সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-০৪

0
1108

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী জামী

” আর ভালো লাগেনা এই সংসার। মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। তিনবেলা হেঁসেল ঠেল, এর জন্য ওর জন্য এটা কর সেটা কর। মনের সুখে কোথাও বেড়াতে যেতে পারিনা, সপ্তাহে একটা দিনও আউটিংয়ে যাওয়া হয়না, না পারি রেস্টুরেন্টে যেতে না পারি একটু পার্লারে যেতে। সারাক্ষণই কাজ আর কাজ। ” নিজের রুমে বসে গজগজ করছে মেহনাজ। রাগে একটা ফুলদানী আছাড় মারল মেঝেতে।

দরজায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সব শুনছিল মেহনাজের বড় মেয়ে ঋত। মা’য়ের এরূপ আচরণ সে কিছুতেই মানতে পারেনা। আগেও প্রতিবাদ করেছে, এবারও তাই করল।

” কি শুরু করলে, আম্মু? দিনদিন তোমার বয়স বাড়ছে না কমছে! তুমি কি শুধু একাই এই সংসারে আছ? বড়মাদের কখনোই এমন কথা বলতে শুনিনি। তারা খুশিমনে সংসার সামলাচ্ছে। আর তাছাড়া তোমাকে তেমন কোন কাজ করতে হয়না। তারপরও কেন এমন কর? ”

” এই তুমি চুপ করবে? মাঝেমধ্যে আমি ভাবি তুমি কি আমার নিজের মেয়ে! নিজের মেয়ে হলে মায়ের দুঃখ বুঝতে। তোমার বাবার ভুলগুলো তাকে ধরিয়ে দিতে। কিন্তু তুমি সেগুলোতো করবেইনা উল্টো আমাকে দোষী করবে। ”

” দোষ করলেইনা তবে সে দোষী হয়। এত বছরেও তুমি শ্বশুর বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারোনি, এটার জন্য দায়ী কিন্তু তুমি। এই পরিবারের মানুষগুলো এতটাও খারাপ নয় যে তুমি মানিয়ে চলতে পারবেনা। তুমি ছাড়া আর কাউকেই অভিযোগ করতে শুনিনি। ”

” ঋত, দয়া করে মুখ বন্ধ রাখবে? তুমিও দেখছি এই পরিবারের মানুষদের মতই টক্সিক। তোমাদেরকে জাস্ট অসহ্য লাগে। সব এক একটা ন্যাকা। বেশি বেশি কাজ করে সবার মনে থাকতে চায়। আসলে এদের ভীত শক্ত নয়, তাই কাজ করেই সবার মন পেতে চায়। সবার ভালোবাসা পেতে চায়। ”

” ভালোবাসা পেতে চায় না, আম্মু। তারা অলরেডি ভালোবাসা পেয়েছে। সেই সাথে পেয়েছে সম্মান আর শ্রদ্ধা। যেটা তুমি এত বছরেও পাওনি আর ভবিষ্যতেও পাবেনা। ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা পেতে গুণ লাগে, যেটা তোমার মধ্যে নেই। ”

আর কিছু বলার আগেই ঋতকে সপাটে থাপ্পড় মারল মেহনাজ। নিজের বিরুদ্ধে কোন কথা সে কখনোই সহ্য করতে পারেনা আজও পারলনা। থাপ্পড় খেয়ে ঋত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মেঝের দিকে। মা’য়ের জন্য বরাবরই তাকে সব জায়গায় লজ্জা পেতে হয়। শুধু তাকে কেন বাবাও মা’য়ের কাজকর্মে লজ্জা পায়। কিন্তু মা সেসবে কখনোই পাত্তা দেয়না। ও অনেক চেষ্টা করেছে তাকে বোঝানোর কিন্তু পেরে উঠেনি।

” মেহনাজ, তুই মেয়েটাকে এভাবে মারলি কেন? দেখেছিস মেয়েটা কাঁদছে? ”

মা-মেয়ের সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন রাবেয়া সুলতানা। তিনি বারান্দায় বসে কাজ করছিলেন। সব কথা শুনেও তিনি না শোনার ভান করছিলেন এতক্ষণ। কিন্তু ঋতকে থাপ্পড় মারায় তিনি আর চুপ থাকতে পারলেননা। ছুটে আসলেন মেহনাজের রুমে। বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলেন ঋতকে।

