সারা জাহান পর্ব-১১+১২+১৩+১৪

0
18

#সারা_জাহান
পর্ব,,,১১
মৌমো তিতলী
🫶

সারাদের ট্যুর বাস দুটো খুলনা বাগেরহাটে পৌঁছায় বিকেল সাড়ে তিনটায়। সেখান থেকে সুন্দরবন খুব বেশি দুরে নয়। বাগেরহাটে পৌঁছে টিচার্সরা সব স্টুডেন্টদের নিয়ে বাস থেকে নামে‌। এখানেই কোন ভালো হোটেল দেখে খাওয়া-দাওয়া করার উদ্দেশ্যে। সবার খাওয়া শেষে জীপ নিয়ে দল ভাগ ভাগ করে সুন্দরবন যাবে। ঘাটে গিয়ে ট্রলারে নদী ভ্রমণ করবে। সারা আর সামিরা এক সাথে বাস থেকে নেমে একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানেই একটা হোটেলে তারা যার যার পছন্দ মতো খেয়ে নিবে। গাছের নিচেই গোল গোল করে চেয়ার টেবিল পেতে রাখা তার ওপরে রংবেরঙের ছাতা মেলে দেয়া হয়েছে। খুবই সুন্দর পরিপাটি পরিবেশ। পছন্দ হলো সকলের। সারা সামিরা একটা টেবিল দখল করে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই আব্র আসে সেখানে। মুখে হাসি রেখে বলে,,

:-হেই কি অবস্থা তোমাদের? জার্নিতে টায়ার্ড হয়ে গেলে নাকি?

:-না না ভাইয়া! কি বলেন এইটুকু জার্নিতে কেউ ক্লান্ত হয় নাকি? শুধু একভাবে বসে থেকে কোমর ধরে গেছে। সামিরা হেসে জবাব দেয়।

:-আচ্ছা আচ্ছা। তোমরা কি খাবে বলো।

সারা ব্যস্ত কন্ঠে বলে,,

:-না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা খেয়ে নেবো।

:-আরে সারা কোন ব্যাপার না। আমরা তো ট্যুরে এসেছি। ঘুরতে, আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। এখানে আমাকে সিনিয়র না ভেবে বন্ধু ভাবতে পারো। তাতে এই অধম বেশি খুশি হবে ম্যাডাম। বি ইজি!!

আব্রর তাদের প্রতি এতো ফ্রেন্ডলি আচরণে সারার অস্বস্তি হয়। তবে সামিরা ভীষণ খুশি হয়। আব্র তিন প্লেট বিরিয়ানী অর্ডার করে। খাবার এলে সবাই খেতে শুরু করে। সারা অল্প অল্প করে লোকমা মুখে নিয়ে খেতে থাকে। অনেক্ষণ ধরেই আব্র সারাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করছে কিন্তু সারা নিজে বা সামিরা কি মনে করবে এটা ভেবে একটু আমতা আমতা করতে থাকে। কিন্তু মনের মাঝে চেপে রাখা কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে সারাকে প্রশ্ন করেই বসে,,

:-আচ্ছা সারা, ডক্টর তৈমুর জাহান শিকদার তোমার কে হন? সকালে দেখলাম উনিই তোমাকে কলেজে ড্রপ করে গেলেন।

তৈমুরের প্রসঙ্গ উঠতেই হিচকি উঠে যায় সারার। খাবার তালুতে উঠে বিষম লেগে যায়। কাশতে কাশতে চোখমুখ লাল টুকটুকে হয়ে যায় মুহূর্তেই! সামিরা সারার মাথার আলতো করে চাপড় মেরে বলে,,

:-আস্তে শাঁস নে!!

সারার হঠাৎ রিয়্যাকশনে ঘাবড়ে যায় আব্র। ব্যস্ত হাতে পানির বোতল খুলে সারাকে খাইয়ে দেয়। আস্তে করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই কেঁপে ওঠে সারা। আরো অস্বস্তিতে গাট হয়ে যায়। কোনমতে নিজেকে সামলে আলতো হাতে আব্রর হাত সরিয়ে জানায়,,

:-আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি।

:-আর ইউ শিউর?

:-জ্বী। ঠিক আছি আমি।

:-আমি কি কোন ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছি নাকি? তুমি এমন রিয়্যাক্ট করলে!

সারা মাথা নেড়ে বলে,,

:-না না তেমন কিছু না। আসলে আমার মনযোগ খাবারের দিকেই ছিলো। আপনার আচমকা প্রশ্নে চমকে ওঠার ফলে এমন হলো।

:-থ্যাঙ্কস গড। তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর!!

সারা মুখ নিচু করে মিনমিন করে বলে,,

:-জাহান ভাইয়া আমার কাজিন। খালামনির ছেলে।

এতক্ষণে মনের খচখচানি বন্ধ হয় আব্রর। অগোচরে হৃদয়ে চেপে রাখা নিঃশ্বাস উদগিরণ করে ধরনীর বুকে। হৃদয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যায়। হাসিমুখে বলে,,

:-ওহ তোমার ভাই হয়!! আমি ভাবলাম কি না কি!!

সারা আর সামিরা দুজনই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে আব্রর দিকে। আব্র অপ্রস্তুত হেসে বলে,,

:-আরে বসে আছো কেনো? জলদি খাওয়া শেষ করো। সকলের কিন্তু খাওয়া শেষের পথে।

কথা না বাড়িয়ে বাকিটা সময় সবাই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে।

******

সুন্দরবন। বাংলাদেশের সব থেকে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট।নানা ধরনের দুর্মূল্য গাছপালা আর পশুপাখির সমাহার এই সুন্দরবন। সেই সুন্দরবনের ফাঁকফোকর দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য ছোট ছোট নদী,খাল। এমনি একটা ঝিরি নদীর বুক চিরে সারাদের ট্রলার টা এগিয়ে যাচ্ছে। পানির ছলছল শব্দের সাথে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ সবাই। সারা ট্রলারের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মনোরম এই প্রকৃতির খেলা। সামিরা হাতে দুটো কুলফি আইসক্রিম নিয়ে আসে সারার নিকট। একটা আইসক্রিম সারার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আয়েস করে আইসক্রিম খেতে খেতে সারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,

:-তোকে একটা কথা বলবো সারা?

সারা সামিরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,,

:-তুই আবার কথা বলতে অনুমতি নিতে শুরু করলি কবে থেকে?

সারার কথায় হাসে সামিরা। বলে,,,

:-আসলে কি বলতো! একটা বিষয় না আমাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে। তুই খেয়াল করেছিস কিনা জানিনা তবে আমার ধারণা আমি যেটা গেস করছি সেটাই হয়েছে।

:-হেয়ালী না করে কি বলছিস খুলাসা করে বল।

:-হুম আমার মনে হয় আব্র ভাই তোকে পছন্দ করে।

সামিরার কথায় চমকে ওঠে সারা। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে ওঠে,,,

:-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে সামিরা? কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিস তুই?

:-আমার মাথা ঠিকই আছে। তুই বড্ড বোকা সরল বুঝলি তো। আমি কিন্তু আব্র ভাইয়ের চোখে তোর প্রতি স্পষ্ট মুগ্ধতা দেখেছি। তা ছাড়া তুই ভেবে দেখ,আব্র ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিচয় হওয়ার পর থেকে প্রায় সময় আব্র ভাই কিন্তু তোর সাথে কথা বলার নানা অজুহাত খোঁজে। কেমন একটা ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করে । উনি তো আমাদের সিনিয়র। তার নিজের ডিপার্টমেন্টের বন্ধুবান্ধব ছেড়ে আমাদের মতো ফ্রেশারদের সাথে কেনো বন্ধুত্ব করতে চাইবে? অবশ্যই যখন সে আমাদের মধ্যে কাউকে সে পছন্দ করবে‌। আর আমাদের সাথে কথা বলতে এলেই কিন্তু আব্র ভাই তোকেই বেশি Attraction দেয়। তা ছাড়া দেখলি না তখন তৈমুর ভাইয়ের কথা কিভাবে জিজ্ঞাসা করলো!! And I am very sure আব্র ভাই তোকে পছন্দ করে।

সামিরার কথা মন দিয়ে শোনে সারা। সামিরার বলা কথাগুলো তো অস্বীকার করা যায় না। সে নিজেও এগুলো খেয়াল করেছে। কিন্তু সত্যিই এমন কিছু হোক সারা চায়না।
সিদ্ধান্ত নেয় এখন থেকে আব্র কে সে এড়িয়ে চলবে।

সারার ধ্যান ভাঙ্গে ফোনের শব্দে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখে। স্ক্রিনে জাহান শিকদারের কল ভাসমান। মুহুর্তে মুখের রং পরিবর্তন হয় সারার। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে শুশ্রী মিষ্টি মুখটায়। সামিরা খেয়াল করে সে পরিবর্তন। ঠাট্টা করে বলে,,,

:-কে কল করেছে রে? যা দেখে আমাদের সারা মনি ব্লাশ করছে। দেখি একটু!
সামিরা সারার হাত থেকে ফোন নিতে গেলে সারা হেসে হাত সরিয়ে নেয়। সামিরা মিটিমিটি হাসতে থাকে। তা দেখে আরো লজ্জায় লাল নীল হয় সারা!!

এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে…..

