সায়াহ্নের প্রেমছন্দ পর্ব-০৭

0
881

#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৭
জাওয়াদ জামী জামী

সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। ভোরের দিকেও থেমে থেমে চলছে মেঘবৃষ্টির লুকোচুরি। কখনো মেঘ এসে বৃষ্টিকে থামিয়ে দিচ্ছে, ঠিক তার পরপরই মেঘের বুক চিঁড়ে বৃষ্টি ঝরে পরছে পরমানন্দে। যেন কপোত-কপোতীর খুনসুটি চলছে অবিরাম।

মান-অভিমানের পালা শেষ করে সবাই রাজ্যকে সাদরে গ্রহণ করেছে। এতদিনের বিরহে যেন সবাই হাঁপিয়ে উঠেছিল। তারই অন্তে সকলেই প্রবলভাবে অনুভব করছে, এই বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। নির্ঘুম রাত কেটেছে রাজ্য’র। জানালার পাশে বসে উপভোগ করেছে বছরের প্রথম বৃষ্টি। অনেককাল হয়ে গেছে সে বৃষ্টি দেখেনি। তাই উৎসাহ একটু বেশিই ছিল। মনের সকল মেঘ কেটে যাওয়ায় বৃষ্টিটা একটু বেশিই উপভোগ্য ছিল। মনে সৃষ্টি করেছিল বৈচিত্র্যময় অনুভূতি। ফজরের আজান শুরু হতেই রাজ্য হাঁই তুলে বেরিয়ে আসল রুম থেকে। অনেকদিন হয়েছে নামাজ আদায় করা হয়না। তাই সিদ্ধান্ত নিল আজকে মসজিদেই নামাজ আদায় করবে।

রুম থেকে বেরোতেই মুখোমুখি হল রাজিয়া পারভীনের। এত ভোরে ছেলেকে দেখে অবাকই হলেন তিনি। ছেলেকে পরিপাটি অবস্থায় দেখে তিনি একটু ভড়কে গেলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” রাজ্য, তুই এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস? ”

” মসজিদে যাচ্ছি। ”

ছেলের কথায় হাসি ফুটল রাজিয়া পারভীনের মুখে। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়। আদুরে গলায় বললেন,

” কারও সাথে ঝগড়ায় জড়াবিনা কিন্তু। ”

মা’য়ের কথায় ছেলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল,

” ঝগড়ায় জড়াবো কেন! ”

” তুই গ্রাম ছাড়ার পর অনেকেই অনেক কথা বলেছে। বাড়ি বয়ে এসে সবাইকে দু’কথা শুনিয়ে গেছে। তোকে দেখলেও তেমন কিছুই করতে পারে। ”

মা’য়ের কথায় মলিন হাসল রাজ্য। কতবড় ভুল সেদিন করেছিল সেটা আজ হাড়েহাড়ে টের পেল।

” চিন্তা করোনান,আম্মু। তোমার ছেলে আর কোনও ভুল করবেনা। ” বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল রাজ্য।

রাজিয়া পারভীন গমনরত ছেলের পানে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা খেলা করছে।

***

নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এদিকওদিক হাঁটছে রাজ্য। মসজিদে ওকে দেখে মুসল্লীরা বেশ অবাক হয়েছে। কিন্তু কেউ তেমনভাবে কিছু বলেনি। এতে একটু স্বস্তি পায় রাজ্য।

