#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৫
জাওয়াদ জামী জামী
” হেই ব্ল্যাক বিউটি, নাম কি তোমার? ”
কারও ডাকে থমকে দাঁড়ায় পেখম। আশেপাশে তাকাতেই দেখল ওর বিল্ডিংয়ের সামনে কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যেই কেউ একজন পেখমকে কথাটা বলেছে। পেখম কোন উত্তর না দিয়ে সোজা গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়।
ফ্ল্যাটে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল মেয়েটা। ওর ভয় হচ্ছে ভিষণ। কয়েকদিন থেকেই লক্ষ্য করেছে বাসা থেকে বেড়োনোর সময় কয়েকটা ছেলে ওর পিছু নেয়। ওর রিক্সার পিছুপিছু কলেজ পর্যন্ত আসে। সারা রাস্তা নানান উস্কানিমূলক কথা বলে। যতভাবে বিরক্ত করা যায় তার সবগুলোই করে। পেখম ভেবে পায়না কি করবে। একবার ভাবল বাড়িতে ফোন করে মা’কে সবটা জানাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিল। অযথা বাড়ির সবাইকে চিন্তায় ফেলে লাভ কিছুই হবেনা। কিন্তু কিছুতো একটা করতেই হবে।
” আমি বরং প্রান্তর ভাইয়াকে জানাই। ভাইয়া কিছু একটা করলেও করতে পারে। ”
যেই ভাবা সেই কাজ। পেখম ফোন করল ওর বড় চাচার ছেলে প্রান্তরকে। খুলে বলল সবকিছু। প্রান্তর আশ্বাস দিল ও বিষয়টা দেখবে। ভাইয়ার আশ্বাস পেয়ে পেখম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
পরদিন সকালে পেখম বিল্ডিং থেকে বেড়োতেই কেউ ওকে ডাকল।
” হেই ব্ল্যাক ডায়মন্ড, আজকে অন্তত নামটা বলে যাও। এই সুযোগে তোমার গলার স্বরও শুনতে পাব। ব্ল্যাক ডায়মন্ডের গলার স্বরও নিশ্চয়ই কোকিলের মত সুমধুর হবে। তোমার গলা শুনে আমি আমার হৃদয় জুড়াই। বলনা কিছু। ”
পেখম আজও ছেলেটার কথার কোনও প্রত্যুত্তর করলনা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে রিক্সা খুঁজতে লাগল। ওর ভয় হচ্ছে প্রচন্ড। আজকে রাস্তাটা একটু বেশিই নীরব। লোকজন তেমন একটা নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও রিক্সা না পেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ও হাঁটতে শুরু করার সাথে সাথেই ছেলেগুলোও ওর পিছু নিল। এটা দেখে ভয়ে আধমরা হয়ে যায় পেখম। ও চিরটাকালই ভীতুই রয়ে গেল। এজন্য কানন মাঝেমধ্যে ওকে ভীতুর ডিম বলে খেপাত।
” ব্ল্যাক বিউটি চলেছে একা পথে,
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে!
