#সারা_জাহান
পর্ব,,,৩০
মৌমো তিতলী
❤️❤️❤️❤️
ছয় বন্ধুর গল্পগুজবের বিরতিতে ওয়েটার এসে আরেক দফা কফি দিয়ে গেলো। এই দিয়ে চার দফা কফি গেলো। তবুও তাদের খোশআলাপ চললো আরো বেশ কিছু সময়।
আলভীর ভাইয়ের একতরফা ভালোবাসে যে মেয়েটা সেই সাবিকা বলে মেয়েটার কথাই আনমনে ভাবছে লুবানা। “আচ্ছা কাউকে ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। তাহলে তাকে ভালোবেসে পেতে চাওয়া কেনো অপরাধ হবে? নিজের একান্ত চাওয়ার মানুষ টা যদি চোখের সামনে অন্য কোন মেয়েকে ভালোবাসে তাহলে তা সহ্য করা কি এতই সোজা?” সেও তো ভালোবাসে তৈমুর কে। কিন্তু তৈমুর কি তাকে চায়? লুবানা জানে তৈমুর তাকে ভালোবাসে না। হয়তো ওদের বাড়িতে আশ্রিতা মেয়েটাকেই ভালোবাসে। সেটা তো লুবানার সহ্য হয়না। লুবানার বিশ্বাস সে একদিন তৈমুর কে ঠিক জয় করে নেবে। তার ভালোবাসার জোরে।
লুবানা কে আনমনে বসে থাকতে দেখে তিশা লুবানার বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলে,,,
:-কি যে লাবু! তুই আবার কি ভাবছিস এতো?
লুবানা হেসে বলে,,,
:-না আমি আলভীর বলা কথাগুলো ভাবছিলাম। তারপর আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,,
:-তুই বললি না তোর শালী সাবিকা বলে মেয়েটা তোর ছোট ভাই কে ভালোবাসে। এখন মেয়েটা যদি তার ভালোবাসার মানুষটা কে পাওয়ার জন্য লড়াই করে তাহলে আমি তো তার কোন অন্যায় দেখছি না এখানে। আফটার অল সবারই তার ভালোবাসার মানুষটা কে নিজের করে পাওয়ার অধিকার আছে!
রাফি লুবানার কথায় মুখ বাঁকিয়ে বলে,,,
:-কি একটা বালের লজিক দিলি! ভাই মানলাম everything is fair in love and war..! কিন্তু তাই বলে এক পাক্ষিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে কি সেটা প্রযোজ্য? সেটা তখনই প্রযোজ্য হবে যখন দুটো মানুষ ভালোবাসে একে অপরের জন্য লড়াই করে। আর এক তরফা ভালোবাসা পেতে লড়াই করাকে ভালোবাসার লড়াই বলে না। এটাকে বলে তৃতীয় পক্ষের ছ্যাঁচড়ামি!!
জাস্ট আ বুলশিট থিঙ্ক!
রাফির কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে লুবানা। কথাটা তার গায়ে লেগেছে। কারন সেও একই পথের পথিক। লুবানা রেগে রাফির দিকে আঙুল তুলে বলে,,
:-তুই নিজের মুখটা বন্ধ রাখ রাফাইন্না। তুই সব সময় বেশি কথা বলিস!
:-কেনো রে? আমি তো একটা কথাও ভুল বলিনি। কিন্তু তোর এতো গায়ে লাগছে ক্যা? আর এমনে ছ্যাৎ কইরাই বা উঠলে কেনো লাবু সোনা!!
লুবানা চোখ রাঙিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ধমকে ওঠে তৈমুর।
:-Shirt up!! Will you guys stop? কি শুরু করেছিস দুজন মিলে?? এখানে আমরা মাইন্ড ফ্রেস করতে এসেছি নাকি তোদের এই বা*ল ছিড়া ঝগড়া দেখতে। ডিস্গাসটিং পিপলস!!
রাফি তৈমুরের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে যায়। তিশা রাফির দিকে হেলে গিয়ে মুখ নিচু করে ফিসফিস করে বলে,,,
:-বেশ হয়েছে!! আরো লাগ লাবুর পিছে! তৈমুর এমনিতেই ওকে দেখতে পারে না। আরো বকবক করতে দেখে রেগে গেছে ব্রো!
রাফিও তিশার মতো ফিসফিস করে বলে,,,
:-চুপ! ব্যাডা মনে হয় রাইগা গেছে মামা!! জমের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে অহন চুপ থাকায় বুদ্ধিমানের কাজ!!
আলভী সবার দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-থাম তোরা। যা হবে দেখা যাবে।
তৈমুর গম্ভীর স্বরে বলে,, আলভী তোর সাথে আমার আলাদা করে একটু কথা বলা দরকার। তুই সময় পেলে কাল একবার আমার হসপিটালে আসিস। আর একটা কথা তোদের সকলকে বলছি! মানে যে কারনে সকলকে বিশেষ করে ডাকা। তা হলো আর মাত্র দশদিন পর আমাদের সায়ানাইডের বিয়ে। আমার বোন তুলির সাথে। তোরা সবাই দু পক্ষ থেকেই ইনভাইটেড!
তারপর আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-তুই তোর ফুল ফ্যামিলি কে নিয়ে আসিস।
আলভী মাথা নেড়ে সায় দেয়।
রাফি দাঁত বের করে হেসে সায়ানের হাত নেড়ে বলে,,
:-কি রে শালা!! আলভীর পরে তাহলে তোরও এবার উইকেট পড়লো ব্যাটা!!
সায়ান হেসে বলে,,,
:-আমার শালাবাবু তৈমুর জাহান শিকদারের কৃপা!! যায় হোক! ভালোবাসার মানুষটা কে পাচ্ছি এই ঢের!! তোরা আসিস কিন্তু সবাই!!
:-বন্ধুরা হৈহৈ করে ওঠে সায়ানের বিয়ের কথায়।
********
হাতে একটা লাগেজ নিয়ে নিজের বরাদ্দকৃত রুম থেকে বেরিয়ে আসলো সাবিকা। সে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকেই চলে যাবে এখান থেকে। বাবার সাথে তার কথা হয়েছে। তিনিও সাবিকা কে বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছেন। এবার যা করার বাড়িতে গিয়েই করবে সাবিকা। তালহা কে এতো সহজে হারাতে দেবে না সে। মনে মনে জেদ জাগে। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে করেই হোক তালহা কে সে নিজের করে নিবেই।
রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই সামনে এসে দাঁড়ায় মহিদ। খালামণি কে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরোতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে।
:-এতো সকাল সকাল তুমি কোথায় যাচ্ছো খালামণি?
সাবিকা নিচু হয়ে মহিদের গালে হাত রেখে বলে,,,,
:-খালামণি তার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি সোনা!!
তাদের কথার মাঝেই সৃষ্টি আসে। বোনকে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে। অবাক হয়ে বলে,,
:-লাগেজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই?
সাবিকা কিছু বলার আগেই মহিদ মাকে বলে,,
:-খালামণি বাড়ি চলে যাচ্ছে আম্মু!
:-বাড়ি চলে যাচ্ছিস মানে! কিন্তু কেনো? আর হুট করে কাউকে কিছু না বলে তুই কিভাবে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিস?
বোনের কথায় মনে মনে বিরক্ত হয় সাবিকা। বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও আমি থাকতে চায়না। বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। বাবা গাড়ি পাঠিয়ে দিবে স্টেশনে।
সৃষ্টি অবাক হয় বোনের কথায়। বাবার সাথে তো তার কথা হলো একটু আগে। কি বাবা তো কিছু বললেন না।
সাবিকার দিকে এগিয়ে গিয়ে বোনের হাত ধরে বলে,,,
:-তুই তালহার কথায় মন খারাপ করে চলে যেতে চাইছিস না?
সাবিকা বোনের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,,
:-আমি তোর মতো মহান নই আপু। নিজের ভালোবাসার মানুষটা কে তুই ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছিস তো! আমার কষ্টটা তুই বুঝবি না। কিন্তু আমিও এরশাদ হামিদের মেয়ে সাবিকা হামিদ। এতো সহজে হাল ছেড়ে দিতে আমি শিখিনি। যেটা আমি চায় সেটা আমি আদায় করে নিতে জানি!
বলেই লাগেজ টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। সৃষ্টি পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও থামে না সাবিকা।
সৃষ্টির খারাপ লাগে বোনের জন্য। মুহুর্তেই ঠোঁটে ফুটে ওঠে তাচ্ছিল্যর হাসি! সবাই ভাবছে সে তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে ভালো আছে। সুখে সংসার করছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে সবার সেটাই মনে হবে। কিন্তু সৃষ্টি আর আলভী জানে তাদের সম্পর্কের ভেতরের কথা। সেখানে কি আদৌ ভালোবাসা ছিলো? বা আছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়না সৃষ্টি।
সৃষ্টির এবাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার আগে বা পরে এমন কি এখনো পর্যন্ত আলভী কখনো তাকে “ভালোবাসি” কথাটা বলেনি। কখনো তার ভালো লাগার কথা ভেবে একটা ছোট্ট উপহার বা ফুল এনে বলেনি ” এটা তোমার জন্য প্রিয়তমা” কখনো একান্তে বসে গভীর ভালোবাসায় নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরেনি। সৃষ্টি তো মাঝেমধ্যে এটাই ভেবে পায়না আলভী কেনো তাকে বিয়ে করেছিলো সেদিন। সে তো রাজি ছিলো না তাহলে কি এমন ঘটেছিলো যে হুট করে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো।
তার অবুঝ জেদি ছোট বোনটা হয়তো ভাবছে ভালোবাসার মানুষটা কে পাওয়ায় একমাত্র সৌভাগ্য। কিন্তু ও এটা বুঝতে পারছে না যাকে সে ভালোবাসে সেই মানুষ টার ভালোবাসা না পেলে এই একসাথে থাকাটা জীবনের সৌভাগ্য না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়!
মনে মনে বোনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে সৃষ্টি।জেদের বসে কোন ভুল না করে বসে মেয়েটা।
*”**********
🌿 দেখতে দেখতে চলে এলো সায়ান ও তুলির মেহেন্দীর দিন।
শিকদার হাউসের ছাদে সন্ধ্যা ৭টা। হালকা বাতাস বইছে, রঙিন আলোকসজ্জা, মিউজিক বেজে চলছে ব্যাকগ্রাউন্ডে “মেহেন্দী হ্যায় রচনেওয়ালি…”
—
তুলি হালকা হলুদ ও সবুজের মিশেলে লেহেঙ্গা পরেছে,, মাথায় জুঁই ফুলের গজরা। পার্লার থেকে আসা দুজন মেয়ে দুদিক থেকে তুলির দুহাতে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে।
রেশমী ফোনে ভিডিও করছে সেটা। এরপর সেও হাতে মেহেদি লাগাবে । সারা আগেই হাতে মেহেদি লাগিয়ে নিয়েছে। সারা আর রেশমী আজ গোলাপি রঙের শাড়ি পরেছে। বড় হওয়ার পর থেকে আজ প্রথম বার শাড়ি পরেছে সারা। হাঁটতে গিয়ে উষ্ঠা খাচ্ছে বারবার। তবুও সে খুশি। মারাত্মক সুন্দর লাগছে তাকে আজ। আত্মীয় স্বজন আর বাচ্চাদের হাসিতে গমগম করছে শিকদার হাউসের সুসজ্জিত ছাদটা।
তৈমুর কৃষ্ণ রঙা কুর্তি-পাজামাতে নিজেকে আবৃত করেছে আজ। বোনের বিয়ের সকল দায়িত্ব, শান্ত গম্ভীর মুখে পালন করে যাচ্ছে। ক্যাটারিং সার্ভিসের লোকেদের তাদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে আসে তৈমুর।
চারদিকে ফেইরি লাইটে ঝলমল করছে। ছাদে উঠে পুরো ছাদে একবার চোখ বুলিয়ে কাঙ্খিত রমণীকে খুঁজতে থাকে তৈমুর। তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না আসেপাশে। কোথায় গেলো তার তোতাপাখি টা!!
