ও গোছাতে দিসনা। না জানি আলমারিতে কাপড়চোপড় কি অবস্থায় আছে। আমি খাবার নিয়ে আসতে আসতে পেখম সব গুছিয়ে রাখুক। ”

রাজিয়া পারভীন রুম থেকে বেরিয়ে গেলে রাজ্য পেখমকে আলমারির চাবি দিল।

” তোমার সুবিধামত সব গুছিয়ে রাখ। চাবিও তোমার কাছেই রেখে দাও। এই রুমটাই এখন তোমার। যেখানে যা রাখার প্রয়োজন, সেভাবেই রেখ। ”

পেখম রাজ্যের হাত থেকে চাবি নিয়ে আলমারি খুলল। আলমারি খুলে হতবাক হয়ে গেল। প্রতিটা তাকে রাজ্যের কাপড় সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা আছে। এইমাত্র বড়মা বলে গেল, রাজ্য কাউকে আলমারি গোছাতে দিতে দেয়না। তারমানে, নিজের কাপড়চোপড় সে নিজেই গুছিয়ে রাখে! পুরুষমানুষও এতটা গোছালো হয়!

পেখম বিস্ময় গোপন করে ব্যাগ থেকে নিজের পোশাক বের করে একে একে গুছিয়ে রাখ। ভেতরের ড্রয়ারে গহনাগুলো রাখতে গিয়ে ওর বিস্ময়ের সীমা থাকলনা। ওর হারিয়ে যাওয়া একটা নুপুর সেখানে দেখে ঘুরে তাকাল রাজ্যের দিকে। শুধু নুপুর নয়, ওর ওড়না, দুইটা কাঁচের চুড়ি, পেখমের কিছু ছবি ড্রয়ারে সযত্নে তুলে রাখা আছে। এসব জিনিস সে পেলো কোথায় থেকে?

পেখমকে ড্রয়ার খুলতে দেখে রাজ্য কপালে হাত দিল। পেখমের জিনিসগুলো যে ড্রয়ারে রেখেছে, সেটা এই মুহূর্তে ভুলে গিয়েছিল।

পেখম রাজ্যের দিকে তাকিয়ে দেখল, রাজ্য কপালে হাত রেখেছে। পেখম কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলনা। রাজিয়া পারভীন খাবার নিয়ে এসেছেন। তিনি পরম যত্নে রাজ্য, পেখমকে খাইয়ে দিলেন।

***

দু’চোখের পাতায় ঘুম এসে রাজত্ব করেছে। চাইলেও বিছানায় শুতে পারছেনা পেখম। একটা অজানা আতংকে ছেয়ে আছে ওর মন। শুধু আতংক নয়, আছে জড়তাও। ও চাইলেও সহজ হতে পারছেনা। ও বুঝতে পারছে, রাজ্যের জন্য ওর অপেক্ষা করা উচিত কিন্তু মন তাতে সায় দিচ্ছেনা। জীবনের প্রথম বাসরের জন্য মেয়েরা যতটা আবেগ, আনন্দ, ভয়, উৎকণ্ঠা আর দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করে সেগুলোর কিছুই দ্বিতীয় বাসরে হয়না। সেটা উপলব্ধি করতে পারছে পেখম।

” অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পর। আমি বিছানার একপাশে ঘুমাব। তোমার আর আমার মাঝে বর্ডার স্বরূপ এই কোলবালিশ থাকবে। বিনা অনুমতিতে বর্ডার ক্রস করার মত কাপুরষ আমি নই। তাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পার। ” পেখমের ভাবনার মাঝেই রাজ্য এসে কথাগুলো বলল। ও একটা বালিশ নিয়ে বিছানার ধারে শুয়ে পরল।

রাজ্যের এমন কাজে পেখম যারপরনাই অবাক। পুরুষের সম্পর্কে ওর অন্যরকম ধারনা ছিল। কিন্তু এই মানুষটা এক নিমেষেই ওর ধারনা পাল্টে দিল। মৃদু হেসে পেখমও বিছানায় পিঠ ঠেকাল।

রাত গভীর হলেও পেখমের চোখে ঘুম নেই। নানান ভাবনা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছেনা। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হচ্ছে ওর। যার ভাগ্যে কখনোই সুখ জোটেনি, খুব সহজেই কি তার ভাগ্যে সুখ ধরা দেয়? চিন্তাটাই ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

