#সায়াহ্নের_প্রেমছন্দ
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী জামী
” কানন, ঘটনা কি বলতো? তুই পেখমকে গত তিন বছর ধরে আপু ডাকিস কেন? দুনিয়া সুদ্ধ মানুষ জানে, অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। হঠাৎ তোর এই অতিভক্তির কারন কি? ” বাহির থেকে এসেই রাজ্য কাননকে চেপে ধরল।
কানন রাজ্যের প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পায়না।ও ভাবতেই পারেনি, ওর একটা কথার রেশ ধরে রাজ্য ওকে এমন প্রশ্ন করতে পারে। মনেপ্রাণে রাজ্যের কাছ থেকে নিস্তার পেতে চাইলেও সেটা সম্ভব হয়ে উঠলনা। ওকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রাজ্য আবারও কথা বলল,
” মুখে কুলু পেতে আছিস কেন? নাকি আমি কি জিজ্ঞেস করেছি সেটা শুনতে পাসনি? অবশ্য শুনতে না পেলেও অসুবিধা নেই। কাউকে কিভাবে কথা শুনতে পাওয়াতে হয় সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। ”
কানন বুঝতে পারছে এবার ওকে মুখ খুলতেই হবে। কিন্তু তারপরও কাঁচুমাচু করছে। কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। অবশেষে হযবরল বলতে চেষ্টা করল।
” আসলে হয়েছে কি ভাইয়া, সকল মেয়েদেরকে আমি বেশ কয়েক বছর যাবৎ সম্মান করার চেষ্টা করছি। মেয়েদের সম্মান করলে মনে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে। আমি মনের প্রশান্তির জন্যই পেখমকে বড় আপুর মত সম্মান করি। তুমিও মেয়েদের বড় বোনের মত সম্মান করে দেখ, তোমার মনও প্রশান্তিতে ছেয়ে যাবে। ”
” আজেবাজে বকা বন্ধ করে আসল কথা বল। তোর আজেবাজে কথা শোনার মত পর্যাপ্ত সময় আমার হাতে নেই। পৃথিবীর সকল মেয়েকেই যদি বোনের চোখে দেখব, তবে বউ হবে কে? সংসার করব কার সাথে? বাচ্চার মা বানাব কাকে? তাই তোর উদ্ভট কথা আমি একটুও বিশ্বাস করলামনা। ”
কানন মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে রাজ্যর দিকে।
” সত্যি বলছি ভাইয়া, আমি সম্মান করি পেখমকে। সেজন্যই ওকে আপু ডাকি। ”
” নাকি ওকে লাইন মারার চেষ্টায় আছিস? আমি জানি ছোটবেলা থেকেই তোর ছোঁকছোঁক করার অভ্যাস আছে। ”
” নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ্। এসব কি বলছ! জান্টুসের বড় বোনকে কেউ কখনো লাইন মারে! ”
কাননের কথায় রাজ্য হাসল। যেন গোপন কিছু জানতে পেরেছে।
” তাহলে আমার সন্দেহই ঠিক। গত তিনদিন ধরে তোকে আমার ঠিকঠাক মনে হচ্ছিলনা। সব সময়ই ফোন হাতে চিপায় চাপায় গিয়ে ফিসফাস করতে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম, ডাল মে কুছ কালা হেয়। তা মেয়েটি কে? কোন সৈয়দের মেয়ে সে? ঐ বাড়িতে সৈয়দের অভাব নেই তো। ”
” হুম আমাদের বাড়িতে যেমন মীরের অভাব নেই। ঋত ওর নাম। ” রাজ্য’র কাছে ধরা খেয়ে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতই লাগছে কাননকে।
” ঋত! মানে রাশেদ চাচার মেয়ে? যে মেয়েটা সব সময়ই ফড়ফড়ায়? আগেরবার যে আমার পিঠে আচমকা কিল মেরেছিল? ”
