#সারা_জাহান
পর্ব,,,১৯
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেলো। তুলির জন্মদিন উপলক্ষে বেশ কয়েকদিন ভার্সিটি থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলো শিকদার বাড়ির তিন কন্যা।
কিছুক্ষণ আগেই তৈমুর তুলি, রেশমি, আর সারাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে গেলো।
তিনজন যে যার মত নিজেদের ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে গেল। তুলি, রেশমি সেম ইয়ার হলেও একই ডিপার্টমেন্টে নয়। তুলি বায়োলজির স্টুডেন্ট আর রেশমি ইকোনমিক্সের।
ক্লাসরুমে ঢুকেই ঘাড়ের ব্যাগটা বেঞ্চের উপর রেখে ধপ করে বসে পড়ে রেশমী। মাথার উপরে পাখা ঘুরছে তবুও আজ বেশ গরম। কিছুটা সুস্থির হতে মুখের ঘাম টুকু ওড়না দিয়ে মুছে নেয়। এমন সময় রেশমির সবথেকে কাছের বন্ধু বান্ধবীরা হুড়মুড় করে ক্লাসে ঢোকে।
সালমা, নিশি, রাতুল, নিরব সবাই এক এক করে এসে আশেপাশে বসে পড়ে। এক এক জন এক এক প্রশ্নই ঝালাফালা করে দেয় রেশমীকে।
রাতুল রেশমির মাথায় টোকা দিয়ে বলে ,,,
:-কিরে রেশমি চুড়ি এদ্দিন পর কইত্তে আইলি? পড়াশোনা সব শিকেই তুইলা ছুটি কাটাইতাছস বেডি।
রেশমি বিরক্ত হয়ে বলে,,,
:- এমন ভাবে বলছিস যেন তোরা জানতিস না আমি কেন ছুটি নিয়েছি! তুলি আপুর বার্থডে ছিল।
সালমা বিরক্ত হয়ে বলে,,,
:- এই রাতুল তুই রেশমীকে এভাবে বিরক্ত করছিস কেন। তুই সবসময়ই এমন করিস!
রাতুল আবার সালমার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,,
:- তুই চুপ কর চামচা!
নীরব বলে,,,
:- যাই বলিস রেশমি তোকে আমরা ভীষণ মিস করেছি। তবে আমাদের থেকেও বেশি আরও একজন মনে হয় তোকে খুউব মিস করেছে! বলেই খিক খিক করে হাসতে থাকে।
নিরবের কথায় রেশমি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিরবের দিকে।
বন্ধুদের মধ্যে নিশি মেয়েটা একটু চুপচাপ স্বভাবের। সে শুধু বন্ধুদের কথা শুনে আর হ্যাঁ, হু ,না তে জবাব দেয়। কথা বলে খুব কম। পড়াশোনায়ও বেশ ভালো নিশি। চোখে পাওয়ার ওয়ালা চশমা থাকে সবসময়। এই মুহূর্তে বন্ধুদের কথায় নিশি ঠোট চেপে মিচমিচ করে হাসি দিচ্ছে।সালমা আর রাতুলেরও একই অবস্থা।
বন্ধুদেরকে পর্যবেক্ষণ করে রেশমি বলে,,
:-কার কথা বলছিস তোরা?? আমাকে আবার কে মিস করেছে?
রাতুল গলা ঝেড়ে বলে,,
:- ইয়ে মানে তুই তো এই কয়দিন ভার্সিটিতে আসিস নি। তাই ম্যাথমেটিক্যাল ইকোনমিক্সের বিখ্যাত, স্বনামধন্য দ্য গ্রেট এরোগ্যান্ট অ্যাটিটিউডের ডিব্বা,,, স্যার তালহা এহমাদ আপনাকে স্মরণ করিয়াছেন মহারানী ভিক্টোরিয়া!!
রেশমি মাত্রই বোতলের মুখ্খা খুলে পানি খেতে নিয়েছিলো ,রাতুলের কথায় পানি নাকে মুখে উঠে বিষম লেগে গেলো। মাথার তালুতে হাত চেপে জোরে জোরে কাশতে থাকে রেশমি। কাশতে কাশতে চোখে পানি এসে যায়।
সালমা,নিশি ঘাবড়ে গিয়ে রেশমির পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।
রেশমি কিছুটা সুস্থির হয়ে অবাক হয়ে বন্ধুদের দিকে তাকায়। এদিকে মনে মনে ভাবছে “এই ব্যাটা আবার আমাকে কেন খুঁজবে!!
ক্লাসে তো একটুখানি এদিক ওদিক হলেই শকুন দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ তো নয় যেন সিসি ক্যামেরা। কিন্তু এত স্টুডেন্টের ভেতরে রেশমি আসেনি সেটা নোটিশ করেছেন স্যার। কেমন অজানা এক অনুভূতিতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠে রেশমির। রাতুল হেসে বলে,,,
:- গত দিন ক্লাসে এসে স্যার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। পরে আমাকে আর সালমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছিলো তুই ভার্সিটিতে আসিস না কেন? তোর কিছু হয়েছে কিনা।
সালমা এগিয়ে এসে রেশমির পাশে বসে ঘাড়ে হাত চেপে বলে,,
:-রাতুল ঠিকই বলেছে রেশমি। আমরা তো বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, তালহা এহমাদ স্যার! যে কিনা কোন ছাত্রীকে পরোয়া করে না! এত এত মেয়েরা ক্রাশ খেয়ে হুমড়ে পড়ে, কত কথা বলে, স্যার কখনো কাউকে পাত্তা দেয় না। চোখ তুলেও তাকায় না। সেই স্যার কিনা নোটিশ করেছে তুই ভার্সিটিতে অ্যাবসেন্ট। আবার আমাদের দেখে জিজ্ঞাসাও করলো। ব্যাপারটা কি বলতো???
রেশমি উদাস হয়ে বলে,,,
:- আমি কি করে বলবো? হয়তো সামনে ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। এই সময় এবসেন্ট দেখে জিজ্ঞাসা করেছে..
নাকের উপরে চশমাটা ঠেলে দিয়ে নিশি মিন মিন করে বলে ওঠে,,,
:-আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। বিষয়টা খুবই সিরিয়াস। Otherwise, I never want to know about any student separately, Tanha Ehmad Sir!!!
রেশমি গম্ভীর মুখে বলে,,
:- তোদের কি মনে হচ্ছে না তোর একটু বেশি বেশি ভাবছিস!
নিরব কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ক্লাসে ট্রেড টিচার চলে আসেন। নিজেদের কথোপকথন সেখানেই স্থগিত রেখে ক্লাসে মন দেয় তারা।
*********
সারা আর সামিরা প্রথম পিরিয়ডের ক্লাস শেষ করে বাইরে আসে। নিজ ডিপার্টমেন্টের লবিতে এসে দাঁড়ায়। সামনে একটা ঝাঁপালো বকুল গাছ। গাছের নিচে গোল করে স্টুডেন্টদের বসার জন্য সিমেন্টের বাধানো বেঞ্চ বানানো আছে। তার উপরে গুটিকয়েক বকুল ফুল পড়ে আছে। সারা এগিয়ে গিয়ে বসে। কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে হাতে তুলে নিয়ে নাকে চেপে ধরে। বকুল ফুলের মিষ্টি সুবাস ভীষন পছন্দের সারার। সামিরা এগিয়ে এসে বসে।
ঝিরঝির করে হাওয়া বইছে। সকালের দিকে ভ্যাপসা গরম থাকলেও এই মুহূর্তে ঝিরিঝিরি বাতাসে বেশ ঠান্ডা হয়েছে আবহাওয়া। অন্তত সারার তাই মনে হলো। সারার মুখে আজ অদ্ভুত একটা খুশির ঝলক দেখে সামিরা। প্রিয় বান্ধবী কে এতো সুখী সুখী ভাব আগে কখনো লক্ষ্য করেনি সে। সারার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,,,
:-কি ব্যপার ম্যাম! আজ মুখটা যেন আলাদায় গ্লো করছে। মাঝেমধ্যে আবার ব্লাস করছেন মনে হচ্ছে। ভাবসাব তো খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না।
সামিরার কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সারা। সামিরা ভ্রু নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে?
লুকাই না সারা। একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে অবলিলায় শেয়ার করে প্রেমিক পুরুষ তৈমুর জাহান শিকদারের কথা। গতদিনে ঘটা সবকিছু। ঘটনা শুনে লাফিয়ে ওঠে সামিরা। মুখ চেপে ধরে বলে,,,
:-কি বলছিস!! আল্লাহ! তৈমুর ভাইয়া তোকে ভালোবাসে বলেছে?
সারা লজ্জা রাঙ্গা মুখ ওপর নিচে করে হ্যাঁ জানায়।
:-আহ! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না সারা। তুই জানিস সুন্দরবনের ওই ইনসিডেন্সের সময় তৈমুর ভাইয়ার বিহেবিয়্যর দেখে আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, তোর প্রতি তৈমুর ভাইয়ার এই চিন্তা, কেয়ার শুধুমাত্র কাজিন বলে না। এর উপরেও কোন কিছু আছে। সেটা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি।
সামিরার কথাই ভ্রু কুচকে তাকাই সারা। সুধায়,,
:-কেনো সেখানে কি করেছিলেন তিনি?