” সারারাত জেগে থাকবার প্ল্যান করেছ বুঝি? রাত জাগলে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল হবে, পিম্পল হবে। মোটকথা, নানান অসুস্থতা চেপে ধরবে। তোমার সব চিন্তা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও। ”

রাজ্যের কথা শুনে চমকে উঠল পেখম। সে কিভাবে বুঝল পেখম জেগে আছে? রুমের টিমটিমে আলোয় বোঝা যাওয়ার কথা নয় ও জেগে আছে। তাছাড়া ও এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই ছিল।

” আমার চিন্তা আপনাকে দেব কেন! ”

” কারন কবুল বলার সাথে সাথে তোমার সব চিন্তা আমার হয়ে গেছে। তোমার সকল দ্বায়িত্ব এখন আমার ওপর। তোমার সুখের সারথি হয়েছি আমি। তাই তোমার জেগে থাকার কারণও এখন আমার আপনার সমস্যা হিসেবেই ধরতে হবে। মাথা ব্যাথা করছে? টিপে দেব? ”

” আমি ঠিক আছি। আপনি ঘুমান। ”

” তুমি না ঘুমানো পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম আসবেনা। ”

” ঘুমাচ্ছি। ”

***

” এসব কি শুনছি, রাজিয়া! রাজ্য নাকি ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করেছে? খবরটা শুনে এখানে না এসে থাকতে পারলামনা। তুই কি করে এমন একটা মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিলি? রাজ্যের মত একটা হিরার টুকরো ছেলের গলায় একটা বানরকে ঝুলিয়ে দিলি তুই? রাজ্য নাহয় ওর ভালোটা বোঝেনা, তাই বলে তুইও কি অবুঝ হয়েছিস? রাজ্যের রুচি এতটা নিচু সেটা আমি ভাবতেই পারিনি। এতকিছু ঘটে গেছে অথচ আমাকে জানাসনি! ” নিজের বড়বোনের মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠল রাজিয়া পারভীনের মাথা।

” এগুলো কি ধরনের কথা, আপা? আমার ছেলের বউকে তুমি অপমান করতে পারোনা। আমার ছেলের জন্য যেটা ভালো হবে সেটাই আমি করেছি। পছন্দ করে ছেলের বউ এনেছি, তাই কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করিনি। আমার ছেলের ভালো কিসে হবে সেটা আমি ভালো করেই জানি। তুমি এসেছ, দুই দিন থাক আনন্দ কর, তারপর বাড়ি ফিরে যাও। আমার ছেলের বউকে নিয়ে কিছু বলতে এসোনা। ” রাজিয়া পারভীন একটু রেগেই উত্তর দিলেন।

” তুই বলছিস এই কথা! একেতো সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়েকে ছেলের বউ করেছিস, তারওপর আবার জোর গলায় কথাও বলছিস? ছিহ, রাজিয়া ছিহ্। ”

” সাট আপ, খালামনি। তুমি কার সম্পর্কে কি বলছ, ভেবেচিন্তে বলছ? রাজ্যর বউকে নিয়ে বাজে কথা বলার আগে তোমার বুকটা একবারও কাঁপলনা? তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এই মুহূর্তে তার জিভ আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম। আমার বউ নিয়ে যেখানে আমার পরিবারের লোকজনের কোন সমস্যা নেই, সেখানে তোমার এত সমস্যা কিসের? কে তোমাকে আসতে বলেছে? তোমার কাছে কেউ কোন পরামর্শ চেয়েছে? পেখম যোগ্য জন্যই আমার বউ হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা আমি ওকে ভালোবাসি। সেকেন্ড হ্যান্ড বলছ কাকে তুমি? এই বাজে শব্দটা যার ওপর প্রয়োগ করেছ সে আমার স্ত্রী। আমার দুনিয়া সে। ভবিষ্যতে এমন কথা বলার আগে দুইবার ভাববে। তুমি না একজন মা? কোন মা কি একজন মেয়েকে নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করতে পারে? মা নামের কলংক তুমি। তোমার মত মানুষের জন্যই সমাজে নারীরা পদে পদে হেনস্তার শিকার হয়। নিজের ছেলেদের সংসারে আগুন লাগিয়ে, এখন এসেছ আমার সংসারে আগুন দিতে? পারবেনা। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, তোমার মত মানুষ আমার আম্মুর বোন হয় কিভাবে। তোমার মত এত নিকৃষ্ট মানুষ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। আজকের পর থেকে তুমি এই বাড়িতে আসবেনা। পেখমকে বাজে কথা বলার সাহস হয় কি করে তোমার? আমার স্ত্রী’র সম্পর্কে যে আজেবাজে কথা বলবে, তার সাথে কোন সম্পর্কই রাখবনা আমি। ”