অনেক্ষণ ধরে তাকে না দেখে বুকের বাঁ পাশটা যে খালি খালি লাগছে মিঃ শিকদারের। এই মুহূর্তেই রিচার্জ দরকার তার! ছাদে তাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আবারো নিচে আসে। পা বাড়ায় সারার রুমের দিকে।
এদিকে সারা পড়েছে বিপাকে। ভেবেছিলো নিজের রুমে এসে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে একটু আরাম করে বসে মেহেদী শুকিয়ে নিবে। কিন্তু রুমে এসে ফ্যান ছাড়তেই মাথায় ছেড়ে রাখা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হাতে মেহেদি থাকার দরুন হাত দিয়ে চুল ঠিক করতেও পারছে না। কোনমতে বিছানা থেকে উঠে মুখ উঁচু করে ওয়াশ রুমে ঢুকে হাত দুটো ধুয়ে আসে।
ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতেই শাড়ির কুচিতে পা বেঁধে পড়তে নেয় বেচারি। চোখ নিচে বন্ধ করে নেয় সারা। কিন্তু নিজের শরীরের কোথাও ব্যাথা অনুভব না হতেই কপালে ভাঁজ পড়লো সারার। মুহুর্তেই নিজের উন্মুক্ত উদরে পুরুষালী হাতের ছোঁয়া পেতেই শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেল। আস্তে আস্তে চোখ পিটপিট করে তাকালো সারা। চোখ মেলতেই মুখের সামনে আরো একটি সুদর্শন চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজের অবস্থান ভুলে মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সারা। পলপল করে সময় এগিয়ে যায় তবু যেন দেখার শেষ হয়না দুজনের।
তৈমুরও ভীষণ মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারার দিকে। গোলাপী শাড়িতে তার প্রেয়সীকে একদম পদ্মফুলের ন্যায় স্নিগ্ধ কোমল লাগছে। ঠিক তখনই বাইরে জোরে বক্স বেজে ওঠে,,
🎵
Mehndi hai rachnewali
Haathon mein gehri laali
Kehte hain uski
Laali kabhi chhoote na
Mehndi hai rachnewali
Haathon mein gehri laali
Kehte hain uski
Laali kabhi chhoote na
গানের শব্দে সম্বিত ফিরে পায় দুজনে। সারা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তৈমুর এখনো সারার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। তৈমুরের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভীষণ লজ্জা লাগে সারার। কিছুক্ষণ পর লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকাতেই ঝটকা খেলো সারা। তার সুন্দর করে গুছিয়ে পরা শাড়ির কুচি খুলে নিচে পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে। সাথে সম্পুর্ন পেট,কোমর উন্মুক্ত হয়ে আছে। সারা হতভম্ব হয়ে ধুমম করে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়।
আচমকা সারার এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে চোখ কুঁচকে এলো তৈমুরের। সারার কাঁধে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বলে,,,
:-what happens Shara?? Are you okay?
তৈমুরের কোথায় লজ্জায় চোখমুখ খিচে দাঁড়ায় সারা। কোনরকম মিনমিন করে বলে,,
:-আমি ঠিক আছি। আপনি প্লিজ একটু রেশমি বা খালামনি কাউকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিন!
:-হুয়াট?? বাট হুয়াই? দেখি এদিকে তাকা? কি সমস্যা আমাকে বল!
তৈমুরের কথায় আর্তনাদ করে উঠে সারা!
:-না…..না! আপনি প্লিজ রেশমী কে আমার রুমে পাঠিয়ে দিন না! কিছু হয়নি বললাম তো!
:-কিছু হয়নি তাহলে আমার থেকে মুখ লুকাচ্ছিস কেন? দেখি এদিকে তাকা!
বলেই সারার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘোরায় তৈমুর। সারা ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তৈমুর সারার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলাতেই ঢোক গিলে। মুহুর্তেই পুরো শরীর গরম হয়ে যায় তৈমুরের। বুকের ওঠানামা দ্রুত হয়। কেমন একটা ঘোরে চলে যায় তৈমুর।
সারার পায়ের কাছে নিচু হয়ে বসে শাড়ির কুচি গুলো হাতে তুলে নেয়। কুচি টা এলোমেলো হয়নি। যে শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছে সে বুদ্ধি করে কুচিগুলো একজোট করে সেফটিপিন দিয়ে আটকে দিয়েছে। তাই কুচি কোমর থেকে ছুটে গেলেও এলোমেলো হয়নি।
তৈমুর কুচি টা হাতে নিয়ে সারার কোমরে আলতো করে গুজে দেয়। পেটে তৈমুরের হাতের স্পর্শ অনুভব হতেই থরথর করে কেঁপে ওঠে সারা। ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করে। তৈমুর ঠাঁই বসে আছে সারার পায়ের কাছে। পুরুষালী অদম্য ইচ্ছাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মস্তিষ্কে। চাইলেও নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না তৈমুর। হাত পা অস্থির ভাবে কাঁপতে থাকে। নিজের বেপরোয়া অনুভূতি স্ফুলিঙ্গের ন্যায় ফুটতে দেখে নিজেই হতবাক তৈমুর। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো। নাহ! কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আচ্ছা সারা তো তার বিয়ে করা বউ! আজ এই মুহূর্তে একটু বেশি ছুঁয়ে দিলে কি খুব অন্যায় হবে?
মনটা ফুঁসে বলে ওঠে,,না না কোন অন্যায় হবে না। হুট করে উঠে দাড়ালো তৈমুর। দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। তৈমুর কে যেতে দেখে হাঁফ ছাড়লো সারা। কিন্তু ক্ষণিকের মধ্যেই তার এই ভুল ভেঙ্গে গেল দরজা লাগানোর শব্দে,,, হকচকিয়ে সামনে তাকানোর ফুরসৎ পেলো না মেয়েটা।
মুহুর্তেই কারো বেপরোয়া আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো সে। তৈমুরের যেন সমস্ত হুঁশ জ্ঞান লোপ পেলো! উতলা হয়ে সারার অধরযুগল শুষে নিতে নিতেই কোলে তুলে নিলো তাকে। মুহুর্তেই সারার পিঠ গিয়ে ঠেকলো নরম বিছানায়। সারাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই শাড়ির আঁচল টা এক টানে খুলে ফেললো তৈমুর। পরপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সারার নরম তুলতুলে উদরের ওপরে। মুখ ডুবিয়ে দিলো সেথায়!
এদিকে তৈমুরের আচম্বিত কাজে খেই হারায় সারা। শরীরে তিব্র কাঁপুনি অনুভব হয়। অদ্ভুত অস্থিরতায় খামচে ধরে তৈমুরের মাথার চুল গুলো।
আরো বেশি উতলা হয়ে উঠলো তৈমুর। সারার ওপরে নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। সারার ঘাড়ে,গলায়, কানের লতিতে জিভের আলিঙ্গনে দিশেহারা করে তুললো সারাকে। এক হাতে কোমর জড়িয়ে আরেক হাত বুকের কাছে ব্লাউজে রাখতেই টনক নড়ে উঠলো সারার। পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে বোধগম্য হতেই অস্থির হয়ে তৈমুরের থেকে ছাড়া পেতে ছুটোছুটি শুরু করলো সে।
নিজ কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তিতে কপাল গুটিয়ে এলো তৈমুরের। সারার গলায় মুখ ডুবিয়ে অস্থির হাস্কি স্বরে বলে উঠলো,,,
:-এভাবে নড়িস না প্লিজ জান! Let me caress you bebe!! desperately I am dying!
সারা অস্ফুট স্বরে বলে,,,
:-প্লিজ জাহান ভাইয়া শান্ত হন। কি করছেন আপনি!
সারার আকুতি যেন কানে পৌঁছালো না তৈমুরের।
নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়ার মতো জড়ানো গলায় বলে,,,
:-I am begging you, please calm me down. Jaan….I love you so much! Bebe 😘
বলে আরো উত্তেজিত হয়ে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে সারাকে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সারা। সারার ফুঁপানো কানে পৌঁছাতেই আচমকা সারাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো তৈমুর। ক্রন্দনরত প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে মাথার চুল গুলো খামচে ধরে বিড়বিড় করে উঠলো,,,,
:-শিট! শিট! শিট।What am I doing? I’m losing my mind!! Oh no!
সারা দুহাতে মুখ ঢেকে হিচকি তুলে কাঁদছে। শাড়ির আঁচল টা তখনও এলোমেলো। তৈমুর জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। তারপর আস্তে করে সারার শাড়ির আঁচল টা হাতে নিয়ে তা পরম যত্নে জড়িয়ে দেয় সারার শরীরে। দু হাতে সারাকে কোলে তুলে বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করায়।
নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে এলোমেলো চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,,,
:-আ’ম সরি জান! আমার এমন কন্ট্রোললেস হওয়া উচিত হয়নি। আমাকে মাফ করে দে জান! আমাকে ভুল বুঝিস না প্লিজ 🙏
সারা তবুও কাঁদতে থাকে। বরং কান্নার তোড় কিছুটা বাড়ে। অসহায় বোধ করে তৈমুর। সারার মুখ থেকে হাত দুটো টেনে সরিয়ে আনে। তারপর হাতের আঙ্গুল দিয়ে সারার চোখ মুছে দিয়ে দুহাতে মুখ টা তুলে ধরে বলে,,,
:-আমাকে তোর ভীষণ খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে তাইনা?
তোর মনে হচ্ছে আমি তোকে…… কথাটা অসমাপ্ত রেখেই তাচ্ছিল্য হাসে তৈমুর। বুকটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়। অন্তর দহনে পুড়তে থাকে হৃৎপিণ্ড। না পারছে সারাকে তাদের সম্পর্কের বৈধতার কথা জানাতে না পারছে নিজেকে আটকাতে। মাঝখানে থেকে সাফার করছে মেয়েটা।
সারাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় তৈমুর। চোখ তুলে তাকায় না মেয়েটা। সেদিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তৈমুর। ধীর কন্ঠে বলে ওঠে,,,
:-আ’ম সরি। পারলে এই খারাপ লোকটাকে ক্ষমা করে দিস। আর কখনো এমন জঘন্য ভুল না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবো। চিন্তা করিস না। আজকের কথা ভেবে নিজের আনন্দ নষ্ট করিস না জান। আমি আর আসবো না তোর সামনে। বলেই দরজা খুলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
এদিকে তৈমুর প্রস্থান নিতেই সেদিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সারা। কি বলে গেল লোকটা? তার সামনে আর আসবে না? কিন্তু কেনো? সে তো তাকে ভুল বোঝেনি। শুধু পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে কেঁদেছে একটু। কান্না ভুলে ফাঁকা দরজার দিকে তাকিয়ে থম মেরে বসে থাকলো সারা।
********
তৈমুর সারার রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই সিঁড়ির কাছে দেখা মেলে রিনা শিকদারের সাথে। রিনা শিকদার ব্যস্ত হাতে কয়েকটা শাড়ির ডালা হাতে ওপরে তুলির রুমের দিকে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে ছেলেকে দেখতে পায়। তৈমুরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন কেমন উদ্ভ্রান্ত লাগছে তার ছেলেটা কে। হাতে ডালা থাকার দরুন দু’পা এগিয়ে গিয়ে ছেলের সামনে গিয়ে সুধায়,,
:-কি হয়েছে আব্বা তোমার? চোখমুখ এমন লাগছে কেনো? শরীর টরীর খারাপ হলো নাকি আবার?
মায়ের বিচলিত ভাব দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করে তৈমুর। মায়ের হাত থেকে ডালা গুলো হাতে নিয়ে বলে,,,
:-কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি আম্মু। কাজ করছি তো সারাদিন আর কিছু খাওয়া হয়নি এখনও। তাই এমন লাগছে হয়তো।
ছেলের কথায় আসস্থ হন রিনা শিকদার। তবে ছেলে এখনো অভুক্ত জেনে বিচলিত হন। বলেন,,,
:- তুমি এখনো কিছু খাওনি আব্বা? এখনই গিয়ে খেয়ে নাও! মেহেন্দির অনুষ্ঠান তো শেষ হয়েই গেছে।
তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলেন,,
:- আব্বা সারা কোথায়? ওকে দেখলাম না যে! মেহেদির অনুষ্ঠানেও ছিলো না। ঠিক আছে তো মেয়েটা?