” ছোট ভাইয়ের ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিনী সম্পর্কে এভাবে বলতে নেই, ভাইয়া। ও সেদিন আমার কথায় তোমাকে মেরেছিল। আমিই ওকে ডেয়ার দিয়েছিলাম। ”
” বাহ্ মেয়েটার দেখছি খুব সাহস! তোর মত ভীতুর ডিমের মধ্যে মেয়েটা কি এমন দেখেছিল যে প্রেমে পরেছে? ”
” আমাকে তুমি ভীতুর ডিম বলতে পারনা, ভাইয়া। আমি যে সাহসী এটা তুমি ভালো করেই জানো। ছোটবেলায় তোমার কথা শুনে কতবার তপন বাগচিদের বাগান থেকে আম, পেয়ারা, কতবেল চুরি করেছি, এগুলোর সাক্ষী স্বয়ং তুমি। ”
” তুই বলতে চাচ্ছিস, সেই সাহস এখনো তোর আছে? ”
” অবশ্যই আছে। কেন থাকবেনা! ”
” তবে দেখি কেমন তোর সাহস? দেখাবি? ”
” কেন নয়? ”
” ভেবে বলছিসতো? ডেয়ার পূরন করতে পারবি? ”
” দিয়েই দেখোনা। ”
” আগামী দুই দিনের মধ্যে তোর জান্টুসকে তার পরিবারের লোকজনের সামনে থাপ্পড় দিবি। এবং এটা তাকে আগে জানানো যাবেনা। থাপ্পড় খেয়ে ওর এবং ওর পরিবারের প্রতিক্রিয়া কি সেটা এসে জানাবি। ”
রাজ্যের ডেয়ার শুনে চমকে উঠে কানন। ও নিশ্চল চেয়ে আছে, মুখে কোন কথা নেই। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। এদিকে রাজ্য ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
” আমাকে যূপকাষ্ঠে চড়াও আমার কোনও আপত্তি থাকবেনা। তবু এমন ডেয়ার দিওনা। আমার প্রেম গোড়াতেই পঁচে যাবে, ভাইয়া। ” অনুনয় ঝড়ল কাননের গলায়।
” তোর সাহস দেখতে চাই আমি। ” অনড়ভাবে বলল রাজ্য।
” প্লিজ, ভাইয়া। ছোট ভাইয়ের ওপর একটু ভালোবাসা দেখাও। এভাবে তার প্রেমের সমূলে বিনাশ করোনা। ”
” ভালোবাসা দেখাতে পারি একটা শর্তে। ”
” আমি হাজারটা শর্ত মানতে রাজি আছি। ”
” পেখমের সাথে কথা আমার বলার ব্যবস্থা করে দে। সৈয়দ দাদু আর দুই বড়মার সাথে দেখা করতে চাই। কথা বলতে চাই তাদের সাথে। ”
” তুমি পেখমের সাথে কথা বলতে চাও! কিন্তু কেন? ও কি রাজি হবে! ” রাজ্যের থাপ্পড় খেয়ে থেমে যায় কানন। এবার ওর দোষ কি সেটা খুঁজে পায়না। বিস্ময় চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
” এবার মারলে কেন! কি করেছি আমি! ”
” পেখম তোর ভাবী এটা মাথায় রাখবি। ভাবীর নাম ধরে ডাকতে নেই এটা জানিসনা? দুই দিনের মধ্যে যা বললাম সেটা করবি, নয়তো তোর প্রেমের বিনাশ করতে আমার দুইদিন সময়ও লাগবেনা। ”
রাজ্য নিজের রুমে চলে গেল। কানন গালে হাত দিয়ে অসহায় চোখে রাজ্যর যাওয়া দেখল। ও কিভাবে পেখমকে রাজ্য’র সামনে নিয়ে আসবে সেটা ভাবতে গিয়েই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে।
***
” পেখম, এদিকে আয় আমি তোকে খাইয়ে দেই। ”
বাসার সবাইকে খেতে দিয়ে পেখমকে খেতে ডাকলেন পারভীন আক্তার। কিন্তু মেহনাজের এটা পছন্দ হলোনা। যেখানে তার বড় জা ঋত, রাতকে খুব একটা খাইয়ে দেয়না, সেখানে পেখমকে সে তিন বেলায়ই মুখে তুলে খাওয়ায় এটা সে মানতে পারেনা কিছুতেই।
” কেন বড় ভাবী, ও কি ছোট আছে যে এখনো মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হবে? ”
