সারা জাহান পর্ব-১৫+১৬+১৭+১৮

0
21

#সারা_জাহান
পর্ব,,,,১৫
মৌমো তিতলী

হসপিটালে আজ দ্বিতীয় দিন। সারার কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার সহ কলেজের সকল স্যারেরা সারাকে দেখতে এসেছিলেন। প্রিন্সিপাল স্যার তো এক প্রকার প্রতিজ্ঞা করেই বসেছেন আর কখনো স্টুডেন্টদের নিয়ে তিনি ট্যুরে যাবেন না। তৈমুর জাহানের কাছে বারংবার অনুশোচনা প্রকাশ করছেন তিনি, সারার সর্বোচ্চ খেয়াল না রাখতে পারার জন্য।
শিকদার বাড়ির সকলে হসপিটালের কাছাকাছি একটা আবাসিক হোটেলে উঠেছে। এত লোক একসাথে হসপিটালে অ্যালাও করবে না তাই রাতেই হসপিটালের কাছাকাছি একটা হোটেলে ফ্ল্যাট বুক করে তৈমুর। সায়ানের দায়িত্বে তাদেরকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। রিনা শিকদার হসপিটালে থাকতে চাইছিলেন কিন্তু তৈমুর থাকছে বলে মাকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ট্যুরের সকলে শহরে ফিরে গেলেও থেকে গেছে সামিরা। প্রিন্সিপাল স্যার অমত করলে তৈমুর দায়িত্ব নেয়। সামিরা তাদের সাথে ফিরবে। থাকুক সে সারার কাছে।
কেবিনে এসে সামিরা তো সারাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিয়েছে,, সামিরা কে এভাবে কাঁদতে দেখে সারা হাসতে হাসতে বলে,,,

:-আরে এবার তো থাম! আর কত কাঁদবি? আমি তো এখন ঠিক আছি দেখ!

সারার কথায় সামিরা চোখ মুছে মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,,

:-চুপ কর তুই। জানিস কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম? তুই ওই জঙ্গলে পৌঁছালি কি করে বলতো? আর ওই ভয়ঙ্কর পাচারকারীদের হাতেই বা পড়লি কি করে? তুই জানিস কাল যদি তৈমুর ভাইয়া ঠিক সময়ে না পৌঁছাতো তাহলে কি হতে পারতো!! আমার তো ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

সারা আড় চোখে তাকায় তৈমুরের দিকে। যে এখন কেবিনের সোফায় আরাম করে বসে ফোনে স্ক্রল করছে। যেন সে এই দুনিয়াতেই নেই। তার সমস্ত মনোযোগ ফোনের দিকেই। সামিরার প্রশ্নে সেদিকে তাকায় তৈমুর। তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,,

:-এগুলো নিয়ে পরে কথা বললেও চলবে। সারা আগে সুস্থ হয়ে শিকদার বাড়িতে ফিরুক। তারপর না হয় সবটা জানা যাবে‌। এখন এসব নিয়ে কোন প্রশ্ন করোনা সামিরা।

সামিরাও আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। সারাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।

এমন সময় দরজায় কেউ নক করে। তৈমুর হাত ঘড়িতে সময় পরখ করে ভ্রু কুঁচকে তাকায় দরজার দিকে। এখন আবার কে আসতে পারে!
তৈমুর গিয়ে দরজা খুলতেই দৃশ্যমান হয় আব্রর মুখটা। আব্রর হাতে একটা ফুলের বুকে। তৈমুর কে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয় আব্র। তৈমুর একবার সারার দিকে তাকিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়‌‌‌। তৈমুরের উপস্থিতিতে অনেকটা অস্বস্তি নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করে আব্র।
আব্র কে দেখে সারা,সামিরাও বেশ অবাক হয়। সামিরা প্রচন্ড বিষ্ময়ে প্রশ্ন করেই বসে,,,,

:- আব্র ভাইয়া আপনি এখানে? আপনি স্যারদের সাথে ফিরে যাননি?

আব্র সামিরার কথায় অপ্রস্তুত হেসে বলে,,,

:-কি যে বলো সামিরা। এতবড় একটা ঘটনার পর সারাকে না দেখেই কি করে চলে যেতাম বলো? সেটা কি উচিত হতো?

আব্রর উত্তরে তৈমুর ভ্রু কুঁচকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,,,

:-তো তুমি বলতে চাইছো সারাকে দেখার জন্যই তুমি যাওনি?

তৈমুরের কথায় জবাব না দিয়ে সারার দিকে এগিয়ে যায় আব্র। সারার দিকে ফুলের বুকে’টা বাড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলে,,

:-কেমন আছো সারা? এটা তোমার জন্য।

সারা স্মিত হেসে ফুলের তোড়াটা নেয়। আড়চোখে তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বলে,,,

:-জ্বী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

:-ভালো ছিলাম না। কিন্তু এখন ভালো আছি। বলে মুচকি হাসে আব্র।

এদিকে আব্রর সারাকে বলা কথাগুলো শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তৈমুরের। ধীর পায়ে সোফায় গিয়ে বসে তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে আব্রকে। ছেলেটাকে মোটেও সুবিধার লাগে না তৈমুরের। সেদিনের সায়ানের বলা কথাগুলো বক্ষ পিঞ্জরে ধাক্কা দিয়ে যায়।

সামিরা আর সারার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায় আব্র। আব্রর উপস্থিতিতে প্রতিটা সেকেন্ড প্রতিটা মুহূর্ত আব্রর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তৈমুর। সারার প্রতি যে তার দুর্বলতা আছে বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়নি তার। সারার প্রতি আব্রর এই মুগ্ধদৃষ্টি রীতিমতো দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছে তৈমুরের মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে।
প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে তৈমুর। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে কল লাগায়। অপর পাশ থেকে কল তুললে জবাবের অপেক্ষা না করে বলে,,,

:- আমারএকজনের ইনফরমেশন চাই!

:-জ্বী ভাই বলেন কার ইনফরমেশন লাগবে! তার ঠিকুজি কুষ্ঠি বের করে আপনাকে পাঠিয়ে দিবো ভাই।

:- তোদের ম্যাডামের কলেজের সিনিয়র আব্রাহাম আব্রর ডিটেইলস লাগবে।

:-ওকে ভাই আপনি টেনশন নিয়েন না। কাজ হয়ে যাবে।

ফোন রেখে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে তৈমুর। মনে মনে ভাবে,,,

:-তুই আমার সারা। আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোর দিকে কোন পরপুরুষের দৃষ্টি আমি সহ্য করবো না। তোর দিকে ধেয়ে আসা প্রত্যেকটা অনুরাগী হাত তোর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবো।
___________

টানা চার দিন পর হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ পেয়ে খুলনা ছাড়লো শিকদার পরিবার।সাড়ে তিন ঘণ্টার জার্নি শেষ করে শিকদার হাউসে পৌঁছায় সবাই। আলিফ শিকদার,সিমা শিকদার, তুলি, রেশমী আর সামিরা দুদিন আগেই ফিরেছিলো। বাকিরা খুলনাতেই ছিলো।

________

সারার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তৈমুর। ল্যাগেজ হাতে সায়ানও আসে তৈমুরের পিছু পিছু। তুলি, রেশমী এসে জড়িয়ে ধরে সারা কে। লুবানা এতক্ষণ সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে তৈমুরের হাতের মুঠোয় রাখা সারার হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলো!
সারা কে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা দেখে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে লুবানা। সেদিন যখন তৈমুর ফোনে সবাইকে জানালো যে,সারাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিকদার বাড়িতে সবাই চিন্তায় অস্থির হয়ে যান। রিনা শিকদার তো কাঁদতে কাঁদতে তখনই খুলনা যাওয়ার জন্য জেদ করতে থাকেন। রিনা শিকদারের জেদের কাছে হার মেনে তখনই সবাই মিলে খুলনার উদ্দেশে রওনা দেন।

কেনো যেনো সারার নিখোঁজ হওয়ার খবরে লুবানার একটুও খারাপ লাগেনি। বরং সে মনে মনে চেয়েছিলো যেন সারাকে না পাওয়া যায়!! সারার প্রতি তৈমুরের এই পজেসিভনেস দেখে হিংসা হয় লুবানার। তৈমুর কে সে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার মানুষটির চোখে অন্যকারো জন্য ভালোবাসা বুঝতে একটুও অসুবিধে হয়না লুবানার। এই কারনেই সারাকে সহ্য করতে পারে না লুবানা।