তৈমুর আড়চোখে একবার সারার রুমের দিকে তাকালো। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-সারার একটু মাথা ব্যথা করছিলো। তাই ঘরেই আছে।
রিনা শিকদার বিচলিত হয়ে ওঠেন।
:-কি বলছো আব্বা! আমি তাহলে গিয়ে একবার দেখে আসি। বলেই ওপরে যেতে নিলে বাঁধ সাধে তৈমুর,,
:-আম্মু.. আম্মু শান্ত হও। আমি ওকে পেইন কিলার দিয়ে দিয়েছি। এখন ঘুমাচ্ছে। এখন আর গিয়ে ডিস্টার্ব না করায় ভালো।
ছেলের কথায় আসস্থ হয়ে মাথা নেড়ে সায় দেন রিনা শিকদার। অতঃপর নিচে নেমে আসে। মায়ের প্রস্থান হতেই সস্থির নিঃশ্বাস নেয় তৈমুর। মলিন মুখে শাড়ির ডালা হাতে পা বাড়ায় তুলির রুমের দিকে।
#সারা_জাহান
পর্ব,,,৩১
মৌমো তিতলী
❤️
আজ একটু সকাল সকাল হসপিটালে এলো তৈমুর। ইমার্জেন্সি ওটি আছে একটা। হসপিটালে ঢুকতেই একজন ওয়ার্ড বয় এসে জানালো ওটি রেডি হয়ে গেছে,তারা তৈমুরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তৈমুর গম্ভীর মুখে অপারেশন থিয়েটারের দিকে পা বাড়ালো। লাইফ কেয়ারে দুজন ইন্টার্ন এসেছে গত সপ্তাহে। তারাই আজকে তৈমুর কে এসিস্ট করবে।
তৈমুর হসপিটালের চেঞ্জিং রুমে ঢুকে ওটির জন্য রেডি হয়ে বেরোলো। তারপর দ্রুত পায়ে এসে ঢুকলো ওটিতে।
*********
বিলাসবহুল একটা বাড়ির স্তব্ধ একটা রুমের মাঝে সবকিছু এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখলে মনে হবে একটু আগেই রুমে বুঝি ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজানো গোছানো জিনিস গুলো ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আয়না ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে পুরো রুম জুড়ে। বেডের ওপর টানটান করে বিছানো চাদর দলামলা হয়ে ঝুলে আছে খাটের এক কোণে।
রুমের সেন্টার টেবিল, ফুলদানি সব উল্টেপাল্টে পড়ে আছে ফ্লোরে। পুরো তছনছ করে জবুথবু অবস্থার রুমের এক কোনায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে এক অপরূপা সুন্দরী যুবতী। অথচ তার অপরুপ সৌন্দর্যের প্রতি আজ ভীষণ আক্ষেপ হচ্ছে! এই রুপ এই সৌন্দর্য তো কোন কাজে আসেনি তার। ভীষণ ক্রোধে মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে মেয়েটা। টানা টানা চোখ দুটো কান্নার দরুন লাল হয়ে ফুলে আছে।
ড্রইং রুমে বাড়ির সব স্টাফ রা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কারো সাহস নেই ওপরে গিয়ে দেখার সেখান কি ঘটছে। তারা চোখ মুখ কুঁচকে অপেক্ষা করছে বাড়ির কর্তার ফিরে আসার। তিনিই একমাত্র পারবেন এই পাগল,জেদি মেয়েকে সামলাতে।
কয়েক মিনিটের মাঝেই দুটো বিএমডব্লিউ গাড়ি এসে থামলো সদর দরজায়।
গাড়ি এসে থামতেই একটা গাড়ি থেকে নেমে এলো গার্ডেরা। একজন গিয়ে সামনের গাড়ির দরজা খুলে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন একজন সত্তরউর্ধ প্রৌঢ়। চুল,দাড়ি সবটা সাদা হয়ে গেছে কবেই। অথচ ঠাটভাট এখনো তরুণ। স্যুট, বুট,টাই,স্যু সবটা একদম পরিপাটি।গলায় মোটা স্বর্নের চেইন,হাতে সোভা পাচ্ছে একটা চকচকে Calabash pipe. যা তিনি মাঝে মধ্যে মুখে নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন।
গাড়ি থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই কয়েকজন স্টাফ ছুটে এলেন তার দিকে। একজন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,,
:- স্যার আপনি এসেছেন। আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আপনি শিগগিরই উপরে যান। ছোট ম্যাডাম ঘরে ভাঙচুর করছেন। আমরা কেউ ভয়ে সেদিকে যায়নি।
স্টাফের কথা শুনে প্রৌঢ় লোকটা একবার উপরের দিকে চাইলেন। তারপর গটগট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন। গিয়ে থামলেন নির্দিষ্ট কামরার সামনে।
দরজায় করাঘাত করে নাম ধরে কয়েকবার ডাকতেই দরজা খুলে দিলো মেয়েটা।
লোকটা ভেতরে ঢুকে রুমের চারদিকে চোখ বুলালেন। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চিৎকার দিয়ে একজন স্টাফকে ডাকলেন তিনি। একজন আসলে রুমটা পরিষ্কার করতে আদেশ দিলেন। তারপর ধীরে সুস্থে মেয়েটাকে নিয়ে অন্য একটা রুমে চলে গেলেন। মেয়েটাকে বসিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসলেন তার সামনে। ধীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,,,
:-What happened, my princess?? এতো রেগে আছে কেনো আমার বাচ্চা টা?
বাবার আদুরে কথায় হুহু করে কেঁদে উঠলো সাবিকা। বাবা কে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,,
:-Dad, I want Talha! I want my Talha at any cost!!
মেয়ের কথায় নড়েচড়ে বসলেন এরশাদ হামিদ। ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
:-I know that, my princess. এইজন্যই তো তোমার দুলাভাইকে দিয়ে সম্বন্ধ পাঠিয়েছি! তালহা তোমারই হবে। Don’t worry!!
সাবিকা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,,
:-কিন্তু ড্যাড তালহা যে বললো He won’t marry me..!! তালহা অন্য কোন মেয়েকে ভালোবাসে ড্যাড। তালহা আমাকে ভালোবাসে না। বলে আবার কাঁদতে লাগলো।
এরশাদ হামিদ মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,,
:-Don’t cry, my princess… তুমি জানো তোমরা দুই বোন আমার কাছে সবকিছু! আজ পর্যন্ত তোমাদের কোন চাওয়া আমি অপূর্ণ রেখেছি? বলো? রেখেছি কখনো অপূর্ণ?
তোমার আপুও আলভীকে ভালবেসেছিলো। কিন্তু আলভীর অন্য মেয়েকে ভালোবাসতো। কিন্তু কি হয়েছে তাতে? সেই তো তোমার আপুকেই বিয়ে করেছে। সৃষ্টির সাথেই সংসার করছে।
তেমন তুমি যখন তালহাকে চেয়েছো তখন তালহা কে তুমিই পাবে। তালহা তোমাকেই বিয়ে করবে। আমি কথা দিচ্ছি। তালহাকে আমি তোমার পায়ের কাছে এনে দেবো। কাঁদে না বাচ্চা! বলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন এরশাদ হামিদ।
বাবার কথায় কিছুটা শান্ত হলো সাবিকা। মনে মনে প্রেমিক পুরুষ কে নিয়ে কল্পনায় নানা স্বপ্ন সাজাই।
কিছুক্ষণ পর সাবিকা ঘুমিয়ে পড়লে তাকে শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন এরশাদ। ফোনটা হাতে নিয়ে কাউকে একটা ফোন করলেন। ফোন রিসিভ হতেই তিনি বললেন,,,
:-একটা ছেলের ছবি পাঠাচ্ছি। খোঁজ লাগাও ছেলেটার কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে? তারপর মেয়েটার এক এক ইনফরমেশন আমার চাই!! গট ইট!
আদেশ দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিলেন তিনি। চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড় করেন এরশাদ,,,
:-যে মেয়ের কারণে আমার ছোট্ট প্রিন্সেসের চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে তাকে তো তার হিসাবটা বুঝিয়ে দিতেই হবে। ঠিক যেমনটা কয়েক বছর আগে কাউকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম!! বলেই রহস্যময় হাসি দিলেন তিনি।
***********
দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পর ওটি থেকে বেরিয়ে আসলো তৈমুর। অপারেশন থিয়েটারের বাইরেই রোগীর পরিবারের লোকেরা অপেক্ষা করছিলো। তৈমুর কে বেরিয়ে আসতে দেখেই তারা একেকজন ঘিরে ধরলো তৈমুর কে,,
:-স্যার কেমন আছে আমার বাবা?
:-ডক্টর আমার স্বামী কেমন আছে?
তৈমুর মুখের মাস্কটা সরিয়ে হাসিমুখে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,
:-Don’t worry,! operation successful..
উনি এখন আশঙ্কামুক্ত। কিছুক্ষণ পর ওনাকে জেনারেল ওয়ার্ডে লিফট করা হবে। রোগীর জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে। জ্ঞান ফিরলে আপনারা তার সাথে কথা বলতে পারবেন।
তৈমুরের কথায় রোগীর পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটলো। একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এসে তৈমুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। তৈমুর কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে মিষ্টি হেসে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো।
কেবিনে ফিরতেই ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো তৈমুর। একজন ওয়ার্ড বয় এসে জানালো,,
:-স্যার একজন দেখা করতে এসেছেন আপনার সাথে।
তৈমুর ওয়ার্ড বয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,,
:-আমার কেবিনে পাঠিয়ে দাও।
ওয়ার্ড বয় মাথা নেড়ে “জ্বী” বলে বেরিয়ে গেল। দুমিনিটের মাথায় কেবিনে প্রবেশ করলো আলভী।
বন্ধুকে দেখে এগিয়ে এলো তৈমুর। হেসে জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে। আলভী কে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলো,,
:-তারপর বল চা না কফি?
আলভী হেসে জবাব দেয়,,,
:-ধুর এসব ফর্মালিটি ছাড় তো! এসব অন্য কোথাও দেখাস!
:-আরে দোস্ত তাই বললে হয় নাকি! হাজার হোক এই প্রথমবার তুই আমার হসপিটালে এলি। বলেই পাশের টেলিফোন তুলে কাউকে দু কাপ কফির অর্ডার দিলো তৈমুর,,,,,
:-তারপর বল! আন্টি কেমন আছেন? আর তোর ছেলে! কি যেন নাম রেখেছিলি?
:-মহিদ। মহিদ এহমাদ। হ্যাঁ ভালো আছে সবাই! মায়ের একটু সুগার প্রবলেম সেটা তো তুই জানিসই।
:-হুমম! যায় হোক। যে কারনে তোকে বিশেষ করে আসতে বলেছিলাম। আমার তোর শশুর আর তার চৌদগুষ্ঠির সবার ইনফরমেশন চাই!
তৈমুরের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় আলভী।
:-বুঝলাম না! তুই এসব জেনে কি করবি?
:-আরে ইয়ার!! গাটার ম্যায় তুই পড়েছিস! আর আমরা তোর বন্ধ,তো টেনে তোলার দায়িত্ব কাদের? এই আমাদের তাই না? আর তুই কাল যা যা বললি তাতে তোর শশুর মশাই লোকটাকে আমার খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। শালা একজন সেনাবাহিনীর এক্সপায়ারি মাল! কিন্তু তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য কেনো যেনো হারামজাদা টাইপের!
তৈমুরের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো আলভী। বললো,,,
:-কি বলবো দোস্ত! উনার স্বভাব সম্পর্কে তো কালকে আমিই বলেছিলাম। উনি প্রচন্ড পরিমাণের স্বার্থপর। আমার শাশুড়ি মারা গেছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। তখন থেকেই দুই মেয়েকে আগলে বড় করেছেন তিনি। আমার ওয়াইফ সৃষ্টি, স্বভাবগত দিক থেকে মায়ের মত হয়েছে। কিন্তু আমার শালী সাবিকা একটু অন্যরকম। এর স্বভাব চরিত্র পুরাই বাপের ফটোকপি। প্রচন্ড একরোখা আর জেদি।
আমার শ্বশুর তো আমাকে চাকরি হারানোর হুমকি দিয়ে সৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে চাকরিটা আমার কাছে সোনার হরিণের মতোই ছিলো। জানিসই তো! সেবার বাবা মারা গেলেন, মাথার ওপরে সংসারের দায়িত্ব, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, মায়ের দেখাশোনা,চিকিৎসা এই সবকিছুতে আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছিলাম। কিন্তু আমার ভাইয়ের তো সেই দায় নেই। ওর জীবন ওর। সেখানেও ওই লোকটা থাবা বসাতে চাইছেন। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।
তৈমুর সবটা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,,,
:-তোর শশুরের আর কোন রিলেটিভ নেই? মানে ফ্যামিলি!
:-হ্যাঁ আছে। আমার শশুর মশায়েরা তিন ভাই বোন। আমার ফুপু শাশুড়ি দেশের বাইরে থাকেন তার পরিবার নিয়ে। আর আমার শশুরের ছোট ভাই আছে, জাহাঙ্গীর কবির। উনি একজন ডক্টর এন্ড প্রোফেসর।
আলভীর কথায় বিষ্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো তৈমুরের। উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো চেয়ার ছেড়ে।
:-হুয়াট! কি নাম বললি?
তৈমুরের রিয়াকশনে ভড়কে গেলো আলভী। থতমত খেয়ে বললো,,
:-জাহাঙ্গীর কবির! হুয়াই?
:-মানে তুই বলতে চাইছিস “হেলথ হার্ট” হসপিটালের প্রফেসর ডাঃ জাহাঙ্গীর কবি?
:-হ্যাঁ উনিই। আমার চাচা শ্বশুর। আর হেলথ হার্ট হসপিটালও ওনাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। মানে ওই হাসপাতালের শেয়ার আমার শশুর এবং চাচা শ্বশুর দু’জনেরই। এমনকি এরা যা করে দুজনে পরামর্শ করেই করে।
তৈমুর ধপ করে বসে পড়লো।
:-হোয়াট দ্যা ফা*ক!!
:-হুয়াট 🙄
:-Did you know! আট বছর আগে ওই হসপিটালেই মায়ার postmortem হয়েছিলো। আর তা কে করেছিলো জানিস? তোর চাচা শ্বশুর ডঃ জাহাঙ্গীর কবির। He was the one who said in the report that it was suicide!!