:-হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম।

ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বরে সালামের জবাব আসে। সারা চোখ বন্ধ করে শোনে তা।

:-সারা!!

তৈমুরের কন্ঠে এমন হাস্কি স্বরে নিজের নাম শুনে শরীরে শিহরণ খেলে যায় সারার। এমন অদ্ভুত অনুভূতির কারণে আরও অস্বস্তি বোধ হয়। আলতো স্বরে জবাব দেয়….

:-হুম!

:-কোথায় এখন? সুন্দরবনে পৌঁছে গেছিস?

:-হ্যাঁ আমরা এখন ট্রলারে।

:-সাবধানে থাকিস। রেলিংয়ের কাছে যাবি না। খেয়েছিস কিছু পৌঁছে?

:-হ্যাঁ।

:-আচ্ছা। সামিরা কে সবসময় সাথে সাথে রাখিস। নিজের খেয়াল রাখিস।

:-আচ্ছা।

পরপর টুটটুট শব্দে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। সামিরা সারার বাহুতে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলে,,,

:-আয় হাই!! তাই তো বলি আমার লাজুকতা বান্ধুপীর মুখটা এতো ব্লাসিং ব্লাসিং হচ্ছে কেনো!! নিশ্চয় তৈমুর শিকদারের ফোন ছিল!!

সারা দ্রুত সামিরার মুখ চেপে ধরে।

:-উফফফ সামু তুই কিন্তু একটু বেশি কথা বলিস!!

সামিরা খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে।

**********

শহরের বেশ নিরিবিলি পরিবেশের এক রেস্টুরেন্টে সামনা সামনি বসে আছে তৈমুর জাহান শিকদার,সায়ান মাহমুদ এবং একজন বিশিষ্ট প্রৌঢ় ভদ্রলোক। যিনি শহরের এক নম্বর মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল “হেল্থ হার্ট” হসপিটালের ম্যানেজমেন্টের প্রধান ডক্টর-প্রফেসর জাহাঙ্গীর কবির।

উভয়ের সামনে টেবিলের ওপর রাখা একটা ফাইল। যেখানে আছে কিছু এগ্রিমেন্ট পেপার। লাইফ কেয়ার হসপিটাল বন্ধ থাকায় তৈমুর আর সায়ানকে হায়ার করতে চায় হেলথ হার্ট হসপিটাল।
তৈমুর জাহান শিকদার এবং ডক্টর জাহাঙ্গীর কবির বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন। বিভিন্ন ডিস্কাসের পর তৈমুর জানায়,,

:- দেখুন স্যার,, যেহেতু আমাদের প্রথম ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো লাইফ কেয়ার থেকে তাই ওই হাসপাতালের প্রতি আমাদের একটা আত্মীক টান রয়েছে। লাইফ কেয়ার হসপিটাল কে কেন্দ্র করে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার সমাধান হতেই আমরা দুজনেই লাইফ কেয়ারে ফিরতে চাইবো। সেক্ষেত্রে যদি আপনার আপত্তি না থাকে তবে আমাদের হেলথ হার্টে জয়েন করতে কোন আপত্তি নেই।

ভদ্রলোক একবার তৈমুর আর একবার সায়ানের ওপরে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। সায়ান নির্বিকার চিত্তে বসে কফির ছিপ নিচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি অনেকটা এমন যে, যেখানেই তৈমুর জাহান শিকদার সেখানেই সায়ান মাহমুদ। সে নিঃসন্দেহে একজন কাবিল সার্জেন। কিন্তু সে যে ডক্টর কম তৈমুর শিকদারের লেজ বেশি সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঠোঁট টেনে হাসলেন প্রফেসর জাহাঙ্গীর কবির।বললেন,,,

:- হেলথ কেয়ার হসপিটাল নিঃসন্দেহে তোমাদের জন্য একটা বেস্ট অপরচুনিটি। শহরের সবথেকে নামকরা বেস্ট হসপিটাল হেল্থ হার্ট। ডাক্তারি জীবনে ইমোশনাল হলে চলে না মিঃ ডঃ শিকদার। সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন।

তৈমুর জাহান প্রফেসর জাহাঙ্গীর কবিরের কথায় শান্ত অথচ তেজদীপ্ত কন্ঠে বলে,,,

:-জ্বী অবশ্যই জানি। আর এটাও জানি একজন ডক্টরের কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে পেশেন্টের জীবন। আর চিকিৎসা সেবা একজন ডক্টরের কাছে ফরজ। ডক্টর হিসেবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা কখনো ইমোশনাল হই না। কিন্তু এখানে যে ইমোশন কাজ করে তা চিকিৎসার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে না। একজন ডক্টরের কাছে সব পেশেন্টের জীবনই সমান মূল্যবান। সেটা শহরের এক নম্বর বেস্ট হসপিটাল হোক বা দ্বিতীয় স্থানে থাকা লাইক কেয়ার।সো, আমাদের শর্তে যদি আপনার সম্মতি থাকে তবেই আমরা এগ্রিমেন্ট সাইন করবো নয়তো না। ভেবে দেখুন, নয়তো আপনি আসতে পারেন।

তৈমুরের স্টেইট ফরোয়ার্ড কথায় কিছুটা অপমানিত বোধ করেন ডক্টর জাহাঙ্গীর কবির। কিন্তু প্রকাশ্যে সেটা গায়ে মাখেন না তিনি। তিনি মনে করেন, যে গাভী দুধ দেয় তার তার দুচারটা লাথি মুখ বুজে সহ্য করা কোন ব্যাপার নয়। তার হসপিটাল “হেল্থ হার্ট” আসমানের বুলন্দি ছুঁতে তৈমুর জাহান শিকদার এবং সায়ান মাহমুদের মতো টপ লেভেলের সার্জনেরা এক একটা সিঁড়ির ধাপ হিসেবে কাজ করবে। তাই এই সিচুয়েশনটা তিনি হেলায় হেসে উড়িয়ে দিলেন। তা ছাড়া লাইফ কেয়ার হসপিটাল যে কখনো কলঙ্ক মুক্ত হয়ে দ্বিতীয় বার টপ লেভেলে পৌঁছাতে পারবে এমন সম্ভবনা তিনি দেখেন না।
তাই বেশি কিছু না ভেবে তৈমুরের শর্তে রাজি হয়ে যান।
উভয়পক্ষ এগ্রিমেন্টে সাইন করে। তৈমুর এগ্রিমেন্টের একটা কপি রেখে ওপরটা ডঃ জাহাঙ্গীর কবিরের হাতে তুলে দেয়।
*******

চলবে,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব ১২
মৌমো তিতলী
🫶

সুন্দরবনের ট্যুরিস্ট এলাকা ঘুরে ঘুরে স্টুডেন্টরা অনেক অজানা গাছপালা আর পশুপাখি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। যা তাদেরকে এই এডুকেশনাল ট্যুরের অ্যাসাইনমেন্ট কম্পিলিট করতে সহায়তা করবে। সারা এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য নিজের মুঠোফোনে ফোনে ক্যাপচার করতে থাকে। সামিরা ভীষণ সেলফি প্রিয়। সে সুন্দর সুন্দর ভিউ দেখে নিজের ছবি তুলতে ব্যস্ত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। টিচার্সরা সব স্টুডেন্টদের কাছাকাছি থাকতে বলে। কেউ যেন ট্যুরিস্ট এরিয়া ছেড়ে বের না হয় সে বিষয়ে কঠোর সাবধান করেছেন। দিনের বেলায় ঝলমলে সূর্য শিখার আলোয় আলোকিত সুন্দরবন দেখতে যতটা মনোরম রাতের অন্ধকারে ততটাই অশান্ত।
কখন কোন হিংস্র পশুর আগমন ঘটে বোঝা দায়।
সারা ছবি তোলার বেখেয়ালে কিছুটা দূরে জঙ্গলের ভেতর চলে যাওয়ায় স্যারদের সতর্কবার্তা শুনতে ব্যার্থ হয়। সে ছবি তুলতে তুলতে দল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে তা তার অগোচরেই রয়ে গেল।
সামিরা টিচার্সদের বার্তা শুনতে পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে সারাকে খোঁজ করে ভিড়ের মধ্যে। আসেপাশে সারাকে দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে যায় সামিরার। ছবি তোলা বন্ধ করে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। নিজের কলেজের সবাই এক সাথেই দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আসেপাশে আরো অনেক মানুষের অবস্থান। সামিরা নিজ টিমের ভেতরে সারাকে খুঁজে না পেয়ে আসপাশ টাও খোঁজে। কিন্তু সারাকে কোথাও না পেয়ে আঁতকে ওঠে সামিরা। ঝটপট ফোন বের করে কল লাগায় সারার নম্বরে। রিং হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না দেখে আরো ভয় পেয়ে যায়। কয়েকবার কল করার পরেও সারাকে ফোনে না পেয়ে কপালে চিকন ঘাম দেখা দেয়। ভয়ে শরীর কাঁপতে লাগলো সামিরার। সামিরা দৌড়ে যায় টিচার্সদের দিকে। প্রিন্সিপাল স্যারকে গিয়ে জানায় সারাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। সারার ফোনটাও রিসিভ হচ্ছে না। “সারা নিখোঁজ” খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না মোটেই। আব্র খবরটা শুনেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে আসে সামিরার দিকে। এদিকে সামিরা কেঁদে দিয়েছে প্রান প্রিয় বান্ধবীকে না পেয়ে।
আব্র সামিরার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে,,,

:- সামিরা তুমি সারা কে শেষবারের মতো কখন আর কোথায় দেখেছিলে?