রাতে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তাঘাট ভিজে জবজবে। কোথাও কোথাও কাদায় মাখামাখি। আকাশে মেঘের আনাগোনা। আজ সারাদিন বোধহয় বৃষ্টি হবে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় রাস্তায় মানুষজনও প্রায় নেই বললেই চলে। দিগন্তে তাকাতেই রাজ্য লক্ষ্য করল মেঘ আর কুয়াশার মিতালী। এই অসময়ে কুয়াশা দেখে ও অবাক হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। বিষয়টা ওর হজম হলোনা। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিল। আসলে প্রকৃতির লীলা বোঝা দায়। যখন ও মেঘ আর কুয়াশার মিতালী দেখতে ব্যস্ত, তখনই চোখ গেল ধান ক্ষেতের দিকে। জমির আইল দিয়ে হেঁটে আসছে কেউ। খুব সাবধানে হাঁটছে সে। হাঁটু ছাড়ানো তার কেশরাশি বাতাসে উড়ছে। তার শরীরে ওড়না প্যাঁচানো। বোধহয় তার শীত করছে। এই ভোরে ধানক্ষেতের মাঝে হঠাৎ কাউকে দেখে থমকে দাঁড়ায় রাজ্য। মাথা নিচু করে হাঁটায় তার মুখটা দেখতে পাচ্ছেনা সে। অবশ্য এরজন্য মেঘও কিছুটা দায়ী। কালো মেঘ তার কালো ছায়ায় ধরনীকে আঁধারে রুপান্তরিত করেছে। সেই আঁধারে রাজ্য দেখছে এক তরুণীকে। যে মনযোগ দিয়ে পথ চলছে। দুনিয়ার কোন কিছুই তার খেয়ালে নেই। দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে, তারই ঝমঝম শব্দ আলোড়ন তুলেছে এদিকে। শীতল মলয় ছুঁয়ে দিচ্ছে তনুমন। মেয়েটাও বোধহয় শুনতে পেয়েছে বৃষ্টির শব্দ। সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। আরেকটু কাছে আসতেই রাজ্য দেখতে পেল তাকে। তার মুখের দিকে তাকালোনা বেশিক্ষণ। রাজ্য’র চোখ আটকে গেছে মেয়েটার কেশরাশিতে। কণ্ঠা ভেদ করে শুধু একটা বাক্যই উচ্চারিত হল,

” অপূর্ব! ”

হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সে খেয়াল নেই রাজ্য’র। সে দেখতে ব্যস্ত এক কালো পরীকে। যে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে প্রানপনে হাঁটতে শুরু করেছে। বৃষ্টি যে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে সেটা আমলেই নিচ্ছেনা রাজ্য। সে দেখতে ব্যস্ত একজনকে।

বৃষ্টি নামতেই মেয়েটা জোড়ে পা চালায়। রাজ্যকে অতিক্রম করে চলে যায় নিজ গন্তব্যে। মেয়েটা চলে যেতেই হুঁশ ফেরে রাজ্য’র। আফসোস হলো মেয়েটার পরিচয় জানতে না পারায়। নিজের বোকামির জন্য নিজেকে কয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে দিল। এরপর পা বাড়াল বাড়ির পথে। তখনই লক্ষ্য করল, সে অনেকদূর চরে এসেছে। ওর বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে এসেছে সে। অনেকটুকু রাস্তা হাঁটতে হবে তাকে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই হাঁটতে শুরু করল।

***

বাড়িতে অপরিচিত কাউকে দেখে কপাল কুঁচকে তাকালেন রাজিয়া পারভীন। বোরখা পরিহিত রমনীকে তিনি চিনতে পারলেননা।

” কে আপনি? কাকে চান? ”

” আমাকে চিনতে পারছনা, বড়মা? ” মুখের নিকাব খুলে ফেলল ঋত।

” ঋত, তুই! ”

” হুম আমি। তোমাদের দেখতে আসলাম। তোমরাতো আমাকে ভুলেই গেছ, তাই আমিই নতুনভাবে পরিচিত হতে আসলাম। ”

” কে বলেছে ভুলে গেছি! আয় ভেতরে আয়। চাচা কেমন আছে রে? ”

” ভালো নেই। এই দাদুর জন্য শুধু কাঁদে। বন্ধুকে না দেখার শোক তাকে অসুস্থ করে দিয়েছে। ”

ঋতের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রাজিয়া পারভীন। মেয়েটাকে হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে আসলেন।