তৈমুরের কথায় গলা শুকিয়ে এলো আলভীর। অন্তরটা কেঁপে উঠলো তার। এসির মাঝেও কপালে দেখা দিলো চিকন ঘাম। ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো আলভী। অস্ফুট স্বরে বলল,,,
:-What do you mean, somehow এটা বলতে চাইছিস না তো,ওরা মায়াকে খু…..!
:-I’m not sure.,,, কিন্তু সম্ভবনা আছে। এই ডঃ জাহাঙ্গীর কবির লোকটা মোটেও সুবিধার না। সাথে যেটুকু বুঝলাম তোর শশুর একজন জাতে হারামজাদা। এদের দুটোর কিছু তো পাস্ট থাকবে! আমাদের সবটুকু জানতে হবে আলভী! By any means!!
:-কি করবো তাহলে এখন?
:-আলভী তোর এবার ছুটি শেষ হলে ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে একটাই কাজ হবে!! এই এরশাদ হামিদের সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন অল ইনফরমেশন কালেক্ট করা!!
আলভী কিছুক্ষণ ভেবে বলে,,,
:-ওকে! চিন্তা করিস না। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো।
:-হ্যাঁ। আমিও এখানে “হেল্থ হার্টের” সমস্ত ইনফরমেশন কালেক্ট করে ফেলবো সমস্যা নেই। আমার মন বলছে এখানে কিছু তো একটা আছে আমাদের সবার অগোচরে থেকে গেছে! And this is what I will bring to everyone’s!!
আলভী মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে এক মিষ্টি মায়াময় মুখ! তার কাজল কালো চোখ, ঠোঁটে টানা হাসি। বুকটা ভার হয়ে আসে আলভীর। বুকে যে তার খুনের দায় চেপে আছে! এজনমে কি আর সেই ভার নামবে? দম বন্ধ হয়ে আসে আলভীর।
তৈমুর এগিয়ে এসে আলভীর পাশে বসে কাঁধে হাত রাখে। মুহুর্তেই চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো আলভী। বন্ধ দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রু!
কিছুক্ষণ পর একজন ওয়ার্ড বয় এসে কফি দিয়ে গেলো। তৈমুর, আলভী নিজেদের স্বাভাবিক করে নেয়। তৈমুর কফিতে চুমুক দিয়ে আলভীর দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-কাল আসিস কিন্তু বিয়েতে। ভাবি,মহিদ আর বিশেষ করে তালহা কে নিয়ে আসিস। ওর সাথে আমার কিছু কথা বলা জরুরি।
আলভীও ধীরে সুস্থে কফিতে চুমুক দিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
**********
তুলির হলুদ সন্ধ্যা 💛
সন্ধ্যা নামতেই পুরো শিকদার হাউস আলোয় ঝলমল করে উঠলো। তুলির শরীর জুড়ে আজ কাঁচা ফুলের গহনা। গোলাপ রজনীগন্ধা ফুলের গহনা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে তুলি কে। পরনে বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি। আটপৌরে পরানো হয়েছে শাড়িটা। ঠোঁট দুটো কড়া লাল রঙে রাঙিয়েছে।সব মিলিয়ে অপার্থিব সৌন্দর্যের এক জলন্ত লীলাভূমি আজ তুলি!
সারা একটা হলুদ রঙের ফ্লোরটাচ গাউন পরেছে। সাথে একদম সিম্পল সাদা পাথরের অর্নামেন্টে অপ্সরী লাগছে তাকে। কোমর ছাড়ানো কোঁকড়া চুল গুলো ছেড়ে রাখা। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। হাতের সাদা পাথরের চুড়ি গুলো ঠিক করতে করতে রেশমীর রুমে ঢোকে সারা।
পুরো রুম ফাঁকা! একি: রেশমী আপু কোথাও গেলো! ঘুরে বাইরে বেরোতে নিলে কিছু শব্দ পায় ব্যালকনি থেকে। রেশমী চাপা স্বরে কারো সাথে কথা বলছে!!
কপাল কুঁচকে এলো সারার। রেশমী আপু এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কার সাথে কথা বলছে! সারা এগিয়ে গিয়ে ব্যালকনির দরজায় দাড়াতেই শুনতে পেলো,,
:-আই লাভ ইউ তালহা!!
সারার চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো। রেশমী আপু কাউকে ভালোবাসে বলছে!!! কে সে?
সারা হুড়মুড়িয়ে ব্যালকনিতে ঢুকে গেল। এদিকে সারার আগমনের আভাস পেতেই খট করে ফোনের লাইন কেটে দিলো রেশমী। সারাকে দেখে হকচকিয়ে গেল সে। সারা অবাক চিৎকার করে বলে,,,
:-রেশমী আপু তুমি কাকে আই লাভ ইউ বললে? এই দেখো একদম মিথ্যা কথা বলবে না কিন্তু! আমি স্পষ্ট শুনলাম তুমি কাউকে আই লাভ ইউ বলেছো!
রেশমী দ্রুত এগিয়ে এসে সারার মুখটা চেপে ধরে বলে,,,
:-আল্লাহ! এতো জোরে চিৎকার করছিস কেন গাধা!! আস্তে বল! কেউ শুনবে!
:-উমমম!
:-কি উমম??
সারা রেশমির চেপে ধরা হাতের দিকে ইশারা করে। সারার ইশারা বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে নিলো রেশমী।
সারা হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে বললো,,,
:-তুমি প্রেম করছো রেশমী আপু? আমাকে বললে না কেনো?
:-উফফফ সারা! প্রেম করছো আবার কি কথা! এই তো কিছুদিন মাত্র হলো….. বলতে বলতেই মুখ লাল হয়ে গেল রেশমীর।
রেশমীর লজ্জা রাঙ্গা মুখের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো সারা।
:-এমাআআ রেশমী আপু তুমি তো ব্লাস করছো! তা কে সেই সৌভাগ্যবান পুরুষ টা যার কথা মনে হতেই তুমি একদম লাজে টমেটো হয়ে গেলে? বলো বলো বলো??
সারার উস্কানিতে লাজুক হেসে দিলো রেশমী। তারপর সবটা খুলে বললো সারা কে। সবটা শুনে সারা তো অবাক!! তবে সে খুশিও হয় ভীষণ। হেসে জড়িয়ে ধরে রেশমী কে। কনগ্রাচুলেশন জানায় তার ভালোবাসার অনুভূতি কে।
পরপর দুজন বেরিয়ে আসে রুম থেকে। ছাদে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ছেলের বাড়ি থেকে হলুদ আসবে। তারপরেই তুলিকে হলুদ ছোঁয়ানো হবে।
*********
তৈমুর শিকদার ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে সব কিছু তদারকি করছিলো। তুলির গায়ে হলুদের আয়োজনে ব্যস্ত সবাই। আলো-ঝলমলে ছাদ, সাদা-হলুদের বেলুন, গাঁদা আর রজনীগন্ধার তোড়ায় চারপাশ ভরে গেছে। অতিথিরা হাসছে, ছবি তুলছে, আর পেছনে বাজছে,,
হলুদের আলোয় রাঙা আজ বধূর মুখ,
আকাশটাও হাসে, উড়ছে শাড়ির রং।
আনন্দে মাতোয়ারা, বেণীতে ফুলের মালা,
আজ সুখেরা বাজায় মনেতে ধূণ…….।
এই হাসি আর আনন্দের মাঝে হঠাৎই তৈমুরের চোখ আটকে গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অষ্টাদশীর দিকে।
সারা!
ফ্লোর টাচ হলুদ গাউনে যেন এক খাঁটি কুর্চিপুষ্প ফুটে উঠেছে তৈমুরের চোখের সামনে। ঢেউ খেলানো খোলা চুল, কোমল মুখে মুগ্ধতা—সারা যেন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজের মতো করেই। তৈমুর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, বাকিদের ব্যস্ততার ভীড়েও তার কাছে যেন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর এক মোচড় দিয়ে উঠলো। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখেও তার ভিতরে জমে থাকা কথা গুলো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, অথচ মুখ ফুটে বললো না কিছুই। মনে মনে শুধু ভাবলো—
*“তুই জানিস না, সারা…
এই গাউনটা যতটা সুন্দর, তার চাইতেও বহুগুণ বেশি সুন্দর তুই।
তুই হাসলে আমার ভেতরের সব গুঞ্জন থেমে যায়।
তুই চুপ করে থাকলেও, আমার মনে হাজারো শব্দ বাজে…
সবচেয়ে শান্ত অনুভূতিটা তুই—আর সবচেয়ে অস্থিরতাটাও।
তোর চোখে তাকালেই একরাশ তৃপ্তি পাই, আবার হারিয়ে ফেলতে পারার ভয়েও কাঁপে মন।
তুই জানিস! তোর প্রতি আমার টানটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
আজ তো আমার বোনের গায়ে হলুদের দিন,
তবু আমি শুধু তোকে দেখছি—
কারণ তুই যেখানে, সেখানেই তো আমার মনটা পড়ে থাকে
তৈমুর চোখ ফিরিয়ে নেয় না, যতক্ষণ না সারা হাসতে হাসতে তার দিকে তাকায়।
সারা তার দিকে তাকাতেই চোখে ফিরিয়ে নিলো তৈমুর। কালকের পর থেকে সারাকে একরকম এড়িয়ে চলছে তৈমুর।
বিষয়টা খেয়াল করেছে সারা। কিন্তু তৈমুরের সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ পায়নি।
***********
হলুদের আলোকছটায় ছাদ ঝলমল করছে। তুলির গায়ে হলুদের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ঢাকের বাজনা, হাসাহাসি, আর ফুলের গন্ধে ভরে আছে পরিবেশ।
সায়ানের বাড়ি থেকে আনা হলুদের থালা নিয়ে কিছু ছেলেমেয়েরা ঢুকলো ছাদে। সবার মাঝখানে একটু স্টাইল করে হাঁটছে একজন — সিয়াম। ছিপছিপে গড়ন, চোখে চশমা, কিন্তু চোখে-মুখে ভরপুর কৌতূহল।
সিয়াম কনে পক্ষের কাছে হলুদের থালাটা বুঝিয়ে দিলো। তাদের হালকা পাতলা নাস্তার আয়োজন করা হয়েছিল আগেই। মেহমানদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখতে চান না শিকদার ফ্যামিলি। নাস্তার পর্ব সেরে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে চারপাশের সাজ দেখছিলো সিয়াম। হুট করে কারো দিকে চোখ পড়তেই আটকে যায়…!!
হলুদ গাউনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে থমকে যায় সে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে একটু বাঁকা হাসি, চোখে একরাশ মুগ্ধতা।
—
সিয়াম কে এক দৃষ্টিতে কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বন্ধুরা হাসি চেপে বলে,,,
:-কি বন্ধু কোন ললনা পছন্দ হলো নাকি??
সিয়াম হালকা হেসে বলে,,,
“:-ওই, ওই যে মেয়েটা… লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে আছে… কে রে ও? নায়িকার মতো দেখাচ্ছে!”
ওর এক বন্ধু বললো,,
:-স্টেজের কাছে কেউ একজন বলছিল ওই মেয়েটা শিকদার পরিবারের ‘লিটল প্রিন্সেস’… নাম সারা।”
সিয়াম চোখ না নামিয়ে বলে,,,
:-লিটল না রে ভাই!! একেবারে হট প্রিন্সেস… তোরা দেখে নে ভালো করে,, মেয়েটা আমার ভবিষ্যত ব্রাইড হতে পারে!”
বন্ধুরা একসাথে ওওওওওও করে উল্লাস প্রকাশ করে।
সিয়াম বাঁকা হেসে সামনের দিকে এগোয়, সারার কাছে গিয়ে থামে।
সিয়াম হালকা হাসি দিয়ে বলে,,
:-“হাই… আমি সিয়াম, সায়ান ভাইয়ার মামাতো ভাই।”
হুট করে এমন অপরিচিত কাউকে কথা বলতে দেখে অপ্রস্তুত হয় সারা। তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। ভদ্রভাবে, হালকা মাথা নেড়ে সায় দেয়,,,
:-“ওহ, আচ্ছা হ্যালো!! আমি সারা।”
সিয়াম মুগ্ধ চোখে তাকায়। বলে,,,
:-জানি!… আপনি শুধু নামেই সারা না, আপনাকে দেখে মনও পুরো সারা হয়ে গেলো আমার।”
সারা অস্বস্তিতে নিসপিস করে ওঠে। এক্সকিউজ মি! বলে সেখান থেকে সটকে পড়ে সারা,,,
সেদিকে কেমন নরম চোখে তাকিয়ে থাকে সিয়াম।
অদূর থেকে সম্পূর্ণ দৃশ্যটায় দেখেছে তৈমুর… দাঁতে দাঁত চাপে, চোখে আগুন ঝরে পড়ে।
:-এই ছেলেটা কে? কার এত সাহস? সারার সাথে এভাবে… কথা বলছে!
মুহূর্তেই নিজের রাগ সামলে সে সিয়ামের পেছনে এসে দাঁড়ায়।
সিয়াম পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে একজন ছ’ফিটের সুদর্শন দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে গম্ভীরতার ছাপ!