সামিরা হিচকি তুলে কাঁদছে। আব্রর প্রশ্নে কিছুটা সামলে জবাব দেয়,,,

:-ভাইয়া আমি আর সারা একসাথেই ছিলাম। আধা ঘন্টা আগেও আমার পাশেই ছিলো। ও প্রকৃতির ছবি তুলতে ব্যস্ত দেখে আমি ওকে ডিস্টার্ব করিনি। আমিও নিজের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ওর কোন সাড়া না পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি সারা সেখানে নেই। আমি আমাদের টিম ছাড়াও আসপাশেও খুঁজেছি। কিন্তু সারা কোত্থাও নেই। ওকে ফোন করেছি অনেকবার। রিং হচ্ছে কিন্তু সারা কল রিসিভ করেনি। সারার কোন বিপদ হয়নি তো ভাইয়া!! আবারো ঝরঝর করে কেঁদে দেয় সামিরা।

সামিরার থেকে সবটা শুনে দু হাতে নিজের চুল খামচে ধরে আব্র। এবার চিন্তায় হৃদয় শঙ্কিত হয়ে ওঠে। চারদিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। কোথায় পাবে এখন সারাকে। নিজের ওপরেও ভীষণ রাগ হয় আব্রর। এমনি সময় তো আজ সারাদিনই সারার থেকে চোখ সরেনি‌ আর যখনই একটু চোখের আড়াল হলো তখনই সারা তার থেকে হারিয়ে গেল।সারার যদি সত্যিই কোন বিপদ হয় সেই চিন্তায় মাথা খারাপ হচ্ছে আব্রর।

এদিকে প্রিন্সিপাল স্যার পড়েছেন মহা বিপদে। তার আসল চিন্তা তৈমুর জাহান শিকদার। ট্যুরের ব্যাপারে জানতে পেরে প্রথমেই কলেজে এসে সারার ট্যুরে যাওয়া নিয়ে আপত্তির সুর তুলেছিলো তৈমুর। কোনভাবে ট্যুরে না গিয়ে এই অ্যাসাইনমেন্ট টা কমপ্লিট করা যাবে কিনা জানতে চাইলে প্রিন্সিপাল স্যারই তৈমুর কে বলেছিলেন মিঃ শিকদার ওভার প্রটেকটিভ হচ্ছে সারার প্রতি। যেটা ওর প্র্যাকটিক্যাল এডুকেশনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি এই ট্যুরের গুরুত্ব আর স্টুডেন্টদের প্রাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্স সম্পর্কে বড়সড় লেকচার দিয়েই তৈমুর কে রাজি করিয়েছিলেন। আর এটাও বলেছিলেন সব স্টুডেন্টদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তিনি নিজে নিবেন।
আসার আগেও তৈমুর বার বার করে বলেছিলো সারা এই প্রথমবার আপনজনদের ছাড়া একা বের হচ্ছে। ওর দিকে যেন বিশেষ করে খেয়াল রাখা হয়।
এখন বেচারা প্রিন্সিপালের অবস্থা নাজেহাল। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয় কথাটা যেন তিনি এই মুহূর্তে অনুভব করতে পারছেন।
শেষে কিনা সারার সাথেই এমনটা হতে হলো!! এক সারা নিখোঁজ সেই চিন্তা, তার ওপর তৈমুর শিকদারের খওফ!! প্রিন্সিপাল স্যারের বিপির পারদের মাত্রা ছাড়ালো মুহুর্তেই।
হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়তেই অন্যসব টিচার্স রা তাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। আব্র অস্থির হয়ে প্রিন্সিপাল স্যারকে বলল,,

:- দিস ইজ টু মাচ স্যার! আপনি এখনো এভাবে বসে থাকবেন হয় পুলিশের খবর দিন। নয়তো আমাদেরকে জঙ্গলে ঢুকে ছাড়া কে খুঁজতে দিন।

প্রিন্সিপাল স্যার কোন মতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,,,

:- এটা তুমি কি বলছো আব্র! আমার এক স্টুডেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তোমরাও এখন জঙ্গলে যাবে বলছো? অসম্ভব এই অনুমতি আমি দিতে পারবো না।
পুলিশের খবর দাও। তৈমুরজাহান সিকদার জানতে পারলে কি অবস্থা হবে সেটা ভেবেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

তৈমুর জাহান শিকদারের কথা উঠতেই সামিরার টনক নড়ে। ঝটপট সেখান থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন টা বের করে কল লাগায় তৈমুর কে। প্রিন্সিপাল স্যার যতই বলুন তৈমুরকে জানানোটা প্রয়োজন মনে করে সামিরা।

*****
শিকদার হাউস!

শিকদার বাড়ির সকলেই ডিনারের জন্য খাবার টেবিলে উপস্থিত। আজ তৈমুর তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। অফিসে কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও আজ অদ্ভুত একটা অস্থিরতায় কাজে মনোযোগ দিতে পারেনি তৈমুর। বার বার সারার কথা মনে পড়েছে‌। মেয়েটা কি করছে না করছে তা অবশ্য বার বার ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু বিকেলের পর আর ডিস্টার্ব করেনি। হয়তো এতোবার ফোন করাতে বিরক্ত হতে পারে সারা। বেড়াতে গেছে, অভিজ্ঞতা নিতে গেছে। থাকুক কিছুটা নিজের মতো।
রিনা শিকদার ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দেন। সাইফ শিকদার খেতে খেতে বলেন,,,

:-আজ সারাদিন বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সারা মা না থাকলে বাড়িটা শূন্যই মনে হয়।

তুলি মাথা দুলিয়ে বলে,,,

:-আই এগ্রি বাবা! সত্যিই সারা সারাক্ষণই বাড়িটা মাতিয়ে রাখে। আজ একদিন ও বাড়িতে নেই তাতেই কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে বাড়িটা।

সারাকে নিয়ে সবার এতো ভালোবাসার ছড়াছড়ি কিছুটা ন্যাকামো লাগে লুবানার কাছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,,

:-আঙ্কেল! একটা কথা বলি,সারা তো তোমাদের বাড়ির মেয়ে না! রিনা শিকদারের দিকে তাকিয়ে বলে,,প্লিজ কিছু মনে করবেন না আন্টি! আমি জানি সারা আপনার বোনের মেয়ে কিন্তু সে তো এবাড়িতে আশ্রিতা। তোমরা সবাই সারাকে ভীষণ ভালবাসো বুঝতে পারছি কিন্তু সবাই ওকে এতোটাও নিজেদের সাথে এটাস্ট করে নিও না।

লুবানার কথা শুনে সবাই ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অপ্রস্তুত হেসে বলে,,

:-না মানে তোমরা সবাই সারাকে এতটা ভালোবাসো, কিন্তু সারাতো সারাজীবন এবাড়িতে থাকবে না। সারা যখন বিয়ে হয়ে এবাড়ি থেকে চলে যাবে, তখন তোমাদের আরো বেশি খারাপ লাগবে তাই বলছিলাম আর কি!!

রিনা শিকদার লুবানার কথায় হেসে বলেন,,,

:-বাড়ির মেয়েরা বিয়ে হয়ে শশুর বাড়ি চলে গেলে সব পরিবারের মানুষদেরই একরকম কষ্ট হয়। এইতো আমাদের বাড়ির মেয়ে তুলি,রেশমী। ওদের বিয়ে হলে, শশুর বাড়ি চলে গেলে আমাদের যেমন খারাপ লাগবে তেমন সারাকেও আমরা আমাদের বাড়ির মেয়েই মনে করি। তাহলে তুলি রেশমীর বিয়ে,বিদায় মেনে নিতে পারলে সারারটা কেনো পারবো না? আর কমই বা ভালোবাসতে যাবো কেনো? হতেও তো পারে সারা সারাজীবন এবাড়িতেই থাকলো।

মায়ের কথায় তৈমুরের বিষম লেগে গেলো!! খাবার তালুতে উঠে কাশতে লাগলো তৈমুর। রিনা শিকদার ছেলের মুখে পানির গ্লাস তুলে ধরেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,,,

:-খাবার সময় এখন কে আমার ছেলেটার নাম নিচ্ছে কে জানে!!

সাইফ শিকদার স্ত্রীর কথা শুনে বলেন,,,

:-আহ রিনা! কতবার বলেছি এসব কুসংস্কার মানবে না। কোন কথা শোন না তুমি।

তৈমুর স্থির হয়ে বসতেই তার স্বরে বেজে ওঠে তৈমুরের ফোন। কপাল কুঁচকে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে সামিরার নাম ভাসতে দেখে অবাক হয়। সকালে তৈমুর সামিরা কে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিলো কোন সমস্যা বা প্রয়োজন হলে যেন তাকে কল করে। এই তো শুধুমাত্র কয়েক ঘন্টা সারার সাথে যোগাযোগ হয়নি,এর মধ্যে সামিরা কেন কল দিলো!! কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিলো তৈমুরের। অশান্ত হয়ে উঠলো হৃদয়। ফোন রিসিভ করতেই সামিরার ক্রন্দনরত কন্ঠ শুনে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে তৈমুর,,,

:-হ্যালো সামিরা!! হোয়াট হ্যাপেন! সারা কোথায়? কাঁদছো কেন তুমি?