সিমা শিকদার সকলের জন্য নাস্তা,শরবতের ব্যবস্থা করেন। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে ড্রইং রুমে বসে সবাই। সাইফ শিকদার সারার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করেন কি ঘটেছিলো সেদিন। সারা ধীরে সুস্থে সবটা খুলে বলে সকলকে‌।
সারার মুখে প্রত্যেকটা ঘটনা শুনে রিনা শিকদার,সিমা শিকদার আঁচলে চোখ মোছেন।মেয়েটা সেই কঠিন সময়ে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলো ভাবতেই সকলের চোখে অশ্রু জমে।
সারা একা সেই পরিস্থিতিতে কতটা কষ্ট সহ্য করেছে ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তৈমুরের।
সারার কাছে সবটা শুনে তৈমুরও বাকি ঘটনা ব্যক্ত করে কিভাবে তারা ওই পাচারকারী চক্র পর্যন্ত পৌঁছালো। এটাও জানায় তারা সন্দেহ করছে লুবানার বাবা ডিন আসাদ খানের মৃত্যুর জন্যও এরাই দায়ী।
হসপিটালের ওয়ার্ড বয় মুকুল সহ সৈকত হামিদ আর জাকিরও এখন পুলিশ হেফাজতে আছে। বাকিরাও ধরা পড়েছে। ১০ জন যুবতী মেয়ে আর ২ টা বাচ্চা শিশুকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন এই চক্রের প্রধান মাস্টার মাইন্ড কে সেটাই বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
সৈকত হামিদ, জাকির আর মুকুলকে অনেক মারধোর করেও এখনো মুখ খোলাতে পারেনি পুলিশ। হয়তো তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ প্রান গেলেও সত্যি টা তারা বলবে না। এখন পরবর্তীতে কি হয় সেটাই দেখার অপেক্ষা।

*******

রাতে নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল তৈমুর।
নিচ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। তৈমুর ছাড়া শিকদার বাড়ির বাকি সদস্যরা নিচে ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিচ্ছে। আর তাদের মধ্যমণি হয়েছে সায়ান। কয়েকদিনের ঝড়ঝাঁপটা পেরিয়ে আজকে যেন শিকদার বাড়ি প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
সায়ানের উদ্ভট কথাবার্তায় হাসির ফোয়ারা বইছে ড্রয়িং রুমে।

কিছুক্ষণ পর তৈমুরের রুমে আসে লুবানা। তৈমুরকে ল্যাপটপে কাজ করতে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। বিছানায় তৈমুরের কাছাকাছি গিয়ে বসে।
লুবানার উপস্থিতি অনুভব করে সেদিকে তাকায় তৈমুর। লুবানাকে এত কাছে বসতে দেখে বিরক্ত হয় মনে মনে। স্বাভাবিক মুখে বলে,,,

:-তুমি এখন এখানে কি করছো? বাকিরা নিচে আড্ডা দিচ্ছে সেখানে যাও।

লুবানা এক পাশ থেকে তৈমুরের বাহু জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি কণ্ঠে বলে,,,

:- আমার সাথে সব সময় এমন করো কেন তৈমুর? কেন এমন দূরে দূরে থাকো? You know না! how much I love you!
বলেই তৈমুর কে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে লুবানা।

লুবানাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ায় তৈমুর। মুহুর্তেই লুবানার গলা চেপে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে। মুহুর্তেই লুবানার দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখদুটো যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। সেদিকে তোয়াক্কা না করে তৈমুর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,,

:-You know what!! Taimur Jahan Sikder doesn’t consider cheap girls like you worthy of his shoes.!!
দ্বিতীয়বার আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করলে, আমাকে ছোঁয়ার করার চেষ্টা করলে You will be responsible for the next one.,,,Got it?
বলেই লুবানার গলা ছেড়ে দেয়! তৈমুরের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কাশতে কাশতে চোখমুখ উল্টে আসে লুবানার। জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে লুবানা।
তখনই হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করে সায়ান। নিচে সবার মধ্যে লুবানা কে দেখতে না পেয়ে ঠিকই সন্দেহ করছিলো সে। লুবানা নিশ্চয় তৈমুরের রুমে এসেছে। আর তার রেজাল্ট কি হতে পারে সেই আশংকায় এক প্রকার হন্তদন্ত ছুটে এসেছে সায়ান।
রুমে ঢুকেই তৈমুরের হিংস্র দৃষ্টি আর লুবানা কে এভাবে বুক চেপে ধরে হাঁপাতে দেখে বুঝতে পারে অঘটন যা ঘটার ঘটে গেছে। সায়ান গিয়ে লুবানাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের জগ থেকে থেকে পানি নিয়ে লুবানাকে খাইয়ে শান্ত করে। তৈমুরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,,

:- হোয়াট হ্যাপেন তৈমুর? এমন হাইপার হয়ে আছিস কেন? আর কি করেছিস লুবানার সাথে? কি করেছে ও?

তৈমুর প্রচন্ড রেগে হুঙ্কার দিয়ে বলে,,

:-Ask her what she did! আমাকে জিজ্ঞাসা করছিস কেন? Bloody chip girl,,

তৈমুরের অপমানে চোখ ভরে আসে লুবানার। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,,

:- কি করেছি আমি? ভালোবাসি আমি তোমায়। তোমাকে ছোঁয়ার কি আমার কোন অধিকার নেই?

লুবানার কথায় রাগের পারদ চড়তে থাকে তৈমুরের।

:- হোয়াট? What did you say? অধিকার? কিসের অধিকারের কথা বলছো তুমি? তোমার সাথে আমার কোন অধিকারের সম্পর্ক?? হ্যাঁ একটা অধিকারের সম্পর্ক অবশ্য ছিলো, বন্ধুত্ব! যেটা তুমি নষ্ট করেছো। আর না আমি তোমাকে ভালোবাসি।তাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে Next time অধিকার নিয়ে কথা বলবে না। আর রইলো আমাকে ছোঁয়ার কথা! তুমি আমার বিয়ে করা বউ নও যে যখন ইচ্ছে আমাকে ছুঁতে পারবে!

তৈমুরের কথায় লুবানা রাগে আরো অস্থির হয়ে বলে,,

:-আচ্ছা তাহলে সারা বুঝি তোমার বিয়ে করা বউ!! তাকে তো পারলে তুমি কোলে নিয়ে বসে থাকো!

লুবানার কথায় হুঙ্কার তোলে তৈমুর,,,

:-Just shirt up! খবরদার যদি সারার নাম মুখে নিয়েছো তো!! আমি কাকে কোলে তুলে নেবো,,সারা আমার কে লাগে That’s none of your business…

এদের দুজনের ঝগড়ার মাঝখানে নিজেকে স্যান্ডউইচ মনে হয় সায়ানের। তৈমুর কে টেনে নিয়ে বলে,,,

:-তুই শান্ত হ তৈমুর! এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো?

তৈমুর সায়ানকে সরিয়ে দিয়ে বলে,,

:-তুই আমাকে না বলে এই বেয়াদব মেয়েটাকে চুপ করতে বল।

লুবানা কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,

:-তুমি কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করছো তৈমুর! আমাকে যখন ভালোইবাসো না তাহলে কেনো নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলে? বিপদ হোক যায় হোক থাকতাম পড়ে নিজের বাড়িতে!

:-হাউ স্টুপিড!! লিসেন, তোমাকে ভালোবেসে আমি এবাড়িতে নিয়ে আসিনি। তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি ডিন স্যারের সম্মানের কথা ভেবে। I swear! আমার কাছে যদি কোন অপশন থাকতো আমি কখনোই তোমাকে এই শিকদার বাড়িতে নিয়ে আসতাম না।
আর একটা কথা!! সারার দিকে বিষ দৃষ্টি দেয়ার সাহস দেখাবে না! সাবধান করে দিচ্ছি। বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় তৈমুর।

লুবানা সেখানেই ধপ করে বসে পড়ে। কাঁদতে থাকে নিজের ভালোবাসার মানুষটির করা অপমানে।
সায়ান লুবানার পাশে গিয়ে বসে। ধীর গলায় বলে,,

:-লিসেন লুবানা!! তুমি আমাদের দুজনেরই খুব ভালো বন্ধু
হয়তো তোমার ওপর রাগের কারনে তৈমুর এখন সেটা স্বীকার করেনা। কিন্তু আমি তৈমুর কে আর ওর সমস্ত সভাব সম্পর্কে খুব ভালো করে জানি! তোমার ওপর যতোই রাগ দেখাক তার রাগের আড়ালে বন্ধুত্বের টা এখনো আছে। নয়তো তোমার সেফটির কথা চিন্তা করে তোমাকে এখানে নিয়ে আসতো না।

লুবানা সায়ানের কথার জবাব বলে,,

:-কিন্তু আমি তো তৈমুরের শুধু বন্ধুত্বটা চাইনা। আমি ভালোবাসি ওকে। ও কেনো আমার ভালোবাসা বুঝতে পারে না? কেনো আমার ভালোবাসা একসেপ্ট করে না?

:-আমার মতে তুমি খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে লুবানা। এইটুকু অন্তত তোমার জানা কথা যে,জোর করে কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। ভালোবাসা আসে হৃদয় থেকে। তৈমুর তোমাকে ভালোবাসে না লুবানা। তার প্রতি তোমার ভালোবাসা টা সম্পূর্ণ এক তরফা। এটা মেনে নাও। যত তাড়াতাড়ি তুমি এটা মেনে নেবে তত তাড়াতাড়ি তুমি মুভ অন করতে পারবে। কারন তৈমুর কখনো তোমাকে ভালোবাসবে না।

সায়ানের কথায় লুবানা অস্থির হয়ে বলে,,,

:-কেনো ভালোবাসবে না? কেনো? কেনো? কেনো? কি কমতি আছে আমার মধ্যে যার জন্য তৈমুর আমাকে এভাবে ইগনোর করে!