সামিরা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে বলে,,
:-সেকি তুই জানিস না? সুন্দরবনে যখন তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন, আমিই ফোন করে জানিয়েছিলাম তৈমুর ভাইয়াকে। প্রিন্সিপাল স্যার তো জানাতে দিচ্ছিলেন না। তৈমুর ভাইয়াকে জানাতেই সাড়ে চার ঘন্টার রাস্তা কিভাবে যে দু’ঘণ্টায় তিনি পৌঁছে ছিলেন আল্লাহই ভাল জানে। তাকে দেখে মনে হয়েছিল যেন উড়ে এসেছেন।
আর এসেই সে কি হুঙ্কার। প্রিন্সিপাল স্যারকে তো পারেন না তিনি পদ্মা নদীতে ছুড়ে ফেলেন.. বারবার শাসাচ্ছিলেন, তোর যদি কিছু হয় তাহলে কাউকে ছেড়ে দেবে না।
পরে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন তো তৈমুর ভাইয়া চপারের ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। পুরো জঙ্গল দেখবেন বলে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তারা প্রথমেই ক্লু পেয়ে গিয়েছিলেন। ওই যে হসপিটালের ছেলেটা মুকুল না কি যেন নাম, তাকে ফলো করেই তো তোর পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। গিয়ে যখন দেখলেন ছেলেটা তোকে ড্রাগ ইঞ্জেক্ট করেছে, তৈমুর ভাইয়া ছেলেটাকে কি মার মারলো, পুলিশদেরকেউ তোয়াক্কা করেননি। মারতে মারতে ছেলেটার হাত ভেঙে দিয়েছিলেন। বারবার বলছিলেন তোর সাহস কি করে হয় ওকে ছোঁয়ার! কি যে ভয়ংকর দেখাচ্ছিলো তখন তৈমুর ভাইয়াকে। উনি তোকে যেভাবে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে রেখেছিলেন তখন আমার মনে হয়েছিলো উনি কেবল তোকে কাজিন মনে করেন না। হয়তো তিনি তার থেকেও বেশি কিছু মনে করেন তোকে। কিন্তু হতে পারে সেটা আমার মনের ভুল তাই বেশি কিছু ভাবি নি।
বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে সামিরার কথাগুলো শুনলো সারা। তার দু’কান কে যেন বিশ্বাস করাতে পারছিলো না। জাহান ভাইয়া তার জন্য এতো পাগলামী করেছিলো!!
বুকের ভেতর তিরতির করে কাঁপতে থাকে সারার। মানুষ টা তাকে এতো ভালোবাসে,সে কিনা বুঝলোই না।
আবেগে তো দুচোখ ভরে আসে সারার।
******
চতুর্থ পিরিয়ডে ক্লাসে প্রবেশ করেন ম্যাথমেটিক্যাল ইকোনমিক্সের টিচার তালহা এহমাদ স্যার। কলেজের সুদর্শন ব্যাচেলর টিচারদের মধ্যে টপ লেভেলের স্থানে রয়েছেন তালহা এহমাদ। ভার্সিটির বহু সুন্দরী ছাত্রীর নজরে আছেন তিনি। তবে তার নজরে হয়তো কোন একজন আটকে আছে। তাই বাকিদের কে নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না তিনি।
ক্লাসের ঢুকেই তার চোখ যায় নির্দিষ্ট একটা বেঞ্চের দিকে। কাঙ্খিত রমণীকে বসে থাকতে দেখে সকলের অগোচরেই বুক ভরে চাপা শ্বাস ফেলে তালহা এহমাদ। নিজ হৃদয় সম্পর্কে জ্ঞাত হন, কয়েকদিনের অস্থিরতার ছিটেফোঁটাও কাজ করছে না এই মুহূর্তে।
চুপচাপ সাবলীল ভাবে ক্লাস শেষ করেন তিনি। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তের থমকে দাঁড়ান। গম্ভীর স্বরের বলেন,,,
:-মিস রেশমি শিকদার! পাঁচ মিনিটের মধ্য আপনাকে আমার কেবিনে উপস্থিত চাই! Please come soon!!
তালহা স্যারের গম্ভীর স্বরে হিচকি উঠে যাওয়ার উপক্রম রেশমির।
নিরব রাতুল খিক খিক করে হাসে। ভ্রু নাড়িয়ে বোঝায় “কি বলেছিলাম না” 😄
অদ্ভুত অস্থিরতা আর ভয়ের হাত-পা কাঁপছে রেশমি। স্যার ঠিক কি কারণে তাকে ডাকতে পারে কোন আইডিয়া আসছে না। সালমা আর নিষিদ্ধ হাত ধরে অস্থির কন্ঠে বলে,,,
:-ধুর ভাল লাগছে না বাল। আমি কি কোন ভুল করেছি? মানে আমার দ্বারা কোন অপরাধ হয়েছে কি? বল না স্যার আমাকে কেন ডাকছে?
নিরব বলে,,
:- সেটা তো গেলে তবেই জানতে পারবি। সময় কিন্তু আর দুই মিনিট! এরই মধ্যে তিন মিনিট পার করে ফেলেছিস তুই।
আঁতকে ওঠে রেশমি। তড়িঘড়ি উঠে দৌড় লাগায় সে। গন্তব্য তালহা এহমাদ স্যারের কেবিন।
এদিকে রেশমি যেতেই হু হা করে হেসে ওঠে বন্ধুরা মিলে।
আপাতত তালহা স্যারের কেবিনের বাইরে পায়চারি করছে রেশমি। ঢুকবে কি ঢুকবে না সেটা নিয়েই কনফিউজ সে। মুহূর্তের ভিতর থেকে গম্ভীর সরে আওয়াজ আসে,,,,
:- বাইরে পাইকারি না করে ভেতরে আসুন রেশমি!!
থতমত খেয়ে যায় রেশমি। স্যার কি করে বুঝলো সে বাইরে আছে। বেশিক্ষণ ভাবাভাবি না করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রেশমি।
স্যার তালহা এহমাদ টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাত পকেটে রাখা। আরেক হাতে পেপার ওয়েট নিয়ে টেবিলের কাচের ওপরে ঘোরাচ্ছেন। সাদা শার্ট আর এ্যাস কালারের প্যান্টে অমায়িক দেখতে লাগছে তাকে। এলোমেলো চুল গুলো একটু বেশিই বড়বড়। কপালের ওপর পড়ে আছে একগুচ্ছ চুল। বাড়তি কোন স্টাইল নেই। অথচ তার নজর কাড়া সুদর্শন চেহারা, ধূসর চোখ আর এই এলোমেলো স্টাইলের খাদে পড়ে হাবুডুবু খায় শত শত মেয়েরা।
রেশমি মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। স্যার কিছু বলছে না দেখে মাথাটা সামান্য উঁচু করে স্যারের দিকে তাকাই রেশমি। চোখাচোখি হতেই বুঝতে পারে স্যার এতক্ষণ তার দিকেই দেখছিল নজর পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয় তালহা এহমাদ। গমগমে সুরে বলে,,,
:-Why didn’t you come to the university for a week?
তালহা এহমাদের গম্ভীর স্বরে সামান্য কেঁপে ওঠে রেশমি। মিন মিন করে বলে,,,
:-I had to take leave, sir, because it was my sister’s birthday.,
:- সে তো একটা দিন। বোনের একদিনের বার্থডের জন্য এক সপ্তাহ ছুটি?? Are you still serious about your studies?
:-স্যার! আম সরি আস…..
:- Where is your phone?
:-জ্বী???
:-ফোন কোথায় আপনার? Give me your phone!
রেশমি তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে লক খুলে তালহা স্যারের হাতে দিয়ে দেয়।
ফোনের ওয়ালপেপারে রেশমির গোলাপী ঠোঁট দুটো পাউট করে তোলা একটি ছবি সোভা পাচ্ছে। এদিকে তাকিয়ে চকিতে একবার রেশমির দিকে তাকাই তালহা।
বর্তমানে মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরপর আবারও ছবিটার দিকে তাকায় তালহা। রেশমির অগোচরে ঢোক গিলে দন্ত দ্বারা নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। ফুসস করে শ্বাস ফেলে ফোনে নিজের কাজের দিকে মনযোগ দেয়! কিছুক্ষণ পর ফোনটা আবারো রেশমির হাতে তুলে দিয়ে বলে,,,
:-এরপর থেকে কখনো ছুটির প্রয়োজন হলে বা ছুটি নিলে আমাকে ফোন করে জানাবে। I repeat, call me and let me know….you understand what I mean??
রেশমি একবার চোখ তুলে তাকাই স্যারের দিকে। আবারো মাথা নিচু করে বলে,,,
:জ্বী,,,জ্বী স্যার!
:-,Okay, you can go now.!!
স্যারের বলতে বাকি, মুহূর্তেই উধাও হয়ে রেশমি। এতক্ষন যেন নিঃশ্বাসটা গলার কাছে আটকে ছিলো। বাইরের এসেই বড় বড় শ্বাস ফেলে রেশমি। তাকে দেখে বোধ হয়, সিংহের গুহা থেকে ভাগ্যক্রমে জান নিয়ে ফিরেছে। রেশমি লবিতে এসে দাঁড়াতেই সালমা নিশি নিরব রাতুল হুড়মুড়িয়ে এসে ঘিরে ধরে তাকে। সালমা পানির বোতল এগিয়ে দিতেই তা ছো মেরে হাতে নেয় রেশমি। ঢকঢক করে পুরোটাই শেষ করে দম দেয়।
*********
রাতের খাবার শেষ করে শিকদার হাউসের প্রত্যেকে নিজ নিজ কামরায় চলে গেছে। সারা, রেশমি নিজ নিজ কক্ষে পড়াশোনা করতে ব্যস্ত। তৈমুর এখনো বাড়ি ফেরেনি। প্রায়ই তার হসপিটাল থেকে ফিরতে রাত ১২ টা পার হয়। হসপিটালে ইমার্জেন্সি থাকলে তো কথায় নেই। সে রাতে বাড়ি ফিরবে কিনা তারও গ্যারান্টি থাকে না।
এমন সময় নিঃশব্দে ছাদে পা রাখে তুলি। ছাদের উপরে অনেক ধরনের ফুল ফলের গাছ। এগুলো মুলত সারার জন্য। সারার ফুল বাগানের শখ আছে বিস্তর। ফুল ফলের গাছ গুলো এনে দিয়েছে তৈমুর ভাইয়া। ছাদে পা রাখতেই গন্ধরাজ ফুলের মনমাতানো মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা খায়। মৃদু বাতাস বইছে। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ খুব বেশি জোৎস্না দিতে পারেনি। তবুও চারপাশ টা বেশ পরিস্কার। তুলি এগিয়ে গিয়ে পাশে রাখা দোলনায় বসে পড়ে। হাতে ফোন বিদ্যামান। কিছুক্ষণ দোনামোনা করে ডায়াল করে কাঙ্খিত নাম্বারে। রিং হতেই ওপাশ থেকে কোন মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে আসে,,
“The number you dialed is currently busy”
থেমে থেমে কয়েকবার কল করলে একই জবাব ভেসে আসে। বিরক্ত হয় তুলি। কোথায় কথা বলছে এতো যে ১০ মিনিট ধরে ব্যাস্তই দেখাচ্ছে। মেজাজ খারাপ করে গটগট করে ছাদ থেকে নেমে গেলো সে। নিজ কামরায় প্রবেশ করেই ধামম করে দরজা লাগিয়ে এসে শুয়ে পড়ে। আপাতত পড়তে বসেও লাভ হবে না জানে সে। ফোনটা অফ করে বালিশের পাশে রেখে চোখ বন্ধ করে।
চলবে,,,,
#সারা_জাহান
পর্ব,,,২০
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পার্কিং লটে আসতেই তৈমুরের চক্ষুগোচর হয় সায়ান কে। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে অনবরত কল করে যাচ্ছে। চোখে মুখে কেমন উদ্বিগ্নতা। তৈমুর কে খেয়াল করেনি সায়ান। কাঁধে হাত রাখতেই কেমন চমকে গেলো যেন। ভ্রু কুঁচকে তাকায় তৈমুর।
:-What’s wrong with you? You look worried! Is everything okay?