রাজ্যকে এভাবে রাগতে কেউ কখনোই দেখেনি। ওর বড়মা সাবিকুন্নাহার রাজ্যকে ঠেলে ওর রুমে নিয়ে গেলেন।

পেখম দরজায় দাঁড়িয়ে সব কথা শুনল। রাজ্যের খালামনির কথায় প্রথমে ওর কষ্ট লাগলেও রাজিয়া পারভীন, রাজ্যকে প্রতিবাদ করতে দেখে নিমেষেই কষ্ট উবে গেল।

” বড় আপা, আপনি এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আপনার শত অপরাধের পরও আপনার সাথে আমরা সম্পর্ক রেখেছিলাম। একটা সময় আপনি আমার আর রাজিয়ার বিচ্ছেদ চেয়েছিলেন। সবকিছু জানার পরও আমি কোন প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আপনার আজকের ব্যবহারের পর আমি আর চুপ থাকতে পারলামনা। আমার বাড়িতে এসে, আমারই পুত্রবধূকে অপমান করছেন আপনি? এটা আমি বরদাস্ত করবনা। আজকের পর থেকে আপনার সাথে কোন সম্পর্কই আমাদের থাকবেনা। ” মীর আমজাদ হোসেনও চুপ থাকলেননা।

এত বছর পর আজ পেখমের মনে হচ্ছে, অবশেষে ও সুখের দেখা পেয়েছে। এই মানুষগুলো সত্যিই ওকে ভালোবাসে। আর রাজ্য নামক মানুষটার জন্মই যেন হয়েছে ওকে আগলে রাখতে। সত্যিই ও ভাগ্যবতী।

পেখমের ধ্যান ভাঙ্গল একটা বিকট শব্দে। সকলেই চমকে তাকাল শব্দের উৎসের দিকে। রাজ্যের রুম থেকে আসছে ভাঙ্গচুরের শব্দ। এরইমধ্যে দৌড়ে আসলেন সাবিকুন্নাহার।

” পেখম, তুই একটু রাজ্যের কাছে যা। তুই ছাড়া ওকে কেউ শান্ত করতে পারবেনা। ও রুমের সব জিনিসপত্র ভেঙে ফেলছে। এমন করতে গিয়ে যদি আঘাত পায়। তুই গিয়ে ওকে সামলা, মা। ”

বড়মার কথায় ঢোক গিলে পেখম তাকাল রাজিয়া পারভীনের দিকে। তিনিও সম্মতি দিলেন। পেখম গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল রুমের দিকে।

ভেতরে ঢুকেই পেখম থমকে গেল। চেয়ার উল্টে পরে আছে। একটা পা ভাঙ্গা। খাটের সাইড টেবিলেরও বেহাল দশা। ড্রেসিংটেবিলের সব জিনিসপত্র মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কয়েকটা শো-পিস মেঝের এদিকসেদিক পরে আছে। রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাজ্য রাগে ফুঁসছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ওর হাতে একটা ফ্লাওয়ার ভাস। সেটা ড্রেসিংটেবিলের গ্লাসে ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়েছে। পেখম দৌড়ে এসে ওর ডান হাত রাখল রাজ্যের বুকের বামপাশে। মুহূর্তেই থমকে গেল রাজ্য। থেমে গেল ওর হাত। নমনীয় হলো মুখাবয়ব।