রাবেয়া সুলতানাকে রুমে দেখেই খেঁকিয়ে উঠল মেহনাজ।

” তোমাকে কে ডেকেছে? সব জায়গায়ই মাতব্বরি না করলে চলেনা তাইনা? সবখানেই মধ্যমনি সাজতে চাও? বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে। ভালোবাসা দেখাতে এসেছে আমার মেয়েকে! ওকে ভালোবাসা দেখানোর জন্য আমি আছি। তোমার মত অপয়া মেয়েমানুষের ভালোবাসার দরকার নেই ওর। তোমার নজর যেখানে পরবে, সেখানের সব ছারখার হয়ে যাবে। যেমন ছারখার হয়েছে আমার সংসার। ”

মেহনাজের আক্রমণাত্বক কথায় থমকে গেলেন রাবেয়া সুলতানা। তিনি অসহায় চোখে চাইলেন এদিক-সেদিক। এর আগেও অনেকবার মেহনাজ তাকে অপমান করেছে, কিন্তু আজকের মত করে বলেনি কখনো৷ তিনি কি এতটাই অস্পৃশ্য? এতটাই ঘৃণ্য? কই এমন কোন ঘৃণ্য কাজ করেছে বলে তার মনে পরেনাতো।

” মেহনাজ, কথা বলতে বলতে তুই মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিস। রাবেয়া তোকে কিছু বলেনা তার মানে এই নয় যে, আমরাও তোকে কিছু বলবনা। এতই যখন তোর জমিদারি চালচলন, তখন তোর বাবা-মা এত বড় সংসারে মেয়ের বিয়ে দিল কেন? আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কিন্তু একবারও তাদের হাত-পা ধরেনি তোকে বউ করার জন্য। বরং তারাই বারবার অনুরোধ করেছে। তোর সংসার ছারখার করেছিস তুই নিজেই। স্বামীকে বেঁধে রাখতে জানতে হয়। কিন্তু তুই ব্যস্ত থাকিস তোর রূপচর্চা আর বন্ধুবান্ধব আর পার্টি নিয়ে। তোর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে রাশেদ শহর ছেড়ে গ্রামে এসে থাকছে। নয়তো ওর মত অফিসারকে দেখেছিস গ্রাম থেকে অফিস করতে? তুই ওকে শান্তি দিতে পারিসনি তাই ও পরিবারের সবার মাঝেই নিজের শান্তি খুঁজে নিয়েছে। এখন নিজের দোষ ঢাকতে রাবেয়ার ওপর দোষ চাপাচ্ছিস? ” প্রতিবারের মত এবারও পারভীন আক্তার এসে সাপোর্ট দিলেন রাবেয়া সুলতানাকে৷

” এখন তো সব দোষই আমার। তোমরা সবাই দুধে ধোওয়া তুলসীপাতা। এখন আমার বাবা-মা’কেও দোষী করা হচ্ছে! আজ আসুক রাশেদ। আমি একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। ”

” শুধু রাশেদ আসবে কেন? রাশেদের ভাইরাও আসুক। সবার সামনেই তোর বলা প্রতিটা কথাই আমি রিপিট করব। পদে পদে তুই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে অপমান করিস, রাবেয়াকে টেনেহিঁচড়ে সবার সামনে নিচু করিস এসব বলবোনা ভাবছিস? তুই যেদিন থেকে এই সংসারে বউ হয়ে এসেছিস, সেদিন থেকেই সংসারে আগুন লেগেছে। মানসিক শান্তি সবার গায়েব হয়ে গেছে। ”

এবার যেন একটু দমল মেহনাজ। তবে মনে মনে রাগ হচ্ছে ভিষণ। এই মহিলাকে সে কোনভাবেই শায়েস্তা করতে পারেনা। তাকে সাপোর্ট দেয় পরিবারের সবাই। তার দুই ছেলে বড় চাকরি করে তার স্বামীও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। এজন্যই তাকে সবাই সমঝে চলে।