তৈমুরের প্রশ্নে কেবল বোকা বোকা হাসে সায়ান। যেন কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তৈমুরের শাণিত দৃষ্টি তখনও সায়ানের ওপরেই নিবদ্ধ।
:-কোন সমস্যা নেই। চল অনেক রাত হয়ে গেছে।
:-Are you sure?
:-আরে হ্যাঁ হ্যাঁ চল তো!!
তৈমুর আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে।
তৈমুর যখন বাড়িতে পৌঁছায় তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১২ টার কোটায়। ড্রইং রুম পেরিয়ে ওপরে উঠে আসে ধীরে পায়ে। সারার রুমের সামনে দাড়াতেই বুঝতে পারে ভেতরে আলো জ্বালানো। মানে সারা এখনো জেগে। আলতো হাতে দরজা ঠেলে দিতেই সারাকে পড়ার টেবিলে দেখতে পায়। মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখছে। ছেড়ে রাখা লম্বা চুল গুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। অক্লান্ত চোখে সেদিকে তাকিয়ে রয় তৈমুর।
কিছুক্ষণ পর হালকা কাশি দিয়ে সারার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সারা তাকাতেই ধীরস্বরে বলে,,,
:-একটা স্ট্রং ব্ল্যাক কফি করে আমার রুমে দিয়ে যা তো।
বলেই সারার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের রুমে চলে গেলো তৈমুর।
সারা ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। পরক্ষনেই তৈমুরের কফির কথা স্বরণ হতেই দৌড়ে নিচে আসে। কিচেনে ঢুকেই তৈমুরের কথামতো কফি বানিয়ে ওপরে আসে। দরজায় টোকা দিয়ে উত্তর না পেয়ে আস্তে আস্তে ভেতরে প্রবেশ করে সারা।
ওয়াশ রুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। বুঝতে পারে তৈমুর শাওয়ার নিচ্ছে। কফি রেখে চলে যাবে নাকি অপেক্ষা করবে কনফিউজড হয়ে যায় সারা। সেন্টার টেবিলের ওপর কফির মগটা রেখে ঘুরে দাড়াতেই ধাক্কা খায় তৈমুরের প্রশস্ত বুকে। নাক কুঁচকে ওপরে তাকাতেই প্রথমেই নজরে আসে তৈমুরের উদাম খোলা বক্ষ। আরো ওপরে তাকাতেই চোখে চোখ আটকে যায়। ভেজা চুল থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে মুক্ত দানার মতো পানির ফোঁটা। চুয়ে পড়ছে গলা বেয়ে বুকে। চোখ খিচে বন্ধ করে নেয় সারা। হুট করে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। তৈমুর বাঁকা হেসে হেঙ্গার থেকে একটা টিশার্ট নিয়ে পরে নেয়। ডিভানে বসে সারাকে ডাকে,,
:-আর লজ্জা পেতে হবে না। এবার তাকাতে পারিস!!
তৈমুরের কথায় আরো বেশি লজ্জা পায় সারা। ঘুরে তৈমুরের দিকে তাকাতেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকে তৈমুর,,,
:-কাম!
আলতো পায়ে হেঁটে যায় সারা। তৈমুরের কাছাকাছি আসতেই হাত ধরে টেনে কোলের ওপরে বসিয়ে দেয় সারাকে ।
তৈমুরের কাজে হতভম্ব হয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকে সারা। বুকের ভেতর হাটুড়ি পেটাচ্ছে। পেটের ভেতর কেমন গুড়গুড় করছে। অদ্ভুত লাগছে সারার।
তৈমুর হাতের তোয়ালে টা সারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে ,,,
:-মুছে দে! বলেই কফির মগটা হাতে নিয়ে সিপ নিতে থাকে।
সারা চুপচাপ কথা শোনে। আলতো হাতে তৈমুরের ভেজা চুল মুছতে থাকে। ততক্ষণে কফি টা শেষ করে পাশে রেখে দেয় তৈমুর।
কিছুক্ষণ পর মিনমিন করে বলে,,
:-হয়ে গেছে জাহান ভাইয়া!
এতক্ষন চোখ বন্ধ করে প্রেয়সীর হাতের স্পর্শ অনুভব করছিলো তৈমুর। সারার কথায় চোখ মেলে তাকালো। সারার হাত থেকে তোয়ালে টা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে ফেললো। সারার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মুখ নিচু করে বসে আছে সারা।
অধর প্রশস্ত হয় তৈমুরের। তার ছোট্ট বউটা লজ্জা পাচ্ছে।
তৈমুর দুহাতে সারার কোমরটা একটু কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে। শিউরে উঠে সারা। পরপর শুনতে পায় তৈমুরের হাস্কিটোন,,,
:-আমার দিকে তাকা?
সারা সময় নিয়ে তাকাই তৈমুরের চোখে।
তৈমুর সারাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। আলতো হাতে সারার মুখের পাশে ঝুলে থাকা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞাসা করে,,
:-রাতে খেয়েছিলি?
:-হুম। মাথা নাড়িয়ে জানায় সারা।
:-পরিক্ষা শুরু হতে কতদিন বাকি?
:-দু সপ্তাহ।
:-পড়াশোনা হচ্ছে?
আবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায় সারা।
তৈমুর হেসে ওঠে। সারার কপালে চুমু এঁকে নেশাক্ত কন্ঠে বলে,,
:- you miss me, babe?
I missed you so much!!
বুকটা ধড়াস করে ওঠে সারার। পা দুটো ভেঙে আসতে চায় যেন। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করতে চায়।
সারার কামড়ে ধরা অধরের দিকে নজর পড়তেই গলা শুকিয়ে আসে তৈমুরের।
পলক ঝাপটে তৈমুরের দিকে তাকাতেই তৈমুর সারার অধরজোড়া আঁকড়ে ধরে। তৈমুরের ঘাড়ের কাছে টিশার্ট খামচে ধরে সারা। অস্থির হয়ে ওঠে তৈমুর। সারার পা দুটো দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে আরো কাছে টেনে নেয়। তিব্রতার সাথে পান করতে থাকে প্রেয়সীর অধরসূধা। সারা ছাড়া পেতে ছটফট করে ওঠে। নড়াচড়া টের পেতেই শান্ত হয়ে ওঠে তৈমুর। সারার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,,
:-আই লাভ ইউ বেবে!! I love you very much to the extreme….
সারা ঠোঁট এলিয়ে হাসে। আলতো করে জড়িয়ে ধরে তৈমুর কে। তৈমুর আবারো বলে,,,
:-ডু ইউজ লাভ মি বেবে??
সারা লজ্জায় তৈমুরের গলায় মুখ গুজে কোনরকমে শব্দ বের করে গলা দিয়ে,,,
:-উমমমম!!!
:-উমম কি? মুখে বল?
সারা অস্ফুট স্বরে বলে,,,
:-আমি…আমার লজ্জা লাগছে 🙈
আমাকে নয়তো কাকে বলবি জান? লজ্জা পেলে চলবে না। মুখে বল আমাকে?? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল!!
সারা আলতো চোখে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,,
:-ভা..ভালোবাসি।
:-কি ভারোবাসিস? বল আমি তোমাকে ভালোবাসি তৈমুর জাহান।
সারার গাল দুটো জ্বলে ওঠে। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সে। তবুও ছাড় দিচ্ছে না নিষ্ঠুর পুরুষ টা। যেন মুখ থেকে শুনেই ক্ষান্ত হবে। তৈমুর এখনো তাকিয়ে আছে সারার মুখের দিকে।
:-আমি আপনাকে ভালোবাসি জাহান ভাইয়া!!
সারার কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে তৈমুর। তার প্রেয়সীর বোকা বোকা কথায় শরির দুলিয়ে হাসতে থাকে।
তৈমুর কে এভাবে হাসতে দেখে মোহগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে রয় সারা। জাহান ভাইয়া এভাবে হাসতে পারে!! এটা ভেবেই পুলকিত হয় অন্তর। এই নির্মল হাসি তে কি সুন্দরই না লাগছে তার প্রেমিক পুরুষ কে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সারা।
তৈমুর হাসতে হাসতেই বলে,,,
:-আপনাকে ভালোবাসি জাহান ভাইয়া!!!!! ভালোবাসি বলছিস আবার ভাইয়াও বলছিস।
আবারো লজ্জা পায় সারা। মিনমিন করে বলে,,,
:- অভ্যাস তো!!
