#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী জামী
” পরী বুবু, তোমাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবে? ” সৈয়দ শামসুল হক বসে আছেন পেখমের সামনে। তিনি করুণ গলায় নাতনিকে জিজ্ঞেস করলেন।
দাদুর এহেন অনুরোধে পেখম বেশ চমকায়। দাদু কখনোই এভাবে অনুরোধ করেনি কিংবা ওর কাছে কিছু চায়নি।
” কি বলবে নিঃসংকোচে বলতে পার, দাদু। এমন অপরাধীর মত করে অনুমতি চাইছ কেন! ”
নাতনীর থেকে অনুমতি পেয়ে হাসলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি জানেন, তার নাতনীর বিচার-বিবেচনাবোধ প্রখর। সেই সাথে তার আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। সে কাউকে আঘাত করতে জানেনা। সে গড়তে জানে, ভাঙতে জানেনা। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছেন, কিভাবে নাতনীকে কথাটা বলবেন।
পেখম আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে দাদুর দিকে। দাদু কি এমন কথা বলতে চাইছে, যার দরুন দাদুকে এতটা ভাবতে হচ্ছে আবার ওর থেকে অনুমতিও নিতে হচ্ছে!
” পরী বুবু, তোমার মীর দাদু তোমাকে দেখতে চেয়েছে। দীর্ঘদিন সে তোমাকে দেখেনি। তার শেষ ইচ্ছে তোমাকে একবার দেখবে। ”
দাদুর কথায় পেখম কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। ও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। যেন মেঝের ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত আছে। অনেকক্ষণ পর যখন সে চোখ তুলে চাইল, তখন তার চেহারায় অন্যরকম অভিব্যক্তি দেখলেন সৈয়দ শামসুল হক। পেখম দীর্ঘশ্বাস গোপন করলনা। সজোরে শ্বাস ছেড়ে বলল,
” কখন যেতে হবে, দাদু? ”
” তুমি যখন চাইবে। তবে তোমার চাচারা বাড়িতে না থাকলে যেতে হবে। ” উচ্ছ্বসিত গলায় দাদু বললেন।
” তবে আগামীকাল যাই চল? চাচারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই না-হয় যাব। ”
” তুমি বউমার থেকে অনুমতি নিবেনা? যদি সে রাগ করে? ”
” তুমি আমার মা’কে জানোনা? তোমার খুশির চেয়ে তার কাছে বড় কিছু আছে? ”
” এটা আমার থেকে ভালো কেউ জানেনা। তবে পরী বুবু, মেহনাজকে এই বিষয়ে কিছু জানিওনা। সে কিন্তু রাশেদের কানে কথাটা ঠিক পৌঁছে দেবে। ”
” কেউ জানবেনা, দাদু। ”
” আরেকটা কথা, বুবু। রাজ্য বাড়িতে এসেছে। ”
পেখম এবার অবাক হয়ে তাকায় দাদুর দিকে। তবে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,
” আমরাতো আর সেখানে থাকতে যাবনা। দাদুকে দেখেই চলে আসব। বাড়িতে কে আছে, না আছে সেটা দেখার কোন দরকার কি আদৌও আছে? ”
” মোটেও নেই। ”
***
ফজরের নামাজ আদায় করে এসে ঘুমিয়েছে রাজ্য। হঠাৎই তার ঘুম ভাঙ্গল চেঁচামেচি শুনে। মা-চাচীরা বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। অন্য দিনের চাইতে আজকে তারা একটু জোরেই কথা বলছে মনে হচ্ছে! অনেক চেষ্টা করেও রাজ্য ঘুমাতে পারলনা। তারপরও বিছানা না ছেড়ে চোখ বন্ধ করে পরে রইল।
রাজিয়া পারভীনসহ তার জা’য়েরা সবাই পেখমকে ঘিরে বসে আছেন। মীর রেজাউল করিম পেখমের হাত ধরে রেখেছেন। তারা নানান গল্প করছেন। মীর রেজাউল করিম এ নিয়ে কয়েকবার পেখমের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ছেলের কৃতকর্মের জন্য বারবার পেখমের কাছে ক্ষমা চাইছেন রাজিয়া পারভীন। সবার এমন কর্মকাণ্ডে বিব্রত হচ্ছে পেখম। ও কারও ওপর রেগে নেই কিংবা মন খারাপ করে নেই, সেটা ও সবাইকে বুঝিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। তাই আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে মীর দাদুর স্ত্রী’ র দিকে। দাদীমা সবার কর্মকাণ্ডে থেকে থেকেই হেসে উঠছেন। বোঝাই যাচ্ছে তিনি বেশ আনন্দ পাচ্ছেন।