এদিকে তৈমুরের কথায় খাবার টেবিলে উপস্থিত সকলের কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে তৈমুরের দিকে।

:-সামিরা কিছু বলছো না কেনো? কোথায় সারা?

ওপাশ থেকে সামিরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

:- ভাইয়া সারাকে প্রায় এক ঘন্টা ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আসেপাশে সবখানেই খোঁজা হয়েছে কিন্তু সারা কোত্থাও নেই। প্রিন্সিপাল স্যার পুলিশকে ইনফরম করেছেন। কিন্তু আমার ভীষণ ভয় করছে। নিশ্চয় সারা কোন বিপদে পড়েছে। ওকে আমি…..

সামিরার সম্পুর্ন কথা না শুনেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তৈমুর। পরপর কল করে সারার নম্বরে। কিন্তু কল আউট অফ রিচ দেখায়! তৈমুর খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে। সাইফ শিকদার উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চান কি হয়েছে?
তৈমুর গাড়ির চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে বলে এখন সময় নেই,এসে সবটা জানাবে। হন্তদন্ত বেরিয়ে যায় তৈমুর, পেছনে ফেলে যায় শিকদার বাড়ির প্রত্যেকটা চিন্তিত সদস্যদের কে।

তৈমুর গাড়ি পার্কিং লট থেকে বের করতে করতে কল লাগায় সায়ানকে। ডিনারের পর স্টাডি টেবিলে কিছু পড়াশোনা করছিল সায়ান। এই সময় তৈমুরের ফোন আসলে ফোনটা কানে ধরতেই তৈমুর জানায় এক্ষুনি তাদেরকে সুন্দরবন যেতে হবে। সায়ান তৈমুরের কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারে মামলা নিশ্চয়ই সিরিয়াস। বিনা বাক্যব্যয়ে গায়ে একটা শার্ট চড়িয়ে বাসা থেকে বের হয় সায়ান। দু মিনিটেই সায়ানের বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয় তৈমুর। সায়ান গাড়িতে উঠতেই তা চলতে শুরু করে। সিটবেল্ট লাগাতেই তৈমুরের দিকে তাকায় সায়ান। অদ্ভুত ভাবে ঘামছে তৈমুর। স্টিয়ারিং রাখা হাত দুটোও অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। এরকম নাজুক অবস্থায় তৈমুরকে এর আগে কখনো দেখেনি সে।
সায়ান। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে তৈমুর কে,,,

:-হোয়াট হ্যাপেন তৈমুর? হঠাৎ সুন্দরবন কেনো? পরপর কিছু একটা মনে পড়তেই বলে,,

:-এক মিনিট! আজ সকালেই তো ছোট্ট ভাবির কলেজ থেকে সুন্দরবনে ট্যুরে গেল। সেখানে কিছু,,, তৈমুর কি হয়েছে? ছোট্ট ভাবি ঠিক আছে তো?

তৈমুরের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ করছে। কিছু একটা হারানোর ভয়ে কন্ঠরোধ হয়ে আসছে যেন। সায়ানের প্রশ্নে কোনরকম জবাব দেয়,,

:-সারাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সায়ান। তাও প্রায় গত দেড় ঘন্টা ধরে।

তৈমুরের কথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটলো যেন, আর্তনাদ করে উঠলো সায়ান,,,
:-হোয়াট!! খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি!!

:-জানি না, জানি না আমি কিচ্ছু জানি না।

তৈমুরের কথায় সায়ান স্পষ্ট বুঝতে পারে তৈমুরের ভেতরের অবস্থা!! এই মুহূর্তে তৈমুর ড্রাইভ করলে ব্যপারটা আরো রিস্কি হয়ে যাবে। সায়ান জোর করে তৈমুর কে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থামলে সায়ান গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। রাতের ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির স্পিড ১০০তে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

তৈমুর কল লাগায় প্রিন্সিপাল স্যার রেজাউল করিম কে।
এদিকে প্রিন্সিপাল স্যার মাথায় আইসব্যাগ চেপে বসে আছেন ।
পুলিশ ফোর্স জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করেছে ১০ মিনিট আগে। আশেপাশেও পুলিশ ফোর্স খোঁজাখুজি করছে। এই মুহূর্তে তৈমুরের কল আসা করেননি তিনি। তৈমুরকে কল করতে দেখে কাঁপতে লাগলেন প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম। হাত পা অসাড় হয়ে আসলো যেন। তৈমুরের কল পেয়েই বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই খবরটা তার কানে চলে গেছে। আগে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হন তারপর এই বেইমানি টা কে করল বের করে ছাড়বেন তিনি,,,, আপাতত তৈমুর শিকদারকে ঠান্ডা করা দরকার।

ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই তৈমুরের হুঙ্কার কানের নিচে ধাক্কা খায়। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নেন তিনি।

:- মিঃ শিকদার আপনি শান্ত হন। দেখুন!!

এদিকে তৈমুরের রাগে মস্তিষ্ক দপদপ করছে। কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে ক্রোধের তাড়নায়।
প্রিন্সিপালের কথায় চিৎকার করে ওঠে তৈমুর,,,,

:-শান্ত হবো মানে? আপনি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন? আমি আপনাকে বলেছিলাম মিঃ রেজাউল করিম। তখন আপনি বড় বড় লেকচার দিয়েছিলেন। দায়িত্ব যখন পালন করতে পারেন না তখন দায়িত্ব নিতে গেলেন কেন? আই সোয়্যার! সারার যদি এতোটুকুও ক্ষতি হয়, আপনার প্রিন্সিপালগিরি আমি ছুটিয়ে দেব।রাগে ফোন কাটে তৈমুর। নয়তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাংলা গালাগাল ঝেড়ে দিতো!

তৈমুরের হুমকিতে গলা শুকিয়ে আসে প্রিন্সিপালের।কান থেকে ফোন নামিয়ে নিয়ে বিড়বিড় করেন তিনি,,,,

:-উফফফ টেনশন টেনশন!! এতো ডেঞ্জারাস লোক আমি বাপের জন্মে দেখিনি। আল্লাহ!! মেয়েটাকে সহিসালামত ফিরিয়ে দাও। নয়তো দেখা যাবে মিস্টার শিকদার এই সুন্দরবনের জঙ্গলেই ফেলে আমার অপারেশন করে ছাড়বেন।

এদিকে জঙ্গলের ভেতরে পুলিশ ফোর্স খোঁজাখুঁজি করতে করতে একটা লেডিস ব্যাগ খুঁজে পাই। সেটাই নিয়ে এসে কলেজ টিমকে দেখালে ব্যাগটা চিনতে পারে সামিরা। ব্যাগটা সারারই। এবার কপালে আরো বেশি চিন্তার ভাঁজ পড়ে সকলের। এদিকে সামিরা কেঁদে চলেছে। পাশেই সারার ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আব্র। চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত লাগছে ছেলেটার।
রাত বারোটার আগেই স্পটে পৌছাই তৈমুর,সায়ান। প্রায় চার ঘন্টার রাস্তা ২ ঘন্টা ৩৫ মিনিটে বলতে গেলে হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে এসেছে সায়ান। এই সময়টাও বেশি মনে হয়েছে তৈমুরের নিকট।

গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে আসে তৈমুর। তৈমুরের উপস্থিতি আরো আতঙ্কিত করে তুললো সকলকে। আব্রও অবাকের চুড়ান্তে পৌঁছে যায়। ভাবে, ডঃ শিকদার এইটুকু সময়ে এখানে কি করে আসলেন!!
তৈমুর কে সবটা জানালে আব্রর থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নেয় সারার ব্যাগটা। জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই পুলিশ ফোর্সে বাধা দেয়। এরিয়াটা নিরাপদ নয় তারওপর রাত। নিরাপত্তা ছাড়া এভাবে তারা কাউকে জঙ্গলে ঢুকতে দেবেন না বলে জানান।

রাগে আরো হুঙ্কার দিয়ে ওঠে তৈমুর। চোখ দুটোতে ছড়িয়ে আছে রক্তিম আভা। এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর লাগছে তাকে। সায়ান কোনরকম শান্ত করে তৈমুর কে।

তৈমুরের Desperation দেখে সবার মনেই প্রশ্ন জাগে, এই Desperateness শুধুমাত্র কাজিনের জন্যই নাকি অন্য কিছু!!