:-আচছা আচ্ছা। লজ্জা পেতে হবে না। যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ আর রাত জেগে পড়তে হবে না।
সারা ঘাড় নেড়ে বলে,,
:-আচছা।
মৃদু পায়ে তৈমুরের কামরা থেকে বেরিয়ে আসে সারা। প্রেয়সীর প্রস্থান হতেই সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈমুর। আহ! কবে যে মেয়েটা তার সাথে তার ঘরে থাকবে!! মনটা বড্ড ব্যাকুল হয় আজকাল মেয়েটাকে কাছে পেতে। হৃদয় পোড়ে। ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষায় শুকনো মরুভূমির মতো হাহাকার করে ত্রিশ বছরের তাগড়া যুবোকের প্রেমিক সত্ত্বা। মেয়েটা তার জন্য হালাল হওয়া সত্ত্বেও পারে না কাছে টেনে নিতে। বুকের বাঁ পাশে শিরশিরানি ব্যাথা হয় তাতে। তার বোকাসোকা নাদান বউ টা সারাক্ষণ চোখের সামনে টইটই করে ঘুরে বেড়িয়ে সেই ব্যাথা টা চিড়বিড়িয়ে আরো বাড়িয়ে দেয় সহস্র গুণে।
**********
দেখতে দেখতে তুলি,রেশমির ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। সারার এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আর মাত্র দুইটা বাকি আছে। এই মাসটা ধুমসে পড়াশোনা করেছে তিনবোন। পরিক্ষার শেষে এখন রিল্যাক্সে সময় পার করছে তুলি, রেশমি। সারারও বাকি দুটো পরিক্ষা নিয়ে অতো চিন্তা নেই। কঠিন সাবজেক্ট গুলো আগেই শেষ হয়েছে।
বিকেলে শিকদার হাউসের ড্রইং রুমে চা সমোচার আড্ডা বসেছে। শুধু মাত্র তৈমুর অনুপস্থিত। সে হসপিটালের ডিউটি তে ব্যাস্ত।
কিচেনে কড়াইয়ে গরম তেলে কাবাব ফ্রাই করছেন সিমা শিকদার। কয়েকদিন ধরে তার শরির টা ভালো যাচ্ছে না। কেমন দূর্বলতা অনুভব করছেন তিনি। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরে ওঠে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। আজ যেন একটু বেশিই দূর্বল লাগছে তার।
কড়াইয়ে কাবাব নাড়িয়ে দিয়ে ঘুরে বড় জায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিতেই মাথা ঘুরে উঠলো সিমা শিকদারের। শরীর হেলে পড়তে নিতেই আঁতকে উঠে ধরে ফেললেন রিনা শিকদার। ছোট জায়ের মুখে হালকা চাপড় মেরে ডাকেন,,,,
:-এই ছোট! কি হলো তোর? ছোট শরীর খারাপ লাগছে বলিসনি কেন? এই ছোট!
কোন হেলদোল পেলেন না সিমা শিকদারের। রিনা ঘাবড়ে গিয়ে জোরে জোরে তুলি, রেশমি কে ডাকি দেন।
ড্রয়িং রুমেই তুলি, রেশমি, সারা গল্প করছিলো সাইফ শিকদারের সাথে। মেয়েদের সাথে বিভিন্ন ধরনের গল্পে মেতে উঠেছিলেন সাইফ সিকদার। হুট করেই কিচেন থেকে অর্ধাঙ্গিনীর চিৎকারের শব্দ শুনে থমকে গেলো সকলে। মাইন্ডে ঘটনা ক্যাঁচ করতেই তিন বোন হুড়মুড়িয়ে কিচেনের দিকে দৌড় লাগায়। চারজনে মিলে সিমা শিকদার কে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এসে সোফায় শুইয়ে দেয়।সাইফ শিকদার আর্তনাদ করে উঠলেন,,,
:-কি হলো সিমার?হাত পা পুড়িয়ে ফেলেনি তো??
রিনা শিকদার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন,,,
:-না। কি হলো কে জানে! হুট করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো। এইতো কথা বলছিলো আমার সাথে। ওর যে কোনরকম শরীর খারাপ করছে আমি তো বুঝতেই পারিনি। চিন্তিত চোখে তাকিয়ে থাকে বোনের মতো ছোট জায়ের মুখের দিকে।
সাইফ শিকদার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে পানি আনতে বললে সারা ডাইনিং টেবিলে বিদ্যামান কাঁচের জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে নিয়ে এসে রিনার হাতে দেন। ততক্ষণে সাইফ শিকদার সবথেকে নিকটস্থ হাসপাতালের ডক্টর কে কল করে।
রিনা শিকদার হাতে পানি নিয়ে সিমার মুখে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খোলে সিমা শিকদার।
চোখ খুলতেই আগে চোখে পড়ে মেয়েদের চিন্তিত চেহারা গুলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখেন রিনা শিকদারের বাহুডোরে আবদ্ধ তিনি। বড় বোনের মতো বড় জায়ের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখলেন তিনি।
রিনা শিকদার চিন্তিত স্বরে বললেন,,,
:-কি হলো হঠাৎ করে তোর ছোট? শরীর খারাপ করছে বলিসনি কেন?
:-কি জানি আপা!! বুঝতে পারিনি হঠাৎ করে কি হলো। কয়েকদিন ধরেই একটু শরীরটা খারাপ লাগছিলো। আমি অত গুরুত্ব দেয়নি। আজকে কি যে হলো হঠাৎ করে বুঝলাম না।
ছোট জায়ের হেঁয়ালি পনা কথায় শক্ত গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাইফ শিকদার ডক্টর নিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করলেন।
রিনা শিকদার ছোট জা কে ধরে তার রুমে নিয়ে গিয়ে ঠিকঠাক করে বসিয়ে দিতেই ডক্টর জহুরুল হক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন। পেছন পেছন সারা, তুলি রেশমিও আসে। রেশমির ফর্সা গালে তখনও অশ্রুর দাগ। মায়ের অসুস্থতায় কেঁদে কেটে সারা হয়েছে মেয়েটা। ডক্টর জহুরুল হক হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। সিমা শিকদারের হাতে স্ফিগমোম্যানোমিটার সেট করেন। স্থেটিসকোপ কানে লাগিয়ে ব্লাড প্রেশার চেক করেন।
চিন্তিত একটা ছাপ পড়ে ডক্টরের কপাল জুড়ে। আরো কিছু মেজর পরিক্ষা নিরিক্ষার পর চিন্তার ছাপ বদলায় হাসিমুখে। পাশেই রিনা শিকদার চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ডক্টর জহুরুল হকের মুখের দিকে। ডক্টর জহুরুল হক যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলেন,,,,
:-ভাবি মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। শিকদার বাড়িতে নতুন অতিথি আসতে চলেছে।
ডক্টর জহুরুল হকের মুখের এক বাক্যে ছোটখাটো বজ্রপাত হলো শিকদার হাউসে। সিমা শিকদার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ডক্টরের দিকে। যেন তিনি এই মুহূর্তে কি বললেন তা ঠিকমতো কর্ণ গোচর হয়নি তার। মাথাটা ঝিমঝিম করছে মনে হচ্ছে।
এদিকে রিনা শিকদার চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। শিকদার হাউসের তিন কন্যারও একই অবস্থা।
রিনা শিকদার আমতা আমতা করে বললেন,,,
:-কি বললেন ভাই!!
ডক্টর জহুরুল হকের মুখে হাসি চওড়া হয়।
:-একদম ঠিকই বলেছি ভাবি। ঘরে নতুন অতিথি আসছে। এখন একটু বেশি খেয়াল রাখবেন ছোট ভাবির। আপাতত সবাই ব্যাপারটা একটু সামলে নি ন তারপর কিন্তু অবশ্যই মিষ্টি খাওয়াতে হবে। বলেই তিনি হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ঘটনাটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলো মেয়েদের। ব্যাপারটা বুঝতেই তিনজনে একসাথে চিৎকার করে উঠলো আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
এদিকে সীমা সিকদার লজ্জায় চাদরের নিচে মুখ ঢাকা দিয়েছেন এতক্ষণে। রিনা শিকদার হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে ঠাঁই বসে রইলেন।
সিকদার বাড়ির তিন কন্যার চিৎকার শুনে হন্তদন্ত ছুটে আসলেন সাইফ সিকদার।তিনি অবশ্য এতক্ষণে বিষয়টা অবগত হয়েছেন ডক্টর জহুরুল হকের থেকে।
তিনি রুমে এসে হাসতে হাসতে তিন মেয়েকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেলেন। বললেন মিষ্টি কিনতে হবে চলো সবাই। বড় ভাসুরের মুখে মিষ্টি কেনার কথা শুনে আরও লজ্জায় গুটিয়ে গেলেন সিমা সিকদার। মেয়েরা ফুরফুরে মেজাজে সাইফ শিকদারের সাথে হই হই করতে করতে বেরিয়ে গেল।
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে সাইফ সিকদার পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লাগায় ছোট ভাইয়ের ফোনে।
সকলে বেরিয়ে যেতেই তাদের থেকে একটুখানি মুখ বের করে বড় জায়ের দিকে তাকালেন সীমার শিকদার রিনা শিকদার এখনো ছোট জয়ের মুখের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে। ছোট জা কে তাকাতে দেখে ফিক করে হেসে ফেললেন তিনি।
:-এটা কি শুনছি ছোট?? কি করেছিস তুই?? আমি ভীষণ খুশি হয়েছি রে!!
সীমার শিকদার লজ্জায় লাল হয়ে মিনমিন করে বলেন,,,
:- এটা কিভাবে হলো বুঝতে পারিনি আপা। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। কি হবে এখন?? ছেলে বৌমা হয়ে গেছে। মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে আর এই বয়সে হুট করে এরকম একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। আমি এই মুখ নিয়ে ছেলে মেয়েদের সামনে দাঁড়াবো কি করে আপা??