তৈমুর ঠান্ডা গলায়, কিন্তু চোখে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করে,,,
:-কে তুমি?
তৈমুরের ঠান্ডা কন্ঠস্বরে সিয়াম কেমন চমকে ওঠে।
:-“জ..জি ভাইয়া! আমি সিয়াম। সায়ান ভাইয়ার মামাতো ভাই। আপনি নিশ্চয়ই তৈমুর ভাইয়া?”
তৈমুর সিয়ামের কথার জবাব না দিয়ে বলে,,,
:-তুমি তো বেশ ফ্রেন্ডলি দেখছি…!!
সবাইকে চেনো বা না চেনো, কিন্তু কথা বলার ধরন খুব আত্মবিশ্বাসী।”তা কি শুধু মেয়েদের দেখলেই নাকি সবার ক্ষেত্রে?
সিয়াম ঢোঁক গিলে বোকা হাসি দিয়ে বলে,,,
”
:-আসলে ভাইয়া আমি একটু এক্সট্রোভার্ট টাইপের… পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সহজেই আপন করে ফেলি!”
তৈমুর এবার সরাসরি সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
:-কিন্তু আমার আপন মানুষের সঙ্গে খুব বেশি ‘আপন’ হওয়ার দরকার নেই।
বিশেষ করে ওই মেয়েটা! বলে সারার দিকে ইশারা করে। সিয়ামের গালে শীতল চাপড় মেরে বলে,,,
:-She is such a girl.যার দিকে তাকানোরও একটা সীমা থাকা তোমার জন্য ফরজ। বুঝলে?”
সিয়াম চমকে ওঠে। হালকা মলিন হেসে বলে,,,
:-জি ভাইয়া… আমি আসলে কিছু ভাবিনি, আমি তো শুধু এমনি কথা বলছিলাম”
তৈমুর সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দৃঢ় গলায় বললো,,,
:-ভাবারও দরকার নেই। শুধু মনে রাখো—যদি আবার তার দিকে ভুল করেও তাকিয়েছো, তাহলে পরেরবার কথা বলার মত অবস্থায় থাকবে না তুমি! তুমি কার কি হও সেটা দেখার একদমই প্রয়োজন বোধ করবো না আমি। প্রথমবার ভুল করেছো,বয়স কম, ছোট মানুষ তাই বুঝিয়ে বললাম!
চোখ নামিয়ে নেয় সিয়াম। আর কিছু না বুঝুক মেয়েটা যে তার জন্য হারাম এইটুকু সে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে। তৈমুর শান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। নিরবে প্রস্থান করে সেই স্থান।—কিন্তু চোখে তখনো রাগের ঝলক, আর মনের গভীরে ভালবাসার আগুন।
—চলবে…..
#সারা_জাহান
পর্ব,,,,৩২(ধামাকা)
মৌমো তিতলী
❤️
শিকদার হাউস আজ যেন আলোর জোয়ারে ভাসছে।
শিকদার হাউসের ছাদ আর নিচতলার বাগানজুড়ে ঝকমকে আলোকসজ্জা, চারদিকে গোলাপি আর সোনালী পর্দা টানা হয়েছে। কাঠের তৈরি ডিজাইনার তোরণে শোভা পাচ্ছে ঝুলন্ত বেলুন, ফেয়ারি লাইট আর গাঁদা-রজনীগন্ধার মালা। প্রাসাদের মতো বাড়ির চারপাশে সাজানো হয়েছে নানান পদের ফুলে। গাঁদা, গোলাপ, টিউলিপ, অর্কিড। বাড়ির প্রধান ফটকে বড় করে লেখা—
“— A Royal Wedding
Tuli ❤️ Sayan
ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে আয়তাকার প্যান্ডেল, যার ছাদে ঝুলছে রাজকীয় ঝাড়বাতি। গেস্টদের বসার জন্য সাজানো হয়েছে মেরুন-সোনালী কাপড়ে মোড়া ডিভান আর কুশন। মাঝখানে গোল টেবিল— যেখানে রাখা কাচের বাটিতে ভাসছে গোলাপের পাঁপড়ি আর মোমবাতি।
পার্লার থেকে আসা মেয়েরা তুলিকে বধুরুপে সাজাতে ব্যস্ত।
তুলি আজ যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক নবাবী কনের প্রতিচ্ছবি।
সে পরেছে গাঢ় মেরুন রঙের জমকালো লেহেঙ্গা, যার ওপর সোনালী জরি আর স্টোনের কাজ করা। লম্বা ঘোমটা তার মুখের অর্ধেক ঢেকে রেখেছে। গলার হেভি চোকার সেট, কানে ঝুলন্ত ঝুমকা আর কপালে রুবি বসানো টিকলি— সব মিলিয়ে যেন ঠিক এক রাজবধূর মতো। হাতভর্তি মেহেদি আর কাঁচ bangles-এর টুংটাং শব্দে তার পদচারণা যেন সংগীত তুলেছে।
সারাও আজ পরেছে কালো বেইজড এক রাজকীয় লেহেঙ্গা—যা তাকে সেদিন উপহার দিয়েছিলো তৈমুর।
কালো মখমলের ওপর সোনালী কাজ করা লেহেঙ্গা।
সারার মুখে আজ যেন অন্যরকম দীপ্তি। তার চোখে কাজল ঘেরা গভীরতা, ঠোঁটে হালকা গ্লসি, কানের দুল দুলছে হাওয়ায়। কিন্তু সব ছাড়িয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য তার এই রূপে। আজ সারার সৌন্দর্য এক নজরে কারো বুকে মুগ্ধতার খঞ্জর চালিয়ে দিতে সক্ষম
________
শিকদার হাউসের গার্ডেন ভ্যালি আজ যেন স্বর্গরাজ্যের টুকরো। বউ-বরের জন্য বানানো আলাদা মঞ্চে গোল্ডেন ক্রাউন স্টাইলের ব্যাকড্রপ, মাঝখানে ফ্লাওয়ার আর্ক, তার চারপাশে বেঁধে রাখা তুলির প্রিয় টিউলিপ আর সায়ানের পছন্দের ল্যাভেন্ডার ফুলে রঙের ছোঁয়া।
আর সবকিছুর নজরদারিতে রেখেছে তৈমুর জাহান শিকদার
তৈমুর আজ কালো রঙের স্যুটে নান্দনিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করছে। শার্প কাটের ওয়েস্টার্ন ব্লেজার, হাতে রোলেক্স ঘড়ি, কালো চামড়ার বেল্টে সোনালী বকলস, আর পায়ে চকচকে অক্সফোর্ড বুটস। তার ঘাড় অব্দি পরিপাটি চুল, পাতলা দাড়ি ছাঁটা— চোখে হালকা কালো সানগ্লাস। এমন পোশাকে সে যেন হলিউডের কোন হিরোর থেকে কম নয়, বরং বাস্তব জীবনের এক নায়ক, যার এক ঝলকে গেস্টদের মাঝে কিছু ললনা দের চোখ আটকে যাচ্ছে।
তবে তৈমুরের এসবে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখ-কান-মাথা পুরোপুরি বোনের বিয়ের প্রতিটা মুহূর্তে ব্যস্ত। সাইফ শিকদার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে যেন অন্তরদুর্বলতায় আটকে গেছেন। মেয়েটা তার শশুর বাড়িতে চলে যাবে। বাবা তিনি বুক উজাড় করে ভালোবাসে ছেলেমেয়েদের। আজ তার একমাত্র কন্যার বিবাহ বেলায় কেমন মুচড়ে পড়েছেন, তিনি তৈমুর কে বলেই দিয়েছেন—
জাহান আজ এই বিয়ের পুরো চালিকাশক্তি তুই। শুধু ভাই না, আজ তুই তুলির বাবার দায়িত্বে থাকবি”
তৈমুর যেন বুঝলো বাবার মনের অবস্থা!
বাবার করা আদেশ! তৈমুর সেই দায়িত্ব হৃদয় দিয়ে পালন করছে।
প্রিমিয়াম গেস্টদের একজন একজন করে নিজে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে, তাদের বসার জায়গা নিশ্চিত করছে, সার্ভিং টেবিল থেকে খাবার অপশন যাচাই করে নিচ্ছে—সাথে রিসেপশন টিমে থাকা স্টাফদের নজরদারি করে যাচ্ছে চুপচাপ।
এত কিছুর মাঝেও তার চোখ খুঁজে চলেছে একটিমাত্র মুখ—সারা। এখনো পর্যন্ত সেই মুখটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি শিকদার কর্ণধারের।
রিনা শিকদার আজ পরেছেন নেভি ব্লু আর সিলভার কাজের শাড়ি। হাতে সোনার চুড়ি,। মেয়ের বিয়েতে তার মুখে চাপা আনন্দ, চোখে জল। মনে মনে তিনি আল্লাহর দরবারে আর্জি জানান,,সবকিছু নিখুঁত হোক।
তিনি আজ সারাকেও চোখে চোখে রাখছেন। বাড়িতে আজ চেনা অচেনা মানুষের ভিড়। অনেক অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা ঘুরা ঘুরি করছে। আচমকা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটলে তৈমুর কে সামলানো যাবে না। আজকের দিনে অন্তত তিনি কোন অশান্তি হোক চাননা। তার মধ্যে একটা বড় কারণ সালাম শাহরিয়ার। আজ তিনি পরিবার নিয়ে আসবেন। রিনা শিকদারের কেনো যেনো মনে হচ্ছে আজ আবারো তিনি সারার বিয়ের কথা তুলবেন। সাইফ শিকদার কেও তিনি এই বিষয়ে অবগত করলে তিনি জানান এমন কিছু ঘটলে তাদেরকে জানিয়ে দিবেন সত্যিটা। তৈমুর যখন বিষয়টাকে মেনে নিয়েছে তাহলে আর রাখঢাক করে লাভ নেই।
আলিফ শিকদার নিজের রুমে তৈরি হচ্ছেন—সাদা পাঞ্জাবি আর ওয়েস্টকোটে, বেরিয়ে আসেন একহাতে স্ত্রীর হাত ধরে।
সিমা শিকদার—সাত মাসের গর্ভবতী। পরেছেন হালকা গোলাপি সিল্কের শাড়ি, আরামদায়ক ব্লাউজ, চুলে গুঁজেছেন গোলাপ ফুল। তাঁর জন্য ভিন্ন বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, পাশে ওয়াটার স্প্রে আর মিষ্টিজাতীয় খাবার রাখা হয়েছে সিমা শিকদারের জন্য। এতো ব্যস্ততার মাঝেও রিনা শিকদার ছোট জায়ের যত্ন নিতে ভোলেননি।
সারা আর রেশমীও বারবার এসে খোঁজ নিয়ে যায় তাঁর।
***********
গেস্টদের আপ্যায়ন নিশ্চিত করে হাতে কিছুটা সময় নিয়ে বিয়ের ভেন্যুতে গিয়ে দাঁড়ায় তৈমুর। প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল করে সায়ানকে।
সায়ানরা জানাই ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ভেতরে তারা সিকদার হাউজে প্রবেশ করবে। কথা শেষ করে ফোন কাটে তৈমুর। পেছন ঘুরে তাকাতেই থমকে যায় তৈমুর । থমকে যায় চারপাশের পরিবেশ।।
দম কালো লেহাঙ্গায় অপ্সরী লাগছে সারাকে। রেশমীর সামনে হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বলছে। হাসছে! দম আটকে আসে তৈমুরের। বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে ধরে
এক কোণে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে—বিড়বিড় করে তৈমুর ….
> “এই মেয়েটাই আমার বউ… ছোটবেলা থেকে লুকিয়ে ভালোবেসেছি যাকে, আজ সে আমার দেয়া পোশাকে হাসছে, ঝলমল করছে! সে কি বুঝছে না,আমার পৃথিবীটা কীভাবে শুধু ওর অনুকরণে ঘুরছে।”
তৈমুরের ঠোঁটে মৃদু হাসি, চোখে এক ঝলক ভালোলাগার আর্তি। তবে মুখে কিছু বলে না, কারণ ও জানে—সারার দিকে এমন করে তাকানোর অধিকার কেবল তার। এই মেয়েটা একান্ত তার। সেই শুধু অনুভব করবে তাকে, অতি গোপনে অতি যত্নে!
***********
ঠিক তখনই গেট দিয়ে প্রবেশ করলো আলভী তার পুরো পরিবার নিয়ে। সবার মাঝে একজন পরিচিত মুখ দেখে রেশমী হঠাৎ চমকে যায়। রেশমীর চোখ কপালে!
অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে রেশমী…
“তালহা এহমাদ স্যার”…যার প্রতি রেশমীর মনের এক কোণে আজকাল অনুভূতির কুঁড়িটা অঙ্কুরিত হয়েছে।
তালহার হালকা হেসে অভিবাদন করা, চশমা টেনে ঠিক করা ভঙ্গি দেখে রেশমী রীতিমতো হাবুডুবু খেতে থাকে নিজের মনে। মুখটা লাল হয়ে যায় লজ্জায়। তালহার চোখাচোখি হতেই সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলে।
গতকাল আলভী যখন জানায় তার কোন বন্ধুর বোনের বিয়েতে যাওয়ার জন্য পুরো পরিবার কে ইনভাইট করেছে তখন তালহা রাজি হয়নি আসতে। কিন্তু কথায় কথায় যখন জানতে পারে বিয়েটা তৈমুর জাহান সিকদারের বোনের। তখন কিছু একটা চিন্তা করে হুট করে করে রাজি হয়ে যায় তালহা। সে মূলত রেশমির কথা ভেবেই এই বিয়েতে আসতে রাজি হয়েছে।
আজ এখানে এসে তালহার মনে হচ্ছে এই বিয়েতে আসার সিদ্ধান্তটা তার জীবনের বেশ সিদ্ধান্তের একটি!
প্রেয়সীর লজ্জারাঙ্গা মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তর-করণে শান্তির বার্তা বয়ে যায় তালহার।
এই পুরো বিষয়টি সারার চোখে অজানা থাকেনা।
সারা এগিয়ে আসে রেশমীর কাছে, কানে কানে ফিসফিস করে বলে—
:-এই যে আপু তুমি যে ভয়ে রাতে ফিসফিস করে প্রেম করো, এখন সামনাসামনি স্যারকে দেখে টমেটো হয়ে যাচ্ছো তো! কিন্তু উনি এখানে কেন? তুমি ইনভাইট করেছিলে বুঝি?
রেশমী অস্থির গলায় ফিসফিস করে—
:-কি পাগলের মতো বকছিস! আমি ইনভাইট করতে যাবো ক্যান! আমি নিজেই শকড্!
সারা হেসে বলে—
:-চিন্তা করো না আপু। হয়তো উনি এবাড়ির কারো পরিচিত। বা গেস্টদের কারো সাথে এসেছেন।
রেশমী মুচকি হেসে আড়চোখে তাকায় তালহার দিকে। সারাকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,
:-তুই ঠিকই বলেছিস সারা! ওই দেখ তালহা স্যারের মতো দেখতেই একটা ছেলে তৈমুর ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। হয়তো ভাই আর বন্ধু!! ওনাদের সাথেই তো আসতে দেখলাম।
রেশমির কোথায় সারা বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
********
ঠিক সেই মুহূর্তেই সিকদার হাউজের বড় লোহার গেট দিয়ে এক এক করে বরের গাড়ি প্রবেশ করে। সিকদার ফ্যামিলির কর্তারা এগিয়ে যাই বর পক্ষকে অভ্যর্থনা জানাতে। আত্মীয়-স্বজন এবং বরযাত্রীদের আগমনে মুহুর্তেই সরগরম হয়ে ওঠে বিয়ের ভ্যানু।
রিনা শিকদার দুধ,মিষ্টি দিয়ে জামাই বরণ করেন। সুহানি এসেই রেশমি আর সারার কাছে চলে যায়। ভীষণ মিষ্টি সেজেছে মেয়েটা। রেশমি আর সারা সুহানের হাত ধরে উপরের তুলির রুমে নিয়ে যায়।
বরযাত্রীদের আপ্যায়নে ব্যাস্ত ক্যাটারিং এর লোকেরা। আলিফ সিকদার, তৈমুর জাহান আর তার বন্ধু আলভী এবং রাফি হাতে হাতে সবটা তদারকি করে।
************
বাইরে অতিথিদের কোলাহল, হালকা বাজছে সঙ্গীত, আর ভিতরে নানা কাজে ব্যস্ত সবাই। ঠিক সেই সময়েই প্রবেশ করেন সালাম শাহরিয়ার, বয়সে ভারী, ব্যক্তিত্বে দৃঢ়, চোখে তার নিজস্ব অভিজাততা। পাশে তার ছাব্বিশ বছরের সুদর্শন ছেলে আব্রাহাম শাহরিয়ার আব্র। আব্র কে দেখে মোটেও অবাক হয়নি তৈমুর। সে আব্রর নাড়ি নক্ষত্র বহুদিন আগেই জেনেছে। আব্রাহাম শাহরিয়ার আব্রই যে সালাম শাহরিয়ারের ছোট পুত্র সেটা তৈমুর জানে।
সালাম শাহরিয়ার সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে, সাইফ শিকদারের পাশে বসেন। কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনার পর তিনি আবার প্রসঙ্গ তোলেন—
:-সাইফ ভাই, আপনি তো জানেনই আমার মনোভাব। আপনার মেয়েটা—সারা—খুবই সম্ভ্রান্ত, বুদ্ধিমতী। আমি তো বলেছিলাম আমার ছোট ছেলের কথা। আজ সে আপনাদের সামনে। আর কাকতালীয় ভাবে আমি জানতে পেরেছি আমার ছেলে আব্রাহাম আর সারা একে অপরের পরিচিত। তাকে বহুদিন ধরে পছন্দ করে আব্রাহাম। আমি আবারও প্রস্তাবটা রাখছি আপনাদের সামনে।”
সাইফ শিকদার এবার একটু অস্বস্তিতে পড়েন। সঙ্গে ছিলেন রিনা শিকদারও। তিনি ইশারায় সবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলেন,
:-চলেন ভাইজান আমরা ভিতরের ঘরে গিয়ে বসি। এখানে এসব কথাবার্তা বলা ঠিক হবে না।”
সাইফ শিকদার,রিনা শিকদারের শোবার ঘর। ঘরটি ছিমছাম, বাইরের কোলাহল এখানে পৌঁছায় না। দরজাটা খানিকটা ভেজানো,
সাইফ শিকদার,আলিফ শিকদার , রিনা শিকদার, সিমা শিকদার সকলেই উপস্থিত আছেন এখানে। সামনে ডিভানে বসে আছে সালাম শাহরিয়ার তার পাশেই আব্রাহাম বসে আছে। তার মনে লজ্জা আর এক্সসাইটমেন্ট দুটোই কাজ করছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে যে সে সারাকে পেতে যাবে তার ধারণাও ছিলো না তার।
আলিফ শিকদার শীতল চোখে একবার পরিস্থিতি বুঝে নিলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা বের করে সকলের অগোচরেই মেসেজে কিছু টাইপ করে সেন্ড করে দিলেন নির্দিষ্ট নাম্বারে। তারপর নিশ্চিত মনে বসে বসে তামাশা দেখতে লাগলেন।
সবার মুখো ভঙ্গি পরখ করে নড়েচড়ে বসলেন সালাম শাহরিয়ার। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,,
:-সাইফ ভাই আমি কিন্তু না শুনবো না। আমি আগেও একবার প্রস্তাব রেখেছিলাম, তখন বলেছিলেন বড় মেয়েদের বিয়ের কথা। আজ তো তুলি মা’য়ের বিয়ে.. এখন অন্তত আমার ছেলের সাথে সারা মায়ের বিয়ের কথা পাকা করে রাখলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়! আমার আবদার টা কিন্তু আপনাদের রাখতেই হবে।
সালাম শাহরিয়ারের কথায় কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন সাইফ সিকদার। আড়চোখে একবার সহধর্মিণীর দিকে তাকালেন। রিনা শিকদার ইশারা করতেই তিনি অপ্রস্তুত হেসে বললেন,,
:-দেখো সালাম ভাই! একটা কথা তোমাদের কারো জানানো হয়নি। আমার আত্মীয়-স্বজনও তেমন কেউ কিছু জানে না। আসলে আমরা সারার বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা বলতে পারবো না। সেই অধিকার আমাদের কারো নেই।
সাইফ শিকদারের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় সালাম শাহরিয়ার । আব্রও যেন কনফিউজড। কি বলতে চাইলো এরা কেউ বুঝলো না ঠিকঠাক। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল আব্র।
:-মানে ঠিক বুঝলাম না কি বলতে চাইলেন। আমার জানা মতে সারা রিনা ভাবির প্রয়াত বোনের মেয়ে। সে হিসেবে তো আপনারাই ওর গার্ডিয়ান এখন। তাহলে একথা বলার অর্থ কী?
সাইফ শিকদার পাঞ্জাবির করার টেনে ঠিক করেন। রয়ে সয়ে বলেন,,,
:-আমি বলতে চাইছি সারার একমাত্র লিগ্যাল গার্ডিয়ান আমার একমাত্র ছেলে তৈমুর জাহান শিকদার। কারন সারা তার বিবাহিত স্ত্রী।
সাইফ শিকদারের বলা কথায় ঘরের পরিবেশ মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেলো। সালাম শাহরিয়ার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
এদিকে আব্রর কানে তখনও বেজে চলেছে “সারা তৈমুর জাহান শিকদারের বিবাহিত স্ত্রী” এবার আব্রর শুরু থেকে সবটা হিসাব মিলাতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হয়না। সেই সুন্দরবনে তৈমুরের সারার জন্য করা পাগলামী,সারার সব বিষয়ে অধিকার চর্চা,সারার সকল সিদ্ধান্ত নেয়া এই সবটাই তাহলে এই কারনে। বুকে হালকা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে আব্রর। সারাকে নিয়ে কল্পনায় সাজানো ভালোবাসার পশরা তাসের ঘরের ন্যায় এক এক করে ভেঙে পড়তে লাগলো। কিন্তু সে এটা বুঝতে পারছে না, সারা যদি বিবাহিতই হবে তাহলে তাকে বললো না কেন? সে তো সবসময় তৈমুর কে কাজিন বলে পরিচয় দিয়ে এসেছে।
আব্র চোখের কোনে ব্যথা লুকিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে,,
:- সরি আঙ্কেল আমি জানতাম না। ওকে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো বুনেছিলাম… তা অজান্তেই। আর সারাও তো কখনো বলেনি যে……
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করে তৈমুর জাহান।
আব্রর কথাটা সম্পুর্ন না হতেই তৈমুর খুব ঠান্ডা গলায়, অথচ নিশ্চিত কণ্ঠে বলে,,
:- সারার বিয়ে হয়ে গেছে। আর সেটা আমার সাথেই।
ছোটবেলায় আমাদের দুজনের আক্দ হয়েছিল, সেটা আমার মা’ বাবার ইচ্ছায়, ছাড়া তখন মাত্র পাঁচ বছরের তাই হয়তো বিয়ের ব্যাপারে তার তেমন কোন স্মৃতি মনে নেই। আমরাও তাকে এখনো কিছু জানায়নি। হয়তো কিছুদিনের মাঝেই বিষয়টা তাকে জানানো হবে।
সে বিবাহিত আর সেটার প্রমাণ,ছবি সবটা আমার কাছে গচ্ছিত আছে। আপনারা চাইলে আপনাদের তাছাল্লির জন্য তা আমি দেখাতে পারি।
আমি সারার স্বামী। সারা আমার বিবাহিত স্ত্রী। আমি তৈমুর জাহান শিকদার ওর একমাত্র লিগ্যাল গার্জেন।”
এক মুহূর্তের জন্য ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
সালাম শাহরিয়ার এবার গম্ভীর হয়ে যান, কিন্তু কিছু বলেন না। চুপচাপ সাইফ শিকদারের দিকে তাকান, আর মৃদু মাথা নাড়েন।
:-না না তার কোন প্রয়োজন নেই আমি আপনাদের মুখের কথার বিশ্বাস করি।
এদিকে, রিনা শিকদারের ঘরের বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে সারা। সে এসেছিলো রিনা শিকদার কে খুঁজতে। দরজার কাছে দাড়াতেই হঠাৎ করেই সে ভেতরের কথাগুলো বিশেষ করে তৈমুরের বলা কথাগুলো শুনে ফেলে। দরজা সামান্য খোলা ছিলো বিধায় সম্পূর্ণ কথাটা স্পষ্ট ভাবে তার কর্ণগোচর হয়।
প্রথমে কিছুটা বিস্ময়, তারপর ধীরে ধীরে তার চোখের কোণে জমে ওঠে জল। শীতল চোখে একবার ঘরের ভেতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সারা।
দেখতে পায় তৈমুরকে। যে এই মুহূর্তে সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে।, এতো দৃঢ় অধিকার এতো দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছে তার অবস্থান—
সারার হৃদয়ে এক অপার্থিব ভালবাসার কষ্ট জেঁকে বসেছে। এটা আসলেই কষ্ট নাকি অনাকাঙ্খিত ভাবে ভালোবাসার পরিণয়ের মতো সত্যিটা অবগত হওয়ার প্রশান্তি একসাথে মিশ্র কোন অনুভূতি বুঝতে পারে না সারা।
সে কেবল নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায় সিঁড়ির দিকে। তাই দ্রুত পায়ে চলে যায় ওপরে। নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে মনে পড়ে তৈমুরের বলা কিছু কথা!!