সায়ান লুবানার অস্থিরতায় হালকা হেসে আনমনে বলে,,,

:-বিষয় টা কমতির নয় লুবানা। হতে পারে তৈমুরের মনে অন্য কারো বসবাস!! হতে পারে তৈমুরের হৃদপিন্ড অন্য কারো নাম জপে! বা হয়তো তৈমুরের নিঃশ্বাস টায় চলে অন্য কারো ছন্দে!

কথাগুলো বলেই সায়ান রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নিতেই লুবানার তাচ্ছিল্য স্বরে বলা কথায় পা থেমে যায়,,,

:-সেই অন্য কেউ টা বুঝি সারা?

সায়ান চমকে উঠে তাকায় লুবানার দিকে। বলে,,,

:-এতো কিছু তোমাকে না ভাবলেও চলবে। নিচে এসো।

বলেই প্রস্থান করে সায়ান। সায়ান বেরিয়ে যেতেই বিছানার চাদর খামচে ধরে রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে লুবানা। বিছানায় তৈমুরের ব্যাবহৃত বালিশটা হাতে নিয়ে তাতে নাক ডুবিয়ে তৈমুরের পুরুষালী স্মেল টা নিজের ভেতরে টেনে নেয়। বালিশটা বুকে আঁকড়ে ধরে বলে,,,

:- তুমি আমার ভালোবাসা তৈমুর। তুমি শুধু আমার হবে। অন্য কেউ তোমাকে পাবে না। তোমার মনে আমি অন্য কাউকে থাকতে দেবো না। ওই আশ্রিতা মেয়েটাকে তো নয়ই। বলেই বালিশটা স্বজোরে ফ্লোরে আছাড় মারে। যেন সেটা বালিশ নয় বরং স্বয়ং সারা।

#সারা_জাহান
পর্ব,,,১৬
মৌমো তিতলী

লাইফ কেয়ার হসপিটালের তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
লাইফ কেয়ার হসপিটালের ওয়ার্ড বয় মুকুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে লাইফ কেয়ার হসপিটালের ডিন প্রফেসর ডা: মোঃ আসাদ খানের হত্যা মামলায় ওয়ার্ড বয় মুকুল ও তার পাচারকারী চক্রের হাত ছিলো। তারা লাইফ কেয়ার হসপিটালে চিকিৎসারত গরিব শ্রেণীর মানুষদের বাচ্চা চুরি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দিতো। বড়সড় পয়সাওয়ালা লোকগুলো,যাদের সন্তান ছিলো না বা নিজেরা সন্তান জন্ম দিতে চাইতো না তারা চড়া দামে এসব বাচ্চাদের কিনে নিতো। তাতেই মুকুল ও তার পাচারকারী চক্রের হাতে আসতো মোটা অঙ্কের টাকা। লাইফ কেয়ার হসপিটালে বাচ্চা সরিয়ে নিতে সাহায্য করতো ওয়ার্ড বয় মুকুল। দির্ঘ্যদিন বাঁধাহীন চক্র চালিয়ে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি। একদিন হসপিটালের ডিন প্রফেসর ডা মোঃ আসাদ খান জেনে যায় তাদের এই ঘৃন্য চক্রের ব্যপারে। প্রথমে তাকে মুখ বন্ধ রাখতে মোটা টাকা অফার করা হয় কিন্তু তিনি রাজি হননি। পুলিশকে তথ্য দিতে চাইলে তাকে হত্যা করা হয়।
তবে ওয়ার্ড বয় মুকুল ও তার সঙ্গিদেরকে মারধর করেও পাচারকারী চক্রের মুল হোতা কে তা জানা যায়নি। তারা কেউই জানে না সবার ওপরে কে বা কারা কাজ করছে। তাদেরকে ফোনে নির্দেশ দেয়া হতো আর তারা কথামত ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে ফোনের মাধ্যমেই বড় অঙ্কের টাকা হস্তগত হতো‌। ওপরে বস হিসেবে কে বা কারা কাজ করছে সেটা তারা কেউই জানে না। এমনকি কখনো তাদেরকে দেখেনি বলে জানিয়েছে পাচারকারী চক্র।
সকাল থেকে প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানেলে এগুলোই প্রচার করা হচ্ছে।

লাইফ কেয়ার হসপিটালের তদন্ত মামলায় ওয়ার্ড বয় মুকুল কে দোষী সাব্যস্ত করে পুনরায় হসপিটাল চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। প্রফেসর ডা মোঃ আসাদ খানের হত্যা মামলায় আদালত হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িতদের ১৪ বছরের জেল ঘোষণা করেছেন এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িতদের গ্রেফতার করে পুলিশ হেফাজতে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ডিন আসাদ খানের হত্যা মামলার কেস এখানেই ক্লোজ করা হয়েছে।

সকাল থেকে তৈমুর,সায়ান আদালতেই উপস্থিত ছিলো। মামলা শেষ হলে আদালত থেকে বেরিয়ে আসে তারা। সেখান থেকে সোজা হসপিটালে আসে।
হসপিটালের অন্যান্য সিনিয়র ডাক্তারগণ তৈমুর জাহান শিকদার কে হসপিটালের ডিন হিসেবে জয়েন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। বাকিরাও তাতে সম্মতি জানিয়েছেন। উক্ত ঘটনায় ভীষণ খুশি সায়ান। সেও তৈমুর কে ডিন হিসেবে জয়েন করতে অনুরোধ করে। অগত্যা রাজি হয় তৈমুর জাহান শিকদার। জানানো হয় আগামী সপ্তাহে হসপিটালের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ায় একটা সেলিব্রেশন পার্টির আয়োজন করা হবে। সেদিনই হসপিটালের পরবর্তী ডিন হিসেবে ঘোষণা করা হবে বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডঃ তৈমুর জাহান শিকদারের নাম।সকলেই ভীষণ খুশি এই সিদ্ধান্তে।

শিকদার হাউসের সকলেই বসে আছে ড্রইং রুমে। লুবানা আজ নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে। যেহেতু ডিন প্রফেসর মোঃ আসাদ খানের হত্যাকারীরা পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে ,সাজা পেয়েছে এখন লুবানা নিজ বাড়িতে নিঃসন্দেহে ফিরে যেতে পারে। আসাদ খানের হত্যা মামলার রায় ঘোষণা শোনার পর লুবানা অনেক কেঁদেছিলো। শিকদার হাউসের সকলেই ভীষণ ভাবে লুবানার পাশে ছিলো এতো দিন। সবার প্রতি লুবানার কৃতজ্ঞতা থাকলেও একমাত্র সারা কে সে ভালো ভাবে নিতে পারেনি কখনো। বিশেষ করে যখন থেকে সারার প্রতি তৈমুরের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছে। শিকদার হাউস থেকে যাওয়ার আগে লুবানা নিজ মনে প্রতিজ্ঞা করে তৈমুর কে সে কিছুতেই সারার হতে দেবে না। তৈমুর শুধু তার। তৈমুর কে নিজের করে পেতে সে সবকিছু করতে পারে। আর করবেও।

***********

অসুস্থতার পর আজ ক্যাম্পাসে এসেছে সারা। সামিরা অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলো। সারা এলে দুজনে মিলে ক্যাম্পাসের এক কোনে বকুল তলায় বসে। জমানো কথার ফুলঝুরি ছড়ায়।
আব্র লাইব্রেরিতে বসে নিজের অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করছিলো। ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলে এসে জানায় সারা আজ কলেজে এসেছে। সারার নাম শুনতেই হৃদয়ে উষ্ণ স্রোত বয়ে যায় আব্রর। লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে পা বাড়ায় ফার্স্ট ইয়ারের ডিপার্টমেন্টের দিকে।
কর্নারে আসতেই আব্রর চক্ষুগোচর হয় সারা কে। হাসিমুখে এগিয়ে যায় সেদিকে।

:- হেই সারা! কেমন আছো?

আব্রকে দেখে সারাও সৌজন্য হাসে। উত্তর দেয়,

:- ভালো আছি ভাইয়া! আপনি কেমন আছেন?

:-আমিও ভালো আছি। তো কি করছো তোমরা?

সারা জবাব দেয়ার আগেই সামিরা জবাব দেয়,

:- কি আর করবো বলেন! সারা এতদিন পর ক্যাম্পাসে এলো তাই একটু গল্প করছিলাম দুজনে।

আব্র হেসে বলে,,

:-আচ্ছা। তোমাদের একটা নিউজ দেয়ার ছিলো। আগামী ১৫ জুন আমাদের পারিবারিক বিজনেসে এমডি হিসেবে জয়েন করার জন্য আমার অনারে একটা পার্টি আছে। আমার বাড়িতেই পার্টির আয়োজন করা হবে। তোমাদের দুজনকেই ইনভাইট করছি!! আসা করি তোমাদের কে পাবো পার্টিতে। বলেই আব্র ব্যাগ থেকে দুটো কার্ড বের করে সারার কোলের ওপর রাখে। সারা কিছু বলতে নিবে তার আগেই সামিরা সারার হাত চেপে ধরে এক্সাইটেড হয়ে বলে,,

পার্টির কথায় তাৎক্ষনিক সারা বলে,,,

:-অভিনন্দন ভাইয়া কিন্তু আমি এসব পার্টিতে কমফোর্ট ফিল করিনা। তা ছাড়া আমরা স্টুডেন্ট,আরো আপনার জুনিয়র। এসব পারিবারিক বিজনেস সম্পর্কিত পার্টিতে যাওয়া টা যুক্তিসঙ্গত নয়।

সারার কথায় আব্রর মুখটা একটু মলিন হয়। সামিরা সেটা খেয়াল করে বলে,,

:-এডভান্স কনগ্রাচুলেশন ভাইয়া। ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আসলে সারা এসব পার্টি ফার্টি খুব একটা এনজয় করে না। তবে আমরা অবশ্যই যাওয়ার চেষ্টা করবো।
সামিরার কথায় আব্র স্মিথ হাসে। বলে,,,

:-ওকে!! থাকো তবে আমি এখন যায়।

আব্র যেতেই সারা সামিরাকে বলে,,,

:-এটা কি করলি তুই? কেনো বললি আমরা যাবো ওনার পার্টিতে?