রিনা সিকদার মৃদু ধমক দিয়ে বলেন,,,
:-এক্সিডেন্ট কেন বলছিস ছোট?? আল্লাহ যা করেন পরিকল্পনা মাফিক করেন। তাই আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে একসিডেন্ট বলে নিজের গুনাহ বাড়াস না। তাছাড়া লজ্জার কি আছে? বাচ্চাটা তো আর অবৈধ নয়। সবাই দেখছিস না ভীষণ খুশি হয়েছে! দেখিস আমাদের বাড়িতে এবার একটা ছোট তৈমুর আসবে এই আমি বলে রাখছি!!
:-আপা উনি শুনলে কি বলবে? বুড়ো বয়সে আবার বাবা হচ্ছেন শুনলে উনি রাগ করবেন।
:-ধুর তুই একটু বেশি ভাবছিস। আলিফ ভাই নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হবে। তুই কি চিনিস না তাকে?
সিমা শিকদার চাদরে মুখ ঢেকে বলেন,,,,
:-জানিনা আপা!! আমি আর এই ঘর থেকে বের হবো না। কারো সামনেও যাবো না। 🙈🙈🙈
ছোট জায়ের লজ্জা মাখা বাচ্চামিতে খিলখিল করে হেসে ওঠেন রিনা শিকদার।
#সারা_জাহান
পর্ব,,,২১
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️
শিকদার বাড়িতে একটা বড়সড় পারিবারিক উৎসব শুরু হয়েছে যেন। নতুন অতিথির আগমনী বার্তা ইতিমধ্যে শিকদার হাউসের প্রত্যেকটা সদস্যদের কানে পৌঁছে গেছে। আলিফ শিকদার ড্রইং রুমের এক কোনায় বসে সকলের উল্লাস পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি খুশি হয়েছেন এটা সত্যি কিন্তু লজ্জাও পাচ্ছেন বিস্তর। ছেলে মেয়েদের সামনে একটা কথাও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না তিনি। এইতো গতকাল সন্ধ্যার ঘটনা। অসময়ে বড় ভাইয়ের ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলেন তিনি। ফোন রিসিভ করতেই সাইফ শিকদার গম্ভীর স্বরে বলেন,,,,
:-এই মুহুর্তে যে কাজেই থাকিস না কেন, এক্ষুনি বাড়িতে আয়।
ভাইয়ের গম্ভীর স্বরে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঘটনা কি জানতে চাইলে তাকে বলা হয়,যা শোনার বাড়িতে এসে শুনতে পাবে। এক্ষুনি যেন সে শিকদার হাউসে এসে পৌঁছায়।
বেশ ঘাবড়ে গেছিলেন তিনি। বাড়িতে কারো কিছু হলো নাকি, সেই চিন্তাই যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে এসেছিলেন আলিফ শিকদার। কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করার পর বড় ভাই- ভাবির মুচকি হাসি আর মেয়েদের হাসিমুখ দেখে এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যা কিছুই ঘটুক তা চিন্তা নয়। ছোট ভাইকে দেখে এগিয়ে আসেন সাইফ সিকদার।
হেসে কাঁধ চাপড়ে বলেন,,,,
:-এসে গেছিস!! আয় আয়।
:-কি হয়েছে ভাইজান? এভাবে তাড়াহুড়ো করে আসতে বললে। তোমরা সবাই এভাবে হাসছোই বা কেনো? ব্যাপারটা কি আমাকে কেউ খুলে বলবে?
পাশ থেকে দেবরের কথায় ফিক করে হেসে ফেলেন রিনা শিকদার। এগিয়ে এসে বলেন,,,,
:-কি বলবো আলিফ ভাই! যা বলার তো তুমি বলবে। আমরা তো শুধু কনগ্রাচুলেশন জানাতে তোমাকে ডেকে এনেছি।
:-মানে কি ভাবি? এভাবে হেঁয়ালি না করে কেউ তো বলো কি হয়েছে। আর সিমা কোথায়? বাড়ির সবাই এখানে দেখছি। সিমা কোথায়?
সাইফ শিকদার ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ঠান্ডা গলায় বলেন,,,
:-নতুন করে বাবা হতে চলেছিস!! তার জন্য অভিনন্দন।
আলিফ সিকদার ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বড় ভাইয়ের মুখের দিকে। কি বললেন বড় ভাই সেটা যেন ব্রেইনে সঠিক সময়ে সাপ্লাই দিতে পারলো না। তিনি কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছেন।
বাবাকে এমন থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে রেশমি। বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে বলে,,,
:-আমার একটা ছোট্ট ভাই বোন আসবে বাবা!! আমি, আমরা সবাই ভীষণ খুশি হয়েছি। তুমি খুশি হওনি বাবা??
মেয়ের কথায় নড়েচড়ে দাঁড়ালেন আলিফ শিকদার। এই মুহূর্তে ঠিক কি বলা উচিত বুঝতে পারছেন না তিনি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আলিফ শিকদারের চোখ দুটো চিকচিক করছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে সুধালেন,,
:-তোমার মা কোথায়?
রেশমি হাতের ইশারায় তাদের ঘরের দিকে দেখিয়ে দিতেই তিনি ধীরে সুস্থে সেদিকে পা বাড়ান।
_________
রুমে প্রবেশ করতেই চোখ যায় বিছানায় শায়িত অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সেদিকে তাকাল সিমা শিকদার। স্বয়ং আলিফ শিকদার কে দেখে হকচকিয়ে উঠে বসেন। হড়বড় করে বলেন,,
:-দেখো তুমি রাগ করোনা। আসলে এটা কিভাবে যে হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আমি ইচ্ছে করে কিছু ঘটায়নি বিশ্বাস করো!!
আলিফ সিকদার দ্রুত পায়ে বিছানার কাছে গিয়ে স্ত্রী কে জড়িয়ে ধরেন। থমকে যান সিমা শিকদার। বুঝতে পারেন স্বামীর শরীর কাঁপছে। কিছুটা সুস্থির হতেই অনুভব করতে পারেন কাঁদছেন আলিফ শিকদার। ঢোক গিলে আস্তে করে স্বামীর পিঠ আঁকড়ে ধরেন সিমা।
আলিফ সিকদার সত্যিই কাঁদছেন। তবে তা দুঃখে নয় সুখে কাঁদছেন তিনি। দীর্ঘ 22 বছর পর এমন একটা খুশির সংবাদে সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গেছিলেন তিনি। তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করার তিন চার বছর পর থেকে তারা আরেকটা সন্তান নিতে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তখন মহান আল্লাহতালা হয়তো রাজী ছিলেন না, তাই দ্বিতীয় সন্তান হয়নি। কিন্তু দীর্ঘ এতো বছর পর হঠাৎ মহান আল্লাহতালা তাদের ঘরে আবারো সন্তান সুখ প্রদান করবেন তা তিনি কল্পনাও করেননি কখনো।
হঠাৎ পাওয়া এই খুশির সংবাদে তিনি সত্যি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলেন। দু হাতে সীমা শিকদারের গাল দুটো চেপে ধরে কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেন।
সিমা শিকদার স্বামীর প্রতিক্রিয়া দেখে আমতা আমতা করে বলেন,,,
:- তুমি রাগ করোনি?
অর্ধাঙ্গিনী প্রশ্নে হাসেন আলিফ সিকদার। হাসিমুখেই বলেন,,,
:- রাগ করবো কেন? আল্লাহ আমাদের ঘরে আবারো সন্তান সুখ প্রদান করছেন, এটা তো খুশির সংবাদ। রাগ করবো কেন?
স্বামীর এহেন কোথায় কেঁদে ফেলেন সীমা শিকদার। বলেন,,
:- আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি রাগ করবে।
:-না গো! আমি একটুও রাগ করিনি বরং আমি ভীষণ খুশি হয়েছি! এতো বছরে এই চিনলে আমায়?
:-সরি।
:-আচছা সরি বলতে হবে না। আমি ভীষণ খুশি। আর এই খুশি উপহার দেয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, অভিনন্দন। তো তুমি আমাকে এতো খুশির একটা সুসংবাদ দিলে তার বিনিময়ে আমারও তো তোমাকে কিছু উপহার দেওয়া উচিত তাই না?? কি দেয় বলোতো?
স্বামীর কথায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকন সিমা শিকদার। পরমুহূর্তেই আলিফ শিকদার বলেন,,,
:-হ্যা তোমার এই খুশির সংবাদে খুশি হয়ে আমি আমাকেই তোমার সেবাই ২৪ ঘন্টা নিয়োজিত করলাম রানিসাহেবা!! এখন থেকে ফার্ম হাউসে নয় বরং আমি এখন থেকে এই শিকদার হাউসেই থাকবো। তোমার সাথে তোমার পাশে।
এক সাথে এতো খুশি কোথায় রাখবেন বুঝতে পারেন না সিমা শিকদার। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে থাকেন আলিফ শিকদার।
সে রাতে তৈমুর হসপিটাল থেকে ফিরে আসলে তাকেও সুসংবাদটা দেয়া হয়। তৈমুরও ভীষণ খুশি হয় তা শুনে। রাতে একবার গিয়ে ছোট মায়ের সাথে দেখাও করে আসে।
********
বর্তমানে বাড়ির সদস্যদের আনন্দে মুখরিত হচ্ছে শিকদার হাউসের ড্রইং রুমের প্রতিটি কোনা। সাইফ শিকদার, আলিফ শিকদার সোফার এক কোনে বসে হাসিমুখে বাচ্চাদের পাগলামী দেখছেন।
তৈমুর আর সায়ান মাত্রই মস্ত বড় একটা কেক নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। সেটা ড্রইং রুমের সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে শার্টের হাতায় কপালের ঘাম মুছে এদিক ওদিক তাকায়। কাঙ্খিত মানুষ টাকে দেখতে না পেয়ে ওপরের দিকে পা বাড়ায়। সায়ান গিয়ে আলিফ শিকদারের পাশে বসে পড়ে। দাঁত বের করে হেসে বলে,,,
:- কনগ্রাচুলেশন’স আঙ্কেল!! এই বয়সে পারফেক্ট ছক্কা হাঁকানোর জন্য!