” কেন, আমি ওকে খাইয়ে দিলে তোর কি সমস্যা? আমি শুধু পেখমকেই খাইয়ে দেইনা। অন্যদেরও দেই। পেখম, আমার কাছে আয়। ”
” অন্যদের কেমন খাইয়ে দাও সেটাতো দেখতেই পাই। এবার বাড়িতে আসার পর আমার মেয়েদের কয়দিন খাইয়ে দিয়েছ? ”
” তোর মেয়েরা প্রতিরাতে নিজের রুমে কেন খায় এটা ওদের জিজ্ঞেস করেছিস? কিংবা ওরা রাতে কি খায় সেটা জানিস? ”
” আম্মু, বড়মা আমাদের প্রতিদিন রাতেই খাইয়ে দেয়। তুমি না জেনে কথা বলছ কেন? ” রাত দু’জনের মাঝে কথা বলল।
” রাত, তুমি খাও। অযথা তোমার আম্মুর সাথে মুখ লাগিওনা। সে সর্বদাই অন্যকে দোষী করে নিজেকে সুখী ভাবে, এটা তাকে ভাবতে দাও। নিজেকে সুখী ভাবার অধিকার তারও আছে। ” রাশেদ খেতে খেতে বলল।
স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে চুপ মেরে গেল মেহনাজ। সে আর কিছু বলার সাহস করলনা। কারন সে জানে, এই মুহূর্তে কিছু বললেই রাশেদ ওকে সবার সামনে অপমান করতে একবারও ভাববেনা।
এদিকে রাশেদের কথা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে মুখ টিপে হাসল। মেহনাজের কথার ধরন এই বাড়ির কারোই পছন্দ নয়। সবাইকে অপমান করে সে শান্তি পায় সেটা তারা জানে।
” ঋত, পেখম তোরা কালকে একটু শপিংয়ে যাসতো, মা। আমার কয়েকটা জিনিস লাগবে। তোরা দুই বোন গিয়ে পছন্দ করে এনে দিস। ” পারভীন আক্তার দু’জনকেই উদ্দেশ্য করে বললেন।
” কি কিনবে, বড়মা? শুধু কি তুমিই নিজের জন্য শপিং করতে দেবে? আমাদের কিছুই দেবেনা? ” ঋতও কম যায়না। সে সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল।
” তোদের শপিংয়ে পাঠাব আর তোদেরকে কিছু কিনে দেবনা এটা কখনো হয়েছে? কার কি লাগবে লিষ্ট করিস। পেখম তোর লিষ্টও করিস। একবার ক্লাস শুরু হয়ে গেলে তোকে কিন্তু সময় নষ্ট করতে দেবনা। ”
” আচ্ছা, বড়মা। ”
খাওয়া শেষ করে ঋত গিয়ে কাননকে ফোনে জানালো ওরা শপিংয়ে যাবে।
***
” গুড নিউজ, ভাইয়া। ”
রাজ্য বই নিয়ে বসেছিল। কানন এসে ওর বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুতে শুতে বলল৷
” আগে নিউজটা বল। তারপর বুঝব সেটা গুড না ব্যাড। ”
” কাল ঋত আর ভাবী দু’জন শপিংয়ে যাচ্ছে। ”
রাজ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকাল কাননের দিকে। এরপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
” তোর কি কি লাগবে সেটা আমাকে বল, তুই যা চাইবি কাল সব পেয়ে যাবি। ”
” সত্যিই! তুমি কিনে দেবে? ”
” নাহ্ তোর জান্টুস দেবে। ”
” কাম অন, ভাইয়া। ওর কাছে এত টাকা নেই যে আমার চাহিদা পূরণ করবে। ”
” তাহলে লিষ্ট কর। তোর সাথে বাড়ির সবার লিষ্ট নিয়ে নে। ”
***
” আপু, চল ফুচকা খাব। ” শপিং শেষে বায়না ধরল ঋত।
” অন্য কিছু খেতে চাইলে চল। ফুচকা নট এলাউ। ”
” প্লিজ, আপু। তুমি তো জানোই ফুচকা আমার ফেভারিট। ”
” অন্য কিছু খেতে চাইলে বল। নান, চিকেন কাবাব, শর্মা বা অন্য যেকোন কিছু। ”
ঋত বুঝল পেখম ওকে ফুচকা খেতে দেবেনা। মনটা খারাপ হয়ে গেল নিমেষেই।