রাজিয়া পারভীন পায়েস আর পাটিসাপটা পিঠা আনলেন। পেখম খেতে না চাইলেও তিনি জোর করে খাওয়ালেন।
এতকিছুর মধ্যে পেখম লক্ষ্য করল কানন ভাইয়া ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তার চেহারায় এক ধরনের সমীহ দেখতে পাচ্ছে পেখম। অথচ আগে কানন ভাইয়া ওকে নানান কথা বলে খেপাত। আগের কানন ভাইয়া আর আজকের কানন ভাইয়ার মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। বিষয়টা ভাবাচ্ছে পেখমকে।
চোখ খুলেই রাজ্য অবাক হয়ে যায়। ওর রুমের জানালা কেউ খুলে দিয়েছে। সেই জানালা দিয়েই দেখতে পেল সেদিনের সেই বৃষ্টি বিলাসীনিকে। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাজ্যর মা’য়ের সাথে কথা বলছে। বিস্ময়ে রাজ্য মাথা ঝাঁকায়। এটা হয়তো ওর চোখের ভুল। অথবা প্রতিদিন মেয়েটাকে ভাবে, তাই হয়তো তাকে স্বপ্নে দেখছে। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে যে মা’কেও দেখা যাচ্ছে! ওদের বাড়িটা চারপাশে ঘোরানো দোতলা বাড়ি। মাঝখানে ফাঁকা উঠান। বাড়ির ভেতর দিকেই প্রত্যেক রুমের জানালা থাকায়, জানালা খুললে প্রতিটা রুম থেকেই উঠান আর বারান্দায় থাকা মানুষকে দেখা যায়। রাজ্যও দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু রাজ্য স্বপ্ন দেখছে ভেবে মনকে প্রবোধ দিল৷ কিন্তু না একটু পরই বড়মা এসে দাঁড়িয়েছে! এ ও কি সম্ভব! একই স্বপ্নে মা, বড়মা আর সেই বৃষ্টি বিলাসীনিও থাকবে! রাজ্য আরও চমকাল যখন দেখল সৈয়দ দাদুও এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ কেমন স্বপ্ন! না এটা মোটেও স্বপ্ন নয়। রাজ্য এক ঝটকায় উঠে বসল। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে৷ চোখ রগড়ে ভালো করে তাকাল। নাহ্ মস্তিষ্ক কিংবা নয়ন কোনটাই ওর সাথে ছলচাতুরী করেনি। সত্যিই সেই বৃষ্টি বিলাসীনি এসেছে! রাজ্য অনড় হয়ে বসে রইল। কে এই বৃষ্টি বিলাসীনি? পেখম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই হুঁশ ফিরল রাজ্যর। ও বিছানা থেকে নেমে বারান্দার দিকে হাঁটতে থাকে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেই কালো পরী৷ আজকে তার পরিচয় না জেনে যেতে দেবেনা কিছুতেই।
কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই ধাক্কা খায় কাননের সাথে।
” কি ব্যাপার ভাইয়া, ঘুম থেকে উঠেই কি মাথাটা গেছে? নাকি আগেই গেছিল, ঘুম ভাঙার পর সেটা টের পেয়েছ? ”
” তুই আমার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে আবার আমাকেই দোষী করছিস? চলেই গেল বোধহয়। ”
” কে চলে গেল, ভাইয়া? এমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছিলে? ”
” সৈয়দ দাদুকে দেখলাম মনে হয়? ”
” হুম, দাদু এসেছিল। ”
” তার সাথে একটা মেয়েকে দেখলাম, কে সে? ”
” কিহ্ তুমি তাকে চেনোনা? ”
” না তো। কে সে? ”
” পেখম। দাদু পেখমকে দেখতে চেয়েছিল, সেজন্যই সৈয়দ দাদুর সাথে সে-ও এসেছিল। ”
কাননের কথা শুনে রাজ্য কপালে হাত দিল। পিছিয়ে গেল দু-পা। মিশু আপুর মুখে এই নামটা ও অনেকবার শুনেছে। তবে কি সেদিনের সেই মেয়েটাই ওর বৃষ্টি বিলাসীনি? যাকে বিয়ে না করে ও বাড়ি ছেড়েছিল?