সায়ানের কথায় বিষম খেয়ে খুকখুক করে কেশে ওঠেন আলিফ শিকদার। বড় ভাইয়ের সামনে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যান। সাইফ শিকদার সায়ানের দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকান। সায়ান বরাবরই ঠোঁটকাটা স্বভাবের। তার জন্য মাঝেমধ্যে বিরক্ত হন সাইফ শিকদার। বিড়বিড় করে বলেন,,,
:-অসভ্য ছেলে!!
আলিফ শিকদার মিনমিন করে বলেন,,,
:-ধন্যবাদ।
বলেই উঠে সিমা শিকদারের রুমের দিকে হাটা দেন তিনি। এখানে বসে থাকা ইম্পসিবল!! এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই। আবার কখন কি মুখ ফসকে বলে লজ্জায় ফেলবে। তার থেকে বরং বউয়ের কাছে গিয়ে বসে থাকবেন তিনি।
সায়ান এবার হাসিমুখে সাইফ শিকদারের দিকে তাকায়। তা দেখে মনে মনে প্রমাদ গুণলেন তিনি! এই ছেলে এবার তাকে ধরবে নাকি!! এই ছেলের সামনে থাকাও রিস্ক!
:-যায় দেখি তোমার আন্টি কি করছে দেখি। তুমি বসো। বলেই কোনরকমে উঠে তাড়াহুড়ো করে প্রস্থান করলেন তিনি।
সায়ান বুঝলো না এনারা এভাবে কেটে পড়লেন কেনো। ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করে সায়ান!!
:-যাব্বাবা! কি এমন বললাম যে সব পালালেন! পরক্ষনেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,,
:-যায় হোক!! আমি বরং দেখি আমার একমাত্র মূল্যবান তুলা ঠিকঠাক আছে নাকি হালকা বাতাসে উড়ে গেছে!!
বলেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়!!
***********
সিমা শিকদার কে দিয়ে শিকদার হাউসের নিউ মেম্বার আসার সেলিব্রেশন উপলক্ষে কেক কাটানো হয়। বড় ধামড়া ছেলে মেয়েদের এহন কাজে ভীষণ লজ্জা পেলেন তিনি। তবে সেসব তোয়াক্কা করলেন না কেউ। ধীরে ধীরে বিষয় টা সহজভাবে নিলেন সকলে।
__
সায়ান এদিক ওদিক তাকিয়ে কাঙ্খিত রমণীকে খুঁজতে থাকে। তুলির রুমে ঢু মেরেও তুলিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে আসে!! সেই পরশু রাতে কল করে সায়ানকে না পেয়ে পর থেকে উধাও মেয়েটা। পরে কম করে হলেও ছয় হাজার বার কল করা হয়ে গেছে সায়ানের। প্রথমে রিসিভ হয়নি পরে তার নম্বর টা ব্ল্যাক লিস্টে ফেলেছে মেয়েটা। একবার সময়মতো কল ধরতে না পারা যে এতবড় শাস্তি হয়ে যাবে আগে বোঝেনি। বেডি মাইষের এতো ঢঙ কইত্তে আসে সেটাই বুঝে আসছে না বেচারার।
সেই তো কেক কাটার সময় এক পলক দেখলো। তারপর কোথায় গেলো মেয়েটা? অভিমান ভাঙ্গাতে হলেও তো থাকে কাছে পেতে হবে নাকি!! তার যে রাগ ভাভা গো ভাভা!!
পথে মধ্যে দেখা মেলে রেশমির। তাকে দেখেই দাঁত বের করে হেসে কপালে টোকা মেরে জিজ্ঞাসা করে,,,
:- হেই রোশ,,তুলা কই আছে বলতে পারো??
রেশমি কপাল কুঁচকে তাকায়! একচুয়ালি সায়ান তুলা কাকে বললো বুঝতে পারেনি সে, পরমুহূর্তেই বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেসে দেয়! হাত দিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে ইশারা করে। সায়ানও ইশারা অনুসরণ করে ছাদের দিকে পা বাড়ায়।
পড়ন্ত বিকেলের নরম আবহাওয়ায় ঝিরঝিরি বাতাস বয়ে যাচ্ছে। গোধূলির লালিমা পশ্চিম অম্বর জুড়ে। নরম সেই সোনালী আলোকেই হয়তো বলা হয় কনে দেখা আলো। গোধূলির সোনাঝরা সেই অমোঘ সৌন্দর্য গায়ে লেপ্টে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক অপরূপা। চুলগুলো হালকা বাতাসে দোল খাচ্ছে।
সায়ান কিছুক্ষণ বিভোর হয়ে চেয়ে রয় সেদিকে। পরমুহূর্তেই অপরুপার রাগের কথা স্বরণ হতেই ফুসসস করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায়।
পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ায় তুলির। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সায়ানের মুখটা চক্ষু গোচর হয় তুলির। তবে মুখে কোন হেলদোল দেখালো না। যেন সে জানতো এই বেহায়া ছেলেটা এখানে আসবে।
সায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে,,,,তুলি তাকাতেই দাঁত ভ্যাটকানি দেয়। তুলি বিরক্ত হয়ে আবারো সামনে তাকায়।
সায়ান আমতা আমতা করে বলে,,,
:-বলছি! আমার অপরাধ টা কি ক্ষমার অযোগ্য? অভিমান টা কি বিশাল?
তুলি কোন ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করে,,
:-পরশু রাতে ১৫ মিনিট ধরে কোন মেয়ের সাথে কথা বলছিলে?
সায়ানও কথা ঘুরায় না। সাবলীল ভাবে বলে,,
:-আমার একজন ফলোআপ পেশেন্ট। ওনার হার্ট সার্জারি হয়েছিল আমারি হাতে। খুব ক্রিটিক্যাল কেস ছিলো। সার্জারির পর…….. আচ্ছা বাদ দাও 😒 আমার জীবনের সবথেকে ক্রিটিক্যাল কেস তো আমার হাওয়ায় ভাসা তুলা!! বলেই দাঁত বের করে হাসে সায়ান।
তুলি দেখে সে হাসি। ফুস করে শ্বাস ফেলে বলে,,
:-তোমার এই মন ভুলানো কথায় আর এফেক্ট করে না। তুমি বদলে গেছো সায়ান মাহমুদ।
তুলির কথায় চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে তাকালো সায়ান। মনে মনে ভাবে,,,”উউউউউ ভাইইই মারো মুঝে মারো” প্রথমবারের মতো কল করে পায়নি বলে সে বদলে গেলো?????
:-আমি?? আমি বদলে গেছি?? তারপর আবার স্বাভাবিক গলায় মধু ঢেলে বলে,,,
:-হাআআ একটা বদল তো আমার হয়েছে!! আগে আমার চোখ সব সময় পেশেন্ট দের দেখতো আর আজকাল তুলা ছাড়া কিছু চোখে দেখিনা! এটা গেলো একটা বদল। আবার আগে আমার নার্ভ স্বাভাবিক ভাবেই হার্টে বিট করতো আর এখন আমার তুলার নাম শুনলেই ধড়াস ধড়াস করে। এটাও একটা বদল!!
তুলি হা করে তাকিয়ে আছে এই আদ্যপান্ত বেহায়া ছেলেটার দিকে। এ জীবনে কখনো সিরিয়াস হবে বলে মনে হয় না। হতাশ হয় তুলি!
মুহুর্তেই সায়ান তুলির কাছে চলে আসে। তুলির খুব কাছে মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। তুলির নাকে আঙুল দ্বারা টোকা মেরে বললো,,
:-তুমি কি জানো তুলা? রাগলে তোমার নাক টা একদম স্ট্রবেরির মতো হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো গোলাপের কুঁড়ির মতো ফুলে ওঠে। তখন আমার অবাধ্য মন চায় টুপ করে তোমার ঠোঁটে একটা চুমু এঁকে দিই।
:-সায়ান!!!
সায়ান আরো একটু ক্লোজ হয়। ঘোর লাগা স্বরে বলে,,
:-তুমি চিৎকার করলেও আমার প্রেম বাড়ে! ঠোঁটের কোণে জমা রাগে সেই প্রেমের টান বাড়ে শতবার,, সহস্রবার!!
:-তুমি সত্যিই একটা পাগল।
বাঁকা হাসে সায়ান,,,
:-হ্যাঁ তোমার জন্য পাগল,আমার তুলার জন্য পাগল!!
বলেই তুলির কোমর আঁকড়ে ধরে টেনে নেয় নিজের কাছে।
ঠিক সেই সময়ই সায়ান কে ডাকতে ডাকতে ছাদে পা রাখে তৈমুর! আচমকা চোখের সামনে বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে ছোট বোনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত দেখে থমকে যায়!
অস্ফুট স্বরে ডাকে,,
:-সায়ান!!
তৈমুরের ডাকে সম্বিত ফিরে পায় দুজন। দুজনেই হকচকিয়ে ছিটকে সরে যায় দুদিকে। তুলি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে গেছে মনে হচ্ছে। সায়ানও বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। হুট করে এই মুহূর্তে তৈমুর কে আশা করেনি।
তৈমুর এগিয়ে যায় ওদের দিকে। তুলি হড়বড় করে বলে,,,
:-ভাইয়া!!
হাত উঁচু করে থামিয়ে দেয় তৈমুর। শক্ত গলায় বলে,,
:-নিচে যা!
:-প্লিজ ভাইয়া একবার আমার কথা শোন। তুমি যে…
আচমকা তৈমুর হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,,
:-I said go!!