চলবে,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব,,,১৩
মৌমো তিতলী
🫶

ভ্যাপসা গরমে গুমোট অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সারা। একটা পুরনো হলুদ রঙা গামছা দিয়ে মুখটাও বাঁধা। কিছু চুল উস্কো খুস্কো হয়ে মুখের সামনে ঝুঁলে আছে। গরমে ঘামে ভিজে বেহাল দশা। ভালোভাবে চোখ মেলে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো সারা। মাথায় চিনচিনে ব্যথা করছে। মুখ, হাত-পা বাঁধা থাকায় ঠিকমতো উঠে বসতে পারলো না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করে মনে করার চেষ্টা করলো কি ঘটেছিল তার সাথে।
সন্ধ্যায় ট্যুরিস্ট স্পটে প্রকৃতির ছবি তুলতে তুলতে কখন সে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো বুঝতে পারেনি। একটা গাছে ফুটে থাকা চমৎকার বুনো ফুল দেখে তার ছবি তোলার চেষ্টা করছিলো সে। হঠাৎ পেছন থেকে হিস-হিস শব্দ ভেসে আসে। শব্দ শুনে তা অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় সারার। ইয়া বড় মোটা একটা সাপ তার দিকে হাঃ করে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সাপটা দেখেই চিৎকার করে ওঠে সারা। দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড় দেয় সারা। ভয় পেয়ে পালাতে গিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে কাঁধের ব্যাগটা পড়ে যায়। ফোন টাও ছুটে যায় হাত থেকে। পালাতে গিয়ে খেয়াল করে না সে জঙ্গলের আরো গভীরে চলে গেছে।
ততক্ষণের দিনের আলোর পাট চুকিয়ে আদিত্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। আবছা আলোয় সারা যখন বুঝতে পারে সে লোকালয় ছেড়ে একা দুরে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে তখন ভয় পেয়ে যায়। রাত নামতেই চারদিক থেকে বিবিধ হিংস্র পশুর গর্জন ভেসে আসতে থাকে। ভয়, উদ্বেগ ,চিন্তায় সারার তখন হাত পা কাঁপতে থাকে। অসহায় হয়ে কাঁদতে থাকে সারা। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক পাগলের মতো রাস্তা খুঁজতে থাকে। রাস্তা না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে বসে মুখ চেপে ধরে কাঁদতে থাকে সারা। জাহানকে ভিষণ মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। হঠাৎ সামিরার কথা মনে পড়ে….সে তো তাদের টিমের সাথেই ছিলো,এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পেরেছে স্টুডেন্টদের সে মধ্যে মিসিং। নিশ্চয় সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। জাহান ভাইয়ার কাছেও কি এতক্ষণ খবর চলে গেছে? বাড়ির সকলে নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে।
মাথায় নানা দুশ্চিন্তা ঘুরতে থাকে।কি করবে বুঝতে পারে না সে। জীবনে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি সারা। এই গভীর অন্ধকার জঙ্গলে হিংস্র পশুদের গর্জনে ভয়ে তটস্থ অসহায় সারার যেন একটা একটা মুহূর্ত মৃত্যুসম মনে হয়। হঠাৎ কিছুটা দূরে এক চিলতে আলো দেখতে পায় সারা। আসেপাশে মানুষের অস্তিত্ব পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। আলো অনুসরণ করে কিছুটা এগিয়ে যেতেই চাপা কান্নার আওয়াজ শুনে পা থমকে যায় সারার। কৌতুহল নিয়ে একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। নিজের বিপদ ভুলে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে কান্নার আওয়াজ কোথা থেকে আসছে। তার সামনেই কিছুটা ফাঁকা জায়গায় একটা বড় কন্টেইনার পরিবহন দাঁড়িয়ে আছে। কন্টেইনারের গায়ে আর্মিদের ড্রেসের মতো ডিজাইন করা। অন্ধকার জঙ্গলে বোঝার উপায় নেই সেখানে কোন বড়সড় গাড়ি দাঁড়ানো থাকতে পারে। কিন্তু এই জঙ্গলে এমন গাড়ি কোথা থেকে আসলো? রাস্তায় বা কোন দিকে! এরা কি সেনাবাহিনীর লোক? তাহলে কান্নার আওয়াজ আসছে কেনো? এমন নানা ধরনের প্রশ্ন সারার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়। ভালোকরে দেখার চেষ্টা করে কি ঘটছে সেখানে। যে দুজন হাতে আলো নিয়ে আসলো তারা গিয়ে কন্টেইনারের গায়ে টুকটুক করে শব্দ করে। কিছুক্ষণ পরেই কন্টেইনারের দরজা খুলে একজন বেরিয়ে আসে। দরজা খুলতেই ভেতরটা দেখতে পায় সারা। ভেতরে পাঁচ ছয়টা মেয়েকে হাত-পা মুখ বেঁধে রেখেছে। তাদেরই চাপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলো সারা। এখানে কি ঘটছে বুঝতে বেগ পেতে হয় না সারার। এরা নিশ্চিত মেয়ে পাচারকারী। আতঙ্কে মুখ দিয়ে অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে আসে সারার। মুখে হাত চেপে ধরে সারা। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল। জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীদের থেকে পালাতে গিয়ে শেষে কিনা পাচারকারীদের মুখে এসে পড়লো!! পালাতে হবে,যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। ভেবেই পেছনের দিকে এক পা এক পা করে পেছাতে থাকে সারা। কিন্তু বিধিবাম। অন্ধকারে কোন একটা বুনো লতার সাথে পা বেজে পড়ে যায় সারা। সাথে সাথে শুকনো পাতার মরমর আওয়াজ সাথে সারার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অস্ফুট আর্তনাদ। আর সেই শব্দ সেখানে উপস্থিত লোকদের কানে পৌঁছে যেতে সময় লাগে না।

আসেপাশে মানুষের অস্তিত্ব টের পেতেই সতর্ক হয়ে যায় পাচারকারী লোকেরা। তিনজনের মধ্যে যে ওস্তাদ যে সে গলা হাঁকায়,,,,

:- এই জাকির! শব্দ আইলো কই থেইকা?

বাকি দুজনের মধ্যে লিকলিকে টাইপের একটা ছেলে বলে,,

:- কইতে পারি না ওস্তাদ! তয় শব্দডি মুইও হুনছি।

:- শা*লা হুনছোস যহন খাড়াইয়া আছোস ক্যান? দেখ গিয়া ! কোন হালায় আবার আমগো ঢ্যারার খবর পাইলো।
ধমকে ওঠে ওস্তাদ লোকটা।

জাকির নামের ছেলেটা এগিয়ে আসতে থাকে সারা যেদিকে ছিলো সেদিকে।
সারা পড়ে যাওয়ার ফলে পায়ে কিছুটা আঘাত পায়। পা টেনে টেনে কিছুটা দূরে গিয়ে গাছের আড়ালে বসে। অন্ধকারে আসেপাশের কিছুই দেখতে পায় না। আধারের মাঝেই হাতড়ে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করে আসপাশটা। কিছুক্ষণ পরেই নিজের খুব কাছেই কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে আঁতকে ওঠে। তবে কি সে পাচারকারীদের চোখে পড়ে গেল!! মুখ চেপে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে সারা।
জাকির ছেলেটা হাতের মুঠোয় ধরা ফোনের আলো জ্বেলে আসপাশটা দেখে। কাউকে দেখতে না পেয়ে পেছন ফিরে চলে যেতে নিলেই হালকা আলোয় চিকচিকে কিছু একটা দেখতে পায়। সেদিকে এগিয়ে যেতেই সারাকে দেখে ফেলে ছেলেটা।
সারা ধরা পড়ে গিয়ে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। কোনমতে উঠে দৌড়ে পালাতে নিলে জাকির সারার হাত ধরে ফেলে। নাজুক সারা তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ছেলেটা তার কোমরে বাঁধা গামছা দিয়ে সারার হাত বেঁধে দেয়। তারপর হাতে একটা ধারালো চাকু নিয়ে সারার গলায় ধরে বলে,,

:- ওই ছেমড়ি চুপ!! চেচাইলে গলা নামাইয়া দিমু কইলাম।

আগে থেকেই ভয়ে, ক্লান্তিতে দূর্বল হয়েছিল সারা। কিন্তু এই মুহূর্তে চিৎকার করার শক্তিটুকুও হারালো। অতিরিক্ত ভয়ে প্যানিক হয়ে সেখানেই জ্ঞান হারায় সারা।

এরপর কতক্ষন পরে তার জ্ঞান ফিরেছে বুঝতে পারে না সারা। তবে এটুকু বুঝতে পারে ভয়াবহ এক ফাঁদে আটকা পড়েছে সে‌। যেখান থেকে হয়তো আর কখনো আপনজনদের কাছে ফিরতে পারবে না সে।দেখতে পাবে না প্রিয় মুখগুলো। আর দেখতে পাবে না কঠোর সুদর্শন অ্যারোগেন্ট সেই মানুষটাকে। দুচোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ফর্সা তুলতুলে নরম গাল বেয়ে।

আসেপাশে চোখ ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে সে। ছোটখাটো স্টোর রুমের মতো একটা কামরা। দেয়ালের অনেক জায়গায় রং চটে গিয়ে খসে পড়েছে। কয়েকটা ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল পড়ে আছে। আর তেমন বিশেষ কিছুই নেই ঘরটায়। হঠাৎ খেয়াল আসে রাতের দেখা সেই মেয়েগুলো কোথায়!! তাদের কি পাচার করে দিয়েছে? তাহলে কি তাকেও,,,, না না তাকে পাচার করে দিলে তো মেয়েগুলোর সাথেই থাকতো। পাচার যদি না হবে তাহলে এভাবে আলাদা কেনো রেখেছে তাকে?কি করবে তারা সারাকে নিয়ে ?
দুমিনিট বাদেই দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় সারা। রোগা পটকা একটা লোককে দেখতে পায়।সারাকে চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে লোকটা। ঠাট্টা সুরে বলে,,

:- কি মাইয়া হুস আইছে তয়!!