” এভাবে রিয়্যাক্ট করছেন কেন? একটু শান্ত হোন। আপনি সত্যটা কেন মানতে পারছেননা! এটা তো হওয়ারই ছিল। এভাবে কয়জনের মুখ বন্ধ করবেনন আপনি? এমন রিয়্যাক্ট করার বদলে বরং সত্যটা মানতে শিখুন। যে যা বলে বলুক। ”

” কি বলতে চাও তুমি? ওরা তোমাকে অপমান করবে আর আমি চুপচাপ সব দেখে যাব? কক্ষণো না। প্রয়োজনে আমি পুরো দুনিয়ার বিপক্ষে যাব, শুধুমাত্র তোমাকে প্রটেক্ট করতে। তোমার সম্মান রক্ষার দ্বায়িত্ব আমার। তোমার সম্মানে হাত দিলে কাউকে ছাড় দেবোনা আমি। ”

” পুরো দুনিয়ার বিপক্ষে না গিয়েও কাউকে প্রটেক্ট করা যায়। আমার সম্মান বাঁচাতে গিয়ে আপনি গুরুজনদের সাথে দুর্ব্যবহার করবেন, এটা আমি কিছুতেই মানতে পারবনা। এতে আপনার সম্মানও হানী হবে এটা কি জানেন? আপনি সবাইকে শান্তভাবে বুঝিয়ে বলবেন। দেখবেন সবাই মানবে। ”

” আমাকে কি তোমার সাধু-সন্ন্যাসী পর্যায়ের মানুষ মনে হয়? তোমার সম্মান রক্ষার বেলায় সাধু-সন্ন্যাসী আমি সাজতে পারবনা। আমি আমার মতই প্রতিবাদ করব। ”

” আপনি আমার কথা শুনবেননা? ”

” শুনব। কেন শুনবনা! তোমাকে ভালোবাসতে বল, দেখ তোমার কথা আমি সুবোধ বালকের ন্যায় শুনব। তুমি চাইলে ভালোবাসার বর্ষনে ভাসিয়ে দেব তোমার দুকূল। তুমি চাইলে নিলীমার নীলে রাঙ্গাব তোমার আঁচল। তুমি চাইলে রংধনুর বুকে ঘর বাঁধবো তোমাকে নিয়ে। বল কি চাও? ” রাজ্যের ঘোরলাগা গলা শুনে পেখমের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল। পা দুটো টলমল করছে। যেকোন মুহূর্তে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। তবুও হাল ছাড়লনা।

” আমার একটাই চাওয়া আপনি শান্ত হোন। ”

পেখমের কথায় রাজ্যের যত প্রেম, আবেগ নিউট্রাল হয়ে গেল। হতাশ গলায় বলল,

” ব্যাস! আর কিছুই চাওয়ার নেই তোমার? হাহ্ রাজ্য তোর কপালে বউয়ের ভালোবাসা নেই। অথচ তোর একমাত্র সাধনা বউয়ের ভালোবাসা পাওয়া। সেম অন ইউ, রাজ্য। ”

রাজ্যের কথার ধরন শুনে হাসল পেখম। রাজ্যকে শান্ত হতে দেখে স্বস্তি পেল।

***

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা পেরিয়েছে অনেক আগেই। রাজ্য এখনো বাড়িতে ফেরেনি। বিকেলে ওরা দাদুকে দেখতে গিয়েছিল। রাজিয়া পারভীনের সাথে পেখম বাড়িতে এসেছে। রাজ্য কাজ আছে বলে ওদের সাথে আসেনি। রাজিয়া পারভীন পেখমকে ঘুমাতে পাঠিয়ে নিজে রাজ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন।

পেখম এসে দাঁড়িয়েছে বেলকনিতে। থালার মত রূপালী চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে ধরনী। বেলকনিতে রুপালী আলোর বান ডেকেছে। পেখম বেলকনির লাইট নিভিয়ে দিয়ে জোৎস্না বিলাসে মত্ত। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সুধাকর পানে।

” তুমি আমার চাঁদের আলোয় চন্দ্রাবতী,
আঁধার রাতের অরুন্ধতী।
স্বপ্নলোকের স্বপ্নদ্যূতি,
ভালোবাসায় পূর্ণবতী।
একটু ভালোবাসলে ক্ষতি কি আমার, জোৎস্নাময়ী?
বাড়াবে কি হাত?
দেবে কি ভালোবাসা?
হবে কি আমার? ”