” রাবেয়া কেমন আছে? শুনলাম পেখম নাকি বুয়েটে চান্স পেয়েছে? কেমন আছে মেয়েটা? ” রুমে এসে ঋতকে জিজ্ঞেস করলেন রাজিয়া পারভীন।

” সবাই ভালো আছে, বড়মা। পেখম আপু দুইদিন হলো বাড়িতে এসেছে। সে-ও ভালো আছে। আমি যে তোমাদের এখানে এসেছি এটা কিন্তু চাচাদের বলোনা। আর আমাকে দাদুর কাছে নিয়ে চল। দাদু তার বন্ধুকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমি ভিডিও কলে দুই বন্ধুর দেখা করিয়ে দেই। ”

” চল। শোন ঋত, গতরাতে রাজ্য এসেছে। আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি। যদি ওকে রাজি করাতে পারি, তবে এবার পেখমকে বউ করে নিয়ে আসব। ”

” ভাইয়া এসেছে? কোথায় সে? তুমি রাজি করালেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে, বড়মা? আমার বাবা-চাচারা কি রাজি হবে? ”

ঋতের কথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ল রাজিয়া পারভীনের কপালে। মেয়েটা ভুল কিছু বলেনি। রাজ্য’র বাবা-চাচারাও যে রাজি হবে তেমনটাও কিন্তু নয়। দুই পরিবারই বেঁকে বসেছে। বিষয়টা এত সহজ নয়।

” রাজ্য ঘুমাচ্ছে। উঠতে দেরি হবে। তুই আরেকদিন এসে ওর সাথে কথা বলিস। এখন চল আব্বার রুমে। ”

***

অনেকদিন পর দুই বন্ধুতে কথা বললেন। ভিডিও কলে দু’জন দু’জনকে দেখলেন। আবেগে আপ্লুত হলেন, কখনো কাঁদলেন আবার কখনো হাসলেন। দু’জনের মুখে যেন কথার ফুলঝুরি ছুটেছে। রাজিয়া পারভীন আর তার বড় জা সাবিকুন্নাহার সবটা দেখে হাসলেন।

ঘন্টা খানেকের বেশি সময় মীর বাড়িতে কাটিয়ে ঋত ফিরে গেল নিজের বাড়িতে।

***

ভাতিজার আসার খবর শুনে হাসিব, মাহমুদ পরিবার নিয়ে গ্রামে এসেছেন। এসেছে কাননও। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। হাসিব চাকরির সুবাদে চিটাগং থাকছেন। তার মেয়ে হৃদিতাও তাদের সাথেই থাকে। কাননও বাবা-মা’র সাথেই থাকত। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর ও একাই ঢাকা থাকছে।

মীর মাহমুদের দুই ছেলেমেয়ে ঈশাই আর মেঘ। ওরা একজন ক্লাস টেনে পড়ে আরেকজন সেভেনে পড়ে। তারা রাজশাহী থাকে।

ছেলেবউ, নাতি-নাতনীদের পদচারণায় মীর বাড়ি মুখরিত হয়ে আছে। সবাই মিলে আনন্দ করছে। চার জা রান্নাঘরেই কাটাচ্ছেন দিনের অধিকাংশ সময়। একেকজনের একেক আবদার হাসিমুখে পূরণ করছেন।

সেই রাতেই অসুস্থ হয়ে পরলেন মীর রেজাউল করিম। রাজ্য কাননকে নিয়ে ছুটল ডক্টরের কাছে।