সারা কিছু বলতে চায়! মুখ বাঁধা থাকায় উমম উমম ছাড়া শব্দ বের হয়না।
লোকটা আবারো গা জ্বালানো হাসির দেয়। বলে,,

:- কিছু কইবা? তয় একটু অপেক্ষা করো। ওস্তাদ অহনি আইবো। আইলে মুখ খুইলা দিবো।

সারা ছটফট করে উঠলো। আবারো উমম উমম করে কিছু বলতে চায়।
তখনই আরো দুজন লোক দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। দুজনের মধ্যে একজন রোগা পটকা লোকটাকে সুধায়,,,

:-কিরে জাকির খবর কি!

রোগা ছেলেটায় জাকির যে কাল রাতে সারাকে ধরে নিয়ে এসেছিলো। ওস্তাদের প্রশ্নে বিগলিত হয়ে জবাব দেয় জাকির,,

:-মাইডার জ্ঞান ফিরছে ওস্তাদ! মনে অয় কিছু কইতে চাই!

:-মুখ খুইলা দে। দেহি কি কইবার চায়।

জাকির ছেলেটা ঝটপট গিয়ে সারার মুখের গামছা টা খুলে নেয়। এতক্ষণ বাঁধা মুখ খোলা পেতেই আগে হা করে শাঁস নেয় সারা। হাঁপিয়ে গেছে মেয়েটা। গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেছে। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলে,,

:-পানি… পানি!!

ওস্তাদ লোকটা জাকির ছেলেটাকে বলে পানি দিতে। জাকির একটা বতলের মুক্কা খুলে এগিয়ে দেয় সারার মুখের দিকে। হাত বাঁধা থাকায় সেভাবেই কিছুটা পানি গলাধঃকরণ করে সারা। সেই ভয়াবহ ঘটনার পর কতক্ষন কেটেছে ঠিকঠাক বুঝতেও পারছে না পারা। তবে রুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা সূর্যের আলো দেখে বুঝতে পারে এখন দিন। নিজের টিমকে ছেড়ে পুরো একটা রাত কেটে গেছে ভাবতেই বক্ষ পিঞ্জরে বেদনা অনুভব করে সারা। আল্লাহ জানে তাকে না পেয়ে সবাই কি করছে এখন। আচ্ছা জাহান ভাইয়া কি খুঁজছে তাকে? কি করছে সে এখন? চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে আসে সারার। অনেক্ষণ ধরে না খেয়ে থাকার ফলে প্রেসার ফল করছে হয়তো‌।

ওস্তাদ লোকটা সারার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,,

:-ওই মাইয়া কাইল রাইতে জঙ্গলে কি করতে গেছিলি? তুই কি মিডিয়ার লোক? কোন গোপন ক্যামেরা আছে নি তর কাছে?

চোখ টেনে খোলে সারা। দু পাশে মাথা দুলায়। না বোঝায়।

ওস্তাদ লোকটা আরেকজন লোককে বলে,,

:-অই মুকুল দেখতো চেক করে কোন ক্যামেরা আছে কিনা।

এতক্ষণ ধরে মুকুল লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সারার দিকে। সারার সুন্দর পুতুলের মতো মুখ আর লতানো শরীরটায় চোখ পড়েছে সেই রাতেই। শুধু ওপর মহল থেকে কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকায় কোন মেয়ের সাথে নিজের কুতৃষ্ণা মেটাতে পারে না তারা। শুধু দুর থেকে নয়নসুখ নিয়েই নিজেকে সামলে রাখতে হয়। তবে ওস্তাদের আদেশে সারাকে একবার ছুঁয়ে দেখার লোভ তরতর করে বেড়ে যায় মুকুলের। দ্রুত পায়ে সারার দিকে ছুটে যায়। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে নিলেই চিৎকার করে ওঠে সারা।

:- প্লিজ,, ছুঁবেন না আমায়। সরে যান…সরে যান আমার থেকে। আমার কাছে কোন ক্যামেরা নেই। আমি প্রেসের কেউ নই। রাতে জঙ্গলের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে ছুঁবেন না প্লিজ।

ওস্তাদ লোকটা থামতে বলে মুকুলকে। হাতের এতো কাছে পেয়েও নিজের খায়েশ মেটাতে না পেরে মনে মনে নোংরা গালি দেয় মুকুল।

জাকির এগিয়ে এসে ওস্তাদ কে উদ্দেশ্য করে বলে,,,

:-ওস্তাদ মাইয়ার কাছে কিছু নাই। হেই সত্যেই কইতাছে লাগে। আর থাকলেই বা কি! হেই তো এখন আমগো হাতে বন্দি। মাইয়া কইলাম ফরীর লাহান। কইতাছি ওস্তাদ হেরেও বাকিদের লগে দিয়া দ্যান। সুন্দর মাল,ম্যালা ট্যাকা আইবো এর বদলে।

ওস্তাদ লোকটা জাকিরের পিঠ চাপড়ে সাবাসী দেয়।

:-হাছা কইছস জাকির! তুই আমার যোগ্য সাগরেদ। তর প্রমোশন পাক্কা কইলাম।

জাকির বিগলিত হয়ে বলে,,

:-আপনের দয়া ওস্তাদ!

ওস্তাদ লোকটা মুকুলকে ডেকে বলে,,,

:-তুই এক কাম কর!! এই মাইয়াডা সলিড কইরা পাডাইতে হইবো। তুই গিয়া কিছু খাবার কিন্না আন। আর গঞ্জে আমগো লোক আইবো,ডেরাগ সাপ্লাই দিতে। ওইডাও লইয়া আসিস। মাল সাপ্লাই দেওনের সময় এগোর শইলে ডেরাগ দিতে কইতে বস। কোন রিস্ক নেওন যাইবো না।

মুকুল জাকিরের প্রমোশনের কথা শুনে এমনিতেই হিংসায় জ্বলছিলো তারওপর ওস্তাদের আদেশে মনে মনে গালাগালি দিয়ে মনের রাগ মেটায়। ভাবে,,,
হক্কল কাম আমারে দিয়া করাইয়া গোলামের পুত প্রোমোশন দেয় আরেকজন রে!! হালার কুত্তার বাচ্চা!

***********

বাগেরহাট থানার এসআই নিজাম উদ্দিন তার ফোর্স এবং তাদের সাথে স্বয়ং তৈমুর জাহান শিকদার কাল সারা রাত এবং আজ সকাল ১০ টা পর্যন্ত জঙ্গলে আঁতিপাঁতি খুঁজেও সারার কোন হদিস পায়নি। খোঁজ এখনো পর্যন্ত জারি রাখা হয়েছে। তবে সারার ফোনটা পাওয়া গেছে। ফোনে সামিরা,তৈমুরের ফোনের ঝড়। ফোন বেজে বেজে চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আপাতত ফোনটাও তৈমুরের কব্জায়। সারার ব্যাগ আর ফোনটা হাতে নিয়ে উদাস হয়ে গাড়ির বোনেটের ওপর বসে আছে তৈমুর। সায়ান পাশেই দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তৈমুরের দিকে নিবদ্ধ। এক সারার জন্য কতটা পাগল এই তৈমুর জাহান শিকদার তা সায়ানের থেকে ভালো কে জানে! সারাকে হারিয়ে তৈমুর যেন পাথর বনে গেছে। শুন্য দৃষ্টিতে সারার জিনিস গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে অপলকে।
সায়ান তৈমুরের কাঁধে হাত রেখে বলে,,,

:-চিন্তা করিস না তৈমুর। ছোট্ট ভাবি কে ঠিক পাওয়া যাবে দেখিস।

তৈমুর চোখ তুলে তাকায় সায়ানের দিকে। রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তৈমুরের দুটো চোখ। কাল সেই বিকেল থেকে এখনো পর্যন্ত চিন্তা, হতাশা আর সারাকে হারিয়ে ফেলার ভয় সবটা মিলে ভীষণ ছন্নছাড়া অগোছালো লাগছে তাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,,,

:-সায়ান চপারের ব্যবস্থা কর!! আমি পুরো সুন্দরবন উজাড় করে হলেও সারাকে চায়! I wants my Sarah at any cost.

সায়ান তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বলে,,

:-কিন্তু এতো দ্রুত চপার কোথায় পাবো!! এখানকার এয়ার পোর্টে তো আমাদের যোগাযোগ নেই!

:-I don’t want to hear any excuses. I need a chopper right now.!!

:-আচ্ছা আচ্ছা তুই শান্ত হ! আমি দেখছি!
সায়ান ফোনটা বের করে কাউকে কল করতে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। হুট করে সামনে তাকাতেই পরিচিত কাউকে দেখে কপাল কুঁচকে যায়। বিড়বিড় করে সায়ান,,,

-এটা এটা লাইফ কেয়ার হসপিটালের ওয়ার্ড বয় মুকুল না!! এ এখানে কি করছে! সাথের লোকটায় বা কে! কি হ্যান্ডোভার করলো লোকটা? এমন চোরের মতো হাবভাব করছে! Surely there is some noise.,,,সায়ান কিছুটা এগিয়ে একটা দেয়ালের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের কিছু কথোপকথন কর্ণগোচর হয় সায়ানের,,,

:-আরে কাইল রাইতে পাওয়া মাইয়াটা হেব্বি। হালার ওপর মহলের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে কাল রাতটা স্বপ্নের লাহান কাটতো।
:-কস কি!! তোর তো মাইয়া দেখলেই জিহ্বায় লালা ঝরে। থাকিস ক্যামনে?