সারা দুহাতে চোখের পানি মুছে থমথমে পায়ে এগিয়ে যায় তৈমুরের রুমের সামনে। কিছু একটা ভেবে দরজা ঠেলে ঢুকে যায় ভেতরে। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়ায় আলমারির সামনে। আলমারির হাতল দুহাতে টেনে খুলে ফেলে। তারপর পাগলের মত ভেতরের সব জামাকাপড় ছুড়ে ফেলতে থাকে। কাঙ্খিত কিছুর খোঁজে লন্ডভন্ড করে তৈমুর জাহান শিকদারের সুসজ্জিত আলমারি।
চলবে,,,,,,,,,
#সারা_জাহান
পর্ব,,,, ৩৩
✍️ মৌমো তিতলী
❤️
সারা নিস্তব্ধ হয়ে থম মেরে বসে আছে।
চোখে আজ অঝোর ধারায় ঝরছে অশ্রু, ঠোঁটে চাপা কাঁপুনি, হৃদয়জুড়ে এক দুর্বোধ্য অনুভূতি।
একটু আগেই তৈমুরের আলমারির সবকিছু ছুঁড়ে ফেলার পর তার হাতে এসে ঠেকেছে একটা লেদার কভারেজ ডায়েরি, আর হলুদ খামের ভেতরে থাকা কয়েকটা ছবি। ছবিতে খুবই ছোট্ট বয়সের সারা বধু বেশে লাল ওড়নায় মুখ ঢাকা তার পাশেই মাথায় টোপর,সাদা পাঞ্জাবিতে ১৫ বছর বয়সি কিশোর—তৈমুর জাহান শিকদার। একটা ছবিতে সারা দাঁত বের করে হাসছে,সামনে একটা দাঁত নেই। আর তৈমুর থমথমে মুখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কেনো যেনো ছবিটা দেখে কাঁদতে কাঁদতেও ফিক করে হেসে দিলো সারা।
ছবিগুলো উল্টেপাল্টে দেখে সারা। প্রত্যেক ছবির পেছনে কিছু না কিছু লেখা। আনাড়ি হাতের খসখসে হ্যান্ডরাইটিং—
> “আক্দ সম্পন্ন হয়েছে — তৈমুর জাহান &সারা জাহান।
স্থান: শিকদার হাউস। সারা বুড়ি কে খুব সুন্দর লাগছে আজ। বউ সেজেছে যে। আমার বউ!
> “আমি জানি। ও জানে না। ও ছোট, ও কিছুই বোঝেনি। । কিন্তু আমি… আমি জানি, আমি বুঝি—ও আমার কী। আমি নিজে এই বন্ধনকে শুদ্ধ রাখবো যতদিন বাঁচি।”
>”ও এই বিয়েটাকে কোন খেলা ভেবেছে। ও আমার বউ তা ও জানেই না।
এমনই নানা রকম উক্তি লেখা ছবিগুলোর পেছনে।
ছবিগুলো পাশে রেখে ডায়রিটা খোলে সারা। পড়তে শুরু করে এক এক করে সকল পাতা। সারাকে নিয়ে কল্পনায় সাজানো হাজারো অনুভূতি ব্যক্ত করেছে তৈমুর পুরো ডায়রি জুড়ে। স্তব্ধ হলো সারা। থেমে গেলো চারপাশের সোরগোল। শিহরণ বয়ে গেল শরীর জুড়ে।
সারার ভেতর কাঁপুনি ধরে যায়। চোখে পানি এসে ভাসিয়ে নেয় সব গুছিয়ে রাখা যুক্তি। কি এক তিব্র অভিমানে গলা বুজে আসে সারার। এলোমেলো এক রাশ কাপড় চোপড়ের মাঝ খানে এলোমেলো হয়ে বসে আছে সে।
ঠিক তখনই ঘরের দরজাটা খুলে ভেতরে আসে তৈমুর। তৈমুরের চোখে বিস্ময়।
আলমারির সামনে মেঝেতে বসে থাকা সারা, হাতে ছবিগুলো আর খোলা ডায়েরি দেখে যা বোঝার বুঝে যায় তৈমুর।
সারা ধীরে তার দিকে তাকায়, চোখে অভিমান আর ভালোবাসার তীক্ষ্ণ মিশ্র প্রতিচ্ছবি।
সারা চোখে জল নিয়ে কাঁপা গলায় বলে,,,
:-ছোটবেলায় আমার আপনার সাথে বিয়ে হয়েছিলো জাহান ভাইয়া? আমি তাহলে জানিনা কেনো? কেনো সেটা লুকিয়ে রাখলেন আমার থেকে? কেন আমায় বলেননি জাহান ভাইয়া?”
বলেই আবার হিচকি তুলে কাঁদতে থাকে সারা।
তৈমুর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সারার পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে। ওর হাত থেকে ডায়রি টা টেনে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,,,,
:-তুই তখন খুব ছোট ছিলি সারা, মাত্র পাঁচ। আমি ছিলাম পনের। খালু আর খালামনির মৃত্যুর পর আমার মা-বাবার ইচ্ছায় এই আক্দটা হয়েছিলো, যাতে তুই নিরাপদ থাকিস, সারাজীবন আমাদের সুরক্ষায় থাকিস। প্রথমে আমি সেই মুহূর্তেই বিয়েটা করতে চায়নি। কিন্তু মায়ের জেদের কাছে আমাকে হার মানতে হয়েছিলো। বিয়েটা তো হয়েছিল। কিন্তু তুই বেমালুম ভুলে গেলি। তোর কাছে সেটা শুধুই একটা পুতুল বিয়ে। যখন দেখলাম বিয়েটার কথা তুই ভুলেই গেছিস তখনই ঠিক করেছিলাম—তোকে জানাবো না কিছু । তোকে তখনই সবটা জানাবো, যখন তুই নিজে নিজেকে বুঝতে পারবি। নিজের ভালোবাসার মানে বুঝবি।”
সারা চোখ নামিয়ে নেয়। ধকধক করছে বুকের ভেতর টা। অতি কষ্টে কাঁপা কণ্ঠে বলে,,
:-তাহলে আপনি এতদিন আমার সবকিছুর সিদ্ধান্ত নিতেন এই কারণে? কারণ আপনি আমার স্বামী? আমার কিছুই জানার অধিকার ছিলো না?
তৈমুর কাছে এসে সারা’র হাত ধরে নরম গলায় বলে,,,
:-আমাকে ভুল বুঝিস না সারা। আমি ওই বয়সে তোকে বিয়ে নামক বেড়াজালে বন্দি করতে চায়নি … তোকে তোর অগোচরে রক্ষা করেছি।নিজের করে রেখেছি শুধু। আমি জানতাম তুই একদিন বুঝবি। সেদিন তুই সত্যি টা না জেনেই নিজে আমাকে ভালোবাসবি।
তুই নিজে যখন প্রেমে পড়েছিলি আমার তখন তুই আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের কথা জানতিস না, আমি তো চেয়েইছিলাম—তুই না জেনে আমাকে ভালোবাসিস। কারণ ওটাই প্রকৃত ভালোবাসার প্রমাণ। তুই যদি আগে থেকেই এই বিয়ের কথা জানতিস তাহলে ভালবাসার থেকে বেশি যেটা কাজ করতো সেটা বাধ্যতা। না চাইতেও সেই বিয়ে নামক দায়িত্ব ও কর্তব্যের কারণে আমার সাথে তোকে বেঁধে দেয়া হতো।
আর আজ, যখন তুই সব জানলি… তখনও যদি তুই চলে যেতে চাস, আমি বাধা দেবো না।
কিন্তু জেনে রাখ, আমি তোর স্বামী, শুধু কাগজে না—আত্মায়, হৃদয়ে, ধর্মে। আমি তোকে আগেও ভালোবাসতাম, আজও বাসি, আর চিরকাল বাসবো।”
সারা হুহু করে কেঁদে উঠলো। কোনমতে কান্না চেপে বললো,,,
:-আপনি আমার প্রতি অধিকার নিয়েছেন। আপনি যখন তখন নক না করেই আমার রুমে আসতেন। আমাকে নির্দ্বিধায় ছুঁয়েছেন আপনি। কারণ আপনি জানতেন আপনি কোন ভুল করছেন না। আপনার অধিকার ছিলো আমার প্রতি আপনি জানতেন সেটা। যার খবর আমার ছিল না। আমি কিছুই জানি না, আপনার প্রতিটা কাজের পেছনে আমার জন্য কেমন আবেগ ছিলো আমি আগে কিছুই বুঝিনি?
আপনি যেভাবে আমাকে আগলে রেখেছেন, আমি এটাকে শুধুই ভালোবাসা বলে বলে মনে করতাম—ভয় পেতাম, যদি কেউ জানতে পারে আমাকে খারাপ ভাববে।
কিন্তু আজ জানলাম, আমি ছাড়া এ বাড়ির বাকি সবাই জানে আমরা বিবাহিত।
তৈমুর কিছু না বলে ধীরে ধীরে সারাকে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিলো। দুহাতে সারার মুখটা মুছে চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে নিলো। আলতো করে কপালে চুমু খেলো।সারা চুপচাপ সবটা দেখে গেলো শুধু। কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইল দুজনে। সারা এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো তৈমুরের প্রশস্ত বুকে। আজ একটু বেশিই আপন, বেশি শান্তি লাগছে না এই বুকে!!!
তৈমুর প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে রাফিকে কল করে—রিসিভ হতেই কোনরকম ভনিতা ছাড়াই বললো,,,
:-এক ঘন্টা সময় আছে তোর কাছে। রেজিস্ট্রি পেপার্স রেডি কর। আমি বিয়ে করবো। আজ এই মুহূর্তে আমাদের আক্দকে আইনী স্বীকৃতি দেবো। আজই আবার দোয়া পড়ে নতুন করে কবুল বলবো, তার সম্মতিতে।
রাফি কে কিছু বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিল তৈমুর। সারা হাঁ করে তাকিয়ে আছে তৈমুরের মুখের দিকে। তৈমুর তা দেখে বাঁকা হেসে সারার নাকে টোকা মেরে বলে ,,,
:- কি! তাকিয়ে আছিস কেন? আজ আমি আবার বিয়ে করবো—আমার নিজের স্ত্রী কে। ধর্মে যেমন হয়েছিলো, আজ আইনেও তেমন হবে!”
এইবার তুই বল—তুই কি সত্যি আমার হতে চাস, নিজের ইচ্ছায়?
তুই যদি বলিস ‘হ্যাঁ’, তাহলে তোকে আবার বিয়ে করবো, সবার সামনে, পুরো দুনিয়ার সামনে!”
সারা ধীরে হাসে, চোখ এখনো ভেজা। নাক টেনে বলে,,,
:-আমি যদি এখন না করে দেয়!
সারার কথায় তৈমুরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,,
:-এক তো তুই আমাদের বিয়ের কথা বেমালুম ভুলে গুলে খেয়ে বসে ছিলি। তার জন্য কিন্তু তোর শাস্তি পাওনা রয়েছে সারা। আর এখন এই মুহূর্তে যদি আর একটা উল্টোপাল্টা কথা বলিস আই স্যুয়ার তোকে আমি কি করবো নিজেও জানিনা।
তৈমুরের কথায় ঢোক গিলে সারা। তৈমুরের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে,,,,
:-কে বলছে আমি না করছি! আমি তো হ্যাঁ বলছি। আমি তো আপনাকেই চাই। আপনি আমার, আমি আটনার।
সারার কথায় ঠোঁট টিপে হাসে তৈমুর। সারার গাল চেপে ধরে বলে,,,,
:-That’s like a good girl” my lady!
বলেই গালে শব্দ করে চুমু খায়। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয় সারা। তা দেখে মুচকি হাসে তৈমুর।
—
হুলুস্থুল কাণ্ড বিয়ে বাড়িতে। বিয়ে করবে তৈমুর জাহান শিকদার। আত্মীয় স্বজনদের মাঝে অলরেডি গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। কেউ বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটছে।
তারা এসেছিলো শিকদার বাড়ির বড় মেয়ের বিয়েতে। এখন শুনছে শিকদার বাড়ির মেয়ের সাথে সাথে শিকদার বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকার তৈমুর জাহান শিকদারেরও বিয়ে। তাও আবার তাদেরই বাড়ির আরেক মেয়ের সাথে ।
সবকিছু শুনে সায়ান তো লাফিয়ে উঠলো!
তৈমুরের হাত ধরে টেনে বললো,,,
:-ভাই, তুই বউ ঘরে রেখে আবার বিয়ে করতে যাচ্ছিস??
তারপর কপালে হাত ঠেকিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো,,,
:-নাআআআ এটা হতে পারে না!! তুই এটা করতে পারিস না। আমার ছোট্ট ভাবির তাহলে কি হবে!!
সায়ানের কান্ডে জোরে শ্বাস ফেলে তৈমুর। মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,,
:- তোর এক্সট্রা ড্রামা করা বন্ধ কর সায়ানাইড!!