:-আরে আব্র ভাই!! কলেজের ফেমাস ক্রাশ দ্যা গ্রেট আব্র ভাই তার পার্টিতে ইনভাইট করলো আর তুই বলছিস যেতে রাজি হবো না?

:-ক্রাশ হবে তোর! তুই যা। আমাকে টানবি না। জাহান ভাইয়া আমাকে জেতে দিবে না। আমি বলতেও পারবো না। একবার একা বাইরে যেতেই এতো কিছু ঘটে গেলো। আর কলেজের সিনিয়র ভাইয়ের পারিবারিক পার্টিতে যাওয়ার কথা বললে দেখবি থাপড়ে মুখ বাঁকা করে দিয়েছে‌। জাহান ভাইয়ার সামনে আমি তো বলতেই পারবো না।

সারার কথায় সামিরা অভয় দিয়ে বলে,,

:-আচ্ছা তৈমুর ভাইয়ার সাথে না হয় আমি কথা বলবো। যেতে দিলে যাবো না দিলে নাই!! সমস্যা নেই তো!! আচ্ছা ছাড় এসব। চল ক্লাসে চল‌। অতঃপর দুজনে ক্লাসের উদ্দেশ্য প্রস্থান করে।

*************
লাইফ কেয়ার হসপিটাল। রাত ১১ টা। তৈমুরের কেবিন….

আজ হসপিটালের নতুন ডিন হিসেবে জয়েন করেছে তৈমুর জাহান শিকদার। এতদিনের হিসাব, কাজ সবটা বুঝে নিতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।
হাসপাতালের কেবিনের কাঁচের জানালায় শহরের আলো ঝলমল করছে। তৈমুর ক্লান্ত চোখে মাথা নিচু করে বসে আছে চেয়ারে। এমন সময় কেবিনে আসে সায়ান।

:-কিরে আর কতক্ষন কাজ করবি? বাসায় ফিরবি না?

তৈমুর মাথা না তুলেই বলে,,

:-যাবো। গাড়ি বের কর। সারাদিন আমার প্রাণ টাকে দেখিনি। চোখে বড়ই তৃষ্ণা। যতক্ষণ না মিটছে শান্তি নেই।

সায়ান হেসে ফেলে।

:-তুই আসলে গভীর প্রেমে তলিয়ে গেছিস বন্ধু!! সারা ছাড়া আর কেউ তোকে টেনে তুলতে পারবে না।

তৈমুর এবার হালকা হাসে।

:- তাকে ছাড়া আর কাউকে প্রয়োজনও নেই। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা চুলের ছোট্ট গোলাপী হেয়ার পিন বের করে,,হেয়ার পিন টা সারার। নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলো তৈমুর। এটা কাছে থাকলে মনে হয়,সারা তার কাছেই রয়েছে।

সায়ান হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়।

তৈমুর যখন শিকদার হাউসে পৌঁছায় তখন রাত ১ টা‌। রিনা শিকদার তখনও ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। তৈমুর মাকে খাবার রেডি করতে বলে ওপরে চলে যায় ফ্রেস হতে। নিজের রুমে ঢোকার আগে সারার রুমে যায়‌। অভ্যাস মতো বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। তৈমুর এগিয়ে যায় সেদিকে। সারার মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো আলতো আঙ্গুলের ছোঁয়ায় কানের পাশে গুঁজে দেয়। অতঃপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়াবতীর মুখের দিকে। কিছুক্ষণ মন ভরে দেখে কপালে অধর ছুঁয়ে দেয়। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।

পরদিন দুপুরে,,,,

তুলি লনে দাঁড়িয়ে ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। এমন সময় সায়ান আসে সেখানে। তুলিকে গাছে পানি দিতে দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি নাড়া দেয়,,তুলির পেছনে গিয়ে বলে,,,

:-হে রুপসী বাংলার রুপসী কন্যা! বলো তো আমি গাছ নাকি ফুল?

তুলি পেছনে না ঘুরেই বলে,,,

:-এখানে অপশনের কি আছে? তুমি একটা গাছ! ডঃ হয়ে কাজ কাম নেই? বেকার দাঁড়িয়ে থাকো সবসময়!!

সায়ান এক লাফে সামনে এসে বলে,,

:- তাহলে আমাকেও একটু জল দাও। দেখো আমি দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছি তোমার ভালোবাসার অভাবে!!

তুলি নাক কুঁচকে বলে,,

:-এই ডায়লগ দিয়ে কতগুলো মেয়েকে পটিয়েছো আজ পর্যন্ত??

:-শুধুই তোমাকে পটাতে চায় রুপসী!! বাকি মেয়েগুলো তো শুধু চা কফি খাওয়ার জন্য!

:-ওহ আচ্ছা ! চা কফি খাওয়ায় বুঝি! তাহলে এসো আমি তোমাকে বিষ খাওয়াবো।

সায়ান বুক চেপে ধরে বলে,,

:-তুমি নিজ হাতে আমার ঠোঁটে যদি বিষ ঢেলে দাও, তা হবে আমার কাছে অমৃত!!

:-ছিইই!! তোমার ফ্লার্টিং লেবেল কি বিশ্রি!! বলেই পেছনে ফিরে ঠোঁট চেপে হেসে দেয় তুলি।

সায়ান হাসতে হাসতে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। সায়ান যেতেই তুলির বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। অপলক তাকিয়ে থাকে সায়ানের গমন পথের দিকে।

শিকদার হাউসে সকলে ড্রইং রুমে বসে আছে। শুধু মাত্র তৈমুর ছাড়া। গতকাল অনেক রাত করে বাসায় ফিরে আজ সারাদিন রেস্ট করছে। ড্রইং রুমে আলোচনার টপিক তুলির জন্মদিন।
আগামী পরশু দিন তুলির জন্মদিন। সেটার সেলিব্রেশনের প্ল্যান করা হচ্ছে সবাই মিলে। সায়ানও তাতে যোগ দিয়ে হৈহৈ একটা ব্যাপার ক্রিয়েট করে ফেলেছে। ঠিক করে সবাই মিলে শপিংয়ে যাবে। রিনা শিকদার সায়ানকে বলে তৈমুর কে ডেকে রেডি হয়ে আসতে। সায়ান রিনা শিকদার কে জড়িয়ে ধরে বলে,,,

:-কই চিন্তা নেহি ডার্লিং!! এখনি রেডি হয়ে আসছি‌ ।বলেই ওপরে দৌড় দেয়। শিকদার হাউসের সকলেই হাসতে থাকে সায়ানের কান্ডে!!

চলবে,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব,,,,১৭
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️

ফুল আর ছোট ছোট ফেইরি লাইটে সেজে উঠেছে শিকদার হাউস। বাড়ির বড় মেয়ে তুলির ২৩ তম জন্মদিন আজ। সন্ধ্যার দিকে আমন্ত্রিত অতিথিদের আনাগোনা শুরু হয়। বাড়ির বড়রা অতিথি আপ্যায়নে ব্যাস্ত।
তুলি, রেশমী,সারা তিনজনই তুলির রুমে সাজুগুজু করছে।
তৈমুর দুপুরে একটা ইমার্জেন্সি কেসে হসপিটালে গিয়েছিলো , এখনো পর্যন্ত বাড়িতে এসে পৌঁছায়নি। সেভাবে সায়ানও এখনো আসেনি। তুলি এর মধ্যেই
ভাইকে দু-তিন বার ফোন করে ফেলেছে। তৈমুর জানিয়েছে আধাঘণ্টার মধ্যে শিকদার হাউসে উপস্থিত থাকবে।

সাইফ শিকদার লিভিং রুমে গেস্ট দের সাথে আলাপ করছেন। রিনা আর সিমা শিকদার ব্যাস্ত রান্নাঘরে। দুই জা ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের পছন্দের রান্না করতে ব্যস্ত। বাকি অতিথিদের জন্য ক্যাটারিংয়ের লোকজন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। সিমা শিকদার হাতে কাজ করছেন কিন্তু তার মুখটা কেমন উদাস হয়ে আছে। রিনা শিকদার সেটা খেয়াল করে। মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,,

:-কিরে ছোট! মুখটা এমন লাগছে কেন? কি ভাবছিস এভাবে?