:-আরে ভাই কইসনা। বসের আদেশ একটা মাইয়াও যেন দাগি না হয়! এক্কেরে ফেরেস মালের দাম বেশি। কাইল তো আট দশটা মাইয়া লইয়া আইতাছিলো। এই মাইয়া নাকি রাস্তা হারাইয়া আইছিলো! হালার সবই কপাল! দে দে…তুই ডেরাগ লইয়া আইছোস না হেই মোর কাছেই দিতে কইছে ওস্তাদ। মাইয়া গুলানরে ডেরাগ দিয়াই সাপ্লাই দিতে হইবো।

এদের কথা শুনে সায়ান উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে থাকে। কার কথা বললো মুকুল!! আর মুকুল এসব কি বলছে!! সে তো লাইফ কেয়ারে চাকরি করতো!! মেয়ে, ড্রাগস, সাপ্লাই কথাগুলো শুনে তো মনে হচ্ছে পাচারকারীদের সাথে হাত আছে মুকুলের। তাহলে কি লাইফ কেয়ারের বাচ্চা চুরির ঘটনায় আর ডিন স্যারের খুনের সাথেও জড়িত আছে মুকুল? আর কাল রাতে কাকে পেয়েছে? সারা নয়তো!!

সায়ান ফোনটা পকেটে ভরে দ্রুত তৈমুরের কাছে ফিরে আসে। বিষয়টা তৈমুর কে জানালে গাড়ির ওপর থেকে তড়াং করে লাফিয়ে নামে তৈমুর। সায়ানের দেখানো পথে দ্রুত এগিয়ে যেতেই মুকুলকে দেখতে পায়,একটা দোকান থেকে খাবার কিনছে। সাথের লোকটা এখন নেই। সায়ান দ্রুত এসআই নিজাম উদ্দিনকে কল করে জানিয়ে দেয়। তৈমুর সায়ানকে নিয়ে পিছু নেয় মুকুলের।

চলবে,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব,,,১৪
মৌমো তিতলী

আলো আঁধারের লুকোচুরি ঘরটায় ছোট্ট ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা সূর্যের এক ছটা আলোর দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে সারা। বিগত ১৪-১৫ ঘন্টা সে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই এক মহিলা এসে সোজা করে বসিয়ে দিয়েছে সারা কে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে চুপচাপ। মুখটা বাঁধা নেই কিন্তু চিৎকার করারও সাহস নেই মেয়েটার। সকালের লোকগুলো হুমকি দিয়ে গেছে চেঁচামেচি করলে মেরে ফেলবে তাকে।
পরিবারের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। হয়তো সে তাদেরকে আর কোনদিন দেখতে পাবেনা। খালামনির মায়ের মতো আদর-আহ্লাদ, ভালোবাসা, আঙ্কেলের বাবার মতো শাসন, বন্ধুত্ব,তুলি, রেশমীর মতো বান্ধবীসম বোন। ছোট চাচু,ছোট মা কাউকে দেখতে পাবে না।
সব থেকে বেশি মনে পড়ছে যার কথা সে কি তাকে মনে করবে? সেই তো এতো দিন ধরে তাকে সকল বিপদ থেকে আগলে রেখেছে। আজ কি সে তাকে খুঁজবে না? তার কি সারাকে না পেয়ে কষ্ট হবে? আচ্ছা এরা যদি সারা কে সত্যিই আজ পাচার করে দেয়, পরবর্তীতে কি হবে তার জীবনে? বেঁচে থাকার যোগ্য থাকবে তো সে? নানা দুশ্চিন্তায় সারার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল। এসব ভাবতেই ঠোঁটে ফুটে ওঠে তাচ্ছিল্যের হাসি। সে তো তৈমুর জাহান শিকদার,সে কেনো সারাকে মনে করতে যাবে!! সারা তো তার নিজের কেউ নয়। তবুও সারার অবচেতন মন কেনো চাইছে মানুষ টা তাকে খুঁজুক। তাকে এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করে নিয়ে যাক!! এই কঠিন পরিস্থিতিতে তার কথায় কেনো বার বার মনে পড়ছে তার!! ভাবতেই ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেয় সারা!! অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করতে থাকে,,,
:- জাহান ভাইয়া কোথায় আছেন আপনি!! আমার হারিয়ে যাওয়ার খবরটা এতক্ষণে নিশ্চয় শুনেছেন আপনি। আপনি কি আমাকে খুঁজছেন? আপনার কি আমার কথা একবারও মনে পড়ছে না? অশ্রু জলে ছেপে যায় তুলতুলে গাল দুটো।
কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে উঠেছে সারার। নাকটা লাল টমেটো হয়ে গেছে। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে,তবুও তার কান্না থামে না।

এদিকে প্রিন্সিপাল রেজাউল করিম স্যারের অবস্থা আরো বেগতিক। তৈমুর জাহান তাকে হুমকি দিয়েছে,সারাকে না পাওয়া গেলে তাকে কেটে কুটে সুন্দরনের পশুপাখির খাবার বানিয়ে দিবে। বেচারা প্রিন্সিপালের বিপি,সুগার সব হাই হয়ে একেবারে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তিনি এখনো পর্যন্ত হাত পা ছড়িয়ে মাথায় আইসব্যাগ ঠেসে ধরে হাঁপিয়ে চলেছেন। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছেন,,,
:-আল্লাহ এবারের মতো মেয়েটাকে যেন সহি সালামত উদ্ধার করতে পারে,,এ জীবনে আর কখনো স্টুডেন্টদের নিয়ে তিনি ট্যুরে আসার নামও নেবেন না। দরকার হলে তিনি এই প্রিন্সিপাল পদ থেকে ইস্তফা দিবেন।
তার হাঁপানির টান বাড়তে থাকে। পাশে দুজন স্যার দুপাশ থেকে জোরে জোরে বাতাস করে চলেছে!

এসআই নিজাম উদ্দিনের কাছে সায়ানের ফোন আসার পরপরই তিনি তার ফোর্স নিয়ে বাগের হাট বড় বাজারের দিকে রওয়ানা দেন। আব্রও যায় তাদের সাথে। সারার জন্য টেনশনে ছেলেটার মুখটা শুকিয়ে গেছে। মনে মনে প্রে করে চলেছে সারাকে যেন পাওয়া যায়। ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়।

******
ওয়ার্ড বয় মুকুলকে ফলো করতে করতে মূল বাজার থেকে বেশ কিছুটা দুরে,প্রায় জঙ্গলে ঘেরা একটা তিন তলা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায় তৈমুর,সায়ান। মুকুল তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সে আগেই মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে চলে গেছে। পাশেই আরেকটা দ্বিতল ভবনের আড়ালে দাঁড়িয়ে চারদিকে পর্যবেক্ষণ করছে তৈমুর। বিল্ডিংয়ের সামনে কয়েকজন গার্ড স্টেইনগান হাতে পাহারায় নিয়োজিত। আসেপাশেও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। ফটকের ওপরে মেডিসিন ফেক্টরির বোর্ড ঝুলছে। তৈমুরের ধারালো মস্তিষ্ক বলছে ভেতরে ঘাপলা আছে। এখানে প্রবেশ করতে হলে টেড়ামেড়া কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

বিল্ডিংয়ের তিন তলার একটা রুমে একজন মহিলা দুটো বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওস্তাদ সৈকত হামিদ ফোনে কারো সাথে কথা বলছে,,পান খাওয়ার দরুন মুখের দুপাশ থেকে পানের পিক ছড়িয়ে পড়েছে। বা হাতে তা সুপুৎ করে মুছে নিয়ে বলে,,,

:- হ্ বস! আপনে টেনশন লইয়েন না। সব ঠিকঠাক ভাবেই হইবো। মুকুল ডেরাগ লইয়া আইলো বলে,আইলেই মাইয়া গুলানের শইলে ইনজ্যাকশন দিয়া ঢুকাইয়া দিমু।

:-_______________

:-জ্বী বস! হইয়া যাইবো। আপনে চিন্তা কইরেন না।

ফোন রেখে সৈকত হামিদ ঘরের এক কোনে পিচিৎ করে মুখ থেকে এক দলা পানের পিক ফেলে মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে,,

:- হুন বাইচ্চা দুইডারে চালান দিতে হইবো।বসে কইলো দুটো পার্টি পাওয়া গিয়েছে। হ্যাঁগোর কুনো সন্তান নাই। হ্যারাই কিইন্না লইবো! পুরো পঞ্চাশ লাখ টাকার ডিল হইছে। কোন ভুল করন যাইবো না। তয় বস মোগো মাইরা ফালাইবো।
তুই যা! বাইচ্চা দুইডারে সেটিং কইরা সাপ্লাইয়ের বেবস্থা কর গিয়া। আমি যাইয়া দেহি মুকুল আইলো কিনা!!

মহিলা মাথা নাড়িয়ে সাঁই জানাতেই সৈকত হামিদ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। করিডোরে দাড়াতেই মুকুলকে দেখতে পায়। মুকুল এক গাল হেসে বলে,,,

:-ওস্তাদ ডেরাগ লইয়া আইছি। কন তো পুশ কইরা দেয়!!