হার মেনেছে দিনের আলো,
ব্ল্যাক বিউটি হোকনা একটু কালো। ” হেঁড়ে গলায় কেউ গেয়ে উঠল।
লজ্জায়-অপমানে পেখম পারলে মাটির সাথে মিশে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখারও সাহস করলনা, কোন ছেলেটা গাইল।
ছয় জনের দলটা পেখমের পিছুপিছু হাঁটছে আর নানান আজেবাজে কথা বলছে। গান গাইছে। ওরা চাইছে পেখম ওদের সাথে কথা বলুক, প্রতিবাদ করুক। পেখম মুখ খুললেই ওরা কিছু একটা ঘটানোর সুযোগ পাবে।
” সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোঁতা দাও দিয়া কাইট্টালা। ” ছেলেটা গান শেষ করতে পারলনা। কাঁধে কারো শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ পেয়ে থেমে গেল।
” কোন হালারে? কার এত্তবড় সাহস আমার ঘাড়ে হাত রাখছে? ”
পেখম অশ্লীল গানটা শোনার সাথে সাথেই কানে হাত দিয়েছিল। কিন্তু পেছন থেকে কারও রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শুনে হাত নামিয়ে ফেলল। মনে মনে প্রার্থনা করছে, কেউ এসে ওকে উদ্ধার করুক।
” কি ব্রো, গান গাইছ? তোমার কণ্ঠ মাশা-আল্লাহ। ইন্ডিয়ান আইডলে গেলে নাম করতে পারবে। চাইলে ইন্টারন্যাশনাল প্লাটফর্ম থেকে দুই-চারটা প্রাইজও পেতে পার। করবে নাকি পার্টিসিপেট? ”
কণ্ঠস্বর শুনে পেখম জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে। ওর মুখে হাসি ফুটল। আল্লাহ ওর প্রার্থনা কবুল করেছেন।
” তুই কে বে? আমার এলাকায় আইসা আমারেই জ্ঞান দিতাছস? হালা বান্দীর পুত, তরে আমি খাইয়ালামু। ঘাড় থাইকা হাত নামা, হালার পুত। ”
” কুল ব্রো, কুল। এত রাগের কিচ্ছু হয়নি। আমি কিন্তু খারাপ কিছু বলিনি। তুমি চাইলে আমি নিজে তোমার রেজিষ্ট্রেশন করে দেব। ”
” এই রাকিব্বা, ধর হালারে। বান্দীর পুতেরে আজ খাইয়া দিমু। আমারে নিয়া মজা লয় হালা ? ”
” ব্রো, তুমি অযথাই আমাকে গালি দিচ্ছ। চাইলেও আমাকে তোমরা খেতে পারবেনা। আমি মানুষ, গরু-ছাগল নই। আমি তোমাকে ভাইরাল করতে চাচ্ছি, কোথায় তুমি আমাকে সাহায্য করবে, তা না করে ঝগড়া বাঁধাচ্ছ। ”
” সুজন, হালারে ধর, কানের নিচে দুইডা দিলেই ফড়ফড়ানি বন্ধ হইয়া যাইব। হালায় আমারে সাহায্য করব! ওর সাহায্য ওরই পেছন দিয়া ভইরা দিমু। ”
ছেলেটা আর কিছু বলতে পারলনা। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আচমকাই। কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করল। এরপর হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসে একদলা থুথু ফেলল রাস্তায়। থুথুর বদলে রক্ত দেখে তার মাথা ঘুরে উঠল।
” ঐ হারামজাদার দল, এই বান্দীর পুত আমারে মাইরা মুখ ফাটায় দিছে। আর তরা খাড়ায়া দেখতাছোস? ধর হালারে। ”
” আয় কে আসবি? যে আসিস না কেন তার অবস্থাই এই ইডিয়টের মত হবে। একবারে মাটিতে পিষে ফেলব একেকজনকে। ”
” মানিক ভাই, আপনে শান্ত হন। আমি লিডাররে ফোন দিতাছি। লিডার আরও পোলাপান পাঠায় দিব। ”