বড় জায়ের প্রশ্নে তার দিকে তাকায় সিমা। মাঝে মলিন ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,,

:-তেমন কিছু না আপা! আজ বাড়ির বড় মেয়েটার জন্মদিন। আর তোমার দেবর দেখো এখনো পর্যন্ত বাড়িতে আসেনি। ওর জীবনে পশুপাখির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় পরিবার তো দুর আমরা মা মেয়েও নয়‌।
রিনা শিকদার ছোট জায়ের অভিমান বুঝতে পেরে খিলখিল করে হাসতে থাকেন। সিমা শিকদার মুখ গোমড়া করে বড় জায়ের দিকে তাকান।

:-আমি কি হাসির কথা বললাম আপা?

রিনা শিকদার হাসতে হাসতে মুখে হাত চেপে বলেন,,

:-তুই কি এখনো ছোট বাচ্চা ছোট??? আলিফ ভাই সেই কখন এসেছেন বাড়িতে‌। তুই দেখিসনি‌। বাড়িতে আসার সাথে সাথেই তোর ভাসুর বাজারে পাঠিয়েছে কোন কাজে। তোর আর অভিমান করে থাকতে হবে না।

সিমা শিকদার বড় জায়ের ঠাট্টায় লজ্জা পায়। মুখটাই লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। কতদিন পর লোকটা বাড়িতে এসেছে!! কিন্তু মনের মাঝে পুষে রাখা অভিমান ফুলে ফেঁপে ওঠে।

****

সায়ানকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে তৈমুর। সায়ান আজ বেশ ফুর্তিতে আছে। গুনগুন করে গানও গাইছে মাঝে মাঝে। চোখ ঘুরিয়ে ড্রাইভ করতে থাকা তৈমুরের দিকে তাকায় সায়ান। তৈমুর একমনে ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। মুখটা যথাযথ গম্ভীর করে রেখেছে। প্রিয় বন্ধুর মনে কি চলে সে বিষয়ে অবগত সায়ান। ফলে মুখের হাসি টা বৃদ্ধি পাচ্ছে মাঝেমধ্যে। সায়ানের দুষ্টু হাসি ঠিকই টের পাচ্ছে তৈমুর। নিরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর স্বরেই বলে,,,

:-এভাবে হাসলে পাছায় লাত্থি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিবো সায়ান!

তৈমুরের কথায় সায়ানের মুচকি হাসি অট্টহাসিতে রুপান্তরিত হয় ‌। হাসতে হাসতে বলে,,,

:- কি মাম্মা! দিলে হরতাল চলে? বাড়িতে ফিরতে ভয় হয়? এমনে পালায় পালায় বেড়াও কেনো চাচা?

সায়ানের কথায় বিরক্তিতে”চ” শব্দ করে ওঠে তৈমুর। মনে মনে ভাবে,,
খুব একটা ভুল বলেনি সায়ান! আজকাল শিকদার হাউসে থাকতে ভয় হয় তৈমুরের। বাড়িতে যে সারাক্ষণ কারো খিলখিল হাসি আর তার উপস্থিতির প্রকোপে কেমন নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। বাড়ির কোথাও গিয়ে শান্তি পায়না। মনে হয় সমস্ত জায়গায় তার শরীরের মেহেক ছড়িয়ে আছে। দিন দিন মনটা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। তাকে একবার নিজের করে পেতে, একবার গভীর ভাবে বক্ষ পিঞ্জরে আটকে নিতে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তাকে নিজের চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে। অপলকে তাকে দেখতে। মাঝে মাঝে তার নরম কোমল ঠোঁটে নিজের পুরুষালী অধরের অবস্থান জারি করতে। নিজেকে যে আর বেশিদিন আটকে রাখা অসম্ভব তা বেশ বুঝতে পারে তৈমুর জাহান শিকদার। সারা কে নিজের বশে করতে যা করার তা দ্রুতই করতে হবে। ভাবতেই ঠোঁটে রহস্যময় হাসি খেলে যায় তৈমুরের।

তৈমুর,সায়ান শিকদার হাউসে প্রবেশ করে তখন রাত আট টা। এরমধ্যেই ছোট-বড় পজিশনের প্রায় সব গেস্টই এসে হাজির । সাইফ শিকদার,আলিফ শিকদার কিছু প্রিমিয়াম গেস্ট দের কে খুবই আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করছেন। আসেপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে।
সায়ান লিভিং রুমে এসেই সাইফ শিকদার আলিফ শিকদারের সাথে কুশল বিনিময় করে নিজেকে সোজা রান্না ঘরে চালান করে। সেখানে রিনা আর সিমা শিকদার তখন প্যানে তেল গরম করে চিকেন ফ্রাই করতে ব্যাস্ত। সায়ান কিচেনে ঢুকেই একটা চিকেন ফ্রাই তুলে মুখে চালান করে দেয়!! তারপর চিবাতে চিবাতে “উমমমম সো ইয়াম্মি” বলে খেতে থাকে। রিনা শিকদার “দুষ্টু ছেলে” বলে সায়ানের বাহুতে চড় দিয়ে হেসে ওঠেন।

:-সত্তি বলছি আন্টি! তোমার হাতের এই ক্রিস্পি ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাইয়ের তুলনায় হয়না। এত্তো ডেলিসিয়াস চিকেন ফ্রাই কি করে করো বলোতো!!

পাশ থেকে সিমা শিকদার আরেকটা চিকেন ফ্রাইয়ের পিচ সায়ানের মুখে তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলেন,,,

:- তুই ঠিকই বলেছিস সায়ান। বড় আপার হাতের সব রান্না কিন্তু আসলেই খুব মজা হয়!!

সায়ান এবার সিমা শিকদারের হাত চেপে ধরে বলে,,

:-আরে ছোট আন্টি! তোমার হাতের যে স্পেশাল আদা “চা” আহা ওইটাও একদম সেরা। ঝটপট এক কাপ চা খাওয়াও তো দেখি!!

সিমা শিকদার সায়ানের প্রশংসায় ভীষণ খুশি হয়ে বলেন,,,

:-আচছা তুই গিয়ে তৈমুরের রুমে গিয়ে বস। আমি চা কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ওক্কে বলে সায়ান কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে।

রিনা আর সিমা শিকদার সায়ানের কান্ডে হাসতে থাকে। আসলেই সায়ানকে শিকদার বাড়ির সকলেই ভীষণ ভালোবাসে। এই শহরে সায়ানের কেউ না থাকায় তারা সায়ান কে বাড়ির ছেলের মতই ট্রিট করে।

সিমা শিকদার সায়ানের গমন পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আনমনে বলেন,,

:-আচছা বড় আপা, একটা কথা বলবো??

রিনা শিকদার কড়াইয়ে খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে বলেন,,

:-হ্যা বল না কি কথা!

:-আপা সায়ান ছেলেটাকে তোমার কেমন লাগে?

সিমা শিকদারের অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকান রিনা শিকদার।

:-কি বলছিস ছোট!! সায়ান ছেলেটার কোন তুলনা হয়? ছেলেটা মনে হয় একদম আমাদের বাড়ির ছেলে। আমরাও তাকে সেভাবেই দেখি। এমন চমৎকার দুষ্টু আর প্রাননবন্ত মানুষ আমি দুটো দেখিনি। আমাদের ছেলেটা তো একদম গম্ভীর ‌। হাসেও মেপে মেপে।
তারপর রিনা শিকদার কিছু একটা ভেবে ফিক করে হেসে বলে,,
:-জানিস ছোট! তৈমুরের পর তুলি যখন পেটে এলো! আমি ভেবেছিলাম এবারো ছেলে হবে‌ তখন মনে হতো পেটের টা ছেলে হলেও যেন তৈমুরের মতো শান্ত না হয়!! একটু দুষ্টু হয়! সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে!! কিন্তু কোলে আসলো ছোট্ট তুলি!! পরপর তোর পেটেও সন্তান আসলো। তখনও মনে হয়েছিল আমার টা হয়নি তো কি হয়েছে। তোরটা যেন হয়! কিন্তু তোর কোলেও আসলো রেশমী। আর এই দুটো দুষ্টুমি করবে কি! দু বোন ছোট থেকেই এক ভাইয়ের শাসনে দুষ্টুমি ছেড়ে ভদ্র মেয়ে হয়ে বড় হলো!! সিমা শিকদার আর রিনা শিকদার দু জায়ের গল্পে গল্পে হাসতে হাসতে নাজেহাল অবস্থা।
কিছুক্ষণ পর সিমা শিকদার বলেন ,,,

:- আমি সেই জন্য বলছিনা আপা! আমি বলতে চাইছি সায়ান কে বাড়ির ছেলে থেকে বাড়ির জামায় করা যায় না? তুমি কি বলো?