সৈকত হামিদ আবারো মুখ ভর্তি পানের পিক ফেলে। সন্তোষ চিত্তে বলে,,,

:-হ দিয়া দে,,দিয়া দে,,

মুকুল দেরি করে না। ড্রাগস আর প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো নিয়ে যে ঘরে মেয়েগুলো কে রাখা হয়েছে সেদিকে চলে যায়।

মাঝারি সাইজের ঘরটার মাঝখানে প্রায় নয় দশজন মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের হাত পা মুখ সবটাই বাঁধা। মুকুলকে দেখে মেয়েগুলো অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। এর মধ্যেই দুজন মেয়েকে মুকুল প্রেমের ফাঁদে ফেলে এখানে নিয়ে এসেছে। মেয়ে দুটো ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মুকুলের দিকে। মুকুল ঠোঁট বাঁকিয়ে শয়তানী হাসি হাসে,,,

পাশেই একটা টেবিলের ওপর ড্রাগসের সরঞ্জামগুলো রাখে। তারপর ইনজেকশন রেডি করতে করতে তার ধোঁকায় পড়ে আসা মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলে,,,

:-কি জানেমান! কষ্ট হইতাছে? চিন্তা কইরো না এহনি কষ্ট দুর কইরা দিতাছি!!

মুকুল ধীরে সুস্থে প্রত্যেকটা মেয়েকে ড্রাগস ইনজেক্ট করতে থাকে। আর ইনজেকশনের বাহানায় ব্যাড টাচ করতে ভোলে না। হাই পাওয়ারের ড্রাগস দেয়ার ফলে মুহুর্তেই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। নেতিয়ে পড়ে মেয়ে গুলো।
শেষ একটা কিট হাতে নিয়ে পাশের রুমে চলে যায় মুকুল। সারাকে সেখানেই আটকে রাখা হয়েছে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় সারা‌। মুকুলকে দেখে ভয় পেয়ে যায় সারা। এই লোকটা তখন তাকে খারাপ ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলো ভাবতেই ঘাবড়ে যায় মেয়েটা‌। রুমে এখন কেউ নেই । লোকটা যদি খারাপ কিছু করে বসে তার সাথে। আতঙ্কে গুটিসুটি মেরে দেয়ালের সাথে চেপে বসে সারা।
তাকে দেখে সারার প্রতিক্রিয়ায় শয়তানের মতো হাসে মুকুল। সারার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে,,,সারার দিকে হাত বাড়াতেই চিৎকার করে ওঠে সারা,,,

:-সরে যান। একদম ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না আমাকে।

ঠোঁট টেনে খিক খিক করে হাসে মুকুল। বলে,,,

:-কি কও সোনা! এতো সুন্দর মোমের মতন গতরখানি একটু ছুঁইয়া না দেখলে জীবনডায় বৃথা হইয়া যাইবো তো!!

মুকুলের কুৎসিত কথাবার্তায় ঘৃণায় মুখ কুঁচকে যায় সারার। আবারো চেঁচিয়ে ওঠে সারা,,,

:-কুত্তার বাচ্চা এক্ষুনি আমার থেকে দূরে যা। না হলে আমি কিন্তু চিৎকার করবো!!

সারার মুখে গালি শুনে মুকুলের ক্রোধ বাড়ে। সাথে বাড়ে লালসা। সারার নরম গালে স্বজোরে থাপ্পড় মেরে দাঁতে দাঁত চেপে নোংরা ভাষায় গালি দিয়ে বলে,,

:-শা*লার মা* এতো ত্যাজ আসে কইত্তে? তর ত্যাজ এহনি বাইর করতাছি খাড়া!!
মুকুল হাতে বিদ্যামান ড্রাগসের সিরিঞ্জটা চেপে ধরে সারার বাহুতে।
মুহুর্তেই হাই ডোজের ড্রাগস ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায়। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। সেই ঝাপসা চোখের সবটুকু আলো নিভে যাওয়ার আগেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট অথচ অতি চেনা একটা অবয়ব!! যেন সে অবয়ব ছুটে আসতে চাইছে তার দিকে। জোর করে চোখ খুলে রাখতে চায় সারা!! সে কি ঠিক দেখছে নাকি সবটাই তার নিছকই কল্পনা!! জীবনের চরম বিপর্যয়ের মুহূর্তে তার অবচেতন মন কি তার আকাঙ্ক্ষিত মানুষ টাকে ইম্যাজিন করাচ্ছে!!! বুঝতে পারে না সারা। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে পড়তেই অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে,,,, জাহান ভাই…..!!
সারার নরম তুলতুলে দেহখানি মাটি স্পর্শ করার আগেই কেউ একজন সযত্নে আগলে নেয় তার বক্ষ পিঞ্জরে।

********

প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে পিটপিট করে চোখ খোলে সারা। চোখের সামনে এখনো সবকিছু ঝাপসা অস্পষ্ট। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে পুরোপুরি চোখ খুলতে সক্ষম হয় সারা! চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাদা ধবধবে সিলিং,,নাকে ফিনাইলের গন্ধ এসে ধাক্কা খায়। নিজের অবস্থান বুঝতে মাথা ঘুরিয়ে আসেপাশে তাকায়,,সব মেশিন পত্রের ছড়াছড়ি। হাত নাড়াতে গেলে ব্যাথা পেয়ে কঁকিয়ে ওঠে সারা। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পায়,বা হাতে স্যালাইনের ক্যানালা লাগানো। বুঝতে পারে সে এখন হসপিটালে। কিন্তু সে এখানে কি করে এলো!! কে নিয়ে এলো তাকে? মাথা চেপে ধরে মনে করার চেষ্টা করে।
সে তো পাচারকারীদের কাছে বন্দী ছিলো। ওই লোকটা তখন তার হাতে কিছু একটা পুশ করতেই সব ঝাপসা হয়ে গেল,,, তারপর… তারপর কি হলো? একটা অস্পষ্ট কায়া দেখতে পেয়েছিলো যেন সারা! সে কি সত্যিই দেখেছিলো! নাকি ওই বাজে লোকগুলো তাকে পাচার করে দিয়েছে! সে কি এখনো বাসার কারীদের হাতেই বন্দী!! তাহলে তাকে হসপিটালে কে আনলো? রুমটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে এটা একটা বিলাসবহুল কেবিন। পাচারকারীরা নিশ্চয়ই তাকে এরকম জায়গায় ট্রিটমেন্ট করাতে নিয়ে আসবে না! তাহলে কে নিয়ে এলো তাকে?

সারার ভাবনার মাঝেই কেবিনের দরজা খুলে কেউ একজন প্রবেশ করলো। সারা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সারা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং তৈমুর জাহান শিকদার! সারা চোখ বন্ধ করে আবারো ভালো করে তাকায়!! নাহ! সত্যিই সে তাকেই দেখতে পারছে। এটা যে তার কল্পনা নয় বাস্তব তা মস্তিষ্কে ধারণ করতেই ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেয় সারা।

কেবিনে ঢুকতেই সারার জ্ঞান ফিরতে দেখে খুশি হয়েছিলো তৈমুর। কিন্তু হুট করে সারার কান্নার আওয়াজ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় সারার কাছে। দুহাতে সারার মুখটা সযত্নে আগলে নিয়ে অস্থির হয়ে বলে,,,

:-হোয়াট হ্যাপেন সারা? কাঁদছিস কেনো? ব্যথা পেয়েছিস কোথাও? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমাকে?

সারা কথা বলে না। তৈমুরের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতেই থাকে। এদিকে সারার কান্নায় আরো অস্থির হয়ে পড়ে তৈমুর। নিজেই সবকিছু চেইক করে কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা!! সবই ঠিকঠাক আছে। সারার হাতের স্যালাইনের নলটা খুলে দেয় তৈমুর। সারার গালে এখনো পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। লাল হয়ে আছে গাল টা। তৈমুর ঝুঁকে আলতো করে চুমু দেয় সেথায়। তৈমুরের অভাবনীয় কাজে থম মেরে যায় সারা!! কান্না ভুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তৈমুরের দিকে। কি হলো এটা! সারার প্রতিক্রিয়ায় তৈমুর ঠোঁট কামড়ে হাসে।

তখনই হুড়মুড় করে কেবিনে প্রবেশ করে শিকদার বাড়ির সবাই,,, তুলি আর রেশমীর হাতে ফুলের তোড়া। রিনা শিকদার খাবারের টিফিন ক্যারিয়ার হাতে উদ্বেগ মাখা চোখে তাকিয়ে আছে সারার দিকে। সাইফ শিকদার, আলিফ শিকদার সারাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে এগিয়ে এসে দুদিক থেকে আগলে ধরে!! মাথায় চুমু দেন। রিনা শিকদার কাছে এসে সারার কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে হাসিমুখে সুধায়,,,

:-এখন কেমন লাগছে রে মা? কষ্ট হচ্ছে কোথাও?

সিমা শিকদারও সারার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে,,,

:-কেমন আছিস সারা?

তুলি,রেশমী সারার পাশে ফুলের তোড়া দুটো রেখে সারার গাল দুটো টিপে দিয়ে হাসতে থাকে!!

জীবনের একটা কঠিন পরিস্থিতি যে সে সত্যিই পেরিয়ে এসেছে বিশ্বাস হয়না যেন। দীর্ঘ সময় পর পরিবারের আপন মানুষ গুলোর মুখ দেখে আবেগে হতবিহম্বল সারা!! খুশির চোটে মুখ দিয়ে কথা বের হয় না সারার। শুধু দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।

চলবে,,,,