” এক কাজ কর, তোদের লিডারকেও এখানে ডাক। তাকেই আমার দরকার। তার পোষা কুত্তাবাহিনী রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করছে, এটা তার জানা দরকার। তাহলে তোদের সবাইতে লাল দালানের রুটি খাওয়াতে আমার সুবিধা হবে।”
আগন্তুকের কথায় সবাই চমকে উঠল। একে-অপরের মুখপানে চাইল।
” আপনি কে, ভাই? ” জিজ্ঞেস করল একজন।
” সৈয়দ প্রান্তর আহমেদ। তোদের এলাকার এ এস পি। আর ঐ যে মেয়েকে প্রতিদিন টিজ করিস, আমি তার ভাই। এবার বল আমাকে নিয়ে তোদের পরিকল্পনা কি? ডাকবি তোদের লিডারকে? নাকি আমার সাথেই যাবি তার আস্তানায়? ”
” স্য…স্যার, ভুল হইছে। এবারের মত মাফ করেন। আর এমন ভুল হইবনা। আমরা ম্যাডামরে চিনবার পারিনাই। চিনবার পারলে তারে মা ডাকতাম। ”
” রাস্কেল, তোরা একটা মেয়েকে উত্যক্ত করেছিস এটাই তোদের প্যাদানোর জন্য যথেষ্ট। আমার বোন হলে সে রেহাই পাবে, আর বাকি মেয়েরা? তারা তোদের শিকার? তাদের টিজ করবি? ইন্সপেক্টর লাঠি নিয়ে আসুন। এদেরকে সহবৎ শেখানো প্রয়োজন। ”
পেখম হাসিমুখে তাকিয়ে আছে প্রান্তরের দিকে। প্রান্তরের ডাকে পাঁচজন বেরিয়ে আসল গাছের আড়াল থেকে। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি। তারা প্রান্তরের কাছে এসে কোন কথা না বলে বেধড়ক পেটাতে শুরু করল সবাইকে।
প্রান্তর পেখমের কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর মুখেও হাসি।
” থ্যাংকিউ, ভাইয়া। আমি ভাবতেই পারিনি তুমি আজকেই এসে এদের শিক্ষা দেবে! ”
” আমার বোনের বিপদ আর আমি আসবনা এটা কি কখনো হতে পারে! ”
” কিন্তু ভাইয়া, এরা যদি পরে কোন সমস্যা করে? এরা লিডারের কথা বলল, সে যদি তোমার কোন ক্ষতি করে? ”
” সেসব দেখার দ্বায়িত্ব আমার, তোর নয়। তুই শুধু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবি। যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, আমার কিংবা ভাইয়ার কারও কাছেই থাকবিনা, সেহেতু প্রতিদিন সকালে গাড়ি পাঠাব। তুই এখন থেকে গাড়িতেই যাতায়াত করবি। ”
” তোমার নিজেরই গাড়ি নেই, তুমি আমাকে গাড়ি পাঠাবে কিভাবে! গাড়ি পাঠাতে হবেনা, আমি রিক্সাতেই যেতে পারব। ”
” তোর এত চিন্তা করতে হবেনা। গাড়ির ব্যবস্থা আমি করব। তুই সময়মত নিচে এসে দাঁড়াবি তাহলেই হবে। ”
কথা বলতে বলতে ওরা অনেকটুকু এগিয়ে যায়। একটা রিক্সা পেতেই প্রান্তর ওকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে আবারও যায় চিৎকার দিতে থাকা বখাটেদের দিকে। মার খেয়ে ওদের অবস্থা খারাপ।
***
স্কুল থেকে বেরিয়ে ঋত এদিক-ওদিক তাকায়। কিন্তু কাননকে দেখতে পায়না। সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল বেশ কিছুক্ষন। কিন্তু কাননের দেখা নেই। বিরক্ত হয়ে ও সামনের ফুচকার দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়।
” খাবি নাকি? ”
কাননকে দেখেও কিছু বললনা ঋত। মুখ ঘুরিয়ে রাখল।