কানন ঋতকে দাদুর অসুস্থতার কথা জানাল। সে আরও জানায়, দাদু তার বন্ধুকে দেখতে চেয়েছেন। এটাই তার শেষ ইচ্ছা। ঋত বাড়ির সবাইকে বলল সে কথা। ঋতের মুখে বন্ধুর অসুস্থতার সংবাদ শুনে চিন্তিত হয়ে পরলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছুটে যেতে চাইলেন বন্ধুর কাছে। তার ছেলেরা বাঁধ সাধল। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দার ন্যায় আচরণ করলেন। যেকোন মূল্যেই তিনি বন্ধুর কাছে যাবেন। তার জেদের কাছে হার মানতে হয় সকলকেই। ছেলেরা রাজি হল অবশেষে। বড় পুত্রবধূ পারভীন আক্তারকে নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক চললেন বন্ধুর কাছে।

মীর বাড়ির দরজায় এসে থমকে দাঁড়ালেন দু’জনই। অতঃপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকলেন।

সৈয়দ চাচাকে দেখে সাবিকুন্নাহারসহ তার তিন জা এগিয়ে এলেন। কুশল বিনিময় করলেন দু’জনের সাথে। এরপর তাদের নিয়ে চললেন শ্বশুরের ঘরে।

রাজ্য দাদুর ঘরে ঢুকে থমকে যায়। সৈয়দ দাদুকে দেখে ওর পা মেঝের সাথে আটকে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে। আপনাআপনি মাথা নিচু হয়ে গেছে। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরতে হবে এই ধারনা কখনোই ছিলনা। তবে ওকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি আগ বাড়িয়ে কথা বললেন রাজ্য’র সাথে।

” কেমন আছ, বড়মা? ” রাজ্য এবার জিজ্ঞেস করল পারভীন আক্তারকে।

” আলহামদুলিল্লাহ। তোমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে? দেশে এসেছ কবে? ”

” তিনদিন হয়েছে এখানে এসেছি। পড়াশোনা শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন। ”

” কি করছ এখন? ”

” আমার ভার্সিটিতেই জয়েন করেছি। ”

” বাহ্ বেশ। ” আর কিছু বললেননা পারভীন আক্তার। তার ভেতরের ক্ষত এখনো শুকায়নি। পেখমের দিকে তাকালে তার বুকের ভেতরটা কষ্টে ফেটে পরে সর্বদা। আজ তিনি রাজ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, স্বেচ্ছায় হীরকখণ্ড পায়ে ঠেলেছে রাজ্য।

রাজ্য বুঝল বড়মা ওর সাথে কথা বলতে চাইছেনা। তাই ও ভেতরে দাঁড়ালনা। দৃঢ় পায়ে বাহিরে বেরিয়ে এল।

” বউমা, তোমার কাছে একটা অনুরোধ করব, রাখবে? ” মীর রেজাউল করিম ক্ষীন গলায় বললেন। তার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। থেকে থেকেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

” অনুরোধ বলবেননা, চাচা। বলুন আদেশ। ”

” পেখমকে একটাবার আমার কাছে নিয়ে আসবে? মৃত্যুর আগে মেয়েটার কাছে মাফ না চাইলে আর ও মাফ না করলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। আমি পাপী। ওর ক্ষমাতেই আমার সেই পাপ কিছুটা কমবে। ” কেঁদে উঠলেন মীর রেজাউল করিম।

এবার পারভীন আক্তার বেশ চিন্তায পরলেন। তিনি কি উত্তর দেবেন! আর কিভাবেই বা পেখমকে বলবেনন একথা!

” বউমা, আনতে পারবেনা পেখমকে? এ আমার অনুরোধ। পাপ মোচনের একটা সুযোগ তুমি দাও। ” পারভীন আক্তারকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও বললেন মীর রেজাউল করিম।

বন্ধুকে এভাবে অনুনয় করতে দেখে মুখ খুললেন সৈয়দ শামসুল হক। বন্ধুর কান্না তিনি সহ্য করতে পারলেননা।

” আমি পরী বুবুকে তোমার কাছে নিয়ে আসব, রেজাউল। এবং খুব তাড়াতাড়িই আসবে সেই দিন। তুমি শান্ত হও। ”

বন্ধুর থেকে আশ্বাস পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন মীর রেজাউল করিম।

চলবে…