তৈমুরের ধমকে আঁতকে ওঠে তুলি। চোখ ভরে আসে মুহূর্তে। টুপটাপ অশ্রু ঝরে পড়ে ফর্সা গাল বেয়ে। সায়ানের দিকে একবার অসহায় চোখে চেয়ে এক ছুটে বেরিয়ে যায় ছাদ থেকে। সায়ান হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে নিতেই তৈমুর সায়ানের হাত ধরে থামিয়ে দেয়।
তৈমুর ঠান্ডা গলায় বলে,,
:-এসব কি সায়ান?
সায়ান কোন ভনিতা না করেই বলে,,,
:- আমি তুলিকে ভালোবাসি তৈমুর!
:-আর তুলি?
এবার নিশ্চুপ হয়ে যায় সায়ান। আসলেই তো! তুলি কি তাকে ভালোবাসে? সে তো কখনো মুখে বলেনি যে সেও সায়ান কে ভালোবাসে। সায়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঢোক গিলে বলে,,,
:-জানি না। ও আমাকে কখনো বলেনি যে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার ইজহারে নাও করেনি।
:-আর কবে থেকে চলছে তোর এই ইজহার??
সায়ান গলার অ্যাডম অ্যাপেল স্পর্শ করে বলে,,,
:- দু বছর আই স্যুয়্যার!!!
:-বাহ!! দুই বছর!! আর আমাকে সেটা বলার প্রয়োজন মনে করলি না তুই?
:- একচুয়ালি তুলির থেকে কখনো সেভাবে সাড়া পায়নি আর তুইও ছোট ভাবিকে নিয়ে টেন্সড ছিলি তাই বলা হয়ে ওঠেনি।
:- ঠিক আছে। আমি তুলিকে জিজ্ঞাসা করবো। তুলির যদি সম্মতি থাকে তাহলে তুই আঙ্কেল আন্টিকে দেশে আসতে বলবি।
তৈমুরের কথায় আবেগে আত্মহারা হয়ে তৈমুরকে জড়িয়ে ধরে সায়ান। বলে,,
:- দোস্ত !! তার মানে তুই রাগ করিস নি??
:- সায়ানকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে,,,
:- রাগ করবো কেন, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড! আমি তোকে চিনি, বিশ্বাস করি। কিন্তু তুই যদি আমার বোনকে কখনো কষ্ট দিস,কাঁদাস তাহলে আমি তৈমুর জাহান শিকদার তোর ওপেন হার্ট সার্জারি করবো। তাও সেটা ছুরি কাঁচি দিয়ে নয়, বরং হৃদয় ছিঁড়ে!!
:- কি যে বলিস!! তোর বোনকে কাঁদানোর আগে আমিই কাঁদবো দেখিস!! কিন্তু তুই ওকে ধমক দিলি কেন? কষ্ট পেয়েছে যে!
:-এখন একটু কষ্ট পেলে পাক! পরে পুষিয়ে দিবি।
সায়ান হেসে আবারো জড়িয়ে ধরে তৈমুর কে!
:-You are the best friend in the world!!!
:-ছিঃ সর তো!! সারাক্ষণ মেয়েদের মতো চিপকা চিপকি করিস কেন এতো? আমি কি তোর গার্লফ্রেন্ড লাগি নাকি??
সায়ান দাঁত বের করে হেসে বলে,,,
:-তার মানে তুই কি ছোট ভাবির সাথে সবসময় চিপকা চিপকি করিস নাকি?😁
:-ওহ হ্যালো! ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয় ওকে! ও আমার বউ। তিন কবুলে বিয়ে করা বউ! আমি আমার বউয়ের সাথে যা ইচ্ছে করি তোর কি তাতে?
সায়ান মাথা চুলকে বিড়বিড় করে বলে,,,
:-আহা আজ একটা বউ নাই বলে,,,,,
চলবে,,,
#সারা_জাহান
পর্ব,,,২২
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️❤️
গোধূলির শেষ রঙটাও মুছে গেলো অম্বর হতে। এরমধ্যেই আসেপাশের বিল্ডিংয়ে জ্বলে উঠেছে সোডিয়ামের বাতি। সায়ান, তৈমুর অনেকক্ষণ নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করে নিচে নামে। সায়ান সকলের সাথে দেখা করে চলে যেতে নিলে তৈমুর জানায় সে ড্রপ করে দিবে।
শিকদার হাউস থেকে বেরোনোর সময় এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়েও তুলিকে কোথাও দেখতে পেলো না সায়ান। বেশ ভয় পেয়েছে মেয়েটা। তবে সায়ানের মনে অন্যরকম প্রশান্তি, তৈমুর যখন বিষয়টাকে পজেটিভলি নিয়েছে তখন বাকিটা সে ইজিলি হ্যান্ডেল করতে পারবে। এখন শুধু মাত্র বাবা-মা কে জানিয়ে দেশে নিয়ে আসার যেটুকু সময়। তার তুলা কে সে ঠিক নিজের করে নিবে।
______
সন্ধ্যার পর নিজ কামরায় পড়ার টেবিলে টুকটাক পড়াশোনা আয়ত্ত করতে ব্যস্ত রেশমি। ফিন্যান্সের বই খুলে রাখা সামনে। ব্যাগ থেকে একটা খাতা টেনে বের করতেই পাশে রাখা ফোনটা তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো। খাতা রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে চোখ রাখতেই কপাল গুটিয়ে এলো তার!
স্ক্রিনের ওপর স্পষ্ট ভাসছে,,,
calling Talha…..!!
মুহুর্তেই হাত থেকে ঠাসস করে ফোনটা পড়ে গেলো। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেছে রেশমির। পরপর পলক ঝাপটে ফোনটা হাতে তুলতেই কল কেটে গেলো। এখনো ঘোরে আছে বেচারি। তালহা নামে কারো নাম্বার সে কখনো সেভ করেছে বলে মনে পড়লো না। তা ছাড়া তার জীবনে তালহা নামের শুধুমাত্র একজন মানুষকেই তো সে জানে! কিন্তু স্যার তালহার নম্বর এভাবে নাম দিয়ে সেভ তো সে করেনি। মস্তিষ্কে জোর দিতেই কয়েকদিন আগের কথা মনে পড়ে। স্যার কেবিনে ডেকে রেশমির ফোন চেয়েছিলো। হ্যাঁ মনে পড়েছে,, স্যার তো কিছুক্ষণের জন্য তার ফোনটা নিয়েছিলো। তাহলে কি স্যার নিজেই তার নাম্বার টা নাম দিয়ে সেভ করেছে!! তিনি তো বলেছিলেন ভার্সিটি থেকে ছুটি নিলে তাকে ফোন করে জানাতে।
আবারো ঝনঝন করে বেজে উঠলো ফোন!
কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে রেশমি। আলতো কন্ঠে সালাম দেয়,,,
:-আসসালামু আলাইকুম স্যার!
ওপাশ থেকে কোন শব্দ না পেয়ে আবারো সালাম দেয় রেশমী। এবারে এক সুমিষ্ট ভরাট শ্রুতিমধুর কন্ঠস্বর কানে এসে ধাক্কা খায় রেশমীর। জবাব আসে,,,
:- ওয়ালাইকুমুসসালাম!
:-স্যার আপনি!
:-হুম আমি!কেমন আছেন আপনি?
:-জ্বী,,জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন স্যার?
:-হুম ভালো। আজ ভার্সিটিতে আসেননি কেনো জানতে পারি?
রেশমী কোনমতে ঢোক গিলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কি যেন ভেবে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। তারপর মন্থর পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ফোনের ওপাস থেকে আবারো ভেসে আসে,,,
:-মিস রোশি!
তালহা স্যারের এমন সম্বোধনে কেঁপে ওঠে রেশমী। এটা কেমন সম্বোধন করলেন স্যার। রোশি!!!! এভাবে তো তাকে কেউ কখনো সম্বোধন করে না। সায়ান ভাইয়া মাঝে মধ্যে তাকে রোশ বলে ডাকে, কিন্তু তাতে তো কখন এমন সে এমন শিহরিত হয় না।
:-হ্যাঁলো মিস শুনতে পারছেন আমার কথা?
:-হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার! শুনতে পারছি। একচুয়ালি স্যার আজ আমাদের বাড়িতে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিলো। সেই জন্য যাওয়া হয়নি।
:-মিস রোশি আপনাদের বাড়িতে রোজ রোজ কিসের এতো পারিবারিক অনুষ্ঠান হয় জানতে পারি?
এ পর্যায়ে কিছুটা থতমত খায় রেশমী। তার মা প্রেগন্যান্ট! সেই খুশিতে পার্টি দিয়েছিলো তা এখন স্যার কে কি করে বলবে! অতঃপর আমতা আমতা করে বলল,,,
:-স্যার একচুয়ালি কিছুটা ব্যক্তিগত…
“ব্যক্তিগত” শব্দটা কেনো যেনো বজ্রপাতের ন্যায় কানে এসে ধাক্কা খায় তালহার। কপাল কুঁচকে যায় মুহূর্তে। কিছুটা হড়বড়িতে অস্থির কন্ঠে ফের সুধায়,,,
:-ব্যক্তিগত মিন’স? মিস রোশি আপনাকে কি পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো?
আশ্চর্য হয়ে চোখ বড়বড় করে ফেলে রেশমী!! স্যার এসব কি জিজ্ঞাসা করছে!
:-স্যার কি বলছেন আপনি! আমাকে কেনো পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে?
এতক্ষণে তালহার আটকে রাখা নিঃশ্বাস টুকু ধরণীতে পতিত হয়। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে রিল্যাক্স মুডে বলে,,,
:-নাহ আপনি যেভাবে আমতা আমতা করে বললেন ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান,তাই মনে হলো হয়তো আপনাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিলো। তাই জিজ্ঞাসা করলাম আর কি!