—++—
পুরো শিকদার হাউস খুশিতে রমরমা। তৈমুরের সিদ্ধান্তে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছে রিনা শিকদার। তিনি আগ্রহ ভরে সবকিছুর তোড়জোড় করছেন।
তুলি, রেশমী দুজনেই ভীষণ খুশি সারা তৈমুরের বিয়েতে।
💍 দেখতে দেখতে দু জোড়া দম্পতির আইনী ভাবে রেজিস্ট্রেশন শেষ হলো… সারা-তৈমুর , সায়ান -তুলি কবুল বলে,
আর সেই মুহূর্তে আতশবাজি, করতালির শব্দ আর ফুল ঝরে পড়ে শিকদার হাউসের ছাদের ওপরে!
এই সবকিছু ঘটলো লুবানার উপস্থিতিতে। তিশার হাত ধরে বিয়ের ভ্যানুর এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে লুবানা। এই মুহূর্তে তার কেমন রিয়াকশন দেয়া উচিত বুঝতে পারছে না লুবানা। সবকিছু এতো দ্রুত ঘটলো যে কোনরকম রিয়্যাক্ট করার সময়ই পেলো না।
রাগে, দুঃখে, ঈর্ষায় তিশার হাতটা খামচে ধরে কাঁপতে লাগলো লুবানা।
লুবানার মনের অন্ধকার নামে…
তৈমুর আর সারার বিয়ের খবরটা যেন আগুন ছড়িয়ে দিল লুবানার ভেতরে। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের এক চিলতে হাসি, চোখে ক্ষোভের দাবানল।
“কে ও? ওর মত একটা মেয়ে… তৈমুরের বউ? অসম্ভব!” — মনে মনে গর্জে উঠল লুবানা।
লুবানার বুকের ভেতরটা ধুকধুক করে জ্বলে উঠতে লাগল ঈর্ষায়।
“যে মেয়েটার নিজের কোনও পরিচয় নেই, যার অস্তিত্বই তৈমুরের দয়ায়— সে কীভাবে আমার জায়গা দখল করে নিতে পারে?”
সামনেই দু জোড়া বর-কনের ঠোঁট জুড়ে তৃপ্তির হাসি। সারাকে মুখ নামিয়ে লাজুক হাসি হাসতে দেখেই লুবানার রক্ত গরম হয়ে ওঠে।
আমি দেখবো কতদিন হাসে।”সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো—
“এই বিয়ে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি চুপ করে থাকলেও, এদের শান্তি আমি সহ্য করব না। ওই মেয়েটার মুখ থেকে হাসি কেড়ে নেওয়ার জন্য আমি যেকোনো নিচু পথে হাঁটতেও রাজি। তৈমুর আমার। শুধু মাত্র আমার। তৈমুর একদিন বুঝবে… এই মেয়েটাকে বিয়ে করে সে কী ভুল করেছে।”
লুবানার চোখ জ্বলতে থাকল একধরনের অন্ধ প্রতিশোধ স্পৃহায়। তার মনের গহীন অন্ধকারে বিষের বীজ অঙ্কুরিত হতে লাগল— আর সেই বিষ সে ঢালবে সারার উপর, ধীরে ধীরে, নীরব, নিখুঁত আঘাতে।
—
তুলির বিদায়ের মুহূর্তে শিকদার হাউসে আজ যেন অদ্ভুত এক নীরবতা। আনন্দের সব জৌলুস ছাপিয়ে উঠেছে সকলের চোখের জল আর বুকচাপা দীর্ঘশ্বাসে। একমাত্র মেয়ে আজ শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে—এই সত্যটা যেন কারও গলায় উচ্চারিত হচ্ছে না, কিন্তু বাতাসে সেই কষ্টের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে।
রিনা শিকদারের চোখে জল।
তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে, আঁচলে চোখ মুছে বারবার দোয়া করতে থাকেন। তুলির মাথায় হাত রেখে বলেন,,
:-আল্লাহ তোর নসীব ভালো করুক মা… স্বামীর-সংসারে যেন হাজার সুখে থাকিস। এই বাড়িটা আজ খালি হয়ে গেল… তুই তো আমার বুকের ধন…”।
সাইফ শিকদার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন চুপচাপ।
সবসময় গম্ভীর থাকা এই মানুষটাও আজ তুলির কপালে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললেন,,,
:-বাবা হিসাবে যতটুকু করবার ছিলো, করেছি। এবার তোকে নিজের ঘরকেই আপন করতে হবে মা… আল্লাহ্ তোকে হায়াত দিক, সুখ দিক।”
তুলি আর ধরে রাখতে পারে না নিজেকে।
সে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে । কাঁদতে কাঁদতে বলে,
:-আমি তোমাদেরকে খুব মিস করবো।
রিনা শিকদার কাঁদতে কাঁদতেই মাথায় কুরআনের সূরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। সাইফ শিকদারও একই পদ্ধতি অনুসরণ করলেন।
সারা রেশমী এসে তুলিকে কে জড়িয়ে ধরলো।
রেশমী কাঁদতে কাঁদতে বললো,,
:-“তুই গেলে আমি একা হয়ে যাবো… মনে রাখিস তোর যখনই ইচ্ছা হবে চলে আসবি। আমি থাকবো তোর অপেক্ষায়।”
তুলি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে।
তৈমুর এগিয়ে আসলে ভাইকে জড়িয়ে ধরে আরেক দফা কাঁদলো তুলি। তৈমুর বোনের মাথায় স্নেহের চুমু এঁকে দিলো। বললো,,
:-চিন্তা করিস না। সায়ান ভালো ছেলে। ওর কাছে ভালো থাকবি তুই! হাত উঁচু করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,,,
:-লেইট হচ্ছে। চল।
তুলি একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকালো পুরো শিকদার হাউসের দিকে।
“এই বাড়িতে এই ঘরে তার হাসি, দুষ্টুমি, শৈশব—সবকিছু পেছনে রয়ে গেলো। আর সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে।
গাড়িতে উঠে বসতেই চলতে শুরু করলো। সায়ান তুলির পাশে বসে নরম কণ্ঠে বলল,,,
“:-আর কতো কাঁদবে তুলা। তুলি ভেজা চোখে তাকালে সায়ান তুলির হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আবারো বলে,,
:-দেখো আমি জানি এই মুহূর্তটা কষ্টের। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে আজ থেকে আমি তোমার ‘মাহরাম’। আমি আছি তোমার পাশে। একটুও ভয় পেও না।”
তুলি চোখ মুছে সায়ানের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিল।
:-তুমি থাকলে আমি ভয় পাব না,” ফিসফিস করে বলল তুলি।
সায়ান ওর হাতটা আলতো করে ধরলো,
:-চলো, আজ থেকে শুরু করি আমাদের জিন্দেগির নতুন অধ্যায়। ইনশাআল্লাহ, সব ঠিক হবে।”
গাড়িটা ধীরে ধীরে শিকদার হাউস ছেড়ে রওনা দিলো।
পেছনে রয়ে গেল বাবা-মা,চাচা-চাচির কেঁপে ওঠা বুক, সারা, রেশমীর চোখের অশ্রু, ভাইয়ের অন্তঃস্থল থেকে একরাশ দোয়া—“আল্লাহ তোমাদের দুইজনকে হিফাযত করুন।”
***********
রাত যখন ১:৩০ মিনিট। সারা তখন বিরক্ত ভঙ্গিতে এক এক করে ভাঁজ করছে তৈমুরের রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামাকাপড়। বলাই বাহুল্য এগুলো কয়েকঘণ্টা আগে সারাই এলোমেলো করেছিলো।
এখন তৈমুরের দেয়া শাস্তি স্বরূপ বসে বসে সেসব জামা কাপড় ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছে সারা। অদ্ভুত বিরক্তিতে বিড়বিড় করে সারা,,,,
“এই লোকটার নির্ঘাত মাথার তার ছিঁড়ে গেছে।
আসলে উনি মানুষ না, একেবারে জল্লাদ! আজ নাকি আমাদের বাসর রাত। হাঃহ এই রাতে কেউ নতুন বউ কে জামাকাপড় গোছাতে দেয়? বর তো না, রাক্ষস একটা!!
সারা রাগে ফুটছে। অথচ পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তৈমুর হেলান দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। চোখে মুখে প্রশ্রয়, ভালোবাসা, আর একটু একটু জেতার আনন্দ।
সারার বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো সবই তার কানে এসেছে। বাঁকা হেসে তৈমুর ঠান্ডা গলায় বলে,,,
:- তোর শাস্তিটা কিন্তু বেশি দেইনি। আলমারি তো তুই নিজেই এলোমেলো করেছিলি, আমি শুধু নতুন করে সাজাতে বলেছি।”
সারা চোখ তুলে তাকায়—
রাগ দেখিয়ে হাতের মুঠোয় ধরা স্যুট টা একটু জোরে ভাঁজ করে রাখে।
:-একটা মানুষের এই এত্ত জামা কাপড় কীভাবে থাকে আলমারিতে? মনে হচ্ছে পুরো বসুন্ধরা সিটি শপিং মল এই এক আলমারির মধ্যে।
তৈমুর এবার হাসতে হাসতে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।
সে এসে বিছানায় আরাম করে বসে বলে,,,,
:-তুই আমাকে কি বললি যেন একটু আগে? আমি রাক্ষস?আমি রাক্ষস হলে তুই এতক্ষণ আস্তো থাকতিস? খেয়ে ফেলতাম না তোকে?
সারা একটু থেমে তাকিয়ে থাকে তৈমুরের চোখের দিকে। তারপর হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে আবার জামা গুছাতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
তৈমুর ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। সারার হাতে থাকা শার্ট টা নিয়ে রেখে দিলো পাশে। হাত ঘুরিয়ে টান দিতেই সারার পিঠ গিয়ে ঠেকলো তৈমুরের চওড়া বুকে। সারাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দেয় তৈমুর। গলায় মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে বলে,,,
:-রেখে দে। আর গোছাতে হবে না।
থরথর করে কেঁপে ওঠে সারা। উদরে বিদ্যামান তৈমুরের হাত খানা শক্ত করে চেপে ধরলো সারা। ঢোঁক গিলে অস্ফুট স্বরে বলল,,
:-কি করছেন,,,!
:–শশশ!! এখনো তো কিছু করলামই না। হিসেবমতো কিন্তু আজ আমাদের বাসর রাত সারা। আয় বাসরটা তাহলে করে ফেলি!! এমনিতেও চৌদ্দ বছর অপেক্ষা করেছি!! আর অপেক্ষা করতে পারবো না।
:-দে… দেখুন আপনি কিন্তু,,
:-হুমমম দেখবো তো। একদম থ্রিডি এঙ্গেলে দেখবো জান।
রুমে বাতিটা মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। সারা লজ্জায় মুখ নামিয়ে হাতের আঙ্গুলে ওড়নার ভাঁজ টেনে ধরছে বারবার, কিন্তু হাত কাঁপছে।
তৈমুর ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
তারপর নিচু গলায় বলে,,,,
:-সারা… আজকের এই রাত শুধু আমাদের… এত বছর যাকে কেবল দূর থেকে ভালোবেসেছি, আজ তাকে আমি বিনা বাঁধায় ছুঁতে পারি… আল্লাহ্ সাক্ষী থাক, আমি একটুও তাড়াহুড়া করবো না, কিন্তু আজ তোকে আমার চাই… একান্ত করে… আত্মা ছুঁয়ে।” সারার কপালে কপাল ঠেকিয়ে তৃষ্ণার্ত পীড়িত কন্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে তৈমুর,,,
:-প্লিজ! জান না করিস না। মরে যাবো আমি।
সারা চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় তৈমুরের আগুন জ্বলা চোখে বৈধ আকাঙ্ক্ষা—কিন্তু ঠোঁটে নরমতা।
সারার ঠোঁট কাঁপে, বলতেও পারে না কিছু… মাথা নিচু করে ফেলে।
তৈমুর ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে—
:-ভয় পাস না… আমি তোকে ভাঙবো না, গলিয়ে নিবো… ধীরে ধীরে, ভালোবেসে।”
সারার চোখ দুটো বুজে আসে। শরীর কাঁপে এক অজানা অনুভূতিতে। সে জানে, আজ থেকে কিছুই আগের মতো থাকবে না। একটা বাঁধন আজ সম্পূর্ণ হতে যাচ্ছে—ভেতর থেকে, শরীর থেকে, আত্মা থেকে।
সারা নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,,,
:- আমি প্রস্তুত…!
আসন্ন পরিস্থিতি বুঝে ভয় আর নতুনত্বের অনুভূতিতে থরথর করে কাঁপছে সারা। তবে তৈমুর কে আর বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলো না। দুর্বল হাতে আঁকড়ে ধরলো তৈমুরের প্রসস্থ পিঠ।
সারার সম্মতি বুঝতেই আরো অস্থির হয়ে উঠলো তৈমুর।
:-I love you, Jaan…
বলেই সারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরলো। দুহাতে সারার লতানো কোমর জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।
অধরের অবস্থান জারি রেখেই সারাকে নিয়ে বিছানায় ঠেলে দিলো তৈমুর।
চলবে,,,,,,,