***

সেদিন সন্ধ্যার পরে রাশেদ বাড়িতে আসলে পারভীন আক্তার তাকে সবকিছু বললেন। সৈয়দ শামসুল হক নীরবে শুনলেন সবকিছু। তিনি দুপুরের পুরো ঘটনাই জানেন। তবুও পুরোটা সময় নীরব থাকলেন। তিনি বুঝতে পারেন মেহনাজ গ্রামে থাকতে চায়না। তিনি আগেও অনেকবার রাশেদকে বলেছেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শহরে যেতে। কিন্তু রাশেদ তার কথা শোনেননি। তবে আজ পারভীন আক্তারের মুখে সবকিছু শুনে রাশেদ সিদ্ধান্ত নিলেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আবারও শহরে গিয়ে থাকবেন। তার এই সিদ্ধান্ত তার দুই মেয়ে ঋত, রাত মেনে নিতে পারলনা। কিন্তু বাবার আদেশ উপেক্ষা করার ক্ষমতা ওদের নেই। তাই মন খারাপ হওয়া স্বত্বেও ওরা নিজেদের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করল।

***

” বউমা, রাজ্য দাদুভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে তোমার? কেমন আছে সে? কতদিন তার গলা শুনিনা। ” মীর রেজাউল করিম হাহাকার করে উঠলেন।

” ঐ ছেলের সাথে আর কোন কথা বলতে চাইনা, আব্বা। যে ছেলে বাপ-দাদার সম্মান নিয়ে খেলে তার মুখ দেখার ইচ্ছেও আমার নেই। এতবড় অন্যায় করল ও, তারপরও ওর সাথে কথা বলতে চেয়েছি আমি, বারবার ফোন করেছি মিশুর কাছে। কিন্তু সে একবারও আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেনি। আজ দুইটা মাস হয়ে গেল, তার কোন খবর পাইনি। সে নিজ থেকে একবারও ফোন দিয়ে জানতে চাইলনা আমরা কেমন আছি। ” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রাজ্যর মা রাজিয়া পারভীন।

” মা, কেঁদোনাতো। হয়তো ভাইয়া ব্যস্ত আছে। সময় হলে নিশ্চয়ই ফোন দেবে। ”

মেয়ের মুখে ভাইয়ের সাফাই শুনে রেগে উঠলেন রাজিয়া পারভীন।

” তুই এখানে কেন, নাবিলা? যা ঘরে গিয়ে পড়তে বস। সব সময় বড়দের মাঝে কথা না বললে তোর পেটের ভাত হজম হয়না তাইনা? আর যদি একদিনও শুনেছি ভাইয়ের পক্ষে কথা বলতে, তবে সেদিন তোকে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মারব বলে দিলাম। ”

মায়ের ধমক খেয়ে নাবিলা সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

” বউমা, মেয়েটাকে বকলে কেন বলতো? ও রাজ্যকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমরা সবাই জানি। মেয়েটা কত কষ্ট পেল। ”

শ্বাশুড়ির কথায় তার দিকে তাকালেন রাজিয়া পারভীন। আজকাল তিনি একটু বেশিই কঠোর হয়ে গেছেন। কথায় কথায় ধমক দেন নাবিলাকে। মাঝেমধ্যে স্বামীকেও দু-চার কথা শুনিয়ে দেন। আবার হুটহাট ছোট জা’য়ের সাথেও রাগ করেন। সেদিনতো বড় জা’কে কয়েকটা কটু কথা শুনিয়েছেন। কিন্তু তার কথায় কেউ মন খারাপ করেনা। সবাই বুঝতে পারে তার ভেতর কি চলছে। একদিকে ছেলে আরেকদিকে দুই পরিবারের বন্ধুত্ব। ছেলের জন্য ফাটল ধরেছে দুই পরিবারে। কষ্ট পাচ্ছেন দুই বৃদ্ধ। প্রতিদিন একবার হলেও যারা একে-অপরের কাছে যেতেন, দিনে তিনবার কথা বলতেন ফোনে। শ্বশুরকে কাঁদতে দেখেছেন রাজিয়া পারভীন। পরিস্থিতিই তাকে কঠোর করেছে। এটা সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ কোন সমাধান দিতে পারেনা।

***

” ঋত? ”

স্কুল থেকে বেরোতেই পরিচিত আওয়াজ পেয়ে থমকে যায় ঋত। আশেপাশে ভালো করে তাকাতেই দেখল কানন দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।