সিমা শিকদারের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকান রিনা শিকদার। তারপর বলেন,,,

:-মানে কার কথা বলছিস! আমাদের তুলি?
সিমা মাথা উপর নিচু করে হ্যা বোঝায়।

রিনা শিকদার কিছুক্ষণ ভেবে বলেন,,,

:-এমনটা তো কখনো আমার মাথায় আসেনি!! তবে ব্যপার টা যে খুব অসম্ভব তা নয়! কিন্তু তুই তো জানিস এখনকার বাচ্চা দের। কার মনে কি আছে তারাই জানে। আমরা বললাম পরে দেখা যাবে ওদের মনে হয়তো অন্যকেউ আছে। তখন ছেলেমেয়ে দুটো লজ্জা পাবে। তবে তোর কথা আমি মাথায় রাখলাম। কখনো তেমন সুযোগ হলে প্রস্তাব রাখবো। সায়ান ছেলেটাকে আমারো খুব পছন্দ। এবাড়িতে আসলে কেমন মাতিয়ে রাখে।। আমার মনের অপূর্ণ সুপ্ত ইচ্ছে টা অনেকটা পূরণ করে দেয় এই ছেলেটা।

এমনি বিভিন্ন কথা বলতে থাকে দুই জা!!

তৈমুর গোসল করে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখে সায়ান বিছানার উপর বসে ফোনে স্ক্রল করছে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে কাবার্টের দিকে এগিয়ে যায়। সব জামাকাপড় দেখে দেখে একটা সাদা শার্ট গায়ে চড়ায়। ওপরে এ্যাস কালারের ফরমাল স্যুট প্যান্ট পরে। পায়ে কালো রঙের লোফার। হাতে সিলভার কালারের চেইনের ঘড়ি সাথে চোখে চিকন ফ্রেমের সাদা চশমা। চুলগুলো হেয়ার ড্রাই দিয়ে শুকিয়ে জেল দিয়ে সেট করে নেয়। সবকিছু গোছগাছ করে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে!!

:-তুই কি এভাবেই থাকবি? নাকি ফ্রেস হয়ে চেঞ্জ করবি?

সায়ান এক তৈমুর কে পলক দেখে হাতের ফোনের দিকে মনযোগ দিয়ে বলে,,,

:-আরে এক মিনিট ব্রো!! গেইম ওভার…..ওভার….ওভারররররর!! হা কি যেন বলছিলি? ফ্রেস হতে হবে ক্যা! আমাকে কি এই পোশাকে খারাপ লাগছে? বলে নিজের ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।

তৈমুর বিরক্ত হয়! বিছানায় রাখা সায়ানের কোট টা তুলে সেটা দিয়েই সপাৎ করে এক বাড়ি দেয় সায়ানের পিঠে!!

:-ছি: তুই এতো ম্যাসি ক্যান বলতো!! দুপুর থেকে এই পোশাকে আছিস। তোর গা থেকে ঘামের গন্ধ আসছে!! বলেই নাক চেপে ধরে তৈমুর!

সায়ান হাত উঁচু করে শুকে বলে,,,

:- আহা ! এতো সুন্দর বিদেশি পারফিউমের গন্ধ,,আর তুই তাকে ঘামের গন্ধ বলে অপমান করলি!!! দেখ তো কেমন সুগন্ধ!! বলেই তৈমুরের দিকে এগিয়ে গিয়ে যায় সায়ান।

তৈমুর ছিটকে চার হাত দুরে গিয়ে বলে,,,

:- ছিইইই!! সায়ান সত্যিই আমি তোর পাছায় লাত্থি মেরে শিকদার হাউস থেকে বের করে দেবো!! ইয়াককক🤮

তৈমুরের রিয়্যাকশনে খিকখক করে হাসতে হাসতে বাথরুমে ঢুকে যায় সায়ান।

********

তৈমুর রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই সারাও বেরিয়ে আসে নিজের রুম থেকে। সারা কে দেখে পা দুটো থমকে যায় তৈমূরের। চোখের সামনে যেন কোন সাদা পরী দাঁড়িয়ে আছে। নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় তৈমুর। বুকের ভেতর ড্রাম বাজতে থাকে। হৃদপিন্ড ছলকে বেরিয়ে আসার উপক্রম যেন।

সাদা গাউনে সারাও হুট করে তৈমুরের সামনে পড়ে কেমন মিইয়ে যায়। তৈমুর কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গাল দুটোতে ফুটে ওঠে গোলাপী আভা। হাত দুটো কচলাতে থাকে সারা।

তৈমুর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নেয়!! এগিয়ে যায় সারার দিকে। তৈমুর কে এগিয়ে আসতে দেখে শরীরে শিহরণ খেলে যায় সারার। তৈমুরের শরীর থেকে আসা পারফিউমের গন্ধ আর তৈমুরের নিজেস্ব পুরুষালী গন্ধ নাসারন্ধ্র ভেদ করে মস্তিষ্কে আঘাত হানে সারার। গলা শুকিয়ে আসে। শরীর কাঁপতে থাকে তিরতির করে।
হুট করে তৈমুর সারার হাত চেপে ধরে সারার রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়‌। চোখের পলকে ঘটে যাওয়া ঘটনায় হতভম্ব সারা। পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় তৈমুর দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তৈমুরের। সারা হতবাক হয়ে লজ্জা ভুলে ছুটে যায় তৈমুরের কাছে। হুট করে তৈমুরের বুকে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বলে,,,

:- জাহান ভাইয়া!! কি হয়েছে আপনার? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? খালামণিকে ঢেকে আনবো?
আপনি এভাবে দাড়িয়ে থাকবেন না। আগে বসুন। তৈমুর কে টেনে বিছানায় বসাতে গেলে সারার হাত টেনে থামিয়ে দেয় তৈমুর। সারা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে তৈমুরের দিকে।

তৈমুর কোনরকমে বিড়বিড় করে বলে,,,

:- কাউকে ডাকতে হবে না। কাউকে না,,,

সারা তৈমুর কে বসিয়ে দিয়ে বলে,,,

:- কি বলছেন! আপনি এমন করে হাঁপাচ্ছেন কেনো? আমি খালামণি নয়তো আঙ্কেল কে ডেকে আনি। আপনার নিশ্চয় শরীর খারাপ করছে। আপনি একটু বসুন আমি খালামণি কে ডাকি আর পানি নিয়ে আসি।

সারা আবারো যেতে নিলে আচমকা সারার হাত চেপে ধরে টান দেয় তৈমুর। ফলে সারা নিজেকে সামলে উঠতে না পেরে ব্যালেন্স হারিয়ে তৈমুরের কোলে বসে পড়ে। সারা কোলে বসতেই তৈমুর সারার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়‌।
তৈমুরের কাছে খেই হারায় সারা। শরীরে অদ্ভুত ভাবে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। তৈমুরের এমন ছোঁয়া সহ্য হয়না মেয়েটার। তৈমুর জাহান শিকদারের হলো টা কি!
তৈমুর নিভু নিভু চোখে সারার দিকে তাকায়। সারার শরীর থেকে আসা মিষ্টি সুগন্ধে বেকাবু হয়ে পড়ে মস্তিষ্ক। হালাল সম্পর্কের উস্কানিতে কিছু মিছু করে ফেলতে উতলা হয়ে ওঠে হৃদয়।
এদিকে তৈমুরের এমন কান্ডে অসাড় হয়ে আসে সারা। তৈমুরের গতিবিধি বুঝতে পারছে না বেচারি। তৈমুরের ক্যারেক্টারের বাইরে ঘটছে যেন সবকিছু। সারার মনে হচ্ছে এটা যেন তৈমুর জাহান শিকদার নয়!! এটা তার রুপ ধারণ করা অন্য কেউ। নয়তো তৈমুরের মতো শান্ত গম্ভীর অ্যাংরি বার্ডস এমন অদ্ভুত বিহ্যাভ কেনো করবে??
সারা মুখ ফুটে মিনমিন করে বলতে চায়!

:-কি করছেন; ছাড়ুন।

তা তৈমুর শুনলো কিনা বুঝলো না সারা। একই ভাবে সারার কোমর আঁকড়ে ধরে অদ্ভুত নেশালো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে তৈমুর। নিজ থেকে উঠতে নিলে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে সারার কোমর। সারা বিষ্ময়ে বাকহারা হয়ে যায়। তৈমুরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিতেই তৈমুরের এক অভাবনীয় কাজে ৪৪০ ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে যায় সারার শরীরে‌। চোখ দুটো যারপরনাই বড় বড় হয়ে গেছে সারার। শরীরের তীব্র কাঁপুনি অনুভব করে। অদ্ভুত অজানা অনুভূতি তে ছেয়ে যায় হৃদয়। অসাড় হয়ে আসে পা দুটো।

এদিকে সারাতে হুস জ্ঞান খুইয়ে বসেছে তৈমুর জাহান শিকদার। সারার নরম কোমল ঠোঁট দুটো মনের আকুতি মিশিয়ে শুষে নিতে থাকে তার পুরুষালি অধর দ্বারা। দিন দুনিয়ার হুস নেই যেন তৈমুরের। সারাকে টেনে বুকের সাথে লেপ্টে নেয়। এদিকে সারা বাকহারা। তার সাথে কি ঘটছে,কেনো ঘটছে,কে ঘটাচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। থরথর করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। জীবনে প্রথমবার কোন পুরুষের এমন গভীর ছোঁয়ায় বেকাবু হয়ে উঠেছে যেন‌। নিজ হাত দুটো আপনাআপনি চলে যায় তৈমুরের ঘাড়ে। দু হাতে তৈমুরের গলা জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় নাজুক মেয়েটা। সারার হাত দুটো নিজের ঘাড়ে অনুভব করে আরো উতলা হয়ে উঠে তৈমুর। সারার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। আতঙ্কে, লজ্জায় , অস্বস্তিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সারা‌।