” ওকে, চল তবে চিকেন মোমো খাই। সামনের রেস্টুরেন্টের ওরা মোমো খুব ভালো বানায়। ”
” চল। ”
” আরে, পেখম আপু! কেমন আছো? ” হঠাৎই কোথাও থেকে কানন উদয় হয়ে জিজ্ঞেস করল।
পেখম হঠাৎ করেই কাননকে দেখে অবাক হয়ে গেছে। অনেকদিন পর ও কাননকে দেখল৷ কিন্তু তার থেকেও বেশি অবাক হয় ওকে আপু ডাকতে শুনে।
” কানন ভাইয়া, তুমি আগে কিন্তু আমাকে নাম ধরেই ডাকতে। আজ হঠাৎ কি হল যে, আমাকে আপু ডাকছ? ”
” এখন থেকে তোমাকে আপু বলেই ডাকব। আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে কারও আদেশ উপেক্ষা করব! ”
” কারও আদেশ মানে! ”
” না তেমন কিছু নয়। আসলে আজকাল নারীদের সম্মান দেয়ার চেষ্টা করছি। এই যেমন ধর, ঋতকেও আগে ‘ তুই ‘ বলতাম, কিন্তু এখন ‘ তুমি ‘ ডাকি। তাইনা ঋত? ”
” তোমার সাথে ঋতের দেখা হয়! ঋত তুই আমাকে বলিসনিতো? ”
পেখমের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় ঋত, কানন দু’জনেই। ঋত ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে।
” সব সময় দেখা হয়নাতো। তবে আগে মাঝেমধ্যে এদিকে আসলে দেখা হত। তোমরা কি শপিং করতে এসেছিলে? ”
” হুম। শপিং শেষ এবার রেস্টুরেন্টে যাব। তুমি যাবে নাকি আমাদের সাথে? ” ঋত তড়িঘড়ি করে বলল।
” পেখম আপু বললে যেতে পারি। ” কানন আঁড়চোখে পেখমের দিকে তাকিয়ে বলল।
” কানন, তুই এখানে কি করছিস? আমি তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান আর তুই কিনা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? ”
পেখম বুঝতে পারছে কেউ ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে-ই বলল কথাগুলো।
” এইতো ভাইয়া, বড়ছোট আপুদের সাথে কথা বলছিলাম। ”
পেখম এখনও পেছনে তাকায়নি। এদিকে ঋত রাজ্যকে দেখে চমকে উঠেছে। ও পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় হচ্ছে, পেখম আপু রাজ্য ভাইয়াকে দেখলে কি রিয়্যাক্ট করবে৷
রাজ্য উসখুস করছে পেখমকে দেখবার জন্য। কিন্তু মেয়েটা ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। তাই বাধ্য হয়ে ও পেখমের সামনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এমন ভাব করল যেন আনমনে হাঁটছে। ঠিক তখনই কারও কথা কানে আসল। সাথে সাথে শক্ত হয়ে গেল ওর শরীর।
” আরে রাজ্য ভাইয়া, যে! তুমি দেশে এসেছ কবে? ”
রাজ্য ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। সব কেঁচে দিল এই ছেলেটা। তবে ছেলেটার প্রশ্নের উত্তর ঠিকই দিল।
” এইতো কয়েকদিন হচ্ছে এসেছি। ”
” ঋত, তুই কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি বাড়িতে যাবি? বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে এখানেই থাকতে পারিস। কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি। ”
একটা রিনরিনে কণ্ঠস্বর রাজ্যের কর্ণকুহরে ঝংকার তুলল। গেঁথে গেল ওর হৃদয়ের গহীনে। উচ্ছ্বাসে হত-বিহবল রাজ্য লক্ষ্যই করলনা পেখম ওকে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
চলবে…