” কানন ভাইয়া, তুমি! ” ঋত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। ও কাননকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে।

” চল, কোথাও গিয়ে বসি। ”

ঋতের উত্তরের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করল কানন। ঋতও কাননের পিছুপিছু হাঁটতে থাকে।

” কেমন আছিস তুই? হঠাৎ গ্রাম থেকে চলে আসলি যে? ”

” তুমি তো আম্মুকে জানোই। আম্মু গ্রামে থাকতে চায়নি। ”

” আমাকে জানাতে পারতিস কিন্তু। তোর বন্ধুদের কাছে শুনতে হলো খবরটা। ”

” কিভাবে জানাতাম! আমার কি ফোন আছে? কারও ফোন থেকে ফোন দেয়ার রিস্ক নিতে পারিনি। আগের মত তোমাদের সাথে সম্পর্ক থাকলে ঠিকই জানাতে পারতাম। ”

” পেখম আপুর খবর কি রে? ভালো আছে আপু? ”

” হুম ভালো আছে। পড়াশোনায় মন দিয়েছে। ভিকারুননিসায় চান্স পেয়েছে। ”

” বাহ্। দাদু কেমন আছে? আর বড়মা? বড়মা কি কান্নাকাটি করে এখনো? ”

” সবাই ভালো আছে। বড়মাও সামলে নিয়েছে নিজেকে। আচ্ছা, দাদা-দাদিমা কেমন আছে? কতদিন হয়ে গেছে তাদের দেখিনা। আর কি দুই পরিবারের সম্পর্ক জোড়া লাগবেনা, ভাইয়া?

ঋতের প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কানন। এই প্রশ্নের উত্তর নেই ওর কাছে। মাঝেমধ্যে রাজ্য’র ওপর ভিষণ রাগ হয়। সে এমন না করলে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতোনা দুই পরিবারে।

” জানিনা কিছুই। আচ্ছা শোন, আজকে তুই বাসায় যা। দেরি হলে চাচী তোকে বকবে। কালকে স্কুলে ছুটি হলে আমার জন্য অপেক্ষা করিস। ”

” এখনই চলে যাবে? ”

” আর কিছুক্ষণ থাকতে চাস? ”

মাথা নাড়ায় ঋত। কানন আর কথা বাড়ায়না। চুপচাপ বসে থাকল। ও লক্ষ্য করল ঋত আঁড়চোখে ওকে দেখছে।

” কি দেখছিস? ”

” তোমাকে। অনেকটা শুকিয়েছ। ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করোনা? ”

” তোরা চলে এসেছিস শোনার পর থেকে খেতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিল, তোকে বোধহয় আর দেখতে পাবোনা। ”

” এতকিছু কেন মনে হয়! সামনে না তোমার এইচএসসি পরীক্ষা? এখন পড়াশোনায় মন না দিয়ে উল্টাপাল্টা কথা কেন ভাব? ”

” তোর জন্যই তো। ঋত বিয়ে করবি আমাকে? অপেক্ষা করবি আমার জন্য? রাজ্য ভাইয়ার করা ভুলে আমরা কেন ভুগব? ”

” সবাই মেনে নেবে আমাদের? তোমার কি মনে হয়, এতকিছুর পরও দুই পরিবার রাজি হবে? ”

” সহজে রাজি হবেনা। কিন্তু রাজি করাতে হবে। যেভাবেই হোক। শুধু তুই ঠিক থাকিস। দেখবি আমি সবার মন জয় করেছি। আমি রাজ্য ভাইয়া নই, আমি কানন। ”

ঋত হাসল কাননের কথা শুনে। ও কেবলমাত্র ক্লাস টেনে পড়ছে। এই বয়সেই একজনের প্রেমে পরেছে এটা ভাবলেই শরীর অবশ হয়ে যায়। কিন্তু ও নিরুপায়। এই সম্পর্ক থেকে বেড়োনো ওর পক্ষে অসম্ভব। দুই পরিবারকে আবার একত্রিত করতে চায় ও। দাদুর মুখে হাসি ফোটাতে চায়। দাদুর জীবনের শেষ দিনগুলো ভরিয়ে দিতে চায় খুশিতে।

চলবে…