সারার ফুঁপানোর শব্দ কানে পৌঁছাতেই হুস ফিরে তৈমুরের। আসক্তিতে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে বোধগম্য হয়। বিচলিত হয়ে সারার মুখটা দুহাতে ধরে অস্থির হয়ে বলতে থাকে,,,

:-আ’ম সরি! আ’ম সরি। সারা প্লিজ প্লিজ আমি সরি! প্লিজ কাঁদিস না বেবি। আ’ম এক্সপ্লেইন!! সারা আ’ম সরি।

চলবে,,,,,,,

#সারা_জাহান
পর্ব,,,,১৮
মৌমো তিতলী

টিক টিক ঘড়ির কাঁটার সাথে সারার রুমে নেমে এসেছে নিরবতা। সারা এখনো পর্যন্ত মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে কাঠের পুতুলের ন্যায়। অস্ফুট স্বরে হিচকি তুলে কাঁদছে সে।

সারার কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় বোধ করে তৈমুর। দু পা এগিয়ে সারার হাত দুটো আলতো করে ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে নিজে হাঁটু মুড়ে বসে সারার পায়ের কাছে। একই ভাবে সারার হাত দুটো ধরে নরম সুরে বলে,,,

:-কাঁদছিস কেনো তুই? আমি কি তোকে মেরেছি? বকেছি? আদরই তো করেছি একটু। আদর করলে কাঁদতে হয় তোকে না দেখলে জানতাম না।

তৈমুরের কথায় হতভম্ব দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় সারা‌ চোখে তার বিষ্ময়ের ছড়াছড়ি। সারার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার সামনে বসে থাকা মানুষটা তার দেখা সব থেকে অ্যারোগেন্ট, গম্ভীর ডঃ তৈমুর জাহান শিকদার। তার আজকের করা ব্যবহার যেন কোনভাবেই মেলাতে পারছে না সারা। হুট করে কেনোই বা তৈমুর তাকে…. আর এভাবে কথা বলছে! তৈমুরের মুখের দিকে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে সারা।

এদিকে সারার মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট চেপে হাসে তৈমুর।
ফ্লোর ছেড়ে উঠে বিছানায় বসে সারার পাশ ঘেঁষে। এক হাতে সারাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। আরেক হাতে সারার গালটা আলতো করে তুলে ধরে নিজের দিকে।
সারার চোখে চোখ রেখে হাস্কি স্বরে বলে,,,,

:-তুই জানিস সারা কেনো আজ আমি তোর কাছে নিজের একান্ত গোপনীয় অনুভূতি প্রকাশ করলাম??

সারা মাথা নিচু করেই দুপাশে মাতা নাড়িয়ে না জানায়।

তৈমুর আবারো বলে,,,

:-কারণ তুই আমার অনুভূতি আর আমাকে সামলানোর মতো যথেষ্ট বড় হয়েছিস। সারা তুই আমার জীবনে একমাত্র নারী,যাকে আমি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে চেয়ে এসেছি নিজের একান্ত ব্যক্তিগত নারী হিসেবে।

তৈমুরের কথায় অবাক বিস্ময়ে অভিভূতের ন্যায় চেয়ে রয় সারা। কিছু বলবে বলবে করেও গলা দিয়ে স্বর বের হয়না সারার। পরন্তু অদ্ভুত আওয়াজ বের হয় গলা দিয়ে। তৈমুর নিজ হাতের আঙ্গুল আলতো করে চেপে ধরে সারার ঠোঁটের উপর।

:-শশশ আমার কথা শেষ হয়নি। তুই আমার সারা। তোকে ভালোবাসতে,তোকে নিজের করে নিতে,তোর এই ছোট ছোট নরম কোমল হাতের এক একটা স্পর্শ পেতে আমি পুরো দুনিয়া ছুড়ে ফেলতে পারি।
সারার মাথাটা এগিয়ে এনে সারার কপালের সাথে নিজের কপাল লাগিয়ে ধীরে শ্বাস নেয় তৈমুর। অস্ফুট স্বরে বলে,,

:-তুই আমার অধিকার,আমার পাগলামী,আমার এক সমুদ্র অনুভূতি তুই। তুই চাইলেও তুই আমার,না চাইলেও তোর আমি ছাড়া কোন অপশন নেই। তুই সারা শুধু আমাতেই সিমাবদ্ধ। And now do you have any questions or doubts?

এদিকে সারার বেহাল দশা। তৈমুরের কথায় থরথর করে কাঁপছে সারার নরম কোমল শরীর টা। ঢোক গিলে চোখ তুলে তৈমুরের মুখের দিকে তাকায় অতি কষ্টে।
সেখানে তৈমুরের দৃষ্টি আগে থেকেই সারাতে নিবদ্ধ। মিলন হলো দুটো দৃষ্টির। এক জনের চোখে হাজারো প্রশ্ন তো অপর জনের চোখে নেশা, ভালোবাসার নেশা।
তৈমুরের চোখে এতো আবেগ,এতো ভরপুর অনুভূতি আগে কখনো দেখেনি সারা। কোনরকমে বিড়বিড় করে বলে,,,,

:-আপনি সত্যিই আমাকে এতো ভালোবাসেন জাহান ভাইয়া??

সারার প্রশ্নে ঠোঁট এলিয়ে হাসে তৈমুর। দু হাতে সারাকে জড়িয়ে ধরে নিজ বক্ষ পিঞ্জরে। আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় মাথার অগ্রভাগের কেশরাশিতে।সারাও চুপচাপ পুতুলের ন্যায় গুটিসুটি মেরে পড়ে রয় তৈমুরের বুকে।

অন্তরকরণে অসহ্যকর শান্তির ছড়াছড়ি তৈমুরের। বুকটা ঠান্ডা হাওয়ায় দুলিয়ে যায়। অনেক দিনের চাপা একটা পাথর যেন সরে গেছে বুকের ওপর থেকে। ইদানিং নিজের অনুভূতিকে লুকাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলো তৈমুর। তাছাড়া ছাড়া সারার চোখে নিজের প্রতি অনুরাগী দৃষ্টি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি বেচারা প্রেমিক পুরুষ। আপাতত তৈমুরের নিজের নিয়ন্ত্রন হীন অনুভূতির সাথে পরিচয় হোক সারা। তৈমুরের ভালোবাসার অনুভূতিতে গা ভাসাক।
পরে সময় বুঝে বিয়ের বিষয়টিও জানিয়ে দিবে বলে মনে মনে ঠিক করে তৈমুর জাহান শিকদার।

***********
শিকদার হাউসের রুফটফে কেক কাটা হচ্ছে। বাড়ির বড় মেয়ে তুলির জন্মদিন বলে কথা। বার্থডে গার্ল তুলি আজ নীল রঙের লং গাউন পরেছে। চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। গলায় আর কানে ডায়মন্ডের সিম্পল অর্নামেন্টে অপ্সরী লাগছে তুলি কে। ছাদের ঝিলিমির রুপালি আলোয় কানে আর গলার সাদা পাথর ঝিকঝিক করে কিরণ ছড়াচ্ছে। তাতে তুলির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে।শিকদার হাউসের সকলেই উপস্থিত সেখানে। বড় বড় গেস্টদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিজেদের মতো করে পার্টি এনজয় করছে সকলে। ঠিক রাত ১২ টায় কেক কাটা হয়। তুলি এক এক করে বাবা-মা সহ পরিবারের সকলকে কেক খাইয়ে দেয়। তুলি কেও খাইয়ে দেয় সকলে।

ধুর থেকে অপলকে তুলির দিকে তাকিয়ে আছে সায়ান। বুকের বাঁ পাশে অতি যত্নে লালিত প্রেয়সীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সে। হাতে গিফটের প্যাকেট। এখনো পর্যন্ত তুলির হাতে দিতে পারেনি বেচারা। সায়ান কে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকে তৈমুর। তৈমুরের ডাকে ধ্যান ভঙ্গ হয় সায়ানের। হাসিমুখে এগিয়ে যায় সামনে। ততক্ষণে শিকদার হাউসের সকলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। একেক জন একেক অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। তুলির পাশ ফাঁকা হতেই পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায় সায়ান। তুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,,

:-আমার ব্যক্তিগত তুলোর জন্মদিন,আর তাকে স্পেশাল গিফট না দিলে কি হয় বলোতো???

তুলি সায়ানের কথায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,,

:-তোমার বেকার ফ্লার্টিং ছাড়া ভালো কিছু গিফট কি আছে??

তুলির কথায় সায়ান বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে ধরে বলে,,,,

:-হায়য়য় মেরি জান!! আছে তো। আমি তো আমার হৃদয় নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।

:-হাহঃ তোমার এই সরকারি হৃদয় তো অনেককে দিয়েছো। তা কি জানিনা ভেবেছো?

:-তুমি বিশ্বাস করো বা না করো এই সায়ানের হৃদয়ে একটা ব্যক্তিগত চেম্বার আছে। তা শুধুমাত্র আমার প্রেয়সী “তুলোর” নামে বুক’ড। যেখানে তুলো ছাড়া কারো ঢোকার অনুমতি নেই গো!!!