” রাগ হয়েছে? ”
তবুও কোন উত্তর দিলনা ঋত।
” মামা, আপনার বউমাকে দুই প্লেট ফুচকা দিন। ঝাল কম দেবেন। এমনিতেই রাগে তার অবস্থা খারাপ। বেশি ঝাল খেলে ফেটেও যেতে পারে। আর হ্যাঁ, দামটা কিন্তু ও দেবে। ”
” খাবনা আমি ফুচকা। মামা, এই ফকিন্নিকে এক বালতি ফুচকা দিন। দাম আমিই দেব৷ ” ঋত পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে ফুচকাওয়ালার সামনে রেখে হাঁটতে শুরু করল।
এদের ঝগড়া দেখে ফুচকাওয়ালা হাসছে। সে কাননের দিকে টাকাটা বাড়িয়ে দেয়।
” মামা, সামনের পার্কে দুই প্লেট ফুচকা পাঠিয়ে দিয়েন। আমি যাই, আপনার বউমার রাগ ভাঙ্গাই। ” টাকাটা পকেটে পুরে কানন দৌড়ে যায় ঋতের কাছে।
” এই ঋত, তোর ক্লাসের অন্তি নামের মেয়েটা কিন্তু হেব্বি। আমার দিকে মাঝেমধ্যেই চোরা চোখে তাকায়। তার চাহনিও জোস। কেমন নেশা ধরে যায়। ” ঋতের পাশে বসতে বসতে বলল কানন।
কাননের কথায় ঋতের মাথায় আগুন ধরে যায়। ও দুমদাম মারতে থাকে কাননের পিঠে।
” লুচু একটা। বলতে অন্তি ওর দিকে চোরা চোখে তাকায়, আবার বলছে ওর চাহনি জোস!, তুমি না তাকালে বুঝলে কেমন করে, তোমার দিকে ও তাকায়? আবার ওর চাহনিতে নেশা হয় সেটাই বা বুঝলে কিভাবে? তারমানে তুমিও নিয়মিত তাকিয়ে থাক ওর দিকে? লুচু ছেলে একটা, অসভ্য ছেলে, অশ্লীল চিন্তাভাবনার ছেলে। ”
ঋতের গালি শুনে হো হো করে হাসতে থাকে কানন। ওর হাসি দেখে রাগে কেঁদে ফেলল ঋত।
***
নিউইয়র্ক সিটি। রাত ১.৫০।
রাজ্য ক্যাব নিয়ে বেরিয়েছে রাত দশটার পর। দুইটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত ক্যাব চালাবে ও। এরপর বাসায় গিয়ে ঘুম দেবে। উঠবে সকাল নয়টার দিকে। এরপর ফ্রেশ হয়ে যাবে ভার্সিটিতে। এটা ওর প্রাত্যহিক রুটিন। তবে উইকেন্ডে ভোর পর্যন্ত ক্যাব চালায় ও। অর্ধেক দিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে পার্টি দেয়।
সোডার ক্যানে চুমুক দিয়ে সামনে তাকিয়েই দেখল একজন ওকেই সিগন্যাল দিচ্ছে। ও মেয়েটার পাশে গিয়ে ক্যাব থামায়।
” হেই, ক্যান ইউ গো টু দ্য ব্রোনাক্স? ”
” ইয়াহ্, কাম। ”
রাজ্য গাড়ি থেকে বের না হতেই মেয়েটা দরজা খুলে রাজ্য’র পাশের সিটে বসল। রাজ্য একটু তাকাল, তবে কিছুই বললনা। প্রায় মেয়েরাই এমন করে। ওরা পেছনে না বসে সামনের সিটেই বসে।
নিরবে ড্রাইভ করছে রাজ্য। ওর নজর সামনের দিকে।
” আর ইউ ইন্ডিয়ান? ”
” নোহ্, বাংলাদেশী। ”
” মাই গুডনেস। মাই ড্যাড ওয়েন্ট টু বাংলাদেশ। আর দেই ভেরি হসপিটালেইবল? ড্যাড ডিডন্ট ওয়েন্ট টু কাম হেয়ার। মম’স এ্যাংগার ওয়াজ বাউন্ড টু কাম। ”
মেয়েটার কথায় মৃদু হাসল রাজ্য। ও কিছুই বললনা।
” এনি ওয়ে, আ’ম জ্যানেট জনসন। ইউ? ”
” মির্জা মাশরুর আহমেদ রাজ্য। ”
” নাইস টু মিট ইউ। ” হাত বাড়িয়ে দিল জ্যানেট। রাজ্যও হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল।
চলবে…