হুট করেই রাজ্যের গলা পেয়ে চমকে উঠল পেখম। তাকাল পেছনে। সাথে সাথেই ধাক্কা খেল রাজ্যের সাথে।

” ভয় পেয়েছ? ” পেখমকে নিরব থাকতে দেখে রাজ্য জিজ্ঞেস করল।

” কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ” রাজ্যের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল পেখম।

” কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ”

” আপনি কাজও করেন! কই কখনোতো দেখিনি। যখনই দেখেছি, তখনই বখাটেদের মত ঘুরতে দেখেছি। ”

” এত পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত বখাটে উপাধি কপালে জুটল! এবার আর বখাটের বখাটেপনা দেখতে হবেনা তোমার। কাজে মনযোগী হব। আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি বুঝলে? বখাটের তকমা গা থেকে মুছেই তবে আসব। ”

রাজ্যের কথা শুনে চমকে ওর মুখের দিকে তাকাল পেখম। ওর বুক ধুকপুক করছে। হঠাৎই মন খারাপের মেঘ জমা হল হৃদয়ের অন্তঃপুরে। মুখ ভার করে বলল,

” চলে যাবেন? কিন্তু কেন? আসবেন কবে? ”

” জরুরী কাজ পরে গেছে। তাই যেতে হবে। মিস করবে আমাকে? যখন বুঝব আমাকে অনুভব করছ হৃদয় থেকে, মিস করছ আমাকে, আমার বিহনে বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছ, দেখবে ঠিক তখনই আমি এসে গেছি। ”

” খাননি নিশ্চয়ই? ফ্রেশ হয়ে খেতে চলুন। মা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। ” কম্পিত গলায় বলল পেখম।

***

” এসব কি কথা, রাজ্য? তুই আমেরিকা ফিরে যাবি? কিন্তু কেন? কি এমন হলো যে এভাবে তুই চলে যাচ্ছিস? ” রাজিয়া পারভীন ছেলের চলে যাওয়ার কথা শুনে চমকে গেলেন।

” জরুরী কাজে যেতে হবে, আম্মু। আমার ফ্রেণ্ড এন্ডারসন ভিষণ অসুস্থ। এই মুহূর্তে ওর কাছে থাকা আমার প্রয়োজন। তাই ভাবছি, যাবই যখন, তখন ভার্সিটিতে জয়েন করি। অনেকদিন তো ভার্সিটি থেকে দূরে কাটালাম। এবার বোধহয় সময় এসেছে ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেয়ার। ”

” তোর ফ্রেণ্ড অসুস্থ তাই তুই আমেরিকা যাবি! কেন ওর কি পরিবার-পরিজন নেই? ”

” ও অনাথ। একটা পরিবারের কাছে মানুষ হয়েছে। কিন্তু সেই পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। নিঃসন্তান দম্পতি ছিলেন তারা। ”

” বুঝলাম। কিন্তু তুই বিয়ে করেছিস সাতদিন হল। এরইমধ্যে চলে যাবি? মেয়েটা কষ্ট পাবেনা? ”

” একটু বোঝার চেষ্টা কর, আম্মু। যেতেই হবে। আমিতো চিরদিনের জন্য যাচ্ছিনা। দেখবে সময় করে ঠিক চলে আসব। আর তাছাড়া পেখমেরও সামনে এক্সাম। ওর এই মুহূর্তে পড়াশোনা করা দরকার। আমার সাথেই ও ঢাকা যাক। এখানে থাকলে ও পড়তে বসবেনা। আমি ভাবছি নাবিলাকে পেখমের সাথে ঢাকা পাঠিয়ে দেব। তুমিও মাঝেমধ্যে গিয়ে থাকবে। চাচী বলল, তিনি এখন আর ঢাকা যাবেননা। দাদু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এখানেই থাকবেন। ”

” ঠিক আছে। তোর কথামতই সবকিছু হবে। কিন্তু তুই আবার কবে আসবি? ”

” আগে তো যেয়ে নেই, আম্মু। তারপর দেখি কবে আসতে পারি। ”

পেখম একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা-ছেলের কথা শুনছিল। কেন যেন আজ ওর কান্না পাচ্ছে।

চলবে…