তুলি অবাক হয়ে তাকায় রায়ানের চোখে। সেখানে যেন বিশ্বাসের ছায়া ছাড়া কোন রকম ভনিতা,মজা কিছুই নেই। সায়ান আবারো ফিসফিস করে বলে,,,

:-আমার তুলো কে আমি শুধু ভালোইবাসি না। সে আমার পৃথিবী, আমার এক আকাশ অনুভূতির প্রকাশ। আমার আবেগ ,ভালোবাসা আর হৃদয়ের সহস্র আলোর মিছিল। এক জলন্ত অথচ নরম কোমল অনুভূতির নাম তুলি!!

সায়ানের কথায় তুলির চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। এই একজন মানুষকেই তো সেও চেয়েছে। সে যানে সায়ানের নেচার সম্পর্কে। তাই এতো দিন সায়ানের মুখের কথায় ভরসা করেনি। কিন্তু আজ সায়ানের চোখে সে ফ্লার্টিং নয় বরং সত্যি কারের ভালবাসা দেখেছে। সেটাই যেন তুলির জন্মদিনে পাওয়া সবথেকে মূল্যবান উপহার।

সায়ান হাসিমুখে তুলির হাতে গিফটের প্যাকেট টা তুলে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে,,,

:-হ্যাপি বার্থডে মাই গার্ল!!

*************

জন্মদিনের পার্টি শেষ হতে সব গেস্টরা বিদায় নিতে নিতে রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। বর্তমানে শুনশান নিরবতা শিকদার হাউসের আনাচে কানাচে।
সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে চলে গেছে। সীমা সিকদার হাতের কাজ শেষ করে রুমে এসে দেখে আলিফ শিকদার বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে। হাতে একটা বই। সিমা কোন কথা না বলে ওয়াশ রুমে ঢুকে। প্রায় আধাঘণ্টা পর বেরিয়ে এসে আলিফ শিকদার কে একি ভাবে বসে থাকতে দেখে গলায় কিছুটা তেজ ঢেলে বলে,,,

:-কি ব্যপার! তুমি আজ বাড়িতে থেকে গেলে যে! রাতের আকাশে চাঁদ আজ কোন দিক থেকে উঠলো কে জানে!

অর্ধাঙ্গিনীর গলা শুনে আলিফ শিকদার বেশ বুঝতে পারে গিন্নি বড়ই চটে আছে। গলায় এক বালতি মিষ্টতা ঢেলে তিনি বলেন,,,

:- আমার হুররম তুমি কি খুশি হতে আমি চলে গেলে?

আলিফ শিকদারের কথায় ছ্যাৎ করে ওঠেন সিমা শিকদার।

:-এই,,,এই খরবদার আমাকে এসব ফালতু কথায় গলানোর চেষ্টা করবে না। আমার খুশির পরোয়া করে কে হ্যাঁ? যেন আমার খুশির খুউব পরোয়া করেন উনি!! এলেন আমার কোথাকার সুলতান সুলেমান!! বুড়ো বয়সে ভীমরতি দেখলে বাঁচি না।

বউয়ের অভিমান মিশ্রিত অভিযোগ শুনে গা দুলিয়ে হাসেন আলিফ শিকদার। অর্ধাঙ্গিনীর হাতটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে পাশে বসান। দু হাতে সিমা শিকদারের মুখটা তুলে ধরে বলেন,,

:-তুমি তো আমাকে বোঝো সিমা! আমি জানি তোমার আমার প্রতি অনেক অভিযোগ। আমি হয়তো স্বামী হিসেবে তোমার সকল দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। দিনের পর দিন তোমাকে ছেড়ে, আমাদের ছোট্ট রাজকন্যা কে ছেড়ে এই পরিবারকে ছেড়ে পশুপাখি নিয়ে দুরে থেকেছি। কিন্তু সিমা এটা তো তুমি অস্বীকার করবে না যে, আমি বিয়ের পরে এমন হয়নি। আমি তো বিয়ের আগে থেকেই এমন ছিলাম। তুমি কি ভুলে গেছো আমাদের প্রথম দেখা কিভাবে হয়েছিলো? তোমাদের ভার্সিটি থেকে এই এনিমেল ফার্ম পরিদর্শন করতে এসেই কিন্তু তোমার আমার সাথে প্রথম দেখা।

সে সময় যখন আমাদের দুজনের পরিচয় হয়, তুমি কিন্তু আমাকে এই এনিমেল ফার্মটা নিয়ে ভীষণ এপ্রিশিয়েট করেছিলে। সর্বদা প্রশংসা করতে আমার কাজের। আমিও তো তোমার এই গুন টার প্রেমেই আগে পড়েছিলাম। আমার সাথে একই মতামতে রাখা একটা মিষ্টি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। সংসার করার স্বপ্ন নিয়ে তাকে নিজের জীবনে নিয়ে এসেছিলাম। তাহলে এখন কেন অভিযোগ করো? আমি তো তোমাদের ছেড়ে থাকতে চাইনি। কতবার বলেছি তোমরা গিয়ে আমার সাথে থাকো। বড় ভাইজানও তোমাদেরকে বলেছে আমার কাছে গিয়ে থাকতে। কিন্তু তুমি যেতে রাজি হওনি। তাহলে আজ কেন এতো অভিযোগ??

সিমা শিকদার ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকায়।

:-সেটা সময় আলাদা ছিল আলিফ। কিন্তু এখন আমাদের মাথার উপরে আমাদের মেয়ের দায়িত্ব আছে। আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যৎ আছে। তুমি যে দিনের পর দিন নিজের পরিবার ছেড়ে, নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে, ব্যবসায় নিজের অংশ ছেড়ে এভাবে ছন্নছাড়ার মতো বাইরে গিয়ে ফার্ম হাউসে পড়ে থাকো, তাহলে আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যৎ কি হবে বলতো? তবুও আমি চেয়েছিলাম আমাদের মেয়েটাকে এ বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকার তৈমুরের জাহান শিকদারের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে। কিন্তু সেখানেও তা সম্ভব হয়নি। তোমার মেয়ের জেদ আর সারার কারণে। বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার আগেই সে জায়গাটা সারার হয়ে গেলো। আর আমাদের মেয়েটাও জেদ ধরে বসে থাকলো তৈমুর কে নাকি সে ভাই ছাড়া কিছু ভাবতে পারবে না। তাহলে আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যৎ টা কি হবে?

আলিফ সিকদার সীমা শিকদারের কথা শুনে মুচকি হাসেন। রেগে না গিয়ে ধৈর্য নিয়ে অর্ধাঙ্গিনীকে বোঝান। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,,

:-তুমি এমনটা কেন ভাবছো সীমা? আমাদের মেয়ে সিকদার বাড়ির মেয়ে! সে কি পথে পড়ে আছে? তুমি কেন ভাবছো আমাদের মেয়েটার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত! আচ্ছা একটা কথা বলতো তুমি, তুমি তো এই পরিবারে আমার থেকে বেশি সময় কাটিয়েছো। এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে তুমি আমার থেকেও বেশি চেনো, জানো। তাহলে এমন একটা আশঙ্কা তুমি কিভাবে নিজের মাথায় নিয়ে ঘুরছো? আমি বছরের পর বছর সবকিছু ছেড়ে বাইরে থেকেও কখনো এমন আশঙ্কা করিনি। সেখানে তুমি যাদের মাঝে থাকো যাদেরকে চোখের সামনে দেখো তাদেরকেই চিনলে না??
তোমার কি বড় ভাইজান কে দেখে কখনো মনে হয় তিনি আমাদের ঠকাবেন? জানো সীমা! বাবা-মা যখন মারা যায় তখন আমি একেবারেই ছোট। বড় ভাইজান সেই মানুষ, যিনি আমাকে মা বাবার ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন। কখনো আমার কোন ইচ্ছে অপূর্ন রাখেননি। আমার কোন স্বপ্ন অপূর্ন রাখেননি। আর তৈমুরের কথা যদি বলো, তুমি হয়তো জানো না আমাদের পারিবারিক ব্যবসায়ে আমার অংশটুকুর অর্ধেকটা তৈমুর আগেই আমাদের মেয়ে রেশমির নামে উইল করে দিয়েছে। বাকি অর্ধেকটা আমার নামেই আছে।

আলিফ সিকদারের কথা শুনে বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে সীমা সিকদার। স্বামীর কথা শুনে নিজের ভাবনার কথা স্বরণ হতেই ভীষণ লজ্জিত হন। তার দুচোখে অবিরত ঝরতে থাকে অশ্রু। আলিফ সিকদার সীমা শিকদারের মনের অবস্থা বুঝতে পারেন। দুহাতে অর্ধাঙ্গিনীর কপোল থেকে অশ্রু মুছে দেন আলতো হাতে। কপালে চুমু এঁকে গভীর আবেশে বুকে জড়িয়ে নেন স্ত্রীকে। কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলেন। তাতে সিমা শিকদারের ফর্সা গাল দুটো লাল হয়। লজ্জা লুকাতে সেই স্বামীর বুকেই মুখ লুকান তিনি।

চলবে,,,,