রাজ্যকে বেকায়দা ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায় কানন। ও এগিয়ে যায় রাজ্যর দিকে। উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,
” ভাইয়া, তুমি ঠিক আছ? ”
রাজ্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” ও কি সৈয়দ দাদুর নাতনী পেখম? ”
” হুম। যাকে তুমি বিয়ে না করে সেদিন বাড়ি ছেড়েছিলে। সেদিনের পর থেকে ও এই বাড়িতে পা রাখেনি। দাদুর অনুরোধে ও আজ এসেছিল। ”
কানন কথা শেষ করতে না করতেই রাজ্য ওকে সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। বেচারা থাপ্পড় খেয়ে অসহায়ের মত গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ও নিজের অপরাধ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোন দোষ খুঁজে পেলনা। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করেই বসল,
” এমন নির্দয়ের মত মারলে কেন? আমার গাল কি সরকারি সম্পত্তি নাকি? ”
” বেয়াদব ছেলে বড়দের নাম ধরে ডাকছিস মানে? বৃষ্টি বিলাসীনি ওপস্ সরি পেখম কি ছোট যে ওর নাম ধরে ডাকছিস? ”
রাজ্যর অদ্ভুত কথা শুনে কানন ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে। ওর মুখে কোনও কথা জোগাচ্ছেনা। রাজ্য যে ওকে কারন ছাড়াই মারল এটা মেনে নিতে পারছেনা। আবার কেন কারন ছাড়া মারল এটাও বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু চেষ্টা করেও কোন লাভ হলোনা। অনেকক্ষণ নিরব থাকার পর মুখ খুলল। তবে ওর মন খারাপ হয়েই রইল।
” আমি গুরুজনদের সম্মান দিতে পারি, ভাইয়া। পেখম আমার জুনিয়র। তবুও তাকে বড় বোনের মতই সম্মান করি আমি। গত তিন বছর ধরে ওকে আমি আপু ডাকি। ”
” ভাবীকে কেউ কখনো ‘ আপু ‘ ডাকে, আহাম্মক? ভাবী মা’য়ের সমতুল্য। তাই প্রয়োজনে তাকে ‘ মা ‘ ডাকা যায়, কিন্তু ‘ আপু ‘ নয়। ও যদি তোর ‘ আপু ‘ হয়, তবে আমাকে তোর ‘ দুলাভাই ‘ ডাকতে হবে। আমি কি তোর : দুলাভাই ‘ লাগি, হাঁদা? ”
রাজ্য বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে আছে রাজ্য’র দিকে। ভাইয়ার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা। এদিকে রাজ্য ওকে চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত করে বাড়ির বাহিরে চলে গেল।
রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটল রাজ্য। ওর মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। তবে যখনই আড়াই বছর আগের কথা ভাবছে তখনই অজানা ভয় এসে হানা দিচ্ছে হৃদয়ের গহীনে। সেদিনের করা বোকামি বুমেরাং হয়ে ওরই দিকে ফিরে এসেছে। আর সেদিনের সেই বুমেরাং ওকে পোড়াবে, ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিবে, আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করবে এটাও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। তবে সে-ও হাল ছাড়বার পাত্র নয়। যতই ঝড়, বাঁধা-বিপত্তি আসুক রাজ্য ওর বৃষ্টি বিলাসীনিকে জয় করেই ছাড়বে।
চলবে…