:-জ্বী না স্যার! এটা অন্যরকম ব্যক্তিগত! তা এখন আমি আপনাকে বলতে পারবো না।
“অন্যরকম ব্যক্তিগত নিয়ে আমার মাথাব্যথাও নেই”!! বিড়বিড় করে তালহা এহমাদ। তা স্পষ্ট শুনতে পায়না রেশমী।
:- জ্বী কিছু বললেন স্যার??
:-নাথিং। কাল যথাসময়ে ভার্সিটিতে আসবেন। এসে আমার সাথে দেখা করে যাবেন। আপনাকে বলেছিলাম ভার্সিটিতে না আসলে আমাকে ফোন করে জানাতে। আপনি তা করেননি মিস রোশি! তারজন্য তো আপনার শাস্তি প্রাপ্য!
তালহার কথায় আকাশ থেকে পড়ে রেশমী!! শাস্তি মানে কিসের কি!! বললেই হলো নাকি!
:-স্যার কি বলছেন আপনি!! শাস্তি দিবেন মানে কি! আমি কি স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী!! স্যার ভার্সিটির কত স্টুডেন্ট তো ক্লাস এটেন্ডই করে না। কি তাদের তো কোন স্যার কিছু বলেন না। তাহলে আমি কি দোষ করলাম?
:-বাকি সবাইকে তো আমি ফোন করতে বলিনি। আপনাকে বলেছিলাম। আপনি তা করেননি। তাই শাস্তি আপনারই প্রাপ্য।
:-এটা কিন্তু জবরদস্তি হচ্ছে স্যার!! আমার মন চায় আমি ভার্সিটিতে যাবো না চায় তো যাবো না!! তাতে আপনার কি? আমি কি ক্লাস টু এর বাচ্চা? আমি এখন এ্যাডাল্ট। আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না।
রেশমীর কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয় তালহা এহমাদের। তাচ্ছিল্য হেসে গম্ভীর ধীর স্বরে বলে,,,
:-আমাকে আপনার এডাল্টি বোঝাচ্ছেন মিস রোশি! ওকে ফাইন! I’ll check your adult status next time you come to the university….!!
পরপর ফোন ডিকলাইন হয়ে যায়। তালহা স্যারের ঠান্ডা স্বরে বলা এহন বাক্যে শরীরে অদ্ভুত কাঁপুনি অনুভব হয় রেশমীর। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রেশমী। এতক্ষনে তালহা স্যারের বলা কথা গুলো কানের মাঝে বাজতে থাকে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তালহা এহমাদ স্যার,যে কিনা হুমকি ধামকি দিয়ে স্টুডেন্ট দের জান কবচ করে ফেলে, সে কিনা এভাবে কথা বললো তার সাথে! কিন্তু কেনো? এই কেনোর উত্তর মিললো না যেন কোনভাবেই।
**********
পরদিন সকালে। হসপিটালের জন্য একবারে রেডি হয়ে কামরা থেকে বের হয় তৈমুর। আজ একটু সকাল সকাল বের হবে সে। নিচে নামার আগে সারার রুমে উঁকি দেয়। মহারানী রুমে নেই। মানে অলরেডি নিচে চলে গেছে । সারার রুম থেকে বেরিয়ে তুলির রুমের সামনে গিয়ে থামে। কাল বিকেল থেকে তুলি আর তৈমুরের সামনে আসেনি। রাতে খেতেও আসেনি সে। তৈমুর বোঝে তার অস্বস্তি টা ঠিক কি কারণে। তবে এবার তুলির সাথে কথা বলা প্রয়োজন। সেকথা চিন্তা করেই তুলির রুমের দরজায় নক করে তৈমুর। দু’বার নক করার পর দরজা খোলে তুলি। দরজা খুলতেই বড় ভাইয়াকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে। ভাইয়া কি তাকে বকবে? এই জন্যই এসেছে?
তৈমুর তুলিকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বিছানা পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রশ্ন করে,,
:-কি করছিলি?
ইতিমধ্যেই গলা শুকিয়ে এসেছে তুলির। কোনরকমে ঢোক গিলে অস্ফুট স্বরে বলে,,,
:-প.. পড়ছিলাম ভাইয়া!
:-রাতে খাসনি দেখলাম! শরীর ঠিক আছে তোর?
তৈমুরের এমন স্বাভাবিক কথাবার্তায় আরো ঘাবড়ে গেল তুলি!! কি চলছে বড় ভাইয়ের মনে বোধগম্য হয় না তার!! অতঃপর জড়ানো গলায় জবাব দেয়,,,
:-ঠিক আছি ভাইয়া।
তৈমুর সরাসরি তাকায় বোনের দিকে। তার থেকে অদুরে দাঁড়িয়ে ফ্লোরের টাইলসে নখ খুঁটছে মেয়েটা। তুলির মনের অস্থিরতা বুঝতে পারে তৈমুর। হাত বাড়িয়ে বোনের হাত ধরে টেনে পাশে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও তুলির সামনে চেয়ার টেনে বসলো। নরম হাতে বোনের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,,,
:-দেখ বনু! আমি কোন রকম লুকাছুপা পছন্দ করি না সেটা তোরা সকলেই অবগত আছিস নিশ্চয়। তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো। মন থেকে ঠিকঠাক জবাব দিবি আসা করি।
অতঃপর এক হাত আদরের বোনের মাথায় রাখে আলতো করে।
:-কিছু আড়াল করবি না। মনের ভেতর যায় থাকুক ,যেরকম ফিলিংসই থাকুক সত্যিটা প্রকাশ করবি তো ভাইয়ার কাছে??
চোখে অশ্রু জমেছে তুলির। নাকের পাটা ফুলে লাল হয়ে গেছে। কান্না সংবরণ করে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়।
তৈমুর ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করে,,
:-ভালোবাসিস সায়ান কে? বিয়ে করতে চাস?
অবাক হয়ে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায় তুলি!! এরকম প্রশ্ন সে আশা করেনি তা তার দৃষ্টিতেই স্পষ্ট। তৈমুর তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়ায় তুলি। বোনের ইশারা বুঝতে পেরে চোখে হাসে তৈমুর। বলে,,,
:-তাহলে সায়ান কে বলি ওর বাবা মা কে আমাদের বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসতে??
মুহুর্তেই রক্তিম হয় তুলির ফর্সা গাল। মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে হাসে। তুলির হাসিমুখ জবাব দিয়ে দেয়। ঝটপট উঠে দাঁড়ায় তৈমুর। কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে বোনের উদ্দেশ্যে,,,
:-এক্ষুনি নিচে গিয়ে খেয়ে নিবি। আজ ড্রাইভার দিয়ে আসবে ভার্সিটিতে। আমার তাড়া আছে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি এখনই।
বোনের জবাবের অপেক্ষা না করে প্রস্থান করে তৈমুর।
*********
গাড়ি নিয়ে সায়ানের বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই সায়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তৈমুর। হাত দিয়ে দরজা ঠেলে খুলে দিয়ে বলে,,,
:-জলদি উঠে আয় সায়ানাইড!
সায়ান উঠে বসতেই ফের স্টার্ট করে তৈমুর। ড্রাইভ করতে করতেই সায়ানের দিকে তাকায়। আজ কেমন চুপচাপ বসে আছে সায়ান। তার চিন্তার কারণ বুঝতে সময় লাগে না তৈমুরের। তবে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনা। কারন সে জানে এই নিরবতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। আর একবার ফুয়ারা ছুটতে শুরু করলে সহজে থামবেও না।
কিছুক্ষণ পরে ঠিকই সায়ানের অস্থিরতা টের পাই তৈমুর। কেমন একটা উসখুস করছে সে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করেই বসে,,,
:-তুলির সাথে কথা বলেছিলি??
:-হুম।
তৈমুরের ঠান্ডা রিয়াকশনে আরো ঘাবড়ে যায় সায়ান। কপালে দেখা দেয় চিকন ঘাম। অতঃপর আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করে,,
:-কি বলল তুলি ?
বন্ধুর অস্থিরতা টের পেয়ে আড়ালে ঠোঁট টিপে হাসে তৈমুর। তারপর মুখটা স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর স্বরে বলে,,,
:-আঙ্কেল আন্টিকে দেশে আসতে বল।
তৈমুরের কথা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগে সায়ানের। বোধগম্য হতেই খুশিতে বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে থাকে।
“তারমানে তুলি হ্যাঁ বলেছে! তবেই তো তৈমুর তার বাবা মাকে দেশে নিয়ে আসতে অনুমতি দিলো। বুকের মাঝে অদ্ভুত অস্থিরতায় ছেয়ে যায়। খুশির ঢেউ খেলে যায় হৃদয় জুড়ে। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে,,,
:-ইশশশশ এখন যদি তুলিকে সামনে পেতাম! জড়িয়ে ধরে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চুমু খেয়ে নিতাম।
সায়ানের কথায় নাক কুঁচকে বলে,,
:-ছিঃ সর এনতে!! অশ্লীল। তুই আমার সামনেই আমার বোনকে নিয়ে এসব কথা বলছিস লজ্জা করছে না?
সায়ান খিল খিল করে হেসে তৈমুরের বাহুতে টোকা মেরে বলে,,,
:-আহা! বড় লজ্জাবান ব্যক্তি এলেন! শালা তুই যে ছোট ভাবিকে একা পেলে কি কি করিস তা আমি জানিনা ভেবেছিস?
:-কথায় কথায় আমার আদরকে টানবি না।
:-ইসসসস!! নিজের বেলায় ষোল আনা। আর আমার বেলায় চার আনাও নয় তাই না?
সায়ানের কথায় অধর কোণে হাসি ফুটে ওঠে তৈমুরের। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে সারার মুখটা স্বরণ করে।
সেই মুহূর্তেই অদুরের কোন এক রেস্টুরেন্ট থেকে ভেসে আসে গানের সুর
-যখন ওই রূপ স্বরণওও হয়!!
থাকে না লোক-লজ্জার ভয়!